২৩ মার্চ, ২০১২

Nimrod: নমরুদের খোদাদ্রোহীতা ও ঐশ্বরিক প্রতিক্রিয়া।

বাইবেলের বুকস অব জেনেসিস ও বুকস অব ক্রোনিকেলস অনুসারে নমরুদ ছিলেন কুশের পুত্র, হামের পৌত্র এবং নূহের প্রপৌত্র। নমরুদ নামটি এসেছে নমর ও উদ, বা, নমরা ও উদু শব্দ দু’টি থেকে যার অর্থ- জাজ্জ্বল্যমান আলো। অবশ্য কারো কারো মতে এ নামের অর্থ বিদ্রোহী, খোদার বিরুদ্ধে দ্রোহীতার কারণে তাকে এ নামে সম্বোধণ করা হত। 

আরবীয় ঐতিহাসিকগণও নমরুদকে চরম স্বেচ্ছাচারী (আল-জব্বার) হিসেবে বিবেচনা করে।এই স্বেচ্ছাচারী মানুষটির শক্তি, ক্ষমতা ও দম্ভের প্রকাশ গগণ ছুঁয়েছিল। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হবার মানসে স্বর্গরাজ্যের প্রভুকে পরাভূত ও তাঁকে স্বর্গ থেকে বিতাড়নে এক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে নেমেছিলেন। এই আর্টিকেলে আমরা দেখব ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে তার ঐ প্রতিদ্বন্দ্বীতার ধরণ কেমন ছিল এবং তা কি ফল বয়ে নিয়ে এসেছিল।

ইহুদি ধর্মপুস্তকগুলো নমরুদকে উপস্থাপন করেছে- “ধরার বুকে মহাক্ষমতাশালী মানব ও পরাক্রমী এক শিকারী হিসেবে।” শিকারে তার এই মহাসাফল্যের কারণ ছিল চামড়ার তৈরী অাদমের সেই কোট। শয়তানের প্ররোচনায় গন্ধম ফল ভক্ষণের ফলে আদম-হাওয়া যখন উলঙ্গ হয়ে পড়েন, তখন খোদা তাদের জন্যে এই কোট তৈরী করে দিয়েছিলেন।-(জেনেসিস ৩:২১) এই কোট বংশ পরস্পরায় নূহ এবং নূহ থেকে হাম-কুশ হয়ে নমরুদের হাতে পৌঁছে। নানা রঙে রঙিন এই কোটে কিছু চিহ্ন খোঁদিত ছিল। যখনই কোন পশু খোঁদিত ঐ চিহ্ন দেখতে পেত, তখনই সে গুড়ি মেরে নত হয়ে যেত। ফলে ঐ সব পশু শিকারে নমরুদকে কোন বেগ পেতে হত না। -[আর. এল  পিরকে, ২৪; বুক অব জাসের ১সি] নমরুদ খোদার প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন। শিকারে পাওয়া পশুগুলো তিনি খোদার তরে উৎসর্গ করতেন।

নমরুদ কিভাবে নৃপতি বনে গেলেন সে সম্পর্কে নানান কাহিনী রয়েছে। কারো কারো মতে শিকারে তার পারদর্শীতার ক্ষমতাকে লোকেরা আলৌকিক বলে ভাবত। আর এ কারণেই তারা তাকে তাদের নরপতি বানিয়ে নেয়। অন্য কাহিনী মতে, নমরুদের বয়স যখন ১৮ বৎসর তখন তার গোত্র হেমিটিকদের সাথে জাফেটিকদের বিরোধ বাঁধে। অত:পর যুদ্ধের শুরু হলে, জাফেটিকদের বিজয়ের লক্ষণ দেখা দেয়, কিন্তু, নমরুদ কুশাইটদের ক্ষুদ্র এক বাহিনী নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করে তাদের উভয়কে পরাজিত করেন। এই বিজয়ের পর তিনি সকল মানুষের নৃপতি বনে যান।শিনার ভূ-খন্ডের বাবিল, উরুক, আক্কাড ও কালনেহ এবং শিনারের বাইরে অশুর, নিনেভ, রজেন, কালাহ এবং রিহোবৎ নিয়ে তার সাম্রাজ্য গঠিত হয়।

নূহের মৃত্যুর পরের বছর নমরুদ রাজার রাজা [কিং অব কিংস] উপাধিতে ভূষিত হন। মিসরে ৪২টি রাজ্যের রাজ্যপতিদের এক সম্মেলনে তিনি এই উপাধি লাভ করেন। খ্যাতির এই শিখরে পৌঁছে তার মনোভাবে পরিবর্তন আসে। তিনি ঘোর পৌত্তলিক বনে যান এবং দেবমূর্ত্তি নির্মাতা আজরকে (তেরাহ)-কে তার মন্ত্রী নিয়োগ করেন। অাজর এ সময় চ্যালডীয়ার কুটা বা উরে বসবাস করতেন।পরে তিনি নিজেকে দেবতাদের দেবতা ঘোষণা দেন, তখন প্রজারা উপাস্যরূপে তার পূজা ও অর্চণা শুরু করে।

ইব্রাহিমের জন্মগ্রহণ উপলক্ষে আজর তার কিছু বন্ধু-বান্ধব বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করেন। নিমন্ত্রিত ঐসব অতিথিদের মধ্যে ‍নমরুদের বেশকিছু উপদেষ্টা ও গণক ছিলেন। মধ্যরাতে সব অতিথি যখন ভোজন-পান শেষে গৃহত্যাগ করেন, তখন নমরুদের ঐ উপদেষ্টা দল উর্দ্ধদিকে তাকিয়ে দেখতে পান, পূর্বদিক থেকে একটা নক্ষত্র ছুটে এসে আকাশের চারদিকের [উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের] চারটি বড়বড় নক্ষত্রকে একে একে গিলে ফেলল। তখন তারা এই ঘটনার বিষয়টি গণনা করে জানতে পারেন, “ধরায় এক শিশুর আগমণের কথা যার নিয়তি নির্ধারিত এ জগৎ ও পরজগৎ জয়কারী হিসেবে।” অবিলম্বে তারা নমরুদকে বিষয়টি জানিয়ে দিলেন।
নমরুদ বলেন, “এ শিশু কি জন্মগ্রহণ করেছে?” 
তারা বললেন “সুনিশ্চিত।” 
নমরুদ বলেন, “কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে?” 
তারা বললেন “আজরের গৃহে।” 
নমরুদ বিষ্মিত হয়ে বলে উঠলেন, “আমার বিশ্বস্ত এক কর্মচারী গৃহে?”

আজর দেবমূর্ত্তি নির্মাতা ছিলেন, ফলে সমাজে তার সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। এ কারণে উপদেষ্টাগণ নমরুদকে পরামর্শ দিলেন তাকে না চটিয়ে অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে শিশুটিকে হস্তগত করতে, এমন পরিমান সম্পদ যা উপেক্ষা করা আজরের পক্ষে সম্ভব হবে না। তখন তাদের পরামর্শ মত আজরকে ডেকে নমরুদ ঐ প্রস্তাব দিলেন। তখন আজর বলল, “এ তো তেমনি এক প্রস্তাব যা এক ব্যক্তি এক গাধাকে দিয়েছিল। ঐ ব্যক্তি তার গাধাকে বলেছিল, “আমি তোমাকে গোলাভর্ত্তি যব দেব, যদি তুমি আমাকে তোমার মাথাটা কেটে ফেলার অনুমতি দাও।”

উত্তরে ঐ গাধা বলেছিল, “মাথা যদি আমার কেটেই ফেল তবে ঐ গোলাভর্ত্তি যব আমার কি কাজে লাগবে?” -এভাবে প্রকারন্তে আজর নমরুদকে বোঝাতে চাইলেন যে, ঘর ভর্ত্তি সম্পদ কি কাজে আসবে যদি তা ভোগ করার জন্যে উত্তরাধিকারীরাই না থাকে।

গল্প শুনে নমরুদের মুখ রাগে লাল হয়ে যায়। এ দেখে তেরাহ তাড়াতাড়ি বলেন, “আমি এবং আমার সব সন্তানই তো আপনার অধীন। সুতরাং কোন বিনিময়ের আবশ্যকতা নেই। আমাকে তিনদিন সময় প্রদান করেন, যাতে করে আমি আমার পরিবারকে এ বিষয়ে সম্মত করাতে পারি।”
নমরুদ তার দাবী মেনে নেন এবং বলেন, “তবে যথাসময়ে যদি তুমি তোমার সন্তান হস্তান্তরে ব্যর্থ হও, মনেরেখ তোমার গৃহে একটি কুকুরও জীবিত থাকবে না।”

গৃহে ফিরে আজর এক দাসীসহ ইব্রাহিম ও তার মাতাকে এক গুহায় লুকিয়ে ফেলেন এবং সদ্য জন্ম নেয়া অপর এক দাসীর সন্তানকে নমরুদের হাতে তুলে দেন। নমরুদ ঐ শিশুকে তখনি হত্যা করে ফেলেন।-[বুক অব জাসের-৮:১-৩৬]

ইব্রাহিম দশ বৎসর লোক চক্ষুর অন্তরালে গুহায় বসবাস করে। অত:পর নমরুদ যখন তার বিষয়ে সম্পূর্ণ বিম্মৃত হন তখন পিতা আজর তাকে বাড়ীতে নিয়ে আসেন। সম্ভবত: নির্জনে বসবাস করার কারণে ইব্রাহিম বাল্যকালেই গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছিল প্রকৃতি এবং তার স্রষ্টাকে নিয়ে। আর তাই পিতাকে নিজ হাতে তৈরী মূর্ত্তিকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করতে দেখে তার মনে জন্ম নেয় সন্দেহ আর অবিশ্বাস। অবশেষে সে চিনতে পারে স্রষ্টাকে। আর তাই নির্মিত দেব-দেবীর অসারত্ব তার গোত্রের লোকদেরকে দেখিয়ে দিতে সে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় একটি বাদে মন্দিরের সব দেবতা। 

লোকেরা ইব্রাহিমকে বন্দী করে নমরুদের রাজদরবারে হাজির করল এবং এ অভিযোগ করল যে, ইব্রাহিম তাদের সকল দেবতাদেরকে অসার জ্ঞান করে, সে বলেছে, ফেরাউন নয়, তার উপাস্য কেবল তার প্রতিপালক, খোদা। এতে অবাক হয়ে ফেরাউন জিজ্ঞেস করেন, "হে ইব্রাহিম, কে তোমার প্রতিপালক?"
ইব্রাহিম বললেন- "যিনি এক- যার কোন শরীক নেই, যিনি আরশের অধিপতি।"
নমরুদ বললেন, “তোমার সেই আরশের অধিপতিটাই বা কে?"
ইব্রাহিম বললেন, "তিনি, যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান।"

এসময় নমরুদ দু’জন বন্দীকে দরবারে হাজির করতে নির্দেশ দিলেন। এই বন্দীদ্বয় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ছিল। তাদেরকে দরবারে হাজির করা হলে, তিনি একজনকে মুক্তি দিলেন এবং অপরজনকে হত্যা করার আদেশ দিলেন। তারপর বললেন, "ও ইব্রাহিম! এভাবে আমিও জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি।"
ইব্রাহিম বললেন, "নিশ্চয় তিনি সূর্য্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে, এবার আপনি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখান।"
এ প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে নমরুদ রেগে গেলেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ওকে পুড়িয়ে ফেল; সাহায্য কর তোমাদের দেবতাদেরকে, যদি একান্তই কিছু করতে চাও।” আর তিনি ইব্রাহিমকে বললেন, "হে ইব্রাহিম! দুনিয়ার রাজত্ব তো আমার। শীঘ্রই আকাশের রাজত্বও আমি তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেব।"

ইব্রাহিম বললেন, “পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের জন্যে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমা গুলোকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছ, কিন্তু শেষবিচারের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে ও অভিশাপ দেবে। তোমরা বাস করবে জাহান্নামে আর তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।”
নমরুদ তার লোকদেরকে বললেন, “এরজন্যে এক অগ্নিকুন্ড তৈরী কর; আর একে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দাও। আর পাহারা দিতে থাক, তার যেন কোন সাহায্যকারী না থাকে।”

লোকেরা স্বেচ্ছাশ্রমে লাকড়ি যোগাড় করল এবং সেগুলি এক জায়গায় জড় করে তৈল ও ঘি ঢেলে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হল। সাত দিন আগুনে তা দিয়ে পূর্ণ অগ্নিকুন্ড তৈরী করার পর তারা সমস্যায় পড়ল ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করা নিয়ে। কেননা তীব্র তাপের জন্যে আগুনের ধারে কাছে পৌঁছান কারও পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এসময় সেখানে উপস্থিত হয় স্বয়ং ইবলিস, নজদের এক পর্যটকের বেশে। সে এ্রই মহতী উদ্যোগকে সফল করতে জনগণকে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছিল। তার পরামর্শে একটা চড়ক গাছ তৈরী করা হয়। আর তাতে ঝুলিয়ে ইব্রাহিমকে অগ্রিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ইবলিসের এই উপস্থিতি জানা যায় ইয়াজিদি ধর্মগ্রন্থ “কিতেবা চিলওয়া” থেকে- “অামি উপস্থিত ছিলাম যখন আদম স্বর্গে বাস করত এবং আমি উপস্থিত ছিলাম যখন নমরুদ ইব্রাহিমকে অগ্রিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিলI” 

কথিত আছে, চড়ক গাছ তৈরী করা হলেও তার সাহায্যে ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, ফেরেস্তা জিব্রাইল চড়ক ঘোরাতে বাঁধা সৃষ্টি করছিল। তখন ইবলিসের পরামর্শে ঐ চড়ক ঘিরে নগ্ন নারী নৃত্যের আয়োজন করা হয়। এতে জিব্রাইল সেখান থেকে সরে গেলে ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়।

আর যখন ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, তখন তিনি খোদাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “তুমি ব্যতিত অন্য কোন খোদা নেই। তুমি সর্বোচ্চ, মহান। সকল প্রশংসা এবং গৌরব কেবল তোমারই!” 

ইব্রাহিম আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার সাথে সাথে জিব্রাইল তার সামনে হাজির হয়ে বলল, “তুমি কি আমার সাহায্য চাও?” আগুন ইতিমধ্যে ইব্রাহিমের পরিধেয় বস্ত্র পুড়িয়ে ফেলেছে।
ইব্রাহিম বললেন, “অামার দরকার কেবল আল্লার সাহায্য।”
উচ্ছাসিত হয়ে জিব্রাইল বলল, “তবে তাঁর কাছে প্রার্থনা কর, যেন তিনি তোমাকে রক্ষা করেন।”
“তিনি আমার অবস্থা পুরোপুরি অবহিত আছেন।” ইব্রাহিম উত্তর দিলেন।

"Not wondering, though in grief, to find
The martyr's foe still to keep his mind:
But fixed to hold Love's banner fast,
And by submission win at last."-[Keble].

তখন আল্লাহ বলেন, “হে অগ্নি, তুমি ইব্রাহিমের জন্যে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।”-(৩৭:৯৭)

ইব্রাহিম চল্লিশ দিন ঐ অগ্নিকুন্ডে ছিলেন। এই দীর্ঘসময় ধরে লোকেরা পালাক্রমে ঐ অগ্নিকুন্ড পাহারা দিয়েছিল। অবশ্য শেষদিকে পাহারা যথেষ্ট শিথিল হয়েছিল, কেননা, তারা ভেবেছিল সে আর বেঁচে নেই। 

অতঃপর লোকেরা আবিস্কার করল ইব্রাহিম জীবিত অগ্নিকুন্ড থেকে বেরিয়ে এসেছে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ্য, আগুন তার কোন ক্ষতি করেনি। পাহারাদাররা বিষয়টি ফেরাউনকে অবহিত করল না দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে। অন্যদিকে ইব্রাহিমের সম্প্রদায়ও এতটাই হতবাক হয়ে পড়েছিল যে, তারাও ভুলে গেল বিষয়টি ফেরাউনের গোচরীভূত করতে। কিন্তু ফেরাউন বিষয়টি জেনে গেলেন স্বপ্নের মাধ্যমে।

এক রাতে নমরুদ স্বপ্ন দেখলেন যে, “অগ্নিকুন্ড থেকে খোলা তরবারী হাতে এক লোক বেরিয়ে এল। তারপর সে তাকে দেখতে পাওয়া মাত্র তার দিকে দ্রুত দৌঁড়ে আসতে লাগল। এ দেখে তিনি দৌঁড় লাগালেন। তখন ঐ ব্যক্তি একটা ডিম ছুঁড়ে মারল তার দিকে। ঐ ডিম মাটিতে পড়ে ভাঙ্গা মাত্র তা রূপান্তরিত হয়ে গেল বিশাল এক নদীতে। আর সেই নদীতে তার সকল সৈন্য-সামন্ত ডুবে গেল, কেবল বেঁচে গেলেন তিনি ও তার তিনজন সঙ্গী। তারপর ঐ নদী পুন:রায় ডিমে পরিণত হল এবং পরে তা থেকে বেরিয়ে এল ছোট এক পেঁচা যা তার দিকে উড়ে এসে ঠুঁকরে তার দু’চোখ তুলে ফেলল।” 

গণকেরা এই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় ভবিষ্যৎবাণী করল যে, ইব্রাহিমের হাতে নমরুদের পরাজয় ঘটবে। এতে নমরুদ গোপনে তাকে হত্যার জন্যে লোক পাঠান। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার, ইতিমধ্যে ইব্রাহিম উর ত্যাগ করেছেন খোদার নির্দেশে।

ইব্রাহিমকে না পেয়ে রেগে গিয়ে ফেরাউন তার উপাস্য আরশের অধিপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কিন্তু কিভাবে তিনি আকাশে পৌঁছিবেন? উপায় খুঁজে পেতে মন্ত্রণা পরিষদকে আহবান করলেন তিনি। তারা বলল, “স্বর্গ অনেক উঁচুতে হওয়ায় এ ধরণের যাত্রার আয়োজন করা বেশ কঠিন হবে।” 

এসময় পরিষদবর্গের একজন পরামর্শ দিল সূউচ্চ এক টাওয়ার নির্মাণের, যেন তার চূঁড়া থেকে স্বর্গে লুকিয়ে থাকা ইব্রাহিমের খোদাকে সহজেই ধরাশায়ী করা যায়। নমরুদ প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং এভাবে নূহের বন্যার ২০১ বৎসর পর টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু হল। 

নির্মাণ কাজের উদ্বোধনীতে নমরুদ এক জ্বালাময়ী ভাষণে আকাশ মালিকের অন্যায় ও অবিচারের কথা জনতার সামনে তুলে ধরলেন। তিনি নূহের বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে বলেন, “এখানে বন্যা আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকবে, আর তিনি উপাদেয় স্বর্গভোজ সাবাড়েরত থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখবেন, এমনটা হতে পারে না।... আর তাই”, তিনি বলে চলেন, “তাঁর কোন অধিকার নেই নিজের জন্য উর্দ্ধজগৎটা বেঁছে নেয়া এবং নিম্ন জগৎটা আমাদের জন্যে রেখে দেয়া। সুতরাং আমরা একটা টাওয়ার নির্মাণ করব।” -[জেনেসিস, ৩৪-৭; বুবের, নূহ, ২৪] 

এই টাওয়ারের নির্মাণের কাজে কোনরূপ অবহেলা সহ্য করা হয়নি। যারা পরামর্শক ছিলেন, তারা প্রয়োজনীয় ইট তৈরীর কাজে যথেষ্ট সংখ্যক নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ করেন। আর কর্মাধ্যক্ষগণ কঠোরতার সাথে তাদেরকে পরিচালিত করে। কথিত আছে- ইট তৈরীর কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের সন্তান প্রসবের জন্যেও এমনকি কোন সময় মঞ্জুর করা হয়নি। একজন স্ত্রীলোক কর্মরত অবস্থায় সন্তান প্রসব করে এবং নবজাতককে কাপড়ে জড়িয়ে নিয়েই তাকে কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। -(৩ বারুখ).

বুক অব জুবিলি জানায়- And they began to build and in the fourth week they made brick with fire, and the bricks served them for stone, and the clay with which they cemented them together was asphalt which comes out of the sea, and out of the fountains of water in the land of Shinar. And they built it: forty and three years were they building it; its breadth was 203 bricks, and the height [of a brick] was the third of one; its height amounted to 5433 cubits and 2 palms (8,150 ft), and [the extent of one wall was] thirteen stades [and of the other thirty stades]. -[জুবিলী ১০:২০-২১]

দীর্ঘ দিনে (৪৩ বৎসরে) হাজার হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে টাওয়ার অব বাবেল নির্মিত হয়। এই টাওয়ার সম্পর্কে বাইবেলে আছে- “...এবং এমন এক টাওয়ার যার চূঁড়া যেন স্বর্গে গিয়ে ঠেকেছিল....”. -[জেনেসিস ১১:৪] তখন খোদা বললেন, “আমি নমরুদকে ক্ষমতার শিখরে তুলে দিলাম, আর সে এক টাওযার বানিয়ে নিল, যাতে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।”- [হুল. ৮৯বি]

টাওয়ার নির্মিত হয়ে গেলে নমরুদ অত:পর তার চূঁড়ায় আরোহণের প্রস্তুতি নিলেন। আর যখন তিনি চূড়ায় উঠলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল একদল লোক, যাদের কেউ কেউ সাথে করে তুরপুন জাতীয় যন্ত্রপাতি এনেছিল স্বর্গ প্রাচীর ভেদ করার মানসে। কেননা, তাদের তো আর জানা ছিল না স্বর্গ কিসের তৈরী- পাথরের, লৌহের না তামার। -[৩ বারুখ, ৩:৭]

এদিকে নমরুদ টাওয়ারের চূঁড়ায় পৌঁছে খুবই ক্ষুন্ন হলেন। তার এই মন:ক্ষুন্নের কারণ এটা দেখে যে, স্বর্গ তখনও তার থেকে তেমনি দূরে রয়েছে যেমন সেটা ছিল তার ভূমিতে থাকাকালীন অবস্থায়। যাহোক, প্রতিপক্ষকে তার উপস্থিতি জানান দিতে তিনি কর্মচারীদেরকে তার মূর্ত্তি টাওয়ারের চূঁড়ায় স্থাপন করতে নির্দেশ দিলেন। তখন তারা নাঙ্গা তলোয়ার হাতে তার এক মূর্ত্তি সেখানে স্থাপন করল যাকে দেখলে যেন মনে হয় স্বর্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করছে সে।


টাওয়ার অব বাবেল
পরদিন নমরুদ আরো বেশী মন:ক্ষুন্ন হলেন যখন টাওয়ার ধ্বসে পড়ল এমন শব্দে যাতে লোকেরা ভয়ে মূর্চ্ছা গেল। আর তারপর তাদের যারা বেঁচে গেল, তারা তাদের বাক ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলল, যা বাইবেলে বর্ণনা করা হয়েছে ভাষার বিভ্রান্তি হিসেবে।

এই টাওয়ার ধ্বসে নমরুদের নিজ সন্তানসহ বহু মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটে তথাপি নমরুদের স্বর্গ জয়ের আকাংখা থেমে থাকেনি। তিনি বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। এ সময় তার পরিষদবর্গের একজন অদ্ভূত এক পরামর্শ দিল। তাদের পরামর্শে চারটি বৃহৎ শকুনকে লালন-পালন করা হল। অতঃপর একটি সিন্দুক তৈরী করে শকুন চারটিকে কয়েক দিন অভুক্ত রেখে ঐ সিন্দুকের চার কোনায় বেঁধে দেয়া হল। তারপর সিন্দুকের উপর দিকে শকুনের নাগালের বাইরে কিন্তু দৃষ্টির সীমানায় ঝুলিয়ে দেয়া হল মাংসের টুকরো।

নমরুদ ও তার সেনাপতি প্রস্তুত হয়ে সিন্দুকে আরোহণ করলেন। তারপর শকুনেরা মাংসের টুকরো খেতে চাইল, আর তাদেরকে নিয়ে সিন্দুকসহ উর্দ্ধপানে উড়ে চলল। সিন্ধুকের উপর এবং নীচের দিকে দু’টি গবাক্ষ ছিল। আর সেনাপতি পালাক্রমে ঐ গবাক্ষ দু’টি উন্মুক্ত করে উভয়দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখে নিতে লাগল যে, তারা ঠিকঠাক মত স্বর্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কি-না। 

উর্দ্ধ আকাশে পৌঁছে অর্থাৎ যেখান থেকে অাকাশ বা পৃথিবীর, কিছুই আর দৃষ্টি গোচর হল না, নমরুদ প্রস্তুতি নিলেন তীর নিক্ষেপ করার। তারপর তারা একের পর এক তীর উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। ঐ সময় আল্লাহ জিব্রাইলকে বলেন, "আমার এই বান্দা যেন নিরাশ না হয়।" এতে সে তীরের মাথায় রক্ত লাগিয়ে তা ফেরৎ পাঠাল, যাতে নমরুদ বুঝতে পারেন, তিনি ইব্রাহিমের খোদাকে ধরাশায়ী করতে সমর্থ্য হয়েছেন। 

কথিত আছে, জিব্রাইল তীরের অগ্রভাগ রক্ত রঞ্জিত করতে পশু, পাখী ও জলজ জীবের কাছে রক্ত চেয়েছিল। কিন্তু কেউই তাদের নিজের রক্ত দিতে সম্মত হয়নি "বেলে মাছ” ছাড়া। তাই বেলে মাছের শরীরে কোন রক্ত নেই। অার তাই বুক অব চামিস জানিয়েছে- “নমরুদের তীরের মাথায় যে রক্ত দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, জ্ঞানী লোকেরা একমত ছিলেন না কোত্থেকে তা এল: অনেকে যুক্তি দিয়েছিল, সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প সাথে মেঘ তা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর ঐ রক্তের সম্মানে তারা যুক্তি দেখান, কেন মাছ জবেহ [খোদার নামে] করার দরকার হয় না।” 

এদিকে সকল তীর নিক্ষেপ শেষে নমরুদ পৃথিবী পৃষ্ঠে ফিরে আসতে চাইল। সেজন্যে শকুন গুলিকে নিম্নগতি করার লক্ষ্যে সিন্দুকের উপরের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া মাংস একই ভাবে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া হল। অবতরণের সময় সিন্দুক প্রচন্ড শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ে গুড়িয়ে যায়। নমরুদ নিজে অবশ্য এই পতনে কোনরূপ আঘাত প্রাপ্ত হননি।

মাটিতে অবতরণের পর নমরুদের রক্ষীরা নিক্ষিপ্ত তীরগুলি কুড়িয়ে নিয়ে এল। আর যেগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার সবগুলোই ছিল রক্তরঞ্জিত। নমরুদ রক্তমাখা তীরগুলি দেখে সফলতার আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলেন, “নিশ্চয়ই আমরা ইব্রাহিমের খোদা এবং স্বর্গের সব বাসিন্দাদেরকে হত্যা করতে সমর্থ্য হয়েছি, তীরে লেগে থাকা রক্তই তার সাক্ষ্য বহন করে।”

এ বিষয়ে ইহুদি রাব্বানিক সাহিত্য জানিয়েছে- “নমরুদ স্বর্গ তছনছ করতে পাখি চালিত এক বাহনে চড়ে নিজে তীর নিক্ষেপ করেছিল।” আর বুক অব জাসের জানায়- “..তারা আসমানের দিকে তীর ছুঁড়ল এবং সকল তীর রক্ত মাখা অবস্থায় ফিরে এল ভূমিতে, তারপর তারা যখন সেগুলো খুঁজে পেল, তারা একে অপরকে বলল, “নিশ্চয় আমরা আসমানবাসীদের সকলকে হত্যা করেছি।”. -[জাসের, ৯:২৯] “..তারা ভেবেছিল তারা খোদাকে হত্যা করে ফেলেছে।” -[জাসের, ৯:৩০]

নমরুদ নিজে কেবল খোদাদ্রোহী ছিল না, সে তার প্রজাদেরকেও গোমরাহীতে নিমজ্জিত করেছিল। আর তাই খোদা ইব্রাহিমকে বললেন, “ইব্রাহিম! নমরুদকে সতর্ক কর তার উপর শাস্তি আসার আগেই।"

সুতরাং ইব্রাহিম হাজির হলেন নমরুদের রাজদরবারে। তাকে দেখে উৎফুল্ল হলেন নমরূদ, বললেন, “ও ইব্রাহিম! আমরা তো ইতিমধ্যে তোমার খোদাকে হত্যা করতে সমর্থ্য হয়েছি।” তিনি তার সিংহাসনের পাশে রাখা একগুচ্ছ তীর থেকে একটা হাতে তুলে নিয়ে, আত্মগর্বে সেটিকে পরখ করতে করতে বললেন, “এই তীরে লেগে থাকা রক্তই তার সাক্ষ্য বহন করে।”
ইব্রাহিম বলেন, “আমার স্রষ্টা চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী।”
তখন নমরুদ বলেন, “তিনি যদি মারা গিয়ে না থাকেন, তবে তাঁর সৈন্যদলকে একত্রিত করতে বল। আমিও আমার সৈন্যদল ময়দানে সমবেত করছি।”

ইব্রাহিম তাকে বলেছিলেন, “আল্লাকে ভয় করেন, তিনিই তো আপনাকে রাজ্য ও রাজত্ব দান করেছেন। আর তিনিই পরজগতের প্রতিফল দাতা।” কিন্তু ফেরাউন তার কথায় কান না দিয়ে উল্টো খোদার দিকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, বললেন, “দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি কেবল আমি, সুতরাং তোমার রবকে তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ময়দানে হাজির হতে বল।” আর তিনি তিন দিনের সময়ও বেঁধে দিলেন। 

নির্দিষ্ট দিনে নমরুদ তার সেনাবাহিনী ময়দানে সমবেত করলেন। তিন দিনের ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ময়দানে নমরুদ তার সেনাবাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছেন কিন্তু প্রতিপক্ষের কোন দেখা নেই। ইব্রাহিমকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হয়ে তাকে ডেকে বললেন, "ওহে ইব্রাহিম! তোমার প্রতিপালকের সেনাদল কোথায়? তিনি নিশ্চয় আমার শক্তিবল দেখে ভীত হয়ে পশ্চাৎপসারণ করেছেন।"

ইব্রাহিম বললেন, "আমার রব ক্ষমতায় মহান, কোনরূপ ভীতি তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, বরং তিনিই তা প্রদর্শণ করে থাকেন। একথা নিশ্চিত যে তার সেনাদল ময়দানে এসে পৌঁছিবেই-আর তা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই।"
নমরুদ তার সেনাপতিদেরকে বললেন, "যুদ্ধ পতাকা উড়িয়ে দাও, সতর্ক হও, নাকাড়া বাজাও।"

সৈন্যদলের সম্মিলিত শোরগোলে ভূমি প্রকম্পিত হল। ফেরাউন পুনঃরায় ইব্রাহিমকে বললেন, "কোথায় তোমার রবের সৈন্যদল?"
ইব্রাহিম দূরে আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। দূরে কাল রঙের একটা মেঘ দেখা যাচ্ছে। যখন সেটা কাছে, মাথার উপর চলে এল, লক্ষ লক্ষ মশার গুণ গুণ কলতানে চারিদিক মুখরিত হল। 

মশা! 
মশা! ক্ষুদ্র এ প্রাণীটি সন্ত্রাসী, বেপরোয়া। রক্তের নেশায় জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা আক্রমণ করে মানুষ, পশুকে। আর এ মশা তো আল্লাহ প্রেরিত, যুদ্ধের নিমিত্ত। কিন্তু ফেরাউন এদের ব্যক্তিত্বকে খাটো করে দেখলেন। অবজ্ঞার সূরে বললেন, "এ তো মশা! তুচ্ছ এক প্রাণী, তার উপর নিরস্ত্র। তোমার রবের কি অস্ত্র-ভান্ডার বা মালখানা নেই?"

এখানে বলে রাখা ভাল- অনেকের মতে এগুলো মশা ছিল না, ছিল মশার আকৃতির, আকারে আরও ক্ষুদ্র, মাংসাশী এক ধরণের মশা।

ইব্রাহিম বললেন, "আমার রবের সেনাবাহিনী সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই। আপনার এই সেনাবাহিনীর জন্যে তিনি এই তুচ্ছ, নিরস্ত্র মশাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। আর নিরস্ত্র হলেও এরা তাদের যুদ্ধ কৌশল জানে। এখন আপনি শুধু এই বাহিনীর মোকাবেলা করে আপনার শক্তি, সামর্থ্য ও মেধার পরিচয় দিন।"

Gnat
এদিকে এই মশা বাহিনীর সঙ্গে কিরূপে যুদ্ধ করতে হবে তা ভেবে পাচ্ছিল না নমরুদের সেনারা। এত ক্ষুদ্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের পূর্ব কোন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বা ট্রেনিং- কোনটাই নেই। সুতরাং তারা হতভম্ভ হয়ে আদেশের অপেক্ষায় সাঁরিবদ্ধ ভাবে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। 

এই অবসরে প্রতিটি সৈন্যের মাথার উপর একটি করে মশা অবস্থান নিল। অতঃপর কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তারা তাদের নাসিকা পথে মস্তিস্কে প্রবেশ করল। তারপর দংশন। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল। হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য হয়ে তীরন্দাজগণ উর্ধ্বে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। আর পদাতিক সেনারা নিজেদের চতুষ্পার্শ্বে অন্ধের মত তরবারী চালনা শুরু করল। এভাবে একে অপরকে নিজেদের অজান্তেই তারা আহত বা নিহত করে ফেলল।

নমরুদ পালিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসছিলেন। এসময় একটি দূর্বল মশা তাকে তাড়া করল। সে তার শিরোস্ত্রাণের চতুষ্পার্শ্বে কয়েকবার প্রদক্ষিণ শেষে, সুড়ুৎ করে নাসিকা পথে তার মস্তিস্কে ঢুকে পড়ল। তারপর ধীরে সুস্থ্যে মগজে দংশন শুরু করল। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন নমরুদ। উন্মাদের ন্যায় প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। এক সময় দিশেহারা হয়ে পাদুকা খুলে নিজের মাথায় আঘাত করতে শুরু করলেন তিনি। এতে মশা দংশনে বিরত রইল। তিনি একটু আরাম বোধ করলেন। কিন্তু আঘাত বন্ধ করতেই মশা পুন:রায় দংশন শুরু করল। অবশেষে তিনি তার মাথায় মৃদু আঘাত করার জন্যে একজন সার্বক্ষণিক কর্মচারী নিযুক্ত করলেন। সূদীর্ঘ ৪০ বৎসর তিনি ঐ দু:সহ যন্ত্রণা ভোগ করেন।

এটা অদ্ভূত ছিল যে, পাদুকা ব্যতিত অন্যকিছুর আঘাতে মশা দংশনে বিরত থাকত না। এসময়ই ইব্রাহিম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, "হে ফেরাউন! স্বীয় মস্তকে, স্বীয় পাদুকা দ্বারা আঘাতের জন্যে, স্বীয় অর্থেই গোলাম নিযুক্ত করে রাখা জঘণ্য। সুতরাং এখনও সময় আছে আল্লাকে সর্বশক্তিমান ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করে নিন। তাতে তিনি আপনার পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং আপনি এই কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পাবেন।"

নমরুদ মনে করতেন খোদাকে স্বীকার করে নিলে তার ক্ষমতা ও প্রভাব লুপ্ত হবে। তাই তিনি উত্তর দিলেন, "হে ইব্রাহিম! আমিই দুনিয়ার অধিশ্বর। অন্য কাউকে আমি স্বীকার করি না।" ইব্রাহিম বুঝতে পারলেন যাকে আল্লাহ পথ প্রদর্শণ করেননি, সে কখনও পথ খুঁজে পাবে না। তিনি হতাশ হয়ে ফিরে এলেন।

এ কারণেই তার সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে- নমরুদ শেষ পর্যন্ত অনুতপ্ত হোক বা না হোক, ইহুদি এবং ইসলামিক ট্রাডিশনে সে এক শয়তান ব্যক্তির, এক মূত্তিপূজার প্রবর্তকের ও এক স্বৈরাচারী শাসকের প্রতীক হয়ে আছে। রাব্বানিক সাহিত্যের সব জায়গায় তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে এভাবে "Nimrod the Evil".- [হিব্রু: נמרוד הרשע]

এদিকে নমরুদের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল। এক মুহুর্ত অবসর নেই। সামান্য বিরতিতেই তিরস্কার। একসময় তার মনে এমন বিরক্তি ও ক্রোধের সৃষ্টি হল যে, সে তার হস্তস্থিত পাদুকা দ্বারা সজোরে এক আঘাত হানে। ঐ আঘাতেই নমরুদের মৃত্যু হয়।

নমরুদের এই যুদ্ধ ও পরিণতি সম্পর্কে ইহুদি রাব্বানিক সাহিত্য (কিছু ভার্সন) জানায়- “নমরুদ তখন ইব্রাহিমের খোদাকে যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তি পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ দিলেন। তারপর যখন তিনি এক বিশাল সেনাদল নিয়ে ময়দানে হাজির হলেন, তখন খোদা তাদের বিরুদ্ধে এমন এক বাহিনী প্রেরণ করলেন, যেগুলো ছিল মশার চেয়ে ক্ষুদ্র এক প্রাণী। আর তারা নমরুদের বাহিনীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছিল। কিছু উৎস বলে, ঐ ক্ষুদ্র প্রাণীর একটা নমরুদের মস্তিস্কে প্রবেশ করে তাকে উন্মাদ করে দেয়।”

অন্যদিকে এ সম্পর্কে বুক অব চামিস জানায়- “বিশাল এলাকা জুড়ে নমরুদের সেনাবাহিনী ছাউনি ফেলে বিপক্ষদলের অপেক্ষায় রইল। তখন আল্লাহ জিব্রাইলকে ইব্রাহিমের কাছে একথা জিজ্ঞেস করতে পাঠালেন যে, তাকে উদ্ধারে কোন প্রাণী পাঠাবেন তিনি? ইব্রাহিম বেঁছে নিলেন মশা। তখন অাল্লাহ জিব্রাইলকে বললেন, “সত্যই, যদি সে মশা বেঁছে না নিত, তবে মশার একটা পাখার চেয়ে ৭০গুন ক্ষুদ্র এক প্রাণী তাকে সাহায্য করতে চলে আসত।”

যাহোক, মহান আল্লাহর সমন মশাদের রাজার কাছে পৌঁছে গেল। আর সে দুনিয়ার সব মশা নিয়ে নমরুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হল। তাপর তারা নমরুদের বাহিনীকে এমন হিংস্রভাবে আক্রমণ করল যে, অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ময়দানে মানুষের মাথার খুলি, হাঁড়-গোঁড়, তরবারী, বল্লম ও তীরে-ধনুক ব্যতিত অন্যকিছু দেখতে পাওয়া গেল না। কেননা সেগুলো তাদের শরীরের চামড়া, মাংস এমনকি মাথার মগজ পর্যন্ত চুষে খেয়ে ফেলেছিল।

নমরুদ পালিয়ে গিয়ে নিজেকে প্রাসাদের একটা পুরু দেয়াল ঘেরা কক্ষে আঁটকে ফেলেন। কিন্তু তার সাথে সেখানেও একটা মশা পৌঁছে গিয়েছিল। সাত দিন ঐ মশা তার মুখের চারপাশে ঘোরাফেরা করে, তবে নমরুদ কোনভাবেই তাকে ধরতে পারেননি। তারপর সেটি তার নাসিকা পথে প্রবেশ করে। নমরুদ যতই তাকে বাইরে বের করতে চেষ্টা করেন, সেটি ততই গভীরে প্রবেশ করে এবং একসময় মস্তিস্কে পৌঁছায়। তারপর সেটি তার মস্তিস্ক চুষে খেতে শুরু করে।

এসময় ব্যাথা প্রশমনে দেয়ালে মাথা ঠুকা ছাড়া নমরুদের আর কোন উপায় রইল না। পরে তিনি একজন কর্মচারীকে নিয়োগ করেন কাঠের এক হাতুড়ি দিয়ে মাথায় মৃদু আঘাত করার জন্যে। এদিকে মশা অবিরাম খেতে খেতে আকারে বৃদ্ধি পেতে লাগল। আর ৪র্থ দিনে সেটি তার মস্তিস্ক ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। ঐ মশা এসময় বৃদ্ধি পেতে পেতে একটা কবুতরের অাকারের হয়ে গিয়েছিল। তারপর সেটি উড়ে যেতে যেতে মরোন্মুখ নমরুদকে, যার তখন এমনকি তওবা করারও সমর্থ্য ছিল না, বলল, “এমনই খোদার কাজ যেমন তাঁর ইচ্ছে, তিনি তাঁর সৃষ্টির দূর্বলতম কোন প্রাণীকে অুনুমতি দেন ঐ ব্যক্তিকে ধ্বংস করতে যে, তাঁকে ও তাঁর রসূলে বিশ্বাস রাখে না।” 

সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।

# একজন প্রশ্ন করল, “আর্টিকেলের কোথাও কোথাও আপনি নমরুদকে ফেরাউন সম্বোধন করেছেন, কেন?”

@ আমি বললাম, “নূহের মৃত্যুর পরের বছর মিসরে ৪২টি রাজ্যের রাজ্যপতিদের এক সম্মেলনে নমরুদ রাজার রাজা [কিং অব কিংস] উপাধিতে ভূষিত হন। যে কক্ষে ঐ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেটিকে বলা হত ফেরাউন। আর ঐ সম্মেলনের পর ফেরাউন নামটা নমরুদের জন্য সম্মানজনক এক পদবীতে পরিণত হয়। এ কারণে তাকে অনেকসময় “ফেরাউন” সম্বোধন করা হত রাজ্যাধিপতি হিসেবে, কিন্তু কখনও এ্ই উপাধি তার নামের সাথে যুক্ত হয়নি। অর্থাৎ তাকে কখনও “ফেরাউন নমরুদ” হিসেবে সম্বোধন করা হয়নি। ফেরাউন উপাধিটি প্রথম নামের সাথে যুক্ত করেন মিসরের ২২তম রাজবংশের শশাঙ্কেরা। 

# আরেকজন বলল, “নমরুদের যে পরিচয় দিলেন তা কি সঠিক?”

@ আমি বললাম, “সত্যিকার অর্থে এই নমরুদ কে ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। প্রকৃতপক্ষে, তার ব্যাক্তি পরিচয় নিয়ে দু'টি সুপ্রতিষ্ঠিত মতামত রয়েছে। প্রথমটির অবতারণা করেছেন জি. স্মিথ ও জেরেমিয়া প্রমুখ। তাদের মতে নমরুদ ব্যাবিলনীয় বীর ইজদুবার বা গিলগামেশ ব্যাতিত অপর কেউ নন। তাদের এই বক্তব্যের ভিত্তি হল এই যে, ইজদুবারকে ব্যাবিলনীয় মহাকাব্যে উপস্থাপন করা হয়েছে একজন অতি সুদক্ষ শিকারী রূপে, যার সঙ্গে থাকত সবসময় চারটি কুকুর। আর তিনি এশিয়াতে প্রথম একটি বড় সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাছাড়া ইজদুবার এই নামটির এখন পর্যন্ত কোন সঠিক উচ্চারণ নির্ণিত হয়নি। জেরেমিয়ার মতে হিব্রুতে এটি "নমরা উদু" হওয়ারই সম্ভাবনা ব্যাপক, আর তাতে নমরুদের সনাক্ততাও সুসম্পন্ন হয়।

২য় মতটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন সয়েস, পিনকেস ও অন্যান্যরা। তারা ব্যাবিলনীয় মারকারী মারদুককে নমরুদ হিসেবে সনাক্ত করেন। তাদের মতে ইজদুবার অবশ্যই পঠিত হবে “গিলগামেশ” যাতে নামের মাহাত্ম্য সাধারণভাবে নিহীত। আর যে বৈশিষ্ট্য মারদুক নামটিকে প্রতিষ্ঠিত করছে তা হল, তিনিও একজন সুদক্ষ শিকারী। তাছাড়া, এই নামটির ফোনোটিক্যালি হিব্রু উচ্চারণ “অমার উদ”, যা হয়ত: “নমর উদ” হিসেবেও উচ্চারিত হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে বাইবেলীয় নমরুদকে কুশের পুত্র অর্থে না ধরে, কুশ-বংশীয় ধরলে, ‘ইএ’ এর পুত্র মারদুক ও বাইবেলীয় নমরুদ একাত্ম হয়ে যায়।

বাইবেলের মত আরবীয় ঐতিহাসিকগণও নমরুদকে চরম স্বেচ্ছাচারী (আল-জব্বার) হিসেবে বিবেচনা করে। তবে তারা নমরুদের বাইবেলীয় বংশ বৃত্তান্তের সাথে একমত নন। একটি সূত্রমতে তিনি ছিলেন মাশের পুত্র এবং অরামের পৌত্র। তিনি টাওয়ার অব বাবেল নির্মাণ করেন। আর তার গোত্র নাবাতিয়ানদের উপর তিনি রাজত্ব করেন পাঁচশত বৎসর। কিন্তু সাধারণ মত এই যে, তিনি ছিলেন কনান পুত্র এবং কুশের পৌত্র অথবা কুশের পুত্র এবং কনানের পৌত্র। আর এ দু’টি মতামতই দিয়েছেন তাবারী তার। তার জন্ম রিও [ইব্রাহিমের প্রোপ্রোপিতামহ] এর রাজত্বকালে ও তিনিই প্রথম অগ্নি উপাসনা প্রচলন করেন এবং তিনিই প্রথম নরপতি যিনি রাজমুকুট পরিধান করেন।-[কিতাব আল-মাগাল]

অন্য উপাখ্যান মতে দু’জন নমরুদ ছিলেন- প্রথম জন কুশের পুত্র এবং ২য় জন সুপরিচিত স্বেচ্ছাচারী ও ইব্রাহিমের সমসাময়িক। যিনি ছিলেন কনান পুত্র এবং ১ম নমরুদের পৌপোত্র। মাসুদীর মতানুসারে নমরুদ ছিলেন প্রথম ব্যাবিলনীয় নৃপতি এবং ষাট বৎসর রাজত্ব করেন।

# আরেকজন বলল, “মশা কবুতরের মত বড় হয়ে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে উপদেশ দিয়ে উড়ে চলে গেল? বাহ সুন্দর তো।”

@ আমি বললাম, “আমার এ অর্টিকেলের উপস্থাপিত তথ্যে অসংখ্য বিচ্যূতি রয়েছে তা আমি জানি এবং আপনারাও তা সহজেই বুঝতে পারছেন। আমি কেবল তথ্য উপস্থাপন করেছি দু’টো কারণে- যারা নাস্তিক তাদের বিনোদনের জন্যে এবং যারা আস্তিক তারা যেন আার্টিকেলের প্রতিপাদ্য- “এমনই খোদার কাজ, যেমন তাঁর ইচ্ছে, তিনি তাঁর সৃষ্টির দূর্বলতম কোন প্রাণীকে অুনুমতি দেন ঐ ব্যক্তিকে ধ্বংস করতে যে, তাঁকে ও তাঁর রসূলে বিশ্বাস করত না।” -বিষয়টি বুঝতে পারে।

প্রাচীন কালের মানুষ ঘটনার গুরুত্ব বোঝাতে সংখ্যা বাড়িয়ে বলত। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তিল হয়ে যেত তাল। আর বনি ইস্রায়েলে অধিকাংশ নবীর আগমন হওয়ায় প্রায় সকল কাহিনীর ডিটেইলগুলো এসেছে তাদের উৎস থেকে, আর তারা তো ছিল এ বিষয়ে ওস্তাদ। তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থেও এর অনুপ্রবেশ ঘটায়। ফলে কোরআনের অবতরণ।

আর ইসলামি পন্ডিতগণ কোরাণিক ইতিহাস সম্বলিত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা হাদিসে না পেলে ইহুদিসূত্রগুলোর দিকে হাত বাড়াতেন সঙ্গত কারণে, কিন্তু তারা ইহুদিদের প্রকৃতি জানা সত্ত্বেও সেইসব সূত্র থেকে সত্য বের করে আনতে পারেননি, যা সত্যিই দু:খজনক। আমার বক্তব্য বোঝার সুবিধার্থে একটা উদাহরণ দেব। 

ইস্রায়েলীরা মূসার নেতৃত্বে মিসর থেকে বেরিয়ে এসে দক্ষিণ কনান তথা সিরিয়ার প্রান্তে এসে ছাউনি ফেলে। ঐ সময় তিনি নেতৃস্থানীয় বারজনকে কনানে পাঠান, যেন তারা গিয়ে ঐ দেশের প্রয়োজনীয় খবরাখবর -দেশের ভূমি, উৎপন্ন ফসল, শহরগুলোর ধরণ ও তার বাসিন্দাদের গড়ন ইত্যাদি জেনে আসতে পারে, যা তাদেরকে মোকাবেলায় কাজে লাগবে। যাত্রার পূর্বে তিনি তাদেরকে বলে দেন- তারা সেখানে যা কিছু দেখবে, তা যেন প্রথমে তাকে জানায় এবং তার অনুমতি ছাড়া কারও কাছে কোনকিছু না প্রকাশ করে। 

ঐ বারজন তাদের যাত্রা পথে, এক শহরের বাইরে অমালিকা সম্প্রদায়ের আউজ বিন উনূক নামক এক ব্যক্তির মুখোমুখি হল। আউজ কথাবার্তা বলে বুঝতে পারল যে, তারা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে এসেছে। তখন সে রেগে গিয়ে তাদের বারজনকে একাই বন্দী করে রাজদরবারে হাজির করে। সেখানে তাদেরকে আটক রাখা হল এবং দরবারে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ চলল। কেউ কেউ বলল, ‘তাদেরকে হত্যা করা হোক।’ আর অন্যেরা বলল, ‘তাদেরকে মুক্তি দেয়া হোক।’ 

অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে, যেন তারা ফিরে গিয়ে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে অমালিকাদের দৈহিক আকৃতি ও শক্তির কথা বর্ণনা করতে পারে। আর যেন তাদের যুদ্ধের সাধ একেবারেই মিটে যায়। সুতরাং তারা মুক্তি পেল এবং চল্লিশ দিন দেশাটা ঘুরেফিরে দেখে ফিরে এসে মূসাকে সব জানাল। 

মূসা তাদেরকে বললেন, ‘আমরা শহরে ঢুকব কারণ, খোদা আমাদেরকে দেশটা দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছেন- ‘‘তোমরা এ জনপদে প্রবেশ কর এবং যেখানে ইচ্ছে যাও ও যা ইচ্ছে খাও, মাথা নীচু করে প্রবেশ কর আর বল, ‘ক্ষমা চাই’ আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করব; আর যারা সৎকর্ম করে তাদের জন্যে আমার দান বাড়িয়ে দেব।’-(২:৫৮) আর তিনি তাদেরকে অাবারও সাবধান করে দিলেন যেন কাউকে কিছু না বলে। কারণ মূসা জানতেন ৪০০ বৎসর মিসরীয়দের গোলামী করে তাদের মানষিক দৃড়তার কিছু্ই অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া তাদের তিলকে তাল করার অভ্যাস তো আছেই।

কিন্তু, শেষপর্যন্ত কাজ হল মূসার নির্দেশের পরিপন্থী। যদিও তারা প্রকাশ্যভাবে কাউকে কিছু বলেনি। কিন্তু প্রত্যেকে স্বীয় বন্ধুর কাছে গোপনে অমালিকাদের শক্তিমত্তার কথা বর্ণনা করল, দু‘জন (ইউশায়া ইবনে নূন ও কালেব বিন ইউকেনা) ছাড়া। এতে দু’ এক দিনের মধ্যেই সকল ইস্রায়েলীর মধ্যে বিতর্ক ছড়িয়ে গেল। একদল বলতে লাগল, ‘তারা এক একজন এক‘শ হাত লম্বা ও ষাট হাত চওড়া।’ অন্যরা বলে চলল, ‘তাদের কেউ সমুদ্রে নামলে পানি তার হাঁটু সমান হয়।’ আর একদল এদেরকেও ছাড়িয়ে গেল। তারা বলল, ‘তারা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে সূর্য়্যের আগুণে পুড়িয়ে খায়।’

সুতরাং অমালিকাদের সাথে যুদ্ধের জন্য মূসা যখন সকলকে প্রস্তুতি নিতে বললেন, তখন তারা রাজী হল না। এতে তিনি তাদেরকে বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা স্মরণ কর আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি তোমাদের মধ্যে থেকে নবী করেছিলেন, তোমাদেরকে রাজ্যের অধিপতি করেছিলেন ও বিশ্বে যা কাউকে দেননি তা তোমাদেরকে দিয়েছিলেন। হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্যে যে পবিত্রভূমি নির্দিষ্ট করেছেন সেখানে প্রবেশ কর, আর পিছু হোটও না, পিছু হোটলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে।’
তারা বলল, ‘হে মূসা! সেখানে এক দুর্দান্ত সম্প্রদায় রয়েছে, আর তারা সেখান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনও সেখানে প্রবেশ করব না। তারা সেখান থেকে বের হয়ে গেলেই আমরা প্রবেশ করব।’ -(৫:২০-২২)

এসময় দু’জন, ইউশায়া ও কালেব তাদেরকে সাহস দিয়ে বলেন, ‘তোমরা প্রবেশ দ্বারে তাদের মোকাবেলা কর। প্রবেশ করতে পারলেই তোমাদের জয় হবে। আর তোমরা বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহর উপরই নির্ভর কর।’ -(৫:২৩)
কিন্তু বনি ইস্রায়েলীরা যখন তাদের নবী মূসার কথাই বিশ্বাস করছে না, তখন এদের কথা কি করে বিশ্বাস করবে? সুতরাং তারা মূসাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘হে মূসা, যতদিন তারা সেখানে থাকবে ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। সুতরাং তুমি ও তোমার প্রতিপালক যাও ও গিয়ে যুদ্ধ কর।’(৫:২৪) 

এখন মূসা কি করবেন? তিনি তখন খোদার কাছে অভিযোগ করলেন এবং বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার ও আমার ভাই ছাড়া অন্যকারও উপর আমার কর্তৃত্ব নেই; সুতরাং তুমি আমাদের ও সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়সালা করে দাও।’ 
আল্লাহ বললেন, ‘তবে এ চল্লিশ বৎসর তাদের জন্যে নিষিদ্ধ রইল। তারা পৃথিবীতে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াবে। সুতরাং তুমি সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের জন্যে দুঃখ কোরও না।’-(৫:২৫-২৬) 

আর তাই আল্লাহ কেন তাদেরকে তাঁহ প্রান্তরে বন্দী করেছিলেন তা আমরা জানতে পারছি। তাঁহ অর্থ পথভ্রষ্ট হয়ে ঘোরা। কনান দেশটি দেখতে যে চল্লিশ দিন লেগেছিল, সেই চল্লিশ দিনের প্রতিদিনের জন্যে এক বৎসর করে মোট চল্লিশ বৎসর ইস্রায়েলীরা ঐ প্রান্তরে নজর বন্দী ছিল। তারা চাইত এখান থেকে বেরিয়ে মিসরে ফিরে যেতে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যায় তারা নিজেদেরকে ঐস্থানেই পেত যেখান থেকে সকালে রওনা হয়েছিল। এই প্রান্তটির দৈর্ঘ্য ছিল ত্রিশ ফারসেক অর্থাৎ নব্বুই মাইল আর প্রস্থ ছিল নয় ফারসেক বা সাতাশ মাইল। কোরআনে আল্লাহ বলেন- আর তাদের উপর আরোপ করা হল লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে থাকল। এমন হল এ জন্যে যে, তারা আল্লাহর বিধি-বিধান মানত না এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। তার কারণ, তারা ছিল নাফরমান, সীমালঙ্ঘনকারী।-(২:৬১)

এবার মূল কথায় আসি- ঠিক এমনিভাবে যেভাবে ইস্রায়েলীরা তথ্যকে বাড়িয়ে বলত, তেমনিভাবে তারা তাদের ধর্মীয় পুস্তকগুলোকেও তাদের মত করে পরিবর্তণ করে নেয়। [উদাহরণ স্বরূপ, নবী মূসার চাচাত ভাই ইস্রায়েলীদের মধ্যে সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি ছিলেন। কতটা ধনী ছিলেন তার বর্ণনায় তালমুদ জানিয়েছে- “কোরাহর ধনভান্ডরের চাবি ছিল ৩০০ সাদা গাধার বোঝার পরিমান আর তালাচাবিগুলো তৈরী ছিল চামড়ার।” -[সনহেড্রিন ১১০এ; পেসাকিম ১১৯এ]. 

আর মুসলিম লেখকগণ এসব কপি-পেস্ট করেছেন কোন রকম যাঞ্চাই বাঁছাই ছাড়াই। ফলে আমরা নমরূদের সৈন্যসংখ্যা একজনের কাছ থেকে পাচ্ছি ৬০ লক্ষ [বুক অব চামিস]। আর অন্যজন যদিও সংখ্যা উল্লেখ করেননি সম্ভবত তার সূত্র জোরালো ছিল না তাই, তথাপি তার বর্ণনায় যা এসে পড়েছে তা আরও ভয়ানক। তিনি উল্লেখ করেছেন বার বর্গমাইল জায়গায় নমরুদের সেনাবাহিনী ছাউনি ফেলেছিল। আর এসব মুসলিম লেখক দেখেন যে ইহুদিরা কিতাবধারী, সুতরাং তথ্যটা সত্য ধরা যায়, কেননা কোরআনে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু ঐ আমলে সারা মিসরে ৬০ লক্ষ লোক থাকা সম্ভব কিনা বা বার বর্গমাইলে ছাউনি ফেলতে হলে সৈন্য সংখ্যা কত হতে হবে, এসব সাধারণ জ্ঞান তারা ব্যবহার করেননি। 

যা হোক, আমি আর কি বলব, যা বলার ইবনে খালদুন বলেছেন- “Historians, Qur'an commentators and leading transmitters have committed frequent errors in the stories and events they reported. They accepted them in the plain transmitted form, without regard for its value. They did not check them with the principles underlying such historical situations, nor did they compare them with similar material. Also, they did not probe (more deeply) with the yardstick of philosophy, with the help of knowledge of the nature of things, or with the help of speculation and historical insight. Therefore, they strayed from the truth and found themselves lost in the desert of baseless assumptions and errors.”- [আল-মুকাদ্দিমা, পৃ. ৫৯] 

প্রথিতযশা তফসিরকারী, ঐতিহাসিক, ও হাদিস সংকলকদের উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণের পর ইবনে খালদুন কেন এমন বলেছেন বা কেন ইহুদি-খৃষ্টান পন্ডিতগণ ‘সত্য-মিথার পার্থক্যকারী’ বলে দাবী করার পর তার আলোকে তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো সংশোধন না করে বরং খোদ কোরআনকেই তাদের কাছ থেকে ইতিহাস ধারকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ১৪০০ বৎসর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং খোদায়ী ঐ কিতাবের দিকে আঙ্গুল তুলতে সাহস করছে তা এখন পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। 

উৎস: 
কোরআন,
বাইবেল,
বুক অব জাসের,
বুক অব জুবিলি,
গসপেল অব বার্ণাবাস,
পিরকে ডি রাব্বি এলিজার,
হুসেন ইবনে মুহম্মদ, বুক অব চামিস,
কিতেবা চিলওয়া- ইয়াজিদি ধর্মগ্রন্থ,
তাবারী,  তারিখ আল-রসূল ওয়া আল-মুলুক,
আল-খারিজিমি, মাফাতিহ আল-উলুম,
চেইনে এন্ড ব্লাক, এনসাইক্লোপিডিয়া বিবলিকা,
সয়েস, খন্ড ২, পৃ, ২৪৩,
জেরেমিয়াস, ইজদুবার নমরুদ,
পিনকেস, দ্যা ওল্ড টেস্টামেন্ট,
রুবিন, বিরুসি হা কাসিদি,
ডি’হার্বেলট, বিবলোথিক ওরিয়েন্টালে,
হিউজেস, ডিকশনারী অব ইসলাম,
মাসুদী, মুরুজ আল-ধাহাব,
মিরখন্দ, রওজাত আল-সাফা,
তাবারী, ক্রোনিকস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...