প্রাচীনকাল থেকেই ইহুদিরা (Jews) কখনও স্বজনপ্রীতির বশবর্তী হয়ে এবং কখনও নাম-যশ ও অর্থের লোভে ফতোয়াপ্রার্থীদের মনমত ফতোয়া তৈরী করে দিত। বিশেষতঃ অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে এটিই ছিল তাদের সাধারণ প্রচলিত পদ্ধতি। কোন ধনী ব্যক্তি অপরাধ করলে তারা তাওরাতের গুরুতর শাস্তিকে লঘু শাস্তিতে পরিবর্তন করে দিত।
মুহম্মদের মদিনায় আগমনের পর সঠিক ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা ইহুদিদের সামনে এল। এসময় তারা একে একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যাবহার করতে চাইল। মুহম্মদের শরীয়তে একদিকে যেমন নমনীয়তা ছিল, অন্যদিকে অপরাধ দমনের জন্যে যুক্তিযুক্ত বিধি-ব্যবস্থাও ছিল। যেসব ইহুদি তাওরাতের কঠিন শাস্তিসমূহকে পরিবর্তন করে সহজ করে নিত, তারা এ জাতীয় মোকদ্দমায় মুহম্মদকে বিচারক নিযুক্ত করতে প্রয়াস পেত- যাতে একদিকে নরম বিধি-বিধান দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং অন্যদিকে তাওরাত পরিবর্তন করার অপরাধ থেকেও অব্যহতি পাওয়া যায়। কিন্তু এই ব্যাপারেও তারা একটি দুঃস্কৃতির আশ্রয় নিত। তা এই যে, নিয়মিত বিচারক নিযুক্ত করার পূর্বে কোন না কোন পন্থায় তারা মোকদ্দমার রায় ফতোয়া হিসেবে জেনে নিতে চাইত তাদের গোত্রের সেইসব লোকদের মাধ্যমে যারা নিজেদেরকে মুসলমানদের কাছে মুসলমান হিসেবে জাহির করত। উদ্দেশ্য, এই রায় তাদের আকাঙ্খিত রায়ের অনুরূপ হলে বিচারক নিযুক্ত করবে, অন্যথায় নয়।
আবার মুহম্মদ বা মুসলমানদের কেউ যদি তাদের কাছে এ বিষয়ে তাওরাতের বিধান জানতে চাইতেন, তবে ঐসব ইহুদি যাদের অন্তর মুসলমান না, কিন্তু নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে জাহির করত মুসলমানদের কাছে শুধুমাত্র গুপ্তচরবৃত্তির মানসে, তারা মুহম্মদকে বিভ্রান্ত করতে মিথ্যে বলত। আর যদি তাদের কেউ সত্য প্রকাশ করতই, তাহলে অন্যরা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলত-‘আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা প্রকাশ করেছেন তা বলে দিচ্ছ? এতে তো শেষ বিচারের দিনে তিনি ও মুসলমানরা তোমাদের বিপক্ষে স্বাক্ষী হবেন এবং পালনকর্তার সামনে তোমাদেরকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করবেন। তোমরা কি তা উপলব্ধি কর না?’
এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হয়েছিল- হে রসূল, তাদের জন্যে দুঃখ কোরও না, যারা দৌঁড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয়; যারা মুখে বলেঃ আমরা মুসলমান, অথচ তাদের অন্তর মুসলমান না এবং যারা ইহুদি, মিথ্যে বলার জন্যে যারা গুপ্তচরবৃত্তি করে। তারা অন্যদলের গুপ্তচর যারা তোমাদের কাছে আসেনি। তারা বাক্যকে স্বস্থান থেকে পরিবর্তন করে। তারা বলে, যদি তোমরা এই নির্দেশ পাও, তবে তা গ্রহণ করে নিও এবং যদি এই নির্দেশ না পাও, তবে বিরত থেক।
আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তার জন্যে আল্লাহর কাছে তুমি কিছুই করতে পারবে না। এরা এমনিই যে আল্লাহ এদের অন্তরকে পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্যে রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও পরকালে বিরাট শাস্তি।(৫:৪১)
যখন তারা মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা মুসলমান হয়েছি। আর যখন পরস্পরের সাথে নিভৃতে অবস্থান করে, তখন বলে, পালনকর্তা তোমাদের জন্যে যা প্রকাশ করেছেন, তা কি তাদের কাছে বলে দিচ্ছ? তাহলে যে তারা এ নিয়ে পালনকর্তার সামনে তোমাদেরকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করবে। তোমরা কি তা উপলব্ধি কর না?(২:৭৬)
ইহুদিদের যারা নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে জাহির এবং মুহম্মদের কাছে আসা যাওয়া করত, তারা ছিল বনি কুরাইজা, বনি নাজির ও বনি কাইনুকার কতিপয় লোক। মুহম্মদ মনে করেছিলেন এসব গোত্রের কিছু লোক মুসলমান হলে অপরাপরদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান সহজ হবে। সুতরাং তিনি তাদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যাবহার করতে থাকলেন এবং তাদের ছোট বড় সকলকে সম্মান করতে লাগলেন। এমনকি তাদের দ্বারা কোন অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ সংঘটিত হলেও ধর্মীয় কল্যাণের কথা চিন্তা করে সেগুলির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না।
অন্যদিকে ঐসব লোকেরা প্রকৃতপক্ষে কপট ও বর্ণচোরা ছিল, অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে প্রচার করলেও তাদের অন্তরে ঈমান ছিল না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুহম্মদকে সতর্ক করে এই আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছিল- হে নবী! আল্লাহকে ভয় কর এবং অবিশ্বাসী ও কপট বিশ্বাসীদের কথা মানবে না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়, তুমি তার অনুসরণ কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন। তুমি আল্লাহর উপর ভরষা কর। কার্যনির্বাহীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট।(৩৩:১-৩)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন