খ্রীষ্ট ধর্মের উত্থান খুব সহজ ছিল না। ৩য় খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূলত: অশিক্ষিত, গরীব ও সমাজে অবহেলিত নীচু শ্রেণীর মানুষই এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অত:পর এ ধারায় পরিবর্তন আসে। শিক্ষিত ও ধনীক শ্রেণীর মধ্যে ক্রমান্বয়ে এই ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল তৎকালীন আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট। যুদ্ধ, অত্যাচার-অনাচার ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে আত্মরক্ষায় করতে মানুষ এই ধর্মের মধ্যে আশ্রয় খোঁজে।
ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের জীবন ধর্মের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। তারা আজীবন কৌমার্যব্রত পালন করতেন। প্রথমদিকে এরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিশু-কিশোর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ধর্মোপদেশ দিতেন। আর ধর্মানুসারীদের বিবাহ, আন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, প্রত্যাহিক অনুষ্ঠানসহ যাবতীয় ধর্মীয় ও সামাজিক নানা কাজে অংশগ্রহণ করতেন। অত:পর এই ধর্ম প্রতিষ্ঠানিক রূপ নিল।
পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট। |
যারা বিশপ নির্বাচিত হলেন, খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক গভর্নরের কাছে তাদের ভূমিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পাঁচজন থেকে একজন সর্বোচ্চ চার্চের প্রধান মনোনীত হলেন। এই প্রধানই 'পোপ'-খ্রীষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু। ধর্মের কোন ব্যাখ্যা বা নুতন কোন ধর্মীয় বিধান জারি করার একমাত্র অধিকারী তিনিই। তার কার্য সংস্থা 'প্যাপাসি' (Papacy) বলে অভিহিত।
সামন্তবাদ প্রথা। |
পঞ্চম শতাব্দীতে সামন্তবাদের (ফিউডালিজম- লাতিন শব্দ ফিউডাম অর্থ ভূ-সম্পত্তি।) উত্থান ঘটে। এই সামন্তবাদ একটি আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা বা প্রথা। এই প্রথার সূচণা ঘটে সর্বপ্রথম ইউরোপে।
সামন্তপ্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্র বা রাজাই সকল সম্পত্তির মালিক। রাজা কতিপয় শর্তের বিনিময়ে তার অধীনস্ত একটি গোষ্ঠির মাধ্যমে জমি চাষাবাদের জন্যে বিতরণ করতেন। রাজার অনুগত ঐ গোষ্ঠিই সামন্ত প্রভূ। সামন্ত ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন লর্ড বা প্রভূ। রাজার ভ্যাসাল বা তার অধীনস্ত ছিলেন টেনান্ট ইন চিফ, টেন্যান্ট ইন চিফের অধীনস্ত ভ্যাসাল ছিলেন কাউন্ট, ডিউক, আর্ল বা মারগ্রেভ।
সামন্তবাদ প্রথা। |
সামন্ত ব্যবস্থায় বিপুল পরিমান অনাবাদী জমি চাষাবাদের আওতায় আসে। ফলে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব আনে। অতিরিক্ত করের বোঝার কথা মাথায় রেখে কৃষককূল নিজেদের জীবন ধারণ ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এসব জমিতে নানা ধরণের ফসল উৎপাদন করত। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদন ঘটে যা ক্রমশ: বাজার সৃষ্টি করে।
নাইটদের উপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা ক্রমেই তাদেরকে নাইটদের ইচ্ছের পুতুলে পরিণত করে ফেলে। নাইট বা জমিদারদের গৃহস্থলীসহ সকল কাজই কৃষককে বা তাদের পরিবারের সদস্যদের করতে বাধ্য করা হত। জমিদারগণ এদেরকে নিজেদের ইচ্ছেমত ভোগ ও ব্যাবহার করতেন। ফলে ছোটখাট বিদ্রোহ শুরু হল। আর তাই এই পর্বে সামন্ত প্রভুগণ ঐসব বিদ্রোহ দমনে ধর্মীয় অনুভূতি ও মতাদর্শকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাবহারের পরিকল্পণা করলেন। সুতরাং রাজা তার অনুগত ও বিশ্বাসভাজন যাজকদের মধ্যে থেকে পোপ ও অন্যান্য পদে নিয়োগ দিতে লাগলেন। আর এভাবেই শাসক শ্রেণী ধর্ম যাজকদেরকে সামন্তবাদের স্বার্থে ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরী করলেন।
সিটি স্টেট, ভ্যাটিকান। |
এভাবে রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন সুদৃঢ় হল। এই ধারাবাহিকতায় ৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে পিস্পিন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে চার্চ এতদিন যে সকল জমি বেনিফিকাম (Benificum) হিসেবে ভোগ করত সেগুলিকে চার্চের সম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলেন। অত:পর রোমকে আলাদা প্রদেশ করার পর ৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে পোপের জন্যে একটি আলাদা রাজ্য তথা প্যাপাল স্টেট (Papal State) ঘোষণা করা হল। সেইসময় থেকে সেইন্ট পিটারের আমলের নেভিকোলা (Navicula) স্বাধীনভাবে বিরাজ করতে থাকে। এখন ভ্যাটিকান (Vatican) একটি সিটি স্টেট (City State) হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে তার অবস্থান করে নিয়েছে।
সম্রাট ৪র্থ হেনরী পোপের সামনে হাঁটু গেঁড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। |
দশম শতাব্দীতে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা ফ্রান্সের বুরগুন্ডির ক্লুনি মঠে এক সম্মেলন আহবান করে। এই সম্মেলনে কৌমার্যব্রত, কেরানী কোটা রহিতকরণ এবং রাজার অধীনতা থেকে চার্চের মুক্তি দাবী করে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত এই কর্মসূচিই ‘ক্লুনিয়াক কর্মসূচি’ হিসেবে পরিচিত। অত:পর চার্চগুলোর নৈতিক সম্মান উর্দ্ধে তুলে ধরার উপর গুরুত্ব আরোপ করে একটি আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। যাজকগণ এবং স্বয়ং পোপ এইসব দাবীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দান করেন।
Worms-এর এই চার্চে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। |
Concordat of Worms- Emperor Henry V with Pope Calistus II |
Pope Calistus II. |
অবশেষে সম্রাট ও প্যাপাসির মধ্যেকার এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে ১১২২ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ শে সেপ্টেম্বর Worm's- এ এক চুক্তি (Concordat of Worms) স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তৎকালীন রোম সম্রাট হেনরী ৫ম (Henry V) ও পোপ ক্যালিস্টাস ২য় (Calistus II)-এর মধ্যে।
সমাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন