বনি নাজির হযরত হারুণের সন্তান-সন্তুতির মধ্যে একটি গোত্র। মদিনা থেকে দু‘মাইল দূরে এদের সুরক্ষিত বসতি। তাদের পিতৃপুরুষরা তাওরাতে পন্ডিত ছিল। তাওরাতে শেষ নবীর পরিচিতি ও মদিনায় হিযরতের কথা উল্লেখ ছিল। এই পরিবার শেষ নবীর সাহচর্যে থাকার আশায় সিরিয়া থেকে মদিনায় আগমন করেছিল। কালক্রমে তাদের ধারণা হয়েছিল শেষ নবী তাদের গোত্র থেকেই আবির্ভূত হবেন। কিন্তু তা না হয়ে শেষ নবী প্রেরিত হলেন বনি ইস্রাইলের পরিবর্তে বনি ইসমাইল গোত্রে। এই প্রতিহিংসা তাদেরকে মুহম্মদের উপর বিশ্বাস স্থাপনে বাঁধা দিল। তারা যদিও মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল, তবুও তারা গোপনে মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুরু করে দিল। এছাড়া বদর যুদ্ধের প্রথম দিকে যখন মুসলমানদের বিপর্যয় দেখা দিল এবং কিছু সাহাবী নিহত হলেন, তখন তাদের মুহম্মদের নব্যুয়ত প্রাপ্তি সম্পর্কে যে বিশ্বাস ছিল তা টল টলায়মান হয়ে পড়ল।
কা’ব বিন আশরাফ এর বাসস্থান। |
কা’ব মক্কায় এসে আবু সুফিয়ানকে যখন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন, তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা হলে প্রতারক সম্প্রদায়। তাই তোমার প্রতিশ্রুতি সত্য হলে আমাদের এই দেবমূর্ত্তি দু‘টিকে (জ্বিবত ও তাগুত) সেজদা কর।’
কা‘ব তাই করলেন। এরপর তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে তারা মুহম্মদ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করবেন। এসময় আবু সুফিয়ান কথা প্রসঙ্গে কা’বকে বললেন, ‘তোমরা হলে শিক্ষিত সমাজ এবং তোমাদের কাছে আসমানী কিতাব রয়েছে। সুতরাং তুমিই বল, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরাই ন্যায়ের উপর রয়েছি- নাকি মুহম্মদ?’
কা’ব বললেন, ‘আপনাদের দ্বীন কি?’
আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আমরা হজ্জ্বের জন্যে নিজেদের উট জবেহ করি, লোকদেরকে দাওয়াত করে মেহমানদারী করি, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় রাখি, আল্লাহর গৃহ তাওয়াফ করি ও ওমরাহ আদায় করি। পক্ষান্তরে মুহম্মদ তার পৈত্রিক ধর্ম পরিহার করেছে, নিজের আত্মীয়-স্বজন থেকে পৃথক হয়ে গেছে এবং সর্বোপরি আমাদের সনাতন ধর্মের বিপরীতে নিজে এক নতুন ধর্ম উপস্থাপন করেছে।’
সবশুনে কা’ব বললেন, ‘আপনারাই ন্যায়ের উপর রয়েছেন।’
এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ-তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা কিতাবের কিছু অংশ পেয়েছে, যারা মান্য করে প্রতিমা ও শয়তানকে এবং অবিশ্বাসীদের বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সঠিক পথে রয়েছে। এরা হল সে সমস্ত লোক, যাদের উপর লা‘নত করেছেন আল্লাহ স্বয়ং। বস্তুতঃ আল্লাহ যার উপর লানত করেন তুমি তার কোন সাহায্যকারী পাবে না।(৪:৫২-৫৩)
কা‘ব মুহম্মদ ও তার শিষ্যদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক এবং বদর যুদ্ধে বিপর্যস্ত মক্কাবাসীদের জন্যে শোকগীতিমূলক কবিতার মাধ্যমে কুরাইশদের তীব্র প্রতিশোধের ইচ্ছে জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন যা ওহোদের প্রান্তরে বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়েছিল।
অভীষ্ট সিদ্ধির পর তিনি তার গোত্র বনি নাজিরদের মধ্যে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার অশ্লীল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক কবিতার সাহায্যে মুহম্মদ ও মুসলমানদের অনবরত আক্রমণ করতেন। তার এ ধরনের কাজ থেকে মুসলিম মহিলারাও পরিত্রাণ পেত না- তিনি তাদেরকেও অশ্লীল কদর্য ভাষায় চিত্রিত করতেন। তার কার্যাবলী, তিনি যে প্রজাতন্ত্রের একজন সদস্য ছিলেন তার বিরুদ্ধেই প্রকাশ্যে নিয়োজিত হয়েছিল।
সুতরাং কবি কাব ইবনে জুহায়ের মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা উদ্দীপিত করার জন্যে তিনি নিষেধাজ্ঞার অধীন ছিলেন। তার ভাই ছিলেন মুসলমান এবং তিনি তাকে পৌত্তলিকতা বর্জন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্যে প্রবলভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন। কাব তার ভাইয়ের উপদেশ গ্রহণ করে গোপনে মদিনায় গেলেন এবং মসজিদে নব্বী, যেখানে মুহম্মদ সকলকে উপদেশ দিতেন, সেখানে উপস্থিত হলেন।
কাব দেখলেন যে, এক ব্যক্তিকে ঘিরে বহু আরববাসী অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তার উপদেশ শুনছেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে চিনতে পারলেন এবং বেষ্টনী ভেদকরে এসে উচ্চেঃস্বরে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি যদি কাবকে মুসলমান হিসেবে আপনার সম্মুখে উপস্থিত করি, আপনি কি তাকে ক্ষমা করবেন?’
মুহম্মদ উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ!’
তিনি বললেন, ‘আমিই জুহায়ের পুত্র কাব।’
কিছুসংখ্যক মুসলমান তাকে হত্যা করতে চাইলেন। তারা মুহম্মদকে বললেন, ‘হে রসুলুল্লাহ! সে তো ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু। আপনি অনুমতি দিন এই মুহুর্তে তাকে হত্যা করে ফেলি।’
মুহম্মদ বললেন, ‘আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
ক্ষমা পাওয়ায় আনন্দ আর খুশীতে কাব হযরতের অনুমতি নিয়ে একটি কবিতা (কাসিদা) আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তির মাঝে যখন তিনি এই অংশে পৌঁছিলেন-
‘হযরত হলেন আলোর মশাল
উজ্জ্বলিছেন ধরাভূমি,
খোদার অসী, কেটে তিনি
চলেন সদা না-খোদার ঐ বধ্যভূমি।’ -তখন হযরত তাকে নিজের একটি উষ্ণীষ দান করলেন।
মুহম্মদের তিরোধানের পর এই উষ্ণীষটি এই পরিবার মুয়াবিয়ার কাছে ৪০,০০০ দিরহামে বিক্রয় করেছিল। অতঃপর এটি উমাইয়া ও আব্বাসীয়া খলিফাদের হাত ঘুরে অটোম্যান খলিফাদের অধিকারে চলে যায়।
সমাপ্ত।
ছবি: islamiclandmaks.
ছবি: islamiclandmaks.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন