খাদিজা (Khadija) নামে মুহম্মদের এক দূর সম্পর্কের চাচাত বোন ছিলেন। সেই আমলে যখন নারী জাতির দুর্গতির ও লাঞ্ছনার যেখানে সীমা ছিল না তখন এই সতী-সাধ্বী নারী শূচিতায় ও শুভ্রতায় ছিলেন অনন্যা। এ কারণে অনেকে তাকে তাহেরা নামেও সম্বোধন করত। তার দু‘বার বিবাহ হয়েছিল, কয়েকটি সন্তানও ছিল। দ্বিতীয় স্বামী আতিক মৃত্যুকালে অগাধ ধন-সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তিনি তার স্বামীর বিস্তৃত বাণিজ্যের হাল ধরেন। কর্মচারীর মাধ্যমে তিনি নানা দেশে বাণিজ্য পরিচালনা করতেন এবং নিজেই সমস্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেন।
মুহম্মদ ২০ বৎসর বয়সে পদার্পণ করলেন। অতঃপর এই বৎসর বাণিজ্য অভিযানের সময় নিকটবর্তী হল। বিবি খাদিজার একজন প্রতিনিধি তার কাছে এসে বলল, ‘হে মুহম্মদ! বিবি খাদিজা আপনার সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।’
মুহম্মদ খাদিজার বাটীতে উপস্থিত হলেন। খাদিজা সাদর অভ্যর্থণা শেষে তাকে বললেন, ‘হে পিতৃব্য পুত্র! আপনার সত্যনিষ্ঠা, আপনার বিশ্বস্ততা ও মহানুভবতা এবং আপনার চরিত্র-মহিমা বিশেষরূপে অন্য সকলের মত আমিও অবগত আছি। আপনি যদি সিরিয়াগামী আমার বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে আমি যারপর নাই বাধিত হব। অবশ্য এজন্যে আমি আপনাকে অন্যাপেক্ষা দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিতে প্রস্তুত রয়েছি।’
মুহম্মদ তখনই এই প্রস্তাবের কোন উত্তর দিলেন না। তিনি যথোচিত অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন শেষে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের পর পিতৃব্য আবু তালিবকে সবকিছু জানিয়ে তার মতামত জানতে চাইলেন। একে আবু তালিবের পোষ্য পরিবার অনেক, তার উপর সেবারকার দূর্ভিক্ষ, তিনি বিবি খাদিজার বাণিজ্য অভিযানের কর্তৃত্বভার পাওয়াকে বৈষয়িক হিসেবে কম সৌভাগ্যের বিষয় নয় বলে ভাবলেন। সুতরাং তিনি আনন্দের সাথে সম্মতি দিলেন। অতঃপর সফরের প্রস্তুতি নেয়া হল। এই সফরে আবু বকর মুহম্মদের সঙ্গী হলেন।
কাফেলা রওনা হয়ে গেল।
মুহম্মদ বিজ্ঞতার সঙ্গে তার বাণিজ্যকর্ম সম্পাদন করেছিলেন। আর খাদিজাও তার কর্তব্য কর্মে খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং এই প্রতিক্রিয়া ক্রমশঃ অনুরাগে রূপান্তরিত হল। তার আগ্রহে এবং মুহম্মদের সম্মতিতে উভয়পক্ষের অভিভাবকদের মধ্যে বিবাহের প্রস্তাব ও আলোচনা হল। মুহম্মদের পক্ষে তার চাচা আবু তালিব এবং খাদিজার পক্ষে তার চাচা আমর বিন আসাদ অভিভাবকত্ব করলেন। মাত্র সাড়ে বার উকিয়া পণ নির্ধারণে এই শুভশাদীর আয়োজন সুসম্পন্ন হল।
যথাসময়ে কুরাইশ প্রধানরা ও উভয়পক্ষের আত্মীয়বর্গ বিবি খাদিজার গৃহে উপনীত হলেন। পিতৃব্য আবু তালিব ও আমীর হামজা মুহম্মদকে নিয়ে বিবাহ সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। আগতদের যথাযোগ্য অভ্যর্থনা শেষ হলে, আবু তালিব উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সম্বোধন করে বললেন, ‘সেই আল্লাহকে ধন্যবাদ- যিনি আমাদিগকে ইব্রাহিমের বংশে ও ইসমাইলের গোত্রে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদেরকে তাঁর গৃহের অলি, রক্ষক ও সেবকরূপে নির্বাচিত করেছেন ...এবং যিনি আমাদিগকে জনসাধারণের নেতা ও নায়করূপে মনোনীত করেছেন।
--অতঃপর আমার এ ভ্রাতুষ্পুত্র মুহম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহকে আপনারা বিশেষভাবে অবগত আছেন। জ্ঞানে গরিমায় এবং মহত্ত্বে ও মহিমায় তার সাথে অন্য কারও তুলনা হতে পারে না-যদিও তার ধন-সম্পদ অল্প। আর ধন-সম্পদ তো নশ্বর ও নগণ্য।
--সার্ধ দ্বাদশ উকিয়া মোহর বা কন্যাপণ দানে মুহম্মদ আপনাদিগের মহিমাময়ী কন্যা বিবি খাদিজার পাণি গ্রহণের প্রস্তাব করেছে, এখন কন্যাকর্তৃবর্গ-সম্প্রদানের কার্য সমাধা করুন।’
এসময় ওয়ারাকা বিন নওফেল উত্তরে বললেন, ‘আপনি আমাদিগের উপর আল্লাহর যে অনুগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য। পক্ষান্তরে আপনাদের কূলশীলের মর্যাদা এবং সমগ্র আরব দেশের উপর আপনাদের প্রভাব প্রতিপত্তির বিষয়ও সর্বজনবিদিত। আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করার জন্যে আমরা সকলেই আগ্রহান্বিত। অতএব হে কুরাইশগণ! সাক্ষী থাকুন, আমি বর্ণিত মোহরে মুহম্মদের সাথে খাদিজার বিবাহে সম্মতি প্রদান করছি।’
বিবি খাদিজার পিতা খোওয়াইলিদ ফিজার যুদ্ধের পূর্বেই মারা গিয়েছিলেন। এ কারণে এই বিবাহে তার চাচা আমর বিন আসাদ যথানিয়মে কন্যা সম্প্রদান করলেন। আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দিয়ে বিবাহ সুসম্পন্ন হল।
বিবাহের সময় মুহম্মদের বয়স ছিল পঁচিশ ও তার স্ত্রীর চল্লিশ। দু‘জনের মধ্যে বয়সের তারতম্য থাকা সত্ত্বেও একে অন্যের প্রতি তাদের ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। এই বিবাহ মুহম্মদের জন্যে বয়ে এনেছিল শান্তি ও প্রত্যাহিক পরিশ্রম থেকে মুক্তি, যা তার মনকে প্রস্তুত করার জন্যে অপরিহার্য ছিল। এ ছাড়াও তিনি লাভ করেছিলেন এক অনুরক্তা স্ত্রীর হৃদয়, যিনি সর্বপ্রথম তার নব্যুয়তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন।
খাদিজা মুসলিম নারী জগতের স্মরণীয় চরিত্র ও আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তার গর্ভে মুহম্মদের তিন পুত্র-কাসেম, তাহের ও তৈয়ব এবং চার-কন্যা জয়নব, রোকাইয়া, কুলসুম ও ফাতিমা জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সব পুত্রসন্তান শৈশবেই মারা যান, যদিও কন্যারা দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন।
সমাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন