বনি বকররা বনি খোজাদের আক্রমণ করে বসল। বনি খোজারা মুসলমানদের সঙ্গে তাদের রক্ষণাবেক্ষণে চুক্তিসূত্রে আবদ্ধ ছিল। কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে গোপনে বনি বকরদেরকে যোদ্ধা ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল। তাদের সহযোগিতায় পুষ্ট হয়ে বনি বকররা বনি খোজাদেরকে আক্রমণ করল রাতের বেলায়। এতে অধিকাংশ খোজা নিহত হল এবং অল্পকিছু পলিয়ে গেল।
কুরাইশরা ভেবেছিল নৈশ অভিযানে বনি বকরদেরকে গোপনে সাহায্য করার এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সূদূরে অবস্থানরত মুহম্মদ বা মুসলমানরা কখনও জানতে পারবেন না। কিন্তু তাদের ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে পালিয়ে যাওয়া ঐসব বনি খোজারা অতিকষ্টে মদিনায় এসে পৌঁছিল। অতঃপর মুহম্মদের কাছে অভিযোগ করল এবং ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দান করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করল। তারা তাদের অভিযোগে বলেছিল, ‘হে রসূলুল্লাহ! কুরাইশরা আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা আপনার সেই সূদৃঢ় প্রতিজ্ঞাপত্রখানা বাতিল করে দিয়েছে। রজনীর অন্ধকারে অতর্কিতভাবে তারা বনি বকরদের সাথে আমাদের ‘অরক্ষিত’ আবাসগুলি আক্রমণ করেছে এবং আমাদেরকে শায়িত ও উপবিষ্ট অবস্থায় নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে।’
কুরাইশ ও বনি বকরের এই পৈচাশিক অত্যাচারের ও মিত্র খোজা বংশের এই মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞের কথা শ্রবণে মুহম্মদ যার পর নাই মর্মাহত হলেন। এ ঘটনার পর এই আয়াতসমূহ নাযিল হল-‘সম্পর্কচ্ছেদ করা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে।’(৯:১)
সুতরাং মুহম্মদ অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং গোপনে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করলেন।
এদিকে বনি খোজাদের কিছু লোকের পালিয়ে মদিনায় গমনের সংবাদ কুরাইশদের কাছে শীঘ্রই পৌঁছে গেল। তারা বদর, ওহোদ ও আহযাব যুদ্ধে মুসলমানদের গায়েবী সাহায্য লাভের বিষয়টি আঁচ করে এমনিতে হীনবল হয়ে পড়েছিল। তার উপরে চুক্তিভঙ্গের বর্তমান ঘটনায় তাদের কাছে মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অতঃপর মুহম্মদ ও মুসলমানদের পূর্ণ নীরবতা তাদের এই আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করল। সুতরাং কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ান মুহম্মদ ও মুসলমানদের মনোভাব জানতে তাড়াতাড়ি মদিনায় হাজির হলেন।
মদিনায় এসে আবু সুফিয়ান স্বীয় কন্যা, নবী পত্নী উম্মে হাবিবার হুজরায় উপনীত হলেন। পিতাকে দেখে হাবিবা তাড়াতাড়ি হযরত যে বিছানায় উপবেশন করতেন তা গুটিয়ে রাখলেন। এ দেখে আবু সুফিয়ান বললেন, ‘এই বিছানার মর্যাদা কি তোমার পিতার চাইতেও বেশী।’
তিনি বললেন, ‘এই শয্যায় আল্লাহর রসূল উপবেশন করেন, আর তুমি হলে মুশরিক।’
কন্যার এই উত্তর শুনে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মুহম্মদ আমার এই স্নেহের কন্যাটিকে যাদুর জালে আবদ্ধ করে আমার প্রতি এরূপ বীতশ্রদ্ধ করে রেখেছে!’
কন্যার হুজরা থেকে বেরিয়ে আবু সুফিয়ান মদিনায় ইতস্ততঃ এদিক সেদিক ঘুরলেন। কোথাও কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি নেই- নিশ্চিত হয়ে তিনি অতঃপর মুহম্মদের দরবারে হাযির হলেন। মুহম্মদ আবু সুফিয়ানের মদিনায় আগমনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করলেন, বললেন, ‘কি উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার এখানে আগমন?’
তিনি বললেন, ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি আমাদের পক্ষ থেকে ভেঙ্গে গিয়েছে। সুতরাং পুনঃরায় সন্ধি স্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আগমন করেছি।’
মুহম্মদ তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এতে তার মনোভাব বুঝতে পেরে শঙ্কিত হয়ে তিনি দরবার থেকে বেরিয়ে গণ্যমান্য কয়েকজন সাহাবীর কাছে আবেদন রাখলেন যেন তারা মুহম্মদের কাছে চুক্তি বলবৎ রাখার সুপারিশ করেন। কিন্তু তারা সবাই কুরাইশদের পূর্ববর্তী ও উপস্থিত ঘটনাবলীর তিক্ত অভিজ্ঞতার দরুন প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলেন। ফলে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মক্কায় ফিরে এলেন আবু সুফিয়ান।
আবু সুফিয়ানের মক্কায় প্রত্যাবর্তণের পর এই সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে, সন্ধি নবায়িত হয়নি। ফলে মক্কা ও তার আশে পাশের সর্বত্র যুদ্ধভীতি ছড়িয়ে গেল।
৮ম হিজরীর ১৮ই রমজান। পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে দশ সহস্য সৈন্য সংগ্রহ শেষে মুহম্মদ মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এরূপে মূসার ভবিষ্যৎ (Prophecy) বাণী পূর্ণ হল, ‘দশ সহস্র ন্যায়নিষ্ট সহচরসহ তিনি এলেন।
মক্কার উপকন্ঠে ‘মার উজ-জহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় শিবির স্থাপিত হল। অতঃপর মুহম্মদ দূত মারফত কুরাইশদের কাছে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব পাঠালেন।
- হয় তোমরা বনি খোজা গোত্রকে উপযুক্ত রক্তপণ দিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিকার কর। অথবা,
- বনি বকর গোত্রের সাথে সকল সম্বন্ধ ছিন্ন কর। অথবা,
- হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল হয়েছে বলে ঘোষণা কর।
কুরাইশরা জানত না যে, মুসলমানরা প্রস্তুত হয়ে মক্কার উপকন্ঠে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং তারা উৎসাহের সাথে দূতকে জানিয়ে দিল, ‘আমরা তৃতীয় শর্তটিই মেনে নিলাম।’
মুসলিম শিবিরে রাতের খাবার তৈরীর জন্যে আগুন জ্বালান হল। নিকটবর্তীতে এই আগুন দেখে কুরাইশরা অবাক হল। সুতরাং তারা আবু সুফিয়ানকে প্রকৃত তথ্য জানতে প্রেরণ করল।
‘মুসলিম মুজাহিদরা এত কাছে এসে পড়েছে!’-আবু সুফিয়ান বিষ্ময়ের আর শেষ রইল না। তিনি মুসলিম বাহিনীর তাঁবুর চারিদিকে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলেন। এসময় অগ্নিশিখার উজ্জ্বল আলোকে প্রহরীরা তাকে চিনে ফেলল। তারা সঙ্গোপণে তার পিছু নিল এবং অতঃপর বন্দী করে মুহম্মদের কাছে নিয়ে এল। মুহম্মদ আবু সুফিয়ানকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে মুক্তি দিলেন। ক্ষমার এই মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি তখনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং অতঃপর মক্কায় ফিরে এলেন।
সুবেহ সাদেকের শুভপ্রভা পূর্ব গগণে প্রতিভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরুর উপত্যাকার শিখর দেশ হতে বেলালের কন্ঠের সুমধুর আজানধ্বনি চারিদিকে মুখরিত হল। অতঃপর সকলে জামাতে সমবেত হয়ে ফজরের নামাজ সমাপন করলেন। নামাজ অন্তে বিভিন্ন গোত্রের বীররা স্বতন্ত্রদলে বিভক্ত হয়ে মক্কার দিকে যাত্রা করতে আরম্ভ করলেন। আবু সুফিয়ান, পিতৃব্য আব্বাসের সাথে উপত্যাকার একটা চূঁড়ায় বসে চকিত ও স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তা দেখছিলেন। একসময় সেনাপতি সা‘দ ইবনে ওবায়দা পাশ দিয়ে যাত্রার সময় আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আজ ভীষণ সংঘর্ষের দিন, আজ মক্কার সম্ভ্রম নষ্ট হবে।’
আবু সুফিয়ান দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বসে রইলেন। অবশেষে মোহাজিররা সম্মুখে উপস্থিত হলেন। মুহম্মদ এই দলে ছিলেন। তাকে দেখেই আবু সুফিয়ান চিৎকার করে বললেন, ‘মুহম্মদ, তুমি কি তোমার স্বজনকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছ?’
তিনি উত্তর করলেন, ‘না।’
তখন আবু সুফিয়ান সাদের দর্পোক্তির কথা নিবেদন করে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখপানে চেয়ে রইলেন। মুহম্মদ বজ্রগম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন, ‘সা‘দের কথা সত্য নয়, আজ প্রেম ও করুণার দিন, আজ কা’বার সম্ভ্রম চির প্রতিষ্ঠিত হবার দিন।’
সঙ্গে সঙ্গে অশ্ব সাদী হরকরা ছুটে গিয়ে সা‘দকে হুকুম শুনিয়ে দিলেন যে, এই প্রকার উক্তি করার জন্যে তাকে পদচ্যূত করা হয়েছে। সা‘দ নীরবে নবনিয়োজিত সেনাপতির হস্তে পতাকা অর্পণ করে তার বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন।
মুহম্মদ আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘আপনি মক্কাবাসীদের অভয় দিন, আজ তাদের প্রতি কোনই কঠোরতা হবে না। আমার পক্ষ হতে নগরময় ঘোষণা করে দিন-
-যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে -তাকে অভয় দেয়া হল।
-যে ব্যক্তি কা’বায় প্রবেশ করবে- সে অভয় প্রাপ্ত।
-যারা নিজেদের গৃহদ্বার বন্ধ করে রাখবে তাদের কোন ভয় নেই।
-যারা আবু সূফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে তারা অভয়প্রাপ্ত।
মুহম্মদ মক্কাবাসীর প্রতি যে, অভয়বাণী প্রেরণ করলেন, সেই সংবাদ মুসলিম বাহিনীর সমস্ত সৈন্যকেও জানিয়ে দেয়া হল।
সৈন্যদের প্রতি যেরূপ আদেশ ছিল সেইরূপ তারা বিভিন্ন পথে মক্কায় প্রবেশ করলেন। আবু জেহেল পুত্র ইকরামা ও উমাইয়ার পুত্র সাফওয়ান গোত্র প্রধান হিসেবে সামান্য প্রতিরোধ করেছিলেন ফলে কিছু সংখ্যক মুসলমান নিহত হয়েছিলেন। তৎক্ষণাৎ সেনাপতি খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে কৈফিয়ত দেবার জন্যে হাজির করা হল। খালিদ উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেন, ‘মহাত্মন! আমি আপনার আদেশ প্রতিপালন করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এরা কোন মতেই নিরস্ত হল না। তারা প্রথমে আমাদের আক্রমণ করে এবং দু‘জন মুসলমানকে হত্যা করে ফেলে। তখন অগত্যা আমাকেও অস্ত্র চালনা করতে হয়েছিল। কিন্তু হে রহমাতুল-লিল-আল আমিন! আপনি তদন্ত করে দেখুন, যাতে এই সংঘর্ষে অধিক প্রাণহানি না হয়, সেজন্যে আমি সর্বদাই যৎপরোনাস্তি সংযত ও সঙ্কুচিত হয়ে সৈন্য চালনা করেছি।’
এই দু‘একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রায় বিনা প্রতিরোধেই মুহম্মদ মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন।
সমাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন