সা‘লাবাহ ইবনে হাতেম (Salabah ibn Hatim) নামক এক ব্যক্তি মুহম্মদের সম্মুখে হাযির হয়ে নিবেদন করল, ‘হে রসূলুল্লাহ! আমি নিতান্ত দরিদ্র। আপনি আমার জন্যে দোয়া করুন যেন আমি সম্পদের মালিক হতে পারি।’
মুহম্মদ তাকে বললেন, ‘তাহলে কি তোমার কাছে আমার নির্দেশিত পথ পছন্দনীয় নয়?’
সে বলল, ‘তা নয়, আর আমি সম্পদের মালিক হলে প্রত্যেক হকদারকে তার প্রাপ্য নিশ্চয় পৌঁছে দেব।’
মুহম্মদ তার জন্যে দোয়া করলেন। আর সে চলে গেল।
দিনে দিনে সা‘লাবার পশুপালে অসাধারণ প্রবৃদ্ধি শুরু হল। আর মদিনাতে এগুলির সংরক্ষণে অসুবিধা হওয়ায় সে বাইরে চলে গেল। তবে যোহর ও আসরের নামাজ মদিনাতে এসে মুহম্মদের সাথে আদায় করত। একসময় তার পশুপালে আরও প্রবৃদ্ধি ঘটল। তখন সে আরও দূরে গেল। এ সময় সে জুম্মার নামাজের জন্যে মদিনাতে আসত। যখন তার পশুপালের আরও বৃদ্ধি হল, তখন সে মদিনা থেকে বহুদূরে চলে গেল। ফলে তারপক্ষে আর নামাজের জন্যে মদিনাতে আসা সম্ভব ছিল না।
তার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে মুহম্মদ একদিন তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে লোকেরা বলল, ‘তার পশুপাল বেড়ে যাওয়ায় সে মদিনা থেকে দূরে কোথাও বসবাস করছে- তাই এখন আর তাকে দেখা যায় না।’
ঘটনাক্রমে সেই সময়ে সদকার বিধি-বিধান সম্বলিত আয়াত নাযিল হল।
আল্লাহর নামে সম্পদের যে অংশ ব্যয় করা হয় তাই সদকা। এর অধীনে রয়েছে যাকাত (ফরজ) এবং অন্যান্য দান (নফল)। মক্কাতেই যাকাতের আয়াত নাযিল হয়েছিল এবং মুসলমানরা তখন তাদের চাহিদার অতিরিক্ত থেকে যাকাত আদায় করত। এখন মুহম্মদ সদকার বিধিবিধান বর্ণনা করলেন যে, যার কাছে বাৎসরিক খরচ মেটানোর পর নেসাব পরিমান (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বাহান্ন তোলা রৌপ্যর মূল্যমান) সম্পদ থাকে এবং যে ঋণগ্রস্থ নয়, সে তার সম্পদের যাকাত আদায় করবে।
এই বিধান শুনে উদ্ধত ইহুদিরা বলতে আরম্ভ করল, ‘আল্লাহ ফকীর ও গরীব হয়ে গেছেন, আর আমরা হচ্ছি ধনী ও আমীর। সেজন্যেই তো তিনি আমাদের কাছে চাইছেন।’
বলাবাহুল্য, তাদের বিশ্বাস তাদের এই উক্তির সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু মুহম্মদকে মিথ্যে প্রতিপন্ন ও উপহাসের পাত্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই তারা বলেছিল যে, আয়াতটি সঠিক হলে তার মর্ম দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ ফকির ও পরমুখাপেক্ষী।
তাদের একথার জবাব কোরআন দিয়েছে এভাবে- নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে যে, আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্থ আর আমরা বিত্তবান! এখন আমি তাদের কথা এবং যেসব নবীকে তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে তা লিখে রাখব, অতঃপর বলব, ‘আস্বাদন কর জলন্ত আগুনের আযাব।’ এ হল তারই প্রতিফল যা তোমরা ইতিপূর্বে নিজের হাতে পাঠিয়েছ! বস্তুতঃ আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যাচার করেন না।(৩:১৮১-১৮২)
নবী হত্যার ঘটনা (হযরত ইয়াহিয়া ও জাকারিয়া) ঈসার আমলের। কিন্তু এই আয়াতে এ সময়ের ইহুদিদের উপর ঐ হত্যার অপরাধ আরোপ করা হয়েছে। কারণ, এরা তাদের পিতৃপুরুষদের ঐ কাজের প্রতি সম্মত এবং আনন্দিত ছিল বলে হত্যাকারীদের মধ্যে পরিগণিত হয়েছে।
মুহম্মদ শীঘ্রই পালিত পশুর সদকার যথাযতঃ আইন প্রনয়ণ করে দু‘জন লোককে উসূলকারী বানিয়ে মুসলমানদের পালিত পশুর সদকা আদায় করার জন্যে পাঠালেন এবং তাদেরকে বলে দিলেন তারা যেন অবশ্যই সা‘লাবার কাছে যায়।
উসূলকারীরা যখন সা‘লাবার কাছে গেল এবং মুহম্মদের ফরমান শোনাল, তখন সে বলল, ‘আপনারা এখন যান। ফেরার পথে এখান হয়ে যাবেন।’
তারা চলে গেল এবং সুলাইম গোত্রের এক লোকের কাছে পৌঁছিল ও ফরমান শুনাল। তখন সে নিজে তার পালিত পশুপালের মধ্যে যেগুলি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সেগুলি নিয়ে এসে কর্মকর্তার কাছে হাযির করল। কর্মকর্তারা পশুগুলি দেখে বলল, ‘আমাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে, পশুর মধ্যে যেগুলি উৎকৃষ্ট সেগুলি যেন না নেই। তাই এগুলি আমরা নিতে পারিনে।’
লোকটি বলল, ‘আমি নিজের খুশীতে এগুলি দিতে চাই দয়া করে তা কবুল করে নিন।’
তখন কর্মকর্তারা সেগুলি নিল। তারপর তারা অন্যান্য মুসলমানদের কাছ থেকেও নির্দেশ মত আদায় শেষে একসময় সা‘লাবার কাছে ফিরে এল।
সা‘লাবা উসূলকারীদের কাছ থেকে সদকার আইন সম্বলিত পত্রখানা হাতে নিয়ে বলল, ‘এ তো একরকম জিজিয়া করই হয়ে গেল, যা মুসলমানদের কাছ থেকে নেয়া উচিৎ নয়। যাহোক, এখন আপনারা যান আমি পরে চিন্তা-ভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেব।’
ফলে কর্মকর্তারা মদিনায় ফিরে এল এবং মুহম্মদকে তার উত্তর জানাল। সবশুনে তিনি বললেন, ‘সা‘লাবার জন্যে আফসোস।’
এরপর কোরআনের এই আয়াত নাযিল হল-তাদের মধ্যে কেউ কেউ রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিল যে, তিনি যদি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ দান করেন, তবে অবশ্যই আমরা ব্যয় করব এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকব। অতঃপর যখন তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহের মাধ্যমে দান করা হয়, তখন তাতে কার্পণ্য করেছে এবং কৃত ওয়াদা থেকে ফিরে গেছে তা ভেঙ্গে দিয়ে তারপর এরই পরিণতিতে তাদের অন্তরে কপটতা স্থান করে নিয়েছে সেদিন পর্যন্ত যেদিন তারা তাঁর সাথে মিলবে। তা এজন্যে যে, তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা লঙ্ঘন করেছিল এবং এজন্যে যে তারা মিথ্যে কথা বলত।(৯:৭৫-৭৭)
এই আয়াত নাযিল হবার পর সা‘লাবার আত্মীয়-স্বজনদের একজন সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে সা‘লাবার কাছে পৌঁছিল এবং তাকে ভৎর্সনা করে বলল, ‘তোমার সম্পর্কে কোরআনে আয়াত নাযিল হয়েছে।’
একথা শুনে সে ঘাবড়ে গিয়ে তখুনি সদকার পশুপাল নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিল এবং মুহম্মদ সমীপে হাযির হয়ে নিবেদন করল, ‘আমি কখনও এরূপ বলিনি। আমার সদকা কবুল করে নিন।’
মুহম্মদ বললেন, ‘আমি তোমাকে হুকুম করেছিলাম, কিন্তু তুমি তা মান্য করনি। তাই তোমার সদকা কবুল হতে পারে না।’
সা‘লাবা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেল।
মুহম্মদের মৃত্যুর পর সা‘লাবা ১ম খলিফা আবু বকরের কাছে হাযির হয়ে সদকা কবুল করার আবেদন জানিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘যা রসূলুল্লাহ গ্রহণ করেননি, তা আমি কেমন করে গ্রহণ করব?’
আবু বকরের মৃত্যুর পর সা‘লাবা ২য় খলিফা ওমরের কাছে হাযির হয়ে সদকা কবুলের আবেদন জানিয়েছিল। তিনি আবু বকরের মতই উত্তর দিয়েছিলেন। সা‘লাবা তা সত্ত্বেও হাল ছাড়েনি। ওমরের মৃত্যুর পর ৩য় খলিফা ওসমানের কাছেও গিয়েছিল, কিন্তু তিনিও তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ওসমানের খেলাফত কালেই সা‘লাবা মৃত্যুবরণ করেছিল।
সমাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন