১৮ মার্চ, ২০১২

Noah: নূহের বংশধরগণ।

মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়া নূহের (Noah) বংশধররা ও অন্যান্য একেশ্বরবাদীরা ব্যাকটেরিয়ার (বলখের) সমতল মালভূমিতেই প্রথম বসবাস শুরু করেছিল। সময়ের সাথে সাথে তাদের বংশবৃদ্ধি হতে থাকল এবং ক্রমশঃ পরিবার ও গোত্রে বিভক্ত হল। অতঃপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে তারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

ব্যাকটেরিয়া (বলখ)
হেমিটিক শাখার (নূহের পুত্র হামের বংশধর) লোকেরাই সর্বপ্রথম তাদের প্রাচীন আবাসভূমি ত্যাগ করেছিল এবং কালক্রমে তারা ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। তাদের পথ অনুসরণ করেছিল তুরাণীয়রা-তাদেকে উগ্র-ফিনিসীয় গোত্রও বলা হত। তারা ছিল জাফেটিক বংশের (নূহের পুত্র যেফতের বংশের) একটি শাখা। তাদের কিছু কিছু লোক উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা বর্তমান মঙ্গোলীয় জাতির প্রতিষ্ঠাতা। তাদের অপর একদল পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে আজারবাইজান, হামদান, ঘিনান-কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমের দেশগুলিতে বসতি স্থাপন করেছিল। এরাই মিডিয়া নামে পরিচিত। 

অস্টোরৎ দেবতা।
এই দলের একটি অংশ বাবিলের উর্বর সমভূমিতে বসবাস শুরু করেছিল এবং পূর্বাঞ্চলের হেমিটিক উপনিবেশগুলিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছিল। সময়ের স্রোতে পড়ে এই সময় এরা (বাবিলে আবাস গড়ে তোলা তুরাণীয় এবং পূর্বাঞ্চলের উপনিবেশগুলোর হেমিটিক) একেশ্বরবাদ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিল। যেসব ধর্মমত ও আচার অনুষ্ঠান তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল তা হল-সর্বদৈত্যবাদ, সূর্য্য দেবতা ও চন্দ্র দেবতাদের পূজা, যার সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত রয়েছে লিঙ্গ পূজা ও যৌন প্রবৃত্তি, বা'ল (Ba'al) ও মলচ (Moloch) দেবতার প্রতি সন্তান বলিদান এবং বেলটিস (Beltis) ও অস্টোরৎ (Ashtoreth) দেবতার কাছে কুমারী বলিদান। 

অর্থাৎ এসময় উচ্চ জড় সভ্যতা স্থুল ইন্দ্রিয়পরায়ণতার সঙ্গে সস্পৃক্ত ছিল এবং নিষ্ঠুরতা ধর্মে অনুমোদিত ছিল। আর কালক্রমে তারা হেমিটিকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আক্কাডিয়ান বা কুশাই জাতির সৃষ্টি করেছিল। এই কুশাই জাতিই বাবিলের প্রতিষ্ঠাতা। এরা অত:পর এমন একটি ধর্মের জন্ম দিয়েছিল, যা উচ্চতর পর্যায়ে সর্বখোদাবাদের সমগোত্রীয়।

 মলচ দেবতা
এদিকে সেমিটিক জাতিও (নূহের পুত্র শ্যামের বংশধর) তাদের আদি আবাসভূমি পরিত্যাগ করেছিল। তারা তুরাণীয়দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা করেছিল এবং মেসোপটেমিয়ার ব-দ্বীপের উত্তর দিকে বসতি স্থাপন করেছিল। সংখ্যা ও শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তারা দ্রুত বাবিল সাম্রাজ্য দখল করে নিয়েছিল এবং প্রতিবেশী রাজ্যসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করে সুদূর প্রসারী সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল। পশ্চিম এশিয়ার দু’টি বড় নদীর (ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস) মধ্যবর্তী এলাকায় তারা রাজধানী স্থাপন করেছিল। এরাই অ্যাসিরীয় জাতি। এরা তাদের আদি একেশ্বরবাদ থেকে অপার্থিব পুরোহিত তন্ত্রে নীত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে আবারও একেশ্বরবাদী ধর্মীয় ধারণায় ফিরে গিয়েছিল।

 বেলটিস দেবতা। 
জাফেটিক বংশই তাদের প্রাচীন বাসভূমিতে দীর্ঘতম সময় অবস্থান করেছিল। যখন অন্যান্য বংশের লোকেরা মূলবংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাম্রাজ্যের পতন ও ধর্মমতের উদ্ভব ঘটাচ্ছিল তখন এরা নিজস্ব বিশেষ ধারায় বিকাশ লাভ করছিল। 

অত:পর যে প্রাণশক্তি বর্বর জাতিসমূহের মধ্যে সক্রিয় তার দ্বারা তারা অনুপ্রাণিত হয়ে অথবা লোক সংখ্যার চাপে এবং তাদের প্রাচীন আবাস ভূমিতে পশুচারণ ক্ষেত্রের অভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে- একের পর এক পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রাথমিক দলসমূহের মধ্যে ছিল পেলাজিসীয় ও কেল্ট। তাদের অনুসরণ করেছিল অন্যান্য গোত্রের লোকেরা। 

ধর্মগুরু স্পিতাম জরথুস্ত্র
এ পর্যন্ত আর্যগণ তাদের প্রাচীন আবাস ভূমিতেই অধিষ্ঠিত ছিল। এদের এক দলের আবাস ছিল বদখসানে, অন্যরা বাস করত বলখের কাছাকাছি। তারা সেখানে বহু শতাব্দী ধরে প্রতিবেশী জাতিসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। একসময় তারা নিষ্ঠুর বর্বরস্তর থেকে বর্বরতার স্তরে উন্নীত হয়ে সার্বজনীন আদর্শের তাৎপর্যে সচেতন হল। তারা বৈদিক ধর্মের ভীতি ও বিভীষিকাময়তার মধ্যে প্রাকৃতিক বস্তু পূজিত হওয়া থেকে অগণিত আদর্শের দিকে এগিয়ে এল। ফলে সমাজ জীবনে আমূল পরিবর্তন এল। ইতিপূর্বেকার গোত্র ও গোষ্ঠির গঠনতন্ত্র, রাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হল। এভাবে এল শাসক কাইউমূর, এল হোসাং এবং পরবর্তীতে অন্যান্যরা।

ধর্মগুরু স্পিতাম জরথুস্ত্র
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সূচনাকালে আর্যদের দু’টি শাখার মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ দেখা দিল। এই বিরোধ তাদের পূর্ব শাখাকে ব্যাকটেরীয় আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত করল। আর যিনি পাশ্চাত্য আর্যদের মধ্যে প্রবল এই ধর্মীয় বিপ্লব শুরু করেছিলেন, তিনি হলেন ধর্মগুরু স্পিতাম জরথুস্ত্র।

ধর্মগুরু স্পিতাম জরথুস্ত্র পূর্বপুরুষদের অর্জিত আদর্শের সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক ও প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের আরোপিত বৈশিষ্ট্য, আলোক ও অন্ধকার নীতি দু’টি অন্তর্ভূক্ত করলেন। ফলে, ঐশী সত্ত্বার প্রতীক হল জীবন ও আলোকের উজ্জল অগ্রদূত সূর্য্য; যার শক্তি ব্যহত হলেও একসময় অনিষ্ট ও অন্ধকারের নীতিকে জয় করে। তার এসব আদর্শ পূর্বের পূজিত প্রাকৃতিক বস্তুর সঙ্গে পরস্পর মিশে যাচ্ছিল, কখনও সুস্পষ্ট ব্যক্তিসত্ত্বা হিসেবে, আবার কখনও সকল বস্তুতে বর্তমান প্রাণ সত্ত্বার সমগ্র হিসেবে।

নূহের বংশধরদের ছড়িয়ে পড়া।
জরথুস্ত্র (Zarathustra) কর্তৃক শুরু হওয়া ধর্মীয় বিপ্লব আর্যদের দু’টি শাখার মধ্যে যে ধর্মীয় বিরোধ সৃষ্টি করেছিল তা একসময় তাদের পূর্ব শাখা বা প্রাচ্য আর্যদেরকে ব্যাকটেরীয় আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত করল। এই বিরোধ সম্ভবতঃ মানবজাতির মধ্যে প্রথম ধর্মীয় বিরোধ যা, পাশ্চাত্য দ্বৈতবাদী গোত্রসমূহ তাদের বৈদিক ধর্মী (অর্ধ-বহুঈশ্বরবাদী, অর্ধ-সর্বঈশ্বর বাদী) ভ্রাতাদেরকে প্যারাপেমিসেডের ওপারে বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়েছিল। 

স্পিতাম জরথুস্ত্র প্রবর্তিত পার্শী ধর্মের মূল গ্রন্থ জিন্দাবেস্তা ও দশাতির। এই গ্রন্থগুলো মূলত: তার বিজনে ধ্যানের ফলে অর্জিত জ্ঞান (দ্বৈতবাদ) ও পিতৃপুরুষদের ধর্মমত সমূহের সমষ্টি এবং সুপ্রাচীন কিছু ভাববাণী। এই কারণে এইসব গ্রন্থসমূহেও শেষনবী মুহম্মদের আগমনবার্তা সম্বন্ধে কিছু ভবিষ্যৎবাণী সংযুক্ত হয়েছে। যেমন-

জিন্দাবেস্তা: আমি ঘোষণা করছি, হে স্পিতাম জরথুস্ত্র, পবিত্র আহমদ (ন্যায়বানদিগের আশীর্বাদ) নিশ্চয়ই আসবে, যার কাছ থেকে তোমরা সৎচিন্তা, সৎবাক্য, সৎকার্য এবং বিশুদ্ধ ধর্ম লাভ করবে।’

আ'দদের বাসস্থান।
দশাতির: ‘যখন পার্শীরা নিজেদের ধর্ম ভুলে গিয়ে নৈতিক অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত হবে, তখন আরব দেশে এক মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করবে, যার শিষ্যগণ পারস্য দেশ এবং দুর্ধর্র্ষ পারস্যিক জাতিকে পরাজিত করবে। নিজেদের উপাসনালয়ে অগ্নিপূজা না করে তারা ইব্রাহিমের কা’বাগৃহের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করবে, সেই কা’বা প্রতিমা মুক্ত হবে। সেই মহাপুরুষের শিষ্যগণ বিশ্ববাসীর পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপ হবে। তারা পারস্য, মদিয়ান, তুস, বলখ, প্রভৃতি পারস্যবাসীদের যাবতীয় পবিত্রস্থান অধিকার করবে। তাদের পয়গম্বর হবে একজন বাগ্মী পুরুষ এবং সে অনেক অদ্ভূত কথা বলবে।’

যাইহোক, আবার প্রসঙ্গে ফিরি- বিতাড়িত প্রাচ্য বৈদিকধর্মী আর্যগণ ভারতে বলপূর্বক প্রবেশ করল এবং সেখানকার আদি কৃষ্ণবর্ণ জাতিসমূহকে হত্যা, বিতাড়িত এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করল এবং সেখানে তারা কয়েক শতাব্দী ধরে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ল।

নূহের বংশধরদের ছড়িয়ে পড়া।
এই অভিযানকারী আর্যগণ যে আর্য ধর্ম তাদের প্রাচীন আবাসভূমি থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তাছিল মূলতঃ পূর্বপুরুষদের আত্মাসমূহের পূজা এবং দৃশ্যমান নৈসর্গিক ঘটনাবলীর মধ্যে প্রতীকৃত প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের অর্চণা এবং স্পিতাম জরথুস্ত্র প্রবর্তিত ধর্মের কিছু ধারণা। ক্রমে তাদের আধ্যাত্ম ধারণার উন্নতি হল এবং এই আধ্যাত্মক কৌতুহলের তীব্রতায় তারা সর্বোচ্চ একেশ্বরবাদে উপনীত হয়েছিল। 

এদিকে পশ্চিমের আর্যগণ একটি জাতিতে সংহত হয়ে ও নতুন আধ্যাত্মিক বিকাশ সহকারে অনতি বিলম্বে তাদের জন্মভূমির সীমা অতিক্রম করে আধুনিক পারস্য ও আফগানিস্তানের ভূ-খন্ডে ছড়িয়ে পড়ল। 

তারা সেখানকার হেমিটিক ও কুশাইট (হামের পুত্র কূশের বংশধর) বংশসমূহের অধিকাংশকে পর্যুদস্ত করল এবং ক্রমশঃ কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলে উপনীত হল, সেখানে তারা একগুয়ে ও কষ্ট সহিষ্ণু তুরাণীয়দের, মিডিয়ায় ও সুসিয়ানায় সু-প্রতিষ্ঠিত দেখতে পেল। তারা তুরাণীয়দের পরাভূত ও নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে পারলেও একসময় তাদের নিজেদের অধিকাংশই কুশাইট কিংবা অ্যাসিরীয় বংশের একজন অভিযানকারীর ইস্পাত কঠিন শাসনের অধীন হয়ে পড়ল এবং কিছু বিতাড়িত হয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ল। 

সেমিটিক উপনিবেশিকরা যখন মেসোপটেমিয়ার উপরিভাগে বসবাস শুরু করেছিল, তখন হেমিটিকদের কিছু ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ছোট ছোট দলের একটি একসময় আরব উপদ্বীপে পৌঁছে গেল এবং ঔপনিবেশিক হিসেবে তারা মধ্য আরবে প্রধানভাবে বসতিস্থাপন করল। এরাই আ‘দ সম্প্রদায় বা জাতি। 
একসময় এই আ‘দ জাতি সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করল।

সমাপ্ত।

ছবি: Wikipedia, forums.totalwar, jesus-is-savior, woek, mahmag, toolong, israel-a-history-of.

উৎস: The Spirit of Islam -Syed Ameer Ali.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...