১ মার্চ, ২০১২

Medina Charter: মদিনা ও তার পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহকে সন্ধিবদ্ধ করেছিল।


নবীজীর আগমনের পর মদিনায় তিনটি স্বতন্ত্রদলের অস্তিত্ব প্রকাশ লাভ করল। মোহাজির, আনসার ও ইহুদি। প্রথম দলটির নবীজীর> প্রতি আনুগত্য ছিল সীমাহীন। তারা আরব ঐতিহ্যের বিপরীত দিকের ধর্মের জন্যে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। আল্লাহর কাজে তারা সাহসিকতার সঙ্গে সর্বপ্রকার দুঃখ-দুর্দশার মোকাবিলা করেছিল, যাবতীয় প্রলোভনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাদের অনেকেই নিঃসম্বল অবস্থায় মদিনায় এসেছিল।

প্রাচীন মদিনা নগরী।
দ্বিতীয়, আনসাররা তাদের মোহাজির ভাইদেরকে আন্তরিকতার সঙ্গেই গ্রহণ করেছিল। তারা তাদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টন করে দিয়েছিল। নবীজী অত্যন্ত জ্ঞানবতার সঙ্গে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিল। যা ঈর্ষা বিদ্বেষের বিকাশকে বন্ধ করেছিল এবং তাদের মধ্যে উদার দানশীলতার প্রতিযোগীতার জন্ম দিয়েছিল, কে আল্লাহ ও তার রসূলের জন্যে সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করতে পারে।

আনসারদের একাংশ পৌত্তলিকতার জন্যে গোপন পূর্বানুরাগ বজায় রেখেছিল। এই দলের নেতা ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। তিনি প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং তার একটি শক্তিশালী সমর্থক দল ছিল। তিনি মদিনায় রাজত্বলাভের উচ্চাভিলাষ পোষণ করতেন। কিন্তু, নবীজীর আগমন তার পরিকল্পণাকে নস্যাৎ করেছিল। কেবলমাত্র লৌকিক উদ্দীপনা তাকে ও তার সমর্থকদের নামমাত্র ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল।

এই দল সামান্যতম সুযোগ পেলেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত ছিল। কাজেই নবীজীকে তাদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়েছিল। তিনি তাদের প্রতি সর্বোত্তম ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতেন এবং আশা পোষণ করতেন যে, শেষপর্যন্ত তারা ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হবে। অতঃপর এই আশা অবশ্য পরিণতি দ্বারা পরিপূর্ণভাবে সমর্থিত হয়েছিল।

৬২২ সিই, মদিনার আশেপাশের গোত্রসমূহ।
তৃতীয় দল ইহুদিরা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক বিপদের কারণ। কুরাইশদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এবং তাদের দল উপদলসমূহ বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত হয়েছিল ও তারা ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল। তারা তাদের পুরাতন শত্রু আওস ও খাজরাজ গোত্র তাদের পৃষ্ঠপোষক তাদের প্রতিশোধ গ্রহণকারী হতে পারে; আরবদের জয় করতে ও ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় তাদের সাহায্য করতে পারে এই উদ্দেশ্য নিয়ে নবীজীর অভ্যর্থনায় উদাসীনতার সঙ্গে মদিনাবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছিল এবং কিছুকালের জন্যে শান্ত মনোভাব গ্রহণ করেছিল।

মদিনায় আগমনের পর মুহম্মদ মদিনা ও তার পার্শ¦বর্তী এলাকা যে বিভিন্ন জাতি ও বিরোধী উপাদান নিয়ে গঠিত তাকে একটি সুশৃঙ্খল সন্ধিবদ্ধ জাতিতে ঐক্যবদ্ধ করাকে অন্যতম প্রথম কর্তব্য বলে মনে করলেন। এই লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি মদিনার বিভিন্ন জাতির লোকদের মধ্যে সনদ প্রদান করলেন। যার মাধ্যমে মুসলমানদের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ, মুসলমান ও ইহুদিদের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হল। ইহুদিরা সাময়িকভাবে সনদের দুর্দমনীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যে নিরূৎসাহিত হলেও আনন্দের সঙ্গে চুক্তি গ্রহণ করেছিল। বিবেকের স্বাধীনতা সম্বলিত এই মদিনা সনদের (Medina Charter) বর্ণনা ছিল এরূপ-
পরম করুণাময়, দাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে- 
আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ মুহম্মদ কর্তৃক এই সনদ প্রদান করা হচ্ছে যে-

ক) মদিনায় বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মাবলস্বী, বিভিন্ন গোত্রের বিক্ষিপ্ত জনমন্ডলী এক উম্মত বা জাতি বলে বিবেচিত হবে।

খ) সনদের অন্তর্ভূক্ত কোন সম্প্রদায় শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করা হবে।
গ) সনদের অন্তর্ভূক্ত সম্প্রদায়ের কেউ কুরাইশদের সাথে গোপনে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হবে না, কেউ তাদের কোন লোককে আশ্রয় দেবে না, তাদের কোন পরিকল্পনায় সহায়তা করবে না।

ঘ) বহিঃশত্রু কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হলে স্বাধীনতা রক্ষায় সকলে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেদের যুদ্ধব্যয় বহন করবে।
ঙ) সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না।

চ) কোন অমুসলমানের অপরাধ তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ব্যক্তির অপরাধের জন্যে তার জাতি বা সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব করা যাবে না।

ছ) মুসলমানরা সাধারণতন্ত্রের অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি সর্বদা সদাচারণ, স্নেহপূর্ণ আচরণ করবে, তাদের মঙ্গলের চেষ্টা করবে। কোন প্রকারে তাদের অনিষ্টের সংকল্প পোষণ করবে না।
জ) উৎপীড়িতকে রক্ষা করা হবে। যদি ঘনিষ্ট আত্মীয় নিন্দনীয় হয় তাহলেও তাকে কেউ সমর্থন করবে না।

ঝ) প্রত্যেক সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বত্ত্বাধিকারের মর্যাদা রক্ষা করবে।
ঞ) নরহত্যা বা রক্তপাত মদিনাতে হারাম বলে গণ্য হবে।
ট)  রক্তপণ পূর্ববৎ বহাল থাকবে।

ঠ) হযরত মুহম্মদ নবপ্রতিষ্ঠিত সাধারণতন্ত্রের প্রধান বলে বিবেচিত হবেন। সাধারণভাবে যেসব বিবাদ-বিসম্বাদের সমাধান সম্ভব নয়, তা তার উপর ন্যস্ত হবে। আল্লাহর বিধানমতে তিনি সেসবের সমাধান করবেন।

-আল্লাহর নামে এ এক চিরস্থায়ী প্রতিজ্ঞা, যে বা যারা এ ভঙ্গ করবে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ।

আরবদের যে নৈরাজ্যমূলক প্রথার ক্ষেত্রে ব্যথিত ও ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের নিজেদের বা তাদের জ্ঞাতিদের শক্তির উপর নির্ভর করতে হত প্রতিশোধ গ্রহণ বা বিচারের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে সেই প্রথার প্রতি এভাবে মরণাঘাত হানা হল। এই সনদ মুহম্মদকে জাতির প্রধান প্রশাসকে পরিণত করল, এ যেমন তার প্রেরিত পুরুষ সূলভ ভূমিকার দ্বারা তেমনি তিনি ও তার জনগণের মধ্যেকার চুক্তির দ্বারা সাধিত হয়েছিল।

মদিনার উপকন্ঠে বসতি স্থাপনকারী বনি নাজির, বনি কুরাইজা ও বনি কাইনুকা প্রমুখ ইহুদি বংশ সমূহকে প্রথমে এই সনদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, কিন্তু অল্পকাল পরেই তারাও সকৃজ্ঞ চিত্তে এ সনদের শর্তাদি গ্রহণ করেছিল। 

সমাপ্ত।
ছবি: in.groups.yahoo. Muhamad and the people of the book.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...