যখন মেসোপটেমিয়ার ব-দ্বীপটির উপরিভাগে সেমিটিক উপনিবেশিকদের প্রধানদল সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠল, তখন তাদের একটি দলের মধ্যে হযরত আইয়ূব জন্মগ্রহণ করলেন। আইয়ূব আল্লাহকে ভয় করতেন এবং সর্বদা দ্বীনের উপর কায়েম থাকতেন। তার সাত পুত্র সন্তান ও তিন কন্যা সন্তান ছিল। তিনি ছিলেন সম্পদশালী। চাষাবাদের পাশাপাশি পশুপালন ছিল তার আয়ের প্রধান উৎস। মূলতঃ তার এই পশুপাল ও চাষবাসের জন্যে তার প্রচুর দাসদাসীও ছিল। পরিবার ও সন্তানদের মঙ্গলের জন্যে তিনি প্রায়ই আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবাণী দিতেন। বলা চলে নিতান্ত সুখের মধ্যে দিয়েই তিনি জীবন-যাপন করছিলেন। তার এই সুখের দিনগুলির বর্ণণা তার নিজের মুখে এরকম-
‘সর্বশক্তিমান খোদা আমার সঙ্গে রয়েছেন,
আর আমার সন্তান-সন্তুতিরা আমায় ঘিরে রয়েছে।
আমার জীবন-যাপন আরাম-আয়েশে পূর্ণ।
যখন আমি শহরের ফটকে গিয়ে চকে আসন গ্রহণ করি,
তখন যুবকেরা আমায় দেখে সরে দাঁড়ায়,
আর বৃদ্ধরা উঠে দাঁড়ায়,
নেতাদের গলারস্বর থেমে যায়,
আর সকলে আমার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করে,
আমার পরামর্শের জন্যে নীরব থাকে,
আমার কথার পরে তারা আর কথা বলে না।
সকলেই আমার প্রশংসা করে,
যারা আমার কথা শুনে তারা নিজেকে ধন্য মনে করে।
কারণ আমি অন্ধদের দৃষ্টি আর খঞ্জদের শক্তি
অনাথ ও অভাবীদের পিতার মত।
আমি বিদেশীদের পক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করি,
আর দুষ্টদের চোয়াল ভেঙ্গে দিই,
সত্যি বলতে কি, সৈন্যদলের মধ্যে রাজা যেমন,
আমি তেমনই।’
আইয়ূবের খোদা ভক্তি দেখে ইবলিস মনে মনে বলত, ‘ওহে আইয়ূব, তুমি কি এমনি এমনি তাঁকে ভক্তি কর? তিনি কি তোমার গৃহ ও গৃহস্থলীর সবকিছূ তাঁর রহমতে সিক্ত রাখেননি? তাঁর করুণা ও রহমতের কারণে কি তোমার পশুপাল এমন অসাধারণ বৃদ্ধিলাভ করেনি?'
ইবলিস জানত সাধারণ মানুষকে বরবাদ করতে পারলেও কোন নবীকে বরবাদ করার ক্ষমতা তার নেই। তাদের উপর তার কোন প্রভাব খাটবে না। আদমকে দুনিয়াতে পাঠানোর আগে তাকে এটা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমার দাসদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।-(১৭:৬৫) বা, আমার দাসদের ওপর তোমার কোন প্রভাব খাটবে না।’-(১৫:৪২) সুতরাং সে ভাবল- 'আমি তার সন্তান ও সম্পদের উপর একে একে আঘাত করি না কেন! দেখি না সে কেমন করে খোদার উপর বিশ্বাসে অটল থাকে?’
ইবলিস আইয়ূবের উপর একের পর এক আঘাত হানল এবং তাকে একদিনেই হিরো থেকে জিরো করে দিল। এমন একদিনে এই আঘাতগুলো আইয়ূবের উপর দু:স্বপ্ন আকারে এল যেদিন তার সন্তানগণ সকলে নিমন্ত্রণে অন্যত্র ছিল। আর অদ্ভূত ব্যাপার ছিল এই যে, প্রতিটি দু:সংবাদ তার একজন দাস বয়ে নিয়ে এসেছিল, যে কিনা একমাত্র ঐ আঘাত থেকে রক্ষা প্রাপ্ত ব্যক্তি।
প্রথম দু:সংবাদটি আইয়ুব পেলেন দুপুর বেলা। সংবাদ বহনকারী দাস জানাল যে, শিবায়ীয়েরা হানা দিয়ে তার গাধার পাল লুট করেছে, এমনকি জমি চাষে রত ষাড়গুলিও। আর হত্যা করেছে সকল দাসদেরকে। প্রথম দাস তখনও কথা বলছিল ঐসময় দৌঁড়ে এল আরেক দাস। সে জানাল যে, ‘বজ্রপাতে তার ভেড়ার পাল আর দাসেরা নিহত হয়েছে। তারপর এল আর একজন। সে জানাল যে, কলদীয়রা তার উটগুলোকে লুট করেছে আর সকল দাসদের হত্যা করেছে। অত:পর এল মহা দু:সংবাদ। নিমন্ত্রিতের বাড়ীটি ধ্বসে পড়ায় ভোজেরত অবস্থায় তার সকল সন্তান নিহত হয়েছে।
যাহোক, আইয়ূব সব দুঃসংবাদগুলো শান্তভাবে পাথরের মত হয়ে শুনলেন। এসময় আগত দাসেরা একপাশে নিজেদেরকে অপরাধী ভেবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি তা লক্ষ্য করে তাদেরকে বললেন, ‘তোমাদের কুন্ঠিত হবার কোন কারণ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন তা কেবল মঙ্গলের জন্যেই করেন।’
অতঃপর শোকের চিহ্ন হিসেব আইয়ূব তার কাপড় ছিঁড়লেন এবং মাথা কামিয়ে ফেললেন। তারপর খোদার কাছে অন্তরের ভক্তি জানিয়ে বললেন, ‘হে আমার প্রভু! আমি তোমার শোকর আদায় করি এ কারণে যে, তুমি আমাকে সহায়-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দান করেছিলে। এদের মহব্বত আমার অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এরপর এখন আমি এ কারণে শোকর করছি যে, তুমি আমাকে এসব থেকে মুক্তি দিয়েছ। আমার ও তোমার মধ্যে এখন কোন অন্তরায় অবশিষ্ট নেই।’
কোন একদিন ফেরেস্তা জিব্রাইলের সঙ্গে ইবলিসের দেখা হল। জিব্রাইল বলল, ‘হে ইবলিস! আইয়ূব, পুণ্যবানদের একজন। যদিও তুমি বিনা কারণে তার সর্বনাশ করছ, তবুও সে বিশ্বাস ও ভক্তিতে অটল রয়েছে।’
ইবলিস বলল, ‘মানুষের জীবনই তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। মানুষ তার নিজ প্রাণ রক্ষার জন্যে তার যাকিছূ আছে সবই দেবে। কিন্তু আল্লাহর নির্বাচিত দাসদের উপর আমার কোন ক্ষমতা নেই। নইলে তার ঈমান ঠিকই বিনষ্ট করে দিতাম।’
জিব্রাইল বলল, ‘তা সত্য। কিন্তু ক্ষমতা যদি তিনি তোমাকে দিতেনও, তদুপরি তাদের ঈমান এমন ঠুনকো নয় যে ইচ্ছে করলেই তুমি তা বিনষ্ট করতে পারতে।'
ইবলিস বলল, 'সেটা আর প্রমান করতে পারছি কৈ! আহা! যদি আমি একটি বারের মত ঐ ক্ষমতা পেতাম!'
তখন ইবলিসকে জানান হল- আইয়ূবের উপর সে (ইবলিস) পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে-প্রাণ হরণ ব্যতিত।এতে ইবলিস আইয়ূবের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য এক পরিকল্পণা করল। সে তার মাথার তালু থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত ঘায়ের সৃষ্টি করল। যন্ত্রণায় আইয়ূব অস্থির হয়ে পড়লেন। এদিকে ঘা থেকে পুঁজ বেরিয়ে আসতে লাগল। এসময় তিনি শরীরে ধূলো মেখে বসে থাকতেন আর মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরো দিয়ে ঘা থেকে পুঁজ বের করতেন। আস্তে আস্তে তার গায়ের মাংস খসে পড়তে লাগল। দুর্গন্ধে কেউ তার নিকটে যেতে পারত না।
তৈমনীয় ইলীফস, শূহীয় বিল্দদ ও নামাথীয় সোফর -আইয়ূবের এই তিন বন্ধু তার বিপদের কথা শুনতে পেয়েছিল। তখন তারা তাকে সান্তনা দেবার জন্যে এল। তাদের কেউই দূর থেকে আইয়ূবকে চিনতে পারল না এবং কাছে গিয়ে তার অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগল এবং নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে আকাশের দিকে ধূলো ছড়াল। তারা তার কষ্ট অনুভব করল এবং সান্তনার ভাষা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকল। এসময় আইয়ূব বিলাপের সুরে বললেন- আমি কেন গর্ভে থাকতে মরিনি? কেনইবা জন্মেই মরলাম না? তা হলে তো আমি এখন, শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারতাম; আমি ঘুমাতাম আর বিশ্রাম পেতাম। আজ দীর্ঘ নিঃশ্বাসই আমার সঙ্গী, আমার কষ্ট বর্ষার মত ঝরছে; আমার শান্তি নেই, স্থিরতা নেই, কোন বিশ্রাম নেই, আছে কেবল কষ্ট।’
এসব কথা শুনে তার বন্ধু তৈমনীয় ইলীফস তাকে বলল- 'ভেবে দেখ, কতজনকে তুমি উপদেশ দিয়েছ আর দূর্বল হাতকে সবল করেছ; কিন্তু এখন তোমার নিজের উপরই কষ্ট এসেছে, আর তুমি হতাশ হয়েছ। তুমি যে আল্লাহকে ভক্তিপূর্ণ ভয় কর, তাতে কি তুমি আশ্বাস পাও না? নির্দোষ কখনও কি ধ্বংস হয়েছে? সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সংশোধন করেন; কাজেই সর্বশক্তিমানের শাসনকে তুচ্ছ কোরও না। কারণ তিনি ক্ষত করেন আবার বেঁধেও দেন, আর সুস্থ্যতা তাঁরই দয়া।’
তখন আইয়ূব বলতে লাগলেন- ‘আল্লাহর ভয়ংকর কাজগুলো আমার বিরুদ্ধে সাঁরি বেঁধে দাঁড়িয়েছে, নিজেকে সাহায্য করার শক্তি আমার নেই, আমার কাছ থেকে তো আমার সবকিছু দূর করা হয়েছে; পোঁকা আর ঘাঁয়ের মামড়িতে আমার দেহ ঢাকা পড়েছে।আমার চামড়া ফেঁটে গেছে এবং পূঁজ পড়ছে; আমার দিনগুলো তাঁতীর মাকূর চেয়েও তাড়াতাড়ি চলছে, কোন আশা ছাড়াই সেগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। যখন ভাবি আমার শয্যা আমাকে সান্তনা দেবে, তখন নানা দুঃসপ্ন আমাকে ভীত করে তোলে।’
এসময় শূহীয় বিলদদ বলল- ‘ঠিক কথা, আমি জানি এসবই সত্যি। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কি করে মানুষ নির্দোষ হতে পারে? আমি তো সর্বদাই তাঁর দৃষ্টিতে, কিন্তু আমার দৃষ্টি তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না, তিনি যদি ছিনিয়ে নেন, কে তাঁকে বাঁধা দিতে পারে? কে তাঁকে বলতে পারে- তুমি কি করছ?’
আইয়ূব বললেন- ‘তাহলে কেমন করে আমি তাঁর কথার উত্তর দেব? তাঁকে বলার জন্যে কোথায় ভাষা খুঁজে পাব? আমি নিজেকে নির্দোষ ভাবলেও উত্তর দিতে পারিনে, আমি বিচারকের কাছে কেবল দয়াই ভিক্ষে করব।’
নামাথীয় সোফর বলল-‘তুমি বলেছ তোমার ধর্ম বিশ্বাসে কোন খূঁত নেই এবং তাঁর দৃষ্টিতে তুমি খাঁটি। আ-হা, আল্লাহ যেন কথা বলেন, আর জ্ঞানের গোপন বিষয়গুলো তোমাকে জানান; এটা জেনে রেখ, কারও পাপ অনুসারে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন না।’
আইয়ূব উত্তরে বললেন- 'তুমি যা বলেছ কে তা না জানে? পশুদের জিজ্ঞেস কর, তারা তোমাকে শেখাবে, আকাশের পাখীদের বল, তারাও তোমাকে বলে দেবে; পৃথিবীকে, সেও তোমাকে শেখাবে, সাগরের মাছেরাও তোমাকে বলে দেবে এরা সবাই জানে আল্লাহর শক্তিই এসব করেছে।
অন্ধকারের লুকান বিষয়গুলো তিনি প্রকাশ করেন, আর ঘন ছায়াকে আলোতে আনেন। তাঁর মহিমা কি তোমাদের ভয় জাগায় না? তাঁর ভয়ংকরতায় কি তোমরা ভীত হও না? আমি জানি আমার মুক্তিদাতা জীবন্ত, শেষে তিনি পৃথিবীর উপর এসে দাঁড়াবেন আমার চামড়া ধ্বংস হয়ে যাবার পরও আমি জীবন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পাব।’
আইয়ূব যখন এসব বলছিলেন তখন তার বন্ধুদের কেউই তার কথার উত্তর দিল না। এসময় রামের বংশের বৃষীয় ইলীহূ ইবনে বারখেল যে আইয়ূবের বন্ধুদের সাথে এসেছিল, বলল-‘কিন্তু আমি আপনাকে বলি এ বিষয়ে আপনার কথা ঠিক না; কারণ মানুষের চেয়ে আল্লাহ মহান। কেন আপনি তাকে এ অভিযোগ জানাচ্ছেন যে, মানুষের কোন কথার উত্তর তিনি দেন না? আসলে আল্লাহ নানাভাবে কথা বলেন, যদিও মানূষ তা বুঝতে পারে না, স্বপ্নের মধ্যে যখন তাদের নিদ্রা গাঢ় হয়, তিনি তখন তাদের কানে কানে কথা বলেন আর সাবধান বাণী দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করেন, যেন মানুষ তার দুস্কর্ম থেকে ফেরে, আর অহংকার থেকে দূরে থাকে।
যখন মানুষ রোগ যন্ত্রণায় শাস্তি পায়, তখন ফেরেস্তাগণ চিৎকার করে বলেন- ‘হে আল্লাহ! দোযখের শাস্তি থেকে তাকে রেহাই দাও।’
সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তিনি তাকে দয়া করেন, আল্লাহ মানুষের জন্যে বারবার এসব করেন।
আল্লাহ মানুষকে তার কর্মফল দেন; সর্বশক্তিমান কখনও উল্টো বিচার কবেন না, পৃথিবীর ভার কি কেউ তাঁর উপর দিয়েছে? মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর তাঁর দৃষ্টি রয়েছে, তাদের প্রতিটি কর্ম তিনি দেখেন। এমন কোন অন্ধকার জায়গা বা ঘনছায়া নেই যেখানে পাপীরা লুকাতে পারে।
মানুষ যদি পাপ করে তাতে আল্লাহর কি লাভ হবে? সে যদি নির্দোষ হয় তাতেই বা তাঁর কি উপকার হবে? মানুষের কাছ থেকে তিনি কিছুই চান না, তাদের দুষ্টতা কেবল তাদেরই ক্ষতি করে, তাদের নামাজ, রোজা, সততা কেবল তাদেরই সাহায্য করে।আল্লাহ তো তার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষকেই বেশী শিক্ষা দিয়েছেন, আকাশের পক্ষী বা জমিনের পশু কি মানুষের চেয়ে জ্ঞানী? আল্লাহ ক্ষমতায় মহান, তাঁর মত শিক্ষক আর কে আছে?’
এসময় আল্লাহ আইয়ূবকে বললেন,- যখন পৃথিবীর গর্ভ থেকে সমুদ্র বের হয়ে এসেছিল, তখন কে তাকে আবদ্ধ করেছিল? তখন আমি মেঘকে তার পোষাক করেছিলাম, আর তার সীমা ঠিক করেছিলাম, তার দ্বার ও আর্গল আমি স্থাপন করেছিলাম; আর আমি বলেছিলাম, এ পর্যন্ত, আর নয়, এখানেই তোমার গর্বিত ঢেউগুলোকে থামতে হবে।
দোযখ তোমাকে দেখান হয়েছে কি? জগৎটা কত বড় তা কি তুমি ধারণা করতে পার? যে স্থান থেকে আলো ছড়িয়ে যায়, কিংবা যে স্থান থেকে পৃথিবীতে পূবের বায়ূ ছড়িয়ে পড়ে তা কোথায়?
বজ্রপাত ও বৃষ্টির জন্যে কে পথ করেছে? যাতে জনশুণ্য স্থান বৃষ্টি পায়, মরুএলাকা তৃপ্ত হয়, আর সেখানে ঘাস, লতা-গুল্ম উদ্গত হতে পারে?
তুমি কি কৃত্তিকা নামের তাঁরাগুলোকে বাঁধতে পার? কালপুরুষ নামের তাঁরাগুলোর বাঁধন খুলে দিতে পার? তাঁরাপুঞ্জকে তাদের ঋতু অনুসারে বের করে আনতে পার? আকাশের আইন কানুন কি তুমি জান?
কে অন্তরকে জ্ঞান দিয়ে সাঁজিয়েছে? কিংবা মনকে বোঝার শক্তি দিয়েছে? দাঁড় কাকের বাচ্চারা যখন খোদার কাছে কাঁদে, আর খাবারের জন্যে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ায়, তখন কে তাদের আহার জোগায়? পাহাড়ী ছাগ কখন বাচ্চা দেয় তা কি তুমি জান? তাদের বাচ্চা কত দিন গর্ভে থাকে তা কি গুনেছ?
তোমার আদেশে কি ঈগল আকাশে উড়ে? সে খাঁড়া পাহাড়ের উপর বাস করে, সেখান থেকে সে খাবারের অন্বেষণ করে, তার দৃষ্টি দূর থেকে তার শিকার খুঁজে নেয়। তাহলে আমার সম্মুখে কে দাঁড়াতে পারে? আমার বিরুদ্ধে এমন কার দাবী আছে যে, তার দাবী আমাকে মানতে হবে? উপরে আকাশ, নীচে জমিন এবং এ দু‘য়ের মাঝে যাকিছু আছে -সবই আমার সৃষ্টি, কোন কিছুই আমার অপরিজ্ঞাত নয়।’
আইয়ূব বললেন,- ‘আমি তো অযোগ্য, আমি কেমন করে তোমাকে উত্তর দেব? কাজেই আমি যা বলেছি তা এখন ফিরিয়ে নিচ্ছি আর ধূলো ও ছাইয়ের মধ্যে অনুতাপ করছি।’
আইয়ূবের বন্ধুরা সাতদিন তার সাথে থাকল, তারপর তারা ফিরে গেল।
উত্তোরোত্তর আইয়ূবের অবস্থার অবনতি হতে লাগল। এতে দুর্গন্ধে কেউ তার কাছে যেতে পারত না। প্রথম পর্যায়ে তার পরিবারের লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করল। পরবর্তীতে চাকর-বাকরেরা। ফলে রহিমা স্বামীকে নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়ল। কিন্তু এ-ই শেষ ছিল না। প্রতিবেশীরা রহিমাকে হুমকি দিল, ‘তোমার স্বামীকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও। দুর্গন্ধে এখানে আমরা বাস করতে পারছিনে।’
সে বলল, ‘তাকে আমি কোথায় নিয়ে যাব? তোমরা আমাদের প্রতি একটু রহম কর।’
তারা বলল, ‘তোমাদের কারণে আমরাও অসুস্থ্য বা আক্রান্ত হয়ে পড়ি এই কি তোমাদের অভিপ্রায়? তা না হলে আমাদের থেকে দূরে সরে যাও, যেখানে খুশী। আমরা স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলি।’
প্রতিবেশীরা জোরপূর্বক তাদেরকে বাড়ী থেকে বের করে দিল। তারপর তাদের আবাসগৃহ আসবাবপত্র সব পুড়িয়ে দিল। তখন স্বামীকে নিয়ে রহিমা একটু নির্জন স্থানে গেল। কিন্তু নিকটবর্তী গ্রামবাসীরাও তাদেরকে তাড়িয়ে দিল। তারা এসে বলল, ‘তোমার স্বামীর এই রোগে আমরাও আক্রান্ত হয়ে পড়ব, আর তাতে গ্রামটা উজাড় হয়ে যাবে?’
সে বলল, ‘এই রোগ ছোঁয়াচে নয়, এই তো আমি সম্পূর্ণ সুস্থ্য।’
তারা বলল, ‘সুস্থ্য লোক অসুস্থ্য হতে কতক্ষণ?’
রহিমা স্বামীকে অন্য এক স্থানে নিয়ে গেল। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদেরকে সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিল। এভাবে একে একে সাতবার স্থান পরিবর্তনের পর অবশেষে জঙ্গলে আশ্রয় নিল তারা। সহায়-সম্বলহীন।
নিজের পরিচয় গোপন রেখে রহিমা নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে সেখান থেকে সে কাজের বিনিময়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে লাগল। একদা যার গৃহ প্রাচূর্যে ভরপুর ছিল, আজ্ঞা পালনে যার ছিল অসংখ্য দাস-দাসী ছিল, আজ সে দাসীর মত অন্যের গৃহে কাজ করছে। কিন্তু রহিমার এতে কোন আক্ষেপ নেই। সে সুবোধ বালিকার মত প্রতিদিন শ্রমের বিনিময়ে আহার সংগ্রহ শেষে ফিরে এসে অবশিষ্ট সময় স্বামীর পরিচর্যা করতে লাগল।
ইতিমধ্যে দিন, মাস, বৎসর গড়িয়ে যাচেছ। নিকটবর্তী গ্রামে, লোকদের গৃহে গৃহে দাস্যকর্মের দ্বারা খাবার সংগ্রহ করা এখন রহিমার নিত্যদিনের কাজ। একদিন সে যখন খাবার সংগ্রহ শেষে ব্যস্ততা সহকারে গৃহে ফিরছিল, তখন এক বৃদ্ধের বেশে ইবলিস তার ফেরার পথের পাশে বসে রইল। অতঃপর রহিমা যখন নিকটবর্তী হল, তখন সে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মা, আমি বড় ক্ষুধার্ত। একমুষ্ঠি খাবার আমাকে দাও।’
রহিমার কাছে যে খাবার ছিল তা তাদের দু‘জনের কোনমতে চলত। বৃদ্ধকে খাবার দিলে তাকে অনাহারে থাকতে হবে, তবুও সে এই ক্ষুধার্ত বৃদ্ধকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারল না। সে এগিয়ে এল এবং তার অংশের খাবার বৃদ্ধকে দিল। বৃদ্ধের আরও খাবার বা পানির দরকার হতে পারে ভেবে সে চলে যেতে পারল না। সুতরাং সে একপাশে বসে নীরবে তার খাওয়া দেখতে লাগল, আর তার মন পড়ে রইল অসুস্থ্য স্বামীর কাছে। খেতে খেতে বৃদ্ধ বলল, ‘মা, তোমাকে এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?’
রহিমা সংক্ষেপে তাকে তার দুঃখের কথা জানাল। সব শুনে বৃদ্ধ বলল, ‘আমি একটা ঔষধের কথা জানি। কিন্তু তুমি কি তা ব্যাবহার করতে পারবে?’
রহিমা বলল, ‘আমি আমার স্বামীর জন্যে সবকিছু করতে পারব, বাবা।’
বৃদ্ধ বলল, ‘তুমি যদি দ্রাক্ষারস দ্বারা তোমার স্বামীর শরীর ধৌত করে দিতে পার, আর যদি তাকে কিছূ শুকরের মাংস ভক্ষণ করাতে পার, তবে অচিরেই তার রোগের উপশম হবে।’
রহিমা তখন দ্রুত গৃহে ফিরে স্বামীকে সকল কথা বলল এবং তাকে ঐ ঔষধ ব্যাবহারের জন্যে পীড়াপীড়ি করল। আইয়ূব তা করতে অস্বীকার করলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, ‘জীবন থাকতে আমি কখনও নিষিদ্ধ ও অপবিত্র বস্তুর সংস্পর্শেও যাব না। নিশ্চয়ই শয়তান তোমাকে প্ররোচিত করেছে।’
একথা শুনে রহিমা তাকে আর পীড়াপীড়ি করল না।
সাত বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের কোন মুহূর্তেই আইয়ূব হা-হুতাশ, অস্থিরতা ও অভিযোগের কোন বাক্য মুখে উচ্চারণ করেননি। তিনি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছেন আল্লাহর রহমতের। কিন্তু তিনি নিজের জন্যে আল্লাহর কাছে কোন দোয়া করেননি। তিনি দোয়া করার হিম্মত করতেন না এই ভেবে যে, না জানি সবরের কোন খেলাফ হয়ে যায়। একদিন পত্নী রহিমা তাকে বলল, ‘তোমার কষ্ট অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে নিজের জন্যে প্রার্থণা কর।’
আইয়ূব বললেন, ‘নিজের জন্যে আল্লাহর কাছে এসময় কিছু চাইতে আমার লজ্জা লাগছে। আমি সত্তুর বৎসর সুস্থ্য অবস্থায় আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত ও দৌলতের মধ্যে দিনাতিপাত করেছি। এর বিপরীতে মাত্র সাত বৎসর আমি শয়তানের পরীক্ষায়। অন্ততঃপক্ষে সত্তুর বৎসর অতিবাহিত না করে আমি নিজের জন্যে কিভাবে কিছু চাইতে পারি?’
এদিকে ইবলিস যখন দেখল যে সে কিছুতেই আইয়ূবের সবরের খেলাফ করতে পারছে না। তখন সে মানুষের বেশে আশে পাশের গ্রামের প্রতিটি গৃহে জানিয়ে দিল-‘তোমাদের এখানে যে স্ত্রীলোকটি মাঝে মাঝে এসে কাজকাম করে খাবার সংগ্রহ করে, তার স্বামী দূরারোগ্য ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। এখন যদি তোমরা তাকে তোমাদের গৃহের কাজে লাগাও তাহলে তোমরাও ঐ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। আমি তোমাদের ভালোর জন্যেই বলছি।’
সুতরাং রহিমাকে আর কোন গৃহে কাজের জন্যে নেয়া হল না। সারাদিন লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে তিনি যখন ক্লান্ত তখন এক গৃহিনী নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে তাকে কাজে লাগাল এবং বলল, ‘তোমার অসহায় অবস্থা জানি বলেই আজকের মত কাজে লাগালাম। কিন্তু এই শেষ, তুমি আর আমাদের বাড়ীতে আসবে না।’
পরদিন রহিমা অন্য গ্রামে গেল খাবারের সন্ধানে। কিন্তু সেখানকার লোকেরাও তাকে তাড়িয়ে দিল। একসময় ঘুরতে ঘুরতে সে যে বাড়ীতে এল ঐ বাড়ীর কর্ত্রী বলল, ‘তোমার জন্যে আমার বাড়ীতে কোন কাজ নেই।’
রহিমা বলল, ‘আজ কাজ না পেলে আমার অসুস্থ্য স্বামীকে অনাহারে থাকতে হবে। তাই দয়া করে আমাকে কাজ দিন অথবা কিছু ধার দিন। আমি আপনার দেনা পরিশোধ করে দেব।’
সে বলল, ‘তোমার নেই চালচুলো। তোমাকে কিভাবে আমি ধার দেব?’
রহিমার চুলের প্রতি নজর পড়ল তার। তখন সে বলল, ‘তবে তুমি যদি কিছু বিক্রি করতে চাও তা আমি কিনতে পারি।’
রহিমা বলল, ‘আমার কিছুই নেই। আমি কি বিক্রি করব?’
সে বলল, ‘তোমার চুল। আমি খোপা তৈরী করব? বিনিময়ে আমি তোমাকে চাল দেব। তুমি রাজী হলে আমি না হয় কিছু বেশীই দেব। তাতে তেমাদের বেশ কিছুদিন চলে যাবে।’
রহিমা অপূর্ব সুন্দর লম্বা চুলের অধিকারী ছিল, যার প্রশংসা করতেন আইয়ূব সবসময়। তার চোখ ভিজে উঠল। দু‘ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে স্ত্রীলোকটি বলল, ‘তুমি বেঁচতে না চাইলে নাই।’
রহিমা দ্রুত বলল, ‘না, তা নয়। আমার এই চুল ধরে আমার অসুস্থ্য স্বামী উঠে দাঁড়ায়, একস্থান থেকে অন্যস্থানে যায়।..’
স্ত্রীলোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাহলে বরং তুমি তোমার মাথার অর্ধেকটা চুল বিক্রি কর। তাতে তোমার স্বামীর কাজও চলবে, খাবারও পাবে। আমি তোমাকে ঠকাব না।’
কোন বিকল্প ছিল না। তাই রহিমা রাজী হল এবং মাথার অর্ধেকটা চুলের বিনিময়ে খাবার সংগ্রহ শেষে গৃহ অভিমুখে রওনা হল।
এদিকে শয়তান দেখল রহিমার কারণে আইয়ূব এখনও ঈমানে কায়েম রয়েছে। তাই তাদের দু‘জনের বিশ্বাসের মধ্যে ফাঁটল সৃষ্টির চেষ্টায় মনোযোগ দিল সে। সে এক বৃদ্ধের বেশে আইয়ূবের কাছে এল। অতঃপর তাকে বলল, ‘আপনি আল্লাহর একজন নবী। এত কঠিন বিপদাপন্ন অবস্থায়ও আপনি ঈমানে অটুট রয়েছেন। কিন্তু সবকিছু মাটি হয়ে যাচ্ছে আপনার স্ত্রীর কারণে। আপনি তো খবর রাখতে সক্ষম নন- এই সুযোগে আপনার স্ত্রী আপনাকে হারাম খাবার খাওয়াচ্ছে। গ্রামে গিয়ে সে অসৎ কার্য্য এবং চুরি করে খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আজ চুরির সময় সে ধরা পড়েছে। আর গ্রামের লোকেরা এই অপরাধে তার মাথার চুল অর্ধেকটা কেটে নিয়েছে।’
একথা শুনে আইয়ূব দু:খ-লজ্জায় মর্মাহত হলেন। তারপর রহিমা যখন ফিরে এল, তিনি দেখতে পেলেন যে তার চুল সত্যিই অর্ধেকটা কাটা। তিনি ভীষণ রেগে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমার চুরি করে আনা কোন খাবার আমি স্পর্শ করব না।’
রহিমা তার স্বামীকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আইয়ূব তার কোন কথাই শুনতে চাইলেন না। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি এই অপরাধে আমি সুস্থ্য হয়ে তোমাকে অবশ্যই এক‘শ দোররা মারব।’
তিনি রহিমার আনা সমস্ত খাবার ছুঁড়ে ফেললেন।
এত লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের পর সংগ্রহ করে আনা খাবার চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত নয়নে রহিমা সেদিকে তাকিয়ে রইল।
স্বামীর ব্যাবহারে অত্যন্ত দু:খিত হয়ে রহিমা নিজের নির্দোষিতার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে বিচার প্রার্থণা করল। আইয়ূব ও তার পরিবারের এমন দূরাবস্থার কথাই যেন কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- তোমরা কি মনে করেছ যে (এমনই কেবল মুখের কথায়) স্বর্গে গমন করবে? অথচ এখনও তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের (নবী ও তার সহচরবর্গের) অবস্থায় উপনীত হওনি। বিপদের উপর বিপদ এবং আঘাতের উপর আঘাত তাদেরকে স্পর্শ করেছিল, (এমন কি তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত সমূলে) প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল।-(২:২-১০)
এদিকে দু‘দিন অতিবাহিত হল, উভয়েই অনাহারে। এসময় আল্লাহ জিব্রাইলকে প্রেরণ করলেন। সে এসে আইয়ূবকে সকল ঘটনা অবহিত করার পর বলল, ‘এখন আল্লাহর কাছে তোমার নিজের জন্যে দোয়া কর। তিনি তা কবুল করবেন।’
আইয়ূবের এই অবস্থা যেন যবুরের এই সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে-
খোদা, তোমার ক্রোধে আমাকে ভর্ৎসনা কোরও না,
তোমার রোষাগ্নিতে আমাকে শাস্তি দিও না।
কেননা তোমার তীরসকল আমাতে বিদ্ধ,
আমার উপর তোমার হস্ত নেমেছে।
তোমার কোপ হেতু আমার অস্থিতে কোন মাংস নেই,
আমার শোক হেতু আমার মনে কোন শান্তি নেই।
কেননা আমার শাস্তিসমূহ আমার মাথার উপর উঠেছে, ভারী বোঝার ন্যায়,
সেসকল আমার শক্তি অপেক্ষা ভারী।
আমার ক্ষতসমূহ দুর্গন্ধ ও গলিত হয়েছে, আমার অজ্ঞানতা প্রযুক্ত।
আমি কুব্জ হয়েছি, অতি নুয়ে পড়েছি, আমি সারাদিন বিষন্ন ঘুরছি।
কেননা আমার কটিদেশে জ্বালা ধরেছে, আমার অস্থিতে কোন মাংস নেই।
আমি অবসন্ন ও অতিক্ষুন্ন হয়েছি, চিত্তের ব্যকুলতায় আর্ত্তনাদ করছি।
হে প্রভু, আমার সমস্ত কামনা তোমার সামনে,
আমার কাতরোক্তি তোমার কাছে গুপ্ত নয়।
আমার হৃদয় ধুঁকছে, আমার শক্তি নি:শেষ হয়েছে,
আমার চোখের জ্যোতিও আমাকে ছেড়ে গিয়েছে।
আমার প্রণয়ীরা ও আমার বন্ধুগণ আমার ব্যাধি হতে দূরে দাঁড়ায়,
আমার জ্ঞাতিবর্গ দূরে সরে থাকে।
যারা আমার প্রাণের অন্বেষণ করে, তারা ফাঁদ পাতে;
যারা আমার অনিষ্ট চায়, তারা বিনাশের কথা কহে,
আর সমস্ত দিন ছলের চিন্তা করে।
কিন্তু বধিরের মত আমি শুনিনে, বোবার মত আমি মুখ খুলিনে।
আমি তার মত, যে শুনতে পায় না, যার মুখে প্রতিবাদ নেই।
কারণ খোদা, আমি তোমারই অপেক্ষা করছি;
হে প্রভু, আমার উপাস্য, তুমিই উত্তর দেবে।
কেননা আমি বললাম, পাছে ওরা আমার বিষয়ে আনন্দ করে,
আমার চরণ টললেই আমার বিপক্ষে দর্প করে।
আমি তো পড়তে পড়তে উদ্যত;
আমার ব্যথা সতত আমার গোচরে রয়েছে।
আমি নিজের অপরাধ স্বীকার করব, আমার পাপের দরুন খেদ করব।
কিন্তু আমার শত্রুগণ সতেজ ও বলবান, অনেকেই অকারণে আমাকে ঘৃণা করে।
আর তারা উপকারের বদলে অপকার করে,
তারা আমার বিপক্ষ, কারণ যা ভাল আমি তারই অনুগামী।
খোদা, আমাকে পরিত্যাগ কোরও না;
আমার প্রতিপালক, আমা হতে দূরে থেক না।
হে প্রভু, আমার পরিত্রাণ, আমাকে সাহায্য করতে সত্ত্বর হও। (৩৮:১-২২)
অতঃপর স্ত্রীর প্রতি এই অবিচারে আইয়ূব নিদারুণ মানষিক কষ্টে পড়লেন। তিনি তৎক্ষণাৎ শয়তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন এবং নিজের জন্যে প্রার্থণা করলেন, বললেন-‘হে আমার প্রতিপালক! শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে। আমি তার হাত থেকে বাঁচতে তোমার আশ্রয় প্রার্থণা করছি।’
আল্লাহ তার প্রার্থণা কবুল করলেন এবং তাকে জানালেন- ‘তুমি তোমার পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, স্নান ও পান করার জন্যে সুশীতল পানি পাবে।’
আইয়ূব পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করলেন। সেখানে তৎক্ষণাৎ একটি প্রস্রবণের সৃষ্টি হল। তিনি সেই পানিতে স্নান করলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ্য হয়ে গেলেন। তার চেহারায় লাবণ্য ও মাধুর্য ফিরে এল। স্নান সেরে পরিস্কার বস্ত্র পরিধান করে তিনি কাছেই এক বৃক্ষতলে বসে কৃতজ্ঞতাভরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় নিমগ্ন হলেন। কোরআনে রয়েছে-‘আমার দাস আইয়ূবের কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল- ‘শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে।’
আমি তাকে বললাম- ‘তুমি তোমার পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, এ তো স্নান ও পান করার জন্যে সুশীতল পানি।’-(৩৮:৪১-৪৩)
আইয়ূব যখন সুস্থ্য হলেন, তখন তার স্ত্রী সেখানে ছিল না। অনাহারী স্বামীর জন্যে পুনঃরায় খাদ্য জোগাড় করতে সে গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। অতঃপর ফিরে এসে যথাস্থানে স্বামীকে না দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে ধারণা করল তার স্বামীকে হয়তঃ কোন বন্যপশুতে খেয়ে ফেলেছে। সেখানে বসে সে বিলাপ করতে লাগল।
ক্রন্দনরত অবস্থায় হঠাৎ চোখ তুলতেই একটু দূরে এক ব্যক্তিকে উপবিষ্ট দেখতে পেল রহিমা। সে তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে গেল। লোকটি চক্ষু মুদে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। রহিমা তাকে বিলাপের সূরে দ্রুত জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে যে রোগাক্রান্ত লোকটি পড়ে থাকত, আপনি কি তাকে দেখেছেন?’
স্ত্রীর উৎকন্ঠিত কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে আইয়ূব তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভালকরে দেখ, আমিই তোমার স্বামী। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন এবং আমাকে নতুন স্বাস্থ্য দান করেছেন। এখন কাঁদছ কেন আমাকে বল?’
রহিমা তখন তার স্বামীকে চিনতে পেরে তাকে জড়িয়ে ধরল। অতঃপর সে আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। একসময় আইয়ূব তাকে বললেন, ‘তুমি কি ভুলে গেছ আমার প্রতিজ্ঞার কথা?’
রহিমা খুশীমনে তার স্বামীকে তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে বলল। তখন আল্লাহ আইয়ূবকে জানালেন -‘এই ধৈর্য্যশীলা, কৃতজ্ঞা ও পতিপরায়ণা স্ত্রী কখনও শাস্তির যোগ্য নয়। তবে শপথ ভঙ্গ কোরও না। একমুষ্ঠি তৃণ নাও ও তার দ্বারা মৃদু আঘাত করে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ কর।’ কোরআনে রয়েছে- আমি তাকে আদেশ করলাম- ‘এক মুষ্ঠি তৃণ নাও ও তার দ্বারা আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ কোরও না।’
আমি তাকে ধৈর্য্যশীল পেলাম। সে কত উত্তম দাস, সে আমার অভিমুখী ছিল।(৩৮:৪৪-৪৫)
আল্লাহ আইয়ূবের অবস্থা ফিরিয়ে দিলেন, ফিরিয়ে দিলেন সবকিছু পূর্বের চেয়ে কয়েক গুণে। তার ভ্রাতা-ভগ্নিরা এবং যারা তাকে ইতিপূর্বে পরিত্যাগ করেছিলে তারাও আবার ফিরে এল। তার গৃহ আবার সন্তান-সন্তুতিতে ভরে গেল। একে একে তার সাত পুত্র ও তিন কন্যার জন্ম হল। কোরআনে রয়েছে- ‘আমি আমার অনুগ্রহস্বরূপ ও বোধশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্যে উপদেশস্বরূপ তাকে (আইয়ূবকে) আবার দিলাম তার পরিজনবর্গ ও তাদের মত আরও বহুকিছু।’-(৩৮:৪৩)
যতদূর জানা যায়, সুস্থ্য হবার পর আইয়ূব আরও এক’শ চল্লিশ বৎসর আয়ূ লাভ করেছিলেন।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
বিদ্র: অবশ্য প্রশ্ন একটা থেকে যায়- আইয়ূব যিনি কিনা একজন নবী, তিনি স্ত্রীর পূর্ণ বক্তব্য না শুনে অর্থাৎ ঘটনার তত্ত্ব তালাশ না করে, অপরিচিত ব্যক্তির কথাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে স্ত্রীকে দোররা মারতে চাইলেন কেন? তাহলে কি তার স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসে ঘাটতি ছিল? (অবশ্য কেউ হয়ত: বলতে পারেন উক্ত ব্যক্তি আইয়ূবের নিকটাত্মীয়দেরই একজন ছিলেন, যার কথাকে তিনি অবিশ্বাস করতে পারেননি।)
যাইহোক না কেন, মূল বিষয় হচ্ছে, কাহিনী এমনই, তবে কিছু তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতায় অথবা আমার উপস্থাপনায় বিশেষ ঘাটতি রয়েছে।
‘সর্বশক্তিমান খোদা আমার সঙ্গে রয়েছেন,
আর আমার সন্তান-সন্তুতিরা আমায় ঘিরে রয়েছে।
আমার জীবন-যাপন আরাম-আয়েশে পূর্ণ।
যখন আমি শহরের ফটকে গিয়ে চকে আসন গ্রহণ করি,
তখন যুবকেরা আমায় দেখে সরে দাঁড়ায়,
আর বৃদ্ধরা উঠে দাঁড়ায়,
নেতাদের গলারস্বর থেমে যায়,
আর সকলে আমার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করে,
আমার পরামর্শের জন্যে নীরব থাকে,
আমার কথার পরে তারা আর কথা বলে না।
সকলেই আমার প্রশংসা করে,
যারা আমার কথা শুনে তারা নিজেকে ধন্য মনে করে।
কারণ আমি অন্ধদের দৃষ্টি আর খঞ্জদের শক্তি
অনাথ ও অভাবীদের পিতার মত।
আমি বিদেশীদের পক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করি,
আর দুষ্টদের চোয়াল ভেঙ্গে দিই,
সত্যি বলতে কি, সৈন্যদলের মধ্যে রাজা যেমন,
আমি তেমনই।’
আইয়ূবের খোদা ভক্তি দেখে ইবলিস মনে মনে বলত, ‘ওহে আইয়ূব, তুমি কি এমনি এমনি তাঁকে ভক্তি কর? তিনি কি তোমার গৃহ ও গৃহস্থলীর সবকিছূ তাঁর রহমতে সিক্ত রাখেননি? তাঁর করুণা ও রহমতের কারণে কি তোমার পশুপাল এমন অসাধারণ বৃদ্ধিলাভ করেনি?'
ইবলিস জানত সাধারণ মানুষকে বরবাদ করতে পারলেও কোন নবীকে বরবাদ করার ক্ষমতা তার নেই। তাদের উপর তার কোন প্রভাব খাটবে না। আদমকে দুনিয়াতে পাঠানোর আগে তাকে এটা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমার দাসদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।-(১৭:৬৫) বা, আমার দাসদের ওপর তোমার কোন প্রভাব খাটবে না।’-(১৫:৪২) সুতরাং সে ভাবল- 'আমি তার সন্তান ও সম্পদের উপর একে একে আঘাত করি না কেন! দেখি না সে কেমন করে খোদার উপর বিশ্বাসে অটল থাকে?’
ইবলিস আইয়ূবের উপর একের পর এক আঘাত হানল এবং তাকে একদিনেই হিরো থেকে জিরো করে দিল। এমন একদিনে এই আঘাতগুলো আইয়ূবের উপর দু:স্বপ্ন আকারে এল যেদিন তার সন্তানগণ সকলে নিমন্ত্রণে অন্যত্র ছিল। আর অদ্ভূত ব্যাপার ছিল এই যে, প্রতিটি দু:সংবাদ তার একজন দাস বয়ে নিয়ে এসেছিল, যে কিনা একমাত্র ঐ আঘাত থেকে রক্ষা প্রাপ্ত ব্যক্তি।
প্রথম দু:সংবাদটি আইয়ুব পেলেন দুপুর বেলা। সংবাদ বহনকারী দাস জানাল যে, শিবায়ীয়েরা হানা দিয়ে তার গাধার পাল লুট করেছে, এমনকি জমি চাষে রত ষাড়গুলিও। আর হত্যা করেছে সকল দাসদেরকে। প্রথম দাস তখনও কথা বলছিল ঐসময় দৌঁড়ে এল আরেক দাস। সে জানাল যে, ‘বজ্রপাতে তার ভেড়ার পাল আর দাসেরা নিহত হয়েছে। তারপর এল আর একজন। সে জানাল যে, কলদীয়রা তার উটগুলোকে লুট করেছে আর সকল দাসদের হত্যা করেছে। অত:পর এল মহা দু:সংবাদ। নিমন্ত্রিতের বাড়ীটি ধ্বসে পড়ায় ভোজেরত অবস্থায় তার সকল সন্তান নিহত হয়েছে।
যাহোক, আইয়ূব সব দুঃসংবাদগুলো শান্তভাবে পাথরের মত হয়ে শুনলেন। এসময় আগত দাসেরা একপাশে নিজেদেরকে অপরাধী ভেবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি তা লক্ষ্য করে তাদেরকে বললেন, ‘তোমাদের কুন্ঠিত হবার কোন কারণ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন তা কেবল মঙ্গলের জন্যেই করেন।’
অতঃপর শোকের চিহ্ন হিসেব আইয়ূব তার কাপড় ছিঁড়লেন এবং মাথা কামিয়ে ফেললেন। তারপর খোদার কাছে অন্তরের ভক্তি জানিয়ে বললেন, ‘হে আমার প্রভু! আমি তোমার শোকর আদায় করি এ কারণে যে, তুমি আমাকে সহায়-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দান করেছিলে। এদের মহব্বত আমার অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এরপর এখন আমি এ কারণে শোকর করছি যে, তুমি আমাকে এসব থেকে মুক্তি দিয়েছ। আমার ও তোমার মধ্যে এখন কোন অন্তরায় অবশিষ্ট নেই।’
কোন একদিন ফেরেস্তা জিব্রাইলের সঙ্গে ইবলিসের দেখা হল। জিব্রাইল বলল, ‘হে ইবলিস! আইয়ূব, পুণ্যবানদের একজন। যদিও তুমি বিনা কারণে তার সর্বনাশ করছ, তবুও সে বিশ্বাস ও ভক্তিতে অটল রয়েছে।’
ইবলিস বলল, ‘মানুষের জীবনই তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। মানুষ তার নিজ প্রাণ রক্ষার জন্যে তার যাকিছূ আছে সবই দেবে। কিন্তু আল্লাহর নির্বাচিত দাসদের উপর আমার কোন ক্ষমতা নেই। নইলে তার ঈমান ঠিকই বিনষ্ট করে দিতাম।’
জিব্রাইল বলল, ‘তা সত্য। কিন্তু ক্ষমতা যদি তিনি তোমাকে দিতেনও, তদুপরি তাদের ঈমান এমন ঠুনকো নয় যে ইচ্ছে করলেই তুমি তা বিনষ্ট করতে পারতে।'
ইবলিস বলল, 'সেটা আর প্রমান করতে পারছি কৈ! আহা! যদি আমি একটি বারের মত ঐ ক্ষমতা পেতাম!'
আইয়ূব ও তার বন্ধুরা। |
তৈমনীয় ইলীফস, শূহীয় বিল্দদ ও নামাথীয় সোফর -আইয়ূবের এই তিন বন্ধু তার বিপদের কথা শুনতে পেয়েছিল। তখন তারা তাকে সান্তনা দেবার জন্যে এল। তাদের কেউই দূর থেকে আইয়ূবকে চিনতে পারল না এবং কাছে গিয়ে তার অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগল এবং নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে আকাশের দিকে ধূলো ছড়াল। তারা তার কষ্ট অনুভব করল এবং সান্তনার ভাষা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকল। এসময় আইয়ূব বিলাপের সুরে বললেন- আমি কেন গর্ভে থাকতে মরিনি? কেনইবা জন্মেই মরলাম না? তা হলে তো আমি এখন, শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারতাম; আমি ঘুমাতাম আর বিশ্রাম পেতাম। আজ দীর্ঘ নিঃশ্বাসই আমার সঙ্গী, আমার কষ্ট বর্ষার মত ঝরছে; আমার শান্তি নেই, স্থিরতা নেই, কোন বিশ্রাম নেই, আছে কেবল কষ্ট।’
এসব কথা শুনে তার বন্ধু তৈমনীয় ইলীফস তাকে বলল- 'ভেবে দেখ, কতজনকে তুমি উপদেশ দিয়েছ আর দূর্বল হাতকে সবল করেছ; কিন্তু এখন তোমার নিজের উপরই কষ্ট এসেছে, আর তুমি হতাশ হয়েছ। তুমি যে আল্লাহকে ভক্তিপূর্ণ ভয় কর, তাতে কি তুমি আশ্বাস পাও না? নির্দোষ কখনও কি ধ্বংস হয়েছে? সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সংশোধন করেন; কাজেই সর্বশক্তিমানের শাসনকে তুচ্ছ কোরও না। কারণ তিনি ক্ষত করেন আবার বেঁধেও দেন, আর সুস্থ্যতা তাঁরই দয়া।’
তখন আইয়ূব বলতে লাগলেন- ‘আল্লাহর ভয়ংকর কাজগুলো আমার বিরুদ্ধে সাঁরি বেঁধে দাঁড়িয়েছে, নিজেকে সাহায্য করার শক্তি আমার নেই, আমার কাছ থেকে তো আমার সবকিছু দূর করা হয়েছে; পোঁকা আর ঘাঁয়ের মামড়িতে আমার দেহ ঢাকা পড়েছে।আমার চামড়া ফেঁটে গেছে এবং পূঁজ পড়ছে; আমার দিনগুলো তাঁতীর মাকূর চেয়েও তাড়াতাড়ি চলছে, কোন আশা ছাড়াই সেগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। যখন ভাবি আমার শয্যা আমাকে সান্তনা দেবে, তখন নানা দুঃসপ্ন আমাকে ভীত করে তোলে।’
এসময় শূহীয় বিলদদ বলল- ‘ঠিক কথা, আমি জানি এসবই সত্যি। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কি করে মানুষ নির্দোষ হতে পারে? আমি তো সর্বদাই তাঁর দৃষ্টিতে, কিন্তু আমার দৃষ্টি তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না, তিনি যদি ছিনিয়ে নেন, কে তাঁকে বাঁধা দিতে পারে? কে তাঁকে বলতে পারে- তুমি কি করছ?’
আইয়ূব বললেন- ‘তাহলে কেমন করে আমি তাঁর কথার উত্তর দেব? তাঁকে বলার জন্যে কোথায় ভাষা খুঁজে পাব? আমি নিজেকে নির্দোষ ভাবলেও উত্তর দিতে পারিনে, আমি বিচারকের কাছে কেবল দয়াই ভিক্ষে করব।’
নামাথীয় সোফর বলল-‘তুমি বলেছ তোমার ধর্ম বিশ্বাসে কোন খূঁত নেই এবং তাঁর দৃষ্টিতে তুমি খাঁটি। আ-হা, আল্লাহ যেন কথা বলেন, আর জ্ঞানের গোপন বিষয়গুলো তোমাকে জানান; এটা জেনে রেখ, কারও পাপ অনুসারে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন না।’
আইয়ূব উত্তরে বললেন- 'তুমি যা বলেছ কে তা না জানে? পশুদের জিজ্ঞেস কর, তারা তোমাকে শেখাবে, আকাশের পাখীদের বল, তারাও তোমাকে বলে দেবে; পৃথিবীকে, সেও তোমাকে শেখাবে, সাগরের মাছেরাও তোমাকে বলে দেবে এরা সবাই জানে আল্লাহর শক্তিই এসব করেছে।
অন্ধকারের লুকান বিষয়গুলো তিনি প্রকাশ করেন, আর ঘন ছায়াকে আলোতে আনেন। তাঁর মহিমা কি তোমাদের ভয় জাগায় না? তাঁর ভয়ংকরতায় কি তোমরা ভীত হও না? আমি জানি আমার মুক্তিদাতা জীবন্ত, শেষে তিনি পৃথিবীর উপর এসে দাঁড়াবেন আমার চামড়া ধ্বংস হয়ে যাবার পরও আমি জীবন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পাব।’
আইয়ূব যখন এসব বলছিলেন তখন তার বন্ধুদের কেউই তার কথার উত্তর দিল না। এসময় রামের বংশের বৃষীয় ইলীহূ ইবনে বারখেল যে আইয়ূবের বন্ধুদের সাথে এসেছিল, বলল-‘কিন্তু আমি আপনাকে বলি এ বিষয়ে আপনার কথা ঠিক না; কারণ মানুষের চেয়ে আল্লাহ মহান। কেন আপনি তাকে এ অভিযোগ জানাচ্ছেন যে, মানুষের কোন কথার উত্তর তিনি দেন না? আসলে আল্লাহ নানাভাবে কথা বলেন, যদিও মানূষ তা বুঝতে পারে না, স্বপ্নের মধ্যে যখন তাদের নিদ্রা গাঢ় হয়, তিনি তখন তাদের কানে কানে কথা বলেন আর সাবধান বাণী দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করেন, যেন মানুষ তার দুস্কর্ম থেকে ফেরে, আর অহংকার থেকে দূরে থাকে।
যখন মানুষ রোগ যন্ত্রণায় শাস্তি পায়, তখন ফেরেস্তাগণ চিৎকার করে বলেন- ‘হে আল্লাহ! দোযখের শাস্তি থেকে তাকে রেহাই দাও।’
সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তিনি তাকে দয়া করেন, আল্লাহ মানুষের জন্যে বারবার এসব করেন।
আল্লাহ মানুষকে তার কর্মফল দেন; সর্বশক্তিমান কখনও উল্টো বিচার কবেন না, পৃথিবীর ভার কি কেউ তাঁর উপর দিয়েছে? মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর তাঁর দৃষ্টি রয়েছে, তাদের প্রতিটি কর্ম তিনি দেখেন। এমন কোন অন্ধকার জায়গা বা ঘনছায়া নেই যেখানে পাপীরা লুকাতে পারে।
মানুষ যদি পাপ করে তাতে আল্লাহর কি লাভ হবে? সে যদি নির্দোষ হয় তাতেই বা তাঁর কি উপকার হবে? মানুষের কাছ থেকে তিনি কিছুই চান না, তাদের দুষ্টতা কেবল তাদেরই ক্ষতি করে, তাদের নামাজ, রোজা, সততা কেবল তাদেরই সাহায্য করে।আল্লাহ তো তার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষকেই বেশী শিক্ষা দিয়েছেন, আকাশের পক্ষী বা জমিনের পশু কি মানুষের চেয়ে জ্ঞানী? আল্লাহ ক্ষমতায় মহান, তাঁর মত শিক্ষক আর কে আছে?’
এসময় আল্লাহ আইয়ূবকে বললেন,- যখন পৃথিবীর গর্ভ থেকে সমুদ্র বের হয়ে এসেছিল, তখন কে তাকে আবদ্ধ করেছিল? তখন আমি মেঘকে তার পোষাক করেছিলাম, আর তার সীমা ঠিক করেছিলাম, তার দ্বার ও আর্গল আমি স্থাপন করেছিলাম; আর আমি বলেছিলাম, এ পর্যন্ত, আর নয়, এখানেই তোমার গর্বিত ঢেউগুলোকে থামতে হবে।
দোযখ তোমাকে দেখান হয়েছে কি? জগৎটা কত বড় তা কি তুমি ধারণা করতে পার? যে স্থান থেকে আলো ছড়িয়ে যায়, কিংবা যে স্থান থেকে পৃথিবীতে পূবের বায়ূ ছড়িয়ে পড়ে তা কোথায়?
বজ্রপাত ও বৃষ্টির জন্যে কে পথ করেছে? যাতে জনশুণ্য স্থান বৃষ্টি পায়, মরুএলাকা তৃপ্ত হয়, আর সেখানে ঘাস, লতা-গুল্ম উদ্গত হতে পারে?
তুমি কি কৃত্তিকা নামের তাঁরাগুলোকে বাঁধতে পার? কালপুরুষ নামের তাঁরাগুলোর বাঁধন খুলে দিতে পার? তাঁরাপুঞ্জকে তাদের ঋতু অনুসারে বের করে আনতে পার? আকাশের আইন কানুন কি তুমি জান?
কে অন্তরকে জ্ঞান দিয়ে সাঁজিয়েছে? কিংবা মনকে বোঝার শক্তি দিয়েছে? দাঁড় কাকের বাচ্চারা যখন খোদার কাছে কাঁদে, আর খাবারের জন্যে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ায়, তখন কে তাদের আহার জোগায়? পাহাড়ী ছাগ কখন বাচ্চা দেয় তা কি তুমি জান? তাদের বাচ্চা কত দিন গর্ভে থাকে তা কি গুনেছ?
তোমার আদেশে কি ঈগল আকাশে উড়ে? সে খাঁড়া পাহাড়ের উপর বাস করে, সেখান থেকে সে খাবারের অন্বেষণ করে, তার দৃষ্টি দূর থেকে তার শিকার খুঁজে নেয়। তাহলে আমার সম্মুখে কে দাঁড়াতে পারে? আমার বিরুদ্ধে এমন কার দাবী আছে যে, তার দাবী আমাকে মানতে হবে? উপরে আকাশ, নীচে জমিন এবং এ দু‘য়ের মাঝে যাকিছু আছে -সবই আমার সৃষ্টি, কোন কিছুই আমার অপরিজ্ঞাত নয়।’
আইয়ূব বললেন,- ‘আমি তো অযোগ্য, আমি কেমন করে তোমাকে উত্তর দেব? কাজেই আমি যা বলেছি তা এখন ফিরিয়ে নিচ্ছি আর ধূলো ও ছাইয়ের মধ্যে অনুতাপ করছি।’
আইয়ূবের বন্ধুরা সাতদিন তার সাথে থাকল, তারপর তারা ফিরে গেল।
উত্তোরোত্তর আইয়ূবের অবস্থার অবনতি হতে লাগল। এতে দুর্গন্ধে কেউ তার কাছে যেতে পারত না। প্রথম পর্যায়ে তার পরিবারের লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করল। পরবর্তীতে চাকর-বাকরেরা। ফলে রহিমা স্বামীকে নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়ল। কিন্তু এ-ই শেষ ছিল না। প্রতিবেশীরা রহিমাকে হুমকি দিল, ‘তোমার স্বামীকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও। দুর্গন্ধে এখানে আমরা বাস করতে পারছিনে।’
সে বলল, ‘তাকে আমি কোথায় নিয়ে যাব? তোমরা আমাদের প্রতি একটু রহম কর।’
তারা বলল, ‘তোমাদের কারণে আমরাও অসুস্থ্য বা আক্রান্ত হয়ে পড়ি এই কি তোমাদের অভিপ্রায়? তা না হলে আমাদের থেকে দূরে সরে যাও, যেখানে খুশী। আমরা স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলি।’
প্রতিবেশীরা জোরপূর্বক তাদেরকে বাড়ী থেকে বের করে দিল। তারপর তাদের আবাসগৃহ আসবাবপত্র সব পুড়িয়ে দিল। তখন স্বামীকে নিয়ে রহিমা একটু নির্জন স্থানে গেল। কিন্তু নিকটবর্তী গ্রামবাসীরাও তাদেরকে তাড়িয়ে দিল। তারা এসে বলল, ‘তোমার স্বামীর এই রোগে আমরাও আক্রান্ত হয়ে পড়ব, আর তাতে গ্রামটা উজাড় হয়ে যাবে?’
সে বলল, ‘এই রোগ ছোঁয়াচে নয়, এই তো আমি সম্পূর্ণ সুস্থ্য।’
তারা বলল, ‘সুস্থ্য লোক অসুস্থ্য হতে কতক্ষণ?’
রহিমা স্বামীকে অন্য এক স্থানে নিয়ে গেল। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদেরকে সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিল। এভাবে একে একে সাতবার স্থান পরিবর্তনের পর অবশেষে জঙ্গলে আশ্রয় নিল তারা। সহায়-সম্বলহীন।
আইয়ূব স্নান করলেন। |
ইতিমধ্যে দিন, মাস, বৎসর গড়িয়ে যাচেছ। নিকটবর্তী গ্রামে, লোকদের গৃহে গৃহে দাস্যকর্মের দ্বারা খাবার সংগ্রহ করা এখন রহিমার নিত্যদিনের কাজ। একদিন সে যখন খাবার সংগ্রহ শেষে ব্যস্ততা সহকারে গৃহে ফিরছিল, তখন এক বৃদ্ধের বেশে ইবলিস তার ফেরার পথের পাশে বসে রইল। অতঃপর রহিমা যখন নিকটবর্তী হল, তখন সে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মা, আমি বড় ক্ষুধার্ত। একমুষ্ঠি খাবার আমাকে দাও।’
রহিমার কাছে যে খাবার ছিল তা তাদের দু‘জনের কোনমতে চলত। বৃদ্ধকে খাবার দিলে তাকে অনাহারে থাকতে হবে, তবুও সে এই ক্ষুধার্ত বৃদ্ধকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারল না। সে এগিয়ে এল এবং তার অংশের খাবার বৃদ্ধকে দিল। বৃদ্ধের আরও খাবার বা পানির দরকার হতে পারে ভেবে সে চলে যেতে পারল না। সুতরাং সে একপাশে বসে নীরবে তার খাওয়া দেখতে লাগল, আর তার মন পড়ে রইল অসুস্থ্য স্বামীর কাছে। খেতে খেতে বৃদ্ধ বলল, ‘মা, তোমাকে এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?’
রহিমা সংক্ষেপে তাকে তার দুঃখের কথা জানাল। সব শুনে বৃদ্ধ বলল, ‘আমি একটা ঔষধের কথা জানি। কিন্তু তুমি কি তা ব্যাবহার করতে পারবে?’
রহিমা বলল, ‘আমি আমার স্বামীর জন্যে সবকিছু করতে পারব, বাবা।’
বৃদ্ধ বলল, ‘তুমি যদি দ্রাক্ষারস দ্বারা তোমার স্বামীর শরীর ধৌত করে দিতে পার, আর যদি তাকে কিছূ শুকরের মাংস ভক্ষণ করাতে পার, তবে অচিরেই তার রোগের উপশম হবে।’
রহিমা তখন দ্রুত গৃহে ফিরে স্বামীকে সকল কথা বলল এবং তাকে ঐ ঔষধ ব্যাবহারের জন্যে পীড়াপীড়ি করল। আইয়ূব তা করতে অস্বীকার করলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, ‘জীবন থাকতে আমি কখনও নিষিদ্ধ ও অপবিত্র বস্তুর সংস্পর্শেও যাব না। নিশ্চয়ই শয়তান তোমাকে প্ররোচিত করেছে।’
একথা শুনে রহিমা তাকে আর পীড়াপীড়ি করল না।
সাত বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের কোন মুহূর্তেই আইয়ূব হা-হুতাশ, অস্থিরতা ও অভিযোগের কোন বাক্য মুখে উচ্চারণ করেননি। তিনি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছেন আল্লাহর রহমতের। কিন্তু তিনি নিজের জন্যে আল্লাহর কাছে কোন দোয়া করেননি। তিনি দোয়া করার হিম্মত করতেন না এই ভেবে যে, না জানি সবরের কোন খেলাফ হয়ে যায়। একদিন পত্নী রহিমা তাকে বলল, ‘তোমার কষ্ট অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে নিজের জন্যে প্রার্থণা কর।’
আইয়ূব বললেন, ‘নিজের জন্যে আল্লাহর কাছে এসময় কিছু চাইতে আমার লজ্জা লাগছে। আমি সত্তুর বৎসর সুস্থ্য অবস্থায় আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত ও দৌলতের মধ্যে দিনাতিপাত করেছি। এর বিপরীতে মাত্র সাত বৎসর আমি শয়তানের পরীক্ষায়। অন্ততঃপক্ষে সত্তুর বৎসর অতিবাহিত না করে আমি নিজের জন্যে কিভাবে কিছু চাইতে পারি?’
এদিকে ইবলিস যখন দেখল যে সে কিছুতেই আইয়ূবের সবরের খেলাফ করতে পারছে না। তখন সে মানুষের বেশে আশে পাশের গ্রামের প্রতিটি গৃহে জানিয়ে দিল-‘তোমাদের এখানে যে স্ত্রীলোকটি মাঝে মাঝে এসে কাজকাম করে খাবার সংগ্রহ করে, তার স্বামী দূরারোগ্য ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। এখন যদি তোমরা তাকে তোমাদের গৃহের কাজে লাগাও তাহলে তোমরাও ঐ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। আমি তোমাদের ভালোর জন্যেই বলছি।’
সুতরাং রহিমাকে আর কোন গৃহে কাজের জন্যে নেয়া হল না। সারাদিন লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে তিনি যখন ক্লান্ত তখন এক গৃহিনী নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে তাকে কাজে লাগাল এবং বলল, ‘তোমার অসহায় অবস্থা জানি বলেই আজকের মত কাজে লাগালাম। কিন্তু এই শেষ, তুমি আর আমাদের বাড়ীতে আসবে না।’
পরদিন রহিমা অন্য গ্রামে গেল খাবারের সন্ধানে। কিন্তু সেখানকার লোকেরাও তাকে তাড়িয়ে দিল। একসময় ঘুরতে ঘুরতে সে যে বাড়ীতে এল ঐ বাড়ীর কর্ত্রী বলল, ‘তোমার জন্যে আমার বাড়ীতে কোন কাজ নেই।’
রহিমা বলল, ‘আজ কাজ না পেলে আমার অসুস্থ্য স্বামীকে অনাহারে থাকতে হবে। তাই দয়া করে আমাকে কাজ দিন অথবা কিছু ধার দিন। আমি আপনার দেনা পরিশোধ করে দেব।’
সে বলল, ‘তোমার নেই চালচুলো। তোমাকে কিভাবে আমি ধার দেব?’
রহিমার চুলের প্রতি নজর পড়ল তার। তখন সে বলল, ‘তবে তুমি যদি কিছু বিক্রি করতে চাও তা আমি কিনতে পারি।’
রহিমা বলল, ‘আমার কিছুই নেই। আমি কি বিক্রি করব?’
সে বলল, ‘তোমার চুল। আমি খোপা তৈরী করব? বিনিময়ে আমি তোমাকে চাল দেব। তুমি রাজী হলে আমি না হয় কিছু বেশীই দেব। তাতে তেমাদের বেশ কিছুদিন চলে যাবে।’
রহিমা অপূর্ব সুন্দর লম্বা চুলের অধিকারী ছিল, যার প্রশংসা করতেন আইয়ূব সবসময়। তার চোখ ভিজে উঠল। দু‘ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে স্ত্রীলোকটি বলল, ‘তুমি বেঁচতে না চাইলে নাই।’
রহিমা দ্রুত বলল, ‘না, তা নয়। আমার এই চুল ধরে আমার অসুস্থ্য স্বামী উঠে দাঁড়ায়, একস্থান থেকে অন্যস্থানে যায়।..’
স্ত্রীলোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাহলে বরং তুমি তোমার মাথার অর্ধেকটা চুল বিক্রি কর। তাতে তোমার স্বামীর কাজও চলবে, খাবারও পাবে। আমি তোমাকে ঠকাব না।’
কোন বিকল্প ছিল না। তাই রহিমা রাজী হল এবং মাথার অর্ধেকটা চুলের বিনিময়ে খাবার সংগ্রহ শেষে গৃহ অভিমুখে রওনা হল।
এদিকে শয়তান দেখল রহিমার কারণে আইয়ূব এখনও ঈমানে কায়েম রয়েছে। তাই তাদের দু‘জনের বিশ্বাসের মধ্যে ফাঁটল সৃষ্টির চেষ্টায় মনোযোগ দিল সে। সে এক বৃদ্ধের বেশে আইয়ূবের কাছে এল। অতঃপর তাকে বলল, ‘আপনি আল্লাহর একজন নবী। এত কঠিন বিপদাপন্ন অবস্থায়ও আপনি ঈমানে অটুট রয়েছেন। কিন্তু সবকিছু মাটি হয়ে যাচ্ছে আপনার স্ত্রীর কারণে। আপনি তো খবর রাখতে সক্ষম নন- এই সুযোগে আপনার স্ত্রী আপনাকে হারাম খাবার খাওয়াচ্ছে। গ্রামে গিয়ে সে অসৎ কার্য্য এবং চুরি করে খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আজ চুরির সময় সে ধরা পড়েছে। আর গ্রামের লোকেরা এই অপরাধে তার মাথার চুল অর্ধেকটা কেটে নিয়েছে।’
একথা শুনে আইয়ূব দু:খ-লজ্জায় মর্মাহত হলেন। তারপর রহিমা যখন ফিরে এল, তিনি দেখতে পেলেন যে তার চুল সত্যিই অর্ধেকটা কাটা। তিনি ভীষণ রেগে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমার চুরি করে আনা কোন খাবার আমি স্পর্শ করব না।’
রহিমা তার স্বামীকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আইয়ূব তার কোন কথাই শুনতে চাইলেন না। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি এই অপরাধে আমি সুস্থ্য হয়ে তোমাকে অবশ্যই এক‘শ দোররা মারব।’
তিনি রহিমার আনা সমস্ত খাবার ছুঁড়ে ফেললেন।
এত লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের পর সংগ্রহ করে আনা খাবার চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত নয়নে রহিমা সেদিকে তাকিয়ে রইল।
স্বামীর ব্যাবহারে অত্যন্ত দু:খিত হয়ে রহিমা নিজের নির্দোষিতার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে বিচার প্রার্থণা করল। আইয়ূব ও তার পরিবারের এমন দূরাবস্থার কথাই যেন কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- তোমরা কি মনে করেছ যে (এমনই কেবল মুখের কথায়) স্বর্গে গমন করবে? অথচ এখনও তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের (নবী ও তার সহচরবর্গের) অবস্থায় উপনীত হওনি। বিপদের উপর বিপদ এবং আঘাতের উপর আঘাত তাদেরকে স্পর্শ করেছিল, (এমন কি তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত সমূলে) প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল।-(২:২-১০)
এদিকে দু‘দিন অতিবাহিত হল, উভয়েই অনাহারে। এসময় আল্লাহ জিব্রাইলকে প্রেরণ করলেন। সে এসে আইয়ূবকে সকল ঘটনা অবহিত করার পর বলল, ‘এখন আল্লাহর কাছে তোমার নিজের জন্যে দোয়া কর। তিনি তা কবুল করবেন।’
আইয়ূবের এই অবস্থা যেন যবুরের এই সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে-
খোদা, তোমার ক্রোধে আমাকে ভর্ৎসনা কোরও না,
তোমার রোষাগ্নিতে আমাকে শাস্তি দিও না।
কেননা তোমার তীরসকল আমাতে বিদ্ধ,
আমার উপর তোমার হস্ত নেমেছে।
তোমার কোপ হেতু আমার অস্থিতে কোন মাংস নেই,
আমার শোক হেতু আমার মনে কোন শান্তি নেই।
কেননা আমার শাস্তিসমূহ আমার মাথার উপর উঠেছে, ভারী বোঝার ন্যায়,
সেসকল আমার শক্তি অপেক্ষা ভারী।
আমার ক্ষতসমূহ দুর্গন্ধ ও গলিত হয়েছে, আমার অজ্ঞানতা প্রযুক্ত।
আমি কুব্জ হয়েছি, অতি নুয়ে পড়েছি, আমি সারাদিন বিষন্ন ঘুরছি।
কেননা আমার কটিদেশে জ্বালা ধরেছে, আমার অস্থিতে কোন মাংস নেই।
আমি অবসন্ন ও অতিক্ষুন্ন হয়েছি, চিত্তের ব্যকুলতায় আর্ত্তনাদ করছি।
হে প্রভু, আমার সমস্ত কামনা তোমার সামনে,
আমার কাতরোক্তি তোমার কাছে গুপ্ত নয়।
আমার হৃদয় ধুঁকছে, আমার শক্তি নি:শেষ হয়েছে,
আমার চোখের জ্যোতিও আমাকে ছেড়ে গিয়েছে।
আমার প্রণয়ীরা ও আমার বন্ধুগণ আমার ব্যাধি হতে দূরে দাঁড়ায়,
আমার জ্ঞাতিবর্গ দূরে সরে থাকে।
যারা আমার প্রাণের অন্বেষণ করে, তারা ফাঁদ পাতে;
যারা আমার অনিষ্ট চায়, তারা বিনাশের কথা কহে,
আর সমস্ত দিন ছলের চিন্তা করে।
কিন্তু বধিরের মত আমি শুনিনে, বোবার মত আমি মুখ খুলিনে।
আমি তার মত, যে শুনতে পায় না, যার মুখে প্রতিবাদ নেই।
কারণ খোদা, আমি তোমারই অপেক্ষা করছি;
হে প্রভু, আমার উপাস্য, তুমিই উত্তর দেবে।
কেননা আমি বললাম, পাছে ওরা আমার বিষয়ে আনন্দ করে,
আমার চরণ টললেই আমার বিপক্ষে দর্প করে।
আমি তো পড়তে পড়তে উদ্যত;
আমার ব্যথা সতত আমার গোচরে রয়েছে।
আমি নিজের অপরাধ স্বীকার করব, আমার পাপের দরুন খেদ করব।
কিন্তু আমার শত্রুগণ সতেজ ও বলবান, অনেকেই অকারণে আমাকে ঘৃণা করে।
আর তারা উপকারের বদলে অপকার করে,
তারা আমার বিপক্ষ, কারণ যা ভাল আমি তারই অনুগামী।
খোদা, আমাকে পরিত্যাগ কোরও না;
আমার প্রতিপালক, আমা হতে দূরে থেক না।
হে প্রভু, আমার পরিত্রাণ, আমাকে সাহায্য করতে সত্ত্বর হও। (৩৮:১-২২)
সবকিছু ফিরে পেলেন আইয়ূব। |
আল্লাহ তার প্রার্থণা কবুল করলেন এবং তাকে জানালেন- ‘তুমি তোমার পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, স্নান ও পান করার জন্যে সুশীতল পানি পাবে।’
আইয়ূব পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করলেন। সেখানে তৎক্ষণাৎ একটি প্রস্রবণের সৃষ্টি হল। তিনি সেই পানিতে স্নান করলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ্য হয়ে গেলেন। তার চেহারায় লাবণ্য ও মাধুর্য ফিরে এল। স্নান সেরে পরিস্কার বস্ত্র পরিধান করে তিনি কাছেই এক বৃক্ষতলে বসে কৃতজ্ঞতাভরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় নিমগ্ন হলেন। কোরআনে রয়েছে-‘আমার দাস আইয়ূবের কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল- ‘শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে।’
আমি তাকে বললাম- ‘তুমি তোমার পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, এ তো স্নান ও পান করার জন্যে সুশীতল পানি।’-(৩৮:৪১-৪৩)
আইয়ূরের সমাধি, লেবানন। |
ক্রন্দনরত অবস্থায় হঠাৎ চোখ তুলতেই একটু দূরে এক ব্যক্তিকে উপবিষ্ট দেখতে পেল রহিমা। সে তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে গেল। লোকটি চক্ষু মুদে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। রহিমা তাকে বিলাপের সূরে দ্রুত জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে যে রোগাক্রান্ত লোকটি পড়ে থাকত, আপনি কি তাকে দেখেছেন?’
স্ত্রীর উৎকন্ঠিত কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে আইয়ূব তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভালকরে দেখ, আমিই তোমার স্বামী। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন এবং আমাকে নতুন স্বাস্থ্য দান করেছেন। এখন কাঁদছ কেন আমাকে বল?’
আইয়ূবের সমাধি মন্দিরের অভ্যান্তরভাগ। |
রহিমা খুশীমনে তার স্বামীকে তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে বলল। তখন আল্লাহ আইয়ূবকে জানালেন -‘এই ধৈর্য্যশীলা, কৃতজ্ঞা ও পতিপরায়ণা স্ত্রী কখনও শাস্তির যোগ্য নয়। তবে শপথ ভঙ্গ কোরও না। একমুষ্ঠি তৃণ নাও ও তার দ্বারা মৃদু আঘাত করে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ কর।’ কোরআনে রয়েছে- আমি তাকে আদেশ করলাম- ‘এক মুষ্ঠি তৃণ নাও ও তার দ্বারা আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ কোরও না।’
আমি তাকে ধৈর্য্যশীল পেলাম। সে কত উত্তম দাস, সে আমার অভিমুখী ছিল।(৩৮:৪৪-৪৫)
আল্লাহ আইয়ূবের অবস্থা ফিরিয়ে দিলেন, ফিরিয়ে দিলেন সবকিছু পূর্বের চেয়ে কয়েক গুণে। তার ভ্রাতা-ভগ্নিরা এবং যারা তাকে ইতিপূর্বে পরিত্যাগ করেছিলে তারাও আবার ফিরে এল। তার গৃহ আবার সন্তান-সন্তুতিতে ভরে গেল। একে একে তার সাত পুত্র ও তিন কন্যার জন্ম হল। কোরআনে রয়েছে- ‘আমি আমার অনুগ্রহস্বরূপ ও বোধশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্যে উপদেশস্বরূপ তাকে (আইয়ূবকে) আবার দিলাম তার পরিজনবর্গ ও তাদের মত আরও বহুকিছু।’-(৩৮:৪৩)
যতদূর জানা যায়, সুস্থ্য হবার পর আইয়ূব আরও এক’শ চল্লিশ বৎসর আয়ূ লাভ করেছিলেন।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
বিদ্র: অবশ্য প্রশ্ন একটা থেকে যায়- আইয়ূব যিনি কিনা একজন নবী, তিনি স্ত্রীর পূর্ণ বক্তব্য না শুনে অর্থাৎ ঘটনার তত্ত্ব তালাশ না করে, অপরিচিত ব্যক্তির কথাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে স্ত্রীকে দোররা মারতে চাইলেন কেন? তাহলে কি তার স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসে ঘাটতি ছিল? (অবশ্য কেউ হয়ত: বলতে পারেন উক্ত ব্যক্তি আইয়ূবের নিকটাত্মীয়দেরই একজন ছিলেন, যার কথাকে তিনি অবিশ্বাস করতে পারেননি।)
যাইহোক না কেন, মূল বিষয় হচ্ছে, কাহিনী এমনই, তবে কিছু তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতায় অথবা আমার উপস্থাপনায় বিশেষ ঘাটতি রয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন