২৬ মার্চ, ২০১২

Battle of Uhud: ওহোদ যুদ্ধের পটভূমি।

বদর যুদ্ধে পরাজয়ের পর পৌত্তলিকরা প্রতিহিংসা গ্রহণের জন্যে জ্বলছিল। তাই তারা দ্রুত প্রস্তুত হল। তিহামা ও কিনান গোত্রদ্বয়ের সমর্থন লাভ করায় তাদের সম্মিলিত বাহিনী তিন হাজার সুসজ্জ্বিত সৈন্যতে উন্নীত হল যার মধ্যে সাত’শ ছিল বর্মাবৃত্ সৈনিক। হিজরী ৩য় সনে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কোন দিক থেকে কোনরকম বাঁধা না পেয়ে এই বাহিনী মদিনার উত্তর-পূর্ব দিকে একটি স্থানে অবস্থান নিল। একমাত্র ওহুদের পর্বত ও উপত্যকা এস্থানকে মদিনা থেকে বিচিছন্ন করেছে। এই নিরাপদ সুবিধাজনক অবস্থান থেকে তারা মদিনাবাসীদের শষ্যক্ষেত্র ও খেজুর বাগান ধ্বংস করতে লাগল।

ইতিপূর্বে নবীজীর পিতৃব্য আব্বাস কুরাইশদের এই উদ্যোগ আয়োজনের সংবাদ সম্বলিত একখানা পত্র জনৈক অনুগত লোকের মাধ্যমে মদিনায় প্রেরণ করেছিলেন। নবীজী এই সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে ধীর গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, ‘আমাদের আল্লাহ আছেন, তিনি আমাদের অবলম্বণ, তিনিই আমাদের সম্বল, তিনিই আমাদের সহায়। তিনি একাকীই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।’

আক্রমণকারীদের বিস্তারিত তথ্য আনতে দু‘জন শিষ্যকে মদিনার বাইরে পাঠান হয়েছিল। তারা সংবাদ নিয়ে এল যে, কুরাইশ বাহিনী একেবারে মদিনার নিকটবর্তীতে অবস্থান নিয়েছে। So, a Muslim conference of war convened, and there was dispute over how best to repel the Meccans. Muhammad and many of the senior figures suggested that it would be safer to fight within Medina and take advantage of its heavily fortified strongholds. Younger Muslims argued that the Meccans were destroying their crops, and that huddling in the strongholds would destroy Muslim prestige. Muhammad eventually conceded to the wishes of the latter, and readied the Muslim force for battle.

ওহুদ প্রান্তরে সৈন্য বিন্যাস।
তরুণ অনুসারীদের উদ্দীপনা ও মদিনাবাসীদের সম্পদের ধ্বংসের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে নবীজী এক হাজার অনুসারী নিয়ে অগ্রসর হলেন। কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নিজের দলবলকে সম্বোধন করে বললেন, ‘মুহম্মদ আমার কথা শুনলেন না, আমার পরামর্শের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না, আর কতকগুলি অজ্ঞ বালকের কথা অনুসারে কাজ করলেন। সুতরাং আমরা তার সঙ্গে যাব কেন? চল আমরা সকলে ফিরে যাই। অনর্থক তো আর আমরা নিজেদেরকে তরবারীর মুখে এগিয়ে দিতে পারি না।’ উবাই তার তিন’শ অনুসারীসহ দলত্যাগ করলেন।

ফলে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সাত’শতে নেমে এল। তাদের সঙ্গে দু’টি মাত্র অশ্ব,৭০জন বর্মাবৃত, ৫০জন তীরন্দাজ এবং বাকীদের খালি গা, হাতে তরবারী বা বর্শা ছিল। তা সত্ত্বেও এই সাহসী দলটি মনোবল সহকারে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকল এবং খেজুর বনের মধ্যে দিয়ে নীরবে অগ্রসর হয়ে ওহুদের পর্বতে এসে পৌঁছিল। তারা সংকীর্ণ গিরিসঙ্কটের মধ্যে রাত্রি অতিবাহিত করল এবংফজরের নামাজ পড়ে সেই গিরিসঙ্কট থেকে বেরিয়ে সমতলভূমিতে উপস্থিত হল।

৬২৫সিইর ১৯ মা্র্চ, ৩রা শাওয়াল ৩য় হিজরী। ওহুদ প্রান্তর। যুদ্ধের জন্য মুজাহিদগণ পর্বতের পাদদেশে অবস্থান গ্রহণ করল। কুরাইশদের জন্য এ যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের সমূলে বিনাশ করে বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। অন্যদিকে মুসলমানদের জন্য ছিল, ধর্ম রক্ষায়, নবীজীর নিরাপত্তা রক্ষায়- সর্বোপরি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। ওহুদের এই পর্বত প্রান্তরটি মদিনা থেকে উত্তর দিকে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত। একটি উচ্চ সুড়ঙ্গ মুখে যা পর্বত প্রাচীরের একমাত্র সুড়ঙ্গ পথ ছিল, সৈন্যবাহিনীর পিছনে ঐ স্থানে নবীজী কিছু সংখ্যক তীরন্দাজ মোতায়েন করেন এমন নির্দেশ দিয়ে যে, কোন অবস্থাতেই তারা যেন তাদের স্থানত্যাগ না করে। শত্রুর অশ্বারোহী সৈন্যদের অসুবিধা ও মুসলিম মুজাহিদদের হেফাজত করাই তাদের একমাত্র কাজ ছিল। কোরআন জানায়- আর তুমি যখন পরিজনদের কাছ থেকে সকাল বেলা বেরিয়ে গিয়ে মুমিনদেরকে যুদ্ধের অবস্থানে বিন্যস্ত করলে, আর আল্লাহ সব বিষয়ে শোনেন ও জানেন।(৩:১২১)

সংখ্যাধিক্যে অতিশয় বিশ্বাসী হয়ে সৈন্যবাহিনীর কেন্দ্রস্থলে দেবমূর্ত্তি রেখে পৌত্তলিকরা কুচকাওয়াজ করতে করতে সমতল ভূমিতে নেমে এল। এই যুদ্ধে কুরাইশ পৌত্তলিকরা পুরুষদের পশ্চাৎপসারণ রোধ এবং যুদ্ধে উৎসাহিত করার জন্যে নারীদের সঙ্গে এনেছিল। তারা এখন নাচ গানের মাধ্যমে পুরুষদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগল। গোত্র প্রধানদের স্ত্রীরা যুদ্ধের গান গেয়ে ও তাম্বুরা বাজিয়ে নাচতে নাচতে গাইছিল- 

‘প্রভাতী তাঁরার দুলালী আমরা, পুষ্পপেলব মুখ,
গুলাবী রঙিন সিরীন শরাবে, ভরা আমাদের বুক।
কাল কুন্তলে কস্তুরী মাখা, কন্ঠে মুক্তামালা,
খঞ্জনসম নৃত্যচরণা নয়নে বহ্নি-জ্বালা।
ওগো বীরদল, হও আগুয়ান, রাখ স্বদেশের মান,
বিজয়ীর বেশে ফিরে এস সবে, দেব-মিলন মালিকা দান।
কাপুরুষসম পালিয়ে যদি এস, আমাদের গোত্র মাঝে,
ধিক্কার দেব, চিরদিনের তরে, মুখ ফেরাব লাজে।'

উলুধ্বনি, হুংকার, তাম্বুরা ও ঢোলের শব্দের মধ্যে তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে আবু সুফিয়ান যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে এলেন। যখন তিনি থামলেন চারিদিকের সকল শব্দ থেমে গেল। অতঃপর তার বজ্রকন্ঠ ধ্বনিত হল, ‘হে আওস, হে খাজরাজ- তোমরা আমাদের স্বগোত্রস্থ লোকদের পরিত্যাগ করে সরে দাঁড়াও, আমরা তোমাদেরকে কিছুই বলব না, তোমাদের নগর আক্রমণ করব না, এস্থান হতে ফিরে যাব।’

ওহুদের পর্বত ও যুদ্ধক্ষেত্র।
তার প্রস্তাবের প্রতি মুসলমানরা ভ্রুক্ষেপ না করে নবীজীর আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন কুরাইশ বীর তালহা ময়দানে এসে ব্যঙ্গস্বরে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, ‘মুসলমানেরা! তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি- যে নিজের তরবারী দিয়ে আমাকে নরকে প্রেরণ করতে অথবা আমার তরবারীর আঘাতে নিজে স্বর্গে যেতে প্রস্তুত?’
এই আহবান শুনে আলী এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘আমি আছি। আমিই তোমার নরক যাত্রার সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি।’

আলীর এক আঘাতে তালহার মস্তক মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পিতার এই পরিণতি দেখে পুত্র ওসমান আস্ফালন করতে করতে ছুটে এল। নবীজীর পিতৃব্য হামজার এক আঘাতে তার দেহ দ্বি-খন্ডিত হয়ে গেল। পরপর দু‘জনের এই পরিণতি দেখে কুরাইশরা ভীত হয়ে পড়ল। তারা খন্ডযুদ্ধ স্থগিত করে সমবেত ভাবে মুসলমানদের আক্রমণ করল। হামজার নেতৃত্বে মুসলমানেরা কুরাইশদের প্রথম প্রচন্ড আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করল। অতঃপর তারা শত্রু বাহিনীর কেন্দ্র আক্রমণ করে বসে এতে কুরাইশদের পতাকা ভুলুন্ঠিত হতে খুব বেশী সময় লাগেনি। 

শত্রুদের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে হামজা কুরাইশ সৈন্যদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শত্রু নিপাত করতে করতে ভীতি বিহব্বল অবস্থার সৃষ্টি করলেন। বিজয় যখন মুসলমানদের প্রায় করতলগত হয়ে আসছিল এবং শত্রুরা পশ্চাৎধাবন করছিল, সেসময় তীরন্দাজরা নবীজীর নির্দেশ ভুলে গিয়ে স্ব-স্থান ত্যাগ করে লুন্ঠনে যোগ দিল।

মুজাহিদগণ অগ্রসর হতে থাকল
কুরাইশদের অন্যতম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ নিমেষে মুসলমানদের বিচ্যুতি লক্ষ্য করে তার অশ্বারোহী সৈন্যদের ঘুরিয়ে এনে পশ্চাৎ দিক থেকে সুড়ঙ্গ পথে মুসলিম সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। কুরাইশদের জাতীয় পতাকা এতক্ষণ মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। খালিদের এই আক্রমণ এবং মুসলমানদের উপস্থিত সংকট দেখে আম্বা নাম্নী জনৈক কুরাইশ বীরাঙ্গনা আবার তা তুলে ধরে। পলায়নপর কুরাইশদের পদাতিক সৈন্যরাও তাদের দেখাদেখি ঘুরে দাঁড়াল এবং পুনঃরায় যুদ্ধে যোগদান করল। 

কোরআন জানায়- তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল? আর তোমরা তো মৃত্যু আসার আগেই মরন কামনা করতে, কাজেই এখন তো তোমরা তা চোখের সামনে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ।(৩:১৪২-১৪৩)

খুব শীঘ্রই আমি অবিশ্বাসীদের মনে ভীতির সঞ্চার করব। কারণ ওরা আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে যে সম্পর্কে কোন সনদ অবতীর্ণ করা হয়নি। আর ওদের ঠিকানা হল দোযখের আগুন। বস্তুতঃ জালেমদের ঠিকানা হল অত্যন্ত নিকৃষ্ট। আর আল্লাহর সে ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা তাঁরই নির্দেশে ওদের খতম করছিলে। এমনকি যখন তোমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছ ও কর্তব্য স্থির করার জন্যে বিবাদে লিপ্ত হয়েছ, আর যা তোমরা চাইতে তা দেখার পর কৃতঘ্নতা প্রদর্শণ করেছ, তাতে তোমাদের কারও কামনা ছিল দুনিয়া আর কারও বা কামনা ছিল আখেরাত। অতঃপর তোমদেরকে সরিয়ে দিলেন ওদের উপর থেকে যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন। বস্তুতঃ তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। আর আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।(৩:১৫১-১৫২)

সামনের ও পিছনের মুসলিম সৈন্যদেরকে ভীষণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে পুনঃরায় যুদ্ধ আরম্ভ করতে হল। এই সেনাদলের অসীম সাহসী বীরগণের অনেকে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হল। তাদের মধ্যে বীর হামজাও ছিলেন। আলী, যিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পৌত্তলিকদের প্রথম যুদ্ধ আহবানের জবাব দিয়েছিলেন, তিনি, ওমর ও আবু বকর গুরুতর আহত হলেন। এই বিপর্যস্তকর অবস্থা দেখে মুসলমানদের দু‘টি দল (আওস গোত্রের বনি হারেসা ও খাজরাজ গোত্রের বনি সালমা) সাহস হারিয়ে ফেলল। তাদের অনেকে প্রাণের ভয়ে ভাবছিল। আবার কারও কারও আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে ধারণা হচ্ছিল মূর্খের মত। কেউ কেউ মনে মনে বলছিল-‘রসূল থাকা অবস্থায় আমরা কেন পরাজিতের অবস্থায়? আল্লাহর সাহায্য কেন আমরা পেলাম না? এখন আমাদের হাতে কি কিছুই করার নেই?’ 
অনেকে আবার ভাবছিল, ‘আমাদের হাতে যদি কিছু করার থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।’

আলীর নেতৃত্বে যেসব সাহসী যোদ্ধা কেন্দ্রস্থলে উঠে পড়ে যুদ্ধ করছিল তারা পর্বতের উপরের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাদেরকে নবীজী পিছন থেকে আহবান করছিলেন, কিন্তু তা তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছিল না। এদিকে তিনি কতিপয় শিষ্য বেষ্টিত হয়ে সৈন্যদের মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এখন তিনি কুরাইশদের আক্রমণের প্রধান বস্তুতে পরিণত হলেন। 

তার শিষ্যরা তাকে ঘিরে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হতে লাগল। হামজার হত্যাকারী ইবনে কামিয়া নবীজীকে লক্ষ্য করে তার তরবারীর আঘাত হানল। একজন সাহাবী হাত দিয়ে তা প্রতিহত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে পড়ার সাথে সাথে আঘাতও নবীজীর মস্তকে লাগল এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তার মুখমন্ডল রক্তাপ্লুত হয়ে গেল। ইবনে কামিয়া তা দেখে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মুহম্মদ নিহত হয়েছেন।’

যারা পর্বতের উপরের দিকে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে তারা নিরাপদ ছিল, কিন্তু তারা তাদের রসূলের মুত্যু ঘটেছে শুনতে পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কিছু মুসলমান ভগ্ন হৃদয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হল। সর্বত্র সাময়িক বিপর্যয়ে ঘোর বিপদ ও নৈরাশ্যের ছায়া বিস্তার করছিল। মুসলিম বীরদের মৃতদেহ ছিল চোখের সামনে, যোদ্ধারা ছিল আঘাতে জর্জরিত। ফলে নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদরা বেদনায় মুষড়ে পড়েছিল।  

এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুমিনদেরকে উপদেশ দিয়ে এই আয়াতসমূহ নাযিল হয়- যখন তোমাদের দু‘টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করল, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহর উপর ভরষা করা সব মুমিনদের উচিৎ।(৩:১২১-১২২)

আর তোমরা নিরাশ হইও না এবং দুঃখ কোরও না। যদি তোমরা মুমিন হও, তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এদিন গুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তণ ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান-কারা ঈমানদার, আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।(৩:১৩৯-১৪০)
আর মুহম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তার পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাহলে কি সে যদি মৃত্যুবরণ করে অথবা নিহত হয়, তবে তোমরা পশ্চাৎপসারণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাৎপসারণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন। আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না- সেজন্যে একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুতঃ যে লোক দুনিয়ার বিনিময় কামনা করবে, আমি তাকে তা দুনিয়াতেই দান করব। পক্ষান্তরে যে লোক আখেরাতে বিনিময় কামনা করবে, তা থেকে আমি তাকে তাই দেব আর যারা কৃতজ্ঞ আমি তাদেরকে প্রতিদান দেব। 

আর বহু নবী ছিল, যাদের সঙ্গী-সাথীরা তাদের অনুবর্তী হয়ে জেহাদ করেছে; আল্লাহর পথে-তাদের কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু আল্লাহর রাহে তারা হেরেও যায়নি, ক্লান্তও হয়নি এবং দমেও যায়নি। আর যারা সবর করে আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন। তারা আর কিছুই বলেনি শুধু বলেছে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যাকিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদিগকে দৃঢ় রাখ এবং অবিশ্বাসীদের উপর আমাদের সাহায্য কর। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার সওয়াব দান করেছেন এবং যথার্থ আখেরাতের সওয়াব আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।(৩:১৪৪-১৪৮)

আর তোমরা উপরে উঠে যাচ্ছিলে এবং পিছন দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলে না কারও প্রতি, অথচ রসূল ডাকছিল তোমাদেরকে তোমাদের পিছন দিক থেকে। অতঃপর তোমাদের উপর এল শোকের উপর শোক, যাতে তোমরা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বস্তুর জন্যে দুঃখ না কর এবং যার সম্মুখীন হচ্ছ সেজন্যে বিমর্ষ না হও। আর আল্লাহ তোমাদের কাজের ব্যাপারে অবহিত রয়েছেন।(৩:১৫৩)

অতঃপর তোমাদের উপর শোকের পর শান্তি অবতীর্ণ করলেন, যা ছিল তন্দ্রার মত। সে তন্দ্রায় তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝিমুচ্ছিল আর কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে ভাবছিল। আল্লাহ সম্পর্কে তাদের মিথ্যে ধারণা হচ্ছিল মূর্খের মত। তারা বলছিল, ‘আমাদের হাতে কি কিছুই করার নেই?’
তুমি বল, ‘সবকিছুই আল্লাহর হাতে।’
তারা যা কিছু মনে লুকিয়ে রাখে- তোমার কাছে প্রকাশ করে না সেসবও। তারা বলে, ‘আমাদের হাতে যদি কিছু করার থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।’

তুমি বল, ‘তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও থাকতে তবুও তোমরা অবশ্যই বেরিয়ে আসতে নিজেদের অবস্থান থেকে যাদের মৃত্যু লিখে দেয়া হয়েছে। তোমাদের বুকে যা রয়েছে তার পরীক্ষা করা ছিল আল্লাহর ইচ্ছে, আর তোমাদের অন্তরে যা কিছু রয়েছে তা পরিস্কার করা ছিল তাঁর কাম্য। আল্লাহ মনের গোপন বিষয় জানেন। তোমাদের যে দু‘টি দল লড়াইয়ের দিনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল, শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল তাদের পাপের দরুন।’(৩:১৫৪-১৫৫)

পর্বতের উপরে অবস্থান নেয়া যোদ্ধারা যখন দেখতে পেল যে, তাদের সহযোদ্ধারা তখনও যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যস্থানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তখন তারা তড়িৎ বেগে নেমে এল, অতঃপর কা‘ব ইবনে মালেকের ডাকে তারা সেখানে ছুটে এল, যেখানে ছোট একটা যোদ্ধাদল নবীজীকে রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। আর তারা অতি নিকটে এসে দেখল, তরবারীর আঘাতে হযরতের শিরস্ত্রাণের দু‘খানি লৌহ তার কপালে ঢুকে পড়ে সেখান থেকে রক্তস্রোত বইছে তবে তিনি তখনও জীবিত আছেন। 

অতঃপর যোদ্ধারা বহুকষ্টে নবীজীকে নিয়ে ওহোদের উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করতে সমর্থ হল ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আলী ঢালে করে পাহাড়ের গহ্বর থেকে পানি আনলেন। এই পানি দিয়ে তিনি নবীজীর মুখমন্ডল ও ক্ষতসমূহ ধুয়ে দিলেন।
কিছু সাহাবীর পদস্খলন এবং তাদের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাওয়াতে নবীজী অন্তরে যে আঘাত পেয়েছিলেন, তা তার স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমা, করুণা ও চারিত্রিক কোমলতাকে ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই সাহাবীদের কেউই তার কাছ থেকে ভর্ৎসনা প্রাপ্ত হয়নি। কিন্তু সাহাবীদের মনে দুঃখ ও অনুতাপের সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে সাহাবীদের মনস্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং এই ভুলের জন্যে তাদের মনে যে দুঃখ ও অনুতাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেসব ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দেবার জন্যে এই আয়াতসমূহ নাযিল হয়- 

আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের জন্যে কোমল হৃদয় হয়েছ। পক্ষান্তরে তুমি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও এবং তাদের জন্যে মাগফেরাত কামনা কর এবং কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেল, তখন আল্লাহর উপর ভরষা কর- আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন। যদি আল্লাহ তোমাদের সহায়তা করেন, তাহলে কেউই তোমাদের উপর পরাক্রান্ত হতে পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদেরকে সহায়তা না করেন, তবে এমন কে আছে, যে তোমাদের সাহায্য করতে পারে? আর আল্লাহর উপরই মুসলমানদের ভরষা করা উচিৎ।(৩:১৫৯-১৬০)

মুসলমানদের উপর বিপদাপদ যাই এসেছে তা শত্রুর শক্তি ও সংখ্যাধিক্যের কারণে আসেনি, বরং তাদের নিজেদের বিচ্যুতির জন্যে এসেছে। তারা রসূলের আদেশ পালনে শৈথিল্য হয়েছিল। এ সংক্রান্ত আয়াত এই-যখন তোমাদের উপর একটি মুসিবত এসে পৌঁছিল, অথচ তোমরা তার পূর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে পৌঁছে গিয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, ‘এটা কোথা থেকে এল?’ তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌঁছিছে তোমারই পক্ষ থেকে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল।(৩:১৬৫)

সর্বোপরি, যা কিছু হয়েছে তা আল্লাহর ইচ্ছে ও সমর্থনে হয়েছে, যাতে করে সকলে মুমিন ও মুনাফেকদের চিনে নিতে পারে।কোরআন জানায়- আর যে দিন দু‘দল সৈন্যের মোকাবেলা হয়েছে; সেদিন তোমাদের উপর যা আপতিত হয়েছে, তা আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে এবং তা এ জন্যে যে, তাতে ঈমানদারদেরকে জানা যায় এবং তাদেরকে যাতে সনাক্ত করা যায় যারা মুনাফেক ছিল। আর তাদেরকে বলা হল, এস, আল্লাহর রাহে লড়াই কর কিম্বা শত্রুদেরকে প্রতিহত কর।’ 

তারা বলেছিল, আমরা যদি জানতাম যে, লড়াই হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকতাম।’ সেদিন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর কাছাকাছি ছিল। যা তাদের অন্তরে নেই তারা নিজের মুখে সেকথাই বলে; বস্তুতঃ আল্লাহ ভালকরেই জানেন তারা যা কিছু গোপন করে থাকে। ওরা হল সেসব লোক যারা বসে থেকে নিজেদের ভাইদের সম্বন্ধে বলে, ‘যদি তারা আমাদের কথা শুনত, তবে নিহত হত না।’ তাদেরকে বলে দাও, ‘এবার তোমাদের নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’(৩:১৬৬-১৬৮)

এই যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে, তদেরকে আল্লাহ এমন সব প্রতিদান দিয়েছেন, যা ঈর্ষণীয়। নিহতেরা অনন্ত জীবন ও রিজিকপ্রাপ্ত। কোরআনে বলা হয়েছে- আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনও মৃত মনে কোরও না। বরং তার নিজেদের পালনকর্তার কাছে জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উৎযাপন করছে। আর যারা এখনও তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি, তাদের পিছনে তাদের জন্যে আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয়-ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা-ভাবনাও নেই। আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্যে তারা অনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।(৩:১৬৯-১৭১)

নবী মুহম্মদ নিহত হয়েছেন, এই সংবাদ মদিনায় প্রচারিত হওয়ায় বিবি ফাতিমা তিন মাইল পথ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে আসেন। তার সেবায় নবীজী অল্পক্ষণেই সুস্থ্য হন। এরপর নামাজের সময় উপস্থিত হওয়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তিনি সাহাবীদের সাথে জোহরের নামাজ আদায় করলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রের একপ্রান্তে যেখানে মুসলিম বাহিনীর কেউ ছিল না সেখানে কুরাইশ রমনীরা গিয়ে আহত ও নিহতদের কর্ণ, চক্ষু ও নাসিকা কর্তন করতে লাগল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী-হিন্দ বিনতে ওৎবা অন্যান্য কুরাইশ রমনীদের প্রতিহিংসা গ্রহণের বন্য বর্বরতার ক্ষেত্রে অধিকতর হিংস্রতার পরিচয় দিয়েছিল। সে তার পিতার হত্যাকারী হামজার লাশের সন্ধান পাবার পরে উল্লাসে ফেটে পড়ল। সে ছুরি হাতে হামজার বুকের উপর চড়ে বসে হিংস্রতার সাথে তার বুক চিরে ফেলল, তারপর তার হৃৎপিন্ড উপড়ে নিয়ে তার বুকের উপর বসেই তা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। আর শেষে সে অর্ধমৃত ও মৃতদের কর্তিত কর্ণ ও নাসিকা দ্বারা গলার মালা ও বাঁজুবন্দ তৈরী করে তা পরিধান করল। এভাবে বর্বরতার সাথে মুমুর্ষ ও নিহত শত্রুদের দেহ বিকৃত করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে, সে ও তার সঙ্গীরা এলাকা পরিত্যাগ করল। আর কুরাইশরা এতই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, মদিনা আক্রমণ করতে কিম্বা ওহোদের উপত্যকা থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারল না। 

কুরাইশদের একজন কমান্ডার আমর বনুল আ’স ঐ ঘটনা সম্পর্কে পরবর্তীতে বলেছিলেন, “When we renewed the attack against them, we smote a certain number of them, and they scattered in every direction, but later a party of them rallied. Quraysh then took counsel together and said, The victory is ours, let us depart. For we had heard that Ibn Ubayy had retired with a third of the force, and some of the Aws and the Khazraj had stayed away from the battle, and we were not sure that they would not attack us. Moreover we had a number of wounded, and all our horses had been wounded by the arrows.” So they set off.-—আল ওয়াকিদি,  cited in Peters (1994) p. 219.


ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন- Abu Sufyan, after some brief verbal exchanges with Umar, decided to return to Mecca without pressing his advantage  According to Ibn Ishaq: When Abu Sufyan wanted to leave, he went to the top of the mountain and shouted loudly, saying, "You have done a fine work. Victory in war goes by turns: today is in exchange for the day of Badr. Show your superiority, Hubal", that is, vindicate your religion. 

The Messenger told Umar to go up and answer him and say, "God is most high and most glorious. We are not equal: our dead are in paradise, yours are in hell." 

At this answer Abu Sufyan said to Umar, "Come up here to me." 
The Messenger told him to go and see what Abu Sufyan was up to. When he came Abu Sufyan said, "I adjure you by God, Umar, have we killed Muhammad?"
"By God, you have not, he is listening to what you are saying right now", Umar replied. 
Abu Sufyan said, "I regard you as more truthful and reliable than Ibn Qami'a", referring to the latter's claim that he had killed Muhammad.— cf. Ibn Ishaq (1955) 380—388, cited in Peters (1994) p. 219

মুমুর্ষ ও নিহতদের উপর কুরাইশ রমনীগণ যে বর্বরতা দেখিয়েছিল তাতে মুসলমানদের মধ্যে প্রচন্ড উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এমনকি ধীরস্থির নবীজীও নিহতদের লাশ দেখে ঘোষণা করতে বাধ্য হন -‘ভবিষ্যতে কুরাইশদের মৃতদেহের প্রতি অনুরূপ আচরণ করা হবে।’ নবীজীর এ ঘোষণা ন্যায়সঙ্গত এবং খোদায়ী বিধানের তা খেলাফও নয়, কিন্তু তিনি তো সকল সৃষ্টির জন্যে মূর্ত করুণাস্বরূপ। কোরআনে বলা হয়েছে- “এবং আমি তাকে নিখিল বিশ্বের জন্যে মূর্ত্তিমান করুণাস্বরূপ পঠিয়েছি।” -(২১:১০৭)  সুতরাং তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় ক্ষমার মাহত্ম্য। কেননা,-

তাওরাতে ছিল- “প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমসমূহের বিনিময় সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে পাপ থেকে পবিত্র হয়ে যায়।" -(কোরআন, ৫:৪৫) 

Burn for burn, wound for wound, bruise for bruise.-(Exodus 21:25)
Fracture for fracture, eye for eye, tooth for tooth. The one who has inflicted the injury must suffer the same injury.-(Leviticus 24:20)
Show no pity: life for life, eye for eye, tooth for tooth, hand for hand, foot for foot.-(Deuteronomy 19:21)

আর গসপেলে বলা হয়েছে- তোমরা শুনেছ বলা হয়েছে ‘চোখের বদলে চোখ এবং দাঁতের বদলে দাঁত।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের সঙ্গে যে খারাপ ব্যাবহার করে, তার বিরুদ্ধে কিছুই কোরও না, বরং যদি কেউ তোমার ডান গালে চড় মারে, তাকে অন্য গালেও চড় মারতে দিয়ো। -(ম্যাথু-৫-৩৮-৩৯)


আর আমরাও জানি যে, মূল আইনসমূহের কোন পরিবর্তন নেই- কোন কিতাবেই; কেননা, সব কিতাবেরই উৎস একই- একক খোদা  "..তুমি আল্লাহর বিধানে পরিবর্তণ পাবে না এবং আল্লাহর রীতিনীতিতে কোনরকম বিচ্যুতিও পাবে না।" --(৩৫:৪৩) ফলে কোরআন আবারও তা অন্তর্ভূক্ত করল -“আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমান তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।” -(১৬:১২৬) আর তাই এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবীজী বলেছিলেন, ‘এখন আমরা সবরই করব, একজনের উপরও প্রতিশোধ নেয়া হবে না।’ এদিন থেকেই নিহতদের দেহ বিকৃত করার প্রাচীন পৈচাশিক প্রথা মুসলমানদের জন্যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হল।

যুদ্ধে নিহতদের সমাধি।
ওহোদ যুদ্ধে (Battle of Uhud) ৭০ জন মুসলমান নিহত হয়েছিল। তবে কুরাইশরা একজনকেও বন্দী করে নিতে পারেনি।নিহত মুসলমানদের মধ্যে পাঁচ ছয়জন মোহাজির ও অবশিষ্টরা ছিল আনসার। 

মৃতের এ সংখ্যা নির্ধারিত ছিল। বদর যুদ্ধে ধৃত ৭০জন বন্দীকে হত্যা না করে মুক্তিপনের মাধ্যমে মুক্ত করে দেয়াতে জিব্রাইল এসে নবীজীকে অবহিত করেছিল, ‘বন্দীদেরকে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্তের কারণে আল্লাহর নির্দেশক্রমে একথা অবধারিত যে, এর বদলা হিসেবে আগামী বৎসর সমসংখ্যক মুসলমান যুদ্ধে শহীদ হবে।’ 


জিব্রাইল এটি জানিয়েছিল কারণ মূসার উপর খোদার নির্দেশ ছিল শত্রুদের সকলকে হত্যা করার।কিন্তু নবীদের সকল কথা, কাজ ও তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা খোদায়ী কিতাবে পূর্ব থেকেই লিখিত ছিল। একারণে খোদায়ী বিধান অমান্য করাতে কোন আযাব তাদেরকে পাকড়াও করেনি। কোরআন বিষয়টি উল্লেখ করে সাহাবীদের সতর্ক করেছে-“যদি একটি বিষয় না হত যা পূর্ব থেকেই আল্লাহ লিখে রেখেছেন, তাহলে তোমরা যা গ্রহণ করছ, সেজন্যে বিরাট আযাব এসে পৌঁছাত।”-(৮:৬৮)

এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবীজী সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্তের কারণে আল্লাহর আযাব নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল। আর যদি আযাব এসেই পড়ত, তবে ওমর ইবনুল খাত্তাব ও সা‘দ ইবনে মু‘আজ ব্যতিত কেউই রেহাই পেত না।’ 
বলাবাহুল্য, একমাত্র ঐ দু’জনই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর অস্ত্র ধারণকারীরা হত্যার উপযুক্ত বলে অভিমত দিয়েছিলেন। যা হোক, মূল কাহিনীতে ফিরি-

ওহুদের যুদ্ধ শেষে নবীজী মুসলমানদের লাশ সংগ্রহ করে সমাধিস্থ করার আদেশ দেন। তখন কবর খুঁড়ে প্রতি কবরে দু‘তিনজন করে সমাধিস্থ করা হয়। তবে তাদের কারও জানাজা পড়ান হয়নি। আর সকলের দাফন শেষে নবীজী সন্ধ্যার পূর্বেই মদিনায় ফিরে এলেন। 

মুসলমানদের যারা নিহত বা আহত হয়েছিল তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে তাদের মৃত্যু সংবাদ জানতে পেরে বা আহত অবস্থা দেখে আফসোস করে বলতে লাগল, ‘তারা যদি আমাদের সঙ্গে থাকত, তবে তারা মরতও না আহতও হত না!’

এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হয়- হে ঈমানদাররা! তোমরা তাদের মত হইও না, যারা অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নিজেদের ভাই বন্ধুরা যখন কোন অভিযানে বের হয় কিম্বা জেহাদে যায়, তখন তাদের সম্পর্কে বলে, ‘তারা যদি আমাদের সঙ্গে থাকত, তবে তারা মরতও না আহতও হত না!’ যাতে তারা এ ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের মনে অনুতাপ সৃষ্টি করতে পারে। অথচ আল্লাহই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। তোমাদের সমস্ত কাজই, তোমরা যা কিছুই কর না কেন, আল্লাহ সব কিছুই দেখেন। আর তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিম্বা মৃত্যুবরণ কর, তোমরা যাকিছু সংগ্রহ করে থাক, আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা সে সবকিছুর চেয়ে উত্তম।-(৩:১৫৬-১৫৭)

কুরাইশ বাহিনী কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করে রাওহা নামক স্থানে ছাউনি ফেলল এবং তারা তাদের কিংকর্তব্য সম্বন্ধে পরামর্শ করতে বসল। আবু সুফিয়ান, একরামা প্রভৃতি দলপতিরা বললেন, ‘মুহম্মদ আহত, তার অধিকাংশ ভক্তই আঘাত-জর্জরিত, এ অবস্থায় মদিনা আক্রমণ না করে ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে কোন মতেই সঙ্গত হচ্ছে না। মুসলমানদের সমূলে উৎপাটিত ও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করার জন্যেই আমরা এত উদ্যোগ আয়োজন করলাম, নিজেদের যথাসর্বস্ব ব্যয় করে ফেললাম। এখন তার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, অথচ আমরা ফিরে যাচ্ছি। দুদিন পরে তারা আবার সামলিয়ে উঠবে, তখন আমাদের উদ্দেশ্য সফল করা সহজসাধ্য হবে না।’

আবু সুফিয়ান, ইকরামারা আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকদের নানা প্রকার প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে নিজেদের দলে এনেছিলেন। তারা বলতে লাগল, ‘কি করতে এসেছিলাম আর কি করতে যাচ্ছি! মদিনা আক্রমণ করে ধর্মের শত্রুদেরকে বিধ্বস্ত করে ফেলব, মদিনার সমস্ত ধন-সম্পদ লুটে নেব, তাদের যুবতী ও কুমারীদের সতীত্ব হরণ করব। কিন্তু এখন দেখছি এর কিছুই হল না। আমাদেরকে উল্টো ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।’

অতএব সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হল- মদিনা আক্রমণ করতে হবে। ফলে কুরাইশ দলপতিরা তাদের লোক-লস্করসহ মদিনার পথে ফিরে দাঁড়াল। তারা নবীজীর সংবাদ সংগ্রহের জন্যে গুপ্তচর হিসেবে মু'আবিয়াকে মদিনায় প্রেরণ করল। পরবর্তীতে এই মু'আবিয়া ধৃত হয়ে নবীজীর কাছে নীত হয়, নবীজী তাকে মদিনা ত্যাগ করতে আদেশ প্রদান করেন, কিন্তু সে সেই আদেশ অগ্রাহ্য করে গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত থাকায় পুনঃরায় ধৃত হবার পর তাকে হত্যার আদেশ দেয়া হয়।

বনি খোজা গোত্রের প্রধান সমাজপতি মা‘বদ মুসলমানদের বিপদের কথা শুনে সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্যে মদিনায় যাচ্ছিলেন। তার গোত্রের অনেক লোক তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি, কিন্তু নবী মুহম্মদ ও মুসলমানদের প্রতি তাদের বিশেষ সহানুভূতি ছিল। পথে মা‘বদ কুরাইশদের অভিসন্ধির বিষয় জানতে পারলেন এবং দ্রুত মদিনায় এসে নবীজীকে তা জ্ঞাত করলেন। নবীজী আবু বকর ও ওমরকে ডেকে পরামর্শ করলেন। অতঃপর তিনি তার শিষ্যদের একটি ছোট দলকে প্রস্থানকারী শত্রুদের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিলেন এবং কুরাইশদেরকে এ কথা বুঝিয়ে দিতে বললেন যে, যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলেও মুসলমানরা এতটুকু মনোবল হারায়নি ও পুনঃরায় আক্রান্ত হলে তাদেরকে সমুচিত শিক্ষা তারা দেবে। আর পরদিন প্রভাতে মুসলিম বাহিনী নবীজীকে নিয়ে মদিনা থেকে অগ্রসর হল। 
এদিকে ফেরার পথে আবু সুফিয়ানের সাথে মা‘বদের দেখা হল। তার কাছ থেকে আবু সুফিয়ান জানতে পারলেন-মুহম্মদ বিপুল আয়োজনে অগ্রসর হচ্ছেন। আর মদিনার প্রত্যেক মুসলমানই তার সাথে যোগদান করেছে।’ 

মুসলমানরা পশ্চাদানুসরণ করছে জেনে আবু সুফিয়ান তড়িঘড়ি করে মক্কায় ফিরে গেলেন এবং পথিমধ্যে তিনি যে দু’জন মদীনাবাসীর সাক্ষাৎ পান তাদেরকে হত্যা করেন। যাহোক আবু সুফিয়ান ঐসময় নবীজীর কাছে সংবাদ পাঠান যে, তাকে ও তার দলকে সমূলে বিনাশ করার জন্যে তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন। তার উত্তরে নবীজী যে জবাব দিয়েছিলেন তা ছিল বিশ্বাস ও নির্ভরতায় পরিপূর্ণ- ‘আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট। তিনিই সর্বোত্তম অভিভাবক।’

কোরআনে বলা হয়েছে-যারা আহত হয়ে পড়ার পরেও আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালন করেছে, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও পরহেযগার, তাদের জন্যে রয়েছে মহান সওয়াব। যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্যে লোকেরা সমাবেশ করেছে বহু সাঁজ-সরঞ্জাম, তাদের ভয় কর।’তখন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হয়ে যায় এবং তারা বলে, ‘আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট; কতই না কামিয়াবী দানকারী! অতঃপর ফিরে এল মুসলমানরা আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে, তাদের কিছুই অনিষ্ট হল না। তারপর তারা আল্লাহর ইচ্ছের অনুগত হল। বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ অতি বিরাট।-(৩:১৭২-১৭৪)

সমাপ্ত।
ছবি: Wikipedia, commons.wikimedia, quranforkids.
উৎস: 
  • Wikipedia
  • Andrae, Tor; Menzel, Theophil (1960). Mohammed: The Man and His Faith. 
  • Firestone, Rueven (1999). Jihad: The Origin of Holy War in Islam. 
  • Holt, P. M.; Bernard Lewis (1977a). Cambridge History of Islam, Vol. 1A. 
  • I. Ishaq and A. Guillaume (October 2002). The Life of Muhammad. 
  • Muir, William; Weir, T. H. (1912). The Life of Mohammad. 
  • Nafziger, George F.; Walton, Mark W. (2003). Islam at War: a history. 
  • Peters, F.E (1994). Muhammad and the Origins of Islam. 
  • Watt, W. Montgomery (1974). Muhammad: Prophet and Statesman. 
  • Watt, W. Montgomery (1981). Muhammad at Medina. 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...