৪ ডিসেম্বর, ২০১৪

Priestly: বিজ্ঞানী যাজকের খৃষ্টের ঈশ্বরত্ব বিরোধিতা।

যোসেফ প্রিষ্টলি (Josheph Priestly) ১৭৩৩ সনে লিডস এর ৬ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্ষুদ্র ফিল্ডহেড গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় একজন বস্ত্র উৎপাদক। প্রিষ্টলি ছিলেন পিতার জ্যোষ্ঠপুত্র। তার ৬ বছর বয়সের সময় মা মারা যান। কঠোর ক্যালভিনীয় শিক্ষায় বাড়িতে তিনি বেড়ে ওঠেন। কিন্তু স্কুলে তিনি সেইসব ভিন্ন ধর্মীয় আদর্শের অনুসারী শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন যারা চার্চ অব ইংল্যাণ্ডের মতবাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতেন। একজন যাজক হওয়ার লক্ষ্যে তিনি ল্যাটিন, গ্রীক ও হিব্রু ভাষা ভালভাবে আয়ত্ত করেন।

আদমের পাপ (Adam’s Sins) বিষয়ে প্রিষ্টলি পর্যাপ্ত অনুতাপ প্রদর্শন না করায় তাকে বন্ধু সভার (Elders of the Quakers) সদস্য ভুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানান হয়। অর্থোডক্স চার্চের সকল মতবাদের অনুসারী নয়, এমন কাউকে গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তাকে একটি সুপরিচিত একাডেমিতে পাঠানো হয় যেখানে শিক্ষক ও ছাত্ররা অর্থোডক্স চার্চের মতবাদ ও ‘ধর্মবিরোধী মতবাদ’ তথা একত্ববাদে বিশ্বাসের মধ্যে বিভক্ত ছিল। এখানে প্রিষ্টলি খৃষ্টান চার্চের মৌলিক মতবাদ সমূহের বিশেষ করে ত্রিত্ববাদের সত্যতার ব্যাপারে গভীরভাবে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেন। তিনি যতই বাইবেল পাঠ করলেন ততই তার নিজের মতে আস্থাশীল হয়ে উঠলেন। আরিয়াস, সারভেটাস ও সোজিনির রচনা তার মনের উপর গভীর ছাপ ফেলে। তাদের মত তিনিও সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্মগ্রন্থগুলো ত্রিত্ববাদ ও প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কে জোরাল প্রমাণ দিতে পারেনি। এর ফল হল এই যে, তিনি যখন শিক্ষা শেষ করে একাডেমি ত্যাগ করলেন, তখন তিনি একজন কট্টর আরিয়াস অনুসারীতে পরিণত হয়েছেন।

যোসেফ প্রিষ্টলি।
প্রিষ্টলি বার্ষিক ৩০ পাউণ্ড বেতনে একজন যাজকের সহকারী নিযুক্ত হন। যখন আবিষ্কৃত হল যে তিনি একজন আরিয়াস অনুসারী তখন তাকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ১৭৫৮ সনে তিনি চেশায়ারে নান্টউইচে (Nantwich) একজন যাজক হিসেবে নিয়োগ লাভ করতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি তিন বছর চাকুরি করেন। তার আয় অতি সামান্য হওয়ায় প্রাইভেট টিউশনির মাধ্যমে তিনি আরও অর্থোপার্জন করতেন। খুব শিগগিরই একজন ভাল শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আরিয়াসপন্থীরা ১৭৫৭ সনে ওয়ারিংটনে (Warrington) একটি একাডেমী প্রতিষ্ঠা করলে প্রিষ্টলি নান্টউইচ ত্যাগ করেন এবং সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। অবসরকালীন সময়ে তিনি প্রায়ই লন্ডন গমন করতেন। এভাবেই এক সফরের সময় লণ্ডনে বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাংকলিনের সাথে তার প্রথমবারের মত সাক্ষাৎ ঘটে। ১৭৬৭ সনে তিনি তার পুরোন বাসস্থানের কাছাকাছি লিডস (Lids)-এর মিলহিল (Mill Hill) -এর যাজক হয়ে আসেন। সেখানে তিনি ৬ বছর ছিলেন।

লিডস-এ প্রিষ্টলি বেশকিছু পুস্তিকা প্রকাশ করেন। শিগগিরই একত্ববাদের একজন অসাধারণ ও জ্ঞানী মুখপাত্র হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। অবসর সময়ে তিনি রসায়নবিদ্যা পাঠ করতে শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি রয়াল সোসাইটির স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৭৭৪ সনে অক্সিজেন আবিষ্কার করার ফলে তিনি অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি আরও গবেষণায় নতুন কিছু গ্যাস আবিষ্কার করেন যা তার আগে আর কোন বিজ্ঞানী করতে পারেননি। তবে পদার্থ বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের ব্যাপারেই তিনি বেশী উৎসাহী ছিলেন। তাই তিনি এসব আবিষ্কারকে একজন ধর্মতত্ত্ববিদের অবসর মুহূর্তের ফসল হিসেবেই বিবেচনা করতেন। আত্মজীবনীতে প্রিষ্টলি তার এসব যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাত্র একটি পৃষ্ঠা ব্যয় করেছেন। একসময় তিনি লিখেছিলেন: “রসায়নের কয়েকটি শাখায় আমি কিছু আবিষ্কার করেছি। আমি এ ব্যাপারে কখনই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ দেইনি এবং সাধারণ প্রক্রিয়াসমূহের ব্যাপারেও আমি সামান্যই জানতাম।

পরবর্তীতে যোসেফ প্রিষ্টলি আর্ল অব শেলবার্ণের (Earl of Shellburne) লাইব্রেরিয়ান ও সাহিত্য সঙ্গী হন। এ কাজের জন্যে তাকে আকর্ষণীয় বেতন এবং তার খুশিমত কাজ করার স্বাধীনতাসহ আজীবন ভাতা বরাদ্দ করা হয়। তিনি এ কাজে ৭ বছর নিয়োজিত ছিলেন। তার গ্রীষ্মের দিনগুলো কাটত আর্লের পল্লী-প্রসাদে এবং শীতকাল কাটত লণ্ডনে। প্যারিস, হল্যাণ্ড, বেলজিয়াম ও জার্মানী সফরের সময় তিনি আর্লের সঙ্গী ছিলেন। আর্ল বেনজামিন ফ্রাংকলিনের সাথে প্রিষ্টলির বন্ধুত্বের কারণে বিব্রত বোধ করতে থাকেন। কারণ এসময় ফ্রান্সে যে বিপ্লব চলছিল ফ্রাংকলিন তার সমর্থক ছিলেন। প্রিষ্টলি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রাংকলিনের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং এর অত্যল্পকাল পরই বসবাসের জন্যে বার্মিংহাম চলে যান। এই শহরে তার বসবাস ১১ বছর স্থায়ী হয়। যদিও শেষদিকটি ছিল অত্যন্ত মর্মবিদারক, ট্রাজেডিপূর্ণ, তা সত্ত্বেও এটিই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে সুখকর অধ্যায়। যাজক হিসেবে তাকে সপ্তাহে মাত্র একদিন অর্থাৎ রবিবারে দায়িত্ব পালন করতে হত। সে কারণে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে তিনি প্রাণ ভরে গবেষণাগারে কাজ করতে ও ইচ্ছা মত লিখতে পারতেন।

বার্মিংহামে থাকতে প্রিষ্টলি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী গ্রন্থ “History of the Corruptions of Christianity” রচনা করেন। এ গ্রন্থটি চার্চকে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ করে তোলে। এ গ্রন্থে প্রিষ্টলি শুধু ত্রিত্ববাদের বৈধতা প্রত্যাখ্যানই করেননি, উপরন্তু তিনি যীশুর মানবীয়তাকেও সমর্থন করেন। তিনি বলেন, যীশুর জন্ম সম্পর্কে যে সব বর্ণনা ও বিবরণ পাওয়া যায় তা পরস্পর অসংগতিপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যীশু ছিলেন একজন মানুষ। আর দশজন মানুষের মত তিনিও অসুস্থ্যতা, অজ্ঞতা, সংস্কার ও দুর্বলতার প্রবণতা সম্পন্ন ছিলেন। বিশ্বে নৈতিক বিধান চালুর জন্যেই ঈশ্বর তাকে নির্বাচিত করেছিলেন। তার কাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল এবং তাকে প্রদান করা হয়েছিল অলৌকিক ক্ষমতা। যীশুকে মৃত্যু পরবর্তী পরলৌকিক জীবন সম্পর্কে বিপুল জ্ঞান দান করে মানুষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল যে জীবনে মানুষকে তার ইহজীবনের সৎকাজের জন্যে পুরস্কৃত করা হবে, নিছক খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্যে নয়। সরকার কিংবা চার্চ কেউই প্রিষ্টলির এই মত পছন্দ করতে পারেনি।

প্রিষ্টলি যীশুর মানবীয়তাকে শুধু সমর্থনই করেননি, যীশুর অলৌকিক জন্মগ্রহণের (Immaculate Conception) বিষয়টিও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবে তিনি এক নয়া চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করেন। এর ফলশ্রুতিতে একত্ববাদীদের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ সাগরে হাল-বিহীন এক জাহাজের মত। সার্বজনীন একত্ববাদ নামে পরিচিত যে আন্দোলনের সূচনা হয়, তাতে দিক নির্দেশনার একান্তই অভাব ছিল। তাই যীশুর অলৌকিক জন্মগ্রহণের ধারণা প্রত্যাখ্যান সম্পূর্ণ অনাবশ্যক ও তিক্ত এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে যা একত্ববাদের সমর্থকদের মঙ্গলের চাইতে ক্ষতিসাধন করে বেশী। ফরাসি বিপ্লব ও সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইংল্যাণ্ডেও অনুরূপ আরেকটি আন্দোলনের জন্ম ঘটে যা বহু ইংল্যাণ্ডবাসীকে ভীত করে তোলে। গোঁড়া চার্চ এই সুযোগে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, প্রিষ্টলির শিক্ষা ইংল্যাণ্ডেও অনুরূপ ট্রাজেডির সৃষ্টি করবে। এর ফলে প্রিষ্টলিকে অপমান করে ও তাকে হুমকি দিয়ে লেখা অসংখ্য চিঠি তার বাড়িতে আসতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার কুশপুত্তলিকা পোড়ান হয়।

যোসেফ প্রিষ্টলি জন্মস্থান।
১৭৯১ সনের ১৪ জুলাই একদল লোক বার্মিংহামের একটি হোটেলে বাস্তিল পতনের বার্ষিকী উদযাপন করছিল। এ সময় শহরের বিচারকদের নেতৃত্বে এক বিশাল জনতা হোটেলের বাইরে সমবেত হতে শুরু করে। প্রিষ্টলি এ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন ধারণা করে তারা হোটেলে হামলা চালায় ও জানালার কাচ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। তবে প্রিষ্টলি সেখানে ছিলেন না। জনতা তারপর প্রিষ্টলির বাড়িতে হামলা চালায়। প্রিষ্টলির ভাষায় “তারা নিষ্ঠুরভাবে লুন্ঠনপর্ব সমাপ্ত করে বাড়িটিতে আগুন জ্বালিয়ে দিল।” তার গবেষণাগার, লাইব্রেরি, এবং তার সকল পাণ্ডুলিপি ও দলিলপত্র পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এক বন্ধু আগে থেকে সতর্ক করে দেয়ায় প্রিষ্টলি কোন রকমে প্রাণে রক্ষা পান। পরদিন সকল গুরুত্বপূর্ণ একত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এর দু’দিন পর জনতা, যারা ঘোষিত একত্ববাদী নয়, কিন্তু একত্ববাদীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছে এমন সব লোকদের বাড়িগুলোও পুড়িয়ে দেয়। এ সময়টি বার্মিংহামের লোকজনের কাটে আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে। সকল দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষকে উন্মত্ত জনতার রোষ থেকে বাঁচার জন্যে “চার্চ ও রাজা” চিৎকার করে উচ্চারণ করতে ও দরজায় লিখে রাখতে দেখা যায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। তখন দাঙ্গাকারীরা অদৃশ্য হয়।

এ পর্যায়ে বার্মিংহামে অবস্থান করা প্রিষ্টলির জন্যে বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। তিনি ছদ্মবেশে লণ্ডনের উদ্দেশ্যে বার্মিংহাম ত্যাগ করেন। বার্মিংহামের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “আইন বিহীন সহিংসতা থেকে পালানোর পরিবর্তে আমি পালিয়েছিলাম গণবিচার থেকে। চূড়ান্ত প্রতিহিংসার উন্মত্ত আবেগ নিয়ে সেখানে আমাকে খোঁজা হচ্ছিল।” লণ্ডনে এসে লোকের চিনে ফেলার ভয়ে তিনি রাস্তায় প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে সক্ষম ছিলেন না। ইতিমধ্যে তার আশ্রয়দাতার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফলে তাকে একটি ভাড়া বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। তার গৃহস্বামী শুধু বাড়ি হারানোর ভয়েই শঙ্কিত ছিলেন না, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারানোর ভয়েও ভীত হয়ে পড়েছিলেন।

১৭৯৪ সনে বেনজামিন ফ্রাংকলিনকে সাথে নিয়ে প্রিষ্টলি আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। ফিলাডেলফিয়া পৌঁছে তারা শহরে ও আশপাশে প্রথম কয়েকটি একত্ববাদীদের চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে ইংল্যাণ্ডের পরিস্থিতি অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ১৮০২ সনে প্রিষ্টলির পুরোন সংগঠন একটি ক্ষুদ্র গির্জা স্থাপন করে। একত্ববাদীদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বিলশামকে (Bilsham) উক্ত গির্জার উদ্বোধনী ধর্মোপদেশ প্রদানের আমন্ত্রণ জানান হয়। তবে প্রিষ্টলি আমেরিকাতেই থেকে যান। ১৮০৪ সনে তিনি পরলোকগমন করেন।

২য় আর্ল অব শেলবার্ণ।
ইংল্যাণ্ডে একত্ববাদীদের জন্যে প্রিষ্টলির বড় অবদান হল ঈশ্বরের একত্বের সমর্থনে ব্যাপক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক যুক্তিসমূহ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং প্রাচীন খৃষ্টান যাজক ও ধর্মপ্রচারকগণের রচনা থেকে এসব যুক্তি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো তিনি তার সময়কালের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমস্যায় যুক্তিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতেন। তিনি লিখেছিলেন, “অসার বিষয়কে শক্তি দিয়ে যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় না।”

তার সকল ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে দুই খণ্ডে লেখা “History of the corruptions of Christianity” গ্রন্থটি ছিল সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী। এ গ্রন্থে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, প্রকৃত খৃষ্টান ধর্ম, যা প্রথমদিকের চার্চের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ ছিল, তা একত্ববাদী এবং এ বিশ্বাস থেকে সকল ধরনের বিচ্যুতি কার্যত ধর্মবিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়। এ গ্রন্থটি ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার গোঁড়া খৃষ্টানদের ক্রুদ্ধ এবং উদার পন্থীদের আনন্দিত করেছিল। হল্যাণ্ডে গ্রন্থটি প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়। এ গ্রন্থে প্রিষ্টলি লিখেছেন:

খৃষ্টান ধর্মের পদ্ধতিটি বিবেচনা করে দেখলে যে কেউ একে ধর্মের বিকৃতি ও অপব্যবহারের জন্যে দায়ী বলে ভাবতে পারে। খৃষ্টান ধর্মের বাহ্যিক রূপ থেকে যা মনে হয়, তা হল এই যে, মানব জাতির শাশ্বত পিতা (ঈশ্বর) যিশুখ্রিস্টকে মানুষকে সৎকাজ করার আহ্বান জানাতে, অনুশোচনাকারীদের জন্যে তার ক্ষমার আশ্বাস প্রদান করতে এবং সকল সৎকর্মকারীদের জন্যে পরকালে অমর জীবন ও সুখময় দিন যাপনের সংবাদ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেন। এর মধ্যে এমন কিছু নেই যা নিয়ে দুর্বোধ্য জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি বা আপত্তিকর মনে হতে পারে। এ মতবাদ এতই সরল যে, জ্ঞানী-অজ্ঞানী সকলের কাছেই তা শ্রদ্ধার বিষয় বলে মনে হবে। যে ব্যক্তি এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, সে এ ধর্মের প্রচারকালে এ ধর্ম ব্যবস্থার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর বিকৃতি ও অপব্যবহার সম্পর্কে কিছু খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হবে। যীশু ও তার ধর্মপ্রচারকগণ পূর্ব থেকেই অবহিত হয়েছিলেন যে, একসময় সত্য থেকে ব্যাপক বিচ্যুতি ঘটবে এবং তারা যা শিক্ষা প্রদান করেছেন তার সাথে চার্চের মতবাদের বিরাট ফারাক ঘটবে, এমনকি তা সত্য ধর্মের জন্যে ধ্বংসকর হবে।

যা হোক, বাস্তবে ধর্মের বিকৃতির কারণসমূহ উত্তরোত্তর বহাল থাকে এবং তদনুযায়ী, ধর্মের স্বাভাবিক রীতি-নীতি আরও অনুসরণের বদলে অপব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। এক্ষেত্রে যা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক তা হল, সত্যধর্মের স্বাভাবিক কারণে এসব অপব্যবহার ধীরে ধীরে সংশোধিত হচ্ছে এবং খৃষ্টধর্ম তার প্রকৃত সৌন্দর্য ও মহিমা ফিরে পাচ্ছে।

এ ধর্মীয় বিকৃতির কারণসমূহ প্রায় সর্বাংশেই অ-খৃষ্টান জগতের প্রচলিত মত থেকে উদ্ভূত, বিশেষ করে তাদের দর্শনের অংশ এগুলো। সে কারণেই এই অ-খৃষ্টানরা যখন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করল তারা এর সাথে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কারগুলিও মিশিয়ে দিল। উপরন্তু ইহুদী ও অ-খৃষ্টানরা উভয়েই অভিন্ন অনিষ্টকারী হিসেবে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তির অনুসারী হওয়ার ধারণায় এতবেশী মর্মপীড়ার শিকার হয়ে পড়েছিল যে, খৃষ্টানরা এ কলঙ্ক একেবারে মুছে ফেলতে যে কোন মতবাদ পুরোপুরি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল।

গ্যাস পরীক্ষার জন্যে প্রিষ্টলির তৈরী যন্ত্র।
বলা হয় যে মানুষের মানসিক ক্ষমতা শরীর কিংবা মস্তিষ্ক থেকে পৃথক বিষয় এবং এই অদৃশ্য আত্মিক অংশ, অথবা আত্মা, দেহের সাথে সম্মিলনের পূর্বে বা পরে নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম, সকল দর্শনের মধ্যেই তা গভীর শিকড় বিস্তার করেছে, এই উদ্দেশ্যের জবাব খোঁজার ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে তার উপর নির্ভর করা হয়েছে। এ পন্থায় খৃষ্টানরা খৃষ্টের আত্মাকে তার জন্মের পূর্বেই তাদের পছন্দ মত একটি ঐশ্বরিক মর্যাদায় স্থাপিত করতে সক্ষম হয়। প্রাচ্য দর্শন থেকে উদ্ভূত মতবাদ গ্রহণকারী অধ্যাত্ম রহস্যবাদী খৃষ্টানগণ এ নীতি অবলম্বন করেছিল। পরবর্তীতে খৃষ্টান দার্শনিকগণ জ্ঞান অথবা ঈশ্বর পিতার সর্বনিয়ন্ত্রক শক্তিকে ব্যক্তিসম্ভুত করে ঈশ্বর পিতার সমকক্ষ করার অন্য নীতি গ্রহণ করে...।

খৃষ্টানধর্মের সদর্থক প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহার ছিল অত্যন্ত মারাত্মক। এর উদ্ভব ঘটে ধর্মীয় রীতি ও অনুষ্ঠানের বিশুদ্ধকরণ ও পবিত্রকরণের মতবাদ থেকে, যা ছিল অ-খৃষ্টানদের উপাসনার সর্বপ্রধান ভিত্তি এবং সেগুলো ছিল ইহুদী ধর্মের অপব্যবহারের অনুরূপ। আমরা অ-খৃষ্টানদের মত ও আচার-কর্মের মধ্যে সন্ন্যাসীদের কৃচ্ছ্রতার সকল উপাদান দেখতে পাই যারা শরীরকে মাসকারা ভূষিত হওয়ার ও বাসনা দমন করার মাধ্যমে আত্মাকে পবিত্র ও মহিমান্বিত করার চিন্তা করত। চার্চের কর্তৃত্বের এই অপব্যবহারকে সহজেই বেসামরিক সরকারের অপব্যবহারের মতই ব্যাখ্যা করা যেত। জাগতিক স্বার্থসম্পন্ন লোকেরা তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে যে কোন সুযোগকে কাজে লাগাতে সদাপ্রস্তুত ছিল এবং অন্ধকার যুগে এমন বহু ঘটনা সংঘটিত হয় যা তাদেরকে এ ধরনের বিচিত্র সুযোগ এনে দিয়েছিল।

ত্রিত্ববাদ
সামগ্রিকভাবে আমি বলতে চাই যে, একজন মনোযোগী পাঠকের কাছে এটা সুস্পষ্ট হবে যে খৃষ্টান ধর্মের ধর্ম বিশ্বাস ও প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বিকৃতি রয়েছে, আর তা হল, যে পরিস্থিতিতে তার প্রচার ঘটেছিল, তারই ফল। এ সাথে একথাও বলতে হয় যে, এ বিচ্যুতি থেকে মুক্তিও বিভিন্ন পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি।

পুরো বিষয়টিকে (খৃষ্টানদের ভ্রান্ত অবস্থান) সংক্ষিপ্ত করলে দাঁড়ায়:
১) সাধারণ সভা পুত্রকে পিতার মত একই বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করেছিল।
২) পবিত্র আত্মাকে ত্রিত্ববাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
৩) মানবিক আত্মার অধিকারী খৃষ্টকে বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তির সাথে সংযুক্ত করেছিল। 
৪) খৃষ্টের ঐশ্বরিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্যের কল্পিত মিলন ঘটিয়েছিল, এবং 
৫) এই মিলনের পরিণতি হিসেবে দু’টি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে একই ব্যক্তি গঠিত হওয়ার কথা সমর্থন করেছিল।
এসব বৈশিষ্ট্য মনে রাখার জন্যে যথেষ্ট ভাল স্মৃতিশক্তি প্রয়োজন। কারণ এগুলো শুধু কথার বেসাতি, এর সাথে ভাবনা-চিন্তার কোন সম্পর্ক নেই।

The History of Jesus Christ” নামে আরও একটি গ্রন্থে প্রিষ্টলি বলেছেন: আমরা যখন কোন বিষয়ে একটি বা বেশকিছু বইয়ের মতবাদ খুঁজে দেখি এবং যখন বিভিন্ন মতের সমর্থনে বক্তব্যসমূহ দেখতে পাই, তখন আমাদের প্রধানত বিবেচনা করতে হবে যে, পুরো গ্রন্থটির মূল সুর ও মর্ম কি অথবা এ ব্যাপারে প্রথম সযত্ন অনুসন্ধান একজন নিরপেক্ষ পাঠকের উপর কি ছাপ ফেলবে...।

আমরা যদি সৃষ্টি সম্পর্কে মুসার ধারণা আলোচনা করি, তবে দেখতে পাব যে, তিনি একজনের বেশী ঈশ্বরের উল্লেখ করেননি যিনি স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি পৃথিবীতে গাছপালা ও জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি মানুষও সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে বহুবচনাত্মক সংখ্যা তখনি ব্যবহৃত হতে পারে যখন তার বক্তব্য এভাবে উপস্থাপন করা হয়। “চল, আমরা মানুষ সৃষ্টি করি” (আদি পুস্তক ১:২৬); কিন্তু এটা যে শুধুমাত্র বাগশৈলী তার প্রমাণ মেলে কিছু পরেই একবচন সংখ্যা থেকে, “ঈশ্বর মানুষকে তাঁর নিজস্ব কল্পনায় সৃষ্টি করেছেন।”(আদি পুস্তক ৫:২৭), সুতরাং স্রষ্টা কিন্তু একজনই। উপরন্তু বাইবেলের তোরণ নির্মাণ বিবরণেও আমরা পাঠ করি যে “ঈশ্বর বললেন, চল, আমরা নীচে নামি এবং সেখানে তাদের ভাষা তালগোল পাকিয়ে গেছে।” (আদি পুস্তক ১১:৭); কিন্তু পরবর্তী বাক্যেই আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতপক্ষে এ কাজটি যিনি করেছিলেন তিনি ছিলেন একক সত্তা মাত্র।

ঈশ্বরের সঙ্গে আদম, নূহ ও অন্যান্য নবীর কথোপকথনের ক্ষেত্রে কখনই এক সত্তা ছাড়া অন্য কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তারা ঈশ্বরকে একজন হিসেবেই সম্বোধন করেছেন। কখনও তাকে “যিহোভা” কখনও “ইব্রাহিমের ঈশ্বর” নামে তাকে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু এখানে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না যে, প্রথমেই যাকে ঈশ্বর নামে সাধারণ সম্বোধন করা হয়েছে এবং পৃথিবী ও স্বর্গের স্রষ্টা বলে যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তিনি একই সত্তা।

ধর্মগ্রন্থগুলোতে স্বর্গীয় দূতদের (Angels) বিষয়ে বারংবার উল্লেখ রয়েছে যারা কখনও কখনও ঈশ্বরের নামে কথা বলেছে, কিন্তু তারা সর্বদাই স্রষ্টা এবং ঈশ্বরের দাস হিসেবে উল্লেখিত... কোন অবস্থাতেই এসব স্বর্গীয় দূতকে “ঈশ্বর” বলা যেতে পারে না। তারা সর্বোচ্চ সত্তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে কিংবা তাঁর সমমর্যাদা সম্পন্ন হতে পারে না।

ঈশ্বরের একত্ব সম্পর্কিত সবচেয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়ে ওল্ড টেষ্টামেন্টে বার বার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রথম নির্দেশ হল, “আমার পূর্বে আর কোন ঈশ্বর ছিল না” (যাত্রা পুস্তক ২০:৩)। এ কথাটি আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “হে ইস্রায়েলীরা, শোন, যিনি প্রভু তিনিই ঈশ্বর, তিনি একজনই” (দ্বিতীয় বিবরণ ৫:৪)। এবিষয়ে পরবর্তী নবীদের ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল তা পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ আমার নেই। দেখা যায়, ইহুদী ধর্মে এটি ছিল বিরাট বিষয় এবং এর ফলে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ উপস্থিতি ও তত্ত্বাবধান, নিজেদের মধ্যে একেশ্বরের জ্ঞান সংরক্ষণ অন্যান্য জাতির সাথে তাদের পার্থক্য সূচিত করেছিল, অন্যদিকে বাকি বিশ্ব ছিল মূর্তিপূজার অনুসারী। এ জাতির মাধ্যমে এবং অনুসৃত শৃঙ্খলার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এই মহান মতবাদ কার্যকরভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল এবং আজও তা অব্যাহত আছে।

ত্রিত্ববাদ যেমনটি বলে তেমনটি পৃথক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একাধিক ঈশ্বর থেকে থাকলে তা ন্যুনতম পক্ষে মৌলিক ইহুদী ধর্ম-মতবাদের লঙ্ঘন হত এবং তা নিশ্চিতরূপে ব্যাখ্যা দাবি করত, উপরন্তু এর বিপক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হত। শাশ্বত পিতার যদি কোন পুত্র এবং আরও একটি আত্মা থেকে থাকে (পবিত্র আত্মা) যারা প্রত্যেকে তাঁর নিজের সমান ক্ষমতা ও মহিমা সম্পন্ন, যদিও এমন একটি অর্থ থাকা উচিত ছিল যে, তাদের প্রত্যেকেই প্রকৃত ঈশ্বর তবুও সঠিকভাবে বলতে গেলে মাত্র একজন ঈশ্বর রয়েছেন। ন্যূনতম পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত হতে পারত যে, তিন জনের প্রত্যেকেই যদি প্রকৃত ঈশ্বর হতেন তারা সকলে মিলে তিন ঈশ্বর হতেন। তবে যেহেতু ওল্ড টেষ্টামেন্টে এ ধরনের কিছু বলা হয়নি, কোন আপত্তি উত্থাপন বা তার জবাবও দেয়া হয়নি, সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে, এ ধারণাটি তখন ছিল না। সেকালের কোন বক্তব্য বা ঘটনা থেকেও এ ধরনের সমস্যার কথা জানা যায় না।

ইহুদীরা যে জ্ঞান ও উপলব্ধি দিয়ে তাদের নিজেদের পবিত্র গ্রন্থসমূহ অবধান করত, আমরা যদি তার দ্বারা পরিচালিত হই, তা হলে যা দেখতে পাব তা হল যে, খৃষ্টীয় ত্রিত্ববাদের মত কোন মতবাদ সে সব গ্রন্থে নেই। প্রাচীন বা আধুনিককালের কোন ইহুদী তাদের কাছ থেকে এ ধরনের কোন মতবাদ কখনই গ্রহণ করেনি। ইহুদীরা সবসময়ই তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে ঈশ্বর এক, একাধিক ঈশ্বরের উল্লেখ না করা এবং সেই অদ্বিতীয় সত্তাই পৃথিবীর স্রষ্টা প্রভৃতি শিক্ষা প্রদানের জন্যেই ব্যবহার করেছে এবং তাদের এসব ধর্মগ্রন্থ যাজক ও নবীদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে ঈশ্বর, স্বর্গীয় দূত (ফেরেস্তা) ছাড়া তাদের পাশাপাশি অন্য কোন সত্তার কথা বলেনি।

খৃষ্টানরা কল্পনা করে যে, ত্রি-ঈশ্বরের মধ্যে মসীহের (Messiah) স্থান হল দ্বিতীয়। কিন্তু ইহুদীরা কখনই এ ধরনের কোন বিষয় কল্পনা করেনি। অন্যদিকে আমরা যদি এ মহান ব্যক্তির নবীত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণীর বিষয়টি বিবেচনা করি, আমরা দেখতে পাব যে, তারা তাকে মানুষের বাইরে অতিরিক্ত কিছু হিসেবে প্রত্যাশা করেনি। এটা নিঃসন্দেহে সন্তোষজনক। মসীহকে “স্ত্রীলোকের সন্তান” শিরোনামের অধ্যায়ে আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে ঘোষণা করা হয়েছে বলে মনে হয়” (আদি পুস্তক ৩:১৩)। ঈশ্বর ইব্রাহিমকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, পৃথিবীতে তার বংশধরগণের প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকবে (আদি পুস্তক ১২:৩)।

এ বিষয়টি (মোটেও যদি মসীহের সাথে জড়িত হয়ে থাকে) আমাদেরকে যে ধারণা দেয় তা হল এই যে, তার কোন সন্তান বা বংশধর মানব সমাজের জন্যে এক বিরাট আশীর্বাদ বয়ে আনার কারণ হবেন। এ প্রসঙ্গে মসীহ সম্পর্কে মুসার কথিত বর্ণনার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, আমি তাদের নবী হিসেবে সৃষ্টি করব তাদের মধ্য থেকে, তোমার মত এবং তার মুখে দেব আমার বাণী এবং আমি তাকে যা নির্দেশ প্রদান করব সে তা তাদের কাছে ব্যক্ত করবে: (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৮)। এখানে ত্রিত্ববাদ অনুযায়ী দ্বিতীয় ঈশ্বরের মত কিছু নেই বা পিতার সমকক্ষ কোন ব্যক্তির কথা বলা হয়নি- এখানে বলা হয়েছে একজন নবীর কথা যিনি ঈশ্বরের নামে কথা বলবেন এবং তাই করবেন যা করার জন্যে তিনি নির্দেশিত....।

নিউ টেষ্টামেন্টেও আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে ওল্ড টেষ্টামেন্টের মত একই মতবাদ লক্ষ্য করি। প্রথম এবং শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বরিক নির্দেশ কী, ধর্মগুরুর এ অনুসন্ধানের জবাবে আমাদের পবিত্র আত্মা বলেন, “হে ইস্রায়েলীগণ, ঈশ্বরের প্রথম নির্দেশ হল আমাদের প্রভু যিনি ঈশ্বর তিনি এক প্রভু” ইত্যাদি এবং ধর্মগুরু তার জবাবে বলেন “হ্যাঁ প্রভু! আপনি সত্য বলেছেন: কারণ ঈশ্বর একজনই আছেন এবং তিনি ছাড়া আর কোন ঈশ্বর নেই” ইত্যাদি।

বিদ্যুৎ স্টাডির জন্যে প্রিষ্টলির তৈরী বৈদ্যুতিক মেশিন।
যীশু সর্বদাই তার ঈশ্বর ও পিতা হিসেবে এই এক ঈশ্বরের উপাসনাই করেছেন। তিনি বলতেন তার ধর্মমত ও শক্তি তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকেই প্রাপ্ত এবং তিনি বারংবার তার নিজের কোন শক্তি বা ক্ষমতা থাকার কথা অস্বীকার করেছেন (যোহন ৫:১৯), “তখন যীশু জবাব দিলেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের বলছি, পুত্র নিজে কিছুই করতে পারে না।” “আমি তোমাদের কাছে যা ব্যক্ত করেছি, তা আমার নিজের কথা নয়, সেগুলো হল আমার পিতার যিনি আমার ভিতরে বাস করেন, তিনিই সবকিছু করেন” (গালাতী ১৪:১৯)। “আমার সহযোগীদের কাছে গমন কর এবং তাদের উদ্দেশ্যে বল, আমি আমার পিতার ও তোমাদের পিতার এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বরের অধীনস্থ” (গালাতীয় ২০:১৭)। কোন ঈশ্বর এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করবেন, কোনক্রমেই তা হতে পারে না।

শেষদিকের ধর্মপ্রচারকগণ তাদের লেখা, কথাবার্তায় একই বিশ্বাস ও ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তারা পিতাকে একমাত্র প্রকৃত ঈশ্বর এবং খৃষ্টকে একজন মানুষ ও ঈশ্বরের বান্দা হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন যিনি তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে খৃষ্ট যে সকল শক্তির অধিকারী ছিলেন তা তিনি তাকে দিয়েছিলেন। (প্রেরিতদের কার্য ২:২২)। পিটার বলেছেন “হে ইস্রায়েলীগণ, তোমরা শোন, নাজারেথের যীশু, তিনি তোমাদের মধ্যে ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত, তিনি অলৌকিক, আশ্চর্য ক্ষমতা ও নিদর্শনসমূহের অধিকারী যা ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন, ইত্যাদি, ঈশ্বর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।” পলও বলেছেন, “ঈশ্বর একজনই বিরাজমান এবং ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে একজন মধ্যস্থ ছিলেন, সেই লোকটি হলেন যিশুখ্রিষ্ট” (তীমথীয় ২:৫)।

ইতিহাসের ধারায় দেখা যাবে যে, সে সব সাধারণ মানুষ, যাদের ব্যবহারের জন্যে নিউ টেষ্টামেন্ট রচিত হয়েছিল, তারা সেগুলোর মধ্যে খৃষ্টের কোন প্রাক-অস্তিত্ব বা ঈশ্বরত্ব দেখেনি। অথচ এখনকার বহু লোকই দৃঢ় বিশ্বাসী যে, তারা সেগুলোর মধ্যে তা দেখেছে। তা যদি সত্যই হয়ে থাকে তাহলে ওল্ড ও নিউ টেষ্টামেন্টে যেমন সুনির্দিষ্ট এক ঈশ্বরের মতবাদ সুষ্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছে ত্রিত্ববাদ সেখানে সুষ্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয়া হয়নি কেন? ন্যূনতমভাবে নিউ টেষ্টামেন্টে তো তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যেত। কেন একত্ববাদকে এত শর্তহীনভাবে, ত্রিত্ববাদের প্রতি কোন ছাড় ব্যতিরেকে, যাতে এ ব্যাপারে কোন বিভ্রান্তি না ঘটতে পারে এত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে? যেমনটি আজকাল গোঁড়া শিক্ষারীতি, ধর্মমত, উপদেশ সকল ক্ষেত্রেই ত্রিত্ববাদের বিভ্রান্তিকে লালন করা হচ্ছে। ধর্মতত্ত্ববিদ গণ খুবই মামুলি কথাবার্তার উপর অনুমান করে অদ্ভুত এবং অ-ব্যাখ্যাযোগ্য ত্রিত্ব মতবাদ সৃষ্টি করছেন যা সুস্পষ্ট, বলিষ্ঠ এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে ধর্মগ্রন্থ সমর্থিত বলে কারও কাছেই প্রমাণ করা যায় না।

প্রিষ্টলির পরীক্ষাগার।  
বাইবেলে এমন বহু অংশ রয়েছে যেগুলোতে সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠভাবে একত্ববাদের মতবাদ ঘোষিত হয়েছে। ত্রিত্ববাদের সমর্থনে এরকম কোন একটি মাত্র অংশ উদ্ধৃত করা যাবে না। তাহলে সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ সাক্ষ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে রহস্যময় সব বিষয়ে আমরা কেন বিশ্বাস করব? যারা বিশ্বাস করে যে খৃষ্ট হয় ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের অধীনে পৃথিবীর স্রষ্টা তাদের বিবেচনার জন্যে আরেকটি বিষয় এখানে উত্থাপিত হতে পারে। এটি হল: আমাদের প্রভু (যীশু) নিজের সম্পর্কে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেন এবং তার যে শক্তি দিয়ে তিনি অলৌকিক কর্মকাণ্ড সাধন করেন, তা তার ভাষার সাথে অসংগতিপূর্ণ বলে মনে হবে যদি তা থেকে অন্য কোন ব্যক্তির চেয়ে তার নিজের কোন শক্তি অধিক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

যদি খৃষ্ট পৃথিবীর স্রষ্টা হতেন তাহলে তিনি নিজের সম্পর্কে বলতেন না যে, তিনি নিজে কিছু করতে পারেন না, তিনি যা বলেন তা নিজের কথা নয় এবং তার মধ্যে যে পিতা আছে তিনিই সবকিছু করেন। কোন সাধারণ লোক, অন্য সাধারণ লোকের মত কাজ করে যদি এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করত এবং বলত যে সে কিছু বলে না বা করে না, তার মাধ্যমে ঈশ্বরই সবকিছু বলেন ও করেন এবং সে কোন কিছুই বলতে বা করতে সক্ষম নয়, আমরা বলতে দ্বিধা করতাম না যে, সে হয় মিথ্যাবাদী অথবা ধর্ম অবমাননাকারী...।

যদি মনে করা হয় যে, খৃষ্ট যখন বলেছেন যে তার পিতা তার চেয়েও শ্রেষ্ঠতর তখন তিনি তার মানব সত্তার কথা ব্যক্ত করেছেন, অথচ একই সাথে তার ঐশ্বরিক সত্তা সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের সমকক্ষ ছিল, তাহলে তা হবে ভাষার অপব্যবহার। মথি, মার্ক বা লূকের গসপেলে ঐশ্বরিকত্ব, এমনকি অতি দৈবিক সত্তা বলে আখ্যায়িত করা যায়, এমন কিছু যীশুর প্রতি আরোপিত হয়নি। জনের গসপেলের ভূমিকায় এ ধরনের কিছু আভাস আছে বলে স্বীকার করে নিলেও একথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সেখানে এমন বহু অংশ আছে যাতে চূড়ান্ত ভাবে যীশুকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

বামিংহামে প্রিষ্টলির বাড়ীতে আক্রমণ। 
এখন এ খৃষ্টানরা উপলব্ধি করতে পারে না যে, যাদের জন্যে গসপেলসমূহ রচিত হয়েছিল সেই ইহুদী অথবা অ-ইয়াহুদীদের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে তথ্যের প্রয়োজন ছিল না যা এ উভয় শ্রেণীর লোকদের ধারণার বাইরে ছিল বরং যা একই সময়ে ক্রুশের সমালোচনাকে কার্যকরভাবে আবৃত করেছিল, যাছিল সে যুগের খৃষ্টানদের অব্যাহত দুর্দশার কারণ। খৃষ্টের ঈশ্বরত্ব অথবা তার পূর্ব অস্তিত্বের মতবাদ যদি সত্য হয় তাহলে তা যে অতি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও আগ্রহোদ্দীপক বিষয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু এ খৃষ্টানরা সেগুলো  সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট  কোন বিবরণ দিতে পারে না এবং তাদের গুরুত্ব সম্পর্কেও কিছু বলে না, সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় এগুলো তাদের অজ্ঞাত ছিল।

আরেকটি প্রশ্নও তাদেরকে অবশ্যই করা যেতে পারে। তা হল, ধর্মপ্রচারকারীরা যখন যীশুকে ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের অধীন পৃথিবীর স্রষ্টাকে এক অতি-দৈবিক শক্তি হিসেবে আবিষ্কার করলেন, তারপরও তারা কিভাবে তাদের প্রেরিতদের কার্যাবলী (Book of Acts) গ্রন্থে এবং পত্রাবলিতে সবসময়ই যীশুকে একজন মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন? উক্ত ধারণার পর এটা ছিল অমর্যাদাকর, অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক, মানুষের রূপে তার উপস্থিতি একেবারেই বেমানান।...

আসুন, আমরা প্রেরিতদের ও যীশুর শিষ্যদের স্থানে নিজেদের স্থাপন করি। তারা নিশ্চিতভাবে যীশুকে তাদের মতই একজন মানুষ হিসেবে ভেবেছিলেন বলেই তার সাথে সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বলেছিলেন। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। এরপর, তিনি মানুষ নন, বরং প্রকৃত পক্ষে ঈশ্বর, অথবা পৃথিবীর স্রষ্টা বলে জানতে পারলে তাদের বিস্ময় তেমনটিই হত যেমনটি আমাদের হবে যদি আমরা আবিষ্কার করি যে, আমাদের চেনাজানা কোন একজন মানুষ বাস্তবে ঈশ্বর অথবা পৃথিবীর স্রষ্টা। এখানে আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে, আমাদের কেমন অনুভূতি হত এবং আমরা এ ধরনের একজন ব্যক্তির সাথে কেমন ব্যবহার করতাম এবং তার সাথে কিভাবে কথা বলতাম। আমি আস্থাশীল যে, কেউ যদি উপলব্ধি করতে পারে যে, এই লোকটি ঈশ্বর অথবা একজন স্বর্গীয় দূত, সে কখনোই ঐ ব্যক্তিকে আর মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করবে না। সে এরপর থেকে তার পদ ও মর্যাদার উপযোগী পন্থায় তার সাথে কথা বলবে।

প্রিষ্টলির স্ত্রী মেরী প্রিষ্টলি। 
ধরা যাক, আমাদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন দু’ব্যক্তি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর স্বর্গীয় দূত মাইকেল ও গ্যাব্রিয়েল (ফেরেশতা মিকাইল ও জিব্রাইল) বলে প্রমাণিত হলেন। এরপরও কি আমরা তাদের মানুষ বলেই আখ্যায়িত করব? অবশ্যই না। আমরা তখন স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুদের বলব, “ঐ দুই ব্যক্তি যাদের আমরা মানুষ বলে জানতাম, তারা মানুষ নন, ছদ্মবেশে স্বর্গীয় দূত।” এ কথাটি হবে স্বাভাবিক। যিশুখ্রিষ্ট যদি পৃথিবীতে আসার পূর্বে মানুষের চাইতে বেশি কিছু হতেন, বিশেষ করে তিনি যদি ঈশ্বর বা পৃথিবীর স্রষ্টা হয়ে থাকতেন, তিনি কখনই পৃথিবীতে থাকাকালে একজন মানুষ হিসেবে গণ্য হতেন না, কেননা তিনি তার শ্রেষ্ঠত্ব ও আসল বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করতে পারতেন না। তিনি যদি ছদ্মবেশেও থাকতেন তাহলে প্রকৃতপক্ষে তিনি পূর্বে যা ছিলেন তাই থাকতেন এবং যারা তাকে প্রকৃতপক্ষে চিনত, তাদের কাছে সেভাবেই তিনি আখ্যায়িত হতেন। যীশুখৃষ্টকে তখন কোনক্রমেই ন্যায়নিষ্ঠ, যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো না, যদিও তার বাহ্যিক উপস্থিতি মানুষকে অভিভূক্ত করত এবং তারা তাকে এ নামে ডাকত না।

নিউ টেষ্টামেন্টের বাগ-বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি দিলে প্রতিটি লোকের মনে যে কথাটা নাড়া দেবে তা হল ‘খৃষ্ট’ ও ‘ঈশ্বর’ নামক দু’টি আখ্যা যা পরস্পর বিরোধী হিসেবে আগাগোড়াই ব্যবহার হয়েছে ‘ঈশ্বর’ ও ‘মানুষ’ শব্দ দ্বয়ের মত। আমরা যদি শব্দের সাধারণ ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করি, আমরা সন্তোষের সাথে দেখতে পাব যে, এমনটি কখনই ঘটত না যদি প্রথমটি পরেরটির গুণ নির্দেশক হত, অর্থাৎ যদি খৃষ্ট ঈশ্বর হতেন।

আমরা বলি, “রাজপুত্র এবং রাজা”, কারণ রাজপুত্র রাজা নন। যদি তিনি রাজা হতেন, তাহলে আমদেরকে অন্য কোন পার্থক্যসূচক শব্দ যেমন “বৃহৎ ও ক্ষুদ্র” ‘ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন’ ‘পিতা ও পুত্র’ ইত্যাদি ব্যবহার করতে হত। যখন ধর্মপ্রচারক পল বলেন যে, করিন্থের চার্চ খৃষ্টের এবং খৃষ্ট ঈশ্বরের একজন, (নিউ টেষ্টামেন্টে বারংবার এরকম উল্লেখ আছে) তখন প্রতীয়মান হয় যে, অর্থপূর্ণভাবে খৃষ্টের ঈশ্বর হওয়া সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। অনুরূপভাবে ক্লিমেন্স রোমানাস কর্তৃক খৃষ্টকে “ঐশ্বরিক মহিমার রাজদণ্ড” হিসেবে আখ্যায়িত করা থেকে পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলে যে, তার মতে রাজদণ্ড হল এক জিনিস এবং ঈশ্বর অন্য জিনিস। আমার বক্তব্য এই যে, কথাটি যখন প্রথম বলা হয়েছিল তখন তার অর্থ এরকমই ছিল।

প্রিষ্টলির সমাধিফলক।
বাইবেলগুলোর সামগ্রিক মর্ম এবং কতিপয় বিবেচনা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, সেগুলো ত্রিত্ববাদের অথবা খৃষ্টের ঈশ্বরত্ব অথবা প্রাক অস্তিত্বের পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। উপরন্তু আরেকটি বিবেচনার দিকে লক্ষ্য করা যায় যেদিকে কারোরই দৃষ্টি খুব একটা পড়েনি যা এসকল মতবাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং তা তাদের ধর্মগ্রন্থের মতবাদেরও বিরুদ্ধে। সেটি হল, যীশু মসীহ হলেও সে বিষয়টি ধর্মপ্রচারক ও ইহুদীদের কাছে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রকাশ করা হয়েছিল। আমদের প্রভু দীর্ঘসময় যাবৎ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছুই বলেননি, বরং ইহুদীদের মত তার শিষ্যদেরও তাকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাদের উপর ছেড়ে দেন। তিনি শুধু তার কাছে ব্যাপ্টিষ্ট যোহন এর প্রেরিত দূতদেরকেই ব্যাপারটি জানিয়ে ছিলেন।

যীশু নিজেকে মসীহ বলে ঘোষণার পর যদি সর্বোচ্চ পুরোহিত তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলার মাধ্যমে আতঙ্ক প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে তিনি যদি অন্য কোন উচ্চতর রকম দাবি করতেন, তা শোনা বা সন্দেহ করার পর ঐ পুরোহিত কি করতেন? যদি তিনি সে রকম কিছু দাবি করতেন তবে নিশ্চয়ই তা প্রকাশ পেত। যখন সাধারণ মানুষ তার অলৌকিক কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করল, তারা বিস্মিত হয়েছিল এ ভেবে যে ঈশ্বর একজন মানুষকে এ ধরনের ক্ষমতা দান করতে পারেন! জনগণ যখন তা দেখল তারা বিস্মিত ও চমৎকৃত হল এবং ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করল যিনি মানুষকে এ ধরনের ক্ষমতা দিয়েছেন (মথি ৯:৮)। হেরোদ যে সময় তার কথা শুনলেন, কেউ কেউ ধারণা করল তিনি ইলিয়াস, কেউ কেউ বলল তিনি নবী এবং কেউ কেউ বলল তিনি পুনর্জীবন লাভকারী যোহন। কিন্তু কেউই তাকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের অধীন পৃথিবীর স্রষ্টা হিসেবে ভাবেনি।

একটি লোকও একথা বলে না যে, যীশু তার নিজের শক্তিতে এরকম অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন। প্রেরিতগণ যদি প্রকৃতপক্ষে যীশুর ঈশ্বরত্বের মতবাদই প্রচার করতেন এবং ধর্মান্তরিত ইহুদীরা যদি সামগ্রিকভাবে তা গ্রহণ করত, তাহলে অবিশ্বাসী ইহুদীদের মধ্যে তা অবশ্যই সুবিদিত থাকত এবং সে সময় যারা পূর্বাপর একত্ববাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিল তারা কি একাধিক ঈশ্বরের ধর্মমত প্রচারের জন্যে খৃষ্টানদের কাছে আপত্তি উত্থাপন করত না? এখন পর্যন্ত প্রেরিতদের কার্যাবলী গ্রন্থ কিংবা নিউ টেষ্টামেন্টের কোনখানেই এ ধরনের কোন কিছুর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।

দুই অথবা তিনজন ঈশ্বর সম্পর্কিত অভিযোগের জবাব দান কতিপয় প্রাচীন খৃষ্টান পাদ্রীর রচনার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল। তারপরও কেন আমরা প্রেরিতদের সময়ে এধরনের কিছু খুঁজে পাই না? এর জবাব একটাই, আর তাহল এই যে, তখন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি এবং খৃষ্টের ঈশ্বরত্বের মতবাদও উত্থাপিতই হয়নি। মন্দির ও আইনের বিরুদ্ধে কথা বলা ছাড়া ষ্টিফেনের বিরুদ্ধে আর কি অভিযোগ ছিল (প্রেরিতদের কার্য ৬:১৩)? আমরা যদি পলের সকল সফরেই তার সঙ্গী হই এবং ইহুদীদের উপাসনালয়ে (Synagogue) ইহুদীদের সাথে তার আলোচনা সমূহে যোগ দেই, তাদের অবিরাম ও প্রচণ্ড নির্যাতনের বিষয় লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাব যে, তিনি যীশুর নয়া ঈশ্বরত্বের প্রচার করেছেন বলে ইহুদীরা কোন সন্দেহ প্রকাশ করছে না। যদি যীশুর ঈশ্বরত্ব প্রচার করা হত তাহলে ইহুদীরা তাদের চিরাচরিত নিয়মে এক নয়া ঈশ্বরের প্রচার হচ্ছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করত।

প্রিষ্টলির পোর্ট্রেইট।
প্রেরিতগণ কখনোই যীশুর ঈশ্বরত্ব বা পূর্ব অস্তিত্বের মত কোন মতবাদের ব্যাপারে কি কখনও নির্দেশিত হয়েছিলেন? যদি তাই হত, তাহলে তার সাথে তাদের সংযোগ স্থাপনের সময়কালটি আমাদের কাছে ধরা পড়ত যেহেতু সেটি ছিল তখনও সম্পূর্ণ নতুন ও অস্বাভাবিক এক মতবাদ। যদি এ বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে তারা দৃঢ়ভাবে সন্দেহমুক্ত না থাকতেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বিস্ময় প্রকাশ করতেন। তারা যদি অবিচল বিশ্বাসে তা অন্যদের শিক্ষা দিতেন তবে তারা তাদের তাৎক্ষণিক ভাবে গ্রহণ করত না। কিছু বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে তাদের তর্ক-বিতর্ক করা কিংবা কতকগুলো বিষয়ে আপত্তির জবাব দিতে হত। কিন্তু তাদের সমগ্র ইতিহাসে এবং তাদের বিশাল রচনা ভাণ্ডারে তাদের নিজেদের বিস্ময় বা সন্দেহ কিংবা অন্যদের সন্দেহ বা আপত্তির কোন প্রমাণ মেলে না।

একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, উপাসনার যথাযথ লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন পিতা ঈশ্বর, ত্রিত্ববাদে যাকে ঈশ্বরদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি বলা হয়। কার্যত: ধর্মগ্রন্থগুলোতে এরকম কোন অনুমোদিত বিধান পাওয়া যায় না যা আমাদের অন্য কোন ঈশ্বর বা তদানুরূপ কাউকে সম্বোধন করতে বলে। এ বিষয়ে স্বপ্নে যীশুকে দেখার পর তার উদ্দেশ্যে ষ্টিফেনের কথিত সংক্ষিপ্ত ভাষনের উল্লেখ গুরুত্বহীন। যীশু সব সময়ই তার পিতা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন, আর তা তিনি করতেন এত বিনীত ও আত্ম সমর্পিত ভাবে যা একজন অতি নির্ভরশীল ব্যক্তির পক্ষেই শুধু করা সম্ভব। তিনি ঈশ্বরকে সর্বদাই তার পিতা বলে অথবা তার জীবনের প্রভু বলে সম্বোধন করতেন এবং তিনি তার শিষ্যদেরও একই সত্তার প্রার্থনা করার জন্যে নির্দেশ দিতেন। তিনি বলতেন, আমাদের তাঁরই উপাসনা করা উচিত।

তদানুযায়ী শুধুমাত্র পিতার প্রার্থনা করা ছিল চার্চের সুদীর্ঘকালের নিয়ম ও ঐতিহ্য। লিটানিতে (Litany) যেমনটি রয়েছে, “প্রভু আমাদের করুণা কর”, “খৃষ্ট আমাদের করুণা কর” এ ধরনের সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা তুলনামূলকভাবে অনেক পরে প্রবর্তন করা হয়। ক্লিমেন্টীয় প্রার্থনা যা সবচেয়ে প্রাচীন প্রার্থনা হিসেবে আজও বিদ্যমান এবং গীর্জা সংক্রান্ত সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত, এটি রচিত হয়েছিল চতুর্থ শতাব্দীতে এবং সেখানে এ ধরনের কোন বিষয় নেই। অরিজেন প্রার্থনা বিষয়ক এক বিশাল গ্রন্থে অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে শুধু পিতাকে উপাসনার আহ্বান জানিয়েছেন, খৃষ্টকে নয়; এবং যেহেতু জনসাধারণের এ ধরনের প্রার্থনার ক্ষেত্রে নিন্দার বা দোষের কিছু আছে এমন কথা তিনি বলেননি, স্বাভাবিকভাবেই আমরা ধরে নিতে পারি যে, খৃষ্টের কাছে পূর্বোক্ত ধরনের কাতর অনুনয় বিনয় করা খৃষ্টানদের গণ প্রার্থনা সভার কাছে অজ্ঞাত ছিল।

প্রিষ্টলির পোর্ট্রেইট।
এখানে প্রেরিতদের ইতিহাসের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ঘটনার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক। হেরোদ যখন জেমসকে হত্যা করলেন (যনি ছিলেন জনের ভাই) এবং পিটারকে বন্দী করলেন, আমরা পাঠ করি যে চার্চে অবিরাম “ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে” প্রার্থনা করা হয়েছিল; খৃষ্টের উদ্দেশ্যে নয়, “তাঁর জন্য” (প্রেরিতদের কার্য ১২:৫)। পল ও সাইলাস যখন ফিলিপির কারাগারে বন্দী ছিলেন, আমরা পাঠ করি যে, তখন তারা “ঈশ্বরের গুণগান ও প্রশংসা করেছিলেন” (প্রেরিতদের কার্য ১৬:২৫) যীশুর নয়; এবং যখন পলকে জেরুজালেম গমন করলে তার পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়া হল, তখন তিনি বলেছিলেন “ঈশ্বর যা ইচ্ছা করেন তাই হবে (প্রেরিতদের কার্য ২১:১৪)। এ থেকে অবশ্যই মনে করা যায় যে, তারা পিতা ঈশ্বরকেই বুঝিয়েছেন, কারণ যীশু নিজেও এ ক্ষেত্রে একই ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। যেমন ঈশ্বরের উপাসনাকালে তিনি বলতেন: আমার ইচ্ছায় নয়, তোমর ইচ্ছাই পূরণ  হোক...।

পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, ধর্মগ্রন্থসমূহে ত্রিত্ববাদের মত কোন মতবাদ নেই। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কোন যুক্তিবাদী ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের পক্ষে এ ত্রিত্ববাদ গ্রহণ বা ধারণ করা অসম্ভব, কেননা এর স্ববিরোধিতা এটাকে অর্থহীন করে দিয়েছে।

এথানাসিয়াসের ত্রি-ঈশ্বর বিষয়ক মতবাদে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, পিতা, পুত্র বা আত্মার কারোরই কোন কিছুর অভাব নেই, কেননা তাদের মধ্যে প্রত্যেকে প্রকৃত ও যথাযথ ঈশ্বর, প্রত্যেকেই অবিনশ্বরতার দিক দিয়ে সমান এবং প্রত্যেকেই ঐশ্বরিকতায় পূর্ণাঙ্গ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা তিনজন তিন ঈশ্বর নন, শুধু এক ঈশ্বর। ফলে তারা প্রত্যেকে পূর্ণাঙ্গ ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও এক এবং বহু উভয়ই। এটি নিঃসন্দেহে এক স্ববিরোধী বিষয়, যেমন একথা বলা যে পিটার, জেমস ও জন এদের প্রত্যেকেরই এক একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে, তবে তারা সম্মিলিতভাবে তিন ব্যক্তি নয়, একজন মাত্র। “ঈশ্বর” অথবা “মানুষ” শব্দ দ্বয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ধারণা সমূহ এ দু’টি প্রস্তাবের প্রকৃতিতে কোন পার্থক্য সূচিত করতে পারে না। নিসিয়ার কাউন্সিলের পর এই বিশেষ রীতিতেই ত্রিত্ববাদের মতবাদকে ব্যাখ্যা করার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। সে যুগের যাজক ও পাদ্রীগণ বিশেষভাবে তিন “ব্যক্তির” পূর্ণাঙ্গ সমকক্ষতা রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। আর তা করতে গিয়ে তারা একত্বের বিষয়টি সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়েছিলেন।

প্রিষ্টলি মেডেল।
যা হোক, এ মতবাদ কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, সেটি কোন ব্যাপার না হলেও এগুলোর একটিকে সর্বদাই অন্যটির জন্যে বলি দিতে হয়। যেহেতু “ব্যক্তি” (Person) ও “সত্তা” (being) শব্দের ব্যবহার নিয়ে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার, সে কারণে তা সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। “সত্তা” আখ্যাটি প্রত্যেকটি বিষয়ের এবং তারপর ত্রি-ঈশ্বরের তিন ব্যক্তির প্রত্যেকের গুণবাচক আখ্যা হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ যদি বলা হয় খৃষ্টই ঈশ্বর। কিন্তু এখানে কোন সত্তা নেই, বৈশিষ্ট্য নেই যা দিয়ে তার গুণ প্রকাশ পায়। তাহলে এটাকে এক অর্থহীন বিষয় ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কিন্তু যখন বলা হয় যে, এসব ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই স্বয়ং ঈশ্বর, এর অর্থ অবশ্যই এই হবে যে, পিতা পৃথকভাবে একটি সত্তা, পুত্র পৃথকভাবে একটি সত্তা এবং তদানুরূপ পবিত্র আত্মারও স্বতন্ত্রভাবে একটি সত্তা রয়েছে। এখানে তিনটি সত্তার তিনজনই ব্যক্তি। সে ক্ষেত্রে এই তিনজন ঈশ্বর ছাড়া আর কি হতে পারেন যদি না অনুমান করা যায় যে, তিনজন সমন্বিত ব্যক্তি অথবা তিনজন পিতা, তিনজন পুত্র অথবা তিনজন পবিত্র আত্মা আছেন?

প্রিষ্টলির স্টাচু।
পিতার যদি জন্মদানের রহস্যময় বিচিত্র ক্ষমতা থাকে, তবে এখনও তা সক্রিয় নয় কেন? তিনি যদি অপরিবর্তনীয় নাই হবেন তাহলে শুরুতে যা ছিল এখন তা নেই কেন? তাঁর পূর্ণাঙ্গতা কি একই আছে এবং তাঁর পরিকল্পনা করার ক্ষমতাও কি একরই রকম রয়েছে? তাই যদি হয় তা হলে আরও সন্তান তিনি উৎপাদন করেননি কেন? গোঁড়া যাজকরা যেমনটি জিজ্ঞাসা করে সেরকম তিনি কি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়েছেন? অথবা তিনি তাঁর জন্মদানের ক্ষমতা কাজে লাগাবেন কিনা সেই ইচ্ছা ও মর্জির উপরই কি তা নির্ভরশীল? তিনি তাঁর দ্বারা ভিন্নভাবে সৃষ্ট অন্য কোন রূপ বা আকৃতি সম্পন্ন অন্য কোন কিছুর মতই? এবং তিনি তাঁরই মত একই উপাদানে গঠিত হবেন কি না?

এ প্রশ্নও অবশ্যই করতে হবে যে ত্রি-ঈশ্বরের তৃতীয় ব্যক্তি কোন পন্থায় উৎপন্ন হয়েছেন। তাকে প্রথম দু’ব্যক্তির স্ব-স্ব পূর্ণাঙ্গতার অভিপ্রায় থেকে যৌথ ক্ষমতার মাধ্যমে হয়েছে? যদি তাই হয়, তাহলে একই কার্যক্রমে কেন চতুর্থ বা পরে আরও উৎপন্ন করা হল না?

যা হোক, ত্রিত্ববাদের এই অদ্ভুত জন্মদানের কথা স্বীকার করে নিলে পুত্রের ব্যক্তিক অস্তিত্ব তার পিতার মেধা থেকেই উৎসারিত বলে অবশ্যই স্বীকার করতে হয়, আর তা পুত্রের তুলনায় নিশ্চিতভাবে পিতার অগ্রাধিকার অথবা শ্রেষ্ঠত্বের কথাই তুলে ধরে। আর কোন সত্তাই যথাযথ ঈশ্বর হতে পারে না যদি তার চেয়ে ঊর্ধ্বতন বা শ্রেষ্ঠ কেউ থাকে, সংক্ষেপে এই পরিকল্পনা কার্যকরভাবে যথাযথ সমকক্ষতার এবং পাশাপাশি ত্রিত্ববাদে তিন ব্যক্তির একত্বের মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করে।

ত্রিত্ববাদের ব্যাপারে প্রধান আপত্তি এই যে, এটি হল ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের প্রধান উদ্দেশ্য উপাসনার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী। এই একত্ববাদের সংস্কার করা অথবা অন্যরূপে তার অনুসরণ সন্দেহের বিষয় বলেই বিবেচিত বা গণ্য হবে। আর তা এ কারণে যে এ মতবাদ বহু ঈশ্বর তথা পৌত্তলিক উপাসনার প্রবর্তন করে।

ইংল্যাণ্ডের একত্ববাদী আন্দোলনের গভীর প্রভাব আমেরিকাতেও পড়েছিল। ক্যালভিনপন্থী একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে এর সূচনা হয়েছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে ধর্মীয় আশ্রমে পরিণত হয় এবং এ পর্যায়ে ধর্মমতের উপর তত বেশি গুরুত্ব দেয়া হত না। এভাবে ধীরে ধীরে ধর্মীয় পরিবর্তনের পথ উন্মুক্ত হয়। চার্লস চানসী (Charles Chauncy, ১৭০৫-১৭৫৭ সন) ছিলেন বোষ্টনের অধিবাসী। তিনি এক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনের এক সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন। জেমস ফ্রিম্যানের (১৭৫৯-১৮৩৫ সন) নেতৃত্বে কিংস চ্যাপালের ধর্মীয় সমাবেশ ত্রিত্ববাদ বিষয়ক তাদের অ্যাংগলিকান গির্জার সকল রীতি-নীতি বিলোপ করে। ১৭৮৫ সনে এ ঘটনা ঘটে। এভাবে আমেরিকায় প্রথম একত্ববাদী চার্চের অস্তিত্ব ঘোষিত হয়। প্রিষ্টলির মতবাদ প্রকাশ্যে মুদ্রিত ও বিতরিত হতে থাকে। অধিকাংশ লোকই তা গ্রহণ করে। এর ফল হিসেবে বোষ্টনে একজন ছাড়া সকল যাজক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক একত্ববাদ গৃহীত হয়।

সমাপ্ত।
উৎস: Jesus- A Prophet of Islam- by Muhammad Ata ur-Rahim.
ছবি: Wikipedia.

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

Hereafter: পুনরুত্থান, শেষবিচার ও অনন্ত জীবনের উপাখ্যান।


পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এখানে জীবনের সৃষ্টি, পুষ্টি, বৃদ্ধি এবং ক্ষয় সূর্যের দ্বারাই হয়। আর মানুষ বাবা-মা ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী নিয়ে মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে ক্ষণকালীন এক জীবন কাটায়। চলমান এ পৃথিবীতে তারা জাগতিক বিষয়াবলীতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, জীবনের চরম সত্য, মৃত্যুর কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। রূপ-রস ও বর্ণ-গন্ধ-স্বাদে ভরা এত যে সুন্দর, বৈচিত্র্যময়, নয়ন মনোহর ও মায়াভরা পৃথিবী, অথচ এ ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন- এ কি বিষ্ময়ের নয়? জগতের বিচিত্র এতসব পশু-পক্ষী, জীব-জন্তু, গাছ-পালা, কতই না নিখূঁত ভাবে সৃষ্টি, সর্বোপরি এত বড় মহাবিশ্ব সব কি এমনি এমনি? কোন সৃষ্টিকর্তা নেই? কোন উদ্দেশ্য নেই এতসব সৃষ্টির? এত মায়ার বন্ধন সবই কি মিথ্যে? না-কি মৃত্যুর পরেও জীবন আছে? যদি থাকে, তাহলে সে জীবনটার স্বরূপ কেমন?

কিছু ‍কিছু ধর্ম পুনর্জন্মবাদের কথা বলে। আর সে জন্ম এ জগতেই হবে একাদিক্রমে কর্মফল অনুসারে মানব কূলে নতুবা, পশু-পক্ষী কূলে। কিন্তু এ ধারা অনন্ত তা বলা যায় না। কেননা, সূর্যের জ্বালানী শেষ হয়ে যখন এ পৃথিবী ধ্বংস হবে, তখন এ মতবাদের কি হবে তার সুস্পষ্ট কোন উত্তর নেই। অন্যদিকে আসমানী কিতাবগুলো অনুসারে কোন পুনর্জন্ম নেই, মৃত্যুর পরে সকল মানবের পুনরুত্থান ঘটবে এ দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার পর। অত:পর সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং তিনি কর্মফল বিচার শেষে পাঠিয়ে দেবেন চিরস্থায়ী বসবাসের জন্যে স্বর্গরাজ্যে অথবা নরক রাজ্যে। আমাদের এ উপাখ্যানের আলোচ্য বিষয়-
  • জেনারেলাইজড ফর্মে সেই পুনরুত্থানের স্বরূপ,
  • হাশরের ময়দানে সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতির স্বরূপ,
  • বিচার নীতি ও পদ্ধতি,
  • সৃষ্টিকর্তার প্রাথমিক ভাষণের স্বরূপ,
  • ধর্ম ও মতবিরোধের নিষ্পত্তি,
  • আমলনামা স্থাপন,
  • সওয়াল জবাবের ধরণ,
  • বিচারের শুরু ও সমাপ্তি,
  • স্বর্গ ও নরকের পথে যাত্রীগণের দল বিভক্তির স্বরূপ ও তাদের হাল-হকিকত,
  • স্বর্গ ও নরকের প্রবেশ দ্বারে অভ্যর্থনা ও প্রবেশের ধরণ,
  • আরাফ ও আরাফবাসী,
  • নরক ও নারকীয়তা,
  • স্বর্গ ও স্বর্গীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতা, এবং
  • স্বর্গী ও নরকীর বসবাসের চিত্ররূপ, ইত্যাদি।

দান্তের কল্পনায় স্বর্গ
কোন সন্দেহ নেই ধারাবাহিক ভাবে ধাপের পর ধাপ পুরো বিষয়টি উপস্থাপন বেশ জটিল, কেননা, এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। ইতিপূর্বে এই বিশাল প্রেক্ষাপটের উপর পূর্ণাঙ্গ ভাবে কোন উপস্থাপনা হয়নি। দান্তের বিস্তারিত বর্ণনায় ইনফার্ণো ও প্যারাডিসো রয়েছে, কিন্তু তা কবির কল্পনায় আঁকা, সমগ্র চিত্রের এক খন্ডিতাংশ। মূলত: দৃশ্যলোকে বাস করে অদৃশ্যলোকের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আগাম আলোচনা প্রলাপ ব্যতিত কিছুই নয়, যদি-না অদৃশ্যলোকের সংবাদ আমাদেরকে জানানো হয়। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুগে বিনোদনের ক্ষেত্র ব্যতিত, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোন কিছু পাঠ-পঠনের ধাতও আমাদের নেই। তাই সম্পূর্ণ উপস্থাপনাটি করা হল কেবলমাত্র শেষ দু’টি ঐশীগ্রন্থ বাইবেল (নতুন নিয়ম) ও কোরআনের আলোকে, কারণ, এ দু’টি গ্রন্থেই ছড়িয়ে রয়েছে পরলোক সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য, ব্যাখ্যা এবং খুটিনাটি। নি:সন্দেহে খুবই সততা ও সতর্কতার সাথে এ আর্টিকেলটি উপস্থাপিত। কেননা এটি কোন নির্দিষ্ট ধর্মগোষ্ঠী বা ব্যক্তির জন্যে রচিত নয়, এমনকি কারো বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের জন্যেও এ রচনা নয়, বরং এ আর্টিকেলটি তাদের জন্যে, যারা কৌতুহলী কেবলমাত্র এটা জানতে যে- যিশু ও মুহম্মদ পরকালের বিষয়ে কি তথ্য-চিত্র দিয়েছেন আমাদেরকে।

মূলত: যিশু কোন শরীয়ত নিয়ে আগমন করেননি, তিনি তো কেবল ‘মসিহ’- উদ্ধারকর্তা। তার উপাধিই জানান দিচ্ছে তার কাজ ও কাজের পরিধি। তিনি ইস্রায়েলীদেরকে দেখিয়েছেন সহজপথ যা তাদেরকে পৌঁছে দেবে বেহেস্তীরাজ্যে। মূসার শরীয়তের ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতির কারণে ‘দুষ্টু জাতি’ ইস্রায়েলীরা তাদের ’খাতা’য় কোন প্রাপ্তি যোগ করতে পারছিল না, কিন্তু তারা তো চুজেন পিপল। সুতরাং খোদা তাদেরকে শেষবারের মত সরলপথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন যিশুর মাধ্যমে, যাকে দেয়া হয়েছিল খোদায়ী কিছু গুণ। যেমন-

‘এই জন্যে দেখ, আমি তাদেরকে জ্ঞাত করব,
একটিবার তাদেরকে আমি আমার হস্ত ও পরাক্রম জ্ঞাত করব,
তাতে তারা জানবে যে, আমিই খোদা।’---------(অরামিয়া ১৬:২১)

আর যিশু এসে জানালেন তাদের জন্যে রয়েছে মহাসুসংবাদ, কিন্তু তারা তার কথায় কান দিল না। তখন তিনি তার শিষ্যদেরকে পাঠিয়ে দিলেন ঘরে ঘরে গিয়ে সুখবর প্রচার করতে এবং তাদেরকে তার কাছে ডেকে আনতে। কিন্তু দুষ্টুরা নানান বাহানায় তাদেরকে এড়িয়ে গেল। ফলে শিষ্যরা রাস্তা-ঘাটে অন্ধ, খঞ্জ যেখানে যাকে পেল তাকেই ডেকে নিয়ে এসেছিল। ঐ আগতরা (বর্তমানে নিজেদেরকে খৃষ্টান হিসেবে পরিচয় দানকারীগণ) জানে না রীতিনীতির কিছুই। ফলে তারা বিয়েবাড়ীতে (পরকালে) উপস্থিত হল বটে কিন্তু বিয়ের পোষাক (মূসার শরীয়ত) তাদের পরণে নেই। বর (যিশু) দেখলেন পুরো বিয়েবাড়ী মেহমানে ভরপুর। অবশেষে গৃহকর্তা (খাদা) উপর থেকে নেমে এলেন মেহমানদের দেখতে। কিন্তু অধিকাংশ লোকের পরণে বিয়ের পোষাক নেই দেখে তিনি হতবাক হলেন, আর তিনি তাদেরকে ডেকে বললেন, ‘বিয়ের পোষাক ছাড়া কেন তোমরা এসেছ?’ তারা এর কোন উত্তর দিতে পারল না। তখন গৃহকর্তা রেগে গিয়ে চাকর-বাকরদের (ফেরেস্তাদেরকে) ডেকে বললেন, ‘এদেরকে ধরে ধরে বাঁধ, আর ছুঁড়ে ফেল অন্ধকারে (দোযখে)’। -গসপেল আসলেই ইন্টারেস্টিং।

যা হোক আমরা মূল আলোচনায় ফিরি, তবে বিষয়টি বোঝার সুবিধার্থে প্রথমে আমরা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের পটভূমি হিসেবে মানব সৃষ্টি রহস্য ও মহাপ্রলয়ের স্বরূপ খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করে নেব।

Eternal Knowledge of God 
বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ ফেরেস্তাদেরকে এবং মানব সৃষ্টির পূর্বে জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেন। ফেরেস্তাগণ নূরের এবং জ্বিনেরা ’লু এর আগুনের দ্বারা সৃষ্ট।-(১৫:১৬) জ্বিনেরা এক জোড়া আর ফেরেস্তাগণ ‘দুই, তিন কিংবা চার জোড়া পক্ষ বিশিষ্ট।’-(৫:১) ফেরেস্তাগণের সৃষ্টির পরেই লিখিত হয়েছে এক কিতাব। ঐ কিতাবের পত্রসমূহ সম্মানিত, উচ্চ পবিত্র। আর তার লিপিকার ফেরেস্তাগণ অর্থাৎ যারা খোদার নির্দেশে এই কিতাব লিপিবদ্ধ করেছে, তারা অতি মহৎ এবং অতি পুত-পবিত্র।-(৮০:১৩-১৬) অন্যদিকে, আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কোন গোপন ভেদ নেই যা ঐ কিতাবে না আছে।-(২৭:৭৫) প্রত্যেক বস্তুর সৃষ্টি রহস্য, প্রত্যেক রসূলের উপর অবতীর্ণ কিতাব সমূহ এবং প্রতিটি মানুষের জন্ম, মৃত্যু এবং জীবনপথ এতে লিখিত রয়েছে।-(৩৬:১২) আর তা সমুন্নত অটল রয়েছে লওহে মাহফুজে।-(৪৩:৪) বিচার দিবসে আমলনামার মত এ কিতাব প্রদর্শিত হবে স্বাক্ষী স্বরূপ।

ফেরেস্তাগণের সৃষ্টি, পৃথিবী ও তার সকল প্রকার সৃষ্টি এবং জ্বিন জাতির সৃষ্টি শেষে আল্লাহ মানব সৃষ্টির পরিকল্পণা করেন। মানব বাদে প্রত্যেক ঘটনা বা সৃষ্টি তিনি শুধু বলেছিলেন ‘হও’ এবং তাতেই ঐ সমস্ত বস্তু বা প্রাণী সৃষ্টি হয়েছিল।-(২:১১৭)

প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টির পূর্বে খোদা সমস্ত ফেরেস্তাদেরকে সমবেত হতে নির্দেশ দেন। তারা তৎক্ষণাৎ সমবেত হয়। কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল না কেন এই সমাবেশ, তাই পরস্পর ফিসফিস কথাবার্তা ও আলোচনা করছিল।-(৩৮:৬১) অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে তাঁর পরিকল্পণার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’

ইতিপূর্বে ফেরেস্তাগণ জ্বিন জাতির অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। এ জাতি পৃথিবীকে নরকতুল্য করে ছেড়েছিল। সুতরাং তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো রয়েছি আপনার পবিত্র মহিমা ঘোষণা করার জন্যে।’

তিনি বলেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তো তা জান না।’-(২:৩০) ‘সুতরাং অমি ছাঁচে ঢালা শুকনো মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি, যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তাকে সিজদা করবে।’-(১৫:২৮-২৯)

অত:পর আল্লাহ নিজ হাতে আদমকে সৃষ্টি করলেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন যেন সে তার কাছে প্রশান্তিতে থাকে।-(৭:১৮৯) যা হোক, সৃষ্টির পর আল্লাহ আদমকে যাবতীয় কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। আর সে যখন সবকিছু শিখে ফেলল, তখন তিনি ফেরেস্তাদের সম্মুখে সকল বস্তু উপস্থাপন করে বলেন, ‘এসবের নাম আমাকে বল।’

তারা বলল, ‘আপনি মহান। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি প্রাজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী।’

তখন তিনি আদমকে বলেন, ‘হে আদম! তুমি ওদের এসবের নাম বলে দাও।’ যখন আদম তাদের ঐ সবের নাম বলে দিল, তখন তিনি ফেরেস্তাদেরকে বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি জানি, আর আমি জানি যা তোমরা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ।’-(২:৩১-৩৩)

জ্ঞানের দিক থেকে ফেরেস্তাদের উপর আদমের শ্রেষ্ঠত্ব স্পষ্ট হল। ফেরেস্তাদের মধ্যে জ্ঞানীকে এবং আল্লাহর অধিকতর নৈকট্যপ্রাপ্তদের প্রতি সম্মান প্রদর্শণের রীতি প্রচলিত ছিল। এ কারণেই তারা আযাযিল তথা ইবলিসকে সমীহ ও সম্মান করত। আর তাই যখন আল্লাহ বলেন, ‘আদমকে সিজদা কর।’-(২:৩৪) তখন ফেরেস্তাগণ সকলেই সিজদা করল ইবলিস ছাড়া, সে সিজদা করতে অস্বীকার করল।-(১৫:৩০-৩১)

ইবলিস যদিও ফেরেস্তা ছিল না, ছিল জ্বিন-(১৮:৫০), তথাপি সেও এই নির্দেশের অন্তর্ভূক্ত ছিল। কেননা, তখন পর্যন্ত সে ফেরেস্তাদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করত এবং আল্লাহর ঐ নির্দেশ দানের সময়ও সে তাদের সঙ্গে সেখানে স্ব-শরীরে উপস্থিত ছিল।

জ্বিন জাতিকে আনুগত্য ও অবাধ্যতা প্রদর্শণের ব্যাপারে স্বাধীন করে সৃষ্টি করা হয়েছিল। আগুণের সৃষ্ট জ্বিন আযাযিলের নিকট মাটির সৃষ্টি আদম শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়নি-যদিও বিশেষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আদম তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমান দিয়েছে। সুতরাং সে আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে অনড় দাঁড়িয়ে রইল।

এদিকে সিজদাকারী ফেরেস্তাগণ মাথা তুলেই বুঝতে পারল, সিজদা অস্বীকারকারী আযাযিল। এতে তারা ভয়ে পুনঃরায় সিজদায় পতিত হল।

আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলিস! তোমার কি হল যে, তুমি সিজদাকারীদের সাথে যোগ দিলে না?’-(১৫:৩২) আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম, তখন কে তোমাকে বাঁধা দিল, যে তুমি সিজদা করলে না?’
সে বলল, ‘আমি তো তার চেয়ে বড়, তুমি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা দিয়ে।’-(৭:১২)
তিনি বলেন, ‘হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমার বাঁধা কোথায়? তুমি যে অহংকার করলে, তুমি কি এতই বড়?‘-(৩৮:৭৫)
সে বলল, ‘তুমি ছাঁচে ঢালা শুকনো মাটি থেকে যে মানুষ সৃষ্টি করেছ, আমি তাকে সিজদা করব না।’-(১৫:৩৩) লক্ষ বৎসর খোদার একনিষ্ঠ এবাদতকারী ইবলিসের অহঙ্কার তাকে মুহূর্তেই খোদার সরাসরি আদেশ অমান্যকারী এক শয়তানে পরিণত করল।

আল্লাহ বললেন, ‘তুমি এখান থেকে নেমে যাও, এখানে থেকে অহংকার করবে এ হতে পারে না। সুতরাং বের হয়ে যাও, তুমি তো অধমদের একজন।’-(৭:১৩) আর তিনি আদমকে বলেন, ‘হে আদম! এ (ইবলিস) তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত হতে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ-কষ্ট পাবে। তোমাদের জন্যে এই রইল যে, তোমরা জান্নাতে ক্ষুধার্ত বা উলঙ্গ বোধ করবে না এবং সেখানে পিপাসা বা রোদের তাপ তোমাদেরকে কষ্ট দেবে না।’-(২০:১১৭-১১৯) একই সাথে তিনি তাদের স্বাধীনতারও একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দিলেন। তিনি জান্নাতের এক বৃক্ষ দেখিয়ে আদমকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বাস কর এবং যেখানে ইচ্ছে যাও বা যা ইচ্ছে খাও, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইও না, হলে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।’-(৭:১৯)

তারপর শয়তান ইবলিস আদমকে ফুসমন্তর দিল। সে বলল, ‘হে আদম! আমি কি তোমাকে অমরতা ও অক্ষয় রাজ্যের বৃক্ষের কথা বলে দেব?’-(২০:১২০) প্রকৃত পক্ষে তাদের লজ্জাস্থান, যা গোপন রাখা হয়েছিল, তা প্রকাশ করার জন্যে, শয়তান তাদেরকে কূ-মন্ত্রণা দিয়েছিল ও বলেছিল, ‘যাতে তোমরা দু’জনে ফেরেস্তা বা অমর না হতে পার সেজন্যেই তোমাদেরকে এ বৃক্ষের ব্যাপারে নিষেধ করেছেন।’ সে তাদের কাছে শপথ করে আরও বলেছিল, ‘আমি তো তোমাদের একজন হিতৈষী।’-এভাবে সে তাদেরকে ধোঁকা দেয়।-(৭:২০-২১)

আল্লাহ আদমকে ইবলিস সম্পর্কে ইতিপূর্বে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তার মানষিক দৃঢ়তা ছিল না।-(২০:১১৫) তারপর যখন তারা সেই গাছের ফলের স্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল। আর তারা উদ্যানের বৃক্ষপত্র দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত্ত করার চেষ্টা করল। তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এ বৃক্ষের ব্যাপারে সাবধান করে দেইনি?’
তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের উপর জুলম করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর, তবে নিশ্চয় আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হব।’-(৭:২২-২৩)

অনন্তর শয়তান তাদের উভয়কে পদঙ্খলিত করেছিল। তারা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল, তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল।-(২:৩৬) তারপর আদম তার প্রতিপালকের কাছ থেকে কিছু বাণী পেল। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমা পরবশ হলেন। তিনি তো ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।-(২:৩৭) তিনি বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের শত্রু হিসেবে কিছু কালের জন্যে পৃথিবীতে নেমে যাও। আর সেখানে তোমাদের জন্যে আবাস ও জীবিকা রইল। সেখানেই তোমরা জীবন-যাপন করবে, সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে, আর সেখান থেকেই তোমাদেরকে বের করে আনা হবে।’-(৭:২৪-২৫) মূলত: ‘তোমাদেরকে সেখানে কিছু কাল অবস্থান করতে হবে ও লাভ সংগ্রহ করতে হবে।’-(২:৩৬)

স্বর্গ ও নরক গমণের কর্মপদ্ধতি।
এরপর আল্লাহ তাকে মনোনীত করেন-আর তাকে পথের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সৎ পথের নির্দেশ এলে, যে আমার পথ অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না। আর যে আমার স্বরণে বিমুখ হবে, তার জীবনের ভোগ-সম্ভার সঙ্কুচিত হবে, আর আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় ওঠাব।’

সে বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালে? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান।’

তিনি বলবেন, ‘তুমি এরূপই ছিলে, আমার নিদর্শণাবলী তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। সেভাবে আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হবে এবং এভাবে আমি তাকে প্রতিফল দেই যে বাড়াবাড়ি করে ও প্রতিপালকের নিদর্শণে বিশ্বাস স্থাপন করে না। পরকালের শাস্তি অবশ্যই কঠোর ও স্থায়ী।’-(২০:১২২-১২৭) ‘যারা অবিশ্বাস করবে ও আমার নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করবে তারাই আগুনে বাস করবে, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।’-(২:৩৯)

ইবলিস বলল, ‘তুমি একে কি দেখেছ যে আমার উপরে তুমি মর্যাদা দিলে? কেয়ামতের দিন পর্যন্ত যদি আমাকে অবকাশ দাও, তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ছাড়া তার বংশধরদের সমূলে বিনষ্ট করে ফেলব।’

আল্লাহ বলেন, ‘যাও, জাহান্নামই তোমার প্রতিদান, আর প্রতিদান তাদের, যারা তোমাকে অনুসরণ করবে। তোমার কন্ঠম্বর দিয়ে ওদের মধ্যে যাকে পার সত্য থেকে সরিয়ে নাও, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে ওদের আক্রমণ কর, আর ওদের ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্তুতিতে শরিক হও, আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাও।’ আর তিনি জানেন শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেবে তা ছলনা মাত্র। এখন তিনি ইবলিসের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দিলেন এবং বললেন-‘আমার দাসদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।’-(১৭:৬২-৬৫)
সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দাও।’
তিনি বললেন, ‘তোমাকে অবকাশ দেয়া হল সেদিন পর্যন্ত যা অবধারিত।-(৭৮:৭৯-৮১) এতে ইবলিস পূর্ণ স্বাধীনতা পেল। আর তাতে তৎক্ষণাৎ তার উপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যাওয়াতে তার দৌহিক সৌন্দর্য্য কূৎসিৎ আকার ধারণ করল। আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমার এ অভিশাপ তোমার উপর কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে।’-(৭৮:৭৮)

সে (ইবলিস) বলল, ‘যাদেরকে উপলক্ষ্য করে তুমি আমার সর্বনাশ করলে, তারজন্যে আমিও তোমার সরল পথে তাদের জন্যে নিশ্চয় ওৎ পেতে থাকব। তারপর আমি তাদের সামনে, পিছনে, ডান ও বাম থেকে তাদের কাছে আসবই, আর তুমি তাদের অনেককেই কৃতজ্ঞ পাবে না।’-(৭:১৬-১৭) ‘আমি তোমার দাসদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার দলে নিয়ে ফেলব, আর আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবই, তাদের হৃদয়ে মিথ্যে বাসনার সৃষ্টি করব। আমি তাদেরকে নিশ্চয় নির্দেশ দেব এবং তারা পশুর কান ফুঁটো করবে দেবদেবীকে উৎসর্গ করার জন্যে। আর আমি তাদেরকে নিশ্চয় নির্দেশ দেব এবং তারা তোমার সৃষ্টিকে বিকৃত করবে।’-(৪:১১৮-১১৯) সে বলে চলল-‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার যে সর্বনাশ করলে তার দোহাই! আমি পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপকে আকর্ষণীয় করব, আর আমি সকলের সর্বনাশ করব; তোমার নির্বাচিত দাস ছাড়া।’

তিনি বলেন, ‘এ-ই আমার কাছে পৌঁছানোর সরল পথ। বিভ্রান্ত হয়ে যারা তোমাকে অনুসরণ করবে তারা ছাড়া, আমার দাসদের ওপর তোমার কোন প্রভাব খাটবে না।’-(১৫:৩৯-৪২) ‘আর আমি সত্যিই বলছি যে, তোমাকে দিয়ে ও ওদের মধ্যে যারা তোমার অনুসারী হবে, তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভরিয়ে তুলব।’-(৩৮:৮৪-৮৫) ‘তার সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্যে পৃথক পৃথক দল থাকবে।’-(১৫:৪৪)

আদম-হাওয়াকে দুনিয়াতে পাঠানোর পূর্বে আল্লাহ আদম বংশের জন্যে তাদের পৃষ্ঠ হতে তাদের সন্তানদের বের করেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন- ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’

তারা বলেছিল-‘হ্যাঁ, আমরাই স্বাক্ষী রইলাম।’-(৭:১৭২) এভাবে মানব আত্মার সংখ্যা সূনির্দিষ্ট হয়ে গেল। এই পর্যায়ে আমরা রূহ বা আত্মার স্বরূপ কি, তা উপলব্ধের জন্যে সামান্য আলোচনা করে নেব।

মানব আত্মার মানচিত্র-১
আত্মার চারিত্রিক উপাদান মূলত: দু’টি-একটি বিবেক কিম্বা প্রজ্ঞা এবং অপরটি বিকার কিম্বা প্রবৃত্তি। যে শক্তিতে ব্যক্তি চিন্তা করে, সেটি আত্মার প্রজ্ঞার দিক। কিন্তু যে শক্তিতে ক্ষুধা বা তৃষ্ণা বোধ করে, কিম্বা অপর কোন কামনা-বাসনা দ্বারা তাড়িত হয়, সেটি আত্মার প্রবৃত্তির দিক। আত্মার আরও একটি উপাদান আছে, আর তা হল, বিক্রম বা তেজ। কূ-শিক্ষা যদি বিক্রমকে কলুষিত করে না ফেলে, তাহলে তা প্রজ্ঞার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। শিশুদের জন্মের পরই তার মধ্যে বিক্রম বা তেজ দেখা যায়, কিন্তু প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটে বেশ বিলম্বে।

মানুষের আত্মার অধিক পরিমান হল এই প্রবৃত্তি, আর জন্ম গ্রহণের পরপরই এর নিয়ন্ত্রণ ভার নিয়ে নেয় শয়তান। এ কারণেই সন্তান প্রসবের পর ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি!-(৩:৩৫) আমি তার নাম রাখলাম মরিয়ম (মেরী) এবং তাকে ও তার বংশধরকে বিতাড়িত শয়তান হতে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করলাম।’–(৩:৩৬) অন্যদিকে প্রজ্ঞা বা বিবেকের যোগসূত্র মহাজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার সাথে। প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার শেষ নেই। প্রজ্ঞা বা বিবেকের নির্দেশে বিক্রম যদি সাহসের সঙ্গে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, তবেই কেবল কোন ব্যক্তি হয়ে ওঠে ন্যায়পরায়ণ।


মানব আত্মার মানচিত্র-২
আবার, আমরা দেখতে পাই জাগতিক প্রত্যেক সত্ত্বার মধ্যে উত্তম এবং অধমের অস্তিত্ব আছে। উত্তম হচ্ছে তাই, যা অপর কিছুকে রক্ষা করে বা তাকে উন্নত করে। আর অধম হচ্ছে যা অপর কিছুকে দূষিত কিম্বা ধ্বংস করে। যেমন শরীরের ক্ষেত্রে রোগ, কাঠের ক্ষেত্রে পচন, লৌহের ক্ষেত্রে মরিচা ইত্যাদি। মোটকথা, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে তার ক্ষয় কিম্বা অধমের একটা দিক রয়েছে এবং কোন কিছু যদি এই ক্ষয় দ্বারা আক্রান্ত বা সংক্রামিত হয়, তবে পরিণামে তার ধ্বংস অনিবার্য; সে মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং একসময় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়।

কিন্তু আত্মার ক্ষেত্রে কি ঘটে? অন্যায়, অরাজগতা, কাপুরুষতা এবং অজ্ঞতা আত্মাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারলেও তাকে কি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে? রোগ দেহকে ক্ষয় করে বিনষ্ট করে দিতে পারে, কিন্তু অন্যায় বা অপর কোন দুষ্ট শক্তি এমন কিছু করতে পারে না, যাতে আত্মার অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়, তার মৃত্যু ঘটে বা সে দেহ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। আবার এটাও ভাবা ঠিক নয় যে, নিজের ক্ষয়ে কেউ বিনষ্ট হয় না, বিনষ্ট হয় সে অপরের ক্ষয়ে।

দূষিত খাদ্যের কারণে দেহের ক্ষয় বা মৃত্যু হয় না বরং দেহের মৃত্যু ঘটে তার নিজস্ব স্বভাবের কারণে। দূষিত খাদ্য একটা উপলক্ষ্য মাত্র। কারণ দেহ এবং দূষিত খাদ্য স্বভাবগত ভাবে পৃথক। এদের যোগ এখানে এতটুকু যে, দূষিত খাদ্য দেহের নিকৃষ্ট স্বভাবকে ক্রিয়াশীল করে তোলে। এই যুক্তিতে আমরা বলব, দেহের রোগ যদি আত্মার স্বভাবের নিজস্ব রোগকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে না পারে, তাহলে বলা যায় না যে, দেহের রোগে আত্মার মৃত্যু ঘটতে পারে। তা বলার অর্থ হবে, স্বভাবগত ভাবে যারা একেবারেই পৃথক, তাদের একের রোগ অপরকে ধ্বংস করতে সক্ষম।

সুতরাং দেহের জরা কিম্বা কোন রোগ বা কোন আঘাত, এমনকি দেহ যদি ছিন্ন-ভিন্ন হয়েও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, তবুও দেহের ঐসব অবস্থা আত্মাকে প্রভাবিত বা ধ্বংস করতে পারে না। আত্মা আপন স্বভাবে যা ছিল, তাই থাকে। কেননা, কোন কিছুই নিজস্ব স্বভাবের বিকার ব্যতিত, ভিন্নতর অস্তিত্বের স্বভাবগত বিকারে ধ্বংস হতে পারে না। মোটকথা, মৃত্যু আত্মাকে নৈতিক ভাবে কোন অধম সত্ত্বায় পর্যবসিত করে, কোন ভাবেই এটা প্রমাণ করা যায় না। মানুষ কেবল নিজের স্বভাবের দুষ্ট শক্তির কারণেই অধমতর অস্তিত্বে পরিণত হয়। আইনের দেয়া মৃত্যুদন্ডের জন্যে অপরাধীর মৃত্যু নয় বরং তার মৃত্যু ঘটে তার স্বভাবের মধ্যকার মারাত্মক রোগের কারণে। মূলত: দুষ্টশক্তি নিজের মৃত্যু ঘটায় না, মৃত্যু ঘটায় অপরের। অন্যদিকে, যার স্বভাবের মধ্যে এরূপ দুষ্ট শক্তি রয়েছে, সে মৃত্যুর বদলে অধিকতর উদ্দীপনার সঙ্গে জীবনকে উপভোগ করতে থাকে।

আত্মার নিজের স্বভাবের বিকার যেহেতু আত্মাকে ধ্বংস করতে পারে না, তাই সাধারণ ভাবে বলা যায়-কোন কিছুই এমন কোন শক্তির দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে না, যে শক্তির ধ্বংসের লক্ষ্য ভিন্নতর কোন অস্তিত্ব, তার নিজের অস্তিত্ব নয়। বস্তুত: নিজের ধ্বংস কেবল নিজেই করতে পারে, অপরে নয়। আত্মার নিজের স্বভাব কিম্বা অপরের বিকার, কোন কিছুই যেহেতু তাকে ধ্বংস করতে পারে না, সুতরাং তার মৃত্যু নেই, তার অস্তিত্ব চিরন্তন। এক কথায় ‘আত্মা অমর’। আত্মার অমরতার বৃদ্ধি এবং সংখ্যারও কোন হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে না। আর অমরতার বৃদ্ধি যদি মরণশীলের বিনিময়েই ঘটত, তবে পরিণামে সবকিছুই অমর হয়ে যেত। আর যেহেতু দুনিয়াতে সবকিছুই নশ্বর, সুতরাং আত্মার আগমন নিশ্চিত অবিনশ্বর জগৎ তথা অদৃশ্য লোক থেকে। আবার, মানুষের আয়ূর পরিধি যে ৬০-৭০ বৎসর, তা মহাকালের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। সুতরাং আত্মা অবিনশ্বর বলে মানুষের জীবনের এই ক্ষণকালীন সময়কে সে গুরুত্ব দেবে না, দেহের মৃত্যু ঘটলেই সে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি দেবে।

তবে একথা ঠিক, আত্মার মৃত্যু না থাকলেও আত্মা কলুষিত হতে পারে। দেবতা গ্লুকাস সমুদ্রের মাঝে শত শত বৎসর পড়ে থেকে সামুদ্রিক শ্যাওলা ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের ফলে যেমন কুৎসিত ও দানবীয় আকার ধারণ করেছিল, তেমনি দুনিয়াতে মানুষের পাপাচারে আত্মার সৌন্দর্য বিনষ্ট হতে পারে।

ওয়ার্মহোল-১
যখন পৃথিবীতে কোন মানব সন্তান ভূমিষ্ট হয়ে প্রথম শ্বাস গ্রহণ করে, তখন আত্মা অদৃশ্যলোক থেকে দৃশ্যলোকে এসে চালক ও কর্মের ফেরেস্তাদের তত্ত্বাবধানে ঐ শ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করে।[But, H. W. Robinson argues that it is not a spiritual entity that enters the body at birth and leaves it at death but a principle of life that animates the body.] তারপর যখন সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, তখন মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে তার আত্মাকে দেহ থেকে বিয়ুক্ত করে দেয়। যদি ঐ ব্যক্তি মুমিন হয়, তবে তার আত্মা দেহ থেকে বিযুক্ত হলে তাকে বলা হয়-‘শোন হে পরিতৃপ্ত আত্মা! নিজ পালনকর্তার দিকে চল এবার। তুমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট আর তিনিও তোমার উপর খুশী রয়েছেন।’–(৮৯:২৭) আর পাপাচারী হলে আত্মা বিযুক্ত করা কালে মৃত্যুদূত তাকে বলে-‘বের করো তোমার আত্মা, আজ তোমাকে অবমাননাকর আযাব দেয়া হবে, কারণ তুমি আল্লাহর উপর মিথ্যে আরোপ করতে এবং তাঁর আয়াতসমূহ উপেক্ষা করতে অহঙ্কার করে।’–(৬:৯৩)

যা হোক, ফেরেস্তারা ঐ আত্মাকে অদৃশ্যলোকে নিয়ে গিয়ে আমল অনুসারে সিজ্জিনে বা ইল্লিয়্যীনে সংরক্ষণ করে রাখে। (অবশ্য বুক অব চামিসে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে কিছুটা ভিন্ন ভাবে। শলোমনের প্রশ্নের জবাবে মৃত্যুদূত আজ্রাইল বলেছিল- "As often as a believer dies, Gabriel attends me, and wraps his soul in a green silken sheet, and then breathes it into a green bird, which feeds in Paradise until the day of the resurrection. But the soul of the sinner I take alone, and having wrapped it in a coarse, pitch-covered woolen cloth, carry it to the gates of hell, where it wanders among abominable vapors until the last day.") অত:পর পুনরুত্থানের সময় এই আত্মা সংশ্লিষ্ট দেহে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ আত্মা খোদা প্রদত্ত সৎ ও অসৎ কর্মের খোরো খাতা নিয়ে নিয়ে অদৃশ্যলোক থেকে দৃশ্যলোকে আগমন করে এবং এ দু’টি কর্মের সমষ্টি সঙ্গে নিয়েই সে পুন:রায় অদৃশ্যলোকে ফিরে যায়।


ওয়ার্মহোল-২
আত্মার অদৃশ্য ও দৃশ্যলোকে গমনাগমনের এই পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সম্ভবত: এ দু’টি জগতের মধ্যে যাতায়াতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ওয়ার্মহোল (wormhole) রয়েছে।তবে পুরো বিষয়টি অনুধাবনে আমরা কোষের প্রোটিন অণুর পরিবহন ও বিতরণ পদ্ধতির কথা চিন্তা করতে পারি (চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল-২০১৩)। আমরা জেনেছি, ফ্যাক্টরী কোষ থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রোটিন অণু ‘ভেসিকেল কার্গো’ সহযোগে আন্ত:কোষীয় এক জটিল পথ পাড়ি দিয়ে কোষের সীমানায় নির্দিষ্ট এক বন্দরে পৌঁছে সাঁরিবদ্ধ ভাবে বহির্গমনের অপেক্ষায় থাকে। আর আন্ত:কোষীয় এই যাত্রাপথ, গন্তব্য এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে তিন ধরণের জিন। তারপর ঐ প্রোটিন অণুগুলি বন্দরে কর্মরত ‘সেলুলার মেশিনারী’র অনুমতি পেলে, একে একে সীমানা পার হয় এবং সাথে সাথে সেখানে পৌঁছে অপেক্ষায় থাকা ‘নিউরোট্রান্সমিটার’ ঐ অণুর দায়িত্বভার নিয়ে নেয় এবং অত:পর দ্রুত রক্তস্রোতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। উল্লেখ্য, সেলুলার মেশিনারী ও নিউরোট্রান্সমিটার মস্তিস্ক দ্বারা সু-নিয়ন্ত্রিত।

এভাবে বলা যায়-অদৃশ্যলোকে আত্মাদের সংরক্ষিত স্থান (According to kabbalah, underneath the throne (of God) itself lies the abode of all unborn human souls.) থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বেরিয়ে আসা আত্মাগুলো ফেরেস্তাদের পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট পথ পাড়ি দিয়ে অদৃশ্য ও দৃশ্যলোকের সীমানায় নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে। অত:পর নির্দিষ্ট সময়ে এক সু-নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তাদেরকে সীমানার বাইরে অর্থাৎ দৃশ্যলোকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর সেখানে অপেক্ষায় থাকা চালক ও কর্মের ফেরেস্তাগণ তৎক্ষণাৎ তাদের দায়িত্বভার নিয়ে নেয় এবং পরিচালনা দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট দেহে পৌঁছে দেয়। সবকিছুই সৃষ্টিকর্তার সু-নিয়ন্ত্রণে।

এখন আমরা কৌতুহল মেটাতে দেখি কবিকূল শিরোমনি হোমার এ বিষয়ে কি বলেছেন। অবশ্য এখানে তার ঐ কল্পকাহিনী প্লেটোর রিপাবলিক থেকে নিয়ে যথেচ্ছা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে খন্ডিতাকারে তুলে ধরা হয়েছে -

প্যামফিলিয়াতে জন্মগ্রহণকারী আর্মেনিয়াসের পুত্র এর (Er) ছিল একজন বীর যোদ্ধা। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার মৃত্যু ঘটল। অবশ্যই বীরের মৃত্যু। দশদিন অতিবাহিত হবার পর, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিহত মৃত দেহগুলি সংগ্রহ করে তাদের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করা হল। সব দেহগুলিই তখন পচন ক্রিয়ায় বিকৃত। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার, এরের দেহ অবিকৃত ছিল। তার দেহকে তার গৃহে এনে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে লাগল। কিন্তু দ্বাদশ দিবসে এর যখন সমাধি শয্যায় শায়িত, তখন তার দেহে জীবন ফিরে এল।

জীবন ফিরে পেয়ে এর তার চারিদিকে সমবেত সকলকে তার পরলোকের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগল। এর বলল, যখন তার আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হল, তখন সে আরো বহু বীরের আত্মাদের সঙ্গে পরলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। আর সেই যাত্রায় অগ্রসর হতে হতে তারা একসময় একটি রহস্যময় স্থানে এসে উপস্থিত হল। তারা দেখতে পেল, মহাবিশ্বের ঐ স্থানটিতে দু’টি পরস্পর সংলগ্ন পথ রয়েছে। কিন্তু নীচের এ দু’টি পথের উপরে আরও দু’টি পথকে দেখা গেল। উপরের এবং নীচের ঐ পথের মাঝামাঝি স্থানে একদল দেবদূত উপবিষ্ট যাদের অধিকাংশই গভীর মনোযোগে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। তাদের সম্মুখেও রয়েছে বড় বড় পুস্তক। আর তারা আত্মাদেরকে একে একে পিতার নামসহ ডেকে নিয়ে কাউকে ঐ পুস্তকের একটি হাতে দিয়ে তাদেরকে আকাশের পথ দু’টির ডান দিকের পথ ধরে আরোহণের নির্দেশ দিচ্ছে এবং কাউকে তার ভারী পুস্তকটি পৃষ্ঠদেশে আবদ্ধ করে দিয়ে অধ:দেশের নি:স্ক্রমণ পথের বাম দিকের পথ ধরে নেমে যেতে আদেশ করছে। এভাবে যখন এর দেবদূতদের সম্মুখে উপস্থিত হল, তখন তাকে কোন পুস্তক না দিয়ে বলা হল, সে পরলোকের সবকিছু দেখবে এবং শুনবে। অত:পর ফিরে গিয়ে পৃথিবীর মানুষের কাছে তার পারলৌকিক ঐ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবে।

এই আদেশের পর এর সবকিছু দেখতে-শুনতে লাগল। সে দেখল, পৃথিবী থেকে আগত সকল আত্মাই দেবদূতদের কাছ থেকে পুস্তক নিয়ে উপরের বা নিম্নের ঐ নির্দিষ্ট দু’টি নি:স্ক্রমণ পথে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এর আরও দেখতে পেল, অন্য যে দু’টি পথ রয়েছে, তার মধ্যে অধ:দেশের পথটি দিয়ে কেউ হয়ত: ধূলাবালি সমাচ্ছন্ন হয়ে যাত্রার ক্লান্তি নিয়ে পৃথিবীর গহ্বর থেকে উঠে আসছে, আবার উর্দ্ধ মুখের পথটি দিয়ে কেউ কেউ পরিচ্ছন্ন ও উজ্জ্বল বেশে নেমে আসছে। উর্দ্ধ মুখের পথটি দিয়ে যারা নেমে আসছে, তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে, কিন্তু তাদের অবয়বে যাত্রার ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। তাদের দেখা গেল সানন্দ মনে তারা একটি প্রান্তরে পৌঁছে যেন কোন উৎসবের আয়োজন করছে। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে এবং বাক্যালাপে মশগুল হচ্ছে। আর যখন সেখানে পৃথিবী থেকে কোন সদ্য আগত আত্মার দল পৌঁছে যাচ্ছে, তারা এগিয়ে এসে তাদের কুশলাদি জানছে এবং তাদের কাছে পৃথিবীর খবরাখবর বেশ আগ্রহের সঙ্গে শুনছে।

যারা পৃথিবী থেকে সরাসরি (এরা মূলত: শিশু, ধর্ম ও ন্যায়ের পথে মৃত্যুবরণকারী এবং মুমিন) বা পাতালপুরী থেকে (এক পশলা সাজা খেটে আসা) এসেছে তারা তাদের দু:খ, কষ্ট ও যন্ত্রণার করুণ বর্ণনা দিতে লাগল। তাদের চোখ দিয়ে দু:খের অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। স্বর্গ থেকে আগত আত্মা গুলো তখন তাদেরকে স্বর্গের অবর্ণনীয় সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দয্যের বর্ণনা দিয়ে তাদেরকে শান্ত করতে লাগল। এ কাহিনী দীর্ঘ।

এর বলল, দেবদূতগণ পাপীষ্ঠদের পাপের ধরণ অনুসারে প্রতিটি অন্যায়ের দশ গুণ শাস্তির ব্যবস্থা করছে এবং কাউকে তার দন্ড ভোগকে শত বৎসরে একবার বা সহস্র বৎসরে দশবারের ভিত্তিতে বিভক্ত করে দিচ্ছে। কিন্তু যারা খোদার প্রতি বা পিতা-মাতার প্রতি অসম্মানকারী এবং যারা মানুষ হত্যাকারী তাদের শাস্তি উল্লেখিত দন্ডের চেয়ে বহুগুণে অধিক এবং ভয়ানক। এর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করল। সে বলল, সে শুনতে পেল একটি আত্মা অপর একটি আত্মাকে প্রশ্ন করছে- ‘ভাই, মহান আর্ডিউস কোথায়?’

এই আর্ডিউস এরের হাজার বৎসর পূর্বে পৃথিবীতে জীবন-ধারণ করেছিল। সে প্যামফিলিয়ার কোন নগরীর স্বৈরশাসক ছিল। সে তার বৃদ্ধ পিতা এবং জৈষ্ঠ্য ভ্রাতাকে হত্যা করেছিল। এ ছাড়াও তার ঘৃণ্য দুস্কর্মের সীমা ছিল না। সে যা হোক, এর শুনতে পেল অপর আত্মাটি বলছে- ‘আর্ডিউসের আত্মা কখনও উর্দ্ধে আরোহণে সক্ষম হবে না। কারণ, আমরা নিজেদের চোখেই এক ভয়ানক দৃশ্য দেখেছি। পাতালপুরীর সমস্ত অভিজ্ঞতা শেষ করে আমরা তখন সবে গুহা মুখে পৌঁছেছি, আমাদের কেউ কেউ পুন:রায় আরোহণের উদ্যোগ করছে, আবার কেউ কেউ বিশ্রামে, এমন সময় আমরা দেখলাম, আর্ডিউস এবং তার সঙ্গে আরও কিছু আত্মা সেখানে এসে হাজির হল। তারা সকলেই ছিল স্বৈরশাসক। তাছাড়া, তাদের সাথে এমন আত্মারাও রয়েছে, যারা ব্যক্তিগত ভাবে বৃহৎ দুস্কর্মের নায়ক ছিল। তারা এসে সকলকে সরিয়ে দিয়ে গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা ভেবেছিল অন্যদের মত তারাও উর্দ্ধে আরোহণ করবে। কিন্তু আমরা দেখলাম গহ্বরের মুখ তাদের গ্রহণ না করে আচম্বিতে গর্জন করে উঠল।

বস্তুত: এই দূরারোগ্য পাপীর দল কিম্বা তাদের সঙ্গীদের মধ্যে যাদের দন্ড ভোগ সমাপ্ত হয়নি, তাদের কেউ যখন উর্দ্ধে আরোহণের চেষ্টা করছিল, তখনি গুহা গর্জন করে উঠছিল এবং যেসব ভীমাকার প্রহরী দন্ডায়মান ছিল, তারা সেই গর্জনধ্বণি শ্রবণ করে এগিয়ে এসে তাদেরকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল।

আর্ডিউস ও তার সঙ্গীদেরকে প্রহরীর দল হাত-পা বেঁধে ভূমিতে ফেলে তাদেরকে চাবুক মারছিল এবং তাদেরকে কেশগুচ্ছ ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে উপস্থিত অন্যান্য আত্মাদের নিকট তাদের অপরাধের বর্ণনা দিচ্ছিল এবং বলছিল তাদেরকে তারা আরো কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছে। অপরাধী ছাড়া অপর যারা সেই সময় গুহা মুখের আশে-পাশে দাঁড়িয়ে আরোহণের অপেক্ষায় ছিল, তাদের মনে তখন সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল এই যে, পাছে তারাও সেই গর্জন ধ্বনি শুনতে পায়। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে গুহামুখ নীরব হয়ে রইল, তখন তারা একে একে অসীম আনন্দে গুহামুখ দিয়ে উর্দ্ধে আরোহণ করল।’

এর আরও বর্ণনা করেছিল, উর্দ্ধ থেকে আগত আত্মারা সাত দিন প্রান্তরে অতিবাহিত করে আবারও যাত্রা শুরু করল। ৪র্থ দিনে তারা এমন এক স্থানে এসে উপস্থিত হল, যেখান থেকে স্বর্গ এবং মর্ত্য ভেদকারী একটি আলোক দন্ডকে তারা দেখতে পেল। স্তম্ভের মত আলোর এই দন্ডটি বর্ণ সমারোহে রামধণু প্রায়। বরং বলাচলে রামধণুর চেয়েও সে উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট। আরও একদিন অতিবাহিত হল। অভিযাত্রী আত্মার দল এবার সেই আলোক স্তম্ভে প্রবেশ করল। তাদের ঐ অবস্থান থেকে আলোক স্তম্ভের মেরুদন্ডের উপর দৃষ্টিপাত করে এবার তারা স্বর্গ থেকে প্রলম্বিত দন্ডের উভয় প্রান্তকে দেখতে পেল। কারণ, আলোর এই স্তম্ভটি হচ্ছে স্বর্গ বা জ্যোতির্মন্ডলের বন্ধন দন্ড। এই দন্ডই জাহাজের দাঁড়ের সাঁরির বন্ধন-সূত্রের ন্যায় জ্যোতির্মন্ডলের সমগ্র পরিধিকে ধারণ করে রাখে। এই দন্ডের প্রান্তদেশ দ্বয়ে আবদ্ধ হচ্ছে অনিবার্যতার চক্রটি। অনিবার্যতার এই চক্রটির কারণে সমগ্র নক্ষত্র পুঞ্জের আবর্তন।

অনিবার্যতার চক্রের দন্ড এবং বক্র প্রান্ত কঠিন প্রস্তর এবং অন্য কোন ধাতব বস্তুর মিশ্রণে গঠিত এবং এর গতির নিয়ামক অংশটির প্রস্তুত প্রণালীর যে বর্ণনা এর দিয়েছে, তাতে মনে হয় চক্রের একটি অংশকে খোঁদাই করে তা তৈরী করা হয়েছে। এই খোঁদিত অংশটিতে আবার একটি দ্বিতীয় নিয়ামক স্থাপিত হয়েছে। আবার দ্বিতীয়টিতে খোঁদাই করে বসান হয়েছে একটি তৃতীয় নিয়ামক এবং তৃতীয় নিয়ামকটিকে খোঁদাই করে স্থাপিত হয়েছে চতুর্থ নিয়ামক। এমনি করে তৈরী হতে হতে অষ্টম নিয়ামকে যেয়ে তা সম্পূর্ণ হয়েছে। এ যেন কতকগুলি কুম্ভের স্তর-স্তুপ। কারণ, সেখানে সর্বমোট আটটি নিয়ামক খোঁদিত ছিল এবং একটির মধ্যে ঘটেছিল অপরটির স্থাপন। উর্দ্ধদেশ থেকে দেখলে এ নিয়ামকের বাহুকে একটি বৃত্তের মতই মনে হবে। দন্ডকে ঘিরে তৈরী হয়েছে এই নিয়ামকের তল। অষ্টম নিয়ামকের কেন্দ্র বিন্দু দিয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে এই দন্ড। সবচেয়ে বাইরের দিকের নিয়ামকের বাহু প্রশস্ততম। পরিধিতে হ্রস্বতর ছিল ষষ্ঠ এবং তারচেয়ে চতুর্থ। চতুর্থের পরে অষ্টম, অষ্টমের পরে সপ্তম, সপ্তমের পরে পঞ্চম, তারপরে তৃতীয় এবং সবশেষে দ্বিতীয়।

বহির্দিকস্থ বৃহত্তম বাহুটি বর্ণে ছিল বিচিত্র। কিন্তু সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিল সপ্তমটি। অষ্টমটির আলো আসছিল সপ্তম থেকে। কারণ সপ্তমের বর্ণেই অষ্টমের বর্ণ। দ্বিতীয় এবং পঞ্চম নিয়ামকের বৃত্তকে বলা চলে পরস্পর সদৃশ। এদের বর্ণ ছিল অপর বৃত্তের চেয়ে অধিকতর পীত। কিন্তু তৃতীয়টি ছিল শুভ্রতম। চতুর্থটির বর্ণ লোহিত এবং ষষ্ঠটি শুভ্রতার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়। সমগ্র চক্র একটি বেগেই আবর্তিত হত। কিন্তু সমগ্র গতির অন্তরে অন্তর্ভূক্ত অপর সাতটি নিয়ামকের গতি ছিল ধীরতর এবং সমগ্রের বিপরীতমুখী। কিন্তু এদের মধ্যেও অষ্টমটির গতি ছিল সর্বাধিক। গতিতে অষ্টমের নিকটবর্তীতে ছিল যথাক্রমে সপ্তম, ষষ্ঠ এবং পঞ্চম। এদের সকলের গতি ছিল সমহারের। গতির ক্রমে তৃতীয় স্থান ছিল চতুর্থের এবং এর গতি ছিল বিপরীত আবর্তের। চতুর্থ অবস্থান ছিল তৃতীয়ের এবং পঞ্চম স্থান ছিল দ্বিতীয়ের। আবার, সমগ্র চক্রের আবর্তই সংঘটিত হচ্ছে অনিবার্যতার ক্রোড় দেশে এবং প্রত্যেক বৃত্তের উপরিভাগে একটি করে সংকেত শিঙ্গা স্থাপিত রয়েছে। আবর্তের সঙ্গে সঙ্গে এই শিঙ্গাটি যেমন আবর্তিত হতে থাকে, তেমনি এর শিঙ্গা থেকে একটি নির্দিষ্ট খাতের শব্দ সর্বদা ধ্বণিত হতে থাকে। আর প্রত্যেক বৃত্তের শিঙ্গা একই খাতের ধ্বণি সৃষ্টি করে, ফলে আটটি বৃত্তের শিঙ্গা ধ্বণিতে একটি শব্দ রাগের সৃষ্টি হয়।

ল্যাচেসিস, ক্লথো এবং এ্যাটরোপস।
বৃত্তের পরিক্রম পথে প্রায় সমদূরত্বে আসীন তিনটি মূর্ত্তিবৎ দেবদূত। প্রত্যেকেই তারা একটি করে সিংহাসনে উপবিষ্ট। এরের ভাষ্য অনুসারে এরা তিন জন-তিন ভাগ্যদেবী-ল্যাচেসিস, ক্লথো এবং এ্যাটরোপস। শুভ্র বসনে তারা ভূষিত। শিরে তাদের পুষ্পমাল্য। শিঙ্গার ধ্বণির সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে তারা সঙ্গীত সৃষ্টি করে চলেছে। ল্যাচেসিসের সঙ্গীতের ধূয়া হচ্ছে অতীত, ক্লথোর বর্তমান এবং এ্যাটরোপসের ভবিষ্যৎ। অভিযাত্রী আত্মার দল দেখতে পেল, মাঝে মাঝে ক্লথো চক্রের সর্বাপেক্ষা বহি:স্থ বাহুটি আকর্ষণ করে তাতে গতির সঞ্চার করে দিচ্ছে। এ্যাটরোপসও তার বাম বাহু দিয়ে অন্তর্বাহুটি ঘুরিয়ে দিচ্ছে এবং ল্যাচেসিস পর্যায়ক্রমে তার বাম এবং ডান বাহু দ্বারা অন্ত এবং বহির্বাহু গুলিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

এই স্থানটিতে পৌঁছে আত্মার দল সোজা ল্যাচেসিসের সম্মুখে হাজির হল। এবার একজন দোভাষী তাদেরকে অর্ধাবৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে দিল এবং ল্যাচেসিসের ক্রোড় থেকে কতকগুলি জীবন সংখ্যা তুলে নিয়ে একটি উচ্চ মঞ্চে আরোহণ করে ঘোষণা করল-‘হে আত্মার দল! মর্ত্যের মরণশীল জীবন তোমরা এবার শুরু করতে যাচ্ছ। তোমাদের জন্যে কোন ভাগ্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে না। তোমাদের ভাগ্য তোমাদেরই নির্ধারণ করতে হবে। জীবন সংখ্যা ছুঁড়ে দেয়া হবে এবং যে আত্মা সংখ্যার যে ক্রম তুলে নেবে, সেই ক্রম অনুসারে সে নিজ জীবন বাঁছাইয়ের সুযোগ পাবে। তোমাদের বাঁছাইকৃত এই জীবনে উত্তম বা ধর্মের জন্যে খবরদারির আবশ্যকতা রাখা হয়নি। তোমরা যে যা বাঁছাই করবে, সে তাকে তেমনি লাভ করবে। এজন্য বিধাতাকে দায়ী করা যাবে না। আপন ভাগ্য বাঁছাইয়ের দায়িত্ব আত্মার নিজের।’

এই ঘোষণা পাঠ করে ভাষ্যকার জীবন সংখ্যাগুলো ছুঁড়ে দিল এবং আত্মা দলের যার নিকটে যে সংখ্যা এসে পড়ল, সে তা তুলে নিল। একমাত্র ব্যতিক্রম হল এর। সে কোন জীবন সংখ্যা কুড়িয়ে নিল না। কারণ তার জন্যে জীবন সংখ্যা গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। যা হোক, জীবন সংখ্যা কুড়ানো হলে আত্মারা বুঝতে পারল, কে কখন জীবন বাঁছাইয়ের সুযোগ পাবে। এবার ভাষ্যকার সমবেত আত্মাদের যা সংখ্যা তার চেয়ে অধিক জীবন প্রকার তাদের সম্মুখে রেখে দিল। কল্পনীয় সমস্ত প্রকার মানব জীবনই তাদের মধ্যে ছিল। প্রত্যেক প্রকারের প্রতিটি জীবনের সাথে আয়ূস্কাল ও ভাগ্য বর্ণিত ছিল। সমস্ত আয়ূস্কাল ব্যাপী যে জীবন স্বৈরাচারী, তাও যেমন এখানে ছিল, তেমনি ছিল স্বৈরাচারী সেই জীবনও যার মধ্য পথে পতন ঘটে এবং সমাপ্তি ঘটে দারিদ্রে, নির্বাসনে কিম্বা ভিক্ষাবৃত্তিতে। দৌহিক সৌন্দয্যে মনোহর, কিম্বা শারিরীক ক্রীড়ায় পারদর্শী কিম্বা সুজাত বা অভিজাত পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত জীবনের নমুনারও অভাব ছিল না এবং এমন কোন সুনামের অধিকারী নয় তেমন জীবনও সেখানে ছিল। আর দারিদ্র এবং সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য এবং রোগ প্রত্যেক জীবনের সাথেই মিশ্রিত ছিল। জীবনের এই বৈচিত্র্যের সমাবেশ থেকে যার বেলায় যতগুলি জীবনের ধরণ অবশিষ্ট থাকবে, সে কেবল তা থেকেই বেঁছে নিতে পারবে।

মূলত: আত্মারা এখানে যা বাঁছাই করবে তা হল, আয়ূস্কাল, স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য্য, রিজিক, অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি-যশ:, রোগ-শোক, বিবাহ-সন্তানাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে ধর্ম ও ন্যায়ের পথ বাঁছাইয়ের সুযোগ সে পাবে দুনিয়াতে। আর তাই ভাষ্যকার এবার আত্মাদের উদ্দেশ্য করে বলল-‘যে আত্মা সকলের শেষে জীবন বাঁছাইয়ের সুযোগ পাবে, তারও চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা, তার জীবনের ধরণ যাই হোক না কেন, সফলকাম বা ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ সকলেরই সমান সমান। তারাই সফলকাম হয়ে আবার এই জগতে ফিরে আসতে পারবে, যারা দুনিয়াতে বিধাতার তরফ থেকে প্রদর্শিত সত্য ও সরল পথ গ্রহণে প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারবে। কাজেই, সবার প্রথমে যে জীবন নির্বাচন করছে, তার অধৈর্য্য হওয়ার কারণ নেই, সুচিন্তিত ভাবে নির্বাচন করুক সে তার জীবনকে এবং যে নির্বাচন করছে সবার শেষে, তারও হতাশ হবার কোন কারণ নেই।’

ভাষ্যকারের এ বক্তব্য সমাপ্ত হলে যে আত্মার বাজির সংখ্যা ১ম ছিল, সে এবার তার জীবন বাঁছাই করে নিল। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! ত্বরিৎ সে বাঁছাই করে নিল সর্বাধিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের এক জীবনকে। নিজের মূর্খতায় এবং ব্যগ্রতায় সে পরিপূর্ণরূপে বিচার করে দেখল না, কোন জীবনকে সে গ্রহণ করছে। তাই সে উপলব্ধি করতে পারল না, নিয়তির নির্দেশে এই জীবনে তাকে নিজের সন্তানকে হত্যা করতে হবে এবং অনুরূপ বহু অবর্ণনীয় আতঙ্ক তার ভোগ করতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্তের পর অবসর মুহূর্তে যখন সে চিন্তা করে দেখল, কি জীবনকে সে নির্বাচিত করেছে, তখন সে নিজের মূর্খতার জন্যে অনুতাপে বিদ্ধ হতে লাগল। অথচ তার এ দূর্ভাগ্যের জন্যে দায়ী অপর কেউ নয়। সে বিস্মৃত হয়েছিল ভাষ্যকারের সতর্কবাণী। ভাষ্যকার বলেছিল প্রত্যেক আত্মাই তার ভাগ্যের নিয়ামক। কাজেই নিজ ভাগ্যের জন্যে বিধাতা, ভাগ্যদেবী বা অপর কাউকে দায়ী করা অর্থহীন।

বস্তুত: স্বৈরাচারী জীবন নির্বাচনকারী এই আত্মাই নয়, অধিকাংশ আত্মাই জীবন নির্বাচনে বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারল না কেবলমাত্র অজ্ঞতার কারণে, বলা চলে ইতিপূর্বে দু:খের পরীক্ষায় পরীক্ষিত না হওয়ার কারণে। কিন্তু কিছু কিছু আত্মা যারা ইতিপূর্বে ‍পৃথিবী থেকে আগত কোন আত্মাদলের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছিল, জেনেছিল তাদের দূর্ভোগ, তারা নূতন জীবন নির্বাচনে তুলনামূলক ভাবে বিজ্ঞতার পরিচয় দিল। তারা ব্যগ্রতায় নয় বরং ধীর-স্থির ভাবে যথেষ্ট সময় নিয়ে জীবন নির্বাচন করল এবং তাদের জীবন তাদের জন্যে মঙ্গলকর হল। যেমন, বাজির সংখ্যা যার বিংশদশ ছিল, সে খুঁজে ফিরল সাদামাটা আটপৌরে এক জীবন। অবশেষে সে তা খুঁজে পেল এক কোনে, সেখানে পড়ে ছিল সেটি সকলের অবহেলায়। আর তা খুঁজে পেয়ে পরিতৃপ্তির এক হাসি দিয়ে সে ঘোষণা করল, যদি তার বাজির সংখ্যা প্রথমও হত, তবুও সে এ জীবনকেই বেঁছে নিত। প্রকৃতপক্ষে, আত্মাদের জীবন নির্বাচনের পর্বটি যথার্থই দেখার মত ছিল। এ দৃশ্য যেমন করুণার উদ্রেক করেছে, তেমনি হাস্যরস ও বিষ্ময়ের সৃষ্টি করেছে।

যা হোক, সকল আত্মার জীবন নির্বাচনের পর্ব সমাপ্ত হলে আত্মার দল তাদের বাজির সংখ্যার ধারাক্রমে একের পর এক ল্যাচেসিসের সম্মুখে উপস্থিত হল। এখন ল্যাচেসিস প্রত্যেক আত্মার নির্বাচিত পথপ্রদর্শক দেবদূতকে আত্মাদের জীবনপথ প্রদর্শণের নির্দেশ দিল। এতে দেবদূতগণ আত্মাদেরকে প্রথম নিয়ে গেল ক্লথোর নিকট। এভাবে তারা আত্মাদেরকে ক্লথো পরিচালিত চক্রের আবর্তের মধ্যে এনে তাদের নির্বাচিত ভাগ্যকে সুনির্দিষ্ট করে দিল। এই কার্য্য সমাধা করে দেবদূতগণ ক্লথোকে অভিবাদন জানিয়ে আত্মাদেরকে নিয়ে চলল চক্রের নিরলস চালনাকারী এ্যাটরোপসের নিকট। এ্যাটরোপস এবার নিয়তির সূত্রে আবদ্ধ করে আত্মার নির্বাচিত জীবনকে অপরিবর্তনীয় করে দিল।

অত:পর আত্মার দল পশ্চাৎ দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে অনিবার্যতার সিংহাসনের সম্মুখে এসে সমবেত হল। তারপর তারা সেখান থেকে যাত্রা করে অগ্রসর হতে হতে এক সময় পৌঁছে গেল বৃক্ষ-লতা-গুল্ম শুণ্য ‘লেথির সমতল ভূমি’তে। অবশ্য এখানে পৌঁছার পূর্বে তাদেরকে অতিক্রম করতে হয়েছিল এক দু:সহ শ্বাসরুদ্ধকর তাপের তেজকে।

অপরাহ্নে সকলে এসে শিবির স্থাপন করল ‘বিস্মৃতির নদী’র তটে। বিস্মৃতির এই নদীর পানিকে কোন পাত্রেই ধারণ করা চলে না। নিয়তির নির্দেশে সকল আত্মাকেই পান করতে হল এই পানি। যারা বিজ্ঞতার সাথে নিজেকে রক্ষা করতে পারল না, তারা এই পানি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পান করে ফেলল। এবার সকল আত্মা নিদ্রামগ্ন হল এবং পরলোকের সকল অভিজ্ঞতা বিস্মৃত হয়ে গেল। তারপর যখন মধ্যরাত্রি আগত, তখন ভূমির কম্পন শুরু হল এবং বজ্র্ নিঘোষিত হল। আর বিচ্ছুরিত তারকার মত এক বিপুল উৎক্ষেপনে সকল আত্মা পরলোক থেকে উৎক্ষিপ্ত হল ইহলোকে। মর্ত্যলোকে তাদের ঘটল নূতন অস্তিত্বের জন্ম।

বিস্মৃতির নদীর পানি পান করা এরের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেও বলতে পারেনি, কেমন করে, কোন উপায়ে সে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হল তার মৃত দেহের মধ্যে। তার এইমাত্র স্মরণ আছে হঠাৎ সে জীবন ফিরে পেল। তার চক্ষু উন্মীলিত হল, আর দেখতে পেল প্রত্যুষ হয়ে আসছে এবং সে শায়িত রয়েছে তার সমাধি শয্যায়।

আত্মার ধরণীতে গমনাগমনের ধারণা শেষে আবার আমরা মূল কাহিনীতে ফিরি-আল্লাহ মানবজাতিকে পথ প্রদর্শণের ব্যাপারে আদমকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তিনি পূর্ণ করেছেন। যুগে যুগে তিনি পথভ্রষ্ট মানুষকে পথ-নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁর নির্বাচিত দাস অর্থাৎ নবী-রসূলগণের মাধ্যমে। নাযিল করেছেন একের পর এক আসমানী কিতাব। নবী-রসূল হিসেবে আদমের পরে এসেছেন ইদ্রিস, নূহ, আইয়ূব, হুদ, সালেহ, জুলকারনাইন, ইব্রাহিম, লূত, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুর, ইউসূফ, শোয়েব, খিজির, মূসা, হারুণ, ইউশায়া, তালুত, দাউদ, শলোমন, ইলিয়াস, অরামিয়া, ইউনূচ, উজায়ের, দানিয়ূব, জাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা প্রমুখ ছাড়াও আরো লক্ষাধিক, যাদের নাম এখানে উল্লেখিত হয়নি এবং সর্বশেষ রসূল মুহম্মদ।

খোদায়ী বিধানে এবং রীতি-নীতিতে কোন রকম পরিবর্তন নেই-(৩৫:৪৩) মানুষের জন্যে তিনি দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা প্রত্যাদেশ করেছেন মুহম্মদের প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলেন ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, ‘তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কোরও না।’–(৪২:১৩) অর্থাৎ আদম থেকে মুহম্মদ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ পয়গম্বর খোদার একই বিধানাবলী এবং রীতি-নীতি প্রচার করেছেন। মানুষের অন্তর চৈতণ্য ও নৈতিক বোধের কাছে সর্বশেষ ‘ঐশী কিতাব’ কোরআনের আহবান এমনই আবেদনময়ী-

এ সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। এ যে ধর্মভীরুদের জন্যে সঠিক পথের সন্ধান। যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম রাখে, আল্লাহ যে রুজী তাদেরকে দান করেন তা থেকে খরচ করে এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর, যা কিছু মুহম্মদের উপর নযিল হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর, যা তার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখিরাত সম্পর্কে যারা আস্থাবান। এরাই তাদের পালনকর্তার পথগামী-এরাই যথার্থ সফলকাম।-(২:১-৫)

তোমাদেরকে কষ্টে ফেলার জন্যে আমি এই কোরআন নাযিল করিনি। এ তাদের জন্যেই সতর্কবাণী যারা ভয় করে। এই বাণী তাঁর নিকট থেকে এসেছে- যিনি সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী আর ঐ সুউন্নত আকাশ। যিনি পরম করুণাময় এবং আপন শক্তিতে অটুট। আসমান ও জমিনে অথবা উভয়ের মাঝখানে বা মাটির নীচে যা কিছু আছে-সকলের উপরে তাঁর সর্বময় প্রভুত্ব এবং তুমি যা প্রকাশ্যে ব্যক্ত কর তার গুঢ়মর্ম তিনি জানেন, আরও জানেন সেই কথা যা তুমি গোপন করে রাখ।-(২০:২-৮)

‘আমি সত্যসহ এ কোরআন নাযিল করেছি এবং সত্যসহ এটা নাযিল হয়েছে।-(১৭:১০৫) এতে মিথ্যের প্রভাব নেই সামনের দিক থেকেও পিছনের দিক থেকেও।-(৪১:৪২) এটা বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শণ করবে? এবং একে মিথ্যে বলাকেই তোমরা তোমাদের ভূমিকায় পরিণত করবে?’-(৫৬:৮০-৮২)

শপথ আত্মার এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।-(৯১:৭-৮) বস্ততঃ আল্লাহ মানুষকে দু‘টি পথ প্রদর্শণ করেছেন-একটি সত্য সরল পথ ও অন্যটি পথভ্রষ্ট শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ। সত্য সরল পথ হচ্ছে দুর্ভিক্ষের দিনে অন্ন দান এতীম আত্মীয়কে অথবা ধূলি ধুসরিত মিসকীনকে। অতঃপর তাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার।-(৯০:১০-১৭)

‘আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কূ-চিন্তা করে সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী থাকি, যখন দুই ফেরেস্তা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে।’ -(৫০:১৬-১৭)

মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।-(৫০:১৮) যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফল হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।-(৯১:৯-১০)

‘অতঃপর যখন কারও প্রাণ কন্ঠাগত হয় এবং তোমরা তাকিয়ে থাক, তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। যদি তোমাদের হিসেব কিতাব না হওয়াই ঠিক হয়, তবে তোমরা এই আত্মাকে ফিরাও না কেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও?’

‘যদি সে নৈকট্যশীলদের একজন হয়; তবে তার জন্যে আছে সুখ, উত্তম রিজিক এবং নেয়ামতে ভরা উদ্যান। আর যদি সে ডান পার্শ্বস্থদের একজন হয়, তবে তকে বলা হবে, সালাম। আর যদি সে পথভ্রষ্ট মিথ্যা আরোপকারীদের একজন হয়, তবে তাকে আপ্যায়ণ করা হবে উত্তপ্ত পানি দ্বারা এবং সে নিক্ষিপ্ত হবে অগ্নিতে।
এটা ধ্রুব সত্য।’-(৫৬:৮৩-৯৫)

‘আমার দায়িত্ব পথ প্রদর্শণ করা। আর আমি মালিক ইহকাল ও পরকালের। অতএব তারা বাক-বিতন্ডা ও ক্রীড়া-কৌতুক করুক সেই দিবসের সম্মুখীণ হওয়া পর্যন্ত, যে দিবসের ওয়াদা তাদের সাথে করা হচ্ছে।’

‘নভঃমন্ডল, ভূ-মন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু আমি যথাযথ ভাবেই এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছি।’-(৪৬:৩) ‘সূর্য্য তার নির্ধারিত স্থানের উদ্দেশ্যে পথ পরিক্রমায় নিরত। এ মহা-পরাক্রমশালী সূবিজ্ঞ সত্ত্বারই নির্ধারিত ব্যবস্থা।’-(৩৬:৩৮)-আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে এ সত্যতা আমাদের নিকট উপলব্ধ। সূর্যের জ্বালানী এক সময় শেষ হবে, ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে তাপ ও আলো। সূর্যের ঐ শেষ পরিণতির সময় পৃথিবী আঁধার হয়ে আসবে, জীবনের অস্তিত্বের সমাপ্তি ঘটতে থাকবে। সূর্য্য তার ঐ শেষ গন্তব্য ‘সোলার এপেক্স’ এর দিকে সেকেন্ডে বার মাইল বেগে ধাবিত হচ্ছে। বস্তুতঃ গোটা সৌরমন্ডল মহাশুণ্যে অবস্থিত ‘কন্সটেলেশন অব হারকিউলিস’ (আলফা-লাইরি) নামক একটি কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

যা হোক, খোদা আদম-হাওয়াকে ‘আশ্রাফুল মখলুকাত’ এর মর্যাদা দিয়ে মাগনা স্বর্গে বসবাস করতে দিয়েছিলেন। অত:পর শয়তান ইবলিসের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের কারণে তারা সেখান থেকে বিতাড়িত হয়। তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীতে।

বস্তুত: আদম সন্তানের জন্যে স্বর্গবাস আর মাগনা রইল না। খোদা জানিয়ে দেন তারা কিছু কালের জন্যে পৃথিবীতে বসবাস করবে এবং তাদেরকে তাঁর দেয়া বিধি-নিষেধ মেনে চলে ‘লাভ সংগ্রহ’ করতে হবে। অত:পর তাদের মৃত্যু হবে। এরপর পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে এবং বনি আদম তাদের প্রভুর সমীপে নীত হবে হিসাব-নিকাশের জন্যে। তারপর কর্মফল অনুযায়ী তারা চিরস্থায়ী বসবাসের জন্যে স্বর্গে বা নরকে স্থান লাভ করবে। আর সেখানে তারা তেমনি থাকবে যেমনটা হোমার তার কাব্যে উল্লেখ করেছেন-‘স্বর্গপুরীতে ন্যায়বান সোফায় শায়িত এবং বিরামহীন শুরাপানে মত্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করবে। আর তারা সেখানে পুত্র-কন্যা-স্ত্রী সহ পুরো পরিবার নিয়ে বংশ পরস্পরায় বেঁচে থাকতে পারবে। অন্যদিকে অন্যায়কারী হলে তাকে পাতালপুরী বা নরকে নিয়ে একটা জলাভূমির পঙ্কে ডুবিয়ে দেয়া হবে অথবা তাদের ভাগ্যে জুটবে চালুনি ভরে পানি বহন করার পরীক্ষা।’

অন্যদিকে অপর বহি:স্কৃত ইবলিস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় খোদার বিধানাবলীর বিপরীতে দুনিয়াতে আদম সন্তানদের নিকট পাপকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদেরকে বিপথগামী করার, যাতে তারা চিরদিনের জন্যে স্থান লাভ করে নরকে, যেখানে তার স্থান নির্ধারিত হয়েছে। ভূমিকা হিসেবে এ পর্যন্ত যা উপস্থাপন করা হয়েছে এই হচ্ছে তার সার-সংক্ষেপ।

যদি কোন মানুষের নিকট এই প্রস্তাব রাখা হয়- ‘তোমার সামনে দু‘টি গৃহ আছে-একটি সুউচ্চ প্রাসাদ, যা যাবতীয় বিলাস সামগ্রী দ্বারা সুসজ্জ্বিত ও অপরটি মামুলি কুঁড়ে ঘর, যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সামান্যই আছে। এখন হয় তুমি প্রাসাদোপম এই বাংলো গ্রহণ কর, কিন্তু কেবল এক মাসের জন্যে; না হয় এই কুঁড়ে ঘর, যা তোমার চিরস্থায়ী মালিকানায় থাকবে।’ -বুদ্ধিমান মানুষ দু‘টির মধ্যে কোনটিকে প্রাধান্য দেবে?

আর মানুষ তো একে অন্যের সঙ্গে আচার ব্যবহারে নূরে পূর্ণদের চেয়েও বেশী বুদ্ধিমান, আদম কি জ্ঞানে ফেরেস্তাদেরকে পেছনে ফেলেনি? তাছাড়া এর উদাহরণে বাইবেলেও এক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে-

কোন এক ধনী ব্যক্তির প্রধান কর্মচারীর বিরুদ্ধে লোকেরা কানা-ঘুষা করছিল যে, সে তার মনিবের ধন-সম্পদ অপচয় করছে। এক সময় মনিবের কানেও কথাটা গেল। তখন তার মনিব তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সম্বন্ধে আমি এসব কি শুনছি? তোমার কাজের হিসেব দাও, কারণ তুমি আর আমার কর্মচারী থাকতে পারবে না।’

কর্মচারীটি মনে মনে ভাবল, ‘আমি এখন কি করি? মনিব তো আমাকে চাকরী থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। মাটি কাটার শক্তি আমার নেই, আবার ভিক্ষে করতেও লজ্জা লাগে। সুতরাং চাকরী থেকে বরখাস্ত হলে, লোকে যাতে আমাকে তাদের গৃহে আশ্রয় দেয়, সেজন্যে এখনই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’

ঐ কর্মচারী সেদিনই তার মনিবের কাছে ধারিত প্রত্যেককে ডাকল। তারপর সে প্রথম জনকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মনিবের কাছে তোমার ধার কত?’
সে বলল, ‘এক’শ মন তেল।’
কর্মচারী বলল, ‘এখনই তোমার হিসেবের খাতাটা বের কর এবং সেখানে পঞ্চাশ লেখ।’
তারপর সে আর একজনকে বলল, ‘তোমার ধার কত?’
সে বলল, ‘নয়’শ মন গম।’
কর্মচারী বলল, ‘তোমার হিসেবে সাত’শ বিশমন লেখ।’ এভাবে সকলের হিসেব সে সংশোধন করে দিল।

এরপর ঐ কর্মচারী সকল ধারিতদের উপস্থিতিতে মনিবকে তার হিসেবপত্র বুঝিয়ে দিল। সেই সময় ধারিত প্রত্যেকে ঐ মনিবের সামনে কর্মচারীটির ভূয়সী প্রশংসা করল। কর্মচারীটি অসৎ হলেও বুদ্ধি করে কাজ করাতে ধারিতরা তার প্রশংসা করতে বাধ্য হল। আর এত সব প্রশংসা শুনে মনিব তাকে চাকুরীতে বহাল রাখলেন। এতে কি বোঝা যায় না যে, এই দুনিয়ায় লোকেরা নিজেদের মত লোকদের সঙ্গে আচার ব্যবহারে নূরে পূর্ণ লোকদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান?’

তাই মানুষকে উপদেশ দেয়া হয়েছে তারা যেন তাদের বুদ্ধি খাটায়, দুনিয়ায় ধন দিয়ে লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, যেন সেই ধন ফুরিয়ে গেলে, চিরকালের থাকবার জায়গায় তাকে গ্রহণ করা হয়।’

অন্যদিকে, যদি পরকালের নেয়ামত উৎকৃষ্ট নাও হত, তবুও চিরস্থায়ী হওয়ার কারণে তাই অগ্রাধিকারের যোগ্য ছিল। আর বাস্তব এই-পরকালের নেয়ামত শুধু স্থায়ীই নয়, দুনিয়ার তুলনায় অতি উৎকৃষ্ট বটে। কোরআনে বলা হয়েছে-এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক বৈ তো নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন।-(২৯:৬৪) বস্তুতঃ মানুষ পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।-(৮৭:১৬-১৭)

আবার ধরা যাক, কেউ যদি জানতে পারে কোন এক ক্ষেতের মধ্যে গুপ্তধন আছে, তবে কি সে সর্বস্ব বিক্রয় করে সেই ক্ষেত ক্রয় করবে না? আর নিশ্চয়ই মুমিনদের পরকালের বাসস্থান, বেহেস্ত হচ্ছে এই গুপ্তধনতুল্য।

মানুষ দুনিয়াতে আসে শুণ্য হাতে, ফিরেও যায় শুণ্য হাতে। এখানকার ধন-সম্পদ আল্লাহর দান, কেবল এখানেই ব্যবহারের নিমিত্তে। তথাপি মানুষ আল্লাহর রাহে এর ব্যবহারে এত কৃপণতা করে। অথচ সামান্য দানে পরকালে প্রাপ্তি শতগুনে। জমিতে এক মুষ্ঠি গম বপন করলে কি তা শত মুষ্ঠি ফিরিয়ে দেয় না? দান এমনই। তদুপরি মানুষ দুনিয়াতে কেবল তাদের ভোগের জন্যে সম্পদ আহরণে এবং তা সঞ্চয়ে সচেষ্ট থাকে, যদিও তারা জানে না তার কতটুকু তারা ভোগ করতে পারবে। বাইবেল তথা ইঞ্জিলে নিজ ভোগের জন্যে সঞ্চয়কারীকে সতর্ক করা হয়েছে এভাবেই-

“কোন এক ধনী লোকের জমিতে অনেক ফসল হয়েছিল। এ জন্যে সে মনে মনে বলতে লাগল, ‘এত ফসল রাখার জায়গা তো আমার নেই। আমি এখন কি করি? আচ্ছা আমি এক কাজ করব! আমি আমার গোলাঘরগুলি ভেঙ্গে ফেলে বড় বড় গোলাঘর তৈরী করব এবং আমার সমস্ত ফসল ও ধন সেখানে রাখব। পরে আমি নিজেকে নিজে বলব, ‘অনেক বৎসরের জন্যে অনেক ভাল ভাল জিনিষ জমা করা আছে। আরাম কর, খাওয়া দাওয়া কর, আমোদ-আহলাদে দিন কাটাও।’

সে যখন এসব ভাবছিল সেই সময় খোদা তাকে বললেন, ‘ওহে বোকা! আজ রাতেই তোমাকে মরতে হবে। তাহলে যে সমস্ত জিনিষ তুমি জমা করার কথা ভাবছ, সেগুলি কে ভোগ করবে?’”-(লুক ১২:১৬-২০) -এমনিই হচ্ছে, সম্পদ আহরণ ও ভোগ-সম্ভারে লিপ্ত মানুষ হঠাৎ-ই টুপ করে অক্কা পাচ্ছে। পরকালের প্রাপ্তির খাতা রয়ে যাচ্ছে ফক-ফকা কোরা কাগজ। আল আনসারী তাই বলেন-

O my friend, behold yon cemetery, and see
how many tombs and graves there be;
how many hundred thousand delicate
ones there sleep
in slumber deep.

Much toiled they every one and strove,
and feverishly burned with barren hope
and selfish love,
and shining garments jewel-sprinkled wove.

Jars of gold and silver fashioned they,
and from the people profit bore away,
much trickery revealing, and great moneys stealing;
but, at the end, with a full regretful sigh
they laid them down to die.

Their treasuries they filled,
and in their hearts well-tilled
planted the seed
of lustful greed;
but, at the last,
from all these things they passed.

So burdened, suddenly
at the door of death they sank,
and there the cup of destiny they drank.
my friend, ponder well thy dissolution,
and get thee betimes thine absolution;
or, know it full well,
thou shalt in torment dwell. -[al-Ansari of Herat]

জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে মানুষ ধর্ম বিমুখ হচ্ছে। এক দল হয়ে যাচ্ছে পরিপূর্ণ নাস্তিক ( একজন ক্রিশ্চিয়ান তার ধর্মবিমুখতার কারণ হিসেবে বলেছে- “The joy of being an atheist is that I can put my mind to things that have no wishful thinking, myth making or pie-in-the-sky stories. Virgin birth? Rising from the dead? Ascending into heaven with two prophets accompanying him? Walking on water? Raising a dead man into life again? -As my young relative often says "for cripes sake, give me a break."

আর বিজ্ঞান মনস্ক অপর এক নারীর মন্তব্য এমন-“I want my kids to learn about real, worthwhile stuff that’s grounded in logic and reason. Like how a virgin had a magic baby in a stable, and some men arrived with presents after following a UFO.” Extraordinary that we're still discussing this nonsense in the 21st century.)। আর তাই তাদের কাছে পরকাল হচ্ছে আদ্দি কালে বদ্দি নাথের গল্পের মত। অর্থাৎ “পরকাল থাকলেই তো পরকালের ভয়!” এটা কিন্তু তাদের কেবল মুখের কথা, সত্যিকার অর্থে তারা ভীত হয়ে পড়ে বৃদ্ধ বয়সে। পরকালে শাস্তি বা পুরস্কার লাভের যে কাহিনী সারাজীবন তাদের কাছে ছিল পরিহাসের বস্তু ঐ সময় তা হয়ে পড়ে চরম উৎকন্ঠা ও আতঙ্কের বিষয়।

জৈন ধর্মমতে ইহলোক ও পরলোক
পরলোকের সান্নিধ্য বা বয়সের আধিক্য–যে কারণেই হোক না কেন, বৃদ্ধ বয়সে একজন নাস্তিকের পরলোক সম্পর্কে দৃষ্টিটি বেশ পরিস্কার হয়ে যায়, উদ্বেগ ও আতঙ্কে তাই সে অস্থির হয়ে পড়ে। আর যদি সে দেখে তার জীবনে অন্যায়, অবিচার ও পাপের পরিমান নেহায়েত কম নয়, তখন নিদ্রা তার হারাম হয়ে যায়, নানা রকম দু:সপ্ন দেখে সে চমকে উঠে, এক ধরণের ভীতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

অন্যদিকে আস্তিক এবং মুমিন বৃদ্ধ বয়সে যথেষ্ট শান্তিতে মরতে পারে। কেননা, পরকাল না থাকলেও তার অন্তত: হারাবার কিছু নেই। তাছাড়া, পরকালে বিশ্বাস তাকে ন্যায়বান হতে সাহায্য করেছে, বিধাতার সঙ্গে তার সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। তার এই আত্মতৃপ্তি থাকে যে, তার প্রাপ্তির খাতা মোটেও শুণ্য নয়। তাই পরকালের পথে আশাই তাকে ভরষা দিতে থাকে। মৃত্যুর সময়ও যেমন সে উদ্বেগহীন থাকে, নিশ্চিতভাবে বিচার দিনে ও বিধাতার সম্মুখেও সে তেমনি উদ্বেগহীন থাকবে।

কিন্তু আস্তিকদের নানান দল-উপদল। তাদের এক দল জগৎ সংসারের চাপ নিয়ে এতই বেসামাল যে, পরকালের কথা ভাববার ফুসরত নেই! তারা ধর্ম-কর্ম করে যাচ্ছে অনেকটা দায়সারা ভাবে। আর এক দল খোদায়ী গ্রন্থ পিছনে ফেলে রেখে অন্ধের মত অনুসরণ করে চলেছে পিতৃপুরুষদের রেখে যাওয়া নানান ধর্মপথ, আর বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছে একে অপরের ধর্ম বা মতাদর্শ নিয়ে।

ইতিপূর্বে এসব মানুষেরই একদল তো রসূলদের উপরও মিথ্যে আরোপ করেছে, তাদেরকে পাগল ভেবেছে, এমন কি তাদের অনেককে হত্যাও করেছে। নিশ্চয় সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তণ করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তারা আজ মতবিরোধ করছে।-(৫:৪৪-৪৮)

আস্তিকদের অপর আর একদল তো সৃষ্টিকর্তার উপরও অপবাদ আরোপ করে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে কোন মাবুদ নেই, থাকলে প্রত্যেক মাবুদ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে চলে যেত এবং একজন অন্য জনের উপর প্রবল হয়ে যেত।-(২৩:৯১) যদি তাঁর সাথে অন্যান্য উপাস্য থাকত; তবে তারা আরশের মালিক পর্যন্ত পৌঁছার পথ অন্বেষণ করত।-(১৭:৪২) এবং উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত।-(২১:২২) এক ব্যক্তির উপর পরস্পর বিরোধী কয়েকজন মালিক রয়েছে, আরেক ব্যক্তির প্রভু মাত্র একজন-তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? মানুষ কি বোঝে না?-(৩৯:২৯) নিশ্চয় সকলের মৃত্যু হবে। অতঃপর পুনরুত্থান দিবসে তারা সকলে পরস্পর পরস্পরের সাথে পালনকর্তার সামনে কথা কাটা-কাটি করবে।-(৩৯:৩০-৩১)

ধর্মাচারী মানুষের এই সব নানান রূপ ইঞ্জিলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে-এক চাষী বীজ বুনল। বোনা বীজের কিছু পথের পাশে, কিছু পাথুরে জমিতে, কিছু কাঁটা বনে আর কিছু ভাল জমিতে পড়ল।

যে বীজগুলো পথের পাশে পড়েছিল, তার কিছু পাখী এসে খেয়ে ফেলল এবং অবশিষ্ট গুলি অঙ্কুরিত হলে লোকেরা তা পায়ে মাড়িয়ে ফেলল। যে বীজ গুলো পাথুরে জমিতে পড়েছিল, তা অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে উঠল বটে কিন্তু রস না পেয়ে একসময় শুকিয়ে গেল। যে বীজগুলো কাঁটা বনের মধ্যে পড়েছিল, তা অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে উঠলে কাঁটাগাছ সেগুলিকে চেপে রাখল। আর যে বীজগুলো ভাল জমিতে পড়ছিল, তার সবগুলিই অঙ্কুরিত হয়ে সাবলীল ভাবে বেড়ে উঠল এবং একসময় এক’শ গুন ফসল দিল।

এখানে বীজ-খোদার কালাম, চাষী-রসূল। আর পথের পাশে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, যারা সেই বাণী শুনে বটে কিন্তু পরে শয়তান এসে তাদের অন্তর থেকে তা তুলে নিয়ে যায়, তাতে তারা ঐ বাণীর উপর ঈমান আনতে পারে না বলে উদ্ধার পায় না।

-পাথুরে জমিতে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, যারা সেই বাণী শুনে আনন্দের সাথে গ্রহণ করে বটে কিন্তু তাদের অন্তরে তার শিকড় ভাল করে বসে না বলে যখনই পরীক্ষা আসে তারা পিছিয়ে যায়, ফলে উদ্ধার পায় না।

-কাঁটা বনের মধ্যে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, যারা তা শুনে কিন্তু জীবন পথে চলতে চলতে সংসারের চিন্তা-ভাবনা, ধন-সম্পত্তি ও সুখ-ভোগের মধ্যে তারা চাপা পড়ে যায়, ফলে উদ্ধার পায় না।

-আর ভাল জমিতে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, যারা সৎ ও সরল মনে তা শুনে শক্ত করে ধরে রাখে এবং তাতে স্থির থেকে জীবনে পাকা ফল দেখায়। মানুষের মধ্যে এদলই মুমিন এবং এরাই সফলকাম।

যা হোক, যা বলছিলাম-সকলের মৃত্যু হবে অত:পর পুনরুত্থান ঘটবে এবং সকলে প্রভুর সম্মুখে নীত হবে জবাবদিহিতার জন্যে। আর মৃত্যুর পরের জীবন তথা পরকাল শুরু হবে কেবল কেয়ামত সংঘটিত হবার পর, যখন ২য় বার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। তবে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় কেবল সূর্যের জ্বালানী শেষ হলেই হবে, এমনটা সুনিশ্চিত করেনি আসমানী কিতাব। বরং বলা হয়েছে, সংঘটনের সময়কাল কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আর তা মানুষের উপর এসে পড়বে অতর্কিত ভাবে। তবে তার আগে কিছু আলামত বা চিহ্ন দেখা যাবে। কোরআন দু’টি আলামতের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভূ-গর্ভ থেকে অদ্ভূত এক জীব নির্গত হওয়া- ‘যখন প্রতিশ্রুত কেয়ামত সমাগত হবে, তখন আমি মানুষের সামনে ভূ-গর্ভ থেকে একটি জীব নির্গত করব। সে মানুষের সাথে কথা বলবে। এটা এ কারণে যে, মানুষ খোদায়ী নিদর্শণ সমূহে বিশ্বাস করত না।’ -(২৭:৮২)

যতদূর জানা যায়, ঐ জীবটি সাধারণ প্রাণীদের প্রজনন প্রক্রিয়া মোতাবেক জন্মগ্রহণ করবে না, বরং হঠাৎ-ই ভূ-গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসবে। সম্ভবত: এটি মক্কার সাফা পর্বত থেকে বেরিয়ে মাথার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে কা’বা গৃহের ‘কৃষ্ণ-প্রস্তর’ বা ‘হজরে আসওয়াদ’ ও ‘মকামে ইব্রাহিম’ এর মাঝে পৌঁছে যাবে। মানুষ একে দেখে পালাতে থাকবে, কিন্তু কেউই তার নাগালের বাইরে থাকতে পারবে না। এক সময় সে ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণ করতে শুরু করবে এবং সমগ্র বিশ্ব পরিভ্রমণ করবে। সে মুমিন ও অবিশ্বাসীদেরকে চিনবে এবং তাদের সকলের সাথে কথা বলবে এবং প্রত্যেক অবিশ্বাসীর ললাটে একটি বিশেষ চিহ্ন এঁকে দেবে। সে অনেক নিদর্শণ দেখাবে।

আর ২য়টি হচ্ছে ‘ইয়াজুজ-মাজুজ’। এরা একদা পাহাড়ের গুহায় নিরাপদে বসবাস করত এবং লোকালয়ে বেরিয়ে এসে সর্বদা অশান্তি সৃষ্টি করত; সাবার বাদশা জুলকারনাইনের এক সফর এমন এক স্থানে শেষ হয় যেখানকার অধিবাসীগণ দু‘পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে বাস করছিল। আর তারা ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল। তারা দিগ্বিজয়ী সম্রাটের সাক্ষাৎ পেয়ে আশান্বিত হয়ে দল বেঁধে এল। কিন্তু তাদের ভাষা জুলকারনাইন বুঝতে পারছিলেন না। আবার তার কথাও তারা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা ইঙ্গিতে যে আবেদন রাখল তার সারমর্ম হল- ‘হে জুলকারনাইন! ইয়াজুজ-মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি কর এই শর্তে দেব যে, আপনি আমাদের ও ওদের মাঝে এক প্রাচীর গড়ে দেবেন?’

তাদের কথার অর্থ বুঝতে পেরে জুলকারনাইন বললেন, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই উত্তম। সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর, আমি তোমাদের ও ওদের মাঝে এক মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। প্রয়োজনীয় মালের আঞ্জাম তোমরাই দেবে, তবে আমি তোমাদেরকে তার মূল্য পরিশোধ করে দেব।’
তারা বলল, ‘আমরা কি মাল আনব?’
তিনি বললেন, ‘প্রথমে তোমরা আমার কাছে লোহার তাল ও শুকনো কাঠ বা কয়লা নিয়ে এসো।’

লোকেরা লোহার তাল, কাঠ ও কয়লা নিয়ে এল এবং সেগুলি দু‘পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে উঁচু করে সাজিয়ে রাখল। এতে মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা পূর্ণ হয়ে পাহাড়ের সমান হল। অতঃপর তাতে আগুন লাগিয়ে দিলে জুলকারনাইন লোকদেরকে বললেন, ‘তোমরা হাপরে দম দিতে থাকো।’ যখন লোহা জ্বলন্ত অঙ্গারের মত হল তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা গলানো তামা নিয়ে এসো আমি তা ওর উপর ঢেলে দেব।’

অতঃপর গলিত তামা লোহার উপর ঢেলে দিয়ে এক মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করা হল। এরপর ইয়াজুজ-মাজুজ ঐ প্রতিবন্ধক পার হতে পারল না বা ভেদ করতেও পারল না।

জুলকারনাইন বললেন, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন, আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।’

আর যেদিন খোদা ঐ প্রতিবন্ধক দূর করবেন, সেদিন ওরা দলে দলে তরঙ্গের আকারে বেরিয়ে আসবে।-(১৮:৯২-৯৯) প্রত্যেক উচ্চ ভূমি থেকে দ্রুত বেগে ছুটে আসবে।-(২১:৯৬)

আর এসব আলামতের পর আসবে সেই মহাপ্রলয়ের দিনগুলো। এদিন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব গোষ্ঠী! তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে একটু চিন্তা কর। তোমাদের অস্তিত্ব, তোমাদের স্থায়িত্ব। তোমাদের ক্ষমতা, এ তো সামান্য কারণে ধ্বংস প্রাপ্ত। তোমরা তো সামান্য কারণে ভয় পেয়ে থাক, অথচ কেয়ামত দিবসের কম্পন খুবই ভয়াবহ ও কঠিন হবে। পাহাড়-পর্বত যা কিছু আছে, সবই কম্পনের ফলে ধূঁয়ার ন্যায় উড়ে যাবে। হে মানব সম্প্রদায়! ঐদিন তোমরা স্বচক্ষে দেখতে পাবে। সেদিন সকল জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’

আমি পৃথিবীস্থ সবকিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি এবং তার উপর যা কিছু রয়েছে, অবশ্যই তা আমি উদ্ভিদ শূন্য মাটিতে পরিণত করে দেব।-(১৮:৭-৮) সেদিন সূর্য্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে।–(৭৫:৯) পাহাড় সমূহকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া হবে। পৃথিবীকে করা হবে মসৃণ সমতল ভূমি। তাতে তোমরা কোন মোড় ও টিলা দেখতে পাবে না।-(২০:১০৫-১০৬)

যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে-একটি মাত্র ফুৎকার, সেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে।-(৬৯:১৩) শিঙ্গার ঐ ফুৎকার ভয়াবহ শব্দের আকারে মানুষকে আঘাত করবে তাদের পারস্পরিক বাক-বিতন্ডা কালে।–(৩৬:৪৯) সেদিন পর্বতমালা উত্তোলিত হবে ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে,-(৬৯:১৪) অত:পর তা হয়ে যাবে ধুনিত রঙ্গীন পশমের ন্যায়।-(১০১:৫) সেদিন মানুষ বলবে, ‘পালানোর জায়গা কোথায়?’-(৭৫:১০)

কেয়ামত আসবে অতর্কিত ভাবে, অতঃপর মানুষকে তা হতবুদ্ধি করে দেবে, তখন তারা তা রোধ করতেও পারবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না।-(২১:৪০) সেদিন আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছে করবেন, তারা ব্যতিত নভঃমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যারা আছে, তারা সবাই ভীত-বিহব্বল হয়ে পড়বে।-(২৭:৮৭) আকাশ বিদীর্ণ হবে, আর তা রক্তবর্ণে রঞ্জিত চামড়ার মত হয়ে যাবে।-(৫৫:৩৭) প্রবল ভাবে প্রকম্পিত হবে পৃথিবী এবং পর্বতমালা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। তারপর তা হয়ে যাবে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণা।-(৫৬:৪-৬)

শিঙ্গায় দেয়া ফুঁক তো হবে কেবল এক মহানাদ।-(৩৭:১৯) তা হবে কর্ণবিদারী, ফলে আসমান ও জমীনে যারা আছে, সবাই বেঁহুস হয়ে যাবে।-(৩৯:৬৮) নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন হবে একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন মানুষ তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে বিষ্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটাবে এবং মানুষকে দেখাবে মাতালের মত; অথচ তারা মাতাল নয়।-(২২:১-২) মোটকথা, আসমান ও জমিনের জন্যে কেয়ামত হবে অতি কঠিন বিষয়।–(৭:১৮৭)

সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত।-(১০১:৩-৪) তারা পলায়ন করবে তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে।-(৮০:৩৩-৩৬) বন্ধু, বন্ধুর খোঁজ নেবে না, যদিও একে অপরকে দেখতে পাবে। আর গোনাহগার পণ স্বরূপ দিতে চাইবে তার সন্তান-সন্তুতিকে, তার স্ত্রীকে, তার ভ্রাতাকে, তার গোষ্ঠীকে, যারা তাকে আশ্রয় দিত এবং পৃথিবীর সবকিছুকে, অতঃপর নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে।-(৭০:৯-১৪) কেয়ামত হবে ঘোরতর বিপদ ও তিক্ততার।-(৫৪:৪৬)

সেদিন সূর্য্য আলোহীন হয়ে যাবে, নক্ষত্র মলিন হয়ে যাবে, পর্বতমালা অপসারিত হবে; দশ মাসের গর্ভবতী উষ্ট্রী সমূহ উপেক্ষিত হবে, বন্য পশুরা একত্রিত হয়ে যাবে, সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে।-(৮১:১-৬) আকাশ হবে গলিত তামার মত এবং পর্বত সমূহ হবে রঙ্গীন পশমের মত।-(৭০:৮) আকাশ ধূঁয়ায় ছেয়ে যাবে -(৪৪:১০) অগ্নি স্ফূলিঙ্গ ও ধুম্রকুঞ্জ মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে, আর তারা সেসব প্রতিহত করতে পারবে না।-(৫৫:৩৫) এটা হবে এমন দিন, যেদিন কেউ কোন কথা বলবে না এবং কাউকে তওবা করার অনুমতিও দেয়া হবে না।-(৭৭:৩৫-৩৬) মানুষ সেদিন না তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, না জ্বিন।-(৫৫:৩৯) কেয়ামত হবে ভয় প্রদর্শণের দিন।-(৫০:২০)

আল্লাহর সত্ত্বা ব্যতিত সবকিছুই ধ্বংস হবে।-(২৮:৮৮) কারো কি জানা আছে শিঙ্গার এ আওয়াজ কতক্ষণ স্থায়ী হবে? এ আওয়াজ প্রথম যেদিন প্রাত:কালে আরম্ভ হবে, সেদিন থেকে সবকিছু একে একে ধ্বংস হবার পর পূর্ণ ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হবে। আর এ সময়কালে আকাশকে গুটিয়ে নেয়া হবে, যেমন গুটান হয় লিখিত কাগজপত্র। অত:পর যেভাবে খোদা প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন, সেভাবে পুন:রায় সৃষ্টি করবেন। তাঁর ওয়াদা সত্য-সুনিশ্চিত।-(২১:১০৪)

অতঃপর মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম ফেরেস্তা ইস্রাফিলকে পুন:রায় জীবিত করবেন। তারপর তিনি তাকে ২য় বার শিঙ্গায় ফুঁক দেবার জন্যে আদেশ করবেন। এই উভয় বার শিঙ্গা ফুঁকার মাঝে চল্লিশ বৎসরকাল ব্যবধান হবে। (“...there shall be darkness over the world forty years, God alone being alive, to whom be honour and glory forever.” -Gospel of Barnabas-Ch-54) মহাপ্রলয়ের সময় সমুদ্রের সমস্ত পানি, যা বাষ্পাকারে বায়ূ মন্ডলে সংগৃহীত হয়েছিল, সূর্য্য না থাকার কারণে শৈত্যে এই সময়কালে তা অবিরাম বৃষ্টিপাতের আকারে ঝরে পড়তে থাকবে এবং ধীরে ধীরে মৃত মানুষ ও জীব-জন্তুর দৈহিক কাঠামো তৈরী হবে। ইস্রাফিল ২য়বার শিঙ্গায় ফুঁক দিলে, নূতন অবয়বে আসমান সৃষ্টি হবে, আর ঐ সকল দেহে আত্মা এসে যাবে। সকল মখলুকাতই পুনরুজ্জীবন লাভ করবে। ভূ-গর্ভ থেকে মানুষ মাথার ধূলো-মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াবে এবং মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে সম্মুখ পানে ছুটে যাবে।

আজ আমরা জানি, মানুষের মস্তিস্কের কেবল দুই থেকে পনের ভাগ দুনিয়াতে ব্যবহৃত হয়। আর ঐদিন হবে শতভাগ কর্মক্ষম, উজ্জীবিত। সুতরাং উত্থিত হবার পর মুহূর্তেই তারা বুঝতে পারবে, নশ্বর, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ক্ষণকাল কাটিয়ে অনন্ত জীবনে প্রবেশ করেছে তারা। ঐ সময় মানুষের অনুভূতি হবে প্লেটোর সেই গুহা মানবের অনুভূতির মত, যারা জন্ম থেকে কেবলমাত্র গুহার দেয়াল গাত্রে আগুণের আলোয় বস্তু সমূহের প্রতিবিম্বিত ছায়া দেখেছে, অত:পর তাদের কেউ মুক্ত হয়ে সূর্যালোকে যখন প্রকৃত বস্তুসমূহ দেখে।

যা হোক, মূলত: বিচার দিবস শুরু হবে ইস্রাফিলের ২য় বার শিঙ্গায় ফুঁক দেবার মধ্য দিয়ে। এই ফূঁৎকারও হবে এক মহানাদ। অত:পর আল্লাহ সর্বপ্রথম ফেরেস্তাদেরকে পুনর্জ্জীবিত করবেন। তারপর পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হবে এবং আল্লাহর আদেশে সে তার গর্ভস্থ সবকিছু বাইরে নিক্ষেপ করে শুন্যগর্ভ হয়ে যাবে।-(৮৪:৩-৫) অর্থাৎ কবরসমূহ উন্মোচিত হবে।-(৮২:৪) এবং তাতে যা আছে তা উত্থিত হবে।-(১০০:৯) বস্তুতঃ সে উত্থান হবে এক বিকট শব্দের মধ্য দিয়ে।-(৩৭:১৯)

সকল মানুষ কবর থেকে অবনমিত নেত্রে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মত-(৫৪:৭) ছুটোছুটি করে বের হয়ে আসবে।-(৫০:৪৪) এটা এমন হবে যেমনটা হয় মৃত জমিন (শুকনো ঠনঠনে) থেকে বৃষ্টির পর উদ্ভিদের উদ্গমন। অর্থাৎ যেভাবে মৃতজমিন থেকে জীবন বের হয়ে আসে, সেভাবেই পুনরুত্থান হবে কবর হতে।-(৫০:৯-১১) এসময় ফেরেস্তাদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হবে।-(২৫:২৫)

কবরের মধ্য থেকে মানুষ আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে বের হয়ে আসবে।-(১৭:৫২) তারা বের হয়ে আসবে দ্রুত বেগে, দেখলে মনে হবে, তারা যেন কোন লক্ষ্য বস্তুর পানে ছুটে চলেছে। তাদের দৃষ্টি থাকবে অবনমিত; তারা হবে হীনতাগ্রস্থ। এরপর তারা সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে থাকবে।-(৭০:৪৩-৪৪) এদিন সত্যিকারের রাজত্ব হবে আল্লাহর এবং অবিশ্বাসীদের জন্যে দিনটি হবে বড়ই কঠিন।-(২৫:২৬)

সকল মানুষ দন্ডায়মান অবস্থায় বিষ্মিত হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকবে।-(৩৯:৬৮) কোথাও কোন পাহাড়-পর্বত গাছ-পালা নেই-যেন এক উন্মুক্ত প্রান্তর-(১৮:৪৭) আর সেখানে রয়েছে শুধু মানুষ আর মানুষ। সকলে একে অপরকে দেখতে থাকবে, খুঁজতে থাকবে আত্মীয়-পরিজন। এসময়ই প্রত্যেকের সঙ্গী ফেরেস্তা তাদের কাছে দৃশ্যমান হবে তাদের নিজস্ব স্বরূপে-(২৫:২২) এসব ফেরেস্তা হচ্ছে চালক এবং কর্মের সাক্ষী।-(৫০:২১) ফেরেস্তাদের নিজস্ব স্বরূপে উপস্থিতি পাপীদেরকে ভীতি-বিহবল করে ফেলবে। তারা এতটাই আতঙ্কিত হবে যে, পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান সম্মুখে থাকলেও তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের কথা তারা বিস্মৃত হবে। সঙ্গী ফেরেস্তা তাদেরকে বলবে, ‘তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। আজ তোমার কাছ থেকে যবনিকা সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ণ।’-(৫০:২২)
তারা মনে মনে বলতে থাকবে, ‘আজ বড় কঠিন দিন।’-(৫৪:৮)

পাপীরা বুঝতে পারবে আজ তাদের জন্যে কোন সুসংবাদ নেই। তারা সামনে ভয়ানক শাস্তির আশঙ্কা করবে। তাই তারা মনে মনে ভাববে, ‘হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল, কবর থেকে উত্থিত করল? সেখানে থাকলেই তো ভাল হত?’-(৩৬:৫২)
আবার কেউ কেউ বলতে থাকবে, ‘দুর্ভাগ্য আমাদের! এটাইতো প্রতিফল দিবস!’

অতঃপর ফেরেস্তারা সকলকে সম্বোধন করে বলবে, ‘আজ বিচার দিবস। যাকে তোমাদের কেউ কেউ মিথ্যে বলতে।’-(২০:২১) মুমিনেরা মনে মনে বলবে, ‘রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রসূলগণ সত্য বলেছিলেন।’-(৩৬:৫২)

কি পদ্ধতিতে মানুষের কর্মফলের বিচার হবে আজ? এ কথা সত্য যে, দুনিয়াতে যে মানুষ ন্যায়কে বরণ করেছে এবং ন্যায়ের অনুসরণে সাধ্যমত নিষ্পাপ ফেরেস্তায় পরিণত হওয়ার চেষ্টা করেছে, সে মানুষকে খোদা আজ কোন ক্রমেই অবজ্ঞা করতে পারবেন না। অপরদিকে যে অন্যায়কারী, তার ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই সত্য। সুতরাং বলা যায়, বিচার হবে ন্যায্য অর্থাৎ যার যা প্রাপ্য, সে তা পাবে নিশ্চিত ভাবে।

ইঞ্জিলে রয়েছে- ‘যে দাস নিজ প্রভুর ইচ্ছে জেনেও প্রস্তত হয়নি ও তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী কর্ম করেনি, সে অনেক প্রহারে প্রহারিত হবে। কিন্তু যে না জেনে প্রহারের যোগ্য কর্ম করেছে, সে অল্প প্রহারে প্রহারিত হবে। আর যাকে অধিক দত্ত হয়েছে, এদিন তার কাছে অধিক দাবী করা হবে এবং লোকে যার কাছে অধিক রেখেছে, তার কাছে অধিক চাওয়া হবে।’

ঐশী কিতাব গুলোর আলোকে বলা যায়, মূলত: বিচার হবে আমলনামার ভিত্তিতে। আমলনায় লিখিত মানুষের সকল কথা ও কর্ম- ঈমান, আমল এবং দাওয়া এই তিনটি বিষয়ের আলোকে বিবেচ্য হবে।

ঈমানের অঙ্গ বেশ কয়েকটি, যেমন-এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর রসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, তাঁর কিতাব সমূহের প্রতি বিশ্বাস, ফেরেস্তাগণের প্রতি বিশ্বাস, আখেরাতের উপর বিশ্বাস। উল্লেখ্য-ঈমানের গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা, কোন মানুষের পাপের বোঝা কখনও তার ঈমানের ভারকে অতিক্রম করতে পারে না। অর্থাৎ এই সূত্র অনুসারে মাদার তেরেসার মত লোক দোযখবাসী হবে তার ঈমান না থাকলে এবং হিটলারের মত লোকও সাজা ভোগের পর স্বর্গবাসী হবে তার ঈমান থাকলে। আর এ কারণেই মুহম্মদ তার মৃত্যুপথযাত্রী চাচাকে অনুরোধ করেছিলেন কেবলমাত্র “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এটুকু উচ্চারণ করতে যাতে তিনি পরকালে “লা শরিক আল্লা” তথা তার ঈমানের স্বাক্ষী হতে পারেন।

আমলের দু’টি অংশ-একটি আল্লাহর হক, যা কিনা নামাজ, রোজা, হজ্জ প্রভৃতি। অন্যটি বান্দার হক, যার অন্তর্ভূক্ত যাকাত, সদকা, পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালন, আমানতের হেফাজত করা, প্রতিবেশী ও গরীব আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সদ্ব্যবহার এবং তাদের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। বস্তুত: মানুষের নামাজ, রোজা, হজ্জ দ্বারা আল্লাহর কোন উপকার বা ক্ষতি সাধন হয় না। মানুষ এগুলো পালন করে কেবল নিজেরই উপকার করে (নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে।-২৯:৪৫)। মানুষের উপর আল্লাহ এগুলি ফরজ করেছেন এ কারণেও যে তারা যেন তাঁর করুণা ও দয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। সারা জীবন নামাজ রোজা পালন করেনি এমন লোকের অপরাধ আল্লাহ ইচ্ছে করলে ক্ষমা করতে পারেন। কেননা, তাঁর করুণা অসীম। কিন্তু, কোন বান্দার নিকট অপর বান্দার প্রাপ্য চার আনা পয়সাও তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। আর এখানেই বান্দার হকের গুরুত্ব।

আর দাওয়ার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে বাইবেলের ঐ কাহিনীর দিকে নজর ফেরাই। এক ব্যক্তি এসে ঈসাকে বলল, “আমাকে বলুন, কি করলে আমি অনন্তজীবন (বেহেস্ত) লাভ করতে পারব?’
ঈসা বললেন, ‘...আপনি তো হুকুমগুলি জানেন-...।’
সে বলল, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি সেগুলো পালন করে আসছি।’
একথা শুনে ঈসা বললেন, ‘এখনও একটা কাজ আপনার বাকী আছে। আপনার যা কিছু আছে তা নিয়ে বিক্রী করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিন।....আর তারপর এসে আমার পথে চলুন।’

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে ঈমান ও আমল পূর্ণ থাকলেও দাওয়া ব্যতিত তা বেহেস্তের উচ্চস্তর লাভের জন্যে যথেষ্ট নয়।

এখন আমরা দেখি এই দাওয়া কি? দাওয়ার অংশ হচ্ছে- সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ ও সত্য পথে আহবান। যাতে কেয়ামতের দিন কেউ কারো বিরুদ্ধে খোদার কাছে এমন অভিযোগ করতে না পারে যে- ‘সে সত্য জানতে পেরেছিল, নিজে সেই সত্য পথে চলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমাকে অজ্ঞতার মধ্যেই রেখেছে। তাই আমার এই পরিণতি, আমি আজ জাহান্নামী।’

নিশ্চয় জাহান্নাম মানুষের জন্যে গুরুতর বিপদ সমূহের অন্যতম।-(৭৪:৩৫) অবিশ্বাসীদের জন্যে একে করা হয়েছে কয়েদখানা স্বরূপ।-(১৭:৮) আর এদিন এটিকে নিকটবর্তী করা হবে-(৮৯:২৩) অত:পর তার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হবে।-(৮১:১২) এবং তার দ্বার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে মানুষকে দেখানোর জন্যে।-(৭৯:৩৬) জাহান্নামের দরজা সাতটি-(১৫:৪৪) এবং তত্ত্বাবধায়ক ফেরেস্তা (প্রধান) উনিশ জন।-(৭৪:৩০-৩১) অবশ্য এদিন জান্নাতও সন্নিকটবর্তী করা হবে খোদাভীরুদের জন্যে।-(৮১:১৩)

আদেশ হবে-‘তাদেরকে পরিচালিত কর জাহান্নামের পথে।’-(৩৭:২৩) এতে ফেরেস্তাগণ সকলকে পরিচালিত করবে সেদিকে। মানুষ সম্মুখে দৌঁড়াতে থাকবে। অবশ্য তারা স্বেচ্ছায় দৌঁড়াবে না, বরং ফেরেস্তাদের কারণে ভয়ে, আতঙ্কিত হয়ে। অত:পর একসময় আবারো আদেশ হবে-‘তাদেরকে থামাও, তারা জিজ্ঞাসিত হবে।’-(৩৭:২৪) তখন সকলকে ঐ স্থানে থামিয়ে দেবে ফেরেস্তাগণ। ফলে, মানুষ সমবেত হয়ে পড়বে এক নির্দিষ্ট সময়ে, এক নির্দিষ্ট স্থানে।-(৫৬:৪৯-৫০) এটাই হাশরের ময়দান। পাপীরা এসময় মনে মনে কেবল এ কথাই বলতে থাকবে, ‘হায় আফসোস! এর ব্যাপারে আমরা কতই না ত্রুটি করেছি!’-(৬:৩১)

সকলে অনুমান করবে তারা সামান্য সময় দুনিয়াতে অবস্থান করেছে।-(১৭:৫২) দিনের এক মুহুর্তের বেশী সেখানে তারা অবস্থান করেনি। তাই এত তাড়াতাড়ি কেয়ামত হওয়াতে তারা বিষ্মিত হবে। তাদের ভীতি একটু কমলে তারা কতদিন দুনিয়াতে অবস্থান করেছে এ বিষয়ে পরস্পর কথাবার্তা বলবে। তাদের মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে এক সন্ধ্যা অথবা এক সকাল অবস্থান করেছে।-(৭৯:৪৬) প্রথমে তারা চুপিসারে একে অন্যের সাথে বলাবলি করবে, ‘তোমরা মাত্র দশদিন অবস্থান করেছিলে।’-(২০:১০৩)

তাদের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত উত্তম পথের অনুসারী, সে বলবে, ‘তোমরা মাত্র একদিন অবস্থান করেছিলে।’-(২০:১০৪)
আর সেদিন অনেকে কসম খেয়ে বলবে, ‘আমরা এক মুহুর্তেরও বেশী অবস্থান করিনি।’-(৩০:৫৫)
মুমিনগণ তাদেরকে বলবে, ‘আল্লাহর কিতাব মতে আমরা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। এটাই পুনরুত্থান দিবস কিন্তু তোমরা জানতে না।’-(৩০:৫৬) অতঃপর তারা একে অপরের সাথে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হবে।

এসময় আকাশের আবরণ অপসারিত হবে।-(৮১:১১) এবং তা বিদীর্ণ হয়ে তাতে বহু দরজার সৃষ্টি হবে।-(৭৮:১৯) ফেরেস্তারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আটজন ফেরেস্তা আল্লাহর আরশকে (সিংহাসন) তাদের উর্দ্ধে বহন করবে।-(৬৯:১৭) আর সেসময় অসংখ্য ফেরেস্তা আরশের চারপাশ ঘিরে দয়াময় আল্লাহর প্রশংসা করতে থাকবে।-(৩৯:৭৫) এভাবে আল্লাহ উপস্থিত হবেন।

ঐ সময় আল্লাহর উপস্থিতির স্বরূপ কি হবে? এর ব্যাখ্যা করা জটিলই বটে। উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চাইলে বলা যাবে –‘তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।’ আর যারা একটু চিন্তা-ভাবনা করবে, তারা দার্শণিক প্লেটোর মত উত্তরে বলবে- ‘তিনি আপন রূপেই উপস্থিত হবেন। কেননা, তাঁর রূপ এক এবং অপরিবর্তনীয় ভাবে তিনি আপন রূপে প্রতিষ্ঠিত।’ আর খোদার স্বরূপ বিশ্লেষণে তারা বলবে-

নি:সন্দেহে খোদার রূপ হচ্ছে উত্তম। আর নিশ্চয়ই, যা উত্তম তা কখনও ক্ষতিকর বলে পরিচিত হতে পারে না। আবার যা ক্ষতিকর নয়, তা কোন ক্ষতির কারণও নয়। সুতরাং খোদা উত্তম বলে, তিনি কোন ক্ষতির কারণ হতে পারেন না, তিনি কোন অন্যায়ও সাধন করতে পারেন না। আর যিনি অন্যায় সাধন করতে পারেন না, তিনি কোন অন্যায়ের কারণও হতে পারেন না। সুতরাং বলা যায় খোদা উত্তম, মঙ্গলকর এবং তিনি কেবল মঙ্গলেরই কারণ।

অতত্রব, খোদা সবকিছুর মূলে বা সবকিছুর কারণ বলে যে কথা প্রচলিত-তা যথার্থ নয়। কারণ খোদা যদি উত্তম হন, তাহলে তিনি সবকিছুর কারণ স্বরূপ হতে পারেন না, কেননা উত্তম কেবল উত্তমেরই কারণ। সুতরাং বলা যায় খোদা মানুষের জীবনে ন্যায় ও মঙ্গলের কারণ, অন্যায় ও অমঙ্গলের নয়। সুতরাং কেউ যদি হোমারের মত করে বলে-

‘খোদার কাছে রক্ষিত আছে দু’টি ভান্ড:
একটি ন্যায়ের অপরটি অন্যায়ের।
আর সেই ভান্ড থেকে ন্যায় ও অন্যায়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে
যার ভাগ্য তৈরী করেছেন তিনি,
তার জীবনে খেলা চলে দু:সময় আর সু-সময়ের।
কিন্তু যার ভাগ্য তৈরী হয়েছে কেবল অন্যায়ের আরক দিয়ে
সুন্দর পৃথিবীর বুকে বুভূক্ষের তাড়নে সে তাড়িত হয় নিশিদিন
কারণ, খোদা ন্যায় ও অন্যায়ের বিধাতা।’

-তবে তা হবে সর্বৈব মিথ্যা। যা যথার্থ এবং ন্যায় খোদা কেবল তারই কারণ হিসেবে কাজ করেন। অর্থাৎ একদিকে খোদা উত্তম অপরদিকে তিনি দূর্ভাগ্যের কারণ এ কথা বোধ সম্পন্ন মানুষ বলবে না। মানুষের দূর্ভাগ্যের ও দূর্ভোগের কারণ হচ্ছে কেবলমাত্র ইবলিস বা শয়তান। কারণ সে তো মানুষকে রাতদিন হিসিয়ডের মত করে পাপের পথে এমনই মন্ত্রণা দিচ্ছে-

‘পাপের প্রাচূর্য্য লাভে তোমাদের শঙ্কার কোন কারণ নেই,
ওর সড়ক যেমন স্বচ্ছন্দ্য, ওর মঞ্জিলও তেমনি সন্নিকট।
সুতরাং সত্যের পথকে তোমরা পরিহার কর,
ও পথে আমি সঙ্কটের কাঁটাজাল বিস্তার করে দিয়েছি,
আর সে সড়কের চড়াই বড় খাড়া।’

আর ইবলিস তো খোদার কাছে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে- ‘আমি তোমার দাসদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার দলে নিয়ে ফেলব, আর আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবই, তাদের হৃদয়ে মিথ্যে বাসনার সৃষ্টি করব। আমি তাদেরকে নিশ্চয় নির্দেশ দেব এবং তারা পশুর কান ফুঁটো করবে দেবদেবীকে উৎসর্গ করার জন্যে। আর আমি তাদেরকে নিশ্চয় নির্দেশ দেব এবং তারা তোমার সৃষ্টিকে বিকৃত করবে।’-(৪:১১৮-১১৯) সে বলে চলল-‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার যে সর্বনাশ করলে তার দোহাই! আমি পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপকে আকর্ষণীয় করব, আর আমি সকলের সর্বনাশ করব; তোমার নির্বাচিত দাস ছাড়া।’--(১৫:৩৯-৪0)

তাই বিপদের উপর বিপদ, আঘাতের উপর আঘাত, এমনকি নিজের অস্তিত্ব যখন সমূলে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল তখনও নবী আইয়ূব কিন্তু এমনটা বলেননি- ‘খোদা, কেন তুমি আমাকে বিপদে ফেলেছ?’ বরং তিনি বলেছিলেন-‘শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে।’-(৩৮:৪২)

আবার, খোদা জাদুকরের ন্যায় বিভিন্ন রূপের দ্বারা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারেন না। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে প্রথমে আমরা পরিবর্তনের কথাই ধরি, কোন কিছুতে যখন পরিবর্তন সাধিত হয়, তখন সে পরিবর্তনের কারণ হয় সে বস্তু নিজে, নয়ত: অপর কোন শক্তি। কিন্তু আল্লাহর সম্পর্কে আমরা কি বলব? তিনি নিজে অবশ্যই সর্বপ্রকার সুসম্পূর্ণ। সুতরাং বাইরের অভিঘাত নিশ্চয় তাকে বিভিন্ন রূপ গ্রহণে বাধ্য করতে পারে না। তিনি যদি আদৌ পরিবর্তিত হন, তাহলে সে পরিবর্তন সুস্পষ্টত: নিজে থেকেই সাধিত হবেন। আর যদি তিনি আদৌ পরিবর্তিত হন, তাহলে তাকে নিকৃষ্টতর হতে হবে। কারণ ধর্ম বা কান্তি কোন ক্ষেত্রেই তিনি কোন কালে অসম্পূর্ণ ছিলেন এমনটা আমরা ভাবতে পারি না। আর কেউ কি নিজেকে নিকৃষ্টতর করে পরিবর্তিত করতে চাইবে? সুতরাং বলা যায়, খোদা আদৌ নিজের পরিবর্তন কামনা করতে পারেন না। কারণ, তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম এবং মনোহরতম। তাই তিনি আপন রূপে নিত্যকালের জনেই অপরিবর্তিত। এ কারণেই যিশুখৃষ্ট যেমন ঈশ্বর হতে পারেন না, তেমনি মানুষের মাঝে নানারূপ নিয়ে খোদার উপস্থিতিও অসম্ভব। আর এ কারণেই খোদার রূপ কল্পনা করে কোন বস্তু, মূর্তি-প্রতিমার নিকট অর্ঘ্য প্রদান খোদার নিকট ঘৃণ্য, অমার্জিত পাপ কারণ, তৈরীকৃত প্রতিমূর্তি তাঁর প্রকৃত স্বরূপকে নিকৃষ্ট করে; তাঁর স্বরূপের মিথ্যা প্রতিভাস তৈরী করে।

কেউ হয়ত: বলতে পারেন-খোদা অপরিবর্তনীয় হলেও যাদু-মন্ত্রাদির সাহায্যে তিনি আমাদের সামনে বিভিন্ন রূপের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে হয়তোবা উপস্থিত হতে পারেন। কিন্তু বিধাতা কথায় কিম্বা কর্মে নিজেকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবেন বা নিজের মিথ্যা প্রতিভাস তৈরী করবেন এমনটা আমরা ভাবতে পারি না। আর কেউই তার যথার্থ প্রকৃতিতে মিথ্যা প্রতিপন্ন হতে চায় না। আবার খোদা কোন শত্রুর ভয়ে বা কোন জ্ঞানহীন বন্ধুর কারণে মিথ্যার আশ্রয় নেবেন তাও আমরা ভাবতে পারি না। অর্থাৎ আমরা এমন কোন কারণ বা উদ্দেশ্যের কথা চিন্তা করতে পারি না যে জন্যে খোদা মিথ্যার আশ্রয় নেবেন। সুতরাং খোদা মিথ্যার আশ্রয় নিতে একেবারেই অক্ষম। তাই আমরা বলতে পারি-খোদা কথায় এবং কর্মে সরল এবং সত্য। তাঁর কোন পরিবর্তন নেই। শব্দে বা সংকেতে তিনি কাউকে প্রতারণা করতে পারেন না।

খোদার স্বরূপ।
তাহলে কি দাড়াল! যে সত্ত্বা জ্ঞান ও সত্যের মূল এবং যিনি সৌন্দয্যে জ্ঞান এবং সত্যেরও অধিক, তাঁর স্বরূপ কি বিষ্ময়কর তা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সূর্যের কথাই ধরি। সূর্য্য কেবল দৃশ্যের মূল নয়-বস্তুর সৃষ্টি, পুষ্টি ও বৃদ্ধিরও কারণ। কিন্তু সে নিজে স্রষ্টা নয়। তেমনি আল্লাহ যিনি পরম উত্তম, তিনি কেবল সকল জ্ঞাত বস্তুর জ্ঞানের মূল নন, বস্তুর অস্তিত্বেরও মূল, বস্তুর সারেরও মূল, কিন্তু তিনি নিজে সার নন, মর্যাদা ও শক্তির দিক থেকে তিনি সারকেও অতিক্রম করে যান।

সুতরাং বিচার দিবসে খোদার স্বরূপ হবে এমন, যেমন তিনি। আর তা কেবল পুনরুত্থিত মানুষের উপলব্ধ হবে। পরমসত্ত্বার সম্যক উপলব্ধি ব্যতিত আমাদের নিকট সাধারণ ভাবে তাঁর সেই স্বরূপ হবে কেবল নূর, নূর এবং নূর।

কোরআনে বলা হয়েছে- হাশরের ময়দানে খোদার উপস্থিতিতে সমগ্র পৃথিবী (ধ্বংসের পর নূতন করে সৃষ্ট) তাঁর নূরে উদ্ভাসিত হবে।-(৩৯:৬৯) তাঁর পিছনে থাকবে সাঁরিবদ্ধ ভাবে ফেরেস্তাগণ।-(৮৯:২২) এসময় বলা হবে, ‘সকল প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর।’-(৩৯:৭৫) সকলের দৃষ্টি আহবানকারীকে অনুসরণ করবে, যার কথা এদিক সেদিক হবে না এবং দয়াময় আল্লাহর ভয়ে সব শব্দ ক্ষীণ হয়ে যাবে। মৃদু গুঞ্জন ব্যতিত কোন শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে না।-(২০:১০৮)

সকল মানুষ সাঁরিবদ্ধ ভাবে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে।-(১৮:৪৮) তারা সকলেই আজ বিনীত।-(২৭:৮৭) আল্লাহ থাকবেন একটা পর্দার অন্তরালে।-(৮৩:১৫) তিনি বলবেন, ‘হে মানুষ, আমি বলেছিলাম- ‘তোমাদেরকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছিতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, অতঃপর তাঁর সাক্ষাৎ ঘটবে।’-(৮৪:৬) ‘আজ সেই দিন যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল। এবার বল, পৃথিবীতে তোমরা কতদিন অবস্থান করলে বছরের গণনায়?’

তারা বলবে, ‘আমরা একদিন অথবা দিনের কিছু অংশ অবস্থান করেছি। অতএব আপনি গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন।’
তিনি বলবেন, ‘তোমরা তাতে অল্প দিনই অবস্থান করেছ, যদি তোমরা জানতে!’-(২৩:১১২-১১৪)

‘হে বনি আদম!’-মৃদু গুঞ্জন ছাপিয়ে খোদায়ী কন্ঠ সমভাবে ধ্বনিত হবে সর্বত্র-‘আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম, অত:পর নির্দিষ্ট কাল নির্ধারণ করেছিলাম, আর বলেছিলাম, অপর নির্দিষ্ট কাল আমার কাছে আছে’-(৬:২) ‘তোমরা আজ তাতে উপনীত।’

‘আজ তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ, যেমনটা আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ।’-(৬:৯৪)

‘এদিন সম্পর্কে তোমাদেরকে আমি পূর্বেই জানিয়ে ছিলাম আমার রসূলগণের মাধ্যমে। কিন্তু তোমরা অধিকাংশই তো ছিলে উদাসীন। অনেকেই তো একথা বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না।’-(১৮:৪৮) বলতে, ‘আমাদের এ পার্থিব জীবনই জীবন। আমাদেরকে পুন:রায় জীবিত হতে হবে না।’–(৬:২৯) তাহলে তোমরা কি ধারণা করতে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছিলাম এবং তোমরা আমার কাছে আর কিছুতেই ফিরে আসবে না?’-(২৩:১১৫)

‘অবশ্য তোমাদের একদল আনুগত্য করেছিল আমার রসূলদেরকে এবং তারা এ দিনের সাক্ষাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। যাদেরকে তোমরা বিদ্রুপ করে বলতে- ‘তোমাদের রসূল তো তোমাদেরই মত একজন মানুষ এবং তোমরা যা পান কর, সেও তা পান করে। যদি তোমরা তোমাদেরই মত একজনের আনুগত্য কর, তবে তো তোমাদেরই ক্ষতি হবে। সে কি তোমাদেরকে এ প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মাটি ও হাঁড় হয়ে গেলে তোমাদেরকে আবার ওঠানো হবে? তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা কখনও ঘটবে না, কখনও না! একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি-বাঁচি এখানেই, আর আমাদের ওঠানো হবে না। সে তো এমন ব্যক্তি যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যে বানিয়েছে, আর আমরা তাকে বিশ্বাস করিনে।’-(২৩:৩৩-৩৯) অথবা বলতে, ‘যখন আমরা মৃত্তিকা হয়ে যাব, তখনও কি আমরা পুনরুত্থিত হব? এ ওয়াদা প্রাপ্ত হয়েছি আমরা এবং পূর্ব থেকেই আমাদের বাপ-দাদারা। এটা তো পূর্ববর্তীদের উপকথা বৈ কিছু না।’-(২৩:৮৩; ২৭:৬৭) ‘এখন বল, এটা কি বাস্তব সত্য নয়?’
তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, আমাদের প্রতিপালকের কসম।’-(৬:৩০)

তিনি বলবেন, ‘আজ এ কথা বলছ! যখন তোমরা তাতে উপনীত? অথচ, ইতিপূর্বে তোমরা বিশ্বাসীদেরকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে-‘যদি তোমরা সত্যবাদী হও, বল, এ প্রতিশ্রুতি কখন পূর্ণ হবে?’-(২৭:৬৮)

খোদায়ী কন্ঠের মোহজালে আবদ্ধ হয়ে পড়বে মানুষ। তিনি বলবেন, ‘আল্লাহর বিধান ও রীতি-নীতিতে কোন পরিবর্তন নেই।–(৩৫:৪৩) আমার রসূলগণ তোমাদের কাছে একটাই ধর্ম নিয়ে গিয়েছে, আর তোমরা তা পরিবর্তণ ও পরিবর্ধন করে নানা ধর্মমত ও পথের সৃষ্টি করে নিতে।–(২১:৯২) আবার তোমাদের অনেকেই আমাকে অস্বীকার করে মূর্ত্তি-প্রতিমা, আগুন, চন্দ্র-সূর্য্য, পাহাড়, বৃক্ষলতা, পশুপক্ষী এমন কি সাপ-পোঁকাকেও সিজদার যোগ্য উপাস্য, রুযীদাতা ও বিপদ বিদূরণকারী সাব্যস্ত করে নিয়েছিলে। -তোমাদের সেইসব উপাস্যগণ আজ কোথায়?’ মানুষ নিরুত্তর। কেননা আজ তাদের কাছে সবকিছু দিবালোকের মতই পরিস্কার। এসময় তাদের অনেকে বিষ্মিত হয়ে ভাববে “অবশেষে আদম-হাওয়া কাহিনী সত্য হল!” বা মনে মনে বলবে ‘আমরা এ বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলাম।’

তিনি বলবেন, ‘হে বনি আদম! আমি সৃষ্টি করেছিলাম তোমাদেরকে। অতঃপর কেন তোমরা তা সত্য বলে বিশ্বাস স্থাপন করলে না?-(৫৬:৫৭) তবে কি তোমাদেরকে প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত করান হয়নি?’-(৫৬:৬২) ‘আমি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছিলাম ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছিলাম এবং তাদের দু’জন থেকে তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম।’–(৪:১) ‘আজ সেই প্রথম মানব আদম এবং তার সঙ্গীনি হাওয়াও এখানে তোমাদের মাঝে উপস্থিত। তোমরা কি তাদের দু’জনকে দেখতে পাচ্ছ?’

‘হে বনি আদম! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম এবং তোমাদের স্বীকারোক্তিও গ্রহণ করেছিলাম। আর তা এই কারণে যে, আজকের দিনে তোমরা যেন না বল যে, ‘আমরা এ বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলাম।’-(৭:১৭২) দুষ্টুরা এসময় নিজেদের শরীরে চিমটি দিয়ে দেখবে আর মনে মনে, কোনভাবে এই বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করার উপায় খুঁজতে থাকবে।

তিনি বলবেন, ‘আজ বিচার দিবস, আমি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে একত্রিত করেছি। অতএব, তোমাদের কোন অপকৌশল থাকলে তা প্রয়োগ কর আমার কাছে।’-(৭৭:৩৮-৩৯) ‘যারা মুসলমান, যারা ইহুদি, সাবেয়ী, খ্রীষ্টান, অগ্নিপূজক এবং যারা মুশরিক, আজ আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেব।’-(২২:১৭)

ইহুদিরা বলতে-‘ওজায়ের আল্লাহর পুত্র’ আবার খৃষ্টানেরা বলতে ‘মসীহ আল্লাহর পুত্র’ এসব উদ্ভট কথাবার্তা কেবল তোমাদের মুখেই শোনা যেত।-(৯:৩০) তোমাদের কেউ কি একবারও ভেবেছ- ‘কিভাবে তাঁর পুত্র হবে যখন তাঁর কোন সঙ্গীনী নেই?’-(৬:১০১)
‘হে আহলে-কিতাবীরা! তোমাদেরকে কি সতর্ক করা হয়নি- ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়া-বাড়ি কোরও না এবং আল্লাহ শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বোলও না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক উপাস্য। সন্তান-সন্তুতি হওয়া তার যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমান সমূহে ও জমিনে রয়েছে সবই তাঁর। আর কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট?’-(৪:১৭১-১৭২)

‘ইহুদিরা বলতে-‘খৃষ্টানেরা কোন ভিত্তির উপরই না’ আর খৃষ্টানেরা বলত-‘ইহুদিরা কোন ভিত্তির উপরই না’ অথচ তোমরা সবাই কিতাব পাঠ করতে। এমনি ভাবে যারা মূর্খ তারাও তোমাদের মতই উক্তি করত। আজ আমি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেব, যে বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।’-(২:১১৩)

‘নিঃসন্দেহে দুনিয়াতে যারা মুসলমান ছিলে এবং ইহুদি, নাসারা ও সাবেইনদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিলে আল্লাহর প্রতি ও এ দিবসের প্রতি এবং সৎ কাজ করেছিলে, আজ তাদের জন্যে কোন ভয়-ভীতি নেই, তারা দু:খিতও হবে না’-(২:৬২;৫:৬৯) ‘তোমরা যা করেছ কেবল তারই প্রতিদান পাবে আজ। অদ্য কারও প্রতি সামান্যতম জুলুমও করা হবে না।’

মুমিনরা এদিন গুরুতর অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকবে।-(২৭:৮৯) তাদের মুখমন্ডল এসময় উজ্জ্বল হবে। তারা তার পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে-(৭৫:২২-২৩) এবং মনে মনে বলতে থাকবে, ‘নিশ্চয়ই আজকের দিনে লাঞ্ছনা ও দূর্গতি অবিশ্বাসীদের জন্যে।’-(১৬:২৭)

বিচারের জন্যে আমলনামা স্থাপন করা হবে-(৩৯:৬৯) এবং তা খোলা হবে।-(৮১:১০) যাতে মানুষকে তাদের কৃতকর্ম দেখান যায়।-(৯৯:৬) আর আল্লাহ বলবেন, ‘আজ যথার্থই ওজন হবে। অতঃপর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম।’-(৭:৮) ‘আর যার পাল্লা হাল্কা হবে, তার ঠিকানা হাবিয়া। তোমরা কি জান তা কি? -প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।’-(১০১:৮-১১)

এসময় পাপীদের মুখমন্ডল উদাস হয়ে পড়বে। তারা ধারণা করবে যে, তাদের সাথে কোমর ভাঙ্গা আচরণ করা হবে।-(৭৫:২৪-২৫) তারা ভাববে, ‘বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বররা সত্যসহ আগমন করেছিলেন। অতএব আমাদের জন্যে কোন সুপারিশকারী আছে কি, যে সুপারিশ করবে?’ অথবা ‘আমাদেরকে পুনঃ প্রেরণ করা হলে আমরা পূর্বে যা করতাম তার বিপরীত কাজ করে আসতাম।’-(৭:৫৩)

ফেরেস্তাদের প্রতি আদেশ হবে- ‘যার যার আমলনামা তাদের প্রত্যেকের হাতে দিয়ে দাও। যাতে তারা জানতে পারে তারা কে কি উপস্থিত করেছে।’

পাপীষ্ঠদের আমলনামা (লিপিবদ্ধ খাতা) সিজ্জিনে-(৮৩:৭-৯) এবং সৎলোকদের আমলনামা ইল্লিয়্যীনে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেস্তাদের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত ছিল।-(৮৩:১৮-২১) এই নির্দেশের পর আমল লেখক ফেরেস্তাগণ সংরক্ষিত আমলনামা কিতাবের আকারে এনে সংশ্লিষ্টদের কারও ডান হাতে আবার কারও পিঠের দিক থেকে বাম হাতে দিয়ে দেবে এবং প্রত্যেককে বলবে, ‘আমার কাছে যে আমলনামা ছিল তা এই।’-(৫০:২৩)

অবিশ্বাসীরা প্রথমে তাদের আমলনামা নিতে চাইবে না। তারা স-বিষ্ময়ে ফেরেস্তাদের হাতে ধরা আমলনামা দেখতে থাকবে। তারা বলবে, ‘এটা কি?’
ফেরেস্তারা বলবে, ‘এটা আমলনামা, তোমাদের দেখাশোনাকারী ফেরেস্তা ছিলাম আমরা। আর আমরাই এটা তৈরী করেছিলাম। এর ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে তোমাদের চিরন্তন বসবাসের ঠিকানা। দুনিয়াতে তোমাদের প্রতিটি কৃতকর্মের হিসেব এতে রয়েছে। সম্পূর্ণ নির্ভুল। তোমরা নিজেরাই এটা পরীক্ষা করে দেখ।’
তখন নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা তা নেবে।

আমলনামা হাতে সকলেই দন্ডায়মান নতজানু হয়ে। আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজ নিজ আমলনামা দেখতে থাক। আমার কাছে রক্ষিত এই আমলনামা তোমাদের সম্পর্কে সত্য কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করাতাম।’-(৪৫:২৮-২৯) ‘বস্তুতঃ আমি তো অনুপস্থিত ছিলাম না।’-(৭:৭)

প্রকৃতপক্ষে, যাদেরকে আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, তাদের হিসেব নিকেশ সহজে হয়ে যাবে এবং তারা হিসেব শেষে তাদের পরিবার পরিজনদের কাছে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে।-(৮৪:৭-৯) কারণ এরাই তারা যাদের সম্বন্ধে হযরত ঈসা বলেছিলেন-

‘খোদার সামনে যারা বিনীত হয়, তারা ধন্য,
কারণ বেহেস্তী রাজ্য তাদেরই হবে।
যারা দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে, তারা ধন্য,
কারণ বেহেস্তী রাজ্য তারা জয় করবে।
অন্যের প্রতি যারা রহম করে, তারা ধন্য,
কারণ তাদের প্রতি রহম করা হবে।

যাদের অন্তর খাঁটি, তারা ধন্য,
কারণ তারা খোদাকে দেখতে পাবে।
অপরের জীবনে শান্তি ও কল্যাণে যারা পরিশ্রম করে, তারা ধন্য,
কারণ খোদা তাদেরকে সন্তান জ্ঞান করবেন।

খোদার পথে যারা জীবন উৎসর্গ করে, তারা ধন্য,
কারণ বেহেস্তী রাজ্য তাদেরই হবে।’

অন্যদিকে যাদেরকে তাদের আমলনামা পিঠের পশ্চাৎ দিক থেকে দেয়া হবে, তারা বিচার শেষে মৃত্যুকে আহবান করবে এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।-(৮৪:১০-১২) এরাই তারা যাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে-

‘তারা শুনবে, কিন্তু কোন মতেই বুঝবে না।
দেখবে, কিন্তু কোন মতেই জানবে না।
কারণ, তাদের অন্তর অসাড়, কান বন্ধ হয়ে আছে এবং
তারা তাদের চক্ষু মুদিত করে রেখেছে;
যেন তারা চোখ দিয়ে না দেখে, কান দিয়ে না শোনে এবং
অন্তর দিয়ে না বোঝে, আর ভাল হবার জন্যে
আমার (খোদা) কাছে ফিরে না আসে।’-ই’শায়া-৬:১০-১১

আমলনামা হাতে পাবার পর প্রত্যেকে তাতে মনোনিবেশ করবে। মানুষ তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পেয়েছে। তারা দ্রুত তা পড়ে ফেলবে। এভাবে তারা প্রত্যেকেই জেনে নেবে সে কি উপস্থিত করেছে।-(৮১:১৪)

যারা মুমিন, তারা তাদের আমলনামা দেখে খুশী হবে। এদের ডান হাতে তাদের আমলনামা দেয়া হয়েছিল। তাদের মনে হবে তারা আশার অতিরিক্ত ফললাভ করেছে। তারা তখন তাদেরকে যারা আমলনামা দিয়েছিল, বলবে, ‘নাও, তোমরাও দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসেবের সম্মুখীণ হতে হবে।’-(৬৯:১৯-২০)

অন্যদিকে, আমলনামাতে যা আছে তার কারণে অপরাধীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে।-(১৮:৪৮) এদেরকে পিঠের পশ্চাৎ দিক থেকে-(৮৪:১০) বাম হাতে আমলনামা দেয়া হয়েছিল।-(৬৯:২৫) তারা দেখতে পাবে দুনিয়াতে তারা যা কিছু করেছে তার সবই, তা যত ছোট হোক বা বড়, আমলনামায় লিপিবদ্ধ আছে।-(৫৪:৫২-৫৩) লিপিবদ্ধ রয়েছে তাদের মুখ থেকে নির্গত প্রতিটি কথাই। যারা ইঞ্জিল পাঠ করেছিল তারা স্মরণ করবে ঈসার বাণী- ‘আর আমি তোমাদেরকে বলছি, মানুষ যত অনর্থক কথা বলে, বিচার দিনে সেই সবের হিসেব দিতে হবে। কারণ তোমার কথা দ্বারা তুমি নির্দোষ বলে গণিত হবে, আর তোমার কথা দ্বারাই তুমি দোষী বলে প্রমাণিত হবে।’-(Matthew 12:36-37).

দুষ্টেরা এসময় তাদের দুস্কর্ম দেখে কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দূরের হত! তারা মনে মনে বলবে, ‘হায়! আমায় যদি আমার আমলনামা না দেয়া হত! আমি যদি না জানতাম আমার হিসেব! হায়! আমার মৃত্যুই যদি শেষ হত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে এল না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল।’-(৬৯:২৬-২৯)
আল্লাহ বলবেন, ‘পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব। আজ তোমার হিসেব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট।’-(১৭:১৪)

যারা খাঁটি মুমিন, তারা দেখতে পাবে তাদের আমলনামাতে যথেষ্ট পরিমাণ পূণ্য আমল তথা-নামাজ, রোজা, হ্জ্জ, যাকাত, দান-খয়রাত ও সৎকর্ম রয়েছে। তথাপি তারা ম্রিয়মান থাকবে এই ভেবে যে, তারা ছিল অপদার্থ। তারা কেবল তাই করে এসেছে, যা তাদের প্রতি আদেশ ছিল।

আমলনামাতে কেউ অনু পরিমান সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অনু পরিমান অসৎকর্ম করলেও তা দেখতে পাবে।-(৯৯:৬-৭) ফলে, তখন প্রত্যেকে জেনে নেবে, সে কি অগ্রে প্রেরণ করেছে এবং কি পশ্চাতে ছেড়ে এসেছে।-(৮২:৫) তাই সে আফসোস করে বলবে, ‘হায়! এ জীবনের জন্যে যদি আমি কিছু অগ্রে প্রেরণ করতাম!’-(৮৯:২৪) এভাবে সেদিন মানুষ স্মরণ করবে। কিন্তু এ স্মরণ তার কি কাজে আসবে?-(৮৯:২৩)

অন্যদিকে অপরাধীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলবে, ‘হায় আফসোস! এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট-বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি।’-(১৮:৪৯)
আল্লাহ বলবেন, ‘আমি জানিয়ে ছিলাম-‘তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আমার কাছে পাবে। আমি কেয়ামতের দিন ন্যায় বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমানও হয়-আমি তা উপস্থিত করব।’ তোমাদের আমলনামা সেভাবেই তৈরী হয়েছে। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না।’-(২১:৪৭)

অনেকে অভিযোগ করবে। কেউ কেউ বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার! আমার আমলনামায় কিছু সওয়াবের কাজ তো দেখছি লেখা হয়নি?’
আল্লাহ বলবেন, ‘ওগুলো লেখা হয়েছিল, কিন্তু তা মুছে দিয়েছি। কেননা তোমরা ছিলে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। আমি কি তোমাদেরকে পূর্বেই জানাইনি- ’যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রি করে, আখেরাতে তাদের কোন অংশ নেই?’
কেউ কেউ বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমার এবাদতের অনেক নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব এবং যাকাত ও দান তো দেখছি লেখা হয়নি?’

তিনি বলবেন, ‘ওগুলো ছিল লোক দেখান। আর তাই সেগুলো, যাতে কোন নিষ্ঠা ছিল না, তা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। পূর্বেই কি আমি জানিয়ে দেইনি- ‘সাবধান, লোক দেখাবার জন্যে ধর্মকর্ম কোরও না, কেননা এরূপ ধর্ম-কর্মের জন্যে আখেরাতে কোন পুরস্কার নেই।’-ইঞ্জিল; ‘দূর্ভোগ সে সব নামাজীর, যারা তাদের নামাজ সম্পর্কে বেখবর; যারা তা লোক দেখানোর জন্যে করে?’-(১০৭:৪-৬)

কেউ কেউ বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার, অপরের করা কিছু পাপ কর্ম ভুলক্রমে আমার আমলনামায় লেখা হয়েছে।’
তিনি বলবেন, ‘কিতাবে কি ছিল না- ‘যে লোক সৎ কাজের জন্যে কোন সুপারিশ করবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক সুপারিশ করবে মন্দ কাজের, সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে?’-(৪:৮৫)

কিছু ইহুদি বলবে, ‘আমাদের আমলনামায় নবীদের হত্যার অপরাধের কথা লেখা হয়েছে- যে সম্পর্কে আমরা আদৌ অবগত নই।’
তিনি বলবেন, ‘তোমরা হত্যাকারীদের সাথে একমত পোষণকারী ছিলে বলে হত্যাকারীরূপে গণ্য হয়েছ।’

খ্রীস্টানগণ বলবে, ‘হে খোদা! আমাদের আমলনামায় তো আমাদের কৃত সমস্ত পাপই মজুদ রয়েছে- কিন্তু আমরা তো এ পাপসমূহ দুনিয়াতেই আমাদের পাদ্রী-পুরোহিত দ্বারা মোচন করিয়ে নিয়েছিলাম।’
তিনি বলবেন, ‘হে আহলে কিতাবী! পাদ্রী পুরোহিতদের পাপ মোচনের ক্ষমতা রয়েছে’-আমার কোন কিতাবের কোথাও কি একথা লেখা ছিল? না আমার রসূলগণের কেউ তোমাদেরকে তা জানিয়েছিল? তোমরা সত্যবাদী হলে প্রমান হাজির কর। আজ আমার কিতাব সমূহ এবং রসূলগণও এখানে উপস্থিত রয়েছে স্বাক্ষী স্বরূপ। নিশ্চয়ই রসূলগণ এবং যাদের কাছে আমার রসূল প্রেরিত হয়েছিল তারা আজ জিজ্ঞাসিত হবে।-(৭:৬-৭)

ফেরেস্তাগণ তাদেরকে বলবে, ‘পাদ্রী পুরোহিত দ্বারা তোমাদের পাপ মোচন হয়নি বরং তোমাদের অপরাধের স্বপক্ষে স্বাক্ষী সংগৃহীত হয়েছে এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবণা লুপ্ত হয়েছে মাত্র। মূসা ও ইস্রায়েলী সেই নারীর কাহিনী কি স্মরণে আছে তোমাদের?’

সীনাইয়ের পথে বিশ্রামের জন্যে কোথাও তাঁবু ফেললে পরদিন সকালে মূসা বিচারে বসতেন লোকদের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিবিধান দিতে। একদিন এক স্ত্রীলোক তার কাছে এল। সে বলল, ‘হে মূসা! তোমার সঙ্গে তো খোদার কথা-বার্তা হয়। সুতরাং তুমি জেনে নিও তো, আমি বেহেস্তে যাব না দোযখে।’
মূসা বললেন, ‘তুমি কাল একবার এসো।’
পরদিন সে এলে মূসা বললেন, ‘তুমি বেহেস্তে যাবে।’

সে বলল, ‘নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। তুমি পরিস্কার ভাবে আমার নাম জানিয়ে আবারও একবার জিজ্ঞেস কোরও।’ তখন মূসা তাকে পরদিন আবার আসতে বললেন।
পরের দিন যখন সে এল, তখন মূসা তাকে বললেন, ‘তুমি বেহেস্তেই যাবে।’

এই উত্তর শুনে ঐ নারী ক্ষিপ্ত হল। সে বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি ভন্ড, নইলে তোমার খোদা। আমি কিছু দিন যাবৎ এক যুবকের সাথে বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনে রত রয়েছি। নিষিদ্ধ ঐ কাজে লিপ্ত হয়েও আমি কি করে বেহেস্তে যেতে পারি? সুতরাং এ কথাটি উল্লেখ করে এবার তুমি তাকে জিজ্ঞেস করো, আমি এখনই উত্তর চাই।’ মূসা তাকে কিছুসময় অপেক্ষা করতে বললেন।

অত:পর ‘স্বাক্ষ্য তাম্বু’ থেকে বেরিয়ে এসে মূসা ঐ নারীকে বললেন, ‘এখন তুমি দোযখে যাবে। কারণ, তোমার ঐ গোপন অবৈধ কাজের স্বাক্ষী খোদা ব্যতিত অপর কেউ ছিল না। আর দয়ালু খোদা তাঁর নিজ দয়ায় তোমার ঐ গোপন অপরাধ ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, এখন তা আর হবে না, কেননা তুমি নিজ মুখেই তোমার অপরাধ স্বীকার করেছ এবং আমি মূসা তার একজন স্বাক্ষী হয়ে গেছি।’

আল্লাহ জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর এবাদতের জন্যে। আজ তারা সকলে উপস্থিত কৃতকর্মের হিসাব দিতে। সকলেই আজ নতজানু, বিনীত। আল্লাহ বলবেন, ’আজ রাজত্ব কার? এক প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহর। আজ প্রত্যেকেই তার কৃতকর্মের প্রতিদান পাবে। আজ জুলুম নেই। নিশ্চয় আল্লাহ দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী।’-(৪০:১৬-১৭) আর তিনি ফেরেস্তাদেরকে নির্দেশ দেবেন, ‘একত্রিত কর তাদেরকে, তাদের দোসরদের এবং তাদেরকে, যাদের এবাদত করত তারা আমাকে ব্যতিত।’-(৩৬:২২-২৩)

বনি আদম স্বীয় স্বীয় পয়গম্বরের পিছনে সাঁরিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এই নির্দেশের পর ফেরেস্তাগণ প্রত্যেক উম্মতকে ঈমানদার ও অবিশ্বাসী এই দু’দলে বিভক্ত করতে শুরু করবে। এসময় উম্মতগণ স্বীয় পয়গম্বরের কাছে ধর্ণা দেবে তাদের পক্ষে সুপারিশকারী হবার। কিন্তু নিজ উম্মতের মধ্যে পাপীষ্ঠদের সংখ্যা বেশী দেখে পয়গম্বরগণ দুনিয়াতে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়বেন, ফলে কেউই তার উম্মতের জন্যে সুপারিশকারী হতে চাইবেন না শেষ নবী মুহম্মদ ব্যতিত। এতে অন্যান্য নবী-রসূলগণ তার কাছে ধর্ণা দেবেন। এসময় তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলবেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে শাফায়াতের অধিকার দিয়েছেন। আর আমি বনি আদমের জন্যে যথা সময়েই তাঁর কাছে সুপারিশ করব।’

ইতিমধ্যে ফেরেস্তাগণ প্রত্যেক উম্মত বা সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী দল, যারা খোদায়ী বাণীকে অস্বীকার করত, তাদেরকে আলাদা করে ফেলেছিল। অত:পর এখন তারা তাদেরকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করে ফেলল।-(২৭:৮৩-৮৪) কেননা আল্লাহ অপরাধীদের প্রত্যেক দলকে তাদের নেতাসহ আহবান করবেন তাদের মধ্যে বিরোধ ফয়সালায় সওয়াল-জওয়াব করার জন্যে।

সর্বপ্রথমে আদম তার উম্মতদের নিয়ে আল্লাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হবেন। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আদম পুত্র কাবিল আজ পাপিষ্ঠদের অগ্রবর্তীতে দাঁড়িয়ে। দুনিয়ার প্রথম খুনটি সংঘটিত করেছিল সে। যাহোক, আদম এর উম্মতের সওয়াল জবাব শেষ হল একসময়। এভাবে আদম থেকে শুরু হয়ে এক সময় নূহ ও তার উম্মতদের ডাক পড়বে। তারা উপস্থিত হবে। আল্লাহ নূহকে স্বাক্ষী স্বরূপ এবং তার মুমিন উম্মতদের একজনকে বর্ণনাকারী নিযুক্ত করবেন। -(৪:৪১)

নূহ আজ বড়ই লজ্জিত। প্রায় হাজার (৯৫০) বৎসর-(২৯:১৪) দুনিয়াতে মানুষকে হেদায়েত করেও তার অনুসারীর মাত্র কয়েকজন মুমিনদের দলভূক্ত হয়েছে। তার স্ত্রী, এক পুত্রও আজ অবিশ্বাসীদের অগ্রবর্তীতে।

আল্লাহর সম্মুখে নূহের অবিশ্বাসী উম্মতদের দীর্ঘ-বিস্তৃত লাইন। বড়ই অবাক হয়ে তিনি বর্ণনাকারীকে বলবেন, ‘তবে কি আমার বাণী ও বার্তাসমূহ তোমাদের কাছে পৌঁছেনি?’
সে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার বাণীসমূহ যথাযত: ভাবেই পেয়েছি।’
অবিশ্বাসীগণ বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার, কসম আপনার, আপনার কোন বার্তা আমরা পাইনি?’-(৫৮:১৮)

তখন নূহের দু’একজন অনুসারী এগিয়ে এসে বলবে, ‘নিশ্চয় আমরা স্বাক্ষী।’
অবিশ্বাসীগণ বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমাদের এত বড় একটা দলের সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করে, নগণ্য ঐ দলের সাক্ষ্য কি করে গ্রহনীয় হবে?’
তখন আল্লাহ বলবেন, ‘হে নূহ! তোমার দাবীর স্বপক্ষে আর কোন স্বাক্ষী আছে কি?’
নূহ বলবেন, ‘আমার প্রতিটি কথা ও কাজ আমার আমলনামায় লিপিবদ্ধ আছে। সুতরাং আমার আমলনামা স্বাক্ষী।’
তারা বলবে, ‘আমরা তো তাকেই স্বীকার করিনি, সুতরাং তার আমলনামা কিভাবে গ্রহনীয় হবে? স্বাক্ষ্য হতে হবে আমাদের মত একটা বড় দলের।’

একথা শুনে নূহ চুপ হয়ে যাবেন। আজ তার উম্মতগণ তার নবুয়্যতকেই অস্বীকার করছে। এসময় উম্মতে মুহম্মদীর মুমিনেরা দলে দলে এগিয়ে এসে বলবে, ‘আমরা স্বাক্ষী।’ অতঃপর এই স্বাক্ষীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।-(৪:১৫৯)
অবিশ্বাসীগণ তাদেরকে দেখে বলবে, ‘হে আল্লাহ, এরা আমাদের ব্যাপারে কিভাবে স্বাক্ষী হতে পারে, সে সময় তো তাদের জন্মও হয়নি?’

তারা বলবে, ‘সে সময়ে আমাদের জন্ম হয়নি সত্য, কিন্তু আমরা কোরআন এবং আমাদের রসূলের কাছ থেকে তোমাদের ব্যাপারে সঠিক তথ্য জেনেছি। আর কোরআন স্বাক্ষী, আল্লাহ আমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছেন-যাতে আমরা স্বাক্ষ্য দাতা হই মানব মন্ডলীর জন্যে।’ তারা পাঠ করবে-‘এমনি ভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি-যাতে করে তোমরা স্বাক্ষ্য দাতা হও মানব মন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রসূল স্বাক্ষ্য দাতা হয় তোমাদের জন্যে।’-(২:১৪৩) অতঃপর তারা নূহের আহবান সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত সমূহ পাঠ করবে। সবশুনে অবিশ্বাসীরা বলবে, ‘এ সব যে সত্য তা আমরা কিভাবে বুঝব?’

এসময় উম্মতে মুহম্মদী মুহম্মদকে ডাকবে। তিনি বলবেন, ‘আমার উপর অবতীর্ণ কিতাব পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী এবং রসূলদের কর্মকান্ডের স্বাক্ষী। তাই নিঃসন্দেহে আমার উম্মতের এই সাক্ষ্য সত্য।’-(১৬:৮৯) এখন তারা কোন কিছু বলতে পারবে না।-(২৭:৮৫) দয়াময় আল্লাহ জানেন যা কিছু তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে আছে এবং তারা তাকে জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ত করতে পারে না। সেই চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ীর সামনে সব মুখমন্ডল অবনমিত হবে।-(২০:১০৯-১১১)

নূহের পর অন্যান্য ভীতি প্রদর্শণকারী রসূল হুদ, সালেহ, লূত, শোয়েব ও তাদের উম্মতদের ডাক পড়বে। আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘তোমরা কি আমার রসূলদেরকে অস্বীকার করেছিলে? উপেক্ষা করেছিলে তাদের আহবান এবং এই দিবসকে?
ইতিপূর্বে তারা স্বচক্ষে উম্মতে মুহম্মদী দ্বারা নূহের উম্মতদের অপদস্থ হতে দেখেছে। সুতরাং তারা কোন উত্তর দেবে না।

--তখন সামুদদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা কেবল নিদর্শণ চাইতে। অত:পর আমি নিদর্শণ স্বরূপ তোমাদেরকে দিলাম এক মাদী উষ্ট্রী। কিন্তু তোমরা সেটিকে হত্যা করলে।–(১১:৬৫) বাস্তবিকই তোমরা ছিলে অত্যাচারী।’

--সদোম-ঘমোরাবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হবে-‘তোমরা তো নারীকে ছেড়ে পুরুষ ধরেছিলে। তোমাদের হাতে আমার ফেরেস্তাগণও নিরাপদ ছিল না। বাস্তবিকই তোমরা ছিলে সীমালঙ্ঘণকারী।’

--আ’দদের উদ্দেশ্যে বলা হবে-‘তোমাদের বাণিজ্যের সুবিধার্থে আমি তোমাদের যাত্রাপথের স্থানে স্থানে বসতি স্থাপন করে দিয়েছিলাম, যেখানে তোমরা দিনে ও রাতে আশ্রয়, বিশ্রাম ও নিরাপত্তা পেতে। কিন্তু তোমরা বললে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের বিশ্রামের জায়গা গুলো দূরে দূরে রাখ।’-(৩৪:২০) বাস্তবিকই তোমরা ছিলে অহঙ্কারী।’

--আইকাবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হবে-‘তোমরা মাপে ও ওজনে কম দিতে কিন্তু নিজেদেরটা ঠিক মত বুঝে নিতে, আর অপরের অনিষ্ঠ করতে পথের মাঝে বসে থাকতে। অত:পর যখন তোমাদেরকে এ দিনের কথা স্বরণ করিয়ে দেয়া হত, তোমরা তা অগ্রাহ্য করতে। বাস্তবিকই তোমরা ছিলে স্বেচ্ছাচারী।’

‘আমার রসূলগণ যখনই সত্যপথে তোমাদেরকে আহবান করত- তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে। তাদেরকে বলতে, ‘যদি তুমি সত্যবাদী হও, তবে তোমার প্রতিপালককে বল- তিনি যেন এক খন্ড আকাশ আমাদের উপর ফেলেন।’ বস্তুত: তোমরা ছিলে পাপাচারী।’

--‘আমি একাদিক্রমে আমার রসূল প্রেরণ করেছি। যখনই তোমাদের কাছে আমার রসূল আগমন করেছে, তখনই তোমরা তাকে মিথ্যেবাদী বলেছ। অত:পর আমি তোমাদেরকে একের পর এক ধ্বংস করেছিলাম এবং তোমাদেরকে কাহিনীর বিষয়বস্তু করে দিয়েছিলাম।’–(২৩:৪৪)

এ সময় তারা সকলে স্বরণ করবে দুনিয়াতে তাদের উপর নেমে আসা সেইসব গজবের কথা- ওহ, কি ভয়ানক! তারা সমস্বরে বলবে-‘আমরা তখন ভ্রান্তিতে পড়েছিলাম, হে আমাদের প্রতিপালক! এখন আমরা পুরোপুরি বিশ্বাসী হয়ে গেছি। আপনি আমাদেরকে মান্যকারীদের দলভূক্ত করে নিন।’

তিনি বলবেন, ‘এখন? আজ এই বিচার দিনে? অথচ তোমরা এরই তাগাদা করতে? সুতরাং এখন তোমাদের এই ঈমান কোনই কাজে আসবে না। দুনিয়াতেও যেমন আমার আযাব তোমাদেরকে পাকড়াও করেছিল তেমনি এখনও তোমরা আযাবে দাখিল হবে। আজ আমার হাত থেকে নি:স্কৃতি পাবে না।’

এভাবে এক সময় মূসার উম্মতদের ডাক পড়বে। মুমিন ও অবিশ্বাসীদের দু‘দল দু‘পাশে এবং মূসা মাঝে দাঁড়িয়ে যাবেন। ফেরাউন ২য় রামেসিস, হামান ও তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা আজ পথভ্রষ্টদের অগ্রবর্তীতে। মৃত্যুর পূর্বের তিক্ত অবস্থার কথা ফেরাউনের স্মরণে আসবে। সমুদ্রের নোনা পানির স্বাদ এখনও তার মুখে লেগে রয়েছে। অকস্মাৎ তার মনে পড়বে ঈমান আনার কথা, আর সে প্রতিবাদ করে উঠবে, বলবে, ‘আমি তো দুনিয়াতেই ঈমান এনেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমি ঈমান আনলাম, আর কোন মাবুদ নেই সেই আল্লাহ ছাড়া, যার উপর বনি ইস্রায়েলী বিশ্বাসী, আমিও তাদের সামিল যারা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’-(১০:৯০-৯১)-তবে আমি কেন অবিশ্বাসীদের দলে?’

সঙ্গী ফেরেস্তা তাকে বলবে, ‘আল্লাহ বান্দার তওবা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করেন যতক্ষণ না প্রাণ হরণকারী ফেরেস্তা তার কাছে পৌঁছে। তুমি ঈমান এনেছিলে মৃত্যু ভয়ে, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে, যখন প্রাণ হরণকারী ফেরেস্তা তোমার কাছে উপস্থিত ছিল। তাই তোমার সেই ঈমান গ্রহনীয় হয়নি।’

আল্লাহ মূসাকে বলবেন, ‘তুমি যখন তোমার উম্মতকে সত্য ধর্মের দিকে, ইসলামের পথে আহবান করেছিলে, তখন তারা কি সেই আহবানে সাড়া দিয়েছিল, না অস্বীকার ও বিরোধিতা করেছিল?’
মূসা বলবেন, ‘এমনিতে তাদের অধিকাংশই ছিল আমার অবাধ্য। যখন আমি তাদের কাছে কিতাব নিয়ে হাযির হলাম, তখন তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বলল, ‘হে মূসা! এ কিতাব যে তুমি নিজেই লিখে নিয়ে আসনি তা আমরা কিভাবে বুঝব?’

যখন তুমি দশ আজ্ঞা শুনিয়ে দিলে, তারা বলেছিল, ‘আমরা কখনই বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা তাঁকে স্বচক্ষে দেখব।’
যখন তারা কিতাবের সত্যতায় নিশ্চিত হল, তখন তারা বলল, ‘এর আহকামসমূহ বড়ই কঠিন, আমাদের পক্ষে এ পুরোপুরি মান্য করা সম্ভব হবে না।’ তারা কিতাব পরিবর্তনের দাবী জানাল।
আর যখন আমি তাদেরকে যুদ্ধ করার আদেশ দিলাম, তারা বলে বসল, ‘হে মূসা! তুমি ও তোমার আল্লা যাও ও যুদ্ধ কর। আমরা এখানে বসে রইলাম।’

‘হে আমাদের প্রতিপালক! অদৃশ্য বিষয়ে কেবল তুমিই জানো। তাই তাদের ঈমান ও কাজকর্ম সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমি যা জানি তা এতটুকুই যে, আমার সামান্য অনুপস্থিতিতে তাদের একদল গো-বৎসকে উপাস্য স্থির করেছিল।’

উম্মতদের জন্যে ঐ মুহূর্তটি হবে অত্যন্ত নাজুক। তারা যখন ঐ হৃদয় বিদারক পরিস্থিতিতে তাদের নবীর সাফাই আশা করছিল, তখন নবী স্বয়ং তাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে গাফেল বলছেন, তার আদেশ অমান্যের ব্যাপারে তাদেরকে অভিযুক্ত করছেন।

এসময় আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘এই দিনের জন্যে তোমরা যা প্রেরণ করেছ তা কতই না মন্দ। তোমাদের এক দল তো উযায়েরকেও আমার শরীক স্থির করেছিলে।’
এ কথা শুনে উযায়ের বলে উঠবেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমি তো কেবল তোমার দাস হওয়াকেই গৌরবের মনে করি।’

আল্লাহ ইহুদি ঈমামদেরকে লক্ষ্য করে বলবেন, ‘তাওরাতে সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত ভাবে শেষ নবী মুহম্মদের আগমনের সংবাদ এবং তোমাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের নির্দেশ বর্ণিত হয়েছিল। কিন্তু তার আগমনের পর তোমরা তাকে সত্য নবী জেনেও বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে তার বিরোধিতা করতে শুরু করে দিয়েছিলে কেবল পার্থিব যশ ও অর্থ লিপ্সার কারণে।’

--‘হে বনি ইস্রায়েল! তোমরা মূসার প্রতি ঈমান এনে মুসলমান হয়েছিলে। অতঃপর গো-বৎস পূজা করে অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলে-অতঃপর তওবা করে আবারও মুসলমান হয়েছিলে-পুনঃরায় ঈসা ইবনে মরিয়মকে অস্বীকার করে অবিশ্বাসী হয়েছিলে। অতঃপর মুহম্মদকে অস্বীকার করে সেই অবিশ্বাসীই রয়ে গেলে। আর তাই তোমরা দুনিয়াতে পথ দেখতে পাওনি।’-(৪:১৩৭)

--‘অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম এবং পর্যায়ক্রমে রসূল প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে, যা তোমাদের মনে ভাল লাগেনি, তখনই তোমরা অহঙ্কার করেছিলে। শেষ পর্যন্ত এক দলকে মিথ্যেবাদী বলেছিলে এবং এক দলকে হত্যা করেছিলে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।’-(২:৮৭)

‘কোরআন অবতীর্ণের পর যখন তোমাদেরকে বলা হল- ‘আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন, তা মেনে নাও।’ তোমরা বললে, ‘আমরা কেবল তাই মানি যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে।’ আর সেটি ছাড়া বাকী সব গুলোকে তোমরা অস্বীকার কর। অথচ এ গ্রন্থটি সত্য এবং সত্যায়ন করে ঐ গ্রন্থের যা তোমাদের কাছে ছিল। সুতরাং বল, তোমরা যদি এতই বিশ্বাসী ছিলে তবে নবীদেরকে হত্যা করতে কেন? সুস্পষ্ট মু’যেজাসহ মূসা তোমাদের মাঝে গেল, আর তার সামান্য অনুপস্থিতিতে তোমরা নিজেদের জন্যে গো-বৎস বানিয়ে নিলে-বাস্তবিকই তোমরা ছিলে অত্যাচারী।’-(২:৯১-৯২)

‘এই দিনের কথা ভেবে যখন তোমাদেরকে বলা হল-‘আল্লাহর রাহে দান-খয়রাত কর।’ তোমাদের একদল বলে বসলে-‘আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্থ আর আমরা বিত্তবান।’ তোমাদের এ কথায় আমি বলেছিলাম, ‘আমি তোমাদের এসব কথা এবং যেসব নবীদের তোমরা অন্যায় ভাবে হত্যা করেছ তা লিখে রাখব।’-(৩:১৮১) ‘নিশ্চয়ই আমার ওয়াদা সত্য।’

‘আবার, যারা আমার রসূল ও আমার কিতাবে বিশ্বাস স্থাপন করত, তোমরা তাদেরকে বলতে, ‘তোমরা ইহুদি বা খৃষ্টান হয়ে যাও, তবেই সুপথ পাবে।’ (২:১৩৫) ‘অথবা, ‘নিশ্চয়ই ইহুদি ও খৃষ্টান ব্যতিত আর কেউই বেহেস্তে যাবে না।’-তোমরা যদি সত্য বলেছিলে তবে প্রমান হাজির কর।’–(৫:১০৫) ‘আর, তোমরা কি একথা বলছ যে, নিশ্চয় ইব্রাহিম, ঈসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের সন্তানেরা ইহুদি বা খৃষ্টান ছিল?’-(২:১৪০) ‘অথচ, তাওরাত ও ইঞ্জিল তাদের পরেই নাযিল হয়েছে?’-(৩:৬৫)

--‘হে আহলে কিতাবীরা! তোমরা ইহুদিও ছিলে না, খৃষ্টানও ছিলে না, এমনকি তোমরা কোন পথেই ছিলে না যদি না তোমরা তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং যে গ্রন্থ তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল তা পুরোপুরি পালন না করে থাক।’–(৫:৬৮)

--‘হে আহলে কিতাবীরা! কেমন করে তোমরা আল্লাহর কালামকে অস্বীকার করতে, যখন তোমরাই ছিলে তার প্রবক্তা?’-(৩:৭০)

‘বেশ, তোমরা কোরআনকে মিথ্যে সাব্যস্ত করেছিলে। কিন্তু তোমাদেরকে তো তাওরাত দেয়া হয়েছিল, অতঃপর কেন তোমরা তার অনুসরণ করনি? সুতরাং তোমরা হচ্ছ সেই গাধা, যে কেবল কিতাবই বহন করেছে।’-(৬২:৫)

‘হে আহলে কিতাবীরা! যখন তোমাদেরকে আমার কিতাবের প্রতি আহবান করা হত, যাতে তোমাদের মধ্যে মিমাংসা করা যায়, তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে, কারণ তোমরা বলতে ‘দোযখের আগুন আমাদেরকে স্পর্শ করবে না। তবে হাতে গোনা কয়েকদিনের জন্যে স্পর্শ করতে পারে।’ বস্তুত: তোমরা নিজেদের উদ্ভাবিত ভিত্তিহীন কথায় দুনিয়াতে ধোঁকা খেয়েছ। অত:পর তোমরা আমার কাছে সমাবেত। সুতরাং নিজেদের কৃতকর্ম তোমরা প্রত্যেকে পাবে। তোমাদের প্রাপ্য প্রদানে আজ মোটেও অন্যায় করা হবে না।’-(৩:২৩-২৫)

ঈসা ও তার উম্মতদের ডাক পড়বে। পাপীষ্ঠদের এত বড় দীর্ঘ লাইন দেখে মুমিনগণ অবাক হবে। আর তারা হতবাক হয়ে পড়বে যখন তারা দেখবে তাদের পোপ, কার্ডিনাল, প্যাট্রিয়ার্কেট, যাজক, পাদ্রী-পুরোহিতগণ আজ পাপীষ্ঠদের অগ্রবর্তী দল। তারা স্মরণ করবে তাদের রসূলের সেই গল্প-

এক রাজা তার পুত্রের বিবাহ ভোজ প্রস্তুত করলেন। এরপর যে লোকেরা সেই ভোজে দাওয়াত পেয়েছিল, তাদেরকে ডাকবার জন্যে তিনি তার গোলামদের পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু নিমন্ত্রিতদের সকলে একমত হয়ে তাদের অক্ষমতা প্রকাশ করল- কেউই আসতে চাইল না।

তখন রাজা আবার অন্য গোলামদের দিয়ে যে লোকদের দাওয়াত করা হয়েছিল, তাদেরকে বলে পাঠালেন, ‘দেখ, আমি আমার বলদ ও মোটা সোটা বাছুরগুলি জবেহ করে ভোজ প্রস্তুত করেছি। এখন সবই প্রস্তুত, তোমরা ভোজে চলে এসো।’

যে লোকেরা দাওয়াত পেয়েছিল, তাদের একজন সেই গোলামদেরকে বলল, ‘আমি একটা ক্ষেত ক্রয় করেছি, তা আজ দেখতে না গেলেই নয়। আমাকে ক্ষমা করতে হবে।’ -সে তার নিজের ক্ষেতের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
আর একজন বলল, ‘আমি পাঁচ জোড়া বলদ ক্রয় করেছি; আর সেগুলো পরীক্ষা করতে যাচ্ছি; বিনতি করি, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে।’
আর একজন বলল, ‘আমি সদ্য বিবাহিত, এ কারণে যেতে পারছিনে।’
বাকীরা রাজার গোলামদের কথা না শুনেই তাদেরকে ধরে অপমান করল ও কয়েকজনকে হত্যা করল। তখন রাজা খুব রেগে গেলেন এবং সৈন্য পাঠিয়ে তিনি সেই খুনীদের ধ্বংস করলেন আর তাদের শহর পুড়িয়ে দিলেন।

এরপরে রাজা তার গোলামদের বললেন, ‘ভোজ প্রস্তুত, কিন্তু যাদের দাওয়াত করা হয়েছিল, তারা এর যোগ্য নয়। তোমরা বরং রাস্তার মোড়ে মোড়ে যাও, আর দরিদ্র, নুলা, খঞ্জ, অন্ধ-যাদের দেখা পাও, সকলকে বিবাহ ভোজে ডেকে আন।’

তখন সেই গোলামেরা বাইরে রাস্তায় রাস্তায় গিয়ে ভাল-মন্দ যাদের পেল, সকলকে ডেকে আনল। তাতে বিবাহ বাড়ী সেই মেহমানে ভরে গেল।

এরপরে রাজা মেহমানদের দেখবার জন্যে ভিতরে এসে দেখলেন, অধিকাংশ লোক বিবাহের পোষাক না পরেই সেখানে এসেছে। রাজা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিবাহের পোষাক ব্যতিরেকেই তোমরা কেমন করে এখানে ঢুকলে?’
তারা এর কোন উত্তর দিতে পারল না। তখন রাজা চাকরদেরকে বললেন, ‘এদেরকে হাত-পা বেঁধে বাইরের অন্ধকারে ফেলে দাও।’

শেষে ঈসা বললেন, ‘যাদেরকে ডাকা হয়েছে (ইহুদি জাতিকে-কেননা ঈসা কেবল ইহুদিদের হেদায়েতেই এসেছিলেন) তারা আসবে না, তাই অন্যদের ডাকা হবে এবং যারা আসবে তাদের অল্পকেই বেঁছে নেয়া হবে।’- হায়! কত অল্পই না বেঁছে নেয়া হয়েছে।

পাপীদের সংখ্যা বেশী দেখে আল্লাহ ঈসাকে বলবেন, ‘হে ঈসা ইবনে মরিয়ম, তোমার প্রতি ও তোমার মাতার প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মার দ্বারা সাহায্য করেছি। তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে কোলেও এবং পরিণত বয়সেও এবং যখন আমি তোমাকে গ্রন্থ, প্রগাঢ় জ্ঞান, তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছি এবং যখন তুমি কাদা-মাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে, আমার আদেশে অতঃপর তুমি তাতে ফুঁক দিতে; ফলে তা আমার অনুমতিক্রমে পাখী হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাঁড় করিয়ে দিতে এবং যখন আমি বনি ইস্রায়েলকে তোমা থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম, যখন তুমি তাদের কাছে প্রমানাদি নিয়ে এসেছিলে,-(৫:১১০) হে মরিয়ম পুত্র ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে যে, ‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার জননীকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর?’

ঈসা বলবেন, ‘তুমি মহিমাময়! আমার যা বলার অধিকার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভন না। যদি আমি তা বলতাম তবে তুমি তো তা জানতে। আমার অন্তরের কথা তো তুমি জান, কিন্তু তোমার অন্তরের কথা তো আমি জানিনে। তুমিই অদৃশ্য সম্বন্ধে ভাল করে জান। তুমি আমাকে যে আদেশ করেছ তা ছাড়া তাদেরকে আমি কিছুই বলিনি। আর তা এই- ‘তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপাসনা কর।’

আর যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের কর্মকান্ডের স্বাক্ষী, কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলে নিলে, তখন তুমিই তো ছিলে তাদের কর্মকান্ডের স্বাক্ষী। এখন তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই দাস, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর তবে তো তুমি শক্তিমান, তত্ত্বজ্ঞানী।' আল্লাহ বলবেন, ‘আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যতা তাদের উপকারে আসবে।’-(৫:১১৬-১১৯)
[কেন খোদা এ কথা বললেন? এর উত্তর পেতে আমাদেরকে বার্ণাবাসের গসপেলে ফিরতে হবে-

Jesus, weeping, said: "O Barnabas, it is necessary that I should reveal to you great secrets, which, after that I shall be departed from the world, you shall reveal to it." Then answered he that writes, weeping, and said: "Suffer me to weep, O master, and other men also, for that we are sinners. And you, that are a holy one and prophet of God, it is not fitting for you to weep so much."

Jesus answered: "Believe me, Barnabas that I cannot weep as much as I ought. For if men had not called me God, I should have seen God here as he will be seen in paradise, and should have been safe not to fear the day of judgment. But God knows that I am innocent, because never have I harboured thought to be held more than a poor slave. No, I tell you that if I had not been called God I should have been carried into paradise when I shall depart from the world, whereas now I shall not go thither until the judgment. Now you see if I have cause to weep.

"Know, O Barnabas, that for this I must have great persecution, and shall be sold by one of my disciples for thirty pieces of money. Whereupon I am sure that he who shall sell me shall be slain in my name, for that God shall take me up from the earth, and shall change the appearance of the traitor so that every one shall believe him to be me; nevertheless, when he dies an evil death, I shall abide in that dishonour for a long time in the world. But when Muhammad shall come, the sacred Messenger of God, that infamy shall be taken away. And this shall God do ”because I have confessed the truth” of the Messiah who shall give me this reward, that I shall be known to be alive and to be a stranger to that death of infamy." -Barnabas ch-112- এখানে ”because I have confessed the truth” -ঈসার এই সত্য স্বীকারের কারণেই খোদা এসময় এ কথা বললেন।]

‘হে খৃষ্টানগণ! আমি বলেছিলাম, ‘নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহর রসূল এবং তার বাণী যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের কাছে এবং রূহ- তাঁরই কাছ থেকে আগত। অতএব, তোমরা আল্লাহকে এবং তার রসূলগণকে মান্য কর। আর একথা বোলও না যে, আল্লাহ তিনের মধ্যে একজন, একথা পরিহার কর; তোমাদের মঙ্গল হবে। মসীহ আল্লাহর বান্দা হবে তাতে তার কোন লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ট ফেরেস্তাদেরও না। বস্ততঃ যারা আল্লাহর দাসত্বে লজ্জাবোধ করবে, অহঙ্কার করবে, তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন।’-(৪:১৭২) আর আজ সেইদিন এবং তোমরা সকলেই আমার কাছে সমবেত।’

পাপীরা আফসোস করতে থাকবে। হায়! পাদ্রী, পুরোহিতদের কথায় বিশ্বাস করে তারা একেশ্বরবাদ থেকে ত্রিত্ববাদে গিয়ে পৌঁছেছে, তারা অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়েছে। আহা, আবার যদি ফিরে যাওয়া যেত!

আল্লাহ বলবেন, ‘এখন বল তো তোমাদের রসূলের নির্দেশ এবং আমার নির্দেশ যদি এই হয়, তবে কেন তোমরা ঈসা ও তার মাতাকে উপাস্য করেছিলে?’
তারা বলবে, ‘আমাদের রসূল নিজেকে ঈশ্বরপুত্র বলে দাবী করেছিলেন, ফলে আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম এবং আমাদের কাছে সত্য প্রকাশ করার মত কেউ ছিল না।’
তিনি বলবেন, ‘সত্য কোরআন নিয়ে মুহম্মদ কি তোমাদের মাঝে যায়নি? তোমাদের নবী কি তাকে তোমাদের কাছে পরিচিত করে দেয়নি?’
তারা বলবে, ‘আমাদের নবী তার সম্বন্ধে আমাদেরকে কিছুই বলেননি।’

তখন আল্লাহ ঈসাকে বলবেন, ‘হে ঈসা, তাহলে তুমি তাদেরকে কি আহবান জানিয়েছিলে?’
তিনি বলবেন, ‘আমি তাদেরকে জানিয়ে ছিলাম- ’হে বনি ইস্রায়েল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ প্রেরিত রসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সূসংবাদ দাতা যিনি আমার পরে আসবেন। তার নাম আহমদ।’
আল্লাহ বলবেন, ‘অতঃপর যখন আহমদ স্পষ্ট প্রমানাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তোমরা তাকে অস্বীকার করলে?’-(৬১:৬)

মুহম্মদ বলবেন, ‘কোরআন স্বাক্ষী তাদের একদল আমার উপর ঈমান এনেছিল। তিনি পাঠ করবেন কোরআনের কয়েকটি আয়াত-‘খ্রীষ্টানদের মধ্যে আলেম রয়েছে, দরবেশ রয়েছে এবং তারা অহংকার করে না। আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন তুমি তাদের চোখ অশ্রসজল দেখতে পাবে, এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতএব আমাদেরকেও মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন। আমাদের কি ওজর থাকতে পারে যে, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে, তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব না এবং এ আশা করব না যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎ লোকদের সাথে প্রবিষ্ট করাবেন?’-(৫:৮২-৮৫) অত:পর তিনি মাথা নীচু করে অনুচ্চ স্বরে বলবেন- ‘অবশ্য অপরদল কোরআনকে শয়তানের প্রলাপ সাব্যস্ত করেছিল।’

আল্লাহ মুহম্মদকে বলবেন, ‘আমি তার অনুসারীদের একদলের অন্তরে নম্রতা ও দয়া স্থাপন করেছিলাম।’-(৫৭:২৬) ‘তাই তারা সত্যকে চিনে নিতে পেরেছে।’

যারা কোরআনকে অস্বীকার করেছিল তারা এসময় বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তার আগমন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমাদের আলেম ও ঈমামগণও তাকে অস্বীকার করেছিলেন।’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের উপর অবতীর্ণ কিতাব কি তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়নি?
তারা বলবে, ‘আমরা তেমনকিছু আমাদের কিতাবে পাইনি।’

পূর্বে খোদায়ী গ্রন্থ দেখা-শোনার দায়িত্বে ছিল ঈমামগণ। তাই ফেরেস্তাগণ এসময় তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের কাছে খোদায়ী গ্রন্থ গচ্ছিত ছিল আমানতরূপে। আর তোমরা প্রতিজ্ঞাত ছিলে যে, মানুষের কাছে তা বর্ণনা করবে, কোন কিছু গোপন করবে না। সুতরাং বল, এই মুহম্মদ সম্পর্কে তোমরা অবগত কি-না?’
তারা বলবে, ‘হ্যাঁ।’

ফেরেস্তারা বলবে, ‘কিন্তু সেই আহমদ যখন সত্য কিতাবসহ আবির্ভূত হল, তখনি তোমরা তাকে অস্বীকার করলে, আর অল্প মূল্যে আয়াত বিক্রি করে নিজেরা লাভবান হলে!’-(৩:১৮৭) সুতরাং তোমাদের দ্বারা আয়াত পরিবর্তণের কারণে যারা সত্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আজ অপরাধী হয়েছে, তাদের সকলের পাপের ভারও তোমাদের এখন বহন করতে হবে।’

এ সময় তারা বিনীত হয়ে ক্ষমা প্রার্থণা করবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের সাথে কোন কথাই বলবেন না।-(২:১৭৪) ফেরেস্তারা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের রসূল বলেছিল, ‘তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপাসনা কর।’ আর তোমরা তাকে ও তার মাতাকে পালনকর্তার আসনে বসিয়ে দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা হলে ত্রিত্ববাদ প্রচারকারী ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনকারী মুশরিক এবং তোমরা বৃহৎ একদল মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছ। এভাবে বার বার তোমাদেরকে আহবান জানানোর পরও-

‘যারা বলে, আল্লাহই মরিয়ম পুত্র মসীহ, তারা নিঃসন্দেহে অবিশ্বাসী। অথচ মসীহ বলেছিল, ‘হে বনি ইস্রায়েল! তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপাসনা কর।’ অবশ্য যে কেউ আল্লাহর অংশী করবে নিশ্চয় আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত নিষিদ্ধ করবেন ও আগুনে হবে তার বাসস্থান। আর অত্যাচারীকে কেউ সাহায্য করবে না।’-(৫:৭২)

‘যারা বলে, ‘আল্লাহ তো তিনের মধ্যে একজন’, তারা নিশ্চয় অবিশ্বাসী। অথচ এক উপাস্য ভিন্ন অন্য কোন উপাস্য নেই। তারা যা বলে তা থেকে নিবৃত্ত না হলে তাদের মধ্যে যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের উপর অবশ্যই নিদারুণ শাস্তি নেমে আসবে। তবে কি তারা আল্লাহর দিকে ফিরবে না ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে না? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’-(৫:৭৩-৭৪)

A copy of Indulgence
‘মরিয়ম পুত্র মসীহ তো কেবল একজন রসূল, তার পূর্বে কত রসূল গত হয়েছে আর তার মাতা সতী ছিল। তারা দু’জনেই খাওয়া দাওয়া করত। দেখ, ওদের জন্যে আমি আয়াত কিরূপ পরিস্কার করে বর্ণনা করি। আরও দেখ, ওরা কিভাবে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’-(৫:৭৫) -তোমরা কর্ণপাত করোনি বরং এন্যাট ও টাইথের অর্থ দিয়ে নিজেদের মোটাসোটা করছিলে এবং অত:পর (টেটজেলের দিকে তাকিয়ে) আরও অর্থের লোভে তোমাদের কেউ কেউ ‘বেহেস্তের টিকেট’ (Indulgence)ও বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা হ্চ্ছ জালেমদের জালেম।’

পাদ্রী-পুরোহিতদের এই দূর্গতি দেখে তাদের অনুসারীগণ মনে করবে তাদের অপরাধ মওকুফ হবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যে বলা হবে- ‘কিন্তু এতদসত্ত্বেও তোমাদের অনেকে মুহম্মদ ও তার উপর অবতীর্ণ কিতাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং সঠিক পথ বেছে নিয়েছিল-কিন্তু তোমরা যে বিভ্রান্ত হয়েছিলে তো হয়েছিলে, তোমাদের কাছে সুষ্পষ্ট প্রমান আসার পরেও। অথচ তোমাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দান করা হয়নি যে, তোমরা খাঁটি মনে একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম।’-(৯৮:৪-৫) আর তাই তোমাদের অপরাধ মওকুফ হবে না। আমি কি ইতিপূর্বে জানিয়ে দেইনি-‘আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী, তারাই জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে? তারাই সৃষ্টির অধম?’-(৯৮:৬)

এভাবে একসময় মুহম্মদ ও তার উম্মতদের ডাক পড়বে। একদিকে মুহম্মদ (তার নির্ধারিত স্থানে-যা ‘মকামে মাহমুদ’ নামে অভিহিত) ও অন্যদিকে পথভ্রষ্টদের বিভিন্ন উপদলের বিস্তৃত লাইন। অত:পর মুশরিকদের বিপক্ষে একজন স্বাক্ষী দাঁড়িয়ে যাবে।-(২৮:৭৫) অন্যদিকে মুহম্মদ স্বাক্ষী এবং অবস্থা বর্ণনাকারী হবেন।-(৪:৪১)
তারপর তাদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা কি আমার আয়াত সমূহকে মিথ্যে বলেছিলে? অথচ এগুলো সম্পর্কে তোমাদের পূর্ণ জ্ঞান ছিল না! না তোমরা অন্য কিছু করেছিলে?’-(২৭:৮৩-৮৪)

মুশরিকগণ দুনিয়াতে আল্লাহ সম্পর্কে যে মিথ্যে অপবাদ দিত তা বিস্মৃত হবে। তাই তারা বলবে, ‘আমরা তো কোন মন্দ কাজ করতাম না।’
আল্লাহ বলবেন, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়, আমি সবিশেষ অবগত আছি যা তোমরা করতে।’

আর তিনি একদল মূর্তি পূজারীকে বলবেন, ‘আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের দেখছি না, কোথায় গেল তারা, যাদেরকে তোমরা শরীক করতে-আল্লাহ ব্যতিত?’-(৪০:৭৩-৭৪) ‘এখন তোমরা প্রমান আন। ডাক তাদেরকে, যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে?’ তখন তারা তাদের উপাস্যদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা এ আহবানে সাড়া দেবে না।-(২৮:৬২) ফলে তারা হতাশ হয়ে যাবে এব্ং মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

এ সময় আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে আবারো বলবেন, ‘যাদেরকে তোমরা আমার শরীক করতে তারা আজ কোথায়? তারা তোমাদেরকে কোন সাহায্য করতে পারে কি? যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। এখন তোমরা তোমাদের শরীকদের অহবান করছ না কেন? যাদের জন্যে আমার শাস্তি অবধারিত হয়েছে।’-(২৮:৬৩)

আজ যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ব্যতিত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না-(১৯:৮৫-৮৭) এবং যার জন্যে অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্যে ব্যতিত আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসুও হবে না।-(৩৪:২৩) আর তাই তারা কোন সাঁড়া পাবে না। তখন তারা জানতে পারবে যে, সত্য আল্লাহর এবং তারা যা গড়ত, তা তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেছে।-(২৮:৭৫)

আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের দেখছি না, যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। বাস্তবিকই আজ তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবীও উধাও হয়েছে।’-(৬:৯৪)

অত:পর মুশরিকগণ ভীত হয়ে পড়বে এবং তারা যে মিথ্যে অপবাদ দিত তা বিস্মৃত হবে।-(১৬:৮৭) তারা বলবে, ‘তারা আমাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেছে; বরং আমরা তো ইতিপূর্বে কোন কিছুর পূজাই করতাম না।-(৪০:৭৫) কেউ কেউ বলবে, ‘আমরা কি আপনাকে বলিনি যে, আমাদের কেউই এটা স্বীকার করে না?’-(৪১:৪৭)
অনেকে বলবে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর কসম, আমরা মুশরিক ছিলাম না।’-(৬:২৩)

কেউ আবার বলবে. ‘আমরা এ বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলাম।’ কিংবা ‘আমাদের পূর্বপুরুষরাই তো পূর্ব হতে অংশীবাদিতা করেছিল এবং আমরা তাদের পরবর্তী বংশধর ছিলাম, অতএব তুমি কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্যে আমাদেরকে ধ্বংস করবে?’-(৭:১৭২-১৭৩) এভাবে তারা তাদের দেবতাকে অস্বীকার করতে থাকবে।-(৩০:১৩)

এসময় আল্লাহ তাদের সামনে তাদের উপাস্য দেবতাদের হাযির করতে নির্দেশ দেবেন ফেরেস্তাদেরকে।-(২৫:১৭) এভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেবেন যা তারা করত। আল্লাহ তার হিসেব রেখেছেন, আর তারা তা ভুলে গেছে। আল্লাহর সামনে উপস্থিত আছে সব বস্তুই।-(৫৮:৬)

যখন উপাস্য দেবতাদের হাযির করবে ফেরেস্তারা।-(২৫:১৭) তখন সেগুলি দেখিয়ে আল্লাহ বলবেন, ‘এরাই কি আমার অংশীদাররা, যাদের ব্যাপারে তোমরা খুব হটকারিতা করতে?’-(১৬:২৭)

মুশরিকগণ যখন ঐসব বস্তু দেখবে, যেসবকে তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছিল, তখন বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, এরাই তারা যারা আমাদের শেরেকীর উপাদান, আপনাকে ছেড়ে আমরা যাদেরকে ডাকতাম।’-(১৬:৮৬-৮৭)

আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা এবং তোমাদের শরীকরা নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে যাও।’ অতঃপর তাদেরকে পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন করে দেবেন।-(৯:২৮) আর তিনি উপাস্যদেরকে বলবেন, ‘তোমরাই কি আমার এই বান্দাদের পথভ্রান্ত করেছিলে, না তারা নিজেরাই পথভ্রান্ত হয়েছিল?’

তারা বলবে, ‘আপনি পবিত্র, আমরা আপনার পরিবর্তে অন্যকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করতে পারতাম না; কিন্তু আপনিই তো তাদেরকে এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরকে ভোগ-সম্ভার দিয়েছিলেন, ফলে তারা আপনার স্তুতি বিস্মৃত হয়েছিল এবং তারা ছিল ধ্বংস প্রাপ্ত জাতি।’-(২৫:১৭-১৯) আর তারা মুশরিকদেরকে বলবে, ‘তোমরা মিথ্যেবাদী।-(১৬:৮৭) তোমরা তো আমাদের উপাসনা বন্দেগী করনি। বস্ততঃ আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্বাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট। আমরা তোমাদের বন্দেগী সম্পর্কে জানতাম না।’-(৯:২৮)

এভাবে তাদের দেবতাগুলোর মধ্যে কেউ তাদের সুপারিশ করবে না। ফলে সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে যাবে।-(৩০:১২-১৩) পূজাকারীরা অনুতপ্ত হবে, তারা উপাস্যদেরকে লক্ষ্য করে বলবে, ‘কতই না ভাল হত, যদি আমাদিগকে পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ দেয়া হত! তাহলে আমরাও তোমাদের প্রতি তেমনি অসন্তুষ্ট হয়ে যেতাম যেমন তোমরা অসন্তুষ্ট হয়েছ আমাদের প্রতি।’-(২:১৬৭)

আল্লাহ বলবেন, ‘দেখ, ইব্রাহিম বলেছিল, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতিত অন্যান্য ইলাহ গ্রহণ করেছ, যাতে তারা তোমাদের ব্যাপারে সাহায্যকারী হয়। কখনই নয়, তারা তোমাদের এবাদত অস্বীকার করবে এবং তোমাদের বিপক্ষে চলে যাবে।’-(১৯:৮১-৮২)

‘বস্তুত: পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা রক্ষার জন্যে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমা গুলোকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছ। এরপর কেয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরকে লানত করবে। তোমাদের ঠিকানা জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই।’ -(২৯:২৫)

এসময় অনেকে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তাদের এবাদত এজন্যে করেছি, যেন তারা আমাদেরকে আপনার নিকটবর্তী করে দেয়।’-(৩৯:৩) এতে আল্লাহ উপাস্যদের বলবেন, ‘তোমাদের কি হল যে, তোমরা একে অপরকে সাহায্য করছ না?’-(২৫:২৬)

তারা সেদিন হবে আত্মসমর্পণকারী।-(১৬:৮৬) অতঃপর অবনমিত নেত্রে তারা নীচুস্বরে আল্লাহকে বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, এদেরকেই আমরা পথভ্রষ্ট করেছিলাম। আমরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম যেমন আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম। এখন আমরা আপনার সামনে দায় মুক্ত হচ্ছি। তারা কেবল আমাদেরই এবাদত করত না।’

তখন আল্লাহ মুশরিকদের বলবেন, ‘তোমাদের কথা তো তারা মিথ্যে সাব্যস্ত করল, এখন তোমরা শাস্তি প্রতিরোধ করতে পারবে না এবং একে অপরকে সাহায্যও করতে পারবে না। তোমাদের মধ্যে যে অধিক গোনাহগার আমি তাকে গুরুতর শাস্তি আস্বাদন করাব।’-(২৫:১৭-১৯) এরপর তিনি উপস্থিত ফেরেস্তাদেরকে বলবেন, ‘এরা কি তোমাদেরই পূজা করত?’

তারা বলবে, ‘আপনি পবিত্র, আমরা আপনার পক্ষে, তাদের পক্ষে নই; বরং তারা জ্বিনদের পূজা করত। তাদের অধিকাংশই শয়তানে বিশ্বাসী।’-(৩৪:৪০-৪২) এরপর তারা মুশরিকদের উদ্দেশ্যে বলবে, ‘আমাদের প্রত্যেকের জন্যে রয়েছে নির্দিষ্ট স্থান এবং আমারই সাঁরিবদ্ধ ভাবে দন্ডায়মান থাকি এবং আমরাই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করি।’-(৩৭:১৬৪-১৬৬) ‘তোমরা এবং তোমরা যাদের উপাসনা করেছ তাদের কাউকেই তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।’-(৩৭:১৬১)

এসময় ফেরেস্তাগণ ইবলিস ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদেরকে হাযির করবে। তখন তাদেরকে দেখিয়ে মুশরিকরা বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শিরক করিনি; বরং এই শয়তানরা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল।’

আল্লাহ বলবেন, ‘হে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়, তোমরা আজ ওজর পেশ কোরও না। তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে, যা তোমরা করতে।’-(৬৬:৭) এরপর জ্বিনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলবেন, ‘হে জ্বিন সম্প্রদায়, তোমরা মানুষদের মধ্যে অনেককে অনুগামী করে নিয়েছ।’-(৬:১২৮)

তারা বলবে, ‘আমরা বিভ্রান্ত করেছি ঠিকই, কিন্তু আমরা তাদেরকে বাধ্য করিনি। আমরা অপরাধী, কিন্তু অপরাধ থেকে তারাও মুক্ত নয়। কারণ পয়গম্বররাও তাদেরকে হেদায়েত করেছিলেন-প্রমাণাদি দ্বারা তাদের সামনে সত্যকে ফূঁটিয়ে তুলেছিলেন। আর তারা স্বেচ্ছায় পয়গম্বরগণের কথা অগ্রাহ্য করেছে এবং আমাদের কথা মেনে নিয়েছে।’

তাদের এই উত্তর শুনে তাদের মানব বন্ধুগণ বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা পরস্পরের মাধ্যমে ফললাভ করেছি। আর আপনি আমাদের জন্যে যে সময় নির্ধারণ করেছিলেন, আজ আমরা তাতে উপনীত হয়েছি।’-(৬:১২৮)

অন্য একদলকে আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তোমাদেরকে নেয়ামত স্বরূপ চোখ, কান, হাত-পা, ধন-সম্পদ এবং আরও অনেক কিছু দান করেছি। সেগুলির হক তোমরা কিভাবে আদায় করেছ? ধন-সম্পদ কোন কোন পথে ব্যয় করেছ?’-(১০২:৮)

তারা বলবে, ‘আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে তোমার দেয়া সকল নেয়ামত উপভোগ করেছি এবং তোমার নির্দেশিত পথে সেগুলির সদ্ব্যাবহার করেছি। বাকীটুকু সন্তানদের জন্যে রেখে এসেছি।’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা কি তোমাদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করতে-জীবন্ত কবর দিতে।’

তারা তা অস্বীকার করবে। তখন ফেরেস্তারা সেইসব জীবন্ত প্রোথিত কন্যাদেরকে হাযির করবে। আর তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে, ‘কি অপরাধে তোমাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল?’-(৮১:৮-৯)
তারা বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার, তা আমরা জানিনে? আমাদের তো সে সময় কোন জ্ঞান-বুদ্ধিই ছিল না। নিশ্চয়ই আমাদের হত্যাকারী পিতারাই আমাদের অপরাধ সম্পর্কে বলতে পারবেন।’

ঐ সকল কন্যাদের পিতাদেরকে বলা হবে, ‘কি অপরাধে তোমরা তাদেরকে হত্যা করেছিলে?’
তারা এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারবে না।

তখন তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে, ‘দুনিয়াতে তোমরা কি আল্লাহর স্থলে অন্যদেরকে উপাস্য স্থির করেছিলে? আর তাদেরকে পূজা করতে?’
তারা বলবে, ‘আমাদের প্রতিপালকের কসম, আমরা মুশরিক ছিলাম না।’
তখন আল্লাহ মুহম্মদকে বলবেন, ‘দেখ, কিভাবে এরা মিথ্যে বলছে নিজেদের বিপক্ষে?-(৬:২৩-২৪) এখন বল আমার এই বান্দাদের সম্পর্কে তোমার মন্তব্য কি?’

তিনি বলবেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমার এই উম্মতের একদল তো কোরআনকে প্রলাপ সাব্যস্ত করেছিল।’-(২৫:৩০) আর তাদের কেউ কেউ বলেছিল, ‘আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না তুমি মাটি ফাঁটিয়ে একটি ঝর্ণা ফোঁটাবে, বা তোমার খেজুরের বা আঙ্গুরের বাগান হবে, যার ফাঁকে ফাঁকে অজস্র নদী-নালা বইবে, বা তুমি যেমন বল, আকাশকে ও ফেরেস্তাদেরকে নিয়ে আসবে আমাদের সামনে, বা তোমার জন্যে একটি সোনার বাড়ী হবে, বা তুমি আকাশে আরোহণ করবে; কিন্তু তোমার আকাশে আরোহণ আমরা কখনও বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমাদের পড়ার জন্যে তুমি আমাদের উপর এক কিতাব অবতীর্ণ করবে।’-(১৭:৯০-৯৩)
তারা বলবে, ‘আমরা বলেছিলাম বটে, অত:পর তাকে স্বীকারও করে নিয়েছিলাম।’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের আমলনামা আমার সামনে রাখা আছে। এতে তো তোমাদের দাবীর স্বপক্ষে তেমন কিছু নেই।’
তারা বলবে, ‘আমরা এই আমলনামা মানি না।’
তখন তিনি তাদের আমল লেখক ফেরেস্তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমরা আমার এই বান্দাদেরকে কিরূপ দেখেছ?’
তারা বলবে, ‘আমরা তাদের প্রত্যেকটি কর্মকান্ডের খুঁটি-নাটি সম্পর্কে সম্যক অবগত। নিশ্চয়ই তারা পাপী।’

অতঃপর তিনি দুনিয়াতে ঐ ব্যক্তিদের চালক ও হেফাজতকারী ফেরেস্তাদেরকে অনুরূপ প্রশ্ন করবেন। তখন তারাও তাদের বিপক্ষে স্বাক্ষ্য দেবে। তখন আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘আমার এই ফেরেস্তারা তোমাদের দেখাশুনো করত। তারা তো তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়।’
তারা বলবে, ‘আমরা তাদের সাক্ষ্য মানি না। কারণ আমরা তাদেরকে চিনি না।’
আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে জানিয়ে ছিলাম, অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।’-(৮২:১০-১২) আমি কি আরও বলিনি-’তারা কি মনে করে আমি তাদের গোপন বিষয় ও পরামর্শ শুনি না? হ্যাঁ, শুনি। আমার ফেরেস্তারা তাদের কাছে থেকে লিপিবদ্ধ করে।’-(৪৩:৮০) ’আমি সকল গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় অবগত, মহত্তম সর্বোচ্চ মর্যাদা। তোমাদের মধ্যে কেউ গোপনে কথা বলুক বা তা সশব্দে প্রকাশ করুক, রাতের অন্ধকারে সে আত্মগোপন করুক বা প্রকাশ্য দিবালোকে বিচরণ করুক, সবই আমার কাছে সমান। আমার পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তোমাদের অগ্রে এবং পশ্চাতে, আমার নির্দেশে তারা তোমাদেরকে হেফাজত করে।’-(১৩:৯-১১) সুতরাং কিভাবে তোমরা তাদেরকে চেন না?’
তারা বলবে, ‘আমরা আমল করার সময় তাদেরকে দেখিনি।’
আল্লাহ বলবেন, ‘সামনে লওহে মাহফুজ রয়েছে। এতেও তোমাদের অবস্থা এরূপই লিখিত রয়েছে।’
তারা বলবে, ‘পরওয়ারদেগার, আপনি আমাদেরকে জুলুম থেকে আশ্রয় দিয়েছেন কি-না?’
তিনি বলবেন, ‘নিশ্চয়ই, জুলুম থেকে তোমরা আমার আশ্রয়ে রয়েছ।’
তারা বলবে, ‘পরওয়ারদেগার, যে সব সাক্ষ্য আমরা দেখিনি, সেগুলো কিরূপে আমরা মানতে পারি? আমাদের নিজের পক্ষ থেকে যে সাক্ষ্য হবে, আমরা নিশ্চয় তা মানব।’
তিনি বলবেন, ‘তবে, তোমাদের কথা অনুসারেই তোমাদের বিচার হবে।’

তখন ঐ ব্যক্তিদের মুখ সিল করে দেয়া হবে।-(৩৬:৬৩) এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (জিহ্বা, হাত ও পা)-কে সাক্ষ্যের জন্যে আহবান করা হবে।-(১৭:৩৬) সেগুলি তখন আল্লাহর সাথে কথা বলবে এবং তাদের আমলনামার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।-(৩৬:৬৪-৬৫)

প্রত্যেক ব্যক্তির আমলনামার সমস্ত অপকর্ম সমূহ দিনের আলোর মত উদ্ভাসিত করে দেয়া হবে, পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, ভ্রাতা-ভগ্নি, আত্মীয়-স্বজন সর্বোপরি হাশরের সমস্ত মানুষের সম্মুখে। ফলে সকলে এক অদ্ভূত সিনেমা অবলোকন করতে থাকবে। আর ঐ ব্যক্তি নিজের কৃতকর্ম সমূহ দেখে এসময় কামনা করবে জমিনের সাথে মিশে যেতে। কিন্তু গোপন করতে পারবে না আল্লাহর কাছে কোন বিষয়।-(৪:৪২) সুতরাং সে কেবল চিৎকার করে বলতে চাইবে, ‘হে আমার পরওয়ারদেগার! বন্ধ করুন এ প্রদর্শনী। আর আমাকে জাহান্নামেই প্রেরণ করুণ, আমি শাস্তিতেই থাকব। আপনি কেবল অনুগ্রহ করে আমার কর্ম সমূহ সর্বসমক্ষে প্রদর্শণ বন্ধ করুন।’ কিন্তু সে কিছুই বলতে পারবে না, কারণ, তার মুখ পূর্বেই সীল করা হয়েছে।

আর যারা বাইবেল পাঠ করেছে, তারা এই দৃশ্য দেখে স্মরণ করবে ঈসার সেই বাণী-‘এমন ঢাকা কিছুই নেই যা প্রকাশ পাবে না এবং এমন গুপ্ত কিছুই নেই যা জানা যাবে না। অতএব তোমরা অন্ধকারে যাকিছু বলেছ, সেইদিন তা আলোতে শোনা যাবে এবং মনে মনে যা বলেছ তা ছাদের উপরে প্রচারিত হবে।’

অতঃপর আল্লাহ ঐ ব্যক্তিদেরকে বলবেন, ‘তোমাদের আরও কিছু অপরাধ আছে, যা তোমাদের আমলনামায় নেই। এ সব পাপের সাক্ষী কেবলমাত্র আমি ছিলাম। কোরআনে কি বলা হয়নি-‘চোখের চুরি ও অন্তরের গোপন বিষয় আমি জানি?’-(৪১:১৯) এসব অপরাধ আমি ক্ষমা করতাম কিন্তু তোমরা নিজের পক্ষের সমস্ত সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছ। সুতরাং তোমার অন্তরের ঐ সকল অপরাধের ফলও তোমাদেরকে বহন করতে হবে।’

এরপর আল্লাহ তাদের অন্তর সমূহকে একে একে আহবান করবেন।-(৯৯:৩-৫) তখন যার যার অন্তর সেই সেই ব্যক্তির সকল কূ-পরিকল্পণা, কূ-বাসনা প্রকাশ করতে থাকবে। এভাবে সেদিন প্রত্যেকের গোপন বিষয়াদি পরীক্ষিত হবে এবং তার কোন শক্তি থাকবে না বা সাহায্যকারীও থাকবে না।-(৮৬:৯-১০) এভাবে অন্তরে যা আছে তা অর্জণ করা হবে।-(১০০:১০)

সবশেষে আল্লাহ বলবেন, ‘এদের পক্ষে কি কোন সুপারিশকারী আছে?’ কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। তখন তিনি বলবেন, ‘পাপিষ্ঠদের জন্যে কোন বন্ধু নেই কোন সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।’-(৪১:১৮)

অতঃপর তাদের মুখ খুলে দেয়া হবে এবং ফেরেস্তারা তাদেরকে তৎক্ষণাৎ পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে দেবে। যেখানে অবিশ্বাসীদের পৃথক করে রাখা হয়েছে। এ সময় তারা আক্ষেপ করে তাদের কান, চক্ষু, জিহবা, হাত ও পাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, ‘তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? আমরা তো দুনিয়াতে যা কিছু করেছি তোমাদের সুখের জন্যেই তা করেছি।’

তারা বলবে, ‘যে আল্লাহ সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়েছ। তোমাদের কান, তোমাদের চক্ষু এবং তোমাদের ত্বক তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে না-এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তোমরা আমাদের কাছে কিছু গোপন করতে না। তবে তোমাদের এই ধারণাও ছিল যে, তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না। তোমাদের পালনকর্তা সম্পর্কে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছ।’-(৪১:২১-২৩)

যারা তখনও জিজ্ঞাসিত হয়নি তাদের অনেকে দুরুদুরু বক্ষে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসিতদেরকে বলবে, ‘তোমাদের পালনকর্তা কি বললেন?’
তারা বলবে, ‘তিনি সত্য বলেছেন এবং তিনি সবার উপর মহান।’-(৩৪: ২৩)
সকল অপরাধীরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে এবং মনে মনে বলতে থাকবে, ‘হায়! কোন বাঁধা যদি এই বিচার আটকে রাখত।’-(২৫:২২)

কেউ কেউ আপন মনে বলবে, ‘হায় হায়, আল্লাহ সকাশে আমি কর্তব্যে অবহেলা করেছি এবং আমি ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের অর্ন্তভূক্ত ছিলাম।’
আবার অনেকে বলতে থাকবে, ‘আল্লাহ যদি আমাকে পথ প্রদর্শণ করতেন, তবে অবশ্যই আমি পরহেযগারদের একজন হতাম।’-(৩৯:৫৫-৫৮)

একদল মুনাফেকদের হাযির করা হবে। তাদেরকে বলা হবে- ‘তোমরা কি আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর রসূলদের মান্য করেছিলে?’
তারা বলবে, ‘আমরা তাদের অনুসারী ছিলাম। রসূল আমাদের স্বাক্ষী।’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আমি ভালভাবেই জানি। তোমরা মুখে তাদেরকে মান্য করেছিলে, কিন্তু অন্তরে তাদেরকে অমান্য ও ঘৃণা করেছিলে, তাই নয় কি?’

অতঃপর তিনি সাক্ষী সংশ্লিষ্ট রসূলদেরকে বলবেন, ‘তোমরা তাদেরকে কিরূপ দেখেছ?’
তারা বলবেন, ‘তাদের অন্তরের কথা তো আমরা জানতাম না।’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের একদল পরিখা যুদ্ধের সময় আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে, তোমরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ণ করবে না।-(৩৩:১৪) অতঃপর তোমরা তোমাদের রসূলের কাছে এই অযুহাত পেশ করে অব্যহতি চেয়েছিলে যে তোমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত রয়েছে।-(৩৩:১৩) বল, কেন তোমরা আমার কাছে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিলে, বস্ততঃ তোমাদের বাড়ীঘর তো অরক্ষিত ছিল না?’

তারা এই প্রশ্নের কোন জবাব দেবে না। আল্লাহ বলবেন, ‘আমার কাছে কৃত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার কারণে আজ তোমাদের কর্মসমূহ নিস্ফল করে দেয়া হবে।’-(৩৩:১৯)

মুশরিকদের একদল থাকবে অন্ধ, মূক বা বধির অবস্থায়। তাদের মধ্য থেকে একজন ফরিয়াদ করবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালে? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান।’

আল্লাহ বলবেন, ‘তুমি এরূপই ছিলে, আমার নিদর্শণাবলী তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। সেভাবে আজ তোমাকেও ভুলে গেছি আমি, আর এভাবে আমি তাকে প্রতিফল দেই যে বাড়াবাড়ি করেছে ও প্রতিপালকের নিদর্শণে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। আজ আমার শাস্তি হবে অবশ্যই কঠোর ও স্থায়ী। আর তার স্বাদ এখন গ্রহণ করবে তুমি।’- (২০:১২৪-১২৭)

সে তার অজুহাত পেশ করতে চাইবে।-(৭৫:১৫) বলবে, ‘হে আল্লাহ! শয়তানই আমাকে তোমার অবাধ্যতায় লিপ্ত করেছিল।’
তার সঙ্গী শয়তান বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি। বস্তুত: সে নিজেই ছিল সূদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত।’
আল্লাহ বলবেন, ‘আমার সামনে বাক-বিতন্ডা কোরও না। আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ভয় প্রদর্শণ করেছিলাম। আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারীও নই।’-(৫০:২৭-২৯)

অতঃপর আল্লাহ ফেরেস্তাদেরকে বলবেন, ‘আমার এ সকল বান্দাদের কাছে যদি কারও কোন প্রাপ্য থেকে থাকে অথবা তাদের কোন পাওনা থাকে অন্যদের কাছে তবে তা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বন্টন কর।’

ফেরেস্তারা বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার! এমনিতে ঈমান না থাকার দরুন এদের পূণ্য আমলের ওজন কম (এখানে স্বর্তব্য এদিন মানুষের আমল ওজন করা হবে গণনা করা হবে না।) এখন এগুলো পাওনাদারদের মাঝে বন্টন করলে এরা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে পড়বে। এছাড়া দেখা যাবে যার অনেক পূণ্য আমল আছে তার আমলনামায় আরও যোগ হচ্ছে।’
তিনি বলবেন, ‘ইঞ্জিল কি জানায়নি- যার অধিক আছে তাকে আরও দেয়া হবে এবং যার অল্প আছে তাও তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে।’

এক ধনবান ব্যক্তি বিদেশে যাবার আগে তার সমস্ত অর্থ-সম্পদের ভার তার গোলামদের হাতে অর্পণ করলেন। সেই গোলামদের ক্ষমতা অনুসারে তিনি একজনকে পাঁচ হাজার, একজনকে দুই হাজার ও একজনকে এক হাজার দিনার দিলেন।

অনেকদিন পর সেই মনিব এসে গোলামদের কাছে তার অর্থের হিসেব চাইলেন। যে পাঁচ হাজার দিনার পেয়েছিল, সে দশ হাজার দিনার নিয়ে এসে বলল, ‘হুজুর, আপনি আমাকে পাঁচ হাজার দিনার দিয়েছিলেন। দেখুন, আমি আরও পাঁচ হাজার দিনার লাভ করেছি।’

মনিব বললেন, ‘বেশ করেছ! তুমি ভাল ও বিশ্বস্ত গোলাম। তুমি অনেক বিষয়ে বিশ্বস্ত বলে আমি তোমাকে অনেক বিষয়ের ভার দেব। এসো, আমার সাথে আনন্দে যোগ দাও।’

যে দুই হাজার দিনার পেয়েছিল সে এসে বলল, ‘হুজুর, আপনি আমাকে দু’হাজার দিনার দিয়েছিলেন। দেখুন, আমি আরও দু’হাজার দিনার লাভ করেছি।’

মনিব তাকেও বললেন, ‘বেশ করেছ! তুমিও ভাল ও বিশ্বস্ত গোলাম। তুমি অল্প বিষয়ে বিশ্বস্ত বলে আমি তোমাকে অল্প বিষয়ের ভার দেব। এসো, আমার সাথে আনন্দে যোগ দাও।’

যে এক হাজার দিনার পেয়েছিল সে এসে বলল, ‘হুজুর, আমি জানতাম, আপনি ভয়ানক কঠিন লোক। যেখানে বীজ বুনেননি সে জায়গা থেকে আপনি ফসল কাটেন এবং যেখানে মুক্তা ছড়াননি সেই জায়গা থেকে তা কুড়ান। এজন্যে ভয়ে ভয়ে বাইরে গিয়ে মাটিতে আপনার অর্থ লুকিয়ে রেখেছিলাম। এই দেখুন, আপনার জিনিষ আপনারই আছে।’

তখন মনিব তাকে বললেন, ‘ওহে, দুষ্ট ও অলস গোলাম! তোমার মুখের কথা দিয়েই আমি তোমার বিচার করব। তুমি তো জানতে যে আমি কড়া লোক; যেখানে আমি বুনিনি- সেখান থেকে কাটি, আর যেখানে ছড়াইনি -সেখানে কুড়াই। তাহলে মহাজনদের কাছে আমার অর্থ জমা রাখনি কেন? তা করলে তো আমি এসে দিনারটাও পেতাম সঙ্গে কিছু মুনাফাও।’

মনিব রাগান্বিত হয়ে তার পাশে দাঁড়ান অন্য কর্মচারীদেরকে বললেন, ‘তোমরা ওর কাছ থেকে দিনার গুলি নিয়ে যার বেশী আছে তাকে দাও।’
তারা বলল, ‘হুজুর, তার তো দশ হাজার দিনার আছে।’
মনিব বললেন, ‘যার আছে তাকে আরও দেয়া হবে, আর তাতে তার অনেক হবে। কিন্তু যার নেই, তার যা আছে তাও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে। ঐ অপদার্থ, গোলামকে তোমরা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দাও।’

যাহোক, এসময় ফেরেস্তারা অবিশ্বাসীদের একজনকে বেঁছে নেবে। তারপর সে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করবে, ‘এই ব্যক্তি ওমুকের পুত্র ওমুক। যদি কারও কোন প্রাপ্য তার জিম্মায় থাকে, তবে সে সামনে এসে তা আদায় করুক।’

সকলে যার যার আমলনামা পূর্বেই পড়ে ফেলেছিল, তাই এই আহবান শুনে এমন সঙ্কটময় সময় হবে যে, পুত্র আনন্দিত হবে পিতার জিম্মায় নিজের কোন প্রাপ্য আছে দেখলে এবং পিতা আনন্দিত হবে পুত্রের জিম্মায় নিজের কোন প্রাপ্য দেখলে। এমনি ভাবে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনের মধ্যে কারও জিম্মায় নিজের কোন প্রাপ্য দেখলে সে তা আদায় করতে উদ্যত ও সচেষ্ট হবে।

এসময় পিতা যদি দেখে যে তার আমলনামা অনুসারে তার জান্নাতে গমন কঠিন হবে, তখন সে তার পুত্রকে বলবে, ‘হে পুত্র আমার, তুমি জান যে, আমি তোমার প্রতি কেমন স্নেহশীল ও সদয় পিতা ছিলাম।’
পুত্র বলবে, ‘নিশ্চয়, আপনার কাছে আমার ঋণ অসংখ্য।’
তখন পিতা বলবে, ‘আজ আমি তোমার মুখাপেক্ষী। তোমার পূণ্য সমূহের মধ্যে থেকে আমাকে যৎ সামান্য দাও, এতে আমার মুক্তি হয়ে যাবে।’
পুত্র বলবে, ‘পিতা, আপনি সামান্য বস্তুই চেয়েছেন-কিন্তু এই যৎ সামান্য কম হওয়াতে আমারও যে মুক্তি মিলবে না।’
এভাবে পিতা, পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও পিতার কোন উপকার করতে পারবে না।-(৩১:৩৩)

এসময় সেই ব্যক্তি তার স্ত্রীকে সম্বোধন করে একই রকম বলবে। তখন স্ত্রীও পুত্রের মত উত্তর দেবে। পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধনের কথা ভুলে যাবে সবাই।-(২৩:১০১) প্রত্যেকেই নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়বে।-(৮০:৩৭)

অবশ্য এমনও হতে পারে মুমিন পুত্র অবিশ্বাসী পিতা-মাতার জন্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করবে, ‘হে পরওয়ারদেগার! আমার নামাজ রোজার বিনিময়ে আমার পিতা-মাতাকে হিসাব মুক্ত করে দেয়া হোক।’ -তবে তা গৃহীত হবে না। আল্লাহ বলবেন, ‘আজকের এদিনে কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং কারও পক্ষে কোন সুপারিশ কবুল হবে না বা কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না।’-(২:৪৮)

যাহোক, ফেরেস্তারা ঐ অবিশ্বাসীর আমলনামায় মনোনিবেশ করবে। অবিশ্বাসী হলেও এ ব্যক্তির আমলে পূণ্য অনেক। অনেক সৎকাজ দান-খয়রাত ইত্যাদি নিয়ে সে উপস্থিত হয়েছে। ফেরেস্তারা এবার তার আমলের পাপের দিকে মনোযোগ দেবে। দেখা যাবে সে দুনিয়াতে লোকদের গালি দিয়েছে, অন্যের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করেছে, অন্যের অর্থকড়ি অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করেছে, অন্যকে অহেতুক প্রহার করে তাদের অন্তরে আঘাত দিয়েছে এবং সর্বোপরি সে একজন খুনী। ফেরেস্তারা তাকে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। সে বলবে, ‘আমি এসবের কিছুই করিনি? এসবের সাক্ষী কই?’

তখন সেইসব অত্যাচারিতদেরকে হাযির করবে ফেরেস্তারা। অতঃপর এসব মযলুম আল্লাহর কাছে তাদের জুলুমের প্রতিকার দাবী করবে। তখন আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে মযলুমদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ করবেন। সে বলবে, ‘কিভাবে আমি ক্ষতিপূরণ করতে পারি?’
তিনি বলবেন, ‘মযলুমকে পরিমান মত তোমার অর্জিত সৎকর্ম দিয়ে বা পরিমান মত মযলুমের অপরাধ তোমার কাঁধে নিয়ে।’

অতঃপর ফেরেস্তারা তার সৎকর্ম থেকে পরিমান মত ঐ সকল মযলুমদেরকে মধ্যে বন্টন করে দেবে। এতে যদি সৎকর্ম কম পড়ে যায় তবে মযলুমদের গোনাহ তার উপর চাপিয়ে দেবে। এভাবে ঈমানদারদের কাছে তার কোন পাওনা থাকলে সেটাও তাকে দেয়া হল। উল্লেখ্য ঈমানদারদের কাছ থেকে জুলুম ও হকের বিনিময়ে আমল কেটে নিয়ে অন্যদের মাঝে বন্টন করা হবে, কিন্তু ঈমান কখনও বন্টন করা হবে না। আর যদি কোন ব্যক্তির কোন সৎকর্ম নাও থাকে অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি যতবড় পাপীই হোক না কেন, শুধু ঈমান থাকার কারণে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না।

বন্টন শেষে দেখা যাবে কোন অবিশ্বাসীর আমলনামায় কোন পূণ্য অবশিষ্ট থাকবে না। তারা শতভাগ জাহান্নামীতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে কোরআনে বলা হয়েছে- ‘আর যারা অবিশ্বাসী তাদের জন্যে আছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দেবেন।’-(৪৭:৮)

এরূপ ক্ষেত্রে ঐসব ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবে। কিন্তু তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, কেননা তাদের কেউই দুনিয়াতে এই দিনের কথা স্মরণ করে কারও উপর কখনও দয়া করেনি, কাউকে কখনও ক্ষমা করেনি। এ হবে বাইবেলের সেই কাহিনীর মত-

এক রাজা তার দাসদের হিসেব নিতে চাইলেন। তিনি হিসেব আরম্ভ করলে এমন একজন তার নিকটে আনীত হল, যে তার দশ সহস্র তালন্ত ধারিত। রাজা দেখলেন তার পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং তিনি তাকে তার স্ত্রী-সন্তানাদিসহ সর্বস্ব বিক্রি করে তা আদায় করতে আদেশ করলেন। এতে সেই দাস তার চরণে পড়ে প্রাণিপাত করে বলল, ‘হে প্রভু, আমার প্রতি ধৈর্য্য ধরুন, আমি আপনার সমস্তই পরিশোধ করব।’

তখন রাজা তার প্রতি করুনা করলেন ও তার সমস্ত ঋণ ক্ষমা করলেন। কিন্তু সেই দাস বাইরে গিয়ে তার সহদাসদের একজনকে দেখতে পেল, যে তার এক‘শ সিক্কা ধারিত। সে তাকে গলা টিপে ধরল এবং বলল, ‘তুই যা ধারিস, তা পরিশোধ কর।’
তখন সেই সহদাস তার চরণে পড়ে বিনতি পূর্বক বলল, ‘আমার প্রতি ধৈর্য্য ধর, আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করব।’

কিন্তু ঐ দাস তাতে সম্মত হল না। সে তাকে কারাগারে আটক রাখল, যে পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করে। এই ব্যাপার দেখে অন্যান্য সহদাসরা বড়ই দুঃখিত হল, আর তারা তাদের প্রভুর কাছে গিয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করল। তখন ঐ রাজা তাকে ডেকে বললেন, ‘দুষ্টু দাস! তুমি আমার কাছে বিনতি করাতে আমি তোমার ঐ সমস্ত ঋণ ক্ষমা করেছিলাম; আমি যেমন তোমার প্রতি দয়া করেছিলাম, তেমনি তোমার সহদাসের প্রতি দয়া করা কি তোমার উচিৎ ছিল না?’ রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে পীড়নকারীদের নিকটে সমর্পণ করলেন, যে পর্যন্ত না সে সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে।

যা হোক, প্রসঙ্গে ফিরি আবার-আল্লাহ বলবেন, ‘হে জ্বিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বর আগমন করেনি, যারা তোমাদেরকে আমার বিধানাবলী বর্ণনা করত, তোমাদের কাছে আমার আয়াত সমূহ পাঠ করত এবং তোমাদেরকে এই দিনের ভীতি প্রদর্শণ করত?’- (৬:১৩০)

--কিন্তু তোমরা অহঙ্কার করেছিলে এবং তোমরা ছিলে এক অপরাধী সম্প্রদায়! যখন বলা হত ‘আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোন সন্দেহ নেই’, তখন তোমরা বলতে ‘আমরা জানি না কেয়ামত কি? আমরা কেবল ধারণাই করি এবং এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই।’-(৪৫:৩১-৩২)

তারা বলবে, ‘আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম। পার্থিব জীবন আমাদের প্রতারিত করেছে।’-(৬:১৩০) ‘এখন হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে সামান্য মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, যাতে আমরা আপনার আহবানে সাড়া দিতে এবং পয়গম্বরগণের অনুসরণ করতে পারি।’

আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা কি ইতিপূর্বে কসম খেতে না যে, তোমাদেরকে দুনিয়া থেকে যেতে হবে না? তোমরা তাদের বাস ভূমিতেই বসবাস করতে, যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছিল এবং তোমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল যে, আমি তাদের সাথে কিরূপ ব্যাবহার করেছি এবং আমি পূর্বেই তোমাদেরকে ওদের সব কাহিনীই বর্ণনা করেছি।’-(১৪:৪৪-৪৫) ‘অতএব আল্লাহর প্রতি ধারণা কোরও না যে, তিনি রসূলগণের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’-(১৪:৪৭) ‘সুতরাং এখন আগুন হল তোমাদের বাসস্থান। তথায় তোমরা চিরকাল অবস্থান করবে; কিন্তু যখন চাইবেন আল্লাহ।’

এরপর আল্লাহ একে একে ঈমানদারদের বিচার কাজ শুরু করবেন। তবে ব্যতিক্রম হবে এই যে, বদর যুদ্ধে নিহত মুহম্মদের দশজন সাহাবীর আমলনামা ওজন হবে না, তাদের সাথে আল্লাহ কেবল সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করবেন। কারণ, তারা দুনিয়াতেই বেহেস্তের সুসংবাদ প্রাপ্ত। যাহোক, মুমিনদের থেকে এই যে হিসাব আল্লাহ গ্রহণ করবেন, এটা সুনিশ্চিত যে, তা তাদের জন্যে হবে রহমত স্বরূপ। তারা আল্লাহর সাথে কথা বলার সেই স্বাদ উপভোগ করবে, যে স্বাদ মূসা উপভোগ করেছিলেন তূর পর্বতে, আর মুহম্মদ মেরাজ রজনীতে।

এক সূদীর্ঘ সময় ঈমানদারগণ অবিশ্বাসীদের বিচার প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের উপর এই বিচার কোন প্রভাব ফেলেনি।-(৬:৬৯) তারা হাসিমুখে তাদের পালকর্তার সম্মুখে উপস্থিত হবে। ফেরেস্তা তাদের কাউকে আল্লাহর সম্মুখে যথাস্থানে দাঁড় করিয়ে দিলে, সে তার আমলনামা আল্লাহর সামনে পেশ করবে। তখন আল্লাহ তার কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করবেন।-(২৫:২৩) এ এমনই হবে।

যা হোক, এক আল্লাহে, রসূলগণে ও আখেরাতে পূর্ণ বিশ্বাসী এবং সৎকর্মশীল এক ব্যক্তিকে হাজির করা হল। দুনিয়াতে সে ছিল রাজনীতিবিদ। তার আমলনামা দেখে তাকে বলা হবে, ‘এ-কি! তুমি দেখছি ধর্ম-কর্মের আশপাশ দিয়েও যাওনি! যদিও সৎকর্ম আছে বটে, কিন্তু নামাজ-রোজার কিছুই তো নেই তোমার আমলনামায়!’
সে বলবে, ‘হে আল্লাহ! দুনিয়াতে অপরের জন্যে নানান কাজে ব্যাপৃত থাকায় তোমার সম্মুখে হাজিরা দেবার যথেষ্ট সময় বের করতে পারিনি। তবে আমি কখনও বিস্মৃত হইনি আমার প্রতিটি কর্মের প্রতি তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।’
আল্লাহ বলবেন, ‘দাউদ ও শলোমনকে তো বিরাট রাজ্য দান করেছিলাম। তদুপরি তারা আমার আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণ ভাবে পালন করেছিল। সুতরাং তোমার এই ওজর গ্রহণ যোগ্য হবে কিভাবে?’ সে এর কোন উত্তর দিতে পারল না। তার আমল ওজন করা হলে সে দোষী সাব্যস্ত হল, আল্লাহর যথেষ্ট পরিমাণ করুণালাভে ব্যর্থ হওয়ায়।

অতঃপর ফেরেস্তা অপর একজনকে আল্লাহর সম্মুখে হাযির করবে। এই ব্যক্তিটির আমলনামা চমৎকার। মহাত্রাস তাকে চিন্তান্বিত করবে না।-(২১:১০৩) তার আমলনামা ওজনের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হবে ‘সালাম’। এরপর তাকে জান্নাতী ঘোষণা করা হবে। তখন ফেরেস্তারা তাকে নিয়ে যাবেন এক ছায়াময় পরিবেশে।

সেখানে অপেক্ষমান ফেরেস্তা তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলবে, ‘আজ তোমার দিন, যেদিনের ওয়াদা তোমাকে দেয়া হয়েছিল।’ -(২১:১০৩)
তারা তাকে স্ব-সম্ভ্রমে তার জন্যে নির্দিষ্ট আসনে বসতে দেবে। আর সেখানে সে আসনে হেলান দিয়ে বসবে এবং আনন্দে মশগুল হয়ে পড়বে। সেখানে তার জন্যে থাকবে ফলমূল এবং যা সে চাইবে।-(৩৬:৫৬-৫৭)

অপর এক ব্যক্তিকে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড় করান হল। এই ব্যক্তি ভয়ে অস্থির ও কম্পমান ছিল, কেননা সে তার আমলনামা পূর্বেই দেখে ফেলেছিল আর তাতে সৎকর্ম অতি কিঞ্চিত ছিল। তাকে বলা হল- ‘তুমি কি এই আমলনামা মান?’
সে কম্পিত কন্ঠে বলবে, ‘হে আল্লাহ! এই আমলনামা সম্পূর্ণ সত্য আর তা এখন তোমার ন্যায় বিচারের পাল্লার সম্মুখে রাখা।’

তার আমল ওজনে দেয়া হল। লোকটি মাথা নীচু করে মনে মনে আল্লাহর করুণা কামনা করতে লাগল। এসময় তাকে জান্নাতী ঘোষণা করা হল। লোকটি এই ঘোষণা শুনে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সম্মুখে তাকাল, দেখলেন তার সামান্য নেক আমল বিশাল পাপের বোঝাকে নীচে ফেলে দিয়েছে। সে ভাবল নিশ্চয় ওজনে কোন ভুল হয়েছে। এ সময় তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হল-‘ওজনে কোন ভুল হয়নি। এ হয়েছে তোমার সেই আমলের ওজনের কারণে যা তুমি দুনিয়াতে মানুষের কল্যাণের জন্যে রেখে এসেছিলে। তোমার এই শিক্ষা এগিয়ে এসেছে এবং যারা এই শিক্ষা অনুযায়ী আমল করেছে, তাদের সবার আমলেও তোমার অংশ রাখা হয়েছে। তাছাড়া তুমি দুনিয়াতে নির্যাতিত হয়েছিলে অতঃপর ঐ নির্যাতনকারীকে তুমি ক্ষমাও করে দিয়েছিলে। সুতরাং আজ আমিও তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি।’

অতঃপর ফেরেস্তারা তাকে স্ব-সম্ভ্রমে নিয়ে গিয়ে নির্ধারিত আসনে বসাবে। সেখানে তার জন্যে থাকবে পর্যাপ্ত আহার্য এবং পানীয় এবং যা সে চাইবে।

অপর একজন মুমিন বান্দাকে হাযির করা হবে। সে সারাজীবন আল্লাহর দেয়া বিধি-ব্যবস্থা অনুসারে চলেছে। সুতরাং এই ব্যক্তি তার আমলনামাতে খুব খুশী থাকবে। আল্লাহ তার আমলনামা দেখবেন। কিন্তু যখন তার আমল ওজন করা হবে দেখা যাবে তার প্রতিটি আমল ওজনে খুব হালকা। তখন আশা অনুযায়ী ফললাভে ব্যর্থ হয়ে সে প্রতিবাদ করে বলবে, ‘হে আল্লাহ! একই আমলে অন্য অনেকের তুলনায় আমার আমল হালকা হল কেন?’

তিনি বলবেন, ‘আমলের পাশাপাশি অন্যকে সৎ কাজে উৎসাহিত করা এবং অসৎ কাজে নিরুৎসাহিত করা তোমার উপর ফরজ ছিল, কিন্তু তুমি তা করনি। তাই তোমার ঐ ধরণের আমল ওজনে হালকা হয়েছে।’ কিতাবে কি ছিল না- ‘নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ; কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।’-(১০৩:২-৩)

শেষ বিচারের এই ধরন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে ঈসা অনেকগুলো উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন-

--‘শেষের যারা তারা প্রথম হবে এবং বেশী পাবে, আর প্রথম যারা তারা শেষে পড়বে এবং কেবলমাত্র প্রাপ্যটুকুই পাবে।’

এক গৃহস্থ সকাল বেলায় ক্ষেতের কাজে মজুর লাগানোর জন্যে বাজারে গেলেন। বাজারে যে স্থানে মুজুরেরা কাজের সন্ধানে সমবেত হয়, গৃহস্থ সেখানে পৌঁছে কয়েক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। অতঃপর তিনি তাদের সকলকে মুজুর হিসেবে তার ক্ষেতের কাজে লাগাতে চাইলে তারা সকলেই সম্মত হল। তখন তিনি তাদের সঙ্গে ঠিক করলেন যে, তিনি প্রত্যেককে দিনে এক দিনার করে মুজুরি দেবেন। তারা এই মুজুরিতে সম্মত ছিল, সুতরাং ঐ গৃহস্থ তাদের সকলকে তার আঙ্গুর ক্ষেতে পাঠিয়ে দিলেন।

প্রায় নয়টার সময় আবার ঐ গৃহস্থ বাইরে গেলেন এবং বাজারে আরও কয়েক জনকে বিনা কাজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, ‘তোমরাও আমার আঙ্গুর ক্ষেতে কাজ করতে যাও। আমি তোমাদেরকে উপযুক্ত মুজুরীই দেব।’
এতে সেই লোকেরাও গেল।

ঐ গৃহস্থ আবারও প্রায় বারটা এবং তিনটের দিকে বাজারে গিয়ে ঐ একই রকম করলেন। প্রায় পাঁচটার দিকে বাজারে গিয়ে আরও কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা কাজে না গিয়ে সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন?’
তারা বলল, ‘কেউ আমাদেরকে কাজে লাগায়নি।’
তিনি বললেন, ‘তোমরাও আমার আঙ্গুর ক্ষেতের কাজে যাও। আমি উপযুক্ত মুজুরীই দেব।’

সন্ধ্যার সময় ক্ষেতের মালিক ঐ গৃহস্থ তার কর্মচারীকে বললেন, ‘মুজুরদের ডেকে শেষজন হতে আরম্ভ করে প্রথম জন পর্যন্ত প্রত্যেককে মুজুরী দাও।’

বিকেল পাঁচটার সময় যে মুজুরদের কাজে লাগান হয়েছিল, তাদের প্রত্যেকে এক এক দিনার করে নিয়ে গেল। এতে যাদের প্রথমে কাজে লাগান হয়েছিল, তারা বেশী পাবে বলে মনে করল। কিন্তু তারাও প্রত্যেকে এক এক দিনার করে পেল। এতে তারা ঐ মালিকের বিরুদ্ধে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। আর তাদের একজন তো মাটিতে থুথু ছিটিয়ে মালিককে বলেই ফেলল, ‘আমরা সারাদিন রোদে পুড়ে কাজ করেছি, কিন্তু যাদের শেষে কাজে লাগান হয়েছিল, তারা মাত্র এক ঘন্টা কাজ করেছে, অথচ তাদেরকে আপনি আমাদের সমান মুজুরী দিলেন।’

মালিক গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার প্রতি তো অন্যায় করিনি! তুমি কি এক দিনারেই কাজ করতে সম্মত হওনি? তোমার পাওনা নিয়ে চলে যাও। তোমাকে যেমন দিয়েছি এই শেষের জনকেও তেমনই দিতে আমার ইচ্ছে। যা আমার নিজের, তা খুশীমত ব্যাবহার করার অধিকার কি আমার নেই? নাকি আমি দয়ালু বলে তোমার চোখ টাটাচ্ছে?’

--‘যে নিজেকে উঁচু করে- তাকে নীচু করা হবে এবং যে নিজেকে নীচু করে- তাকে উঁচু করা হবে।’

দু‘জন লোক প্রার্থণা করার জন্যে এবাদতখানায় গেল। তাদের মধ্যে একজন ছিল ফরীশী ও অন্যজন কর আদায়কারী। সেই ফরীশী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের বিষয়ে এই প্রার্থনা করল- ‘হে খোদা, আমি তোমাকে ধন্যবাদ দেই যে আমি অন্য লোকদের মত ঠগ, অসৎ ও ব্যভিচারী নই, (আঁড় চোখে পাশে দাঁড়ান কর আদায়কারীর দিকে তাকিয়ে) এমন কি এই কর আদায়কারীর মতও নই। আমি সপ্তাহে দু‘বার রোজা রাখি এবং আমার সমস্ত আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ তোমাকে দেই।’

ঐ ফরীশীর প্রার্থনা শুনে কর আদায়কারীর বেহেস্তের দিকে তাকাবারও সাহস হল না; সে বুক চাপড়ায়ে বলল, ‘হে খোদা! আমি পাপী; আমার প্রতি রহম কর।’
ঐ কর আদায়কারীর সকল পাপ খোদা ক্ষমা করলেন, কিন্তু ঐ ফরীশী পাপমুক্ত হল না।

--‘নি:স্বার্থ দান মূল্যমানে নয় বরং তা সম্পদের শতকরা হারে বিবেচ্য হবে।’

ঈসা এবাদতখানায় বসে রয়েছেন। কাছেই দান বাক্স। লোকেরা টাকা-পয়সা দান করছিল। ঈসা বেশ কৌতুহল নিয়ে লোকদের দান, বাক্সে রাখা দেখছিলেন। ধনীদের অনেকে মোটা অঙ্কের টাকা দিল। একসময় একজন স্ত্রীলোক এসে মাত্র দু‘টো পয়সা বাক্সে রাখল। এই স্ত্রীলোকটি ছিল বিধবা এবং অভাবী। ঈসা তাকে দেখিয়ে তার শিষ্যদের বললেন, ‘এই স্ত্রীলোকটির দান অন্য সকলের চেয়ে অনেক বেশী। খরচ করার পরে যা অবশিষ্ট ছিল অন্যেরা তা থেকেই দিয়েছে। কিন্তু এই অভাবী স্ত্রীলোকটি, তার বেঁচে থাকবার জন্যে যা সম্বল ছিল, সমস্তই দিয়ে দিল।’

প্রসঙ্গে ফিরি- বিচার কাজ শেষে একদল নারী, পুরুষ ও শিশু রয়ে যাবে যারা এক আল্লাহে বিশ্বাসী হলেও দুনিয়াতে তারা ছিল অসহায়, তারা কোন উপায় করতে পারেনি এবং পথও জানত না। এই মাজুর শ্রেণীর লোকেরা যখন আল্লাহর সম্মুখে আনীত হবে, তখন ভীত ও কম্পমান থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘হে আমাদের বান্দারা! দুনিয়াতে তোমাদের অসহায় অবস্থা আমি সম্যক অবহিত ছিলাম। সুতরাং আজ আমি তোমাদের সকল অপরাধ সমূহ ক্ষমা করলাম এবং তোমরাও জান্নাতবাসী হলে।’-(৪:৯৮-৯৯)

এক সময় হাজার বৎসরের সমান এই বিচার দিবসে সকলের বিচার কাজ শেষ হবে-(৩২:৫) এবং আল্লাহ সকল আমলনামা গুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণারূপ করে দেবেন।-(২৫:২৩) এবং বলবেন, ‘হে অপরাধীরা আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও।’

অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা থেকে।-(৫৫:৪১) তাদের বৈশিষ্ট্য হবে-মুখমন্ডল কাল-(৩৯:৬০) ও চক্ষু নীল বর্ণের।-(২০:১০২) ফলে সহজেই ফেরেস্তারা তাদেরকে মুমিনদের থেকে আলাদা করে ফেলবে। এতে সকল মানব তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়বে। অগ্রবর্তীতে থাকবেন নবী-রসূলগণ অর্থাৎ আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্যশীল ব্যক্তিগণ। এদের একদল পূর্ববর্তীদের মধ্যে থেকে এবং অল্প সংখ্যক পরবর্তীদের মধ্যে থেকে হবে। আর ভাগ্যবানেরা ডান দিকে এবং হতভাগারা বাম দিকে থাকবে।-(৫৬:৭-২৬)

Paumotu heavens
বাইবেলে রয়েছে- শেষ বিচারের দিন খোদা ফেরেস্তাদের সঙ্গে নিয়ে আপন প্রতাপে উপস্থিত হবেন এবং তিনি নিজ প্রতাপের সিংহাসনে বসবেন। আর সমুদয় জাতি তাঁর সম্মুখে একত্রীকৃত হবে; পরে (বিচার শেষে) তিনি তাদের একজন থেকে অন্যজন পৃথক করবেন, যেমন পালরক্ষক ছাগ হতে মেষ পৃথক করে। আর তিনি এক দলকে আপনার ডান দিকে এবং এক দলকে বাম দিকে রাখবেন।

তখন খোদা ডান দিকের লোকদেরকে বলবেন, ‘তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। জগতের পত্তনাবধি যে রাজ্য তোমাদের জন্যে প্রস্তত করা হয়েছে, তার অধিকারী হও। কেননা আমি ক্ষুধিত হয়েছিলাম-আহার দিয়েছিলে; পিপাসিত হয়েছিলাম-পান করিয়েছিলে; অতিথি হয়েছিলাম-আশ্রয় দিয়েছিলে; বস্ত্রহীন হয়েছিলাম-বস্ত্র দিয়েছিলে; পীড়িত হয়েছিলাম-সেবা করেছিলে; কারাগারে ছিলাম-দেখতে গিয়েছিলে।’

তারা বলবে, ‘প্রভু, কবে আপনাকে ক্ষুধিত দেখে ভোজন, কিম্বা পিপাসিত দেখে পান করিয়েছিলাম? কবেই বা আপনাকে অতিথি দেখে আশ্রয় দিয়েছিলাম, কিম্বা বস্ত্রহীন দেখে বস্ত্র পরিয়েছিলাম? কবেই বা আপনাকে পীড়িত দেখে সেবা করেছিলাম বা কারাগারাস্থ জেনে দেখতে গিয়েছিলাম?
তখন তিনি বলবেন, ‘আমার বান্দাদের কারও প্রতি যখন তা করেছিলে, তখন আমারই প্রতি করেছিলে।’
আর তিনি ফেরেস্তাদেরকে বলবেন, ‘এদেরকে বেহেস্তে দাখিল কর, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে এবং সুখ ভোগ করবে।’

পরে তিনি বাম দিকের লোকদেরকে বলবেন, ‘তোমরা অভিশপ্ত, সুতরাং শয়তান ও তার সঙ্গীদের জন্যে যে অগ্নি প্রস্তত করা হয়েছে, তাতে প্রবেশ কর। কেননা আমি ক্ষুধিত হয়েছিলাম, আমাকে আহার দাওনি; পিপাসিত হয়েছিলাম, আমাকে পান করাওনি; অতিথি হয়েছিলাম, আমাকে আশ্রয় দাওনি, বস্ত্রহীন হয়েছিলাম, আমাকে বস্ত্র দাওনি; পীড়িত ও কারাগারাস্থ হয়েছিলাম, আমার তত্ত্বাবধান করনি।’
তখন তারা বলবে, ‘প্রভু, কবে আপনাকে ক্ষুধিত, কি পিপাসিত, কি অতিথি, কি বস্ত্রহীন, কি পীড়িত, কি কারাগারাস্থ দেখে আপনার পরিচর্য্যা করিনি?’
তখন তিনি বলবেন, ‘আমার বান্দাদের কারও প্রতিও যখন এ করনি, তখন আমারই প্রতি করনি।’ পরে তিনি ফেরেস্তাদেরকে বলবেন, ‘এদেরকে দোযখের মধ্যে ফেলে দাও, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে এবং শাস্তি ভোগ করবে।’

যাহোক, অত:পর আল্লাহ ফেরেস্তাদেরকে বলবেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং পাপীষ্ঠ, তাদের সঙ্গীদেরকে ও তাদের উপাস্যদেরকে লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাও এবং মুমিনদেরকে জান্নাতে দাখিল কর।’

বিভক্ত হওয়া তিন দলের জন্যে তিন ধরণের ফল অপেক্ষা করছে। যারা ডান দিকে, কত ভাগ্যবান তারা! এবং যারা বাম দিকে, কত হতভাগা তারা। অগ্রবর্তীরা তো অগ্রবর্তীই। তারাই নৈকট্যশীল, অবদানের উদ্যানসমূহে, তারা একদল পূর্ববর্তীদের মধ্যে থেকে এবং অল্প সংখ্যক পরবর্তীদের মধ্যে থেকে, স্বর্ণ খঁচিত সিংহাসনে তারা তাতে হেলান দিয়ে বসবে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে। তাদের কাছে ঘোরা ফেরা করবে চির কিশোরেরা পানপাত্র ও কূঁজা ও খাঁটি সূরাপূর্ণ পেয়ালা হাতে নিয়ে, যা পান করলে তাদের শিরঃপীড়া হবে না এবং বিকারগ্রস্থও হবে না। আর তাদের পছন্দমত ফলমূল নিয়ে এবং রুচিমত পাখীর মাংস নিয়ে। তথায় থাকবে আনত নয়না হুররা, আবরণে রক্ষিত মোতির ন্যায়, তারা যা কিছু করত তার পুরস্কার স্বরূপ। তারা তথায় অবান্তর ও খারাপ কথাবার্তা শুনবে না। কিন্তু শুনবে সালাম আর সালাম।-(৫৬:৭-২৬)

যারা ডান দিকে থাকবে তারা কত ভাগ্যবান। তারা থাকবে কাঁটা বিহীন বদরিকা বৃক্ষে এবং কাঁদি কাঁদি কলায় এবং দীর্ঘ ছায়ায় এবং প্রবাহিত পানিতে ও প্রচুর ফলমূলে, যা শেষ হবার নয় এবং নিষিদ্ধও নয়। তারা থাকবে সমুন্নত শয্যায়, থাকবে জান্নাতী রমনীর সান্নিধ্যে যাদেরকে আল্লাহ বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদেরকে করেছেন চির কুমারী, কামিনী, সমবয়স্কা কেবলমাত্র ডান দিকের লোকদের জন্যে।-(৫৬:২৭-৩৯)

বাম পার্শ্বস্থ লোক, কতই না হতভাগা তারা! তারা থাকবে প্রখর বাষ্পে এবং উত্তপ্ত পানিতে এবং ধুম্রকুঞ্জের ছায়ায় যা শীতল নয় এবং আরামদায়কও নয়।-(৫৬:৪০-৪৩)

Inferno (Dante).
ফেরেস্তাগণ মুমিনদেরকে স্ব-সম্মানে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত করতে থাকবে। এসময় তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলবেন, ‘হে আমার বান্দারা! তোমরা আমার আয়াত সমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলে এবং তোমরা ছিলে আজ্ঞাবহ। সুতরাং তোমাদের আজ কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিত হবে না। জান্নাতে প্রবেশ কর তোমরা এবং তোমাদের বিবিরা সানন্দে। তোমাদের কাছে পরিবেশন করা হবে স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র এবং তথায় রয়েছে মনে যা চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয়। তোমরা তথায় চিরকাল থাকবে। এই যে জান্নাতের উত্তরাধিকারী তোমরা হয়েছ, এটা তোমাদের কর্মের ফল। তথায় তোমাদের জন্যে রয়েছে প্রচুর ফলমূল তা থেকে তোমরা আহার করবে।’-(৪৩:৬৮-৭৩) এসময় জান্নাতীদের মুখমন্ডল হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল।-(৮০:৩৮-৩৯)

অন্যদিকে ফেরেস্তারা পাপীদেরকে লাঞ্ছিত অবস্থায় একসঙ্গে তিন-চার জন শৃঙ্খলিত করে বা গলায় বেড়ী পরিয়ে-(৪০:৭১) অথবা মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যেতে প্রস্তত করে ফেলবে।-(৯৬:১৫-১৬) এসময় তাদের মুখমন্ডল হবে ধূলি ধূসরিত। কালিমা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।-(৮০:৪০) অতঃপর আল্লাহ এসব পাপীদের প্রত্যেকের সঙ্গী ফেরেস্তা দু‘জনকে বলবেন, ‘তোমরা উভয়ই নিক্ষেপ কর জাহান্নামে প্রত্যেক অকৃতজ্ঞ বিরুদ্ধবাদীকে, যে বাঁধা দিত মঙ্গলজনক কাজে, সীমা লঙ্ঘনকারী, সন্দেহ পোষনকারীকে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য গ্রহণ করত, তাকে তোমরা কঠিন শাস্তির সম্মুখীণ কর।-(৫০:২৪-২৬)

এসময় তাদের দম বন্ধ হবার উপক্রম হবে, প্রাণ কন্ঠাগত হবে। তারা অভিসম্পাৎ করতে থাকবে শয়তানকে। তখন শয়তান তাদেরকে সম্বোধন করে বলবে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোন ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি, অতঃপর তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছ। অতএব তোমরা আমাকে ভৎর্সনা কোরও না বরং নিজেদেরকেই ভৎর্সনা কর। আমি তোমাদেরকে উদ্ধারে সাহায্যকারী নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতিপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি।’-(১৪:২১-২২)

অবিশ্বাসীদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় ফেরেস্তাগণ দলে দলে বিভক্ত করে হাঁকিয়ে, ধাক্কা মেরে, টেনে হিঁচড়ে আবার কাউকে চুল বা পা ধরে টেনে নিয়ে চলবে জাহান্নামের দিকে।-(১৯:৮৫-৮৭; ৪১:১৯; ১৪:৪৯-৫০; ৪০:৭১; ৫২:১৩) এসময় ফেরেস্তাগণ তাদের কোন দলকে বলবে, ‘চল তোমরা তারই দিকে যাকে, যাকে তোমরা মিথ্যে বলতে।’-(৭৭:২৯)

আবার কোন দলকে বলবে, ‘চল তোমরা তিন কুন্ডলি বিশিষ্ট ছায়ার দিকে যে ছায়া সুনিবিড় নয় এবং যা অগ্নির উত্তাপ থেকে রক্ষা করে না। তা অট্টালিকা সদৃশ বৃহৎ স্ফূলিঙ্গ নিক্ষেপ করবে।-(৭৭:৩০-৩৩)

যারা বাইবেল পড়েছিল তারা পরিস্কার বুঝতে পারবে তাদের গন্তব্যস্থান। এই দিন এবং এই অবস্থার কথা তো তাদের রসূল তাদেরকে জানিয়েছিলেন-

‘একজন লোক জমি চাষ করে সেখানে উৎকৃষ্ট গমের বীজ বুনলেন। এরপর সেই লোকের শত্রু এসে ঐ জমিতে শ্যামা ঘাসের বীজ বুনে চলে গেল। ফলে গমের চারা যখন বেড়ে উঠেল, তখন তার মধ্যে শ্যামা ঘাসও দেখা গেল। তা দেখে বাড়ীর গোলামেরা এসে মনিবকে বলল, ‘আপনি কি জমিতে উৎকৃষ্ট বীজ বুনেন নি? তবে শ্যামা ঘাস কোত্থেকে এল?’
তিনি বললেন, ‘কোন শত্রু এ করেছে।’
গোলামেরা বলল, ‘তবে আমরা গিয়ে ঘাসগুলি তুলে ফেলব কি?’
তিনি বললেন, ‘না, ঘাস তুলতে গিয়ে তোমরা হয়তঃ ঘাসের সাথে গমের চারাও তুলে ফেলবে। ফল পাকা পর্যন্ত ওগুলি একসঙ্গে বাড়তে দাও। যারা ফসল কাটে, আমি তাদেরকে বলব, যেন তারা প্রথমে শ্যামা ঘাসগুলি জড় করে আগুনে পোড়াবার জন্যে আঁটি আঁটি করে বাঁধে, আর তারপরে গম আমার গোলায় জমা করে।’

এ গল্পে- যিনি ভাল বীজ বুনেন, তিনি রসূল। জমি এ দুনিয়া, আর মুমিন লোকেরা ভাল বীজ। শয়তানের অনুগত লোকেরা সেই শ্যামা ঘাস। যে শত্রু তা বুনেছিল, সে শয়তান। আর ফসল কাটার সময়, পুনরুত্থানের দিন। যারা শস্য কাটবে, তারা ফেরেস্তা। শ্যামা ঘাস জড় করে যেমন আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পুনরুত্থান দিবসেও ঠিক তেমনি হবে-যারা অন্যদের পাপ করায় এবং নিজেরা পাপ করে, বিচার শেষে ফেরেস্তাগণ তাদেরকে আঁটি আঁটি বেঁধে এক সঙ্গে জড় করবে, অতঃপর দোযখের আগুনে ফেলে দেবে।

হায়! আজ তাদের সেই শ্যামা ঘাসের অবস্থা। তারা শৃঙ্খলিত, আর তারা চলেছে সেই দোযখের পথে। আহা তখন যদি তারা তাদের রসূলের কথা মান্য করত! তাদের আফসোসের কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না।

যখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীদেরকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন একসময় তারা তাদের ডান ও বামদিকে জাহান্নাম দেখতে পাবে। তখন তারা ভীত হয়ে পড়বে। আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘এটাই জাহান্নাম যাকে অপরাধীরা মিথ্যে বলত।’-(৫৫:৪৩)

মুমিনদের ভীত অবস্থা দেখে আল্লাহ জাহান্নামকে তাদের দৃষ্টির আড়াল করতে চারিদিক আঁধারে ঢেকে দেবেন। যাতে তারা অপদস্থ না হয়। তখন সকলে দাঁড়িয়ে পড়বে। আর মুমিনেরা আল্লাহকে বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।’

এসময় প্রত্যেক মুমিনকে তার ঈমান ও আমল অনুসারে নূর বন্টন করে দেয়া হবে। ফলে তাদের সম্মুখ ভাগে ও ডান পার্শ্বে তাদের জ্যোতি ছুটাছুটি করতে থাকবে।-(৬৬:৮) তাদেরকে বলা হবে, ‘আজ তোমাদের জন্যে সুসংবাদ জান্নাতের, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত।’-(৫৭:১২)

অতঃপর মুমিনেরা সম্মুখে এগিয়ে যেতে থাকবে। এসময় কপট বিশ্বাসী (মুনাফেক) পুরুষ ও নারীরা তাদের পিছে পিছে দৌঁড়াতে থাকবে। আর তারা সম্মুখস্থ জ্যোতিতে উদ্ভাসিত মুমিনদেরকে বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্যে একটু অপেক্ষা কর, আমরাও কিছু আলো নেব তোমাদের জ্যোতি থেকে।’
মুমিনেরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমরা পিছনে ফিরে যাও ও আলোর খোঁজ কর।’-(৫৭:১৩) তখন তাদের কিছু পিছনে ফিরে যাবে।

এদিকে উভয় দলের মাঝখানে খাঁড়া করা হবে একটি প্রাচীর, যার একটি দরজা হবে। তার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত এবং বাইরে আযাব।-(৫৭:১৩) দোযখের মধ্য দিয়ে যে পথ এই দ্বারের সঙ্গে মিশেছে তাই পুলসিরাত। মুমিনগণ তাদের নিজস্ব জ্যোতিতে সহজেই ঐ সরু পথ পাড়ি দেবে। অন্যরা হারিয়ে যাবে অন্ধকারে, খাদে।

নবীগণ তাদের সঙ্গে ভাগ্যবান বান্দাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বেহেস্তে প্রবেশ করবেন। শেষ ভাগ্যবান প্রবেশ করা মাত্র দ্বার বন্ধ করে দেয়া হবে। কপট বিশ্বাসীরা বাইরের অন্ধকার থেকে চিৎকার করবে কিন্তু স্বীয় রসূলগণ তাদেরকে অস্বীকার করবেন। এ হবে বাইবেলে উল্লেখিত সেই দু’দল মেয়ের ঘটনার মত-

দু’দল মেয়ে বান্ধবীর বরকে এগিয়ে আনতে বাতি নিয়ে বাইরে গেল। তাদের একদল ছিল বুদ্ধিমতী যারা বাতির সঙ্গে পাত্রে করে তেলও নিল। অন্যরা বাতি নিল বটে, কিন্তু সঙ্গে করে তেল নিল না। এদিকে বর আসতে দেরী হওয়াতে দু’দলই ঢুলতে ঢুলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

মধ্যরাতে চিৎকার শোনা গেল, ‘ঐ দেখ বর আসছে, বরকে এগিয়ে আনতে তোমরা বের হও।’ তখন মেয়েরা উঠে তাদের বাতি ঠিক করল। এসময় বুদ্ধিহীনারা দেখল তেলের অভাবে তাদের বাতি নিভে যাচ্ছে। সুতরাং তারা বুদ্ধিমতীদেরকে বলল, ‘তোমাদের তেল থেকে আমাদের কিছু তেল দাও। কারণ আমাদের বাতি নিভে যাচ্ছে।’
তারা বলল, ‘না তেল যা আছে তাতে হয়ত: আমাদের ও তোমাদের কুলাবে না। তোমরা বরং দোকানে গিয়ে নিজেদের জন্যে তেল কিনে আন।’

এদিকে তারা যখন তেল কিনতে গেল, তখন বর এসে পড়ল। যারা প্রস্তুত ছিল তারা বরকে সঙ্গে করে বিবাহ বাড়ীতে প্রবেশ করল। আর সকলে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করলে দ্বার বন্ধ করে দেয়া হল। সেই বুদ্ধিহীনারা ফিরে এসে দেখল বিবাহ বাড়ীর দ্বার বন্ধ। তখন তারা দ্বারে করাঘাত করে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘জনাব, দ্বারটা খুলে দিন।’
বর উত্তর করলেন, ‘নিশ্চয় আমি সত্য বলছি, আমি তোমাদেরকে চিনি না।’

গল্পের শেষে বলা হয়েছিল- ‘যে ব্যক্তি মানুষের সম্মুখে স্বীয় নবীকে স্বীকার করে, নবী তাকে ফেরেস্তাদের সাক্ষাতে স্বীকার করবেন; কিন্তু যে মানুষের সাক্ষাতে তাকে অস্বীকার করে, ফেরেস্তাদের সাক্ষাতে তাকে অস্বীকার করা হবে।’ হলও তাই-

তারা বলল, ‘হে ঈসা! আমরা কি আপনার নামে জ্বিন ছাড়াইনি? লোকদের রোগ-ব্যাধি দূর করিনি?’
ঈসা বলবেন, ‘দুষ্টের দল! আমার নিকট থেকে দূর হও।’

এদিকে আলোর খোঁজে পিছনে ফিরে যাওয়া এক দল আলো না পেয়ে ফিরে এসে মুমিনদেরকে ডেকে বলবে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?’
তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদগ্রস্থ করেছ। প্রতীক্ষা করেছ সন্দেহ করেছ এবং অলীক আশার পিছনে বিভ্রান্ত হয়েছ, অবশেষে আল্লাহর আদেশ পৌঁছেছে। এ সবই তোমাদের আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছে।’-(৫৭:১৪)

লোকেরা দেখবে, ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুব এবং অন্যান্য নবী-রসূলগণ বেহেস্তে রয়েছেন, আর তাদেরকে বাইরে দোযখে ফেলে দেয়া হচ্ছে। আর পূর্ব ও পশ্চিম হতে এবং উত্তর ও দক্ষিণ হতে লোকেরা এসে বেহেস্তে যাচ্ছে। এ যেন সেই জেলেদের ঘটনার মত-

‘একটা টানা জাল সমুদ্রে ফেলা হল, তাতে সর্বপ্রকার মাছ উঠে এল। তখন জেলেরা কূলে বসে ভাল মাছগুলি সংগ্রহ করে খুশীমনে যত্নের সাথে পাত্রে রাখল এবং মন্দগুলো নিতান্ত অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। এরূপই হবে- ফেরাস্তাগণ এসে ধার্মিকদের মধ্য থেকে দুষ্টদেরকে পৃথক করবে এবং তাদেরকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করবে।’

যখন বাম ও ডান দলের মধ্যে প্রাচীর তৈরী হবে, তখন কিছু লোক স্বাভাবিক ভাবেই প্রাচীরের উপর পড়ে যাবে। তারা না ঢুকতে পারবে জাহান্নামে, না ঢুকতে পারবে জান্নাতে।

এ পর্যন্ত মুহম্মদ কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের পক্ষে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করেননি, যদিও সুপারিশ করার অধিকার তার ছিল। কিন্তু এখন মুমিন থেকে পাপীদেরকে প্রাচীর দিয়ে পৃথক করে নেয়া দেখতে পেয়ে তিনি এবার আবেদন জানাবেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি কি তোমার বান্দাদেরকে শাস্তি দেবে? তুমি তো ক্ষমাকারী, দয়ালু। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিল কর। আর নিশ্চয়ই তুমি শাফায়াতের অধিকার আমাকে দিয়েছিলে।’
আল্লাহ বলবেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে শাফায়াতের অধিকার দিয়েছিলাম, সুতরাং তোমার সুপারিশের কারণে আমার অধিক অবাধ্য ব্যতিত সকলকে জান্নাতে দাখিল করব।’

‘আমি তো তোমাকে জানিয়ে ছিলাম-‘তোমার পালনকর্তার কসম, আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে একত্রে সমবেত করব, অতঃপর অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চারপাশে উপস্থিত করব। অতঃপর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দয়াময় আল্লাহর অধিক অবাধ্য, আমি অবশ্যই তাকে পৃথক করে নেব।

তাদের মধ্যে কারা জাহান্নামে প্রবেশের অধিক যোগ্য, আমি তাদের বিষয়ে ভালভাবে জ্ঞাত আছি। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তথায় পৌঁছিবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অনিবার্য ফয়সালা। অতঃপর আমি পরহেযগারদের উদ্ধার করব এবং জালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব।’-(১৯:৬৮-৭২)

মুহম্মদের শাফায়াতের পর পথ হারানো দল একে একে পথ খুঁজে পাবে। অবশ্য ইতিমধ্যে তারা দোযখে অবস্থান করে আসবে সর্বনিম্ন কয়েক হুকবা (এক হুকবা = চান্দ্র বৎসরের অর্থাৎ ৩৬০ দিনের বৎসরের ৮০ বৎসরের কিছু বেশী)। অবশেষে এই দ্বার পার হবে ডান পার্শ্বস্থ সকলে এবং ঈমানদারগণ।

এদিকে অবিশ্বাসীদেরকে জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করবে ফেরেস্তাগণ। অপরাধীরা সেখানে অপমানে অবনত এবং অর্ধ নির্মিলীত দৃষ্টিতে অধ:বদনে দাঁড়িয়ে থাকবে।-(৪২:৪৫) এসময় তাদের মুখমন্ডল এমন কাল হবে যে, যেন তা আঁধার রাতের টুকরো দিয়ে তৈরী। তখন তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা তোমাদের সুখ পার্থিব জীবনে নিঃশেষ করে এসেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ সুতরাং আজ তোমাদের অপমানকর আযাবের শাস্তি দেয়া হবে; কারণ তোমরা পৃথিবীতে অন্যায় ভাবে অহঙ্কার করতে এবং তোমরা ছিলে পাপচারী।-(৪৬:২০) আজ তোমাদেরকে ভুলে যাওয়া হবে, যেমন তোমরা এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিলে। তোমাদের আবাসস্থল জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই।’-(৪৫:৩৪)

এ সময় তারা বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! যেসব জ্বিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়।’ -(৪১:২৯)
অনেকে আবার বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! যারা আমাদের এই বিপদের সম্মুখীণ করেছে, আপনি জাহান্নামে তাদের শাস্তি দ্বিগুন করে দিন।’ -(৩৮:৬১)

কেউ কেউ আশে পাশের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে দেখে মনে মনে ভাবতে থাকবে, ‘আমাদের কি হল যে, যাদেরকে আমরা মন্দ লোক বলে গণ্য করতাম, তাদেরকে এখানে দেখছি না, তবে কি আমরা অহেতুক তাদেরকে ঠাট্টার পাত্র করে নিয়েছিলাম? না আমাদের দৃষ্টি ভুল করছে?’-(৩৮:৬২-৬৩)

অনেকে জাহান্নামের সামনে দাঁড়িয়ে পরস্পর কথা কাটা-কাটিতে লিপ্ত হবে।-(৩৮:৬৪) সাঙ্গ-পাঙ্গরা প্রধানদেরকে বলবে, ‘আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম- অতএব, তোমরা আল্লাহর শাস্তি থেকে আমাদেরকে কিছুমাত্র রক্ষা করবে কি?’
তারা বলবে, ‘যদি আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথ দেখাতেন, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সৎপথ দেখাতাম। এখন আমরা ধৈর্য্যচ্যূত হই কিম্বা সবর করি-সবই আমাদের জন্যে সমান- আমাদের রেহাই নেই।’

এসময় তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমাদের নিজেদের প্রতি তোমাদের আজকের এই ক্ষোভ অপেক্ষা আল্লাহর ক্ষোভ অধিক ছিল, যখন তোমাদেরকে ঈমান আনতে বলা হয়েছিল, অতঃপর তোমরা কুফরী করেছিলে।-(৪০:১০)
আল্লাহ বলবেন, ‘হে বনি আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত কোরও না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু এবং আমার এবাদত কর-এটাই সরল পথ? শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবু কি তোমরা বোঝনি?-(১০২:৬)

ইবলিস এ সময় বলবে, ‘দুনিয়াতে তোমার লক্ষ লক্ষ নির্বাচিত দাস তোমার একটাই বিধান এবং রীতিনীতি সম্বলিত দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে, আর আমিও তোমার সরলপথে ওৎ পেতে থেকে সচেষ্ট ছিলাম তাদেরকে বিভ্রান্ত করায়, তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সমূলে বিনষ্ট করতে।’

‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আদমকে আমার উপরে মর্যাদা দিয়েছিলে। আজ দেখ, আমি তার বংশধরদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার দলে নিয়ে ফেলেছি।’

আল্লাহ বলবেন, ‘আমি বলেছিলাম, ‘তোমাকে দিয়ে ও ওদের মধ্যে যারা তোমার অনুসারী হবে তাদেরকে দিয়ে, আমি জাহান্নাম ভরিয়ে তুলব?’-(৩৮:৮৪-৮৫) ‘তার সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্যে পৃথক পৃথক দল থাকবে?’-(১৫:৪৪) তাকিয়ে দেখ তুমি ও তোমার অনুসারীগণ আজ সেভাবেই জাহান্নামের দ্বারে দলে দলে প্রবেশের অপেক্ষায়।

Dante's Hell-1
অতঃপর তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, ‘হে বনি আদম! আমি বলেছিলাম- ‘তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে, অতঃপর তোমরা তা দেখবে দিব্য-প্রত্যয়ে (দিব্য প্রত্যয় হচ্ছে সেই প্রত্যয় যা চাক্ষুষ দর্শণ থেকে অর্জিত হয়। অর্থাৎ এটা বিশ্বাসের সর্বোচ্চ স্তর, যে স্তরে মানুষ তার পূর্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ফেলে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- মূসা যখন তূর পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে ছিলেন, তখন আল্লাহ তাকে এক পর্যায়ে বলেন যে, তার সম্প্রদায় তার অনুপস্থিতিতে গো-বৎসের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। তিনি আল্লাহর কথা পূর্ণ বিশ্বাস করেছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও তার প্রকাশ তেমন ছিল না-যেমন প্রকাশ ছিল স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর। এ সময় তিনি ক্রোধে আত্মহারা হয়ে দশ আজ্ঞা লিখিত ফলকদ্বয় হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।)-(১০২:৬-৭) এই সেই জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হত।’-(৩৬:৬৩)

সবাই চুপ করে থাকবে। তখন আল্লাহ বলবেন, ‘এটা কি যাদু, না তোমরা চোখে দেখছ না? এতে প্রবেশ কর অতঃপর তোমরা সবর কর আর না কর, উভয়ই তোমাদের জন্যে সমান।’-(৫২:১৫-১৬)
তারা বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদেরকে দু‘বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু‘বার জীবন দিয়েছেন। এখন আমরা অপরাধ স্বীকার করছি। অতঃপর এখনও নিস্কৃতির কোন পথ আছে কি?’

এ সময় ফেরেস্তারা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের এই বিপদ এ কারণে যে, যখন এক আল্লাহকে ডাকা হত, তখন তোমরা অবিশ্বাসী হয়ে যেতে, আর যখন তার সাথে শরীককে ডাকা হত, তখন তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে। সুতরাং এখন আদেশ তাই, যা আল্লাহ করেছেন, যিনি সর্বোচ্চ মহান।’-(৪০:১১:১২)

Dante's Hell-2
এরপর দলে দলে পাপীদেরকে তাদের উপাস্য দেবতাগণসহ জাহান্নামের দ্বার সমূহের কাছে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এভাবে পাপের ধরণ অনুযায়ী প্রত্যেক দরজার জন্যে পৃথক পৃথক দল তৈরী হবে।-(৪১:১৯) অতঃপর তারা সেখানে পৌঁছিলে তার দ্বারগুলি (৭টি) একে একে উন্মোচন করবে জাহান্নামের রক্ষী ফেরেস্তাগণ।-(৩৯:৭১) (জাহান্নামের অসংখ্য রক্ষীর মধ্যে উনিশ জন প্রধান রক্ষী আছে। আর নিয়েজিত এসব রক্ষী ফেরেস্তাগণ পাষাণ হৃদয় ও কঠোর স্বভাব। তারা আল্লাহ যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয় তারা কেবল তাই করে।-৬৬:৬)

পাপীরা জাহান্নামের গহ্ববর থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসতে দেখবে এবং তারা শুনতে পাবে তার গর্জণ ও হুংকার।-(২৫:১২-১৪) জাহান্নাম যেন এক মৃত্যু গহ্বর। যখন তারা তা দেখবে, তখন তারা বুঝে নেবে যে, তাতে তাদেরকে পতিত হতে হবে এবং তারা তা থেকে রাস্তা পরিবর্তণও করতে পারবে না।-(১৮:৫২-৫৩) তাদের মুখমন্ডল হবে লাঞ্ছিত, ক্লিষ্ট-ক্লান্ত।-(৮৮:২-৩)

এসময় জাহান্নামীদের অভ্যর্থনার কাজে নিয়োজিত রক্ষীগণ তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্যে থেকে পয়গম্বর আসেনি? যারা তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহ আবৃত্তি করত এবং সতর্ক করত এ দিনের সাক্ষাৎ ও শাস্তির ব্যাপারে?’
তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে শাস্তির হুকুমই বাস্তবায়িত হয়েছে।’-(৩৯:৭১)

রক্ষীরা বলবে, ‘তাহলে প্রবেশ কর তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে, সেখানে চিরকাল অবস্থানের জন্যে।-(৪০:৭৬) এটা এ কারণে যে দুনিয়াতে তোমরা অন্যায় ভাবে আনন্দ উল্লাস করতে এবং ঔদ্ধত্য করতে। হায়! কত নিকৃষ্ট অহঙ্কারীদের আবাসস্থল।’-(৪০:৭৫)

অতঃপর তাদেরকে জাহান্নামের উপর দাঁড় করান হবে নিক্ষেপের জন্যে। এসময় তারা মনে মনে বলতে থাকবে, ‘কতই না ভাল হত, যদি আমরা পুনঃ প্রেরিত হতাম; তাহলে আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শণ সমূহে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যেতাম।’

আল্লাহ এদের সম্পর্কে বলছেন, ‘এরা চিরকালই মিথ্যায় অভ্যস্ত ছিল। এই আকাঙ্খায়ও এরা মিথ্যেবাদী।’-(৬:২৭-২৮)

প্রকৃতই তাই। কেননা, অতীতে পয়গম্বরদের মাধ্যমে যেসব সত্য তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল এবং তারা তা জানা ও চেনা সত্ত্বেও শুধু হঠকারীতা কিম্বা লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে সেইসব সত্যকে পর্দায় আবৃত রাখতে চেষ্টা করত, আজ সেগুলো একটি একটি করে তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে গেছে, আল্লাহর একচ্ছত্র অধিকার ও শক্তি-সামর্থ্য চোখে দেখেছে, পয়গম্বরদের সত্যতা অবলোকন করেছে, পরকালে পুনর্জীবিত হওয়া- যা সবসময়ই তারা অস্বীকার করত-নির্মম সত্য হয়ে সামনে এসেছে; প্রতিদান ও শাস্তি প্রকাশ হতে দেখেছে এবং জাহান্নাম দেখছে। কাজেই বিরোধিতা করার কোন ছুতো তাদের হাতে অবশিষ্ট রইল না। তাই তাদের এই বক্তব্য-‘দুনিয়াতে পুনঃ প্রেরিত হলে ঈমানদার হয়ে ফিরতাম’-সম্পূর্ণ মিথ্যা ও প্রতারণা মূলক। তাদের কথা অনুযায়ী পুনঃরায় জগৎ সৃষ্টি করে তাদেরকে সেখানে ছেড়ে দিলেও তারা আবার তাই করবে, যা প্রথম জীবনে করত।

অনেকে তাদের মাঝে শয়তান ও তার সঙ্গীদেরকে দেখে বলবে, ‘তোমরা আমাদের ডান-বাম বরং চারিদিক থেকে এসে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলে। আজ তোমাদের জন্যেই আমাদের এই অবস্থা। আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম। আমাদের দুষ্ট কর্মীরাই আমাদেরকে গোমরাহী করেছিল।’

তখন তারা বলবে, ‘বরং তোমরা তো বিশ্বাসীই ছিলে না এবং তোমাদের উপর আমাদের কোন কর্তৃত্ব ছিল না, বরং তোমরাই ছিলে সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’-(৩৭:২৭-২৮) অথবা, বলবে, ‘আমরা তোমাদের পথভ্রষ্ট করেছিলাম, কারণ আমরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট ছিলাম।’-(৩৭:৩১-৩২)
মুশরিকরা আক্ষেপ করে শয়তানকে বলবে, ‘হায়! আমার ও তোমার মাঝে যদি পূর্ব-পশ্চিমের দুরত্ব থাকত?’-(৪৩:৩৮)
অত:পর শয়তান তাদেরকে বলবে, ‘আমাদের বিপক্ষে আমাদের পালনকর্তার উক্তি সত্য হয়েছে। আমাদের অবশ্যই জাহান্নামের স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’-(৩৭:২৯-৩০) তারা সবাই সেদিন শাস্তিতে শরীক হবে। -(৩৭:৩৩)

Inferno (Dante).
আল্লাহ মুশরিকদেরকে লাঞ্ছিত করবেন সেদিন-বলবেন, ‘আজ কোথায় অবস্থান তাদের, যাদেরকে তোমরা শরীক করতে আল্লাহ ব্যতিত?-(১৬:২৭) ভাল করে দেখ, তারা কি তোমাদের মতই গ্রেফতার হয়ে আসেনি? তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা করছ সেগুলো সবই জাহান্নামের ইন্ধন। নিশ্চয় এই মূর্তিরা যদি উপাস্য হত, তবে জাহান্নামে প্রবেশ করত না। আজকের দিনে তোমরা এবং তোমাদের এসব উপাস্যরা একে অপরের কোন উপকার বা অপকার করার অধিকারী নও। এখন তোমরা প্রত্যেকেই এতে চিরস্থায়ী হয়ে পড়ে থাকবে। আর আগুনের যে শাস্তিকে মিথ্যে বলতে তা আস্বাদন করবে।’-(২১:৯৮-১০০)

এ সময় তারা নতশিরে বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা দেখলাম ও শ্রবণ করলাম। এখন আমাদেরকে পাঠিয়ে দিন, আমরা সৎ কর্ম করব। আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে গেছি।’ -(৩২:১২)

আজ অবিশ্বাসীদের ঈমান তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না।-(৩২:২৯) আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘আমার এই উক্তি অবধারিত সত্য ছিল যে আমি জ্বিন ও মানব উভয়কে দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব। অতএব এই দিবসকে ভুলে যাবার কারণে তোমরা স্বাদ আস্বাদন কর। আমিও তোমাদেরকে ভুলে গেলাম। তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্যে স্থায়ী আযাব ভোগ করবে।’ -(৩২:১৩-১৪)


Milton's Hell
ফেরেস্তাগণ তাদেরকে বলবে, ‘দুনিয়াতে তোমরা অন্যায় ভাবে আনন্দ-উল্লাস করতে এবং ঔদ্ধত্য করতে। সুতরাং প্রবেশ কর জাহান্নামের দরজা দিয়ে সেখানে চিরকাল বসবাসের জন্যে।’ অতঃপর তাদেরকে এবং পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখী করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে এবং ইবলিস বাহিনীর সকলকে।-(২৬:৯৪) তারা জলন্ত আগুনে অদৃশ্য হয়ে যাবে।-(৪:৮৮) অতঃপর আগুনের আযাব তাদেরকে ঘেরাও করবে মাথার উপর থেকে এবং পায়ের নীচ থেকে।-(২৯:৫৫)

তারা তথায় কথা কাটা-কাটিতে লিপ্ত হবে, বলবে, ‘আল্লাহর কসম আমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম। আমাদের দুষ্ট কর্মীরাই গোমরাহ করেছিল। অতএব আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই। হায়! যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পেতাম, তবে আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারী হয়ে যেতাম।’-(২৬:৯৫-১০২)

যখন জাহান্নামে কেউ নিক্ষিপ্ত হবে, তখন সে তার উৎক্ষিপ্ত গর্জণ শুনতে পাবে। ক্রোধে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে। আর যখনই তাতে কোন সম্প্রদায় নিক্ষিপ্ত হবে, তখন তাদেরকে রক্ষীরা জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাদের কাছে কি কোন সতর্ককারী আগমন করেনি?’

তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, আমাদের কাছে সতর্ককারী আগমন করেছিল, অতঃপর আমরা মিথ্যোরোপ করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কোন কিছু নাযিল করেননি। তোমরা মহা বিভ্রান্তিতে পড়ে রয়েছ।’ যদি আমরা রসূলদের কথা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামীদের মধ্যে থাকতাম না।’
অতঃপর তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে।-(৬৭:৭-১১)

মুশরিকদের অন্যদল যারা অপেক্ষায় রয়েছে পরবর্তীতে জাহান্নামে যাবার, তাদের কেউ কেউ সেসময় মনে মনে ভাববে, ‘যদি কোনভাবে একবার ফিরে যেতে পারি, তবে অবশ্যই আমি পরহেযগার হয়ে যাব।’
তাদেরকে বলা হবে, ‘হ্যাঁ, তোমার কাছে আল্লাহর নির্দেশ এসেছিল; অতঃপর তুমি তাকে মিথ্যে বলেছিলে, অহঙ্কার করেছিলে এবং অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছিলে।’-(৩৯:৫৮-৫৯)

ওয়ালিদ ইবনে ওকবা সহ আরো অনেকে আবার আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায় আমার দুর্ভাগ্য, আমি যদি ওমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল।’-(২৫:২৭-২৮)

দুর্বলেরা বড়দেরকে বলবে, ‘আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম- অতএব, তোমরা আল্লাহর আযাব থেকে আমাদেরকে কিছুমাত্র রক্ষা করবে কি?’
তারা বলবে, ‘যদি আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথ দেখাতেন তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সৎপথ দেখাতাম। এখন তো আমরা ধৈর্য্যচ্যূত হই কিম্বা সবর করি- সবই আমাদের জন্যে সমান-আমাদের রেহাই নেই।’

আবার কয়েকজন পরিচিত দলপতিদেরকে দোষারোপ করে বলবে, ‘তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হতাম।’
দলপতিরা বলবে, ‘তোমাদের কাছে হেদায়েত আসার পর আমরা কি তোমাদের বাঁধা দিয়েছিলাম? বরং তোমরাই ছিলে অপরাধী।’
তারা বলবে, ‘বরং তোমরাই তো দিবারাত্রি চক্রান্ত করে আমাদেরকে নির্দেশ দিতে যেন আমরা আল্লাহকে না মানি এবং তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করি।’

আবার তাদের মধ্যে অনেকে যখন শাস্তি দেখবে, তখন মনের অনুতাপ মনেই রাখবে। -(৩৩:৩১-৩৩)
অনেকে চিৎকার করে বলবে, ‘হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভূক্ত হতাম।’-(৬৩:১০)
অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ‘আমাদের আর কি দোষ? আল্লাহ আমাদের হেদায়েত করলে আমরাও মুত্তাকী হয়ে যেতাম।’
অনেকে আল্লাহকে ডেকে বলবে, ‘হে পরওয়ারদেগার! আমাদের ফিরে যাবার কোন উপায় আছে কি?’-(৪২:৪৪)

Hell torturer (China Sculpture)
আবার অনেকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে যারা শৃঙ্খলিত ছিল না, তারা জাহান্নামের সম্মুখ থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যাবে। পালিয়েও তারা বাঁচতে পারবে না।-(৩৪:৫১) এসময় আল্লাহ বলবেন-(৯৬:১৮) ‘ধর একে, গলায় বেড়ী পরিয়ে দাও, অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর তাকে শৃঙ্খলিত কর সত্তুর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। নিশ্চয় সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না এবং মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করত না। অতএব আজকের দিনে এখানে তার কোন সুহৃদ নেই এবং কোন খাদ্য নেই ক্ষত নিঃসৃত পূঁজ ব্যতিত।’-(৬৯:৩০-৩৬)

তারা নিকটবর্তী স্থান থেকে ধরা পড়বে ফেরেস্তাদের হাতে। আর ফেরেস্তারা তাদেরকে পুনঃরায় পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনবে। তখন তারা আল্লাহকে বলবে, ‘আমরা সত্যে বিশ্বাস স্থাপন করলাম।’

কেবল পার্থিব জীবনের ঈমানই গ্রহনীয়, পরকালের নয়। তাই তাদের মুক্তি ও জান্নাত পাওয়ার আকাংখা বাস্তবায়িত হবে না। তারা তো পূর্ব থেকে সত্যকে অস্বীকার করেছিল। আর তারা সত্য থেকে দূরে থেকে অজ্ঞাত বিষয়ের উপর মন্তব্য করত। আর এখন তো তাদের ও তাদের বাসনার মধ্যে অন্তরাল হয়ে গেছে। তাই আল্লাহ বলবেন, ‘এখন আর তোমাদের ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং যেমন তোমাদের সতীর্থদের সাথে করা হয়েছে, যারা তোমাদের পূর্বে ছিল-তেমনিই তোমাদের সাথে করা হবে।’-(৩৪:৫২-৫৪)

সত্যি বলতে কি, সেদিন জালেমদের ওজর আপত্তি তাদের কোন উপকারে আসবে না এবং তওবা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সুযোগও তাদের দেয়া হবে না।-(৩০:৫৭)
আর ফেরেস্তারা একে অন্যেকে বলবে, ‘তাদেরকে টেনে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যখানে। অতঃপর তাদের মাথায় ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও।’

এরপর তাদেরকে এক এক করে জাহান্নামের মাঝে ছুঁড়ে ফেলা হবে। আর তাদের মাথায় ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে, আর বলা হবে, স্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত! এ সম্পর্কে তোমরা সন্দেহে পতিত ছিলে।’-(৪৪:৪৭-৫১)

অতঃপর শৃঙ্খলিত অন্যদলকে ফেরেস্তারা সামনে নিয়ে আসবে নিক্ষেপ করার জন্যে। এদেরকে যখন জাহান্নামের কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘তোমাদের পূর্বে জ্বিন ও মানবের যেসব সম্প্রদায় চলে গেছে, তাদের সাথে তোমরাও এখন জাহান্নামে যাও। এ দিবসকে ভুলে যাবার কারণে তোমরা মজা আস্বাদন কর। আমিও তোমাদের ভুলে গেলাম। তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে স্থায়ী আযাব ভোগ কর।-(৩২:১৪)

দুনিয়াতে ধনী ছিল এমন ব্যক্তিদের অধিকাংশ আজ গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে। ঈসা বলেছিলেন ধনীদের পক্ষে বেহেস্তে প্রবেশ করা কঠিন। যারা বাইবেল পাঠ করেছিল তারা এটা সেদিন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাবে-

এক লোক ঈসার নিকট জানতে চাইল, ‘কি করলে আমি অনন্ত জীবন লাভ করব ।’
তিনি বললেন, ‘আপনি তো হুকুমগুলি জানেন-

‘একমাত্র খোদার উপাসনা কোরও,
অসৎ কাজে খোদার নাম নিয়ো না,
প্রতিমা পূজা কোরও না,
ব্যভিচার কোরও না,
নরহত্যা কোরও না,
চুরি কোরও না,
মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ো না,
পিতামাতাকে সম্মান কোরও,
প্রতিবেশীকে মহব্বত কোরও এবং
তাদের কোন বস্তুতে লোভ কোরও না।’

সে বলল, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি এ সমস্ত পালন করে আসছি।’
একথা শুনে তিনি বললেন, ‘এখনও একটা কাজ আপনার বাকী আছে। আপনার যা কিছু আছে তা বিক্রী করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তাতে আপনি বেহেস্তে ধন পাবেন। আর, তারপর এসে আমার পথে চলুন।’

এ কথা শুনে লোকটি বিষন্ন হয়ে চলে গেল, কারণ সে খুব ধনী ছিল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ঈসা উপস্থিত লোকদেরকে বললেন, ‘দেখ, ধনীদের পক্ষে বেহেস্তে প্রবেশ করা কত কঠিন! একজন ধনীর পক্ষে বেহেস্তে প্রবেশ করার চেয়ে বরং সূচের ছিদ্র দিয়ে উটের প্রবেশ করা সহজ।’

বেআব্রু নারীদের নারকীয় শাস্তি
যা হোক, দুনিয়াতে আরাম আয়েশে থাকা এসব ধনীদেরকে যখন জাহান্নামের কোন এক দরজা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হবে, তখন আগুনের মধ্যে পড়েই তারা যন্ত্রণায় চিৎকার জুড়ে দেবে। তখন আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘অদ্য চিৎকার কোরও না। তোমরা আমার কাছ থেকে নিঃস্কৃতি পাবে না। আমি দুনিয়াতে আজকের এই দিনের কথা ভেবে কত ভাবে তোমাদেরকে সৎপথে আসতে আহবান করেছি, কতবার বলেছি- ‘হে মানব জাতি! তোমাদের পালনকর্তার যথার্থ বাণী নিয়ে তোমাদের কাছে রসূল এসেছে, তোমরা তাকে মেনে নাও, যাতে তোমাদের কল্যাণ হতে পারে।’-(৪:১৭০) ‘অতঃপর যখনই তোমাদেরকে আমার আয়াত সমূহ শোনান হত, তখনই তোমরা উল্টো পায়ে সরে পড়তে। অহঙ্কার করে এ বিষয়ে অর্থহীন গল্প-গুজব করে যেতে।’-(২৩:৬৪-৬৭) ‘বিশ্বাসীদেরকে বলতে- ‘তোমরা যে বিধানসহ প্রেরিত হয়েছ তা আমরা মানি না।’ অত:পর তারা যখন এদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিত, তোমরা বলতে-‘আমরা ধনে-জনে সমৃদ্ধ অতএব আমরা শাস্তি প্রাপ্ত হব না।’-(৩৪:৩৪-৩৫)

যারা জাহান্নামে প্রবেশ করছে, তারা দেখতে পাবে তাদের সাথে আরও একদল প্রবেশ করছে। তারা বলবে, ‘তোমাদের জন্যে আজ আর অভিনন্দন নেই।’
যারা তাদের সাথে প্রবেশ করছে, তারা বলবে, ’তোমাদের জন্যেও তো অভিনন্দন নেই। তোমরাই আমাদেরকে এই বিপদের সম্মুখীণ করেছ, অতএব এটি কতই না ঘৃণ্য আবাসস্থল।’-(৩৮:৫৯-৬০)

প্রচন্ড যন্ত্রণায় অস্থির কোন কোন ব্যক্তি উপরের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখতে পাবে লোকজন বেহেস্তে আনন্দে মশগুল রয়েছে। ঘোরাফেরা করছে সঙ্গীদের সঙ্গে। তারা আরও লক্ষ্য করবে দুনিয়াতে যারা তাদের কাছে অবহেলিত, ঘৃণিত ছিল, তারা রসূলদের সঙ্গে আহার ও গল্প-গুজবে মশগুল। তারা চিৎকার করে তাদেরকে ডাকবে। আর তারা তেমনি উত্তর পাবে, যেমন হযরত ঈসা বলেছিলেন-


পিতা ইব্রাহিম, ..লাসারকে পাঠিয়ে দেন...
‘খুব ধনবান এক ব্যক্তি ছিল। সে বেগুনী রঙের কাপড় ও অন্যান্য দামী দামী পোষাক-আষাক পরত। আর প্রত্যেক দিন খুব জাঁক-জমকের সাথে সে আমোদ-প্রমোদ করত। সেই ধনী ব্যক্তির গৃহের সদর দরজার এক পাশে লাসার নামে এক ভিখারী প্রায়ই এসে বসত। তার সারা গায়ে ঘাঁ ছিল। ঐ ধনী ব্যক্তির খাবার টেবিল থেকে যা পড়ত, তাই সে রাস্তার নেড়ি কুকুরের সাথে ভাগাভাগি করে খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করত। আর কুকুরেরা তার ঘাঁ চেটে দিত।

একদিন সেই ভিখারীটি মারা গেল। তখন ফেরেস্তারা এসে তার রূহকে নিয়ে গেল। অতঃপর মুমিনদের রূহের স্থানে ইব্রাহিমের কাছে সে আশ্রয় পেল। এরপর একদিন সেই ধনী ব্যক্তিটিও মারা গেল। তখন তাকে দাফন করা হল। পাপীদের রূহের স্থানে খুব যন্ত্রণার মধ্যে থেকে ঐ ধনী ব্যক্তি উর্দ্ধপানে দৃষ্টি ফেলল এবং দূর হতে ইব্রাহিম ও তার পাশে লাসারকে দেখতে পেল। তখন সে চীৎকার করে বলল, ‘পিতা, ইব্রাহিম! আমার প্রতি রহম করেন। লাসারকে পাঠিয়ে দেন, যেন সে তার আঙ্গুল পানিতে ডুবিয়ে আমার জিহবা ঠান্ডা করে। এই স্থানে আমি বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।’

তার চিৎকার শুনে ইব্রাহিম সেদিকে দৃষ্টি ফেরালেন। (জাহান্নামীদের চিৎকার, হতাশা বা অন্যকিছু জান্নাতীদের কর্ণকূহরে প্রবেশ বা তাদের নিকট দৃশ্যমান হবে না, যদি না তারা তেমন কোন ইচ্ছে প্রকাশ করে। তবে নবীদের কথা আলাদা।) তারপর বললেন, ‘মনে করে দেখ, তুমি যখন দুনিয়াতে ছিলে তখন কত সুখ ভোগ করেছ, আর লাসার কত কষ্ট ভোগ করেছে। কিন্তু এখন সে এখানে সান্তনা পাচ্ছে আর তুমি কষ্ট পাচ্ছ। এছাড়া, তোমার ও আমাদের মাঝে এমন একটা ব্যবধান (পার্থক্য) রয়েছে যে, কেউ এই স্থান থেকে তোমার কাছে যেতে ইচ্ছূক হবে না, আর তোমার ঐ স্থান থেকে কেউ ইচ্ছুক হলেও আমাদের কাছে আসতে পারবে না।’ -এমন উত্তর শুনে সে আফসোস করতে থাকবে। হায়! রসূলদের কথা কত কঠিন সত্যই না ছিল!

একদল মুনাফেকদের নিক্ষেপ করা হল। তাদের স্থান হল জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।-(৪:১৪৫) মুনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কি এ দলে ছিল? ঠিক বোঝা গেল না।

Hell in medievial Church-1
একসময় ফেরাউনের দলকে সামনে আনা হবে নিক্ষেপের জন্যে। ফেরাউন, হামান আষ্টে-পৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত হয়ে বড়ই ভ্যাজালে আজ। কবর জীবনেও তারা ছিল দৌঁড়ের উপর। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আগুনের সামনে পেশ করা হত তাদের। আর এখন ফেরেস্তাদের প্রতি নির্দেশ হবে- ‘তাদেরকে কঠিনতর আযাবে দাখিল কর।’-(৪০:৪৬)

যখন পাপীষ্ঠদের একদলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা সেখানে পতিত হবার পর পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু কোথাও পালাবার জায়গা পাবে না।-(৪:১২১) কঠোর স্বভাবের প্রহরী ফেরেস্তাগণ তাদেরকে একে একে ধরে ফেলবে এবং বসিয়ে দেবে জায়গা মত হাঁতুড়ির এক ঘা। যন্ত্রণায় তারা চিঁহি-চিঁহি করতে থাকবে, ঐ অবস্থায় তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলা হবে আগের জায়গায়।

এক সঙ্গে শিকলে বাঁধা অবস্থায় এক দলকে জাহান্নামের মাঝে কোন এক সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে,-(২৫:১২-১৪) তারপর ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর আগুনে তাদেরকে জ্বালান হবে।-(৪০:৭২) আর তারা পরস্পর বিতর্ক করবে। দুর্বলরা অহঙ্কারীদেরকে বলবে, ‘আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম। সুতরাং তোমরা এখন জাহান্নামের আগুনের কিছু অংশ আমাদের থেকে নিবৃত্ত করবে কি?’
অহঙ্কারীরা বলবে, ‘আমরা সবাই তো এখন জাহান্নামে আছি। আল্লাহ তার বান্দাদের ফয়সালা করে দিয়েছেন। এখন আমাদের নি:স্কৃতি নেই।’-(৪৭:৪৮)

এভাবে যখন এক সম্প্রদায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে; তখন অন্য সম্প্রদায়কে তারা অভিসম্পাৎ করবে। এমনকি যখন তাতে সবাই পতিত হবে, তখন পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে আল্লাহকে চিৎকার করে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এরাই আমাদেরকে বিপথগামী করেছিল। অতএব, তুমি তাদেরকে দ্বিগুন শাস্তি দাও।’
তিনি বলবেন, ‘প্রত্যেকেরই দ্বিগুন, তোমরা জান না।’-(৭:৩৮-৩৯)

এভাবে যখন সকলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়ে যাবে, তখন জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ?’
সে বলবে, ‘আরও আছে কি?’-(৫০:৩০)

জৈন ধর্মমতে নরকের সাত স্তরের শাস্তি
পাপীদের জন্যে জাহান্নামে রয়েছে শিকল, বেড়ী, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।-(৭৬:৪) দুনিয়াতে যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখত এবং তা ব্যয় করত না আল্লাহর পথে, জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে, আর বলা হবে, ‘এগুলো তাই যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।’-(৯:৩৫) বোঝাই যাচ্ছে ইস্রায়েলীদের সেই ধনী ব্যক্তি কারুণ থাকবে বড়ই বিপত্তিতে। সেখানে আরও রয়েছে আগ্নির শয্যা, আর রয়েছে গায়ে জড়িয়ে দেবার জন্যে অগ্নির চাদর।-(৭:৪১)

জাহান্নামীদের পোষাক হবে দাহ্য আলকাতরার-যাতে আগুন লেগে তাদের মুখমন্ডল ও শরীরকে বিভৎস করে তুলবে।-(২৩:১০৪) দুনিয়ার আগুন মানুষের শরীরের চামড়া পোড়ার আগেই তার মৃত্যু হত-কিন্তু জাহান্নামের আগুন তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছিবে-(১০৪:৭) তবুও সে মরবে না। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে পুড়ে যাবে, তখন তা আবার পাল্টে দেয়া হবে অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আযাব আস্বাদন করতে পারে পুরোপুরি।-(৪:৫৬) তারা থাকবে প্রখর বাষ্প ও উত্তপ্ত পানিতে এবং ধুম্রকুঞ্জের ছায়ায়, যা শীতলও নয় এবং আরামদায়কও নয়। সেখানে তারা কোন শীতল এবং পানীয় আস্বাদন করবে না; কিন্তু ফুটন্ত পানি ও পূঁজ পাবে।-(৭৮:২৪-২৫)

আগুনের মধ্যে থেকে জাহান্নামীরা পিপাসায় কাতর হয়ে ‘পানি, পানি’ করে চিৎকার করবে। তখন তাদেরকে ফুটন্ত পানির নহর থেকে পানি পান করান হবে।-(৮৮:৫) আবার কাউকে কাউকে পূঁজ মিশানো পানি পান করতে দেয়া হবে। তারা পিপাসিত উটের ন্যায় তা পান করতে চেষ্টা করবে। কেউ ঢোক গিলে তা পান করবে, কিন্তু গলার ভিতরে প্রবেশ করাতে পারবে না।-(১৪:১৬-১৭) আর তাদের মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে। ফলে তাদের পেটে যা আছে তা এবং চর্ম গলে বের হয়ে আসবে।-(২২:১৯-২২)

Medievial Illustration of Hell
থেকে আমাদের উদ্ধার করুন; আমরা যদি পুনঃরায় তা করি তবে আমরা গোনাহগার হব।’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা ধিকৃত অবস্থায় এখানেই পড়ে থাক এবং আমার সাথে কোন কথা বোলও না। আমার বান্দাদের একদল বলত, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অতএব, তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর ও আমাদের প্রতি রহম কর। তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ট দয়ালু।’ অতঃপর তোমরা তাদেরকে ঠাট্টার পাত্ররূপে গ্রহণ করতে। এমনকি, তা তোমাদেরকে আমার স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছিল এবং তোমরা তাদেরকে দেখে পরিহাস করতে। আজ আমি তাদেরকে তাদের সবরের কারণে এমন প্রতিদান দিয়েছি যে, তারাই সফলকাম।’

নিশ্চয়ই দুষ্টুদের ঠিকানা- জাহান্নাম। তারা সেখানে থাকবে চিরকাল। কতই না নিকৃষ্ট সেই আবাসস্থল। সেখানে রয়েছে উত্তপ্ত পানি ও পূঁজ; অতএব তারা তাই আস্বাদন করুক। এ ধরণের আরও কিছু শাস্তি অবশ্য সেখানে তাদের জন্যে রয়েছে।-(৩৮:৫৫-৫৮)

জাহান্নামীদের জন্যে উপর দিক থেকে এবং নীচের দিক থেকে আগুনের মেঘমালা থাকবে।-(৩৯:১৬) আগুন তাদের মুখমন্ডল, শরীর দগ্ধ করবে, ফলে তারা বিভৎস আকার ধারণ করবে। এসময় তারা কেবলই বলবে, ‘হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রসূলের আনুগত্য করতাম!’-(৩৩:৬৬)

তারা জাহান্নামের আগুন থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে, কিন্তু তা থেকে বের হতে পারবে না।-(৫:৩৭) যখনই তারা যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে, তখনই তাদেরকে পেটানো হবে লোহার হাতুড়ি দিয়ে এবং তাদেরকে পুনঃরায় সেখানে ছুঁড়ে ফেলা হবে এবং বলা হবে, ‘দহন শাস্তি আস্বাদন কর।’-(২২:১৯-২২) আবার কাউকে মুখ হিঁচড়ে টেনে নেয়া হবে, বলা হবে, ‘অগ্নির খাদ্য আস্বাদন কর।’-(৫৪:৪৮) অথবা বলা হবে, ‘তোমরা জাহান্নামের যে আযাবকে মিথ্যে বলতে, তার স্বাদ আস্বাদন কর।’-(৩২:২০)

বৌদ্ধ ধর্মমতে পারলৌকিক শাস্তি-1
তখন তারা জাহান্নামের রক্ষীদের বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্যে দোয়া কর।’
তারা বলবে, ‘তোমরা দুষ্ট, পাপীষ্ঠ, তোমাদের তো দুনিয়াতেই ধ্বংস হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমাদেরই একদল ফেরেস্তা তোমাদের ঐসব কৃতকর্মের জন্যে খোদার কাছে রাতদিন দোয়া ও করুণা ভিক্ষা চাইত, আর তিনি তোমাদেরকে করুণা করতেন। তখন ঐ ফেরেস্তাগণ আশা করত তোমরা তোমাদের পাপের পথ থেকে ফিরবে। কিন্তু না, তোমরা পাপের উপর পাপ করে গেছ! আর এ কথা তো তোমাদের রসূলগণও তোমাদেরকে জ্ঞাত করেছেন, কিন্তু তোমরা তাদের কথায় কান দাওনি। কিতাবে কি ছিল না-

যখন মানুষ পাপের পথে চলে, তখন ফেরেস্তাগণ চিৎকার করে বলেন- ‘হে আল্লাহ! দোযখের শাস্তি থেকে তাকে রেহাই দাও।’ সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তিনি তাকে দয়া করেন, আল্লাহ মানুষের জন্যে বারবার এসব করেন।–(সহিফা আইয়ূব)

আবার-‘কোন এক ব্যক্তির আঙ্গুর ক্ষেতে একটা ডুমুর গাছ লাগান হয়েছিল। একবার ঐ মালিক এসে ফলের খোঁজ করলেন; কিন্তু পেলেন না। তখন তিনি মালীকে বললেন, ‘দেখ, তিন বৎসর ধরে এই ডুমুর গাছে আমি ফলের খোঁজ করছি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছিনে। সুতরাং তুমি গাছটি কেটে ফেল। কেন এ শুধু শুধু জমি নষ্ট করবে?’

মালী উত্তর দিল, ‘হুজুর, এই বৎসরও গাছটাকে থাকতে দিন। আমি ওর চারপাশে খুঁড়ে সার দেব। তারপর যদি ফল ধরে তো ভালই, তা না হলে আপনি ওটা কেটে ফেলবেন।’

বৌদ্ধ ধর্মমতে নরকের শাস্তি-2
এভাবে ফেরেস্তাদের প্রার্থনা ও দোয়ার বরকতে খোদা অনেক সময়ই মানুষের ধ্বংস সাধন থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু যদি তারা পাপকর্ম থেকে বিরত না হয়, তবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।’-(বাইবেল)

আবার -‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চতুর্দিক ঘিরে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে- প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং বিশ্বাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! প্রত্যেক বিষয় তোমার দয়া ও জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত আছে, অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বণ করে, তুমি তাদের ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদের স্থায়ী জান্নাতে উপস্থাপিত কর, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরও। নিশ্চয় তুমি মহাপরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময় এবং তুমি তাদের শাস্তি হতে রক্ষা কর, সেদিন যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে তাকে তো অনুগ্রহই করবে, এ সেই মহান সফলতা।’-(৪০:৭-৯)
তখন তারা বলবে, ‘তাহলে, তোমাদের পালনকর্তাকে বল, তিনি যেন আমাদের থেকে একদিনের আযাব লাঘব করে দেন।’
রক্ষীরা বলবে, ‘তোমাদের কাছে কি সুস্পষ্ট প্রমানাদিসহ রসূলগণ আগমন করেননি?’
তারা বলবে, ‘হ্যাঁ।’
রক্ষীরা বলবে, ‘তবে তোমরাই দোয়া কর।’
তখন তারা নিজেদের জন্যে দোয়া করবে। কিন্তু দোযখীদের দোয়া নিষ্ফল হবে।-(৪০:৪৯-৫০)


শেষ বিচার ও নারকীয়তা
আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, ‘তোমরা তোমাদের শাস্তি আস্বাদন কর। তোমরা একেই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে। -(৫১:১৪) জালেমদের জন্যে আমি তো এ শাস্তিই নির্ধারণ করেছি।’

তখন তারা আর্তচিৎকার করবে এবং বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুণ আমাদেরকে, আমরা সৎ কাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না।’-(৩৫:৩৬)
তিনি বলবেন, ‘তোমরা আমার আয়াত সমূহকে ঠাট্টারূপে গ্রহণ করেছিলে এবং পার্থিব জীবন তোমাদেরকে প্রতারিত করেছিল। সুতরাং আজ তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে না এবং তোমাদের কাছে তওবাও চাওয়া হবে না।’-(৪৫:৩৫) ‘আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর আমার শাস্তি। জালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই।’-(৩৫:৩৭)

তখন তারা বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনে নিয়েছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিসম্পাৎ করুন।’- (৩৩:৬৭-৬৮)
তিনি বলবেন, ‘নিশ্চয় তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে। আমি তোমাদের কাছে সত্য ধর্ম পৌঁছিয়েছি; কিন্তু তোমরা অধিকাংশই নি:স্পৃহ ছিলে।’ -(৪৩:৭৭-৭৮)

হতাশার চরম সীমায় পৌঁছে একদল বলবে, ‘হে মালিক! আমাদের কিচ্ছাই শেষ করে দিন।’ তারা মৃত্যু কামনা করবে ও তাকে ডাকবে।

এসময় ফেরেস্তারা তাদেরকে বলবে, ‘আজ তোমরা এক মৃত্যুকে ডেকো না, অনেক মৃত্যুকে ডাক।’-(২৫:১২-১৪)


হিন্দু ধর্মমতে ব্রক্ষ্মার কোর্ট ও নরক
যাদের ঈমান ছিল, কিন্তু আমলে পাপের পরিমান বেশী হয়েছিল তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করার পর এক সময় জান্নাতে দাখিল করা হবে। অতঃপর জাহান্নামের দরজা স্থায়ী ভাবে বন্ধ করে দেয়া হবে। অবশিষ্ট জাহান্নামীরা সেখানে চিৎকার করবে কিন্তু কিছুই আর শুনতে পারবে না।-(২১:১০০) প্রতি দিক থেকে তাদের কাছে মৃত্যু আগমন করবে, কিন্তু তারা মরবে না।-(১৪:১৬-১৭) যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে মৃত্যুর কোন আদেশ দেবেন না। আর তাদের আযাবও লঘু করা হবে না-(৩৫:৩৬) এবং তারা তাতেই থাকবে চিরকাল, থাকবে হতাশ হয়ে।-(৪৩:৭৪-৭৫)

যখনই অগ্নি নির্বাপিত হয়ে আসবে তখনি তা নুতন করে প্রজ্জ্বলিত করা হবে।-(১৭:৯৭) এভাবেই অগ্নি পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় বন্দী থাকবে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী।-(৭৮:২৩) এই মহা অগ্নিতে অতঃপর তারা মরবেও না জীবিতও থাকবে না।-(৮৭:১৩) আর এভাবে তারা জাহান্নামের অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মাঝে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে অনন্তকাল।–(৫৫:৪৪)

এদিকে যারা দুনিয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং সৎকর্ম করেছিল তারা জান্নাতের অধিবাসী হবে। এ হচ্ছে নেয়ামত রাজির সমাহারে পূর্ণ এক বিশাল রাজ্য। যা হবে আকাশ ও পৃথিবীর মত প্রশস্ত।-(৫৭:২১) এর মধ্যে রয়েছে উদ্যান সমূহ যার পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নির্ঝরিণী সমূহ। আর সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে সদা আপ্যায়ন চলতে থাকবে।-(৩:১৯৮) ইতিপূর্বে তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, ফলে আজ তারা জান্নাতবাসী হয়েছে। তারা তাতেই থাকবে চিরকাল।-(৭:৪২)

জান্নাতীগণ থাকবে সর্বদা বসবাসের উদ্যানে সুশীতল ছায়ায়-প্রস্রবণ সমূহ পরিবেষ্ঠিত অবস্থায়, বাঞ্ছিত ফলমূলের মধ্যে-(৭৭:৪১-৪২), যোগ্য আসনে সর্বাধিপতি সম্রাটের সান্নিধ্যে।-(৫৪:৫৫) সুতরাং একবার জান্নাতে প্রবেশের পর কেউই কোন অবস্থাতেই স্থান পরিবর্তন করতে চাইবে না।-(১৮:১০৮)

যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।-(৩৯:৭৩) আর তারা জান্নাতের নিকটবর্তীতে পৌঁছিলে আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘তোমাদের প্রত্যেক বিনীত অনুরাগী ও স্মরণকারীকে এরই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল; যে না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করত এবং বিনীত অন্তরে উপস্থিত হত। তোমরা এতে শান্তিতে প্রবেশ কর। এটাই অনন্তকাল বসবাসের জন্যে প্রবেশ করার দিন।’-(৫০:৩১-৩৪)

জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে থাকবে একটা প্রাচীর। এটাই আরাফ। এর উপর অনেক লোক থাকবে। তারা তখনও জান্নাতে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তারা প্রবেশের অপেক্ষায়। এরা ঈমানদার বটে, তবে এদের আমলে পাপ ও পূণ্যের পরিমান ছিল সমান সমান। সম্ভবত: মুহম্মদের শাফায়েতের পর প্রথম কিস্তিতেই তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। যাহোক, এই আরাফবাসীগণ জান্নাতীদের ডেকে বলবে, ‘তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এখন প্রবেশ কর জান্নাতে। তোমাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তোমরা দুঃখিত হবে না।’

আর যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামের মধ্যে পড়বে, তখন সেখানে তাদের বেগতিক অবস্থা দেখে তারা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এই জালেমদের সাথী কোরও না।’
আর তারা তাদেরকে বলবে, ‘দেখেছ, তোমাদের দলবল ও ঔদ্ধত্য তোমাদের কোন কাজে আসেনি।’
অথবা কেউ কেউ জান্নাতীদেরকে দেখিয়ে তাদেরকে বলবে, ‘এরা কি তারাই; যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম খেয়ে বলতে যে, আল্লাহ এদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন না?’

যাহোক, যখন জান্নাতের উন্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতীগণ জান্নাতে প্রবেশ করতে থাকবে, তখন জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক, অতঃপর সদাসর্বদা বসবাসের জন্যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর।’
তারা বলবে, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির উত্তরাধিকারী করেছেন। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছে বসবাস করব, মেহনতকারীদের পুরস্কার কতই না চমৎকার’।-(৩৯:৭৩-৭৪)

এসময় জান্নাতীদের মুখমন্ডল হবে সজীব। তাদের কর্মের কারণে সন্তুষ্ট। তারা দলে দলে প্রবেশ করতে থাকবে জান্নাতে। সুউচ্চ জান্নাত। সেখানে কেউ শুনবে না কোন অসার কথাবার্তা। সেখানে রয়েছে প্রবাহিত ঝর্ণা। রয়েছে উন্নত সুসজ্জিত আসন এবং সংরক্ষিত পানপাত্র এবং সাঁরি সাঁরি গালিচা এবং বিস্তৃত বিছান কার্পেট।-(৮৮:৮-১৬) অর্থাৎ জান্নাতীদের জন্যে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।-(৮৪:২৫) তাদের অন্তরে যাকিছু দুঃখ, অতৃপ্তি ছিল, জান্নাতে প্রবেশের আগে আল্লাহ তা বের করে দেবেন।-(৭:৪৩)

জান্নাতে প্রবেশের পর জান্নাতীরা সেখানকার নিয়ামত সমূহ দেখে খুশীতে আত্মহারা হয়ে পড়বে, তাদের অনেকে বলবে, ‘আল্লাহর হাজার শোকর, যিনি আমাদেরকে এই পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। আমরা কখনও পথ পেতাম না, যদি আল্লাহ আমাদেরকে পথ প্রদর্শণ না করতেন। আমাদের প্রতিপালকের রসূল আমাদের কাছে সত্য কথা নিয়েই এসেছিলেন।’-(৭:৪২-৪৩) এসময় তাদের বলা হবে-‘এটিই জান্নাত। তোমরা এর উত্তরাধিকারী হলে তোমাদের কর্মের প্রতিদানে।’-(৭৪:৪৩) তোমরা যা করতে তার বিনিময়ে তৃপ্তির সাথে পানাহার কর। এভাবেই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকেন।’-(৭৭:৪৩-৪৪)

প্রত্যেক জান্নাতী অবাক হয়ে চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখতে থাকবে। প্রত্যেক মুমিনের জন্যে সেখানে থাকবে দু‘টি উদ্যান।-(৫৫:৪৬) উভয় উদ্যানই ঘন শাখা-পল্লব বিশিষ্ট।-(৫৫:৪৮) উভয় উদ্যানে রয়েছে বহমান দুই প্রস্রবণ।-(৫৫:৫০) উভয়ের মধ্যে প্রত্যেক ফল বিভিন্ন রকমের হবে।-(৫৫:৫২) উভয় উদ্যানের ফল তাদের কাছে ঝুলবে।-(৫৫:৫৪) এ দু‘টি ছাড়া আরও দু‘টি উদ্যান রয়েছে, যা কাল মত ঘন সবুজ।-(৫৫:৬৪) তথায়ও থাকবে উদ্বেলিত দুই প্রস্রবণ।-(৫৫:৬৬) আর সেখানেও উৎপন্ন হবে বিভিন্ন ফল-খর্জ্জুর, আনার ইত্যাদি।-(৫৫:৬৮) আর সব বৃক্ষেরই ফলসমূহ অবনমিত থাকবে।-(৬৯:২৩)

এছাড়া জান্নাতী দেখতে পাবে তুব্বা বৃক্ষ, যে বৃক্ষটি শুধু দেখার মধ্যেই মনোরম ও মনোমুগ্ধকরই নয় বরং তার ফলের মধ্যে যে স্বাদ ও মজা রয়েছে তাও হবে অবর্ণনীয়। এর পাতাগুলো শুধু পাতাই নয় বরং তা জান্নাতীদের জন্যে পরিধেয় স্বরূপ হবে যা হাজারো রঙে রঞ্জিত এক মনোমুগ্ধকর বস্ত্র-সামগ্রী। আর তার ফলগুলো হবে হেজাজী মটকার ন্যায় বড়, আর তার রঙ ও স্বাদ হবে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের, যার সুগন্ধীতে সমগ্র জান্নাত ভরপুর হয়ে যাবে।

তারা দেখতে পাবে সুউচ্চ প্রাসাদ, নির্ঝরণী। এসব নির্ঝরিণীর মধ্যে রয়েছে পানির নহর, নির্মল দুধের নহর যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। আরও আছে রকমারী ফলমূল এবং সর্বোপরি পালনকর্তার ক্ষমা।-(৪৭:১৫)

তাদেরকে মোহর করা বিশুদ্ধ পানি পান করান হবে। মোহর হবে কস্তরি, আর তার মিশ্রণ হবে তসনীমের পানি। এটা একটা ঝর্ণা, যার পানি পান করবে তারা।-(৮৩:২৫-২৮) তারা পান করবে কাফুর মিশ্রিত পানপাত্র। এটাও একটা ঝর্ণা যা থেকে তারা পান করবে-একে প্রবাহিত করবে।-(৭৬:৫)

জান্নাতীরা সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না। বৃক্ষছায়া তাদের উপর ঝুকে থাকবে এবং বাগানের ফলসমূহ তাদের আয়ত্ত্বাধীন রাখা হবে। তাদেরকে পরিবেশন করা হবে রূপার পাত্রে এবং স্ফটিকের পানপাত্রে, রূপালী স্ফটিকের পাত্রে-পরিবেশনকারীরা তা পরিমাপ করে পূর্ণ করবে। তাদেরকে সেখানে পান করান হবে যানজাবীল মিশ্রিত পানপাত্র। এটা জান্নাতস্থিত সালসাবীল নামক একটি ঝর্ণা।

তাদের কাছে ঘোরা ফেরা করবে চির কিশোররা। তাদেরকে দেখে মনে হবে যেন বিক্ষিপ্ত মনি-মুক্তা। তাদের আবরণ হবে চিকণ সবুঝ রেশম ও মোটা সবুজ রেশম এবং তাদেরকে পরিধান করান হবে রৌপ্য নির্মিত কঙ্কণ এবং তাদের পালনকর্তা তাদেরকে পান করাবেন শরাবান তহুরা-(৭৬:১৩-২১) তাদেরকে বলা হবে- বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে, তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে।-(৬৯:২৪)

তুব্বা বৃক্ষের পাশেই সুউচ্চ প্রাসাদের কক্ষে জান্নাতীরা রেশমের আস্তর বিশিষ্ট বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে।-(৫৫:৫৪) তথায় থাকবে আনত নয়না রমনীরা, কোন জ্বিন ও মানুষ পূর্বে তাদেরকে স্পর্শ করেনি।-(৫৫:৫৬,৭৪) অর্থাৎ সেখানে থাকবে সৎ চরিত্র সুন্দরী রমনীরা।-(৫৫:৭০) যারা হবে প্রবাল ও পদ্মরাগ সদৃশ।-(৫৫:৫৮) আরও থাকবে তাঁবুতে অবস্থানকারিনী হুর।-(৫৫:৭২) ঐসব চিরকুমারী, সমবয়স্কা কামিনীদের সাহচর্যে তারা আনন্দ স্ফূর্ত্তিতে মেতে উঠবে। তারা তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হবে।-(৫২:২০)

তারা সবুজ মসনদে ও উৎকৃষ্ট মূল্যবান বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে।-(৫৫:৭৬ ) তাদেরকে দেয়া হবে ফল-মূল, মাংস যা তারা চাইবে। সুরক্ষিত মতি সদৃশ চির কিশোরেরা তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে। জান্নাতীরা তাদের কাছ থেকে পানপাত্র নিয়ে একে অপরকে দেবে। রেশমের আস্তর বিশিষ্ট বিছানায় হেলান দিয়ে মুখোমুখী বসে তারা পান করতে করতে একে অন্যের সঙ্গে গল্প-গুজব করবে। তারা বলবে, ‘আমরা ইতিপূর্বে নিজেদের বাসগৃহে ভীত-কম্পিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন। আমরা পূর্বেও আল্লাহকে ডাকতাম। তিনি সৌজন্যশীল,পরম দয়ালু।’-(৫২:২২-২৮)

একসময় তাদের খোলা বাতায়ন দিয়ে দৃষ্টি চলে যাবে দূরে, নীচে। তাদের নজর পড়বে জাহান্নামীদের প্রতি। তখন তারা তাদেরকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ডেকে বলবে, ‘আমাদের সাথে আমাদের প্রতিপালক যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা সত্য পেয়েছি। তোমরাও কি তোমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা সত্য পেয়েছ?’
তারা বলবে, ‘হ্যাঁ।’ -এভাবে পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
তারা বলবে, ‘তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নীত করেছে?’
জাহান্নামীরা বলবে, ‘আমরা নামাজ পড়তাম না, অভাবগ্রস্থকে আহার্য দিতাম না, আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম এবং আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত।’-(৭৪:৪০-৪৭)

অতঃপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবে, ‘আল্লাহর অভিসম্পৎ জালেমদের উপর, যারা আল্লাহর পথে বাঁধা দিত এবং তাতে বক্রতা অন্বেষণ করত। তারা পরকালের বিষয়েও অবিশ্বাসী ছিল।’
Classical Heaven

আজ জান্নাতীরা পরম আরামে, মুখমন্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের সজীবতা নিয়ে সিংহাসনে বসে অবলোকন করছে জাহান্নামীদেরকে।-(৮৩:২২-২৪) দুনিয়াতে ওরা বিশ্বাসীদেরকে উপহাস করত এবং তারা যখন তাদের কাছ দিয়ে গমন করত, তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করত। তারা যখন তাদের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরত, তখনও হাসাহাসি করে ফিরত। আর যখন তারা বিশ্বাসীদেরকে দেখত, তখন বলত, ‘নিশ্চয় এরা বিভ্রান্ত!’-(৮৩:২৯-৩২)

আজ যারা বিশ্বাসী তারা অবিশ্বাসীদেরকে উপহাস করছে। সিংহাসনে বসে তাদেরকে অবলোকন করছে, অবিশ্বাসীরা যা করত তার প্রতিফল কি পেয়েছে?-(৮৩:৩৪-৩৬)

যারা বেহেস্তী এবং তাদের সন্তানরা যারা ঈমানে তাদের অনুগামী ছিল, তাদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের সাথে মিলিত করে দেয়া হবে এবং তাদের আমল বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।-(৫২:২১) অর্থাৎ বেহেস্তে বেহেস্তীগণ তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানগণ সহযোগে বসবাস করবে। ফেরেস্তারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে এবং বলবে, ‘তোমাদের সবরের কারণে তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর তোমাদের এ পরিণাম-গৃহ কতই না উত্তম।’-(১৩:২৩-২৪)

সেখানে তারা মৃত্যু আস্বাদন করবে না, প্রথম মৃত্যু ব্যতিত।-(৪৪:৫৬) সেখানে তারা চিরকাল বসবাসরত অবস্থায় যা চাইবে, তাই পাবে।-(২৫:১৬)তাদের জন্যে নির্মিত রয়েছে প্রাসাদের উপর প্রাসাদ। যার তলদেশে নদী প্রবাহিত।-(৩৯:২০) তথায় তারা স্বর্ণ নির্মিত ও মতি খঁচিত কংকন দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পোষাক হবে রেশমের। আর তারা বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের দুঃখ দূর করেছেন। নিশ্চয় আমদের পালনকর্তা ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী। যিনি স্বীয় অনুগ্রহে আমাদেরকে বসবাসের গৃহে স্থান দিয়েছেন, যেখানে কষ্ট আমাদেরকে স্পর্শ করে না, ম্পর্শ করে না ক্লান্তি।’-(৩৫:৩৩-৩৫)

মোটকথা, জান্নাতীরা নিরাপদে থাকবে-উদ্যানরাজি ও নির্ঝরিণি সমূহে। তারা পরিধান করবে চিকন ও পুরু রেশমী বস্ত্র, মুখোমুখি হয়ে বসবে। এরূপই হবে এবং আল্লাহ তাদেরকে আনতলোচনা স্ত্রী দেবেন। তারা সেখানে শান্ত মনে বিভিন্ন ফলমূল আনতে বলবে। সেখানে তারা মৃত্যু আস্বাদন করবে না, প্রথম মৃত্যু ব্যতিত।-(৪৪:৫১-৫৫) যখনই তারা খাবার হিসেবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, ‘এতো অবিকল সেই ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম’।

বস্তুতঃ তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্যে শুদ্ধাচারিনী রমণীকূল থাকবে। আর সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল।-(২:২৫) তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা যা করতে তার প্রতিফল স্বরূপ তোমরা তৃপ্ত হয়ে পানাহার কর।’-(৫২:১৯) এক কথায় তারা তাদের কর্মের বহুগুণ প্রতিদান পাবে এবং তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে।-(৩৪:৩৭) সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা এই জন্যে যে, তারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত।-(৯৮:৮)

দোযখের দ্বার চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত জাহান্নামীরা জান্নাতের মধ্যে জান্নাতীদের মনের আনন্দে ঘোরাফেরা ও আহার করতে দেখতে পাবে। তীব্র আগুনের মধ্যে থেকে তারা তাদেরকে ডেকে বলবে, ‘আমাদের উপর সামান্য পানি নিক্ষেপ কর।’
কেউ কেউ বলবে-‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে আহার্য দিয়েছেন, তা থেকেই কিছু দাও।’
আর জান্নাতীরা তাদেরকে বলবে, ‘আল্লাহ এই উভয় বস্তু তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ করেছেন। কেননা তোমরা দুনিয়াতে স্বীয় ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছিলে। অতএব, আজকে তোমাদেরকে আমরা ভুলে যাব; যেমন তোমরা এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং আল্লাহর আয়াত সমূহকে অবিশ্বাস করতে।’-(৭:৪৪-৫১)

আবার, এমনও হতে পারে, সম্মানীত জান্নাতীরা নেয়ামতের উদ্যান সমূহের নির্ধারিত রুজি, ফলমূল সহকারে আসনে মুখোমুখী হয়ে আসীন। তাদেরকে ঘুরে ফিরে পরিবেশন করা হবে স্বচ্ছ পানপাত্র। সুশুভ্র, যা পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু। তাতে মাথা ব্যাথার উপাদান নেই এবং তারা তা পান করে মাতালও হবে না। তাদের কাছে থাকবে নত, আয়তলোচনা তরুণীরা, যেন তারা সুরক্ষিত ডিম। অতঃপর তারা একে অপরের দিকে মুখ করে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাদের একজন বলবে, ‘আমার এক সঙ্গী ছিল। সে বলত, ‘তুমি, কি বিশ্বাস কর যে, আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাঁড়ে পরিণত হব, তখনও কি আমরা প্রতিফল প্রাপ্ত হব?’
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা কি তাকে উঁকি দিয়ে দেখতে চাও?’

অতঃপর সে উঁকি দিয়ে দেখবে এবং তাকে জাহান্নামের মাঝে দেখতে পাবে। সে বলবে, ‘আল্লাহর কসম, তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিলে। আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ না হলে আমিও যে গ্রেফতারকৃতদের সাথেই উপস্থিত হতাম। এখন আমাদের আর মৃত্যু হবে না এবং আমরা শাস্তিও প্রাপ্ত হব না।

নিশ্চয় এ-ই মহা সাফল্য।’-(৩৭:৪১-৬০)

সমাপ্ত।
Not Yet Corrected.


ছবি: Wikipedia, holon137.com

উৎস:
কোরআন,
বাইবেল.
প্লেটো, দি রিপাবলিক।

প্রশ্ন ও উত্তর

"আচ্ছা, আমল নামা স্থাপনের আগে বনি আদমের উদ্দেশ্যে খোদা যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেবেন তা কি সকলে বুঝতে পারবে? আই মিন, ভাষাগত প্রবলেম হবে না তো?"

অসুবিধে হবে না, ফেরেস্তাগণ বনি আদমের প্রত্যেককে ট্রানস্লেটিং আ্যাপস সম্বলিত “গুগল গ্লাস” প্রথমেই সরবরাহ করবে। তাছাড়া অনেক সাবধানী পাবলিক কবরে সওয়াল জবাবের কথা ভেবে ঐ অ্যাপস সম্বলিত গুগল গ্লাস পরিধান করেই কফিনে ঢুকবে। তবে যাদেরকে পুড়িয়ে ছাই করে গঙ্গা জলে বিসর্জন দেয়া হবে তাদের এবং সিলেটীদের ক্ষেত্রে একটু আধটু সমস্যা হলেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমলনামা লেখক ফেরেস্তাগণ দোভাষীর কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।
"সিলেটী..?"

সত্যি বলতে কি আমল লেখক ফেরেস্তাদের ‘সহজ বাংলা ভাষা শিক্ষা কোর্স’ সার্টিফিকেট সিলেটীদের জন্যে কোন কাজে আসেনি। ফলে কিছু ফেরেস্তাদেরকে সিলেটীদের গৃহে গৃহে শিক্ষানবীশ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রথা প্রচলিত হয়।

“হু! বুঝতে পেরেছি এ কারণেই কবি বলেছেন-
”নদীয়ায় জন্ম তার কুষ্টিয়ায় লালন,
সিলেটেতে ব্যাধি আর চাটগাঁয়ে মরণ।” ”

হু, আর কিছু ?
“টেক জায়ান্ট, গুগলের কথা ভাবছি। তাদের তো দেখছি ঐ পারেও ব্যবসা জমজমাট!”
হবে না, ইহুদি বলে কথা!
“আচ্ছা, আগে থেকে গ্লাসের একটা এজেন্সি নিয়ে ঐ পারে টু’পাইস কামানোর কথা চিন্তা-ভাবনা করলে কেমন হয়? বেহেস্তে যাবার ভাগ্য আমাদের কি আর হবে? সুতরাং সেখান থেকে হুর-পরী, শরাবান তহুরা ও নানান খাদ্য-খাবার দোযখে আমদানী করার কাজে এই ইনকাম বড়ই উপকারে আসবে।”

ভালই বলেছ! তা আমাকে তোমার এজেন্সীতে একটা চাকরী দেবার কথা একবার ভেবে দেখো। এ পারে তো বাওড়ালের মতই জীবনটা কাটালাম, আর কত? ঐ পারে না হয় কর্মজীবি হয়েই থাকব।

# “ভাল কথা, বেহেস্তের অপার সুখ-স্বাচ্ছন্দের মধ্যে থাকলে তারা কি একসময় এক ঘেঁয়েমিতে পড়বে না?”

সেখানকার সবকিছুই ভিন্ন ভিন্ন রকমের হবে। ফলের রং ও স্বাদ হবে ভিন্ন। এক হুরের রূপ লাবণ্য অন্যজন থেকে পৃথক হবে। অর্থাৎ একজন ঐশ্বরিয়া হলে আরেকজন হবে মাধুরী, অন্যজন শ্রীদেবী ইত্যাদি। সুতরাং হাপুস-হুপুস খেয়েও কেউ কূল করতে পারবে না।
“তবুও?”
যদি তেমন কিছু হয়, তবে সে আবুল ছাড়া আর কেউ নয়। আর আবুলের ক্ষেত্রে নরমালি যা হয় আরকি!

এক আবুল বেহেস্তের অপার সুখ-স্বাচ্ছন্দের মধ্যে থেকেও এক ঘেঁয়েমিতে পড়েছে। প্রতিদিন পোলাও-কোর্মার মত ঐশ্বরিয়া, মাধুরী কাহাতক ভাল লাগে! তার তখন বিরক্ত বামুনের সেই মন্তব্য মনে পড়ল- “সময় নষ্ট, রজ: ক্ষয়, তবু মাগী পয়সা চায়!” পার্থক্য হচ্ছে এই যে, এসব হুর-পরী পয়সা চায় না।”

সে বিকাল থেকে ভাবছে, আর শরাবান তহুরা খাচ্ছে, ইয়ে.. মানে পান করছে। একসময় সে পানপাত্র হাতে রাজসিক প্রাসাদের এক ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। বেহেস্তী সুগন্ধী মৃদু-মন্দ হাওয়া তার মনকে উদাস করে দিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি গেল দূরে- নীচে। সেখানে একদল নারী-পুরুষ ড্রামের তালেতালে উদ্যাম নৃত্য সহযোগে আনন্দ-ফূর্ত্তিতে মত্ত। সে তৎক্ষণাৎ এটেন্ডেন্ট ফেরেস্তাকে ডেকে বলল, “আমি এখানে থাকব না, আমাকে ওখানে নিয়ে চল।”
ফেরেস্তা বলল, “আপনি যা দেখছেন তা কেবলই আপনার বিনোদনের জন্যে।”

ঐ আবুল বলল- ”বিনোদনটা আমি দূর থেকে নয়, বরং ওখানে গিয়েই উপভোগ করতে চাই।”
ফেরেস্তা বলল- “ওটা তো দোযখ, আর তা ওয়ান ওয়ে। বেহেস্তে সকলের ইচ্ছে পূরণ করা হয়, কিন্তু সেখানে কারও কোন ইচ্ছে পূরণ করা হবে না।”
আবুল বলল- “তা না হয় না হোক, আমি সেখানেই যাব।”

তখন ফেরেস্তা তাকে দোযখের দ্বারে নিয়ে গেল। আর সেখানকার রক্ষীরা তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল এমন এক স্থানে, যেখানে কিছু ফেরেস্তা এক সু-বৃহৎ পাত্রে “আলমের ১নং খাঁটি সরিষার তৈল” ও বগুড়ার শুকনো মরিচের গুড়ো সহযোগে কিছু উটপাখীর ডিম সিদ্ধ করছে। আর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফেরেস্তা মাঝে মাঝে এক চামুচ দিয়ে ডিমগুলো উত্তোলন করে পরীক্ষা করছে। আবুল বলল, “এখানে কি হচ্ছে?”
সঙ্গী ফেরেস্তাদের একজন বলল, “প্রথমে আমরা তোমাকে “ডিম থেরাপী” দেব। তাই এখানে তোমাকে আনা। তবে ডিম এখনও রেডি হয়নি, ফুল বয়েল্ড হলেই কেবল ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।"

সে যখন এসব বলছিল তখন ডিম পরীক্ষক ফেরেস্তা বলল, “ডিম প্রস্তুত।” সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ফেরেস্তা জোরপূর্বক তাকে সেখানে শুইয়ে দিল এবং হাত-পা চেপে ধরল। এ সময় ডিম পরীক্ষক চামুচে করে একটা ডিম নিয়ে এল তার কাছে। আবুল চিৎকার করে বলল, “এসব কি হচ্ছে?”

তার চিৎকারে একজন ফেরেস্তা অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “দুনিয়াতে এতটা বয়স পার করে এসেও তুমি এখনও কচি খোকা রয়ে গেছ!? ...কিছুই বুঝতে পারছ না!?? অার এটাই কি আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বল!???”
তার কথায় আবুল যখন হতভম্ব হয়ে এর ওর মুখ চাইছে, তখন নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে পাশ থেকে আনসার টাইপের এক ফেরেস্তা ডিমের দিকে ইঙ্গিত করে টুপ করে বলে বসল, “ইয়ে.. ওটা ভেতরে যাবে।” আর তারপর সে এমন একটা ভাব নিল যেন সে “উইকিলিস”, এই মাত্র “আমেরিকার গোপন নথি” ফাঁস করে দিয়েছে।

যাহোক, তার একথা শুনেই আবুল ক্ষেপে উঠল, দৃঢ় কন্ঠে বলল, “ফাজলামো নাকি! আমি এখানে “নাচগানে ভরপুর” দেখেই এসেছি। সুতরাং এসব “জুজুর ভয়” দেখিয়ে লাভ নেই। আমাকে সেখানে নিয়ে চল।”

সঙ্গী এক ফেরেস্তা এসময়ে একগাল হেসে বলল, “ও হো, এই কথা! ওটা তো ছিল ট্রেইলর! যা দুনিয়াতে প্রদর্শণ করা হয়েছে। আর তাতে দলে দলে মানুষ এখানকার টিকিট কেটে বসেছে। অত:পর তাদেরকে আমরাও মহাসমাদরে অভ্যর্থণা করেছি এবং এখানে এখন তারা আসল সিনেমার মজা লুটছে। আর তোমার জন্যে ঐ উপভোগ্য সিনেমার শুরুটা হতে যাচ্ছে সামান্য ডিম থেরাপীর মধ্য দিয়ে। তবে আমরাও তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, প্রতিটি ধাপেই তুমি সারপ্রাইজড হবে, কেননা কোন সামগ্রী সর্বোৎকৃষ্ট মানের না হলে আমরা তা কখনই ব্যবহার করি না।"

তারা ---------

# পাঠক এবার আপনাদেরও কোন "আবুল Class" প্রশ্ন থাকলে বলে ফেলুন।


Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...