নবী মুহম্মদ নাজরানের খ্রীষ্টানদের কাছে একটি ফরমান (Decree) প্রেরণ করলেন। এ্ই ফরমানে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছিল-
ক) ইসলাম কবুল কর, অথবা
খ) জিজিয়া কর দাও, অথবা
গ) যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও।
নাজরান ছিল আরব দেশীয় খ্রীষ্টানদের কেন্দ্রভূমি। |
অতঃপর সে (মরিয়ম) সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে হাজির হল, ওরা বলল- হে মরিয়ম! তুমি তো এক অদ্ভূত কান্ড করে বসেছ। হে হারুণ ভগ্নি! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না, তোমার মাতাও ব্যভিচারিনী ছিল না।’(১৯:২৭)
শুনে তাকে প্রশ্ন করল- ‘তোমাদের এই কোরআনে মরিয়মকে হারুণ ভগ্নি কেন বলা হয়েছে?’ [অথচ তারা এমন আয়াতের সাথে পরিচিত ছিল- There was in the days of Herod, the king of Judaea, a certain priest named Zacharias, of the course of Abia: and his wife was of the daughters of Aaron, and her name was Elisabeth.-Luke, 1:5] মুগীরা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
অতঃপর নবীজীকে এ বিষয়ে অবহিত করলে তিনি যা বললেন তার সারকথা হল- নবী রসূলদের সঙ্গে সম্পর্কিত করে সম্বোধন করা তখনকার সময় অনেকে বরকতময় বলে মনে করত একারণে পিতামাতারা তাদের সন্তানের নাম তাদের নামে রাখত। এভাবে নবী হারুণের ও মূসার ভগ্নি- পূণ্যবতী নারী মরিয়মের নামেই নাম রাখেন হান্না তার কন্যা সন্তানের- মরিয়ম সংক্ষেপে মেরী। আর মেরী বা মরিয়ম বলে সম্বোধন না করে ঈসার মাতা মরিয়মকে ঐ পূণ্যবতীর সাথে তুলনা করে তাকে অধিকতর লজ্জায় ফেলার চেষ্টা করেছে তার সম্প্রদায়। একই নাম অথচ কতই না বৈসাদৃশ্য- একজন পবিত্রা, অন্যজন বেশ্যা- একজন পূণ্যবতীর পবিত্র নামের কতই না অবমাননা।
নাজরান ছিল আরব দেশীয় খ্রীষ্টানদের কেন্দ্রভূমি। |
তারা এসে নবীজীর সাথে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। তারা বললেন, ‘হে মুহম্মদ! আপনি কি চান যে, আমরা আপনার তেমন উপাসনা করি যেমন আমরা ঈসাকে উপাসনা করি?’
তিনি বললেন, ‘এটা কিরূপে সম্ভব যে, আমরা আল্লাহকে ছেড়ে অপরের এবাদত করি বা অপরকে এর প্রতি আহবান জানাই!’
এ সময় এই আয়াত নাযিল হল- কোন মানুষকে আল্লাহ কিতাব, হেকমত ও নবুয়্যত দান করার পর সে বলবে যে, তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার বান্দা হয়ে যাও’-এটা সম্ভব নয়। বরং তারা বলবে, ‘তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও, যেমন তোমরা কিতাব শিখাতে এবং যেমন তোমরা নিজেরাও যে পড়তে।’(৩:৭৯)
এই আয়াত নাযিল হবার পরও প্রতিনিধিরা এক পর্যায়ে ঈসাকে উপাস্য প্রতিপন্ন করার জন্যে প্রবল বাদানুবাদের আশ্রয় নিলেন। তখন এই আয়াতসমূহ নাযিল হল, যাতে মুবাহালার আয়াতটিও রয়েছে -
নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমের মত। তাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন, তারপর তাকে বলেছিলেন ‘হয়ে যাও’ সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। যা তোমার পালনকর্তা বলেন, তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হইও না। অতঃপর তোমার কাছে সত্য সংবাদ এসে যাবার পর, যদি এ কাহিনী সম্পর্কে কেউ তোমার সাথে বিবাদ করে, তাহলে বল,
“এস, আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে প্রার্থণা করি এবং তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাৎ করি যারা মিথ্যেবাদী।”
নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমের মত। তাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন, তারপর তাকে বলেছিলেন ‘হয়ে যাও’ সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। যা তোমার পালনকর্তা বলেন, তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হইও না। অতঃপর তোমার কাছে সত্য সংবাদ এসে যাবার পর, যদি এ কাহিনী সম্পর্কে কেউ তোমার সাথে বিবাদ করে, তাহলে বল,
“এস, আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে প্রার্থণা করি এবং তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাৎ করি যারা মিথ্যেবাদী।”
নিঃসন্দেহে এটাই হল সত্য ভাষণ। আর এক আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আর আল্লাহ; তিনিই হলেন পরাক্রমশালী, মহাপ্রাজ্ঞ।(৩:৫৯-৬২)
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর মুহম্মদ প্রতিনিধিদলকে মুবাহালার আহবান জানালেন এবং নিজেও ফাতিমা, আলী, এবং ঈমাম হাসান ও হোসাইনকে সঙ্গে নিয়ে মুবাহালার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এলেন। এই আত্মবিশ্বাস দেখে শেরাহবীল ভীত হয়ে সঙ্গীদ্বয়কে বললেন, ‘যদি তিনি সত্যই আল্লাহর রসূল হন, তাহলে আল্লাহর রসূলের সাথে মুবাহালা করলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। সুতরাং মুক্তির অন্য কোন পথ অনুসন্ধান কর।’
তারা বললেন, ‘আপনার মতে মুক্তির উপায় কি?’
তিনি বললেন, ‘শর্তানুযায়ী সন্ধি করাই উত্তম।’
অতঃপর তারা নবীজী কর্তৃক ধার্যকৃত জিজিয়া কর দিতে সম্মত হয়ে মিমাংসায় উপনীত হলেন।
জিজিয়া হচ্ছে, প্রজাতন্ত্রের মধ্যে স্বাধীন ও নিরাপদে বসবাসের বিনিময়ে অমুসলিম কর্তৃক প্রজাতন্ত্রকে প্রদেয় কর, তবে আরবের মুশরিকরা এর অন্তর্ভূক্ত ছিল না, তাদের থেকে কখনও জিজিয়া গৃহীত হয়নি। আর নাজরান গোত্রের সাথে ধার্য্যকৃত এ জিজিয়া কর ছিল-বার্ষিক দু‘হাজার জোড়া বস্ত্র। একটা লুঙ্গি ও একটা চাদরে এই জোড়া নির্ধারিত হয়েছিল এবং এর মূল্য নিরুপিত হয়েছিল এক উকিয়া রৌপ্য (এক উকিয়া সমান ৪০ দিরহাম বা ১১.৫ তোলা রৌপ্য)।
কোরআন জিজিয়ার কোন হার নির্দিষ্ট করে দেয়নি। শাসকের সুবিবেচনার উপর নির্ভরশীল এটা। তবে এ সম্পর্কিত নবীজীর নির্দেশ ছিল- “যে ব্যক্তি কোন অমুসলিম নাগরিকের উপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে জুলুম করবে, রোজ হাশরে আমি ঐ অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ঐ অমুসলিমের পক্ষ অবলম্বণ করব। আর, আমি যার বিপক্ষে দাঁড়াব, তার পরাজয় সুনিশ্চিত।”
-এই নির্দেশ মেনে খলিফা ওমর তার শাসনামলে যে জিজিয়া ধার্য্য করেছিলেন তা ছিল-উচ্চবিত্তের জন্যে মাসিক চার দিরহাম, মধ্যবিত্তের জন্যে দুই দিরহাম এবং নিম্নবিত্তের জন্যে এক দিরহাম বা ৩.৫ মাশা রৌপ্য। গরীব-দুঃখী, বিকলাঙ্গ, মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ এবং সংসারত্যাগী ধর্মযাজকদেরকে এই কর থেকে অব্যহতি দেয়া হয়।
সমাপ্ত।
ছবি: wikipedia, the-saudi, flickr.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন