মুহম্মদ যখন পৌত্তলিক কুরাইশ ও তাদের মিত্র বনি বকরদের বিরুদ্ধে খুবই গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেইসময় সারা নাম্নী এক গায়িকা মদিনায় আগমন করল। তাকে মুহম্মদের কাছে হাযির করা হলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি হিযরত করে মদিনায় এসেছ?’
সে বলল, ‘না।’
তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তবে কি তুমি মুসলমান হয়ে এসেছ?’
সে এবারও বলল, ‘না।’
তিনি বললেন, ‘তাহলে কি উদ্দেশ্যে আগমন করেছ?’
সে বলল, ‘আপনারা মক্কায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন। আপনাদের মধ্যে থেকে আমি জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু আপনারা এখানে চলে এলেন, তারপর মক্কার বড় বড় সর্দাররা বদর যুদ্ধে নিহত হল, ফলে আমার জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি ঘোর বিপদে পড়ে ও অভাবগ্রস্থ হয়ে এখানে আপনাদের কাছে এসেছি।’
মুহম্মদ বললেন, ‘তুমি মক্কার পেশাদার গায়িকা। সেই যুবকেরা কোথায় গেল, যারা তোমার গানে মুগ্ধ হয়ে টাকা-পয়সা বৃষ্টির মত বর্ষণ করত?’
সে বলল, ‘বদর যুদ্ধের পর মক্কার উৎসবপর্ব ও গান-বাজনার জৌলুস খতম হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত আমি কোন আমন্ত্রণ পাইনি।’
মুহম্মদ আব্দুল মুত্তালিব বংশের লোকদেরকে তাকে সাহায্য করার জন্যে অনুরোধ করলেন। তারা তাকে নগত অর্থ ও পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি দিয়ে বিদায় দিল।
মদিনাতে সর্বপ্রথম হিজরতকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন হাতেব ইবনে আবী বালতায়া (Hateb ibn Abi Baltaya)। তিনি ছিলেন ইয়েমেনী বংশোদ্ভূত, পরবর্তীতে মক্কায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। মক্কায় তার স্বগোত্রের কেউ ছিল না। তার পরিবার যখন মুসলমান হয়, তখন পরিবারের মধ্যে কেবল তিনিই মদিনায় হিযরত করেন এবং তার স্ত্রী ও সন্তানেরা মক্কায় রয়ে গিয়েছিল।
মুহম্মদের হিযরতের পর পৌত্তলিক কুরাইশরা মক্কায় বসবাসকারী অবশিষ্ট মুসলমানদের নানাভাবে উত্যক্ত ও নির্যাতন করত। হিযরতকারীদের যাদের সন্তানেরা মক্কায় ছিল তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনের কারণে কিছুটা নিরাপদ ছিল। কিন্তু হাতেব যখন দেখতে পেলেন তার সন্তান-সন্তুতিদের শত্রুর নির্যাতন থেকে রক্ষা করার মত কেউ নেই, তখন তিনি ভাবলেন মক্কাবাসীদের প্রতি কিছুটা অনুগ্রহ প্রদর্শণ করলে হয়তঃ তার সন্তানদের প্রতি জুলুম বন্ধ হবে। আর এসময় গায়িকা সারার মক্কায় ফেরৎ যাত্রাকে তিনি একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করলেন।
হাতেব মুনাফেক ছিলেন না। তিনি নিশ্চিত বিশ্বাসী ছিলেন যে, মুহম্মদকে আল্লাহ বিজয় দান করবেন। এই তথ্য ফাঁস হলে তার কিম্বা ইসলামের কোন ক্ষতি হবে না। তাই তিনি যুদ্ধের তথ্য ফাঁস করে দিয়ে মক্কাবাসীদের নামে একটি পত্র লিখে সারার হাতে সোপর্দ করলেন।
এদিকে মুহম্মদ জিব্রাইলের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলেন। তখন তিনি আলী, আবু মুরসাদ ও যুবায়ের ইবনে আওয়ামকে তার পশ্চাৎধাবনের নির্দেশ দিলেন। এই দল তাকে ‘রওযায়ে খাক’ নামক স্থানে উটে সওয়ার অবস্থায় গমনরত দেখতে পেয়ে আটক করলেন। অতঃপর তাকে বলা হল- ‘তোমার কাছে যে পত্র রয়েছে তা বের কর।’
সে বলল, ‘আমার কাছে কারও কোন পত্র নেই।’
তারা তার উটকে বসিয়ে দিলেন। এরপর তার মালামাল তল্লাসী করলেন। কিন্তু কোন পত্র মিলল না। এই দলের প্রত্যেকে নিশ্চিত ছিলেন মুহম্মদের সংবাদ কখনও ভ্রান্ত হতে পারে না। তাই তারা তাকে ভীতি প্রদর্শণ করলেন, বললেন, ‘হয় পত্র বের কর, নতুবা পত্রের খোঁজে আমরা হয়তঃ তোমাকে বিবস্ত্র করে ফেলব।’
তখন সে পায়জামার ভিতর থেকে পত্রটি বের করে দিল। আর আলী বাহিনী পত্রসহ মহিলাকে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
পুরো ঘটনা জানতে পেরে ওমর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে মুহম্মদকে বললেন, ‘এই ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রসূল ও সকল মুসলমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুতরাং অনুমতি দিন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই।’
মুহম্মদ বললেন, ‘সে কি বদর যোদ্ধাদের একজন নয়? আল্লাহ বদর যোদ্ধাদেরকে ক্ষমা করার ও জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন।’
হাতেবকে ডেকে আনা হল। মুহম্মদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে হাতেব, কিসে তোমাকে উদ্বুদ্ধ করল এ কাজ করতে?’
তিনি বললেন, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ! আমি আমার সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই একাজ করেছি। আমি ব্যতিত অন্য কোন মোজাহির এমন নেই যার স্বগোত্রের লোক মক্কায় বিদ্যমান নেই। আমি ভেবেছিলাম মক্কাবাসীদের প্রতি একটু অনুগ্রহ করলে তারা হয়তঃ আমার সন্তান-সন্তুতিদের কোন ক্ষতি করবে না। তবে আমি এই কাজ ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্যে করিনি। আমার তখনও দৃঢ়বিশ্বাস ছিল এবং এখনও আছে যে, বিজয় আপনার নিশ্চিত, মক্কাবাসীরা জেনে গেলেও তাতে কোন ক্ষতি হবে না।’
সব শুনে মুহম্মদ উপস্থিত সকলকে বললেন, ‘হাতেব সত্য বলেছে। অতএব তার ব্যাপারে তোমরা ভাল ছাড়া মন্দ বোলও না।’
ওমর বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসূলই সত্য জানেন।’
অতঃপর হাতেব ও মুসলমানদের প্রতি উপদেশ সমম্বলিত কোরআনের এই আয়াতসমূহ নাযিল হল-‘মুমিনেরা, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরও না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা, যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করেছে। তারা রসূলকে ও তোমাদেরকে বহিস্কার করে এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখ। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্যে এবং আমার পথে জেহাদ করার জন্যে বের হয়ে থাক, তবে কেন তাদের প্রতি গোপনে বন্ধুত্বের পয়গাম প্রেরণ করছ?
তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা আমি খুব জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। তোমাদেরকে করতলগত করতে পারলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং মন্দ উদ্দেশ্যে তোমাদের প্রতি বাহু ও রসনা প্রসারিত করবে এবং চাইবে যে, কোনরূপে তোমরাও অবিশ্বাসী হয়ে যাও। তোমাদের স্বজন- পরিজন ও সন্তান-সন্তুতি কেয়ামতের দিন কোন উপকারে আসবে না। তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।’(৬০:১-৩)
তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা আমি খুব জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। তোমাদেরকে করতলগত করতে পারলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং মন্দ উদ্দেশ্যে তোমাদের প্রতি বাহু ও রসনা প্রসারিত করবে এবং চাইবে যে, কোনরূপে তোমরাও অবিশ্বাসী হয়ে যাও। তোমাদের স্বজন- পরিজন ও সন্তান-সন্তুতি কেয়ামতের দিন কোন উপকারে আসবে না। তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।’(৬০:১-৩)
সমাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন