ইউসূফ [Joseph], ইয়াকুব ও রাহেলের প্রথম পুত্র। সে তার পিতার খুবই আদরের ছিল। হয়তঃ এই কারণে যে চৌদ্দ বৎসর দাস্যকর্মের বিনিময়ে পাওয়া প্রিয়তমা স্ত্রী রাহেলার প্রথম সন্তান ছিল সে। হতে পারে এ কারণে যে, ইউসূফ প্রিয়তমা স্ত্রী রাহেলেরও খুব প্রিয় ছিল। হয়তঃ এ কারণে যে, সে তার জৈষ্ঠ্য ভ্রাতাদের ঔদ্ধ্যত ও হটকারী মেজাজের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তার ছিল পিতামাতার প্রতি ভদ্র ও সহানুভূতিশীল মনোভাব।
তাছাড়া ইয়াকুব মনে মনে আশা পোষণ করছিলেন এই যে, একদিন এই প্রিয় পুত্রটিকেই খোদা তাঁর মহান কাজের জন্যে মনোনীত করবেন। এই ধারণার পিছনে ছিল ইউসূফের দেখা একটি বিশেষ স্বপ্ন। যার অর্থ ছিল নির্ভুল এবং সে সম্ভবতঃ অজান্তে এই বিষয়টি তার জৈষ্ঠ্য ভ্রাতাদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিল।
একদিন শেষরাতে ইউসূফ এক স্বপ্ন দেখল। পরদিন প্রাতে সে তার পিতাকে তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানাল, বলল, ‘হে আমার পিতা! আমি এগারটি গ্রহ, সূর্য্য ও চন্দ্রকে দেখেছি, ওরা আমাকে সিজদা করছে।’
সবশুনে পিতা ক্ষণকাল নীরব রইলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্ন বৃত্তান্ত তোমার ভাইদেরকে বোলও না, বললে তোমার বিরুদ্ধে ওরা ষড়যন্ত্র করবে। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। এভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন ও তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন। আর তোমার উপর ও আমার পরিবার পরিজনের উপর তিনি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন, যেভাবে তিনি তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসহাকের উপর ইতিপূর্বে তা পূর্ণ করেছিলেন। তোমার প্রতিপালক তো সর্বজ্ঞ তত্ত্বজ্ঞানী।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-ইউসূফ তার পিতাকে বলেছিল, ‘হে আমার পিতা! আমি এগারটি গ্রহ, সূর্য্য ও চন্দ্রকে দেখেছি, ওরা আমাকে সিজদা করছে।’
সে বলল, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বোলও না, বললে তোমার বিরুদ্ধে ওরা ষড়যন্ত্র করবে। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। এভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন ও তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন। আর তোমার উপর ও ইয়াকুবের পরিবার পরিজনের উপর তিনি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন, যেভাবে তিনি তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসহাকের উপর এর আগে তা পূর্ণ করেছিলেন। তোমার প্রতিপালক তো সর্বজ্ঞ তত্ত্বজ্ঞানী।’(১২:৪-৬)
ইতিমধ্যে ভাইদের চোখে ইউসূফ ও বিন্যামিনের প্রতি পিতার খোলাখুলি পক্ষপাত মূলক আচরণ ধরা পড়েছিল, যার কারণে তাদের রাগ ও প্রতিহিংসার মাত্রা বিপদসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। তারা ভাবল এক অকর্মণ্য বালক এবং একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে পিতার ভালবাসা কেন্দ্রীভূত হতে দেয়া যায় না। এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা। কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায় সেই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগল তারা। অধিকাংশের মত চরম ব্যবস্থা নেবার পক্ষে -‘মাথা থাকবে না-ব্যাথাও থাকবে না। এরপর আমরা ভাল হয়ে যাব। পিতার মনোতুষ্টির জন্যে সচেষ্ট থাকব।’
কিন্তু জৈষ্ঠ্যটি সবার সাথে একমত হল না। সে বলল, ‘ইউসূফকে হত্যার চিন্তা বাদ দাও। আমরা দূরে কোথাও ফেলে আসব ওকে। পথ হারিয়ে দেশান্তরী হবে। অথবা অন্ধকূপে ফেলে দেব তাকে। সেখানে না খেতে পেয়ে এমনিতেই মারা পড়বে সে। নয়তঃ কোন পথিক তুলে দূর দেশে নিয়ে যাবে। তাতে সে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে, আর আমরাও হত্যার দায়মুক্ত থাকব।’
ইউসূফের ভাইদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ওরা বলেছিল,‘আমাদের পিতার কাছে ইউসূফ ও তার ভাই আমাদের চেয়ে বেশী প্রিয়, যদিও আমরা দলে ভারী। আমাদের পিতা তো ভুল করছেন। ইউসূফকে হত্যা কর, নয়তঃ তাকে কোন স্থানে নির্বাসনে পাঠাও, তাহলে তোমাদের পিতার দৃষ্টি শুধু তোমাদের উপর পড়বে এবং তারপর তোমরা (তার কাছে) ভাল লোক হবে।’
ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘ইউসূফকে হত্যা কোরও না। আর তোমরা যদি কিছু করতেই চাও তবে তাকে কোন গভীর কূপে ফেলে দাও। পথযাত্রীদের কেউ তাকে তুলে নিয়ে যাবে।’(১২:৮-১০)
অন্যান্য মেষপালকদের মত ইউসূফের দশ ভাইকেও মেষদের খাবারের জন্যে পরিশ্রম করতে হত। তারা হিব্রোণের চারপাশে চরানীর কাজ করত। পরিকল্পণা অনুযায়ী একদিন তারা তাদের পিতাকে বলল, ‘হে আমাদের পিতা! ইউসূফকে তুমি এভাবে গৃহবন্দী করে রেখেছ কেন? এতে ওর ক্ষতিই হচ্ছে। ও ঘরকূনো হয়ে যাচ্ছে, স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে। কাল থেকে ও আমাদের সঙ্গে যাবে-মুক্ত বাতাসে ঘুরবে, ফলমূল খাবে।’
পিতা বললেন, ‘কিন্তু ওতো নিতান্তই বালক। বাইরের পরিবেশের সাথে পাল্লা দিয়ে চলার শক্তি এখনও অর্জন করতে পারেনি।’
তারা বলল, ‘এভাবে থাকলে ও আজীবন বালকই থেকে যাবে। ও আমাদের ভাই, ওর ভালোর জন্যেই বলছিলাম।’
পিতা বললেন, ‘তোমাদের অমনোযোগীতার জন্যে ওর কোন ক্ষতি হয় এই আমার আশঙ্কা। তাছাড়া তোমরা যে এলাকায় মেষ চরাতে যাও সেখানে নেকড়ে বাঘের ভয়ও আছে।’
তারা বলল, ‘তুমি অযথা দুঃশ্চিন্তা করছ। আমরা একটা সংগঠিত দল। তাছাড়া ইউসূফ আমাদের ভাই, আমরা ওর প্রতি অবহেলা করব এ তুমি কিভাবে ভাব?’
তারা তাদের সঙ্গে ইউসূফকে যেতে দিতে পিতাকে অনুরোধ করল। অবশেষে পিতা তাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্মত হলেন এবং বললেন, ‘তবে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে তোমরা কিন্তু হুসিয়ার থেক।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ওরা বলল, ‘হে আমাদের পিতা! ইউসূফের ব্যাপারে আমরা তার ভাল চাইলেও তুমি আমাদেরকে বিশ্বাস করছ না কেন? তুমি আগামীকাল তাকে আমাদের সঙ্গে পাঠাও, সে ফলমূল খাবে ও খেলাধূলো করবে। আমরা তো তাকে দেখে রাখব।’
সে বলল, ‘তোমরা তাকে নিয়ে গেলে আমার কষ্ট হবে; আর আমার ভয় হয় তোমরা তার ওপর নজর না দিলে তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে।’
ওরা বলল, ‘আমরা এক ভারী দল হওয়া সত্ত্বেও যদি নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমাদের ক্ষতি হওয়াই উচিৎ।’(১২:১১-১৪)
ভাইয়েরা ইউসূফকে পিতার সম্মুখ থেকে কোলে কাঁধে বয়ে নিয়ে চলল। তারপর পিতার দৃষ্টির আড়াল হতেই তারা তার সাথে দুর্ব্যাবহার শুরু করল। পরম সোহাগে যাকে এতক্ষণ কাঁধে নিয়ে চলছিল, তাকে এবার জঞ্জালের মত আঁছড়ে ফেলল মাটিতে। তারপর তার চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল সম্মুখপানে। ভাইদের আকস্মিক পরিবর্তনে হতভম্ভ হল ইউসূফ। একান্ত আপনজনদের এহেন ব্যাবহারে এক অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে সে কাঁদতে শুরু করে দিল। তার কান্না, অনুনয়-বিনয় তার সৎভাইদের পাষাণ হৃদয়ে এতটুকু সহানুভূতি জাগাল না। একটা নির্দয়, নিষ্ঠুর, সংঘবদ্ধ দলের বিরুদ্ধে ইউসূফের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল।
ভাইয়েরা দীর্ঘদিন ধরে অন্তরে লালিত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করল। তারা ইউসূফের পরিধেয় নতুন জামাটি খুলে নিল তারপর তাকে পথ পার্শ্বের এক পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দিল।
এদিকে কূপের মধ্যে বাঁচার আকুতি নিয়ে সাহায্যের জন্যে চিৎকার চেঁচামেচি করে কাঁদতে লাগল ইউসূফ। অতঃপর একসময় তার শক্তি ফুরিয়ে এল।
ইউসূফ যখন অন্ধকূপে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল সেইসময় খোদা তাকে আশ্বাসবাণী শুনালেন- ‘হে ইউসূফ ভীত হইও না-অচিরেই এমন একদিনের সাক্ষাৎ পাবে, যখন তোমার ভাইয়েরা তোমাকে চিনবে না, তখন তুমি তাদেরকে তাদের কৃত অপরাধের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারবে।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘তারপর ওরা যখন তাকে নিয়ে গেল এবং সকলে মিলে ঠিক করল, তাকে ওরা কূপে ফেলে দেবে তখন আমি তাকে জানিয়ে দিলাম, ‘তুমি (একদিন) ওদের এই কাজের কথা অবশ্যই ওদের বলে দেবে যখন ওরা তোমাকে চিনবে না।’(১২:১৫)
ইউসূফকে তো সরান গেল, কিন্তু তারা ভাবনায় পড়ল পিতার কাছে তার অনুপস্থিতির বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা নিয়ে। তারা সকলে পরামর্শ করে একটি পরিকল্পণা খাঁড়া করল। সেইমত তারা ইউসূফের জামাটিতে একটি ছাগলের বাচ্চার রক্ত মাখিয়ে দ্রুত বাড়ীর পথে রওনা দিল। বাড়ীতে পৌঁছানোর পর তারা কাঁদতে লাগল। পিতা ছুটে এলেন। তাদেরকে কাঁদতে দেখে উদ্ভ্রান্তের মত বললেন, ‘তোমরা কাঁদছ কেন? আর ইউসূফই বা কোথায়?’
ইউসূফের রক্তমাখা জামা ইয়াকুবের সামনে মেলে ধরেছে ভাইয়েরা। |
রক্তমাখা জামাটা ইহুদা পিতার হাতে দিল।
পিতার প্রতি এই নির্মম প্রবঞ্চনা ভাইদের হিংসা ও নীতিজ্ঞানহীনতার কি নির্মম বহিঃপ্রকাশ! গভীর মমতায় ইয়াকুব জামাটি নেড়ে চেড়ে দেখলেন। তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। হঠাৎ তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। ‘একি! জামাটিতে তো কোন আঘাতের চিহ্ন নেই?’অতঃপর তিনি পুত্রদের দুর্বল বক্তব্য গ্রহণে অস্বীকৃত হলেন। তাদেরকে কঠোরস্বরে বললেন, ‘তোমরা যে যুক্তি খাড়া করেছ তা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
জামাটি তাদের সামনে মেলে ধরলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘বাঘের আক্রমণে জামাটির কোথাও ছেঁড়া নেই কেন?’
তারা দৃষ্টি নত করল। বলল, ‘জানি, আমাদের কথা তুমি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এর বাইরে আর কিছুই জানিনে আমরা।’
ইয়াকুব আর কি করবেন? এই সংকটে আল্লাহর উপর নির্ভর করে ধৈর্য্য ধারণই তিনি উত্তম বিবেচনা করলেন। তিনি পুত্রদেরকে বললেন, ‘এখন ধৈর্য্যধরাই আমার পক্ষে ভাল। তোমরা যা বলছ সেবিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার ভরষা।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘ওরা রাতে কাঁদতে কাঁদতে ওদের পিতার কাছে এল। ওরা বলল, ‘হে আমাদের পিতা, আমরা দৌঁড়ের পালা দিচ্ছিলাম আর ইউসূফকে আমাদের মালপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তারপর নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলেছে। অবশ্য তুমি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবে না, যদিও আমরা সত্যিই বলছি।’
ওরা তার জামায় ঝুটা রক্ত (লাগিয়ে) এনেছিল। সে বলল, ‘না, তোমরা এক মনগড়া কথা নিয়ে এসেছ, তাই পুরো ধৈর্য্যধরাই আমার পক্ষে ভাল। তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার ভরসা।’(১২:১৬-১৯)
ইউসূফকে যে স্থানে কূপে ফেলে দেয়া হয় তার পাশ দিয়ে তৎকালে শ্যাম, হিজাজ এলাকার বণিকেরা মিসরে যাতায়াত করত। তারা সুগন্ধি দ্রব্যাদি এবং মসলাপাতি নিয়ে মিসরে গমন করত-মিসরে এগুলির চাহিদা ছিল প্রচুর এবং ফেরার পথে সেখান থেকে বস্ত্রাদি, তৈজসপত্র ইত্যাদি নিয়ে ফিরে আসত। ঐদিন মিসরগামী মদিনীয় একদল বণিক আশে পাশেই তাঁবু ফেলেছিল। বণিকদলের একজন মালেক ইবনে দোবর পানির খোঁজে বের হল। পথ পার্শ্বে এক কূপ খুঁজে পেয়ে সে তার ডোল নামিয়ে দিল তাতে। কূপটি যে পরিত্যক্ত একথা জানা ছিল না তার।
এদিকে ইউসূফ অন্ধকূপে আল্লাহর উপর ভরষা রেখে নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পন করেছিল। হঠাৎ ডোল নামতে দেখে ভাবল-‘আল্লাহ কি মেহেরবান! ভাইদের সুমতি হয়েছে এবার। তাই তাকে তুলে নিতে ডোল ফেলেছে কূয়োয়।’
ডোলের দড়িকে শক্ত করে ধরল সে।
এদিকে ডোল টেনে তুলছে মালেক ইবনে দোবর। সে ভাবছে- ‘এত ভারী লাগছে কেন?’
অনেক কষ্টে ডোল উপরে তুলতেই অবাক হল সে- ‘এ-কি! এ যে দেখছি এক বালক!’
সে আনন্দে উৎফুল হল বটে, কিন্তু বিস্মিত হলও ততধিক-‘কূয়োর মধ্যে মানুষ এল কিভাবে? না-কি জ্বীন!’
বালকটিকে বারবার নিরীক্ষণ করল সে, জিজ্ঞাসাবাদও করল, কিন্তু ইউসূফ তেমন কিছুই বলল না তাকে।
‘না চাইতেই একটি গোলাম!’ -বালকটিকে নিয়ে মালেক দ্রুত কাফেলার কাছে ফিরে এল। কাফেলার লোকজনও এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে ধরে নিল। বিনা অর্থে এমন সুন্দর ফুটফুটে গোলাম। ইউসূফ তাদের মূল্যবান পণ্য-সামগ্রীর মধ্যে সামিল হয়ে গেল। প্রচুর মুনাফার লোভে তারা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখল বালকটি যেন পালাতে না পারে। একসময় তারা তাকে সঙ্গে নিয়ে মিসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
এদিকে ইউসূফও কম আশ্চর্য হয়নি। অতি অল্পসময়েই বুঝে ফেলল সওদাগরদের হাতে বন্দী হয়েছে সে। অন্ধকূপের মৃত্যু বিভীষিকা থেকে এই বন্দীত্ব অনেক ভাল। নির্বিকার ভাবলেশহীনভাবে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত-‘আর (তারপর) এক যাত্রীদল এল। ওদের যে পানি আনত তাকে পাঠান হল; সে তার ডোল নামিয়ে দিল। সে বলে উঠল, ‘কি খুশীর খবর! এ যে এক বালক!’
তারপর ওরা তাকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে লুকিয়ে রাখল। ওরা যা করছিল সে বিষয়ে আল্লাহ ভালকরেই জানতেন।(১২:১৯)
এদিকে ইউসূফকে নিয়ে বণিকেরা মিসরে পৌঁছিল। নীলনদ বিধৌত তখনকার এই মিসর ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে উন্নত। বিজ্ঞানে মিসরীয়রা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে মৃতদেহকে মমী করে রাখার কৌশল আবিস্কার করেছিল- মানুষকে অমরত্বে উন্নীত করার গবেষণায় নিয়োজিত হয়েছিল।
দেবতা স্ফিংস এর তত্ত্বাবধানে পিরামিড |
সর্বাধিক বিশালাকার পিরামিড তৈরী করা হয়েছিল ফেরাউন থেওপসের জন্যে খ্রী:পূ: ২৬০০ অব্দে। এই পিরামিডের পরিধি এত বড় যে এক চক্কর দিয়ে ঘুরে এলে প্রায় এক কিলোমিটার হাটা হয়ে যায়। ১৫০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই পিরামিড তৈরীতে লেগেছিল ২৩ লক্ষ বড় বড় পাথরের ব্লক। আর এই ব্লকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির ওজন ছিল প্রায় আড়াই টন। এক সঙ্গে এক লক্ষ লোক এটি তৈরীতে কাজ করেছিল। একদল পাহাড় থেকে পাথরের চাঁই ভেঙ্গেছে, আর একদল তা টেনে নিয়ে গেছে নির্মাণ ক্ষেত্রে। তৃতীয় দল সেই বিশাল প্রস্তর খন্ডগুলো কেটে ঘষেমেজে নির্দিষ্ট আকার দিয়েছে, অন্যদল সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে পরপর সাজিয়ে রেখেছে। তত্ত্বাবধায়করা বেত ও লাঠি হাতে মারধোর করে দাবড়ে নিয়ে বেড়াত শ্রমিকদের। আর এই শ্রমিকদের অধিকাংশ ছিল দাস এবং বাকীরা চাষী।
ম্যাপ অব পিরামিড কমপ্লেক্স। |
পিরামিড এবং তার অভ্যন্তরস্থ মমীসমূহকে দেবতা (স্ফিংস) এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল। পিরামিডের অনতিদূরে সম্পূর্ণ একটি পাহাড় কেটে তৈরী করা হয়েছিল ২০ মিটারেরও অধিক উচ্চতা সম্পন্ন এই দেবতা স্ফিংসের মূর্ত্তি- যার দেহ ছিল সিংহের এবং মাথা মানুষের।
খ্রী:পূ: ২য় সহস্রাব্দে নতুন করে পিরামিড তৈরীর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এসময় ফেরাউন ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সমাধিস্থ করার জন্যে পাহাড় কেটে তার মধ্যে কিছু কক্ষ তৈরী সেখানে তাদের রাখার নিয়ম চালু হয়। কোন কারণে এই সব কক্ষে মমী রাখা না হলে সেখানে পাথরের বা কাঠের মূর্ত্তি তৈরী করে রাখা হত। কেননা তারা এ বিশ্বাসও করত যে, মৃত ব্যক্তির আত্মা মূর্ত্তির মধ্যেও বাস করতে পারে।
পিরামিড। |
মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে তারা ইউসূফকে পটিফরের কাছে বিক্রয় করেছিল।
দ্রুত গৃহে ফিরে উত্তেজিত পটিফর স্ত্রীকে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে লাগলেন। এই হাঁক-ডাকে জুলেখা অন্দর থেকে বেরিয়ে এল। অত:পর ইউসূফকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। পটিফর স্ত্রীকে বললেন, ‘একে ভালভাবে রাখ, হয়তঃ সে আমাদের উপকারে আসবে বা আমরা ওকে পুত্র হিসেবেও নিতে পারি।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ‘আর ওরা তাকে কম দামে, মাত্র কয়েক দিরহামে বিক্রি করে দিল। এ ব্যাপারে ওদের লোভ ছিল না। মিসরের যে লোক ওকে কিনেছিল সে তার স্ত্রীকে বলল,‘একে ভালভাবে রাখ, হয়তঃ সে আমাদের উপকারে আসবে বা আমরা ওকে পুত্র হিসেবেও নিতে পারি।’(১২:২০-২১)
ইউসূফ এই অবস্থাকে সহজভাবে গ্রহণ করে, বুদ্ধিপূর্বক আচরণ করল। কারণ আল্লাহ তাকে মনোবল ও জ্ঞান দান করেছিলেন। আর জুলেখা সুন্দর এই বালকটিকে পুত্রস্নেহেই লালন-পালন করতে লাগল। অন্যদিকে পটিফরের কাছে শীঘ্রই সে এমন অনুগ্রহ পেয়েছিল যা ছিল কল্পনাতীত। তিনি তাকে তার গৃহের সর্বোচ্চ স্থানে বসিয়ে দিলেন।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত-‘সে (ইউসূফ) যখন পুরো সাবালক হল তখন আমি তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম। আর এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়নদের পুরস্কৃত করি।’(১২:২২)
পটিফরের গৃহেই পুত্রস্নেহে বেড়ে উঠল ইউসূফ। বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শারিরিক গঠনের পরিবর্তন হল বিষ্ময়কর রকমের। পাগল করা এই রূপের কোন বিবরণ নেই। তারপর তার জীবনে মহা-পরীক্ষা এল।
অসম্ভব সুপুরুষ ইউসূফের প্রতি জুলেখা ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। তার পুত্রস্নেহের শেষ অনুভূতিটুকু মুছে গেল অতি অল্প সময়ে। তার মনে জ্বলে উঠল কামনার আগুন এবং সে তাকে তার সঙ্গে ব্যভিচার করতে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করতে থাকল। কিন্তু ইউসূফ নির্বিকার। সে সাড়া দেয় না। কারণ সে জানে-‘এই প্রস্তাব নিশ্চিত পতনের! এ মহাপাপ।’ প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে জুলেখা- কেনা গোলামের এত বড় স্পর্ধা! যে কোন উপায়ে সে তার মনোষ্কামনা পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিল। অতঃপর সুযোগমত একদিন ইউসূফকে বলল, ‘হে ইউসূফ! এখনি একবার আমার শয়নকক্ষে এস।’
ইউসূফ হয়তঃ জুলেখার মনোভাব আঁচ করতে পেরেছিল। কিন্তু সে তারই গৃহে তারই অন্নে লালিত-পালিত হচ্ছে, সুতরাং তার আদেশকে উপেক্ষা করা সহজসাধ্য ছিল না। জুলেখাকে অনুসরণ করে সে তার কক্ষের দিকে এগিয়ে চলল।
ইউসূফ শয়নকক্ষে প্রবেশ করলে জুলেখা দ্রুত দ্বার রুদ্ধ করে ইউসূফের হস্তধারণ পূর্বক তাকে বলল, ‘আমার এই রূপ যৌবনের লাবণ্যে বিকশিত দেহমন তোমার জন্যে উৎসর্গীত।’
ইউসূফ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কক্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে রইল। সে হয়তঃ মনিব পত্নীর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ফেলত যদি না ঐ সময় সে আল্লাহর নিদর্শণ প্রত্যক্ষ করত।
জুলেখা যখন ইউসূফকে বাহুবন্দী করতে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল গৃহের এক কোনে রক্ষিত একটি মূর্ত্তির প্রতি। তৎক্ষণাৎ ইউসূফকে মুক্ত করে দিয়ে সে দ্রুত এগিয়ে গেল মূর্ত্তির দিকে। তারপর একখন্ড বস্ত্র দ্বারা সেটিকে আবৃত করে লাজুক হেসে আঁড় চোখে ইউসূফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের পারিবারিক দেবতা, আমার উপাস্য। তার দৃষ্টিকে আড়াল করলাম।’
একথা শোনা মাত্র ইউসূফের মনে হল আল্লাহর দৃষ্টিকে তো কোন পর্দা দিয়ে আড়াল করা যায় না। এসময় জুলেখা যখন ফিরে এসে তার হাত ধরে বলল, ‘আমার বিছানায় এস।’ তখন সে সম্বিত ফিরে পেল। সুতরাং তার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘এ হতে পারে না। এ জঘণ্য পাপ। তাছাড়া আপনার স্বামী আমার মনিব। আমাকে যথেষ্ট ইজ্জতের সাথে রেখেছেন তিনি। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আল্লাহর নাফরমানি করা? অসম্ভব! আপনার নোংরা ষড়যন্ত্র থেকে আত্মরক্ষার জন্যে আমি একমাত্র আল্লাহর সাহায্যপ্রার্থী।’
পশ্চাৎ থেকে তার জামা টেনে ধরল। |
এদিকে ইউসূফকে বাহুবন্দী করতে তার পশ্চাৎধাবন করেছিল জুলেখা। সম্মুখে স্বামীকে দেখে চমকে উঠে সে। ইউসূফের ঠিক পিছনে থমকে দাঁড়ায় সেও। এদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় গৃহকর্তা। নিজ স্ত্রী এবং ইউসূফ- উভয়ের অবিন্যস্ত অবস্থা দেখে মনে তার সন্দেহ দাঁনা বেঁধে ওঠে। কি করবেন স্থির করতে পারেন না তিনি। হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
পরিবেশ তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্যে মুহুর্তে রূপ পাল্টে ফেলল জুলেখা। স্বামীকে লক্ষ্য করে তীব্র তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল, ‘এই সেই লোক যাকে তুমি গোলাম হিসেবে খরিদ করে স্নেহের আধিক্যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় উন্নীত করেছ- সে আজ তোমারই সম্ভ্রম হননের অভিলাষী। আমার সঙ্গে জোরপূর্বক ব্যভিচারের চেষ্টা করেছে সে। যে লোক অন্নদাতা গৃহকর্তার মান-মর্যাদার মূল্য দেয় না- এমন জঘণ্য প্রবৃত্তির লোককে কঠিন শাস্তি দেয়া উচিৎ অথবা তাকে কারাগারে রাখাই উত্তম।’
সম্পূর্ণ বাহ্যিক প্রমাণের দ্বারাই দোষী সাব্যস্ত হতে যাচ্ছে ইউসূফ। সে নারী চরিত্রের পরিবর্তনমূখী অবস্থা লক্ষ্য করে বিষ্মিত হল। জুলেখার কথার প্রতিবাদ করে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি কখনই আমার লালনকর্তার মান-সম্মান লুন্ঠনে অভিলাষী নই বরং আপনার স্ত্রীই আমাকে তার কূ-বাসনা চরিতার্থ করতে প্ররোচিত করেছিল। আমি রাজী হইনি।’
উভয়েই পরস্পরের উপর দোষ চাপাতে চাইছে- পটিফর বিষম খেলেন। তিনি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছেন না। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ঐ সময় বাড়ীতে আরও একজন উপস্থিত ছিলেন। তিনি জুলেখারই জ্ঞাতি। সবকিছু শুনে তিনি গৃহকর্তাকে বললেন, ‘এরূপ ঘটনায় ইউসূফের জামার সামনের অংশ ছিঁড়লে সে দায়ী, পিছনের অংশ ছিঁড়লে জুলেখা।’
গৃহস্বামী দেখলেন ইউসূফের জামার পিছনের অংশ ছেঁড়া। তিনি পরিস্কার বুঝতে পারলেন তার স্ত্রীই দোষী- ইউসূফ নির্দোষ। মনে মনে উত্তেজিত হলেও নিজের মান-ইজ্জত, বংশ-মর্যাদার কথা চিন্তা করে নিজেকে সংযত রাখলেন তিনি এবং স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমরা ছলনাময়ী নারী, বহুরূপী। নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সবকিছূ করতে পার তোমরা। নিশ্চয়ই তুমি অপরাধী। অথচ নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিৎ ছিল তোমার। আর ইউসূফকে বললেন, ‘হে ইউসূফ! তুমি এ বিষয়ে কিছু মনে কোরও না। আমার সামাজিক মান-মর্যাদার কথা ভেবে সবকিছূ ভুলে যাও।’
জুলেখা নত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল। গৃহকর্তা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে নারী! এখন লজ্জিত ও অনুতপ্ত হও। আর কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা প্রার্থণা কর।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ‘সে যে মহিলার বাড়ীতে ছিল সে (জুলেখা) তার চরিত্র নষ্ট করার জন্যে তাকে ফুসলাতে লাগল ও সকল দরজা বন্ধ করে বলল, ‘এস।’
সে বলল, ‘আমি আল্লাহর স্মরণ নিচ্ছি, আমার প্রভু, তিনি আমাকে সম্মানের সাথে থাকতে দিয়েছেন। যারা সীমালংঘন করে তারা অবশ্য সফলকাম হয় না।’
সেই মহিলা (জুলেখা) তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল, আর সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শণ প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্যে আমি এভাবে নিদর্শণ দেখিয়েছিলাম। সে ছিল অবশ্যই আমার বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের একজন। ওরা দু‘জন দৌঁড়ে দরজার দিকে গেল আর স্ত্রীলোকটি পিছন থেকে তার জামা ছিঁড়ে ফেলল। স্ত্রীলোকটির স্বামীকে তারা দরজার কাছে দেখতে পেল। স্ত্রীলোকটি বলল, ‘যে তোমার পরিবারের সঙ্গে কূ-কর্ম কামনা করে তারজন্যে তাকে কারাগারে পাঠান বা অন্য কোন দারুণ শাস্তি ছাড়া আর কি শাস্তি হতে পারে?’
ইউসূফ বলল, ‘সেই আমার কাছ থেকে কূ-কর্ম কামনা করেছিল।’
স্ত্রীলোকটির পরিবারের একজন সাক্ষ্য দিল, ‘যদি ওর জামার সামনের দিক ছেঁড়া থাকে তবে স্ত্রীলোকটি সত্যিকথা বলেছে, ইউসূফ মিথ্যে বলেছে; কিন্তু ওর জামা যদি পিছন দিকে ছেঁড়া থাকে তবে স্ত্রীলোকটি মিথ্যেকথা বলেছে, ইউসূফ সত্যি বলেছে।’
গৃহস্বামী যখন দেখল যে তার জামা পিছন দিক থেকে ছেঁড়া তখন সে বলল, ‘এ তোমাদের নারীদের ছলনা! তোমাদের ছলনা তো কঠিন। হে ইউসূফ! তুমি এ বিষয়ে কিছু মনে কোরও না। আর হে নারী! তুমি তোমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তুমি অপরাধী।’ (১২:২৩-২৮)
ঘটনাটি নিয়ে পটিফর বিশেষ ঘাটাঘাটি করতে চাননি। কিন্তু তবুও তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল জুলেখার অসংযত আচরণের কারণে। পাঁচজন স্ত্রীলোক (পটিফরের পানীয় পরিবেশকের স্ত্রী, প্রধান পাচকের স্ত্রী,পশুপালন কর্মকর্তার স্ত্রী, কারা কর্মকর্তার স্ত্রী ও প্রাসাদ রক্ষীদের প্রধানের স্ত্রী) সর্বপ্রথমে এ বিষয়টি আবিস্কার করল যে, ইউসূফের প্রতি জুলেখার আচরণ মনিব-গোলাম সম্পর্কের স্তরে নয়। তারা একে অপরের সাথে বিষয়টি কানাঘুষা করল। অতঃপর তাদের শ্যেণদৃষ্টি জুলেখার একতরফা প্রেমের সম্পর্ক আবিস্কার করে ফেলল। অতি মুখরোচক এই সংবাদ তারা অতিরঞ্জিত করে দ্রুত ছড়িয়ে দিল। এতে শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা পটিফরের স্ত্রীর নিন্দা করতে লাগল। তারা বলতে লাগল, ‘ছি! ছি! এ-কি! এক ক্রীতদাসের কাছে প্রণয় নিবেদন করে জুলেখা তো আমাদের মুখে কালিমা লেপন করেছে।’
কানাঘুষা কানে কানে জুলেখার কানেও ফিরে আসে। সে ভাবল-‘অপরের দুর্বলতা নিয়ে যারা ঘাটাঘাটি করে তাদেরকে জব্দ করতে হবে। তাদেরকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে।’ তাই সে ইউসূফের জন্যে কেন এমন করেছে তা তাদেরকে জানানোর জন্যে শহরের সকল সম্ভ্রান্ত মহিলাদের এক ভোজে নিমন্ত্রণ করল। নির্দিষ্ট সময়ে অতিথিরা উপস্থিত হয়ে আসন গ্রহণ করল। সবার সামনে প্লেটে আপেল এবং ছুরি দেয়া হয়েছে। আনন্দঘন পরিবেশে সকলে আপেল কেটে খেতে শুরু করল। এসময় জুলেখা গিয়ে ইউসূফকে বলল, ‘ওদের সামনে এস।’
জুলেখার সঙ্গে ইউসূফ যখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হল তখনি একসঙ্গে সকলের দৃষ্টি তার প্রতি নিপতিত হল। তাকে দেখার পর তার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তারা সমস্বরে বলল ‘আল্লাহ মহান! এ তো মানুষ নয়, এ তো এক ফেরেস্তা!’
ইউসূফের শ্রেয়তায় বিমুগ্ধ হয়ে অবচেতন মনে উপস্থিত মহিলারা সকলেই ফলকাটা ছুরিতে আপেল কাটতে গিয়ে তাদের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলল। জুলেখার ধারণাই শেষপর্যন্ত সত্য প্রমানিত হল। নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিনী হিসেবে দেখতে পেল নিমন্ত্রিত মহিলাদেরকে। সে মনে মনে বলল, ‘এই তো ঘটনা!’
পিন পতন নিস্তব্ধতা ভেদ করে জুলেখার তীক্ষ্ণ কন্ঠ ধ্বনিত হল, ‘দেখে নাও, এই সেই গোলাম! প্রথম দর্শণেই তোমরা যার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছ। আর যার জন্যে তোমরা আমায় অপবাদ দিতেছিলে। বাস্তবিকই আমি নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সে নিস্পাপ রয়েছে।’-সে দৃষ্টি ফেরাল ইউসূফের দিকে- ‘তবে ভবিষ্যতে সে আমার আদেশ অমান্য করলে অবশ্যই কারাগারে প্রেরিত হবে এবং লাঞ্ছিত হবে।’
নিমন্ত্রিত সুন্দরীরা বুঝল জুলেখার কোন দোষ নেই। কিন্তু তার কথা ভাববার সময় তাদের কোথায়? তাদের মন তো ঐ মুহুর্তে ইউসূফকে প্ররোচিত করতে, তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে নানা ছলাকলা রচনায় ব্যস্ত। তথাপি কয়েকজন মহিলা নিজেদেরকে সামলে নিল। তারা ভাবল- আমরা তো তার অতিথি, সুতরাং তার পক্ষে কথা না বললে প্রতারণা করা হবে। অতঃপর তাদের একজন এগিয়ে এসে ইউসূফকে বলল, ‘জুলেখা তোমার মনিবপত্নী, সুতরাং তার ইচ্ছে অবমাননা করা তোমার কখনও উচিৎ নয়।’
অন্য একজন পাশ থেকে বলল, ‘তুমি কেমন যুবক? এমন সুযোগ হাতছাড়া করছ? তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাও। অতঃপর তাকে ভাল না লাগলে আমরা তো অপেক্ষমান রয়েছি.. ’- অন্যরকম এক হাসি দিয়ে সে এক চক্ষু মুদে একটা অসৎ ইঙ্গিত করল।
ইউসূফ একদল বুভূক্ষ রমনীদের সামনে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিল। অতঃপর যখন দেখল আগত রমনীরাও জুলেখার সূরে সূর মিলিয়েছে, চারিদিক থেকে সকলেই তার চরিত্র হরণের চেষ্টা করছে, তখন সে মনে মনে আল্লাহর রহমত কামনা করে প্রার্থনা করতে লাগল, ‘হে আল্লাহ! চক্রান্তকারীদের কবল হতে তুমি যদি উদ্ধার না কর তবে আমি হয়তঃ ওদের খপ্পরে পড়ে অধঃপতিত হব। তারা তো আমার দম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে দিয়েছে। এর থেকে তো কারাগারই আমার জন্যে উত্তম।’
এসময় জিব্রাইল এসে তাকে জানাল, ‘তুমি নিজেকে নিজে কারাগারে নিক্ষেপ করলে। তুমি নিরাপত্তা চাইলে আল্লাহ তোমাকে নিরাপত্তা দিতেন।’
এদিকে শহরের মহিলারা ইউসূফের ভাবলেশহীন অবস্থাকে তাদের প্রস্তাবের অসম্মতি হিসেবে ধরে নিল। তারা ভীষণ রাগান্বিত হল। অতঃপর তারা তাদের হস্তকর্তণের জন্যে দায়ী করে ইউসূফের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘শহরের মহিলারা বলল,‘আজিজের স্ত্রী তার জওয়ান চাকরটাকে খারাপ করার জন্যে ফুসলাচ্ছে, প্রেমে পাগল হয়ে গেছে, আমরা তো দেখছি সে বড় ভুল করছে।’
সে (আজিজের স্ত্রী) যখন ওদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনল তখন সে ওদেরকে নিমন্ত্রণ করল এক ভোজসভায়। ওদের প্রত্যেককে সে একটি ছুরি দিল (ফল কাটার জন্যে) আর ইউসূফকে বলল, ‘ওদের সামনে এস।’
তারপর ওরা যখন তাকে দেখল তখন তার শ্রেয়তায় অভিভূত হয়ে নিজেদের হাত কেটে ফেলল। ওরা বলল, ‘আল্লাহ মহান! এ তো মানুষ নয়, এ তো এক মহান ফেরেস্তা!’
সে বলল, ‘ইনিই তিনি যার জন্যে তোমরা আমার নিন্দা করছ। আমি তাকে খারাপ করার জন্যে ফুসলাবার চেষ্টা করেছি; কিন্তু সে তো নিজেকে পবিত্র রেখেছে। আমি তাকে যা বলি সে যদি তা না করে তবে সে কারাগারে যাবেই এবং তাকে অপমান করা হবে।’
ইউসূফ বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! এ মহিলারা আমাকে যার দিকে ডাকছে তার চেয়ে যে কারাগার আমার অনেক প্রিয়। তুমি যদি ওদের ছলনা থেকে আমাকে রক্ষা না কর তবে আমি ওদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং জাহেল বনে যাব।’
তারপর তার প্রতিপালক তার ডাকে সাড়া দিলেন ও তাকে ওদের ছলনা থেকে রক্ষা করলেন। তিনি তো সব শোনেন, সব জানেন। লক্ষণ দেখে ওদের মনে হল যে, তাকে কিছু সময়ের জন্যে কারাগারে পাঠাতেই হবে।(১২:৩০-৩৫)
শহরের মহিলাদের অভিযোগ এবং নিজের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার কথা ভেবে পটিফর ইউসূফকে স্ত্রীর নাগালের বাইরে সরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। তিনি ভাবলেন- ‘এই গোলামের কারণে আমাদের অনেক দূর্ণাম হয়েছে, নানাভাবে লজ্জিত হতে হয়েছে। সুতরাং তাকে যদি কিছুদিনের জন্যে কয়েদখানায় রাখা হয়, তাহলে ধীরে ধীরে লোকদের আলোচনা হ্রাস পাবে আর তাতে আমাদের দূর্ণামও ঘুচতে থাকবে।’
তিনি ইউসূফকে জেলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ইউসূফ জেলে গেল। সবাই জানল- পটিফর পত্নী জুলেখাকে অসৎ কাজে ফুসলানোর অপরাধে তাকে বন্দী করা হয়েছে।
জেলখানায় পৌঁছে ইউসূফ জুলেখার একটি পত্র পেল। এতে লেখা ছিল- ‘হে ইউসূফ! তুমি আমার সমস্ত আকাঙ্খা ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছ। তুমি যেমন আমাকে মানষিক কষ্ট দিয়েছ, তেমনি আমিও তোমাকে আযাবে পাকড়াও করেছি।
-রেশমী ভূষণের পরিবর্তে এখন তোমাকে মোটাকাপড় পরিধান করতে হয়েছে। ঐ লেবাস তোমার সুন্দর দেহকে দলিত-মথিত করবে। অলঙ্কারের বদলে এখন পরিধান করতে হয়েছে লোহার বেড়ী, যা তোমার পদদ্বয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলবে।’
কয়েকদিনের মধ্যে জুলেখা বুঝতে পারল জেলখানায় আটক করলেও ইউসূফকে সে মন থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি। ইউসূফ তার প্রেম। গৃহের সর্বত্র এমনকি শয়নে-স্বপনে তার উপস্থিতি। স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরতে লাগল। অতঃপর তার মনে অপরাধবোধ জাগ্রত হল। সুতরাং সে কারাকর্মকর্তার কাছে একপত্র দিল-
‘প্রকৃতপক্ষে এই ব্যক্তি কোন অপরাধী নয়। বিশেষ এক কারণে তাকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। সুতরাং তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শণ করা হোক।তার হাত-পায়ের বেড়ী খুলে তাকে জেলখানার সর্বোত্তম স্থানে রাখা হোক।’
ফেরাউনের তিনটি কয়েদখানা ছিল। এগুলি হল-
- সিজনূল কতলঃ এটা ৪০ গজ গভীর গর্তসদৃশ করে তৈরী করা হয়েছিল। এখানে নিক্ষিপ্ত কোন ব্যক্তি এর সর্বশেষ প্রান্তে পৌঁছিতে পৌঁছিতে মৃত্যুমুখে পতিত হত।
- সিজনূল আযাবঃ এটিও একটি গর্ত বিশেষ। এটা এত অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল যে, সেখানে রাত্রি বা দিনের পার্থক্য করা যেত না।
- সিজনূল আফিয়াঃ এটি ভূমির উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। বিচারের পূর্বে আসামীদের বা সামান্য অপরাধীদের এখানে এনে রাখা হত। জুলেখার পত্র পাবার পর ইউসূফকে এখানকার সর্বোত্তম স্থানে এনে রাখা হয়েছিল।
কারাগারের নিরিবিলি পরিবেশ এবং প্রচুর অলস সময় ইউসূফকে সুযোগ করে দিল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে একনিষ্ঠ ভাবে স্মরণ করার। অতঃপর তার আচরণ, অপরিসীম ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা, চরিত্র মাধুর্য্য, জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা তাকে অন্য বন্দীদের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা এনে দিল। তার সঙ্গে বন্দীদের মধ্যে আরও দু‘জন ছিল। এদের একজন ছিল ফেরাউনের প্রধান রুটিকার আর অন্যজন ছিল প্রধান পানীয় পরিবেশক। খাদ্যে এবং মদে বিষ মিশ্রিত করার অপরাধে এদেরকে বন্দী করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত হচ্ছিল এবং ইতিমধ্যে তা শেষও হয়েছিল। যখন রায় হবে হবে অবস্থা, সেসময়ই একরাতে এদের দু’জনই স্বপ্ন দেখল। কিন্তু বন্দী থাকায় অর্থ জানে এমন কাউকে না পেয়ে তারা উভয়ই মনমরা হয়ে পড়ল। ইউসূফ তাদেরকে বিষন্ন দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদেরকে এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?’
তারা বলল, ‘আমরা দু‘জনেই একটা করে স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তার অর্থ বলতে পারে এমন কেউ এখানে নেই।’
ইউসূফ বলল, ‘একমাত্র আল্লাহই সর্বক্ষমতার অধিকারী। তোমাদের স্বপ্নদু‘টি আমাকে বল।’
প্রধান পানীয় পরিবেশক বলল, ‘স্বপ্নে আমি একটি আঙ্গুরগাছ দেখলাম যার তিনটি ডাল ছিল। সেই ডালে কুঁড়ি ধরবার সঙ্গে সঙ্গে ফুল ফুঁটল আর থোকায় থোকায় আঙ্গুর ধরে পেঁকে উঠল। আমি সেই আঙ্গুর নিংড়ে রস বের করে তা পেয়ালা পূর্ণ করে ফেরাউনকে দিলাম।’
অপরজন বলল, ‘আমি দেখলাম আমার মাথার উপর তিন টুকরি রুটি বইছি আর পাখিরা এসে তা থেকে আহার করতে লাগল। হে ইউসূফ! পারলে আমাদেরকে আপনি এর অর্থ বুঝিয়ে দিন, আমরা তো আপনাকে সৎকর্মপরায়ণ দেখছি।’
ইউসূফ বলল, ‘যে খাবার তোমাদের দেয়া হয় তা আসার পূর্বেই আমি তোমাদের স্বপ্নের অর্থ বুঝিয়ে দেব। আমি যা তোমাদেরকে বলব তা আমার প্রতিপালক আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার থেকেই বলব।’
ইউসূফ একজন নবী। লোকদেরকে মূর্ত্তিপূজা ত্যাগ করে এক আল্লাহর দিকে আহবান করাই তার কাজ। তাই সে তাদেরকে বলল, ‘আমি এক আল্লাহকে ও পরলোকে অবিশ্বাসীদের সমাজ বর্জন করেছি। আমি আমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের সমাজ অনুসরণ করি। হে কারাগারের সঙ্গীরা, একাধিক প্রতিপালক ভাল, না এক শক্তিশালী আল্লাহ? অথচ তাঁকে ছেড়ে তোমরা উপাসনা করছ কতকগুলো নামের যা তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা বানিয়েছ। আল্লাহই আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারও উপাসনা না করতে; এ-ই সরল ধর্ম কিন্তু অনেক মানুষই তা জানে না।’
দু'বন্দীর নিকট স্বপ্ন ব্যাখ্যা করছেন ইউসূফ। |
ইউসূফ জানত, রুটিকার দোষী সাব্যস্ত হবে এবং তাকে শূলে চড়ান হবে। আর পানীয় পরিবেশক নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে চাকুরীতে পুনঃর্বহাল হবে। দু‘টি স্বপ্নের একটির ফল অপরটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু স্বপ্নের অর্থ করার সময় সে স্বপ্ন দু‘টির অর্থ আলাদা করে বলল না। কারণ আলাদা করে বললে রুটিকার সাথে সাথে মনমরা হয়ে পড়ত বা ভেঙ্গে পড়ত। সে একজন রসূল। সুতরাং সে তার কথার দ্বারা তার কোন উম্মতের মনে সামান্য দুঃখ দিতে চাননি। এ কারণে সে উভয় স্বপ্নের অর্থ একত্রে বলেছে, যাতে তারা সাথে সাথেই বুঝে ফেলতে না পারে যে, কাকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করা হবে। আর তাতে সে ক্ষণিকের জন্যে হলেও অস্থিরতা মুক্ত থাকতে পারে।
স্বপ্নের অর্থ শোনার পর বিষ্মিত দু‘বন্দীই একে অপরের সাথে বিষ্মিত দৃষ্টি বিনিময় করল। অতঃপর তারা নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে আলোচনা শেষে ইউসূফকে বলল, ‘হে ইউসূফ! আমরা প্রকৃতপক্ষে কোন স্বপ্নই দেখিনি। এখন আমরা অত্যন্ত দুঃখিত এ কারণে যে, আমরা আপনাকে মিথ্যে বানিয়ে বলেছি।’
ইউসূফ তাদের কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, ‘এই অর্থ আমি নিজে করিনি। এটা আল্লাহর সিদ্ধান্ত। সুতরাং এর ব্যতিক্রম হবে না।’
পানীয় পরিবেশনকারীকে (যে মুক্তি পাবে বলে তার মনে হল) ইউসূফ একান্তে ডেকে বলল, ‘সুদিনে আমার কথা ভুলে যেও না। ফেরাউনকে আমার কথা বোলও, যাতে তোমার সাহায্যে আমি এই কয়েদখানা থেকে বের হতে পারি। সত্যি বলতে কি আমি এমন কিছু করিনি যার জন্যে আমাকে কয়েদখানায় আটক রাখা যায়।’
সে প্রতিজ্ঞা করে বলল, ‘আমি অবশ্যই আপনার জন্যে মধ্যস্থতা করব।’
ইউসূফের ব্যাখ্যা সফল হল। তিনদিন পর ফেরাউনের নির্দেশে উভয় বন্দীকে জেলখানা থেকে দরবারে আনা হল। অতঃপর বিচারক তার রায় ঘোষণা করলেন- ‘স্বাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে রুটিকারের বিরুদ্ধে খাদ্যে বিষ মিশ্রিত করার অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় তাকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যার আদেশ দেয়া হল এবং অপর কয়েদী, পানীয় পরিবেশনকারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় তাকে চাকুরীতে স্ব-সম্মানে পুনঃর্বহাল করার নির্দেশ দেয়া গেল।’
মুক্তিপ্রাপ্ত জন মুক্তি পাবার পরই শয়তানের প্ররোচনায় ইউসূফের ব্যাপারে তার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেল। আর শয়তান তাকে ভুলিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এই কারণে যে- একজন নবীর পক্ষে একজন বন্দীর মাধ্যমে দেশের অধিপতির কাছে স্বীয় মুক্তির জন্যে আবেদন করা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ছিল না।
সুতরাং ইউসূফ আরও কয়েক বৎসর জেলে রইল।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ‘তার সঙ্গে দু‘জন যুবকও কারাগারে গেল। ওদের একজন বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি আঙ্গুর নিংড়ে রস বের করছি।’
আর অন্যজন বলল, ‘আমি আমার মাথায় রুটি বইছি আর পাখি তার থেকে খাচ্ছে, আমাদেরকে আপনি এর অর্থ বুঝিয়ে দাও, আমরা আপনাকে তো সৎকর্মপরায়ণ দেখছি।’
ইউসূফ বলল, ‘তোমাদের যে খাবার দেয়া হয় তা আসার আগে আমি তোমাদের স্বপ্নের অর্থ বুঝিয়ে দেব। আমি যা তোমাদেরকে বলব তা আমার প্রতিপালক আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার থেকেই বলব। যে সম্প্রদায় আল্লাহকে বিশ্বাস করে না ও পরলোকে অবিশ্বাস করে আমি তো তাদের সমাজ বর্জন করেছি। আমি আমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের সমাজ অনুসরণ করি। আল্লাহর সাথে কোন জিনিসকে শরিক করা আমাদের কাজ না। এ আমাদের এবং সব মানুষের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ, কিন্তু অনেক মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
--হে কারাগারের সঙ্গীরা, একাধিক প্রতিপালক ভাল, না এক শক্তিশালী আল্লাহ? তাঁকে ছেড়ে তোমরা উপাসনা করছ কতকগুলো নামের যা তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা বানিয়েছ, যাদের জন্যে কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠাননি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনিই আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্যকারও উপাসনা না করতে; এ-ই সরল ধর্ম কিন্তু অনেক মানুষ তা জানে না।
--হে কারাগারের সঙ্গীরা! তোমাদের একজন সম্বন্ধে কথা এই যে, সে তার প্রভুকে মদ্যপান করাবে। আর অপরজন সম্বন্ধে কথা এই যে, সে শূলবিদ্ধ হবে। তারপর তার মাথা থেকে পাখি আহার করবে। যে বিষয়ে তোমরা জানতে চাচ্ছ তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে।’
ওদের মধ্যে যে মুক্তি পাবে বলে ইউসূফের মনে হল তাকে সে বলল, ‘তোমার প্রভুর কাছে আমার কথা বোলও।’
কিন্তু শয়তান ওকে ওর প্রভুর কাছে তার কথা বলতে ভুলিয়ে দিল। তাই ইউসূফ কয়েক বৎসর কারাগারেই রয়ে গেল।(১২:৩৬-৪২)
ফেরাউন নিজেই দু’টি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে দেখলেন তিনি নীল নদের তীরে দাঁড়িয়ে আছেন এ সময় নদী থেকে সাতটা মোটাসোটা গাভী উঠে এসে নলবনে চরে বেড়াতে লাগল। পরে তিনি দেখলেন ঐ নদী থেকে আরও সাতটা অতি রুগ্ন গাভী উঠে এল এবং তারা এসে ঐ মোটাসোটা গাভীগুলোকে খেয়ে ফেলল।
এই স্বপ্ন দেখার পর ফেরাউনের নিদ্রা টুটে গেল। পরে তিনি আবারও নিদ্রিত হয়ে পড়লেন এবং দ্বিতীয়বার স্বপ্নে দেখলেন একটি গম থেকে সাতটি পুষ্টশীষ জন্ম নিল। তারপর জন্ম নিল আরও সাতটি অপুষ্ট শীষ। সেই অপুষ্ট শীষগুলো ঐ সাতটা তাজা, পুষ্ট শীষগুলো খেয়ে ফেলল।
ফেরাউন তার এই স্বপ্ন দু‘টির অর্থ জানতে উৎগ্রীব হয়ে পড়লেন। তিনি তার সমস্ত পন্ডিতবর্গকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু এর অর্থ তার কোন পন্ডিতই বলতে পারল না। স্বপ্ন সম্পর্কে তারা জানিয়েছিল- ‘এটা একটা অর্থহীন বাজে স্বপ্ন। আর এ ধরণের ফালতু স্বপ্নের অর্থ করা আমাদের কাজ না।’
কিন্তু ফেরাউন তা মেনে নিতে রাজী নন। স্বপ্নের অর্থ জানার জন্যে তিনি অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন। এসময় পানীয় পরিবেশনকারীর ইউসূফের কথা স্মরণ হল যিনি, তার স্বপ্নের অর্থ করেছিলেন। সে করজোড়ে ফেরাউনের কাছে নিবেদন করল, ‘যদি আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে অবকাশ দেন তবে আমি আপনার স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা এনে দিতে পারব।’
ফেরাউন তাকে বললেন, ‘নিশ্চয়ই! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে এই সপ্নের ব্যাখ্যা এনে দাও।’
পানীয় পরিবেশনকারী তাড়াতাড়ি জেলখানায় হাজির হল। তারপর ইউসূফকে বলল, ‘হে ইউসূফ, হে সত্যবাদী! আমি দুঃখিত যে আপনার বিষয়ে ফেরাউনকে বলতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘদিন পর আপনার কথা আমার স্মরণ হয়েছে এবং ফেরাউনকে আপনার সম্মান ও মর্যাদার কথা বলেছি। তিনি তার দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে এখন আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’
অতঃপর সে ফেরাউনের স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণনা করে বলল, ‘হে ইউসূফ! ফেরাউনের দেখা স্বপ্নে সাতটি মোটা গাভী ও সাতটি রুগ্ন গাভীর, সাতটি উত্তম শীষের ও সাতটি শীর্ণ শীষের অর্থ আমাকে জানান। যেন আমি ফিরে গিয়ে তাকে তা জানাতে পারি।’
স্বপ্নগুলি শোনার পরে, ইউসূফের কাছে আল্লাহর মাধ্যমে, যে অর্থ এল, তা সে বলল। সাতটি মোটা গাভী ও উত্তম শীষের অর্থ, প্রচুর ফসলের সাতটি বৎসর এবং সাতটি রুগ্ন গাভী ও সাতটি শীর্ণ শীষের অর্থ পরবর্তী সাতটি বৎসর দুর্ভিক্ষের।’
সে পানীয় পরিবেশনকারীকে আরও একটু অতিরিক্ত তথ্য জানাল যে, দুর্ভিক্ষের বৎসরগুলি অতিক্রান্ত হয়ে গেলে পরের বৎসর প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং প্রচুর ফসল, আঙ্গুর উৎপন্ন হবে। আর লোকেরা তৃপ্তি সহকারে আঙ্গুর উপভোগ করবে।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘বাদশা বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম সাতটি রুগ্ন গাভী, সাতটি মোটাসোটা গাভীকে খেয়ে ফেলছে, আর দেখলাম সাতটি সবুজ শীষ ও বাকি সাতটি শুকনো। হে প্রধানগণ! যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পার, তবে আমার স্বপ্নের সম্বন্ধে বিধান দাও।’
ওরা বলল, ‘এ অর্থহীন স্বপ্ন এবং অর্থহীন স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই।’
দুই বন্দীর মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছিল তার দীর্ঘকাল পরে ইউসূফের কথা স্মরণ হল। সে বলল, ‘আমি এর অর্থ আপনাদেরকে জানিয়ে দেব। আপনারা আমাকে যেতে দিন।’
সে (মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দী) বলল, ‘হে ইউসূফ, হে সত্যবাদী! সাতটি রুগ্ন গাভী, সাতটি মোটা সোটা গাভীকে খেয়ে ফেলছে, আর সাতটি সবুজ ও অপর সাতটি শুকনো শীষ সম্বন্ধে আপনি আমাদেরকে ব্যাখ্যা করেন, যেন আমি বাদশা ও সভাসদদের কাছে ফিরে গেলে তারা জানতে পারেন।’
ইউসূফ বলল, ‘তোমরা সাত বৎসর একটানা চাষ করবে, তারপর তোমরা যে শস্য সংগ্রহ করবে ওর মধ্যে যা তোমরা খাবে তা ছাড়া সব শীষ সমেত রেখে দেবে। আর তারপর আসবে সাতটি কঠিন বৎসর। এই সাত বৎসর তোমরা যা জমিয়ে রাখবে লোকে তা খেয়ে ফেলবে, সামান্য কিছু ছাড়া যা তোমরা বাঁচিয়ে রাখবে। আর তারপর আসবে এক বৎসর, সে বৎসর মানুষের জন্যে প্রচুর বৃষ্টি হবে আর সে বৎসর মানুষ (ভালই) আঙ্গুর পিষবে (উপভোগ করবে)।’(১২:৪৩-৪৯)
পানীয় পরিবেশনকারী ইউসূফের দেয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে খুশী মনে দ্রুত ফেরাউনের দরবারে হাজির হল এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিশদভাবে জানাল। সবশুনে বাদশা তো বিষ্ময়ে বিমূঢ়! স্বপ্নের এমন সুন্দর ব্যাখ্যা! তিনি পানীয় পরিবেশনকারীকে নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি এখনই তাকে মুক্ত করে দরবারে নিয়ে এস।’
ফেরাউনের নির্দেশ পেয়ে দ্রুত পায়ে জেলখানায় উপস্থিত হল পানীয় পরিবেশনকারী। তারপর সে ইউসূফকে বলল, ‘জনাব, সুসংবাদ! আপনার মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছি। ফেরাউন স্বয়ং আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।’
ইউসূফ ফেরাউনের তরফ থেকে মুক্তির সংবাদ পেয়েও তা সাদরে গ্রহণ করেননি। সংবাদ বাহক লোকটিকে তিনি বললেন, ‘এভাবে আমি মুক্ত হতে পারিনে।’
তিনি পানীয় পরিবেশনকারীর মাধ্যমে ফেরাউনকে বলে পাঠালেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আরোপিত ষড়যন্ত্রের প্রকৃত তথ্য উৎঘাটন করতে হবে। যেসব মহিলারা নোংরা বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে, নিজেদের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে আঙ্গুল কেটেছিলেন, তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে হবে। সেই নোংরা ফাঁদে পা না দেবার জন্যেই আমাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। প্রকৃত সত্য উৎঘাটন না হলে চিরজীবন দোষী হয়েই থাকতে হবে। এরকম মুক্তির মধ্যে কোন মাহাত্ম নেই।’
এখানে লক্ষণীয় ইউসূফ তার বক্তব্যে হস্তকর্তনকারী মহিলাদের কথা উল্লেখ করলেন, কিন্তু ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু জুলেখার কথা উল্লেখ করেননি। এটা ঐ নিমকের কদরের কারণে যা তিনি পটিফরের গৃহে লালিত-পালিত হয়ে খেয়েছিলেন।
ইউসূফের বক্তব্য শুনে বিমর্ষবদনে পানীয় পরিবেশনকারী ফেরাউনের কাছে ফিরে গেল। তারপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল তাকে। সকল কথা শ্রবণে ফেরাউন বিষ্মিত হলেন। তার নির্দেশে দরবারে জুলেখা ও অন্যসব মহিলাদের হাজির করা হল।
সবাইকে উদ্দেশ্য করে ফেরাউন বললেন, ‘ইউসূফের ব্যাপারে তোমাদের মতামত জানতে চাই আমি। তোমরা কি তার কথা ভুলে গেছ? সে এখনও কারাগারে।’
সভাষদগণের মাঝে জুলেখা তার প্রেমিকের পবিত্রতা স্বীকার করল। সে বলল, ‘মানুষের মন কূ-কর্মের দিকে প্ররোচিত করে। মনের সাধ পূর্ণ হয়নি আমার। সৎকর্মশীলদের প্রতি আল্লাহ মেহেরবান। ইউসূফের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিনে এবং আমার স্বামীর আমানতও খোয়াইনি -এটাই আমার আত্মতৃপ্তি। আমার বাসনা ভূ-লুন্ঠিত হয়েছে-ইউসূফ পবিত্র রয়েছে।’
অন্যান্য মহিলারা সবাই একযোগে স্বীকার করল-‘ইউসূফ পবিত্র। তার রূপ লাবণ্যের মোহে আমরাই বিভ্রান্ত হয়েছিলাম এবং নোংরা কাজে প্রবৃত্ত হবার জন্যে প্ররোচিত করেছিলাম। কিন্তু পাপ-পঙ্কিল পথে পা দেয়নি ইউসূফ।’
বিষ্মিত হল দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। চক্রান্তকারীরা নিজেরাই আজ ইউসূফকে নির্দোষ বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে। সত্ত্বর ইউসূফকে দরবারে হাজির করার জন্যে কারাগারে লোক পাঠালেন ফেরাউন।
ইউসূফ দরবারে উপস্থিত হলেন। |
ইউসূফ দরবারে উপস্থিত হলেন। তার সৌন্দর্য্য অবলোকন করে দরবারের সকলে বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ হলেন। সকলেই যখন হতভম্ব তখন নিরবতা ভাঙ্গলেন ফেরাউন-‘তোমার বিচক্ষণতা অতুলনীয়, আমার দৃষ্টিতে তুমি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ও মর্যাদাশালী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য এবং বিজ্ঞান সম্মত। দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি কি হওয়া উচিৎ, বিস্তারিত জানতে চাই।’
ইউসূফ বললেন, ‘আপনার ধন-ভান্ডারের দায়িত্ব আমাকে দিন। রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আমি অভিজ্ঞ, আর আল্লাহর ইচ্ছেয় আমি দায়িত্ব সম্পাদন করতে সক্ষম হব।’
তার সুপারিশ ফেরাউন রাইয়ান মনে মনে কবুল করলেন। তিনি ভাবলেন একজন জ্ঞানী, পুত চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি ধন-ভান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করলে সঙ্কট মোকাবেলায় কোন সমস্যা থাকবে না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি কোন সিদ্ধান্ত দিলেন না।
ইউসূফ এক বৎসর পর্যন্ত একজন সম্মনিত অতিথি হিসেবে রাজকীয় অতিথিশালায় রইলেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্তির পর ইউসূফ। |
এই বিলম্বের কারণ সম্ভবতঃ ফেরাউন তাকে সান্নিধ্যে রেখে তার চরিত্র ও অভ্যাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত হয়েছিলেন। যাহোক দায়িত্ব অর্পণের সাথে সাথে ফেরাউন তাকে রাজকীয় পোষাক ও আংটি দিলেন এবং একটি মিসরীয় নাম ‘সাফনৎ পানেহ্’ (গুপ্তবিষয় প্রকাশক) আখ্যায়িত করলেন।
এই যুবক ইউসূফ, যাকে একজন দাস হিসেবে মিসরে বিক্রি করা হয়েছিল মাত্র বিশ বৎসর বয়সে তিনি ঐ সমৃদ্ধশালী ও বিখ্যাত মিসর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলেন। অতঃপর তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে শুরু করলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলি ভান্ডার নগরী স্থাপন করলেন এ কারণে যে, ভাল ভাল বৎসরগুলিতে যখন দেশে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হবে তখন যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত শস্য ভবিষ্যতের দুর্যোগপূর্ণ বৎসরগুলির জন্যে সেখানে গুদামজাত করে সংরক্ষণ করা যায়।
ইত্যাবসরে পটিফর মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এখন আর ইউসূফের সঙ্গে জুলেখার বিবাহে কোন বাঁধা ছিল না। ফেরাউন তাই মধ্যস্থতা করে ইউসূফের সম্মতিতে জুলেখার কাছে তার বিবাহের প্রস্তাব রাখলেন। ইতিমধ্যে অনেক বৎসর অতিবাহিত হয়েছে, সুতরাং ইউসূফের প্রতি জুলেখা প্রথম যৌবনে যে আকর্ষণ বোধ করত তা আর তেমন অবশিষ্ট ছিল না। তথাপি এই প্রস্তাবে সে আনন্দের সাথেই সম্মত হয়েছিল। ফলে বিবাহ হয়ে গেল। বাসর রাতে ইউসূফ তাকে হাসতে হাসতে বললেন, ‘এটা কি তোমার সেই অবৈধ বাসনা থেকে উত্তম নয়?’
শীঘ্রই আল্লাহ সন্তানহীনা জুলেখার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন। সে প্রথমবারের মত সন্তান সম্ভবা হল। এটি একটি পুত্র সন্তান যার নাম রাখা হয়েছিল ইফ্রয়িম। পরবর্তীতে জুলেখা অবশ্য মনশিঃ নামে আরও একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেছিল।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘বাদশা বলল, ‘তোমরা ইউসূফকে আমার কাছে নিয়ে এস।’
যখন দূত তার কাছে এল তখন সে বলল, ‘তুমি তোমাদের প্রভুর কাছে ফিরে যাও ও তাকে জিজ্ঞেস কর যে মহিলারা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কি? আমার প্রতিপালক তো তাদের ছলনা ভালকরেই জানেন।’
বাদশা মহিলাদের বলল, ‘যখন তোমরা ইউসূফকে খারাপ করার জন্যে ফুঁসলাবার চেষ্টা করেছিলে তখন তোমাদের কি হয়েছিল?’
তারা বলল, ‘আল্লাহ মহান! আমরা ওর মধ্যে কোন দোষ দেখিনি।’
আজিজের স্ত্রী বলল, ‘এখন সত্যি বের হল। তাকে খারাপ করার জন্যে ফুঁসলেছিলাম। সে তো সত্যকথাই বলেছে।’
সে (ইউসূফ) বলল, ‘আমি এ বললাম যেন তিনি (আজিজ) জানতে পারেন যে তার অনুপস্থিতিতে আমি তার প্রতি কোন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি; আর আল্লাহ তো বিশ্বাস ঘাতকদের ষড়যন্ত্র সফল করেন না। আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করিনে, মানুষের মন তো মন্দকর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয়, যার ওপর আমার প্রতিপালক দয়া করেন। আমার প্রতিপালক তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
বাদশা বলল, ‘ইউসূফকে আমার কাছে নিয়ে এস, আমি ওকে আমার বিশ্বস্ত সহচর নিযুক্ত করব।’ তারপর বাদশা যখন তার সাথে কথা বলল তখন সে (বাদশা) বলল, ‘আজ তুমি আমাদের কাছে সম্মান ও বিশ্বাসের পাত্র।’
ইউসূফ বলল, ‘আমাকে দেশের কোষাধাক্ষ্য নিযুক্ত করুন, আমি বিশ্বস্ত রক্ষক, আর অভিজ্ঞও।’
(আল্লাহ বলেন) এভাবে আমি ইউসূফকে সেদেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। সেই দেশে সে যথেচ্ছ বসবাস করত। আমি যাকে ইচ্ছে আমার অনুগ্রহ দান করে থাকি এবং সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করিনে। যারা বিশ্বাসী ও সাবধানী তাদের জন্যে পরলোকের পুরস্কারই উত্তম।’(১২:৫০-৫৬)
নির্দিষ্ট সময়ে দূর্ভিক্ষ এল এবং সমস্ত দেশ আক্রান্ত হল। প্রথম পর্যায়ে মানুষ নিজেদের সংগ্রহ থেকে খেতে শুরু করল। দেখতে দেখতে নিঃশেষিত হল ভান্ডার। এমন সময় এল যখন অর্থের বিনিময়ে খাদ্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। রাজদরবারে হাজির হল অনাহারী প্রজাবৃন্দ। ফেরাউন তাদেরকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘খাদ্যের অভাবে মরবে না তোমরা। প্রচুর খাদ্য মজুদ আছে। তোমরা ইউসূফের কাছে যাও, সেই তোমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য-শস্যের ব্যবস্থা করবে।’
প্রজাবৃন্দ খাদ্যের জন্যে ইউসূফের কাছে ধর্ণা দিল। আর তিনি তাদেরকে নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে খাদ্য বিতরণ করতে শুরু করলেন একটি বিশেষ পদ্ধতিতে। প্রত্যেক পরিবারের সক্ষম প্রতিটি ব্যক্তিকে খাদ্য-শস্যের জন্যে উপস্থিত থাকতে হবে এবং প্রত্যেকে কেবলমাত্র এক উট খাদ্য-শস্য কিনতে পারবে যার পরিমাণ এক ওসক বা দু‘শ দশ সের।
খাদ্য বিতরণ চলে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা। অচিরেই মিসরবাসীর মধ্যে কিছুট স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। কিন্তু দুর্ভিক্ষ শুধু মিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না- আশে পাশের রাজ্যগুলিতেও তা ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রমশঃ। ফলে ঐ সব দেশগুলি থেকে দলে দলে ক্ষুধার্ত লোকেরা মিসরে ইউসূফের কাছে আসতে লাগল।
কনানও দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছিল। গাছপালা, ঘাস শুকিয়ে গিয়েছিল, ফলে পশুপালও মরে গিয়েছিল এবং মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। অন্য সকলের মত ইয়াকুব ও তার পরিবারও খাদ্য সংকটে পড়ল। ইয়াকুব তার পুত্রদেরকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছ কেন? আমি শুনেছি মিসরে শস্য আছে। তোমরা সেখানে গিয়ে আমাদের জন্যে খাদ্য-শস্য কিনে আন যাতে আমরা বেঁচে থাকতে পারি।’
সুতরাং বড় দশ ভাই খাদ্য-শস্য কেনার জন্যে মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, কিন্তু বিন্যামিন পিতার কাছেই রইল। ইউসূফকে হারানোর পর রাহেলের শেষ স্মৃতি হিসেবে তাকে ইয়াকুব সবসময় আগলে রাখতেন।
ইউসূফের দশ ভাই মিসরে এসে পৌঁছিল। তারা যখন রাজপথ অতিক্রম করছিল, তখন তাদের অদ্ভূত পোষাক ও চালচলনের কারণে রাজকীয় রক্ষীরা তাদেরকে গুপ্তচর সন্দেহ করল। তারা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করল কিন্তু সন্দেহমুক্ত হতে পারল না। সুতরাং তারা তাদেরকে আটক করল।
রক্ষীরা দশ ভাইকে আটক করে ইউসূফের কাছে নিয়ে এল এবং বলল, ‘এরা নিশ্চয় গুপ্তচর।’
ভাইয়েরা ইউসূফকে দেখল ভয় ও ভক্তি সহকারে কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারল না। সম্ভবতঃ তিনি বেঁচে থাকতে পারেন এমন ধারণা তাদের ছিল না। কিন্তু ইউসূফ ঠিকই তাদেরকে চিনতে পারলেন এবং বিন্যামিনকে দেখতে না পেয়ে এবং বৃদ্ধ পিতা-মাতা কেমন আছে ভেবে তাদের জন্যে মনে কষ্ট অনুভব করলেন, তবে তিনি কিছুই প্রকাশ করলেন না। অন্ধকূপের সেই ভয়ংকর সময়ের সুললিত ঐশীবাণী তার মনে পড়ল। মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি।
ইউসূফ তার ভাইদেরকে কঠিনভাবে পরীক্ষা করলেন যেমনভাবে সন্দেহযুক্ত লোকদেরকে করা হয়। তবে তিনি অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বণ করলেন। ভাইয়েরা বুঝতে পারবে না জেনেও তিনি তাদেরকে মিসরের চলিত ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদেরকে তো মিসরের অধিবাসী বলে মনে হচ্ছে না।’
ভাইয়েরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তাদের একজন কনিষ্ঠ, বয়োজৈষ্ঠ্য অপর একজনকে নীচুকন্ঠে বলল, ‘উনি কি বললেন?’
ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে হিব্রু ভাষায় কথাবার্তা বলছে দেখে এবার তিনিও হিব্রুতে বললেন, ‘তোমরা তো মিসরের অধিবাসী নও, আর তোমাদের ভাষাও হিব্রু। এমতাবস্থায় কেমন করে এখানে এলে?’
তারা বলল, ‘আমাদের দেশ কনান। সেখানে ভীষণ দুর্ভিক্ষ। তাই আমরা খাদ্য-শস্যের জন্যে এখানে এসেছি। কেননা আমরা জানতে পেরেছি এই দেশে খাদ্য-শস্য মজুত রয়েছে।’
ইউসূফ বললেন, ‘তোমরা যে সত্য বলছ আর তোমরা কোন গুপ্তচর নও একথা কেমন করে বিশ্বাস করব?’
তারা তাদের বিস্তারিত পরিচয় দিতে চেষ্টা করল। নিজেদেরকে নির্দোষ দাবী করে বলল, ‘আমরা নবী সন্তান। আমাদের দ্বারা এরূপ কখনও হতে পারে না। বাড়ীতে আমাদের অন্ধ অসুস্থ্য বৃদ্ধ পিতা আর সবার ছোট ভাই রয়েছে। শুণ্য হাতে ফিরে গেলে আমাদের পরিবারের সকলকে অনাহারে মরতে হবে।’
এক দিকে দুর্ভিক্ষ চলছিল তারমধ্যে ইয়াকুব অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অনেক আগেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এই কারণে যে, একবার তিনি যখন শেষরাত্রে উপাসনায় লিপ্ত ছিলেন তখন তার পাশে ঘুমিয়ে ছিলেন ইউসূফ। সে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকতে লাগল। এই শব্দে উপাসনায় ইয়াকুবের মনোযোগ নষ্ট হল। তিনি তার দিকে ফিরে চাইলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার এমন হল। তখন আল্লাহ ফেরেস্তাদেরকে বললেন, ‘দেখ, আমার এই বান্দা আমাকে স্মরণ করার মাঝখানে অন্যের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তাই আমি অচিরেই তার দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেব, যা দিয়ে সে অন্যের দিকে তাকায়। আর যার দিকে সে মনোযোগ দিচ্ছে তাকে আমি দীর্ঘকালের জন্যে বিচ্ছিন্ন করে দেব।’
যাহোক ইয়াকুব অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন এক ধরণের বাতের ব্যাথায়। আর তিনি যখন কোনভাবেই সুস্থ্য হচ্ছিলেন না। তখন মানত করেছিলেন এই বলে, ‘যদি আল্লাহ আমাকে সুস্থ্য করে দেন তাহলে আমি আমার প্রিয় খাদ্য, উটের মাংস আমার জন্যে হারাম করে দেব।’ ইয়াকুব সুস্থ্য হবার পর মানত অনুসারে উটের মাংস হারাম করেছিলেন, ফলে তখন থেকে সকল ইস্রায়েলীর উপর তা হারাম হয়েছিল।
সবশুনে একটি মাত্র শর্তে ইউসূফ তাদের কাছে শস্য বিক্রি করতে সম্মত হলেন যে, পরবর্তীতে খাদ্য ক্রয়ের সময় তাদের ছোট ভাই বিন্যামিনকে সঙ্গে আনতে হবে, অন্যথায় তাদের কাছে কোন শস্য বিক্রয় করা হবে না। অন্য কোন উপায় না থাকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা এই শর্তে রাজী হল।
ইউসূফ তাদেরকে খাদ্য-শস্য দিলেন। আর পরিবার পরিজনদের অভাবের কথা চিন্তা করে খাদ্য-শস্যের মূল্য তিনি রাখবেন না সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাইদের অগোচরে বিশ্বস্ত ভৃত্যের মাধ্যমে বস্তার মধ্যে মূল্য বাবদ ওদের প্রদেয় টাকা রেখে দিতে চাইলেন, যাতে পরবর্তীতে তারা শস্য ক্রয়ে অর্থ সংকটে না পড়ে। সুতরাং তিনি তার চাকরদেরকে বললেন, ‘ওরা যে শস্যের মূল্য দিয়েছে তা ওদের মালপত্রের মধ্যে রেখে দাও যেন আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফেরার পর ওরা বুঝতে পারে যে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে ওরা আবারও আসতে পারে।’
শস্য ক্রয় শেষে কাফেলা কনানের পথে পাড়ি জমাল। শস্য বোঝাই উটগুলো এগিয়ে যাচ্ছে- ইউসূফ তাকিয়ে আছেন- আল্লাহর হাজার শোকর- এ শস্য যাচ্ছে তারই পরিজনদের জন্যে- দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
মিসর থেকে কনান- উটের পিঠে আট দিন লাগে। একসময় কাফেলাটি কনানে পৌঁছিল। বাড়ীতে পৌঁছে পিতার সাথে কুশল বিনিময়ের পর তারা খাদ্যের বস্তাগুলো উটের পিঠ থেকে নামাতে শুরু করল। পুনঃরায় শস্য ক্রয়ের শর্তের কথাও পিতাকে জানাল। সবশুনে পিতা বললেন, ‘তোমাদের যে আর একজন ভাই আছে সেকথা কেন বলতে গেলে?’
তারা বলল, ‘কিন্তু লোকটি আমাদের ও আমাদের পরিবার সম্বন্ধে বিশেষভাবে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমাদের পিতা কি এখনও বেঁচে আছেন? তোমাদের আর কোন ভাই আছে?’ কাজেই আমরা সেভাবেই তার কথার উত্তর দিয়েছিলাম। তখন আমরা কি করে জানব যে, তিনি বলবেন, ‘তোমাদের ভাইকে নিয়ে এস।’
পিতা ইয়াকুব তার এই দশ সন্তানের প্রতি কখনও পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। যদিও পরিবারের সবার জন্যে অন্ন-বস্ত্রের যোগান দেবার কাজ তারাই করে তথাপি তিনি জানতেন তারা হিংস্যুটে, হীনমন্য। তিনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন, ‘বিন্যামিন কোনমতেই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।’
তারা বলল, ‘জীবন বাঁচানোর জন্যে আমাদের তো রসদের প্রয়োজন। আর আমরা যা এনেছি তা পরিমানে অল্প। বিন্যামিন আমাদের সঙ্গে যাবে- কোন দৈব-দূর্বিপাকে না পড়লে অবশ্যই আমরা তাকে সুস্থ্য শরীরে ফিরিয়ে আনব।’
ইয়াকুব বললেন, ‘ইউসূফের বেলায়ও তো তোমরা এমনি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলে। কিন্তু তোমরা সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারনি।’
তারা তাদের বস্তা খুলল। বস্তার মধ্যে টাকা দেখে আশ্চর্য হল। তারা চিৎকার করে পিতাকে বলল, ‘হে পিতা! এই দেখ, মহানুভব মিসরাধিপতি আমাদের অর্থকড়িও ফিরিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় দফা শস্য ক্রয় করতে আমাদের আর কোন অসুবিধা হবে না।’
এতদসম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ইউসূফের ভাইয়েরা এল। তারা তার সামনে উপস্থিত হলে সে ওদেরকে চিনতে পারল, কিন্তু ওরা তাকে চিনতে পারল না। আর সে যখন ওদের রসদের ব্যবস্থা করে দিল তখন সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে তোমাদের সৎভাইকে নিয়ে এস। তোমরা কি দেখছ না যে আমি পুরো মাপ দেই? আর আমি অতিথির সেবা ভালই করি? কিন্তু তোমরা যদি তাকে আমার কাছে না নিয়ে এস, তবে আমার কাছে তোমাদের জন্যে কোন রসদ থাকবে না; আর তোমরাও আমার কাছে আসবে না।’
ওরা বলল, ‘ওর বিষয়ে আমরা পিতাকে রাজী করানোর চেষ্টা করব, আর আমরা এ নিশ্চয়ই করব।’
ইউসূফ তার চাকরদেরকে বলল, ‘ওরা যে শস্যের মূল্য দিয়েছে তা ওদের মালপত্রের মধ্যে রেখে দাও যেন আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফেরার পর ওরা বুঝতে পারে যে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে ওরা আবারও আসতে পারে।’
তারপর ওরা যখন ওদের পিতার কাছে ফিরে এল তখন বলল, ‘হে আমাদের পিতা, আমাদের জন্যে রসদ বন্ধ করা হয়েছে, সুতরাং আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে পাঠাও যেন আমরা রসদ পেতে পারি। নিশ্চয়ই আমরা তার দেখাশুনো করব।’
সে বলল, ‘আমি ওর ব্যাপারে তোমাদেরকে তেমনই বিশ্বাস করব যেমন ওর ভাইয়ের ব্যাপারে এর পূর্বে আমি তোমাদেরকে বিশ্বাস করেছিলাম। রক্ষণাবেক্ষণে আল্লাহই শ্রেষ্ঠ ও দয়ালুদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ দয়াল।’
যখন ওরা ওদের মালপত্র খুলল তখন ওরা দেখতে পেল ওদের পণ্যমূল্য ওদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওরা বলল, ‘হে আমাদের পিতা! আমরা আর কি আশা করতে পারি? এ আমাদের দেয়া শস্যের মূল্য, আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের লোকদেরকে খাবার দাবার এনে দেব ও আমরা আমাদের ভাইয়ের দেখাশোনা করব। আর আমরা আরও এক উট বোঝাই মাল আনব। যা এনেছি তা পরিমানে অল্প।’
পিতা বলল, ‘আমি ওকে কখনই তোমাদের সাথে পাঠাব না।’(১২:৫৮-৬৬)
যতই দিন যেতে লাগল ইয়াকুবের পরিবারের অভাব ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল। কেননা আনা রসদ ইতিমধ্যে নিঃশেষিত হয়েছিল। সুতরাং ভাইয়েরা খাদ্যের খোঁজে নামতে বাধ্য হল। শুধুমাত্র মিসরেই সেই সুযোগ ছিল। তাই ইয়াকুব যখন পরিবারের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পুত্রদেরকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা আবার মিসরে গিয়ে আমাদের জন্যে খাদ্য-শস্য ক্রয় করে আন।’ তখন রুবেন বলল, ‘কিন্তু সেই সরকারী কর্মকর্তা আমাদেরকে কড়াভাবে বলে দিয়েছেন, তোমাদের ভাই সঙ্গে না থাকলে তোমরা আর আমার সম্মুখে আসবে না। আমাদের পরিবারের সকলের তালিকা নেয়া হয়েছে- সক্ষম প্রতিটি পুরুষকে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে উপস্থিত থাকতে হবে। তাই ওকে আমাদের সঙ্গে যেতে দাও। আমরা তাড়াতাড়ি করে রওনা হয়ে যাই যাতে আমরা এবং আমাদের পরিবারের সকলে খাদ্যাভাবে মারা না যাই। আমিই ওর জামিন। যদি আমরা এতদিন দেরী না করতাম তবে নিশ্চয় আমরা আরও একবার গিয়ে ফিরে আসতে পারতাম।’
এভাবে রুবেন ছোট ভাই বিন্যামিনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবার প্রতিজ্ঞা করল এবং তাদের সঙ্গে তাকে যেতে অনুমতি দেয়ার জন্যে পিতাকে বাধ্য করল। ইয়াকুব সম্মতিদানে বাধ্য হলেন এই ভেবে-‘ওরা আর কি হেফাজত করবে? হেফাজতের মালিক তো আল্লাহ। তাঁর প্রতিই নির্ভরশীল থাকা উত্তম।’ সুতরাং পুত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘তোমরা লোকটির জন্যে উপহার হিসেবে কিছু ভাল ভাল জিনিষ সঙ্গে করে নিয়ে যাও। তোমরা দ্বিগুন টাকা সঙ্গে নিয়ো, বস্তার মুখে যে টাকা ফেরৎ পেয়েছ তা হয়তঃ তারা ভুল করে দিয়ে দিয়েছে। আর তোমরা তাড়াতাড়ি করে যাও। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন।’
একদল নব্য যুবক মিসরের রাজপথে যেন জনসাধারণের সন্দেহের উদ্রেক না ঘটায়। গতবার গুপ্তচরের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় কথা স্মরণ করে ইয়াকুব তাই পুত্রদের আরও বললেন, ‘সন্তানেরা, তোমরা মিসরে প্রবেশের সময় একসঙ্গে একই দরজা দিয়ে প্রবেশ কোরও না, আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন পথে শহরে ঢুকবে।’
ভাইয়েরা মিসরে এসে পৌঁছিল। অতঃপর তাদের পিতা যেভাবে তাদেরকে আদেশ করেছিলেন সেভাবেই বিভিন্ন দরজা দিয়ে তারা শহরে প্রবেশ করল। কিন্তু আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে তাদের এই সতর্কতা কোনই কাজে এল না।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘পিতা (ইয়াকুর) বলল, ‘আমি ওকে কখনই তোমাদের সাথে পাঠাব না, যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে শপথ কর যে, তোমরা ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, তোমরা একান্ত অসহায় হয়ে পড়লে অন্যকথা।’
তারপর যখন ওরা তার কাছে প্রতিজ্ঞা করল তখন সে বলল, ‘আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি আল্লাহ তার বিচার করবেন।’
সে (আরও) বলল, ‘হে আমার পুত্ররা! তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ কোরও না, ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জন্যে কিছু করতে পারিনে। বিধান আল্লাহরই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি। আর যারা অপরের উপর নির্ভর করে তাদের উচিত আল্লাহর উপর নির্ভর করা।’
আর যখন তারা তাদের পিতা যেভাবে তাদেরকে আদেশ করেছিল সেভাবেই প্রবেশ করল তখন আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে তা তাদের কোন কাজে এল না। কেবল ইয়াকুবের অন্তরে যে অভিপ্রায় ছিল তা সে পূর্ণ করল, আর সে তো ছিল জ্ঞানী, কারণ আমি তাকে শিক্ষা দিয়ে ছিলাম। কিন্তু অনেক মানুষই এ জানে না।(১২:৬৬-৬৮)
দশভাই তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শণ করল। |
দুপুরে এসে ইউসূফ দূর থেকে বিন্যামিনকে দেখতে পেলেন। তাকে দেখে তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়লেন। তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন। এসময় দশভাই তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শণ শেষে উপহার সামগ্রী দিল। ইউসূফ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের যে বৃদ্ধ পিতার কথা বলেছিলে তিনি কি ভাল আছেন?’
তারা বলল, ‘তিনি শয্যাশায়ী, আগের মতই আছেন।’
তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়লেন। |
তারা একত্রে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানাল।
ভাইদেরকে রাজকীয় অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা করা হল। প্রতি দু‘জন এক এক কক্ষ বরাদ্ধ পেল। ফলে বিন্যামিন একা হয়ে পড়ল। তার জন্যে কোন কক্ষ বরাদ্ধ দেয়া হল না। ইউসূফ বললেন, ‘সে আমার সঙ্গে থাকবে।’
ভাইদেরকে খাদ্যশস্য দিচ্ছেন ইউসূফ। |
সবকিছু ইউসূফের পরিকল্পণা মতই হল। আর শস্য ক্রয় শেষে ভাইয়েরা তাদের নিজ নিজ বস্তা উটের পিঠে চাপিয়ে নিজেদের দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
কাফেলাটি শস্য নিয়ে মিসরের রাজপথ অতিক্রম করছিল। নিশ্চিন্ত মনে পথ চলছিল তারা। হঠাৎ কয়েকজন রাজকর্মচারী দৌঁড়ে এসে পথরোধ করল তাদের। তারা বিষ্মিত হল-জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে রইল। রাজকর্মচারীরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিব্রুতে বলল, ‘আমাদের প্রভুর মূল্যবান পানপাত্রটি পাওয়া যাচ্ছে না। রাজমহলে তোমরা ছাড়া বাইরের কোন লোক ছিল না। বুঝতেই পারছ ঘটনাটি কি? এখন তল্লাসী ছাড়া তোমরা সন্দেহ মুক্ত থাকতে পারছ না।’
ভাইয়েরা বলল, ‘তোমরা কি আমাদেরকে চোর সাব্যস্ত করতে চাও?’
‘আমরা অনুমান করছি তোমাদের মধ্যেই কেউ তা চুরি করে এনেছে।’ -বলল রাজকর্মচারীরা।
তারা দৃঢ়চিত্তে এই অভিযোগ অস্বীকার করল এবং বলল, ‘আল্লাহ মহাজ্ঞানী, তিনিই জানেন সবকিছু। এখানে আমরা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে আসিনি। আর আমরা চোরও নই।’
কর্মচারীদের একজন টোপ ফেলল, বলল, ‘তোমরা জানলে সন্ধান দাও। প্রতিজ্ঞা করে বলছি যে লোক সঠিক সন্ধান দিতে পারবে তাকে এক উট বোঝাই শস্য উপহার দেয়া হবে।’
ভাইয়েরা পরষ্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। পরিশেষে তারা বলল, ‘ব্যাপারটা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।’
তারা বলল, ‘ঠিক আছে, তোমরা ফিরে চল। আমাদের প্রভুর সম্মুখে তোমাদের বস্তাগুলো খুলে পরীক্ষা করা হবে। নির্দোষ হলে ভয়ের কোন কারণ নেই।’
কর্মচারীরা তাদেরকে ফিরিয়ে এনে ইউসূফের সামনে উপস্থিত করল। সবশুনে ইউসূফ বললেন, ‘হারিয়ে যাওয়া পাত্রটি যদি তোমাদের কাছে পাওয়া যায়-তার শাস্তি কি হবে?’
তারা বলল, ‘চোরের শাস্তি দাসত্ব। সুতরাং চোরকে চুরি যাওয়া জিনিসের মালিকের হাতে তুলে দেয়া হবে। আর এটাই আমাদের নিয়ম।’
ইউসূফ বললেন, ‘ঠিক আছে-এবার তোমাদের বস্তাগুলো পরীক্ষা করতে দাও।’
রাজকর্মচারীরা একে একে সকলের বস্তা খুলে পরীক্ষা করল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। সবশেষে বিন্যামিনের বস্তা খুলতেই পাত্রটি বেরিয়ে এল।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ‘ওরা যখন ইউসূফের সামনে উপস্থিত হল তখন ইউসূফ তার আপন ভাইকে নিজের কাছে রাখল ও বলল, ‘আমিই তোমার আপন ভাই, সুতরাং ওরা যা করত তার জন্যে দুঃখ কোরও না।’
তারপর সে যখন ওদের রসদের ব্যবস্থা করে দিল তখন সে তার নিজের ভাইয়ের মালপত্রের মধ্যে বাদশার পানপাত্র রেখে দিল। তখন এক নকিব চিৎকার করে বলল, ‘যাত্রীরা! তোমরা নিশ্চয়ই চোর।’
ওরা তাদের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা কি হারিয়েছ?’
তারা বলল, ‘আমরা বাদশার পানপাত্র হারিয়েছি। যে তা এনে দেবে সে এক উট মাল পাবে, আর আমি তার জামিন।’
ওরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! তোমরা তো জান আমরা এ দেশে খারাপ কাজ করতে আসিনি, আর আমরা চোরও নই।’
তারা বলল, ‘যদি তোমরা মিথ্যে বল তবে যে চুরি করেছে তার কি শাস্তি হবে?’
ওরা বলল, ‘যার মালপত্রের মধ্যে পাত্রটি পাওয়া যাবে তার শাস্তি হবে দাসত্ব। এভাবে আমরা সীমালংঘনকারীদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।’
তারপর ইউসূফ তার আপন ভাইয়ের মালপত্র তল্লাশির পূর্বে ওদের মালপত্র তল্লাশি করতে লাগল, পরে তার সহোদরের মালপত্রের মধ্যে থেকে পাত্রটি বের করা হল। এভাবে আমি ইউসূফকে শিখিয়েছিলাম। আল্লাহ ইচ্ছে না করলে বাদশার আইনে তার আপন ভাইকে সে দাস করতে পারত না। আমি যাকে ইচ্ছে মর্যাদায় বড় করি। প্রত্যেক জ্ঞানী লোকের ওপর আছে আরও বড় জ্ঞানী লোক।(১২:৬৯-৭৬)
বিন্যামিনের বস্তা থেকে পাত্রটি বের হতে দেখে ভাইয়েরা ভীত হয়ে পড়ল। ইউসূফ চুরির ব্যাপারে তাদের অভিমত জানতে চাইলেন। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানত না সুতরাং তাকে তারা সেকথাই বলল। আর তাদের একজন রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ‘বিন্যামিন চুরি করেছে কি-না আমরা তা প্রত্যক্ষ করিনি। প্রকৃতই যদি সে চুরি করে থাকে তবে এটা তার পক্ষেই সম্ভব। কেননা তার বড় ভাইও পূর্বে চুরি করেছিল এবং সাজাভোগ করেছিল।’
ইউসূফ বুঝতে পারলেন ভাইয়েরা তার সম্পর্কে মিথ্যে বলছে। প্রকৃত ঘটনা আল্লাহই জানেন। ইউসূফের এক ফুফু ছিল। তার কোন সন্তানাদি ছিল না। রাহেলের মৃত্যুর পর তাকে ও বিন্যামিনকে দুধপান করান ও লালন-পালন ইয়াকুবের জন্যে সমস্যার ব্যাপার ছিল। ভাই ইয়াকুবের এই সমস্যায় ভগ্নি আগ্রহ করে কিছুদিনের জন্যে তার লালন-পালনের ভার চাইল। ইয়াকুব তার ঐ প্রস্তাব সহজেই মেনে নিয়েছিলেন।
ফুফুর আদর-যত্নে বেড়ে উঠতে লাগল ইউসূফ। একসময় দুধ ছাড়ল। কিন্তু ফুফু তাকে ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করতে লাগল। তখন সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে ভগ্নির গৃহে এলেন ইয়াকুব। ফুফুর ইচ্ছে ছিল না তাকে ফিরিয়ে দেবার। কারণ সে তাকে নিজ সন্তান জ্ঞানে প্রতিপালন করছিল। কিন্তু এখন কিভাবে তাকে ধরে রাখবে? দীর্ঘদিন পরে তার পিতা তাকে নিতে এসেছেন।
অবশেষে মাতৃস্নেহের কাছে নীতিবোধ পরাজিত হল। ইউসূফকে নিজের কাছে রাখার জন্যে প্রতারণার আশ্রয় নিল ফুফু। সে সাঁজগোজ করে তাকে পিতার হাতে তুলে দিল। সাঁজগোজ করানোর সময় তার কোমরে, কাপড়ের নিচে নিজের মূল্যবান কোমর বন্ধনী বেঁধে দিয়েছিল। এই কোমরবন্ধনী সে বিবাহের সময় পিতা ইসহাকের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল। যাত্রার প্রাক্কালে অতঃপর ফুফু প্রচার করল যে, তার কোমর বন্ধনী চুরি হয়ে গেছে।
শুরু হল খোঁজাখুজি।
চোর, চুরি যাওয়া জিনিসের মালিকের সম্পত্তি হয়ে যেত অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চোরকে তাবেদারী করতে হত মালিকের- প্রচলিত নিয়মে চোরের শাস্তি ছিল এই। অবশেষে সেই কোমর বন্ধনী ইউসূফের কোমরে, পরিধেয় পোষাকের নীচে লুকান অবস্থায় পাওয়া গেল। সন্তানহীনা ভগ্নির কারসাঁজি ঠিকই পিতা ইয়াকুব বুঝে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি আইনের বরখেলাফ করেননি। পুত্রকে ভগ্নির কাছে রেখেই চলে এসেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী ইউসূফ ফুফুর জীবিতকাল অবধি তার কাছেই ছিল।
--এই হল প্রকৃত ঘটনা। ভাইদেরও তা অজানা নয়। কিন্তু তারা প্রকৃত সত্যকে বিকৃত করে প্রচার করছে।
ইউসূফ ভাইদের কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, ‘তোমরা কেন এমন করলে? আমার মত ব্যক্তি যে সত্যিই সবকিছু গুনে বের করতে পারে তা-কি তোমরা জানতে না?’
তারা বলল, ‘আমরা আর কি বলব? কি উত্তরইবা দেব? আর কেমন করেইবা নিজেদের নির্দোষ প্রমান করব? আপনার দাসদের অপরাধ তো আল্লাহই দেখিয়ে দিয়েছেন। যার কাছে পাত্রটা পাওয়া গেছে সে আর আমরা সবাই আপনার দাস হলাম।’
কিন্তু ইউসূফ বললেন, ‘সকলকে দাস করলে আমরা তো জুলুমকারী হিসেবে বিবেচিত হব। যার কাছে পেয়ালাটি পাওয়া গেছে কেবল সেই আমার দাস হবে। বাকীরা নিশ্চিন্তে তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও।’
বিন্যামিনকে রেখে বাড়ীতে পিতার কাছে ফিরে যাওয়ার লজ্জা এবং ছোট ভাইয়ের ক্ষতির আশঙ্কায় রুবেন নিজেকে দোষী করে বিন্যামিনের পরিবর্তে তাকে আটক রাখার জন্যে ইউসূফের কাছে অন্তরস্পর্শী কাকুতি-মিনতি করতে থাকল। সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, ‘হে আজিজ! এর পিতা খুবই বৃদ্ধ। তার কাছে আমি ওর জামিন। তাই ওকে না নিয়ে কি করে আমি ওর পিতার কাছে ফিরে যাব? দয়া করে তার বদলে আমাকে আপনার দাস করে রাখুন। আর তাকে তার পিতার কাছে ফিরে যেতে দিন। তাকে না দেখলে তিনি তো শোকেই মারা যাবেন। এমনিতেই তার বড় ভাইয়ের জন্যে তার পিতা শোকে অন্ধ হয়ে গেছেন।’
নিজের বস্তা থেকে পাত্রটি বেরিয়ে পড়ার পর বিন্যামিন কিছুই বুঝতে না পেরে হতভম্ভের মত ইউসূফের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাই রুবেন এর কাকুতি-মিনতি দেখে সে ছলছল চোখে করুণভাবে ইউসূফকে তাকিয়ে দেখছিল। ইউসূফ তা দেখে তার কানে কানে নীচুস্বরে বললেন, ‘আমিই তো তোমার আপন ভাই সুতরাং ওদের জন্যে দুঃখ কোরও না।’
তারপর তিনি রুবেন এর উদ্দেশ্যে দৃঢ় কন্ঠে বললেন, ‘শাস্তি স্বরূপ বিন্যামিনকে অবশ্যই বন্দী হিসেবে মিসরে থেকে যেতে হবে। অপরাধীর পরিবর্তে অন্যকে রাখার অপরাধ থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি। এমন করলে আমরা তো জুলুম করব!’
এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- ওরা বলল, ‘সে যদি চুরি করে থাকে, তার আপন ভাইও তো পূর্বে চুরি করেছিল।’
কিন্তু ইউসূফ প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনে গোপন রাখল ও ওদের কাছে প্রকাশ করল না। সে মনে মনে বলল, ‘তোমাদের অবস্থাতো এর চেয়েও খারাপ আর তোমরা যা বলছ সে সম্বন্ধে আল্লাহ ভাল করেই জানেন।’
ওরা বলল, ‘হে আজিজ! এর পিতা বড়ই বৃদ্ধ। সুতরাং এর জায়গায় আপনি আমাদের একজনকে রাখুন; আমরা তো আপনাকে একজন মহানুভব লোক হিসেবে দেখে আসছি।’
সে বলল, ‘যার কাছে আমরা আমাদের মাল পেয়েছি তাকে ছাড়া অন্যকে রাখার অপরাধ থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি। এমন করলে আমরা তো জুলুম করব!’(১২:৭৭-৭৯)
ভাইয়েরা ইউসূফের কাছ থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হল ও ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেল। তারপর নির্জনে গিয়ে তারা পরামর্শে বসল। ওদের মধ্যে বয়োজৈষ্ঠ্য রুবেন বলল, ‘তোমরা কি ভুলে গেছ যে, পিতা আমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন, আর পূর্বেও আমরা ইউসূফের ব্যাপারে অন্যায় করেছিলাম? সুতরাং আমি কিছুতেই এদেশ ত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আমার পিতা আমাকে অনুমতি দেন বা আল্লাহ আমার জন্যে কোন ব্যবস্থা করেন। আর তিনিই বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’
অনিশ্চয়তার মধ্যে তারা কয়েকদিন অতিবাহিত করল। কিন্তু কোন সমাধান তারা খুঁজে পেল না। শেষপর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিল বিন্যামিনের ব্যাপারে সঠিক কথাই তারা ফিরে গিয়ে পিতাকে জানাবে।
রুবেন তার ভাইদেরকে বলল-‘পিতাকে বোলও-তোমার পুত্র চুরি করেছে আর আমরা যা জানি তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম। অদৃশ্যের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না। প্রয়োজনে যে শহরে আমরা ছিলাম তার বাসিন্দাদেরকে জিজ্ঞেস কর আর যে যাত্রীদলের সাথে আমরা এসেছি তাদেরকেও। আমরা অবশ্যই সত্য বলছি।’
রুবেন তার ভাইদেরকে বলল-‘পিতাকে বোলও-তোমার পুত্র চুরি করেছে আর আমরা যা জানি তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম। অদৃশ্যের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না। প্রয়োজনে যে শহরে আমরা ছিলাম তার বাসিন্দাদেরকে জিজ্ঞেস কর আর যে যাত্রীদলের সাথে আমরা এসেছি তাদেরকেও। আমরা অবশ্যই সত্য বলছি।’
অবশেষে ভাইয়েরা বাড়ীর পথে রওনা হল রুবেন ব্যতিত। পিতার সম্মুখে সে কোন মুখে ফিরে যাবে? সুতরাং সে পিতার অনুমতি ব্যতিত মিসর ত্যাগে রাজী হল না।
এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- যখন ওরা তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হল তখন ওরা নির্জনে গিয়ে পরামর্শ করতে লাগল। ওদের মধ্যে যে বয়োজৈষ্ঠ্য ছিল সে বলল, ‘তোমরা কি জান না যে, তোমাদের পিতা তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন, আর আগেও তোমরা ইউসূফের ব্যাপারে অন্যায় করেছিলে? সুতরাং আমি কিছুতেই এদেশ ছাড়ব না যতক্ষণ না আমার পিতা আমাকে অনুমতি দেন বা আল্লাহ আমার জন্যে কোন ব্যবস্থা করেন। আর তিনিই বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’ তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও আর বল, ‘হে আমাদের পিতা, তোমার পুত্র চুরি করেছে আর আমরা যা জানি তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম। অদৃশ্যের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না। যে শহরে আমরা ছিলাম তার বাসিন্দাদেরকে জিজ্ঞেস কর আর যে-যাত্রীদলের সাথে আমরা এসেছি তাদেরকেও। আমরা অবশ্যই সত্যি বলছি।’(১২:৮০-৮২)
নয় ভাই বাড়ীতে ফিরে এল। অতঃপর পিতাকে সবকিছু খুলে বলল। বিন্যামিনের চুরির ঘটনা শুনে ইয়াকুব তা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি মনে প্রচন্ড আঘাত পেলেও নিজেকে শান্ত রাখলেন। পুত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘তোমরা এক মনগড়া কথা নিয়ে এসেছ। তাই ধৈর্য্য ধারণই উত্তম।’
তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘আফসোস ইউসূফের জন্যে।’
তারা বলল, ‘তুমি তো তার কথা ভুলবে না যতক্ষণ না তুমি মৃতপ্রায় হবে বা মরে যাবে।’
তিনি বললেন, ‘আমার অসহ্য বেদনা ও দুঃখ আমি আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি। আর আমি আল্লাহর কাছ থেকে যা জানি তোমরা তা জান না। সন্তানেরা! তোমরা যাও, ইউসূফ ও তার ভাইয়ের খোঁজ কর।’
তারা বলল, ‘তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইছ। ইউসূফ সেই কবে হারিয়ে গেছে। এসব ভেবে লাভ নেই।’
তিনি বললেন, ‘আল্লাহর আশীর্বাদ সম্পর্কে তোমরা নিরাশ হইও না। কারণ অবিশ্বাসী সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর আশীর্বাদ সম্পর্কে কেউ নিরাশ হয় না।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-(ইয়াকুব) বলল, ‘না, তোমরা এক মনগড়া কথা নিয়ে এসেছ, তাই পূর্ণ ধৈর্য্যধরাই আমার পক্ষে ভাল। হয়ত আল্লাহ ওদের সকলকে একসঙ্গে আমার কাছে এনে দেবেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী।’
সে ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ও বলল, ‘আফসোস ইউসূফের জন্যে।’ সে শোকে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর সে অসহ্য মানসিক কষ্টে ছিল।
ওরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! তুমি তো ইউসূফের কথা ভুলবে না যতক্ষণ না তুমি মৃতপ্রায় হবে বা মরে যাবে।’
সে বলল, ‘আমার অসহ্য বেদনা ও দুঃখ আমি আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি। আর আমি আল্লাহর কাছ থেকে যা জানি, তোমরা তা জান না। বাছারা! তোমরা যাও, ইউসূফ ও তার ভাইয়ের খোঁজ কর। আল্লাহর আশীর্বাদ সম্পর্কে তোমরা নিরাশ হইও না; কারণ অবিশ্বাসী সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর আশীর্বাদ সম্পর্কে কেউ নিরাশ হয় না।’ (১২:৮৩-৮৭)
পিতার সনির্বন্ধ অনুরোধ এবং দূর্ভিক্ষের করাল গ্রাসের কারণে ইউসূফের ভাইয়েরা পুনঃরায় সামান্য অর্থ নিয়ে মিসরে এল। অতঃপর তারা আজিজে মিসরের সম্মুখে হাজির হল। এসময় তারা তাকে বলল, ‘হে আজিজ! আপনি মহানুভব! আপনি জানেন, দুর্ভিক্ষের ভয়াল থাবায় আমরা ক্ষত-বিক্ষত, নিঃস্ব। উপযুক্ত মূল্য দিয়ে খাদ্য ক্রয়ের সঙ্গতি আমাদের নেই। আমরা অল্প মূল্য এনেছি। আমাদেরকে খাদ্য-শস্য প্রদান করুন, আর কিছু দানও করুন। আল্লাহ দাতাদের প্রতিদান দিয়ে থাকেন।’
দানের প্রতিদান ব্যাপক-মুমিন ও অবিশ্বাসী নির্বিশেষে যে প্রতিদান দুনিয়াতে পায় তা হচ্ছে-বিপদাপদ দূর হওয়া। অপর প্রতিদানটি শুধু মুমিনরা ভোগ করবে পরকালে- জান্নাতে। ইউসূফের ভাইয়েরা তখন পর্যন্ত জানত না যে, আজিজে মিসর, ঈমানদার না কূফরকারী। তাই তারা এমন ব্যাপক ভাষা ব্যাবহার করল যাতে ইহকাল ও পরকাল- উভয়ই বোঝা যায়।
বৈমাত্রীয় ভাইদের মিসকিনদের মত অবস্থা এবং নিজ পরিজনদের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে ইউসূফের মন ব্যাথিত হয়ে উঠল। তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। ভাইদেরকে বললেন, ‘তোমাদের এখন এই অবস্থা যে খাদ্য ক্রয়ের প্রয়োজনীয় অর্থও নেই। তোমরা সেই মহাবিজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার স্মরণ থেকে দূরে সরে গেছ। তোমরা কি ইউসূফকে মনে রেখেছ? তার সাথে কি ব্যাবহার করেছিলে মনে পড়ে কি?’
ইউসূফ! কোথায় কনান আর কোথায় মিসর!কতদীর্ঘ সময়! এতকাল পরে মিসরের রাজদরবারে তার প্রসঙ্গই বা কেমন করে উঠল! তারা ভীত, উৎকন্ঠিত ও বিষ্মিত হল। তাদের সকলের দৃষ্টি একযোগে আজিজে মিসরের উপর নিপতিত হল। ইউসূফের সেই বাল্যকালের চাল-চলন, কথাবার্তা, আচার-ব্যাবহার বিশ্লেষণ করে তারা তাকে আবিস্কার করল। কিন্তু এ-কি করে সম্ভব!
‘তবে কি আপনিই ইউসূফ?’-তারা সবিষ্ময়ে প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, আমিই ইউসূফ।’-আজিজে মিসরের ভরাট কন্ঠ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ভাইদের কর্ণকূহরে প্রবেশ করল। ইতিমধ্যে ভাইদের আগমন সংবাদে বিন্যামিন সেখানে এসেছিল এবং তার একপাশে অবস্থান নিয়েছিল। ইউসূফ ইঙ্গিতে তাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আর এ আমারই ভাই।’
ভাইদের বিষ্মিত মুখরয়ব এসময় ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। নিজেদের কৃতকর্মের পরিণতি ভেবে তারা উৎকন্ঠিত হল। তাদের মস্তক অবনত হয়ে পড়ল। এ এমন হল যেন কৃত অপরাধের কথা স্মরণ করে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইছে তারা। ইউসূফ তাদেরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আর তাদের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে নরম কন্ঠে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘তোমরা কুন্ঠিত হইও না। একটা বৈরী পরিবেশ আমাদের পরস্পরকে বিচিছন্ন করে দিয়েছিল- তোমাদেরকে অপরাধ প্রবণতার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাই আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনই অভিযোগ নেই। আমি তোমাদের কৃত অপরাধের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।’
ইউসূফ ভাইদেরকে তার কথা এবং সমস্ত পরিবারকে মিসরে এসে বাস করার জন্যে তার অনুরোধ ফিরে গিয়ে পিতাকে জানাতে বললেন। এছাড়া তিনি তাদের মিসরে ফিরে আসার জন্যে ঘোড়ার গাড়ি দিলেন এবং পিতার জন্যে দামী উপহার পাঠালেন। আর তিনি তার গায়ের একটি জামা ভাইদেরকে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা আমার এই জামাটি নিয়ে যাও। আর পিতার মুখের উপর রেখ। তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন।’
ইহুদা হাত বাড়িয়ে জামাটা নিল, বলল, ‘আমিই নিয়ে যাব এটা।’
নিজেরা ক্ষমা পাওয়ায় এবং ইউসূফ বেঁচে আছে দেখে প্রকৃত কৃতজ্ঞ হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ীর পথে রওনা দিল তারা।
এদিকে ইয়াকুব ঘুম থেকে জেগে উঠেই পরিবারের সকলকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা হয়তঃ আমার কথা বিশ্বাসই করবে না। কিম্বা ভাববে আমার মতিভ্রম হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলছি, আমি ইউসূফের গন্ধ পাচ্ছি।’
পরিবারের কেউই তার কথা বিশ্বাস করতে পারল না। তারা ভাবল-তিনি সেই পুরোন স্মৃতি নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন।
অবশেষে পুত্ররা ফিরে এল এবং পিতাকে সকল কথা জানাল। তারা অতীত কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হয়ে অবনত মস্তকে পিতাকে বলল, ‘হে আমাদের পিতা! ইউসূফ এখনও বেঁচে আছে। আর সেই এখন গোটা মিসর দেশের শাসনকর্তা। হে পিতা! নিশ্চয়ই আমরা অপরাধী। আমাদের পাপমুক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
সবশুনে ইয়াকুব হতভম্ব হলেন। আনন্দে তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমি আল্লাহর কাছ থেকে যা জানি তোমরা তা জান না? আমি অবশ্যই আমার প্রতিপালকের কাছে তোমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করব। তিনি ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।’
সন্তানদের ক্ষমার জন্যে ইয়াকুব তৎক্ষণাৎ দোয়া করার পরিবর্তে দোয়া করার ওয়াদা করলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ওয়াদা করেননি এই কারণে যে, তিনি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে শেষরাত্রে দোয়া করতে চেয়েছিলেন। কেননা তিনি জানতেন ঐ সময়ে দোয়া কবুল হয়। আল্লাহ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে নিকটতম আকাশ থেকে ঘোষণা করেন - ‘কেউ আছে কি, যে দোয়া করবে- আমি কবুল করব? কেউ আছে কি, যে ক্ষমা প্রার্থণা করবে- আমি ক্ষমা করব?’
ইহুদা তার কাছে সযত্নে রক্ষিত ইউসূফের জামাটি বের করল। তারপর ছলছল চোখে পিতার মুখের উপর রাখল সেটি। একদা ইউসূফের রক্তমাখা জামাটি সে-ই পিতার হাতে তুলে দিয়েছিল। আর আজ তারই আরেক জামা সে মিসর থেকে বয়ে নিয়ে এসেছে এই আশায় তাতে হয়তঃ তার পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে।
ইয়াকুবের মুখের উপর জামাটি রাখার সাথে সাথেই তিনি সুস্থ্য হলেন ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। পুত্ররা তখন তাকে সকল উপহার সামগ্রী দেখাল।
এতদসম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হল তখন বলল, ‘হে আজিজ! আমরা ও আমাদের পরিবার পরিজন বিপদে পড়েছি, আর আমরা অল্প মূল্য এনেছি। আপনি আমাদের রসদ দেন পুরোমাত্রায়। আর আমাদের কিছু দানও করেন। আল্লাহ তো দাতাদের পুরস্কার দিয়ে থাকেন।’
(ইউসূফ বলল), ‘তোমরা কি জান তোমরা ইউসূফ ও তার সহোদরের উপর কেমন ব্যাবহার করেছিলে যখন তোমাদের জ্ঞান ছিল না?’
ওরা বলল, ‘তবে কি তুমিই ইউসূফ ?’
সে বলল, ‘আমিই ইউসূফ, আর এ আমার ভাই, আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন। যে লোক সাবধানী ও ধৈর্য্যশীল সেই সৎকর্মপরায়ণ। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।’
ওরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন, আর আমরা নিশ্চয়ই অপরাধী ছিলাম।’
সে বলল, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আর তিনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়াল। তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও। আর আমার পিতার মুখের উপর রেখ। তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর তোমাদের পরিবারের সকলকেই আমার কাছে নিয়ে এস।’
তারপর এ কাফেলা যখন বেরিয়ে পড়ল তখন তাদের পিতা বলল, ‘তোমরা যদি আমাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে না কর তবে আমি বলব যে, আমি ইউসূফের গন্ধ পাচ্ছি।’
যারা উপস্থিত ছিল তারা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আপনি তো আপনার আগের ভুলেই আছেন।’
তারপর যখন সুসংবাদদাতা এল ও তার মুখের উপর জামাটি রাখল তখন সে তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেল।
সে বলল, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমি আল্লাহর কাছ থেকে যা জানি তোমরা তা জান না?’
ওরা বলল, ‘হে আমাদের পিতা! আমাদের পাপের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, আমরা অবশ্যই দোষী।’
সে বলল, ‘আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তোমাদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল পরমদয়ালু।’(১২:৮৮-৯৮)
ইয়াকুব ইউসূফকে দেখতে তাড়াতাড়ি মিসরে যাবার জন্যে ব্যস্ত হলেন। দ্রুত যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে সমস্ত পরিবার পরিজনসহ তিনি অতঃপর মিসরের পথে যাত্রা করলেন। এই যাত্রায় ইয়াকুবের নিজ বংশধরেরা (পুত্রবধূরা বাদে) ছিল ছেষট্টিজন। পথে বুসরাতে আল্লাহ মিসরে তাকে আশীর্বাদের প্রতিজ্ঞা করলেন। তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার সঙ্গে তাঁর চুক্তি নবায়ন করলেন। তাছাড়া সময়মত তার পরিবারকে কনান দেশে ফিরিয়ে আনার নিশ্চয়তাও দিলেন।
কাফেলা একসময় মিসরে পৌঁছিল। সংবাদ পেয়ে ইউসূফ তাদেরকে এগিয়ে নিতে এলেন। যখন পরিবারের সাথে তার দেখা হল, তখন তিনি পিতামাতাকে নিজের পাশে জায়গা দিলেন। অতঃপর তাদেরকে কোলাকুলি করে বললেন, ‘আপনারা সবাই আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাপদে মিসরে ঢোকেন।’
পিতামাতা ও ভাইয়েরা সকলেই ইউসূফের সামনে নমিত হয়ে সিজদা করল। -এই সিজদা সম্মানসূচক ছিল- উপাসনামূলক নয়। কোন পয়গম্বরের শরীয়তে কখনই উপাসনামূলক সিজদা আল্লাহ ব্যতিত কারও জন্যে বৈধ ছিল না, কিন্তু সম্মানসূচক সিজদা মুহম্মদের শরীয়ত আগমনের পূর্বপর্যন্ত অবৈধ ছিল না।
ইউসূফ তার পিতাকে বললেন, ‘হে আমার পিতা! এই আমার আগের স্বপ্নের ব্যাখ্যা। আমার প্রতিপালক তা সত্যে পরিণত করেছেন। আর তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন ও শয়তান আমার আর আমার ভাইদের সম্পর্ক নষ্ট করার পর ও আপনাদের মরুভূমি থেকে এখানে এনে দিয়ে আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী।’
ইউসূফ তার এই বক্তব্যে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু ভাইয়েরা যে তাকে কূপে নিক্ষেপ করেছিল তা উল্লেখ করেননি। কারণ এই যে, তিনি তাদের অপরাধসমূহ পূর্বেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাই যে কোনভাবে কূপের কথা উল্লেখ করে তাদেরকে লজ্জা দেয়া সমীচীন মনে করেননি। তিনি তাদের অত্যাচার উৎপীড়ন শয়তানের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে শেষে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাসমূহ উল্লেখ করলেন।
অতঃপর ইউসূফ অন্তর ঢেলে খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন। বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! ‘তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছ ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহলোকে ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে আত্মসমর্পণকারীর মৃত্যু দাও ও আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভূক্ত কর।’
ইয়াকুব আবেগজড়িত কন্ঠে পুত্র ইউসূফকে বললেন, ‘হে ইউসূফ! সূদীর্ঘকাল কেন তুমি আমাকে বে-খবর রেখেছিলে?’
ইউসূফ - ‘যখনই আমি আপনাকে আমার সংবাদ জানাতে চেয়েছি, জিব্রাইল আমাকে তা থেকে সর্বদা নিবৃত্ত করেছে এই বলে যে, ‘এখনও সময় হয়নি।’
পিতা- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ হচ্ছেন মহান কুশলী, সকল জ্ঞানই তাঁর আয়ত্ত্বাধীন।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-(ইউসূফ) তার পিতামাতাকে কোলাকুলি করে বলল, ‘আপনারা আল্লাহর ইচ্ছেয় নিরাপদে মিসরে ঢোকেন।’
আর ইউসূফ তার পিতামাতাকে উচ্চাসনে বসাল আর ওরা সকলে তার জন্যে নমিত হয়ে সিজদা করল। সে বলল, ‘হে আমার পিতা! এ আমার আগের স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমার প্রতিপালক তা সত্যে পরিণত করেছেন। আর তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন ও শয়তান আমার আর আমার ভাইদের
সম্পর্ক নষ্ট করার পর ও আপনাদের মরুভূমি থেকে এখানে এনে দিয়ে আমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক যা ইচ্ছে করেন তা সূক্ষ্মভাবে করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী।
--হে আমার প্রতিপালক! ‘তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছ ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহকাল ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে আত্মসমর্পণকারীর মৃত্যু দাও ও আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভূক্ত কর।’(১২:৯৯-১০১)
ভ্রাতৃবর্গসহ ইউসূফ ফেরাউনের দরবারে। |
ফেরাউন - ‘তারা কোথায়?’
ইউসূফ তার ভাইদের কয়েকজনকে ফেরাউনের সম্মুখে উপস্থিত করলেন। তারা ফেরাউনকে রীতি অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শণ করল। ফেরাউন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি কাজ কর?’
তারা বলল, ‘হে মহামান্য ফেরাউন! আপনার এই দাসেরা পশুপালনের কাজ করে। আর আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও একাজ করতেন।’
ফেরাউন ইউসূফকে বললেন, ‘তোমার পরিবারের লোকেরা তোমার কাছে এসেছে। সমগ্র মিসর দেশটাই তো তোমার সম্মুখে পড়ে রয়েছে। দেশের সর্বোৎকৃষ্ট স্থানেই তাদেরকে বাস করতে দাও। বরং তারা গোষণেই বাস করুক। আর তাদের মধ্যে যোগ্য লোক পেলে তাদের উপর আমার পশুপালের ভার দিও।’
এরপর ইউসূফ ফেরাউনের সঙ্গে পিতাকে পরিচয় করালেন। তারপর তিনি তার পরিবারের সকলকে পূর্ব মিসরের উর্বরভূমি গোষণ প্রদেশে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন। যেহেতু তারা পশুপালক, তাই তাদেরকে রাজকীয় পশুপাল দেখাশুনো করতে দেয়া হল। এরূপে তাদেরকে আনন্দের সঙ্গেই নিযুক্ত করা হল। এক কথায় তাদের সঙ্গে ভদ্র আচরণ ও সম্মান দেখান হয়েছিল। ইউসূফের মিসর জীবন এবং ইয়াকুবের সেখানে প্রবাস সম্পর্কে যবুরে আছে-
তিনি দেশে দুর্ভিক্ষ আহবান করলেন, সমস্ত ভক্ষ্য নিঃশেষিত হল।
তিনি তাদের অগ্রে এক পুরুষকে পাঠালেন, ইউসূফ দাসরূপে বিক্রিত হল।
বেড়ী তার চরণকে ক্লেশ দিল, তার প্রাণ লৌহ শিকে আবদ্ধ হল।
যতক্ষণ না তার বচন সফল হল,
ততক্ষণ খোদার বাণী তাকে পরীক্ষা করল।
জাতিগণের কর্তা লোক পাঠিয়ে তাকে মুক্ত করল,
তাকে সমস্ত সম্পত্তির কর্তা করল, তাতে সে অমাত্যগণের মধ্যমনি হল।
আর ইস্রায়েল মিসরে উপস্থিত হল, ইয়াকুব হামের দেশে প্রবাস করল।-(১০৫:১৬-২৩)
দুর্ভিক্ষ প্রকট আকার ধারণ করল। অবস্থা এমন ভীষণ হল যে, সারা দেশের কোথাও আর খাদ্য-শস্য রইল না। মিসর ও কনানে হাহাকার পড়ে গেল। এ দু‘টি দেশের লোকেরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে যে শস্য কিনল তার মূল্য বাবদ ইউসূফ দেশ দু‘টির সমস্ত অর্থ তুলে নিয়ে ফেরাউনের কোষাগারে জমা দিলেন।
যখন লোকদের অর্থ ফুরিয়ে গেল, তখন মিসরীয়রা ইউসূফের কাছে এসে বলল, ‘আমাদের খেতে দিন। আমরা কি আপনার চোখের সামনেই অনাহারে মরে যাব? অর্থ-কড়ি আমাদের যাছিল সব ফুরিয়ে গেছে।’
ইউসূফ বললেন, ‘তোমাদের পশুপাল রয়েছে, সেগুলি আমাকে দাও। তোমাদের অর্থ যখন নেই তখন ওগুলোর বদলেই আমি তোমাদেরকে খাদ্য-শস্য দেব।’
লোকেরা তাদের পশুগুলোকে ইউসূফের কাছে আনতে লাগল। ছাগল-ভেড়া, গরু-ঘোড়া ও গাধার বদলে তিনি তাদের খাদ্য-শস্য দিতে লাগলেন। সমস্ত পশু জমা রেখে তিনি গোটা বৎসরটাই তাদের খাওয়ালেন। সেই বৎসরটা এভাবে কেটে গেল। পরের বৎসর লোকেরা এসে বলল, ‘হে মহামান্য কোষাধ্যক্ষ! আপনার কাছে আমরা কিছু লুকাব না। আমাদের অর্থ-কড়ি সব খরচ হয়ে গেছে আর আমাদের পশুগুলোও আপনার। এখন আমাদের এই দেহ এবং জায়গাজমি ছাড়া আপনাকে দেবার মত আর আমাদের কিছুই নেই। সুতরাং আপনি আমাদের ও আমাদের জায়গাজমি সব নিয়ে নেন, আর তার বদলে আমাদের খাবার দেন।’
দুর্ভিক্ষ এমন ভীষণ হল যে, মিসরীয়রা সকলে তাদের জায়গা জমি বিক্রি করে দিল এবং ইউসূফ তা ফেরাউনের নামে কিনে নিলেন। এভাবেই মিসরের সমস্ত জায়গা ফেরাউনের হাতে এসে গেল। তিনি কেবল পুরোহিতদের জায়গা জমি কিনলেন না। কেননা তারা তা বিক্রি করেনি এবং বিক্রি করার কোন প্রয়োজনও তাদের ছিল না। কারণ তারা রাজকীয় কোষাগার থেকে ভাতা পেত এবং তা দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করত।
ইউসূফ মিসর দেশের একসীমা থেকে অন্যসীমা পর্যন্ত যত লোক ছিল তাদের সবাইকে শহরে সরিয়ে আনলেন।
অবশেষে দুর্ভিক্ষ শেষ হল। ইউসূফ সমস্ত অধিবাসীদেরকে বললেন, ‘দেখ, ফেরাউনের পক্ষ থেকে আমি ইতিপূর্বে তোমাদের সব জায়গা জমি কিনে নিয়েছি। তোমরা এখন এই বীজ নাও, আর তা নিয়ে জমিতে বপন কর। এখন থেকে সমস্ত উৎপন্ন ফসলের এক পঞ্চমাংশ ফেরাউনকে দেবে, আর বাকী অংশ বীজ ও পরিবারের লোকদের খাবারের জন্যে রাখবে।’
লোকেরা বলল, ‘আপনি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। হে মহামান্য কোষাধ্যক্ষ! আপনার এমন অনুগ্রহ পেলে আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে ফেরাউনের দাস হয়ে থাকব।’
ইউসূফ মিসর দেশের জায়গা জমি সম্পর্কে এই আইন পাশ করেছিলেন যে, উৎপন্ন সব ফসলের এক পঞ্চমাংশ ফেরাউনের হবে। এ আইন আজও মিসরে চালু রয়েছে।
মিসরে ইস্রায়েলীরা সুখে-শান্তিতে সতের বৎসর অতিবাহিত করল। এসময় ইয়াকুব বয়সের ভারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সন্তানেরাও বুঝতে পারল তাদের পিতা আর বেশীদিন তাদের মাঝে নেই। সুতরাং তারা পিতার সেবায় তার শয্যা পাশে অধিক সময় অতিবাহিত করছিল।
এদিকে পিতার অসুস্থ্যতার খবর ইউসূফ জানতে পারলেন। সুতরাং তিনি তার দু‘পুত্র মন:শি ও ইফ্রয়িমকে সঙ্গে নিয়ে পিতার সাক্ষাতে এলেন।
ইয়াকুব অত:পর তার সকল সন্তানদের ডাকলেন। তারা সকলে তার শয্যা পাশে সমবেত হলে তিনি বললেন, ‘আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাই শান্তিতে মরতে চাই আমি।’ তারপর তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার অবর্তমানে তোমরা কিসের উপাসনা করবে?’
তারা বলল, ‘আমরা এক আল্লাহর, তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাইল ও ইসহাকের উপাস্যের উপাসনা করব। আর আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করি।’
তিনি বললেন, ‘হে আমার পুত্ররা! আল্লাহ তোমাদের জন্যে এই ধর্মকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরও না।’
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- সে পুত্রদের জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার পরে তোমরা কিসের উপাসনা করবে?’
তখন তারা বলেছিল, ‘আমরা তোমার এক আল্লাহর ও তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাইল ও ইসহাকের আল্লাহর উপাসনা করব। আর আমরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করি।’ (২:১৩৩)
(সে বলেছিল), ‘হে আমার পুত্ররা! আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দ্বীন (ধর্ম)কে মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী (মুসলমান) না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরও না।’(২:১৩২)
সবশেষে ইকয়াকুব ইউসূফকে একান্তে ডেকে তার কাছ থেকে এই প্রতিজ্ঞা নিলেন, যেন মৃত্যুরপর তার দেহকে তার পিতার পাশে পারিবারিক গোরস্থানে, মকপেলা গুহাতেই সমাহিত করা হয়। ইউসূফের কাছে ফেরাউন রাজকার্যভার অর্পণ করেছিলেন। আর ইউসূফও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সুতরাং তিনি পিতার নিকট বিদায় চাইলেন। খুশী মনে পিতা তাকে বিদায় দিলেন এবং একই সাথে তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর প্রতি তোমার কর্তব্যে সর্বদা বিশ্বস্ত থাকবে।’
ইয়াকুব মারা গেলেন। এসময় তার বয়স হয়েছিল ১৫০ বৎসর। তার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা তাদের প্রতিজ্ঞা ঠিক রাখার জন্যে তার দেহকে যত্ন সহকারে কনান দেশে নিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হল। ইউসূফ ফেরাউনকে তার পিতার শেষ ইচ্ছে জানালেন এবং পিতার মৃতদেহ নিয়ে ভাইদের সাথে যেতে ফেরাউনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ফেরাউন বললেন, ‘তিনি যে শপথ করিয়েছেন, সেই মতই তুমি সবকিছু কর।’
পিতার লাশ নিয়ে ইউসূফের ভাইয়েরা কনান দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। অনেক রাজকর্মচারীরাও তাদের সাথে গেল। এভাবে একটা বিরাট দল কনানে গিয়ে লাশ সমাহিত করে ফিরে এল।
ইয়াকুবের মৃত্যুর পর মিসরে ইস্রায়েলীদের সম্মান কমে যায়নি। মিসরীয়রাও তাদের কোন প্রকার কষ্ট দেয়নি। কিন্তু ভাইয়েরা এই ভয়ে ভীত হল যে, পিতার অবর্তমানে ইউসূফ তার প্রতি তাদের অতীত কার্য্যকলাপের জন্যে তাদের প্রতি অন্যায় ব্যাবহার করেন কিনা। ইউসূফ তা বুঝতে পেরে ভাইদের প্রতি ভাল ব্যাবহার করার নিশ্চয়তা দিলেন এবং তাদের ভয় দূর করলেন।
সকলে মিসরে নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
একসময় ইউসূফ বৃদ্ধ হলেন। ১১০ বৎসর বয়সে দূরদর্শী ইউসূফ তার সন্তানদেরকে ডেকে স্মরণ রাখতে বললেন যে, এক নির্দিষ্ট সময়ে তাদেরকে কনানে ফিরে যেতে হবে। আর চলে যাবার সময় তারা যেন তার দেহকেও জন্মভূমিতে নিয়ে যায়।
ইউসূফ মারা গেলেন। তার দেহকে সুগন্ধি দ্রব্য দিয়ে যত্ন সহকারে একটি দামী বাক্সে রাখা হল, যতদিন পর্যন্ত না তাদের প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যাওয়া হয়েছিল।
ইউসূফ নব্যূয়তের সুস্পষ্ট প্রমানাদি নিয়ে এসেছিলেন। তাই তার জীবিতকালে ইস্রায়েলীদের ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর একাংশ তাকে নবী হিসেবে জানত এবং মান্য করত। কিন্তু একদল চরম সন্দেহ পোষণ করত। অতঃপর যখন তিনি মারা গেলেন, তখন সেই সন্দেহ পোষণকারীরা বলতে লাগল, ‘আল্লাহ ইউসূফের পরে আর কাউকে রসূল করে পাঠাবেন না।’
এই সন্দেহ পোষণকারীরাই অতঃপর যখন মূসা আগমন করেছিলেন নব্যূয়তের সুষ্পষ্ট প্রমানাদিসহ তখন তাকে অস্বীকার করেছিল এই মনোভারের কারণে।
এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ-ইতিপূর্বে তোমাদের কাছে ইউসূফ সুস্পষ্ট প্রমানাদিসহ আগমন করেছিল, অতঃপর তোমরা তার আনীত বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে। অবশেষে যখন সে মারা গেল, তখন তোমরা বলতে শুরু করলে, ‘আল্লাহ ইউসূফের পরে আর কাউকে রসূল করে পাঠাবেন না।’
এভাবে আল্লাহ সীমালঙ্ঘণকারী, সংশয়ী ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করেন।(৪১:৩৪)
সমাপ্ত।
বি:দ্র: আল্লাহ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন এবং ঘোষণা করেন- ‘কেউ আছে কি, যে দোয়া করবে- আমি কবুল করব? কেউ আছে কি, যে ক্ষমা প্রার্থণা করবে- আমি ক্ষমা করব?’ এটি আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসের অংশ (al-Bukhari,vol. 4, p.68 and vol. 1, p. 136; Muslim, vol. 1, p. 283; Musnad of Ahmed, vol.2, p.258)। কিন্তু আর্টিকেলে এটি হাদিস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি, বরং বাক্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে এভাবে -আল্লাহ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে নিকটতম আকাশ থেকে ঘোষণা করেন- ‘কেউ আছে কি, যে দোয়া করবে- আমি কবুল করব? কেউ আছে কি, যে ক্ষমা প্রার্থণা করবে- আমি ক্ষমা করব?’ -(হুরায়রার এই বর্ণনা বাইবেলের আদি পুস্তকের এই আয়াতটির মত- ঈশ্বর বললেন, "Come, let us go down and confuse their language so they will not understand each other."-Genesis 11:7) এটি এ কারণে যে, Allah is exalted and far above ascending and descending, coming and going etc. অধিকন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সর্বাধিক (৫,৩৭৪টি) হাদিস বর্ণনাকারী এই আবু হুরায়রাকে হযরত ওমর "খোদার শত্রু" হিসেবে আখ্যায়িত করে দু'দুবার চাবকে ছিলেন। প্রথমবার হযরতের সময়কালে, অধিক হাদিস বর্ণনা করার কারনে এবং দ্বিতীয়বার ওমরের খেলাফতকালে, রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় নি:স্ব অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ার কারণে। উল্লেখ্য, শিয়াগণ আবু হুরায়রা বর্ণিত সকল হাদিস বর্জন করে থাকেন।
বি:দ্র: আল্লাহ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন এবং ঘোষণা করেন- ‘কেউ আছে কি, যে দোয়া করবে- আমি কবুল করব? কেউ আছে কি, যে ক্ষমা প্রার্থণা করবে- আমি ক্ষমা করব?’ এটি আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসের অংশ (al-Bukhari,vol. 4, p.68 and vol. 1, p. 136; Muslim, vol. 1, p. 283; Musnad of Ahmed, vol.2, p.258)। কিন্তু আর্টিকেলে এটি হাদিস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি, বরং বাক্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে এভাবে -আল্লাহ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে নিকটতম আকাশ থেকে ঘোষণা করেন- ‘কেউ আছে কি, যে দোয়া করবে- আমি কবুল করব? কেউ আছে কি, যে ক্ষমা প্রার্থণা করবে- আমি ক্ষমা করব?’ -(হুরায়রার এই বর্ণনা বাইবেলের আদি পুস্তকের এই আয়াতটির মত- ঈশ্বর বললেন, "Come, let us go down and confuse their language so they will not understand each other."-Genesis 11:7) এটি এ কারণে যে, Allah is exalted and far above ascending and descending, coming and going etc. অধিকন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সর্বাধিক (৫,৩৭৪টি) হাদিস বর্ণনাকারী এই আবু হুরায়রাকে হযরত ওমর "খোদার শত্রু" হিসেবে আখ্যায়িত করে দু'দুবার চাবকে ছিলেন। প্রথমবার হযরতের সময়কালে, অধিক হাদিস বর্ণনা করার কারনে এবং দ্বিতীয়বার ওমরের খেলাফতকালে, রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় নি:স্ব অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ার কারণে। উল্লেখ্য, শিয়াগণ আবু হুরায়রা বর্ণিত সকল হাদিস বর্জন করে থাকেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন