মুহম্মদ। এই নিরক্ষর নবীর সমস্ত বাণী ছিল সর্বসাধারণের জন্যে। তিনি জ্ঞান শিক্ষার মূল্য ঘোষণা করেছিলেন। ‘এক ঘন্টার জ্ঞানার্জণ সহস্র বৎসরের এবাদত অপেক্ষা শ্রেয়।’
কলমের সাহায্যে মানুষের কার্যাবলীর বিচার হবে। আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষের কার্যাবলীর চূড়ান্ত মীমাংসক কলম, প্রজ্ঞা ও মানবজাতির নৈতিকশক্তির প্রতি স্থায়ী ও অপরিবর্তিত আবেদন, অলৌকিকতার বর্জন, ‘তার ঐশী প্রশাসনের সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারণা ধর্মীয় আদর্শের সার্বজনীনতা, অকপট মানবতা।’ এসব তাকে তার পূর্বসুরীদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে, এসব গুণ তাকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
এই আরাফাত পর্বত প্রান্তরে বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ দেন মুহম্মদ। |
--‘হে মানবমন্ডলী! আমার কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর, কেননা এই বৎসরের পর আমি আর তোমাদের মাঝে এখানে মিলিত হতে পারব কিনা জানিনে। এই দিন, এই মাস যেমন সকলের জন্যে পবিত্র; তোমাদের জানমাল তেমনি তোমাদের জন্যে পবিত্র ও অলংঘী যতদিন না তোমাদের প্রভুর সমক্ষে উপস্থিত হচ্ছ; আর স্মরণ রেখ যে, তোমাদের প্রভুর সামনে তোমাদের উপস্থিত হতে হবে এবং তিনি তোমাদের কাজের হিসাব নিকাশ গ্রহণ করবেন।
--হে জনমন্ডলী! তোমাদের স্ত্রীদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তোমাদের স্ত্রীদেরও তেমনি তোমাদের উপর অধিকার আছে। দয়া ও ভালবাসার সঙ্গে তাদের সাথে আচরণ করবে নিশ্চয়ই আল্লাহর জামিনে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালামের মাধ্যমে তারা তোমাদের জন্যে বৈধ হয়েছে।
--তোমাদের উপর যে বিশ্বাস ন্যস্ত হয়েছে তার প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত থাকবে এবং পাপ পরিহার করবে।
--সুদ অবৈধ ঘোষিত হল। অর্ধমণ শুধু মূল দেয়টাই ফেরত দেবে, আর আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র, আমার চাচা আব্বাসের কাছ থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধ দিয়েই হবে এর শুরু।
--এদিন থেকে অন্ধকার যুগের অনুশীলিত রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ নিষিদ্ধ হল এবং আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র হারিস তস্যপুত্র ইবনে রাবিয়ার হত্যাকান্ড থেকে সবধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটল।’ (ইবনে রাবিয়া ছিল মুহম্মদের চাচাত ভাই। শৈশবে তাকে বনি লাইস গোত্রের একটি পরিবারের কাছে প্রতিপালনের জন্যে দেয়া হয়েছিল। হুজাইল গোত্রের সদস্যরা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করেছিল। কিন্তু এপর্যন্ত ঐ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়নি।)
--‘আর তোমাদের দাসরা! তোমরা যে আহার্য গ্রহণ করবে তাদেরকেও সেই আহার্য প্রদান করবে, আর তোমরা যে বস্ত্র পরিধান করবে তাদেরকেও সেই বস্ত্র পরিধান করতে দেবে। যদি তোমাদের কোন দাস এমন অপরাধ করে ফেলে যা তোমরা ক্ষমা করতে পারছ না, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন কর,কিন্তু তার প্রতি রূঢ় আচরণ কোরও না, কেননা তারা প্রভূর দাস এবং রূঢ় আচরণের যোগ্য নয়।
--হে জনমন্ডলী! আমার কথা শ্রবণ কর আর তা বুঝতে চেষ্টা কর। জেন যে, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তোমরা এক ভ্রাতৃসংঘের অন্তর্ভূক্ত। কারও দ্রব্য অন্যের জন্যে বৈধ নয় যদি সে তা সদিচ্ছা প্রণোদিত হয়ে দান না করে। অন্যায় করা থেকে বিরত থাকবে।
--হে আমার উম্মতেরা! আমি যা রেখে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাক, তবে কিছুতেই তোমাদের পতন হবে না। সেই গচ্ছিত সম্পদ কি? তা আল্লাহর কোরআন। নিশ্চয় জানিও ‘আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। আমিই শেষ নবী। যারা এখানে উপস্থিত আছ তারা- যারা এখানে অনুপস্থিত, তাদেরকে সব বলবে। সম্ভবতঃ যে শুনবে সে, যে শুনছে তার চেয়ে অধিক স্মরণ রাখতে পারবে।’
প্রত্যেক বাক্য শেষ হলে মুহম্মদ থামছিলেন এবং তা খলফের পুত্র উমাইয়া তস্যপুত্র রাবিয়া উচ্চ নিণাদী কন্ঠে পুনঃরাবৃত্তি করছিল যাতে সমগ্র শ্রোতৃমন্ডলী তা শুনতে পারে।
আরাফাত পর্বত প্রান্তরে দেয়া বিদায় হজ্জ্বের (Hajj) এই ভাষণ মুহম্মদের অন্যান্য ভাষণ এর তুলনায় নিতান্ত সাধারণ ও কম মরমীবাদী হলেও এটি ছিল প্রচন্ড আবেদনশীল। ভাষণ সমাপ্তির সময় জনতার উদ্বেলচিত্ততার দিকে লক্ষ্য করে মুহম্মদ বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে বললেন, ‘হে আমার প্রভু! আমি আমার পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি ও আমার কাজ সম্পন্ন করেছি।’
সমবেত বিশাল জনতা সমস্বরে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আপনি আপনার দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন।’
--‘হে আমার প্রভু! আমি মিনতি করছি, তুমি এই বিষয়ে স্বাক্ষী থাক।’ -এ কথা বলে মুহম্মদ তার ভাষণ সমাপ্ত করলেন। আরবের ঐতিহ্য অনুসারে এই ভাষণ বিস্তার, বাগ্মিতা ও প্রাণবন্ততার জন্যে উল্লেখযোগ্য।
অতঃপর কোরআনের শেষ আয়াত নাযিল হল- ‘হে মুহম্মদ! আজ আমি তোমার দ্বীনকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমার উপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমার ধর্ম বলে মনোনীত করলাম।’-(৫:১৩)
হজ্জ্বের আবশ্যিক বিধি পালন করেই মুহম্মদ তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
বি:দ্র: বিদায় হজ্জ্বে নবীজীর দেয়া সর্বশেষ এই ভাষণটি আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত থেকে স্ব-কর্ণে শুনেছিলেন প্রায় ৬০ হাজার মুসলিম। তদুপরি এই ভাষণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে মুসলিমদের মধ্যেও এবং দারুণ কৌতুহলী যাকিছু, তা হচ্ছে এসব বক্তব্যের সবগুলির যথোপযুক্ত প্রমান ও স্বীকৃত দলিল রয়েছে। যেমন-
শিয়া মতে- “আমি তোমাদের জন্যে যা রেখে গেলাম যদি তা তোমরা ধরে থাক, তবে তোমরা কখন্ই বিচ্যূত হবে না, তা হল- আল্লাহর কিতাব ও আমার পরিবার।” -সহীহ মুসলিম ৪৪/৪, নাম্বার ২৪০৮; ইবনে হাম্বল ৪/৩৬৬; দারিমী ২৩/১, নাম্বার ৩৩১৯।
সুন্নী মতে-“আমি তোমাদের জন্যে যা রেখে গেলাম যদি তা তোমরা ধরে থাক, তবে তোমরা কখন্ই বিচ্যূত হবে না, তা হল- আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” -আল মুয়াত্তা, মালিক ইবনে আনাস, ৪৬/৩।
অন্য মতে- “আমি তোমাদের জন্যে যা রেখে গেলাম যদি তা তোমরা ধরে থাক, তবে তোমরা কখন্ই বিচ্যূত হবে না, তা হল- আল্লাহর কিতাব।” -সহীহ মুসলিম ১৫/১৯, নাম্বার ১২১৮; ইবনে মা’যা ২৫/৮৪; আবু দাউদ ১১/৫৬।
আর কেবল “আল্লাহর কিতাব”- এই ভার্সনটি সুন্নী ও শিয়া মুসলিমদের নিকট সমভাবে ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য। এটাই হচ্ছে একমাত্র ভার্সন যা একমত কোরআনে পুন: পুন: উল্লেখের যে, মুহম্মদের বার্তা কেবলমাত্র কোরআন। অনেক সুন্নী এবং শিয়া মুসলিম এমনকি জানে না যে, বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের এমন একটি ভার্সনের অস্তিত্ব আজও রয়েছে দলিল-দস্তাবেজসহ। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, তারা কেউ জানতেও চায় না। সত্যিই সত্য বড় কঠিন, তবে নিশ্চয়ই দোযখের আগুণের শাস্তি হবে আরও বেশী কঠিন।
সমাপ্ত।
ছবি: sites.google.
ছবি: sites.google.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন