২৩ মার্চ, ২০১২

Abraham: ইব্রাহিমের আনুগত্য পরীক্ষা।


একরাতে ইব্রাহিম (Abraham) স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন আল্লাহ তাকে আদেশ করছেন- ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার সব চেয়ে প্রিয় বস্তুকে আমার নামে কোরবাণী কর।’ 

এই স্বপ্ন দেখে তিনি পরদিন তার পাল থেকে অনেকগুলো উট কোরবানী করে দিলেন। রাতে তিনি আবারও ঐ একই স্বপ্ন দেখলেন। তখন তিনি অনেক ভেবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘হে আল্লাহ, পুত্র ইসমাইল ছাড়া আমার তো আর কিছু এত অধিক প্রিয় নেই।’ 
৩য়দিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, পুত্র ইসমাইলকেই তিনি কোরবানী করছেন। পয়গম্বরদের স্বপ্ন ওহীও বটে। সুতরাং ইব্রাহিম বুঝে নিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে পুত্রকেই কোরবানী করার হুকুম হয়েছে। 

অবশ্য আল্লাহ ইচ্ছে করলে এ হুকুমটি ফেরেস্তার মাধ্যমেও নাযিল করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, কেননা তাঁর ইচ্ছে ছিল ইব্রাহিমের আনুগত্যের পূর্ণ পরীক্ষা নেয়া।

স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত আদেশকে মানব মনের পক্ষে ভিন্ন অর্থ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কিন্তু ইব্রাহিম তা পরিহার করে আল্লাহর আদেশের সম্মুখে মাথা নত করে দিলেন। তিনি তার প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তিনি তো জানতেনই আল্লাহ সর্বক্ষমতার অধিকারী। তিনি ইচ্ছে করলেই মৃতকেও জীবিত করতে পারেন। 

ইব্রাহিম, হাজেরা ও ইসমাইল।
হিব্রোণ থেকে ইব্রাহিম মক্কাতে হাজেরার গৃহে গেলেন এবং স্ত্রীকে জানালেন, পুত্র ইসমাইলকে তিনি সফরে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। পিতার সঙ্গে কাজ করার মত বয়স হয়েছিল এসময় ইসমাইলের। সে অতি আনন্দের সাথে তার পিতার সঙ্গে যাবার জন্যে প্রস্তুত হল।

পিতা-পুত্র গৃহ থেকে বেরিয়ে যেতেই ইবলিস এক বৃদ্ধের বেশে হাজেরার গৃহদ্বারে উপস্থিত হল। অতঃপর দ্বারে করাঘাত করে সে অপেক্ষা করতে লাগল। 
হাজেরা দ্বার খুলল। 

বৃদ্ধ-‘মা, তোমার ছেলেটি কোথায়।’
হাজেরা - ‘সে তার পিতার সফর সঙ্গী হয়েছে।’
বৃদ্ধ-‘তোমার স্বামী তোমাকে মিথ্যে বলেছে। সফরে নয়, সে তো তাকে জবাই করতে নিয়ে যাচ্ছে। কি নিষ্ঠুরতা! মা, সন্তানকে জীবিত দেখতে চাইলে এখনও সময় আছে- তাদেরকে ফেরাও।’
হাজেরা -‘আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনে।’
বৃদ্ধ-‘আফসোস নি:ষ্পাপ ছেলেটির জন্যে আরও আফসোস নির্বোধ এই নারীর জন্যে। আমি সত্য বলছি কি-না তা জানতে শীঘ্রই তোমার স্বামীকে ডেকে এনে তাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস কর।’

একথা শুনে হাজেরা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কঠোরস্বরে বলল, ‘নিশ্চয় তুমি অভিশপ্ত শয়তান। সুতরাং তোমার কথা সত্য হলেও আমি তা শুনব না।’ 
নীচু হয়ে সে একটা মাটির ঢিলা হাতে তুলে নিল। ‘দূর হও, শয়তান।’- রুদ্ররোষে সে ঢিলটা ছুঁড়ে মারল ইবলিসকে লক্ষ্য করে।
ইবলিস পালিয়ে গেল।

যাত্রার প্রস্ততি। 
গাধা! কুলীন পশুকূলের মধ্যে তার অবস্থান পৃথিবীর কোথাও নেই, অন্ত্যজ শ্রেণীতেই তার অবস্থান সর্বত্র। কেননা, বেওকুফ এ পশুর পিঠে যতই বোঝা চাপিয়ে দাও মুখে রা নেই। আমাদের দেশে ধোপার বাহন ছাড়া ভিন্নমুখী কোন ব্যবহার তার আছে বলে কেউ বোধহয় শোনেনি। কিন্তু তাতে কি, অতীতে অনেক জ্ঞানী-গুনী, নবী-রাসূলগণ তাকে বাহন হিসেবে ব্যাবহার করেছেন। যেমন-ইব্রাহিম, আমাদের আদি পিতা তার প্রিয় পুত্রকে কোরবানী করতে নিয়ে যেতে গাধাকেই বাহন হিসেবে ব্যাবহার করেছিলেন।  

সুসজ্জিত দু‘টি গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে পিতা পুত্র পথ চলেছেন। কিছুদূর অগ্রসর হবার পর পুত্র তার পিতাকে বলল, ‘হে পিতা! আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
পিতা উত্তর দিলেন, ‘আমরা একটা কোরবাণী করতে যাচ্ছি।’
পুত্র- ‘আমাদের সঙ্গে তো কোন পশু নেই। আমরা কি কোরবাণী করতে যাচ্ছি?’ 
পিতা-‘উৎসর্গের জিনিষ আল্লাহই জুগিয়ে দেবেন।’

মাথার উপর সূর্য্য, তার উপর মরুর তীব্র দাবাদাহ, একসময় পিতাপুত্র বিশ্রামের জন্যে একস্থানে থামলেন। ক্লান্তিতে ইব্রাহিমের তন্দ্রার মত এল। ইসমাইল বসে রইল দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ধূ-ধূ বালু চারিদিকে! কে যেন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। 

হজ্জ্বের সময় শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপ।
গাধায় সওয়ার হয়ে এক বৃদ্ধ সেখানে এসে থামল। অতঃপর ইসমাইলকে বলল, ‘ওহে বৎস! তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
ইসমাইল- ‘আমরা একটা কোরবানী করতে যাচ্ছি।’
বৃদ্ধ- ‘নির্বোধ বালক! তোমার পিতা তোমাকেই জবেহ করতে নিয়ে চলেছে। দেখছ না তোমাদের সাথে কোন পশু নেই?’
ইসমাইল- ‘তুমি এসব কিভাবে জানতে পারলে? নিশ্চয় তুমি শয়তান।’
ইসমাইল এক টুকরো পাথর তার দিকে ছুঁড়ে মারল। বৃদ্ধরূপী ইবলিস তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হল। এ কারণে হজ্জ্বের সময় প্রতিদিন সাতবার করে শয়তানের প্রতিকৃতিকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করা হজ্জ্বের একটা বিধি।

এদিকে তন্দ্রার মধ্যে ইব্রাহিম শুনতে পেলেন, ‘হে ইব্রাহিম তোমার সন্তান তোমার দূরভিসন্ধি জানতে পেরেছে এবং এখন সে তোমাকে প্রতারক হিসেবে ঘৃণা করতে শুরু করেছে।’
তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন এবং দেখলেন তার পুত্র এক পাশে বসে তারই পানে চেয়ে আছে। তার মুখ নির্ভয়, নিরুদিগ্ন, নিসংশয়। তিনি বুঝতে পারলেন অভিশপ্ত শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছে। 

তারা পুনঃরায় যাত্রার প্রস্ততি নিতে লাগলেন। এসময় ইসমাইল বলল, ‘হে পিতা! তুমি আমাকেই কোরবানী করতে নিয়ে চলেছ-না?’
অবাক হয়ে পুত্রের মুখপানে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, একথা সত্য।’ 
তিনি সকল কথা পুত্রকে খুলে বললেন। অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন তুমি কি বল?’
পিতৃভক্ত ইসমাইল বলল, ‘তুমি যা স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছ তা পালন কর। আল্লাহ ইচ্ছে করলে, দেখবে আমি ধৈর্য্য ধরতে পারি।’
তারা দু’জনই আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন।

পিতাপুত্র পুনঃরায় রওনা হলেন। তারপর এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছে সেখানেই থামলেন। ইসমাইল বুঝতে পারল এটাই নির্দেশিত স্থান-মিনা পাহাড়।
ইসমাইল আনন্দের সঙ্গে পিতাকে প্রস্তুতি নিতে বলল। এরপর নিজে প্রস্তুত হয়ে পিতাকে অনুরোধ করে বলল, ‘এবার আমার হাত, পা বেঁধে দাও।’

বাঁধা শেষ হল। তখন ইব্রাহিম পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন। তারপর তার কন্ঠদেশে তরবারী চালালেন। কিন্তু তরবারীর তীক্ষ্ণধার তার গলায় আঁচড় কাটল না। ইব্রাহিম আশ্চর্য হলেন। তিনি তরবারীর তীক্ষ্ণতা সম্পর্কে সন্ধিহান হয়ে পড়লেন। 
ইসমাইল বলল, ‘হে পিতা, তোমার স্নেহদৃষ্টিই হয়তঃ বাঁধা সৃষ্টি করছে। সুতরাং তুমি তোমার চোখ বেঁধে নাও।’

পুত্রের কথামত ইব্রাহিম তার চোখ বেঁধে নিলেন। তারপর তরবারী চালালেন এবং সফল হলেন। নিশ্চয়ই এ ছিল ইব্রাহিমের জন্যে এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আর তাই আল্লাহ ইসমাইলকে সরিয়ে নিয়ে কোরবাণী করার জন্যে দিলেন এক মহান জন্তু-দুম্বা। 

ইসমাইলকে উৎসর্গের জন্যে শোয়ানো হয়েছে।
এদিকে কোরবানী করার পর ইব্রাহিম কম্পিত হস্তে দ্রুত চোখের বাঁধন সরিয়ে ফেললেন। অত:পর তিনি যা দেখলেন তা তার কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি দেখলেন যে, তার তরবারীতে একটি দুম্বা কোরবাণী হয়েছে এবং হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার পুত্র পাশে শায়িত। 

আল্লাহ তার প্রিয় পুত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছেন দেখে ইব্রাহিম আবেগে আপ্লুত হলেন এবং আল্লাহকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানালেন। তখন আল্লাহ বললেন, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নের আদেশ সত্যিই পালন করলে।’ 

বিশ্বাসের এই পরীক্ষায় ইব্রাহিম উর্ত্তীর্ণ হওয়ায় আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করেন। আজ তিনি ইহুদি, খ্রীষ্টান ও মুসলিমদের আদি পিতা; সকলেই তাকে শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে। তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবে আল্লাহ সৎ-কর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকেন। বস্তুত: ইব্রাহিম ছিলেন আল্লাহর এক বিশ্বাসী দাস। আল্লাহ তাকে ইসহাকের সুখবর দিয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন একজন নবী, সৎকর্মপরায়ণদের একজন।

এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- ইব্রাহিম বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্ম পরায়ণ পুত্র দাও।’ 
আমি তাকে এক ধীর স্থির পুত্রের খবর দিলাম। তারপর যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মত বয়স হল তখন ইব্রাহিম তাকে বলল, ‘বাছা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি কোরবাণী করছি, এখন তোমার কি বলার আছে?’
সে বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছে করলে, আপনি দেখবেন আমি ধৈর্য্য ধরতে পারি।’
তারা দু’জনে যখন আনুগত্য প্রকাশ করল ও ইব্রাহিম তার পুত্রকে (কোরবাণী করার জন্যে) কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নের আদেশ সত্যিই পালন করলে।’ 

নিশ্চয়ই এ ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি (তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে) কোরবাণী করার জন্যে দিলাম এক মহান জন্তু এবং তাকে রেখে দিলাম পরবর্তীদের মাঝে (স্মরণীয় করে), ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবে আমি সৎ-কর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিল আমার এক বিশ্বাসী দাস। আমি তাকে ইসহাকের সুখবর দিয়েছিলাম, সে ছিল এক নবী, সৎকর্মপরায়ণদের একজন।(৩৭:৯৯-১১২)

সমাপ্ত।
ছবি: Wikipedia, bibleartists.wordpress.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...