নবী মুহম্মদের আসন্ন মৃত্যু সংবাদ সীমান্তবর্তী কয়েকটি প্রদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল। কয়েক ব্যক্তি ঐশী পরোয়ানা প্রাপ্তির দাবী করলেন। তারা নিজেদেরকে পয়গম্বর হিসেবে প্রচার ও তাদের গোত্রের লোকদের অনুমোদন ও সমর্থনের প্রচেষ্টা চালালেন। এদের মধ্যে বিপজ্জনক ছিলেন আয়হালা ইবনে ক্বাব বা আল আসওয়াদ আল আনসী, যিনি ছিলেন ইয়েমেনের একজন বিশিষ্ট নাগরিক এবং বিপুল সম্পদ ও প্রভূত বুদ্ধিজ্ঞানের অধিকারী। তিনি সর্বদা পাগড়ী পরতেন এবং মুখ ঢেকে রাখতেন।
আরবের গোত্রসমূহ। |
শীঘ্রই আল-আসওয়াদ আল আনসী তার গোত্রের লোকদেরকে নিজ দলভূক্ত করলেন এবং তাদের সাহায্যে শক্তির দ্বারা প্রতিবেশী অনেক গোত্রের বশ্যতা আদায় করলেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হাদ্রামউত থেকে তায়েফ ও আল আহসা থেকে এডেন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখলে নিলেন। তিনি বাজান পুত্র শাহরকে হত্যা করলেন এবং তার স্ত্রী মারজাবানাকে নিজের স্ত্রী করে নিলেন।
এই শাহরকে নবী মুহম্মদ বাজানের মৃত্যুর পর সানার প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। শাহর ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার ইসলাম গ্রহণের পর তার পথ অনুসরণ করে ইয়েমেনের পারস্যিকরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। তার নির্দেশেই আরবের বাইরে, পার্স্যিয়ান বন্দর নগরী সিলোনে প্রথম কোন মসজিদ মসজিদ নির্মিত হয়।
যা হোক, পরবর্তীতে আল আসওয়াদ আল আনসী অবশ্য নিহত হয়েছিলেন। কেননা, তার বিরুদ্ধে নবীজী মৃত্যুদন্ডের আদেশ জারি করেছিলেন। আর ঐ আদেশের পর স্থানীয় মুসলিমগণ সফল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে হত্যা করে ক্ষমতাচ্যুত করে। এক নৈশ পানোৎসব শেষে আল আসওয়াদ যখন মাতাল অবস্থায় ছিলেন, তখন মারজাবানার সাহায্যে এক 'আবনা' (শাহরের গোত্রের নাম), ফিরোজ আদ দায়লামি তাকে তার শয়ন কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছিল। এই ফিরোজ ছিল সম্পর্কে মারজাবানার ভ্রাতা।
অনেকের মতে- একমাত্র রাতে শয়নের সময় ব্যতিত আসওয়াদ সর্বদা একদল দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত থাকায় তাকে রাতে হত্যার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। আর এই হত্যাকান্ডে মারজাবানা সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি গভীর রাতে হত্যাকারীদের সংকেত পেয়ে শয়ন কক্ষের দ্বার খুলে দিয়ে পাশের কক্ষে অবস্থান নেন।
এদিকে ফিরোজ কক্ষে প্রবেশের পর যখন আসওয়াদের শয্যার দিকে এগিয়ে গেল, তখন তিনি বলে উঠলেন,-'ফিরোজ, তুমি কি করতে যাচ্ছ তা আমি জানি।'-এতে ভীত হয়ে সে তৎক্ষণাৎ তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
এতে আসওয়াদ শয্যা থেকে পতিত হয় এবং তার ঘাঁড় ভেঙ্গে যায়। ফিরোজ তাকে ঐ অবস্থায় ফেলে রেখে দ্রুত দ্বারের দিকে এগিয়ে গেলে তার সঙ্গী তাকে বাঁধা দেয় এবং আসওয়াদের দিকে নিজে এগিয়ে যায়। আসওয়াদ তখনও জীবিত ছিলেন। ফিরোজের সঙ্গী তাকে ঐ অবস্থায় ছুরি দিয়ে তার শির বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর তারা ঐ কর্তিত শির নিয়ে দ্রুত প্রাসাদের ছাদে গিয়ে চিৎকার করে বলে-'আল্লাহ মহান'।
এসময় কিছু লোক প্রাসাদের নীচে সমবেত হয়। ফিরোজ তাদের উদ্দেশ্যে বলে-'এই ব্যক্তি আসওয়াদ একজন ভন্ড নবী এবং খোদার শত্রু।' তারপর সে ঐ খন্ডিত শির নীচে সমবেত লোকের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে।
যাইহোক, পত্র মারফত যখন আল আসওয়াদের এই মৃত্যুর খবর মদিনায় পৌঁছিল, তখন জানা যায় যে, রসূলূল্লাহ রাতে মারা গেছেন।
অপর দু‘জন প্রতারক হলেন খোওয়ালিদের পুত্র তুলাইহা ও হাবিবের পুত্র আবু সুমামা হারান (মুসাইলিমা)। তুলাইহা 'বনি আসাদ' গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। আর তিনি তার গোত্রের সাহসী বীরদের অন্যতম ছিলেন। হিজরী নবম সনে তিনি বনি আসাদ গোত্রের প্রতিনিধি দলের সাথে মদিনায় আগমন করেন এবং তার গোত্রের অন্যদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।
বনি আসাদ গোত্রের এই সব লোকেরা এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় মদিনাতে এসেছিল। তারা অন্তরগত ভাবে মুমিন ছিল না। শুধু দান খয়রাত লাভের জন্যে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেছিল। ইসলামী বিধি-বিধান ও রীতি-নীতি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ও বেখবর ছিল। তারা মদিনার পথে-ঘাটে মলমূত্র ও আবর্জনা ছড়িয়ে দিল এবং বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বাড়িয়ে দিল।
আসাদ গোত্রের এসকল লোকেরা নবী মুহম্মদের কাছে এসে যা বলেছিল তা হল- ‘অন্যান্য লোকেরা দীর্ঘকাল ধরে আপনার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে, অনেকে অনেক যুদ্ধ করেছে এরপর মুসলমান হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনরূপ যুদ্ধ ছাড়াই আপনার কাছে উপস্থিত হয়ে মুসলমান হয়েছি। কাজেই আমাদের সদিচ্ছাকে মূল্য দেয়া দরকার।’ তখন তাদের মিথ্যে দাবী ও অনুগ্রহ প্রকাশের মুখোস উন্মোচন করে এই আয়াতসমূহ নাযিল হল-
মরুবাসীরা বলে, ‘আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি।’
বল, তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করনি। বরং বল, আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি। এখনও তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মেনি। যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, তবে তোমাদের কর্ম বিন্দুমাত্রও নিষ্ফল করা হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম মেহেরবান। তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।
বল, তোমরা কি তোমাদের ধর্মপরায়ণতা সম্পর্কে আল্লাহকে অবহিত করছ? অথচ আল্লাহ জানেন যা কিছু আছে ভূ-মন্ডলে এবং যা কিছু আছে নভঃমন্ডলে। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। তারা মুসলমান হয়ে তোমাকে ধন্য করেছে মনে করে। বল, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে কোরও না। বরং আল্লাহ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাক। আল্লাহ নভঃমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের অদৃশ্য বিষয় জানেন, তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন।-(৪৯:১৪-১৮)
যা হোক, তুলাইহা তার দেশে ফিরে গিয়ে নবুয়্যতের দাবী করে বসেন। নবীজী কর্তৃক নিযুক্ত প্রতিনিধি দ্বারার ইবনুল-আযওয়ার তাকে হত্যা করতে আক্রমণ করেন, কিন্তু তরবারীর আঘাত তার শরীরে কাজ করেনি। এই অস্বাভাবিক ঘটনার দ্বারা মানুষের মাঝে তার প্রভূত গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। শীঘ্রই আরবের বনি আসাদ, বনি গাতাফান এবং বনি তাঈ গোত্রের অনেকেই তার ভক্ত ও অনুসারী হয়ে যায়।
অন্যদিকে মুসাইলিমা নজদের ইয়ামামাহ অঞ্চলের আল-আইনিয়্যাহ এলাকায় 'বনি হানিফা' গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। লোকেরা তাকে রাহমানুল ইয়ামামাহ বলত। হিজরী নবম সনে তার গোত্র বনি হানিফার সাথে তিনি মদিনায় হাজির হন। ঐসময় তিনি বলেছিলেন যে, মুহাম্মদ যদি আমাকে তার সাথে নবুয়্যতে অংশীদার মেনে নেন তবে আমি তার অনুসরণ করব। যাহোক, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইয়ামামায় ফিরে গিয়ে নবুয়্যতের দাবী করে বসেন।
Musaylimah, who is reported as having been a skilled magician, dazzled the crowd with miracles. He could put an egg in a bottle; he could cut off the feathers of a bird and then stick them on so the bird would fly again; and he used this skill to persuade the people that he was divinely gifted.
Musaylimah, who is reported as having been a skilled magician, dazzled the crowd with miracles. He could put an egg in a bottle; he could cut off the feathers of a bird and then stick them on so the bird would fly again; and he used this skill to persuade the people that he was divinely gifted.
প্রায় একই সময় নবুয়্যত দাবী করে বসেন সাজ্জাহ বিনতে হারিস (Sajjah bint Harith) নামের এক মহিলা। এই সাজ্জাহ খৃষ্টান গোত্র 'বনি তাগলিব'-এ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নবুয়্যতের দাবী করে বসলে তার গোত্রের লোকরা তাকে সমর্থন করেন। এভাবে গোত্রীয় লোকদের সমর্থনের উপর ভর করে তিনি পাশ্ববর্তী অন্যান্য গোত্রের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। মুসাইলিমা তাকে দক্ষ ও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দেখে তার সাথে সন্ধির প্রস্তাব করেন। আর ঐ সন্ধির মজলিসে তিনি তাকে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করেও সম্মতি আদায়ে সমর্থ হন। সেখানে তিনি সাজ্জাহের সাথে তিনদিন সহাবস্থান শেষে একাকী ফিরে আসেন, কেননা সাজ্জাহ তার গোত্রের লোকদের ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন।
অত:পর হিজরী ১০ সনে মুসাইলিমা তার পক্ষ থেকে মদীনায় দূত প্রেরণ করেন এই পত্র দিয়ে-
“আল্লাহর রসূল মুসাইলিমা হতে আল্লাহর রসূল মুহম্মদের প্রতি-
আসসালামু আলায়কুম!
আমি আপনার অংশীদার; ক্ষমতা আমাদের মধ্যে অবশ্যই ভাগ করতে হবে। পৃথিবীর অর্ধেক আমার, বাকী অর্ধেক আপনার কুরাইশদের। কিন্তু কুরাইশরা লোভী জাতি-তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার নেই।’
--------------------------”
--------------------------”
দূত মারফত নবীজী তার এই পত্রের যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতে তার চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে-
“পরমদাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে-
আল্লাহর রসূল মুহম্মদ থেকে প্রতারক মুসাইলিমার প্রতি-
‘যারা সত্যপথের অনুসারী তাদের প্রতি সালাম। পৃথিবী আল্লাহর, তিনি যার প্রতি সদয় হন তাকেই দুনিয়ার কর্তৃত্ব দান করেন। কেবল পরহিজগারদের জন্যেই পরকাল (শুধু তারাই সুফল লাভ করবে, যারা আল্লাহকে ভয় করবে)।’
(মোহর):
রসূল আল্লাহ।”
মুসাইলিমা নবীজীর প্রেরিত দূতদেরকে চরম অপমান করেন। তাদেরকে ঘৃণাভরে তাড়িয়ে দেয়া হয় এই বলে যে- ‘যদি দূতদের হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি না হত, তবে আমি তোমাদেরকে হত্যা করতাম।’
বিভিন্ন রণাঙ্গনে সেনাবাহিনী প্রেরণ। |
কিন্তু আবু বকরের খেলাফত লাভের পূর্বে এসব ভন্ড নবীদেরকে (False Prophet) দমন করা যায়নি। খেলাফত লাভের পর তিনি যখন সাহাবাদের সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করলেন, তখন কেউই প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মতি দিলেন না। এতে আবু বকর তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘যারা মুসলমান হবার পর রসূল প্রদত্ত নির্দেশ ও ইসলামকে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা আমার কর্তব্য। যদি আমার বিপক্ষে সব জ্বিণ, মানব ও বিশ্বের যাবতীয় বৃক্ষ-প্রস্তর একত্রিত করে আনা হয় এবং আমার সাথে কেউই না থাকে, তবুও আমি একাই ধর্মের জন্যে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’
Ridda wars. |
খলিফা আবু বকর, তুলাইহার বিরুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে তুলাইহা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে স্ত্রী সহ সিরিয়ায় পলায়ন করেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে তার জীবন ইসলামের ছায়াতলেই কেটেছিল।
অন্যদিকে মুসাইলিমার বিরুদ্ধে খলিফা আবু বকর হিজরী ১১ সনে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। ওহুদ যুদ্ধে নবীজীর চাচা হামজার হত্যাকারী- 'ওয়াহশি ইবনে কামিয়া' এ যুদ্ধে মুসাইলিমাকে হত্যা করেছিল।
এই যুদ্ধে সাজ্জাহর গোত্র বা তার অনুসারীগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেনি। আর নবুয়্যতের দাবী করলেও খলিফা আবু বকর তার বিরুদ্ধে কোন সেনা অভিযান করেননি, কেননা সাজ্জাহ ছিলেন খৃষ্টান। অবশ্য পরবর্তীতে মু'আবিয়া তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। তখন তিনি ইরাকের বসরায় গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। যতদূর জানা যায়, একসময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একজন মুসলিমা হিসেবেই বসরাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যাহোক, এখন আমরা দেখি, এ সকল লোকদের এই মিথ্যা নব্যুয়তের দাবীর কারণ কি?
তৎকালীন আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায় -গোত্রীয় ও জাতিগত গোঁড়ামী, ইহুদি ও খৃষ্টানদের মুসলিম জাতির প্রতি প্রতিহিংসা, চিন্তার বিকৃতি, ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মুসলিম জাতির বেহাল দশাই মূলত: নব্যুয়তের দাবীর কারণ।
তৎকালীন আরব সমাজ ব্যাবস্থা ছিল গোত্র নির্ভর। মুহম্মদের আগমন কুরাইশ গোত্রের বনি কোসাইয়ে হলে ঐ গোত্রের অপর একটি শাখা বনি মাখজুম গোত্র তা মেনে নিতে রাজী ছিল না, কেবলমাত্র গোত্রীয় গোঁড়ামীর কারণে। আবু জেহেলের উক্তি থেকেই এর সত্যতা পাওয়া যায়- "কুরাইশ গোত্রের একটি শাখা 'বনি কোসাই'য়ে এসব গৌরব ও মহত্ত্বের সমাবেশ ঘটবে, অবশিষ্ট কুরাইশরা রিক্তহস্ত থেকে যাবে-আমরা তা কিরূপে সহ্য করতে পারি? পতাকা তাদের হাতে, হাজীদের পানি পান করানোর গৌরবময় কাজটি তাদের দখলে, কা’বার প্রহরা ও চাবি তাদের করায়ত্ত। এখন নব্যুয়তও তাদের হাতে ছেড়ে দিলে আমাদের আর কি রইল? সুতরাং আমরা কোনদিনই তাদের অনুসরণ করব না, যে পর্যন্ত না আমাদের কাছেও তাদের অনুরূপ ওহী আসে।”
এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতও নাযিল হয়েছিল- “যখন তাদের কাছে কোন আয়াত পৌঁছে, তখন বলে, ‘আমরা কখনই মানব না যে পর্যন্ত না আমরাও তা প্রদত্ত হই, যা আল্লাহর রসূলগণ প্রদত্ত হয়েছেন। আল্লাহ এ বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত যে, কোথায় স্বীয় পয়গাম প্রেরণ করতে হবে।”-(৬:১২৪)
যা হোক, আরবে বহু গোত্র ছিল। এসব গোত্রের কেউ কেউ (যেমন হানিফা ও আসাদ গোত্র।) মনে করত যে, তারাও কুরাইশদের সমকক্ষ। তারপর যখন কুরাইশ গোত্রের একজন নব্যুয়ত পেলেন, তখন এইসব গোত্রও নব্যুয়তের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা মনে করতে থাকে তাদের মধ্যে থেকেও নবী হওয়া জরুরী। কেননা এটাকে তারা গোত্রীয় সম্মান বলে বিবেচনা করে বসে। আর এতেই পরবর্তীতে এই দু’ই গোত্র থেকেই নব্যূয়তের দাবীদার উত্থিত হয়েছিল।
এভাবে হানিফা গোত্র থেকে যখন মুসাইলিমা নব্যূয়তের দাবী করে বসেন, তখন তার গোত্রের লোকেরা নব্যূয়তের সত্য-মিথ্যা বিচার না করে এটাকে তাদের গোত্রীয় সম্মান বিবেচনা করে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ-হানিফা গোত্রের এক লোক মুসাইলিমার নব্যূয়ত প্রাপ্তির সংবাদে তার কাছে আগমণ পূর্বক জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কাছে এমন কিছু কি অবতীর্ণ করা হয়েছে যে, আমরা তোমার অনুসরণ করব?’
তখন মুসাইলিমা তাকে তার কাছে অবতীর্ণ বাণী শুনিয়ে দিল। লোকটি তখন বলেছিল, ’আমি জানি তুমি মিথ্যেবাদী। কিন্তু আমার কাছে হানিফা গোত্রের একজন মিথ্যেবাদী, কুরাইশ গোত্রের একজন সত্যবাদীর চাইতে অনেক বেশী প্রিয়। সুতরাং আমি তোমাকে অনুসরণ করলাম।’
অবশ্য পরবর্তীতে ঈমানের দৃঢ়তা আসার পর গোত্রীয় কৌলিন্যের জন্যে নব্যুয়তের দাবী তেমন একটা কেউ করেনি। কারণ, মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল যে, নব্যূয়ত কোন দাবীর বিষয় নয়। আল্লাহ জানেন কে উপযুক্ত এবং কোথায় তাঁর পয়গাম প্রেরণ করতে হবে।
আরবদের মধ্যে যেমন গোত্রীয় গোঁড়ামী ছিল, তেমনি অনারবদের মধ্যে ছিল জাতিভেদ। ইসলামের বিজয়ের ফলে প্রচুর অনারব ইসলাম গ্রহণ করে। যেমন,- পারস্যিক জাতি। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের অনেকের মধ্যেই এ ধারণা প্রবল ছিল যে, একসময় তারা শাসক ছিল অথচ এখন মুসলিম আরবদের দ্বারা তারা শাসিত হচ্ছে। সুতরাং তারাও নিজেদের মধ্যে নবীর প্রত্যাশা করল। তারা ধারণা করল, আল্লাহ যেমন আরবদের মাঝে নবী প্রেরণ করেছেন তেমনি তাদের মাঝেও তিনি প্রেরণ করবেন। আর তারা তাদের ঐ ভাবাদর্শ ও চিন্তাধারাকে তাদের অনুসারীদের মধ্যেও বপন করতে সক্ষম হয়। এতে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে নব্যূয়তের দাবীদার উত্থিত হয়। উমাইয়া ও আব্বাসী যুগের নব্যূয়তের দাবীদারদের অধিকাংশই ছিল অনারব।
পরবর্তীতে যারা নব্যূয়তের দাবী করেছেন, তাদের অধিকংশই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায় ভূক্ত। তারা প্রথমে ঈমাম হওয়ার দাবী করেছিলেন, যা শেষপর্যন্ত নব্যূয়তের দাবী পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। যেমন,- মুগীরা ইবনে সাঈদ আল-ইজলী, আবু মনসূর আল-ইজলী, আবুল খাতাব আল-আসাদী এবং বয়ান ইবনে সামুআন। আর আলী ইবনে ফাদল আল হিমাইরী আল ইয়েমেনী, যিনি ছিলেন শিয়াদের বার ঈমামী বাইশনা আশারী উপদলের এক ব্যক্তি। তিনি ইসমাঈলী শিয়াদের প্ররোচনায় পড়ে নিজেকে ঈমাম মেহেদী বলে দাবী করে বসেন, তারপর দাবী করেছিলেন তার নব্যূয়ত প্রাপ্তির।
নব্যূয়তের দাবীদারদের মধ্যে সূফী প্রভাবও বেশ লক্ষ্যণীয়। যেমন,- আল হারিস বিন সাঈদ। সবাই তাকে সবচেয়ে বড় পরহেজগার বলে মনে করত, কিন্তু শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তিনি পদস্খলিত হন এবং নিজের নব্যূয়ত দাবী করে বসেন।
মূলত: নব্যূয়তের দাবীদারদের যে কাজটি সবচেয়ে বেশী সহযোগীতা করেছিল তা হল তাদের সম্প্রদায়ের মাঝে ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব। ফলে এইসব দাবীদাররা সহজে তাদের মতামত ঐ সম্প্রদায়ের উপর খাটাতে সক্ষম হয়েছিল। আবার একথাও উড়িয়ে দেয়া যাবে না যে, নব্যূয়তের এইসব দাবীদাররা মুসলিম উম্মাহর খারাপ অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল সবচেয়ে বেশী।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
উ’স:
এই যুদ্ধে সাজ্জাহর গোত্র বা তার অনুসারীগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেনি। আর নবুয়্যতের দাবী করলেও খলিফা আবু বকর তার বিরুদ্ধে কোন সেনা অভিযান করেননি, কেননা সাজ্জাহ ছিলেন খৃষ্টান। অবশ্য পরবর্তীতে মু'আবিয়া তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। তখন তিনি ইরাকের বসরায় গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। যতদূর জানা যায়, একসময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একজন মুসলিমা হিসেবেই বসরাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যাহোক, এখন আমরা দেখি, এ সকল লোকদের এই মিথ্যা নব্যুয়তের দাবীর কারণ কি?
তৎকালীন আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায় -গোত্রীয় ও জাতিগত গোঁড়ামী, ইহুদি ও খৃষ্টানদের মুসলিম জাতির প্রতি প্রতিহিংসা, চিন্তার বিকৃতি, ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মুসলিম জাতির বেহাল দশাই মূলত: নব্যুয়তের দাবীর কারণ।
তৎকালীন আরব সমাজ ব্যাবস্থা ছিল গোত্র নির্ভর। মুহম্মদের আগমন কুরাইশ গোত্রের বনি কোসাইয়ে হলে ঐ গোত্রের অপর একটি শাখা বনি মাখজুম গোত্র তা মেনে নিতে রাজী ছিল না, কেবলমাত্র গোত্রীয় গোঁড়ামীর কারণে। আবু জেহেলের উক্তি থেকেই এর সত্যতা পাওয়া যায়- "কুরাইশ গোত্রের একটি শাখা 'বনি কোসাই'য়ে এসব গৌরব ও মহত্ত্বের সমাবেশ ঘটবে, অবশিষ্ট কুরাইশরা রিক্তহস্ত থেকে যাবে-আমরা তা কিরূপে সহ্য করতে পারি? পতাকা তাদের হাতে, হাজীদের পানি পান করানোর গৌরবময় কাজটি তাদের দখলে, কা’বার প্রহরা ও চাবি তাদের করায়ত্ত। এখন নব্যুয়তও তাদের হাতে ছেড়ে দিলে আমাদের আর কি রইল? সুতরাং আমরা কোনদিনই তাদের অনুসরণ করব না, যে পর্যন্ত না আমাদের কাছেও তাদের অনুরূপ ওহী আসে।”
এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতও নাযিল হয়েছিল- “যখন তাদের কাছে কোন আয়াত পৌঁছে, তখন বলে, ‘আমরা কখনই মানব না যে পর্যন্ত না আমরাও তা প্রদত্ত হই, যা আল্লাহর রসূলগণ প্রদত্ত হয়েছেন। আল্লাহ এ বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত যে, কোথায় স্বীয় পয়গাম প্রেরণ করতে হবে।”-(৬:১২৪)
যা হোক, আরবে বহু গোত্র ছিল। এসব গোত্রের কেউ কেউ (যেমন হানিফা ও আসাদ গোত্র।) মনে করত যে, তারাও কুরাইশদের সমকক্ষ। তারপর যখন কুরাইশ গোত্রের একজন নব্যুয়ত পেলেন, তখন এইসব গোত্রও নব্যুয়তের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা মনে করতে থাকে তাদের মধ্যে থেকেও নবী হওয়া জরুরী। কেননা এটাকে তারা গোত্রীয় সম্মান বলে বিবেচনা করে বসে। আর এতেই পরবর্তীতে এই দু’ই গোত্র থেকেই নব্যূয়তের দাবীদার উত্থিত হয়েছিল।
এভাবে হানিফা গোত্র থেকে যখন মুসাইলিমা নব্যূয়তের দাবী করে বসেন, তখন তার গোত্রের লোকেরা নব্যূয়তের সত্য-মিথ্যা বিচার না করে এটাকে তাদের গোত্রীয় সম্মান বিবেচনা করে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ-হানিফা গোত্রের এক লোক মুসাইলিমার নব্যূয়ত প্রাপ্তির সংবাদে তার কাছে আগমণ পূর্বক জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কাছে এমন কিছু কি অবতীর্ণ করা হয়েছে যে, আমরা তোমার অনুসরণ করব?’
তখন মুসাইলিমা তাকে তার কাছে অবতীর্ণ বাণী শুনিয়ে দিল। লোকটি তখন বলেছিল, ’আমি জানি তুমি মিথ্যেবাদী। কিন্তু আমার কাছে হানিফা গোত্রের একজন মিথ্যেবাদী, কুরাইশ গোত্রের একজন সত্যবাদীর চাইতে অনেক বেশী প্রিয়। সুতরাং আমি তোমাকে অনুসরণ করলাম।’
অবশ্য পরবর্তীতে ঈমানের দৃঢ়তা আসার পর গোত্রীয় কৌলিন্যের জন্যে নব্যুয়তের দাবী তেমন একটা কেউ করেনি। কারণ, মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল যে, নব্যূয়ত কোন দাবীর বিষয় নয়। আল্লাহ জানেন কে উপযুক্ত এবং কোথায় তাঁর পয়গাম প্রেরণ করতে হবে।
আরবদের মধ্যে যেমন গোত্রীয় গোঁড়ামী ছিল, তেমনি অনারবদের মধ্যে ছিল জাতিভেদ। ইসলামের বিজয়ের ফলে প্রচুর অনারব ইসলাম গ্রহণ করে। যেমন,- পারস্যিক জাতি। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের অনেকের মধ্যেই এ ধারণা প্রবল ছিল যে, একসময় তারা শাসক ছিল অথচ এখন মুসলিম আরবদের দ্বারা তারা শাসিত হচ্ছে। সুতরাং তারাও নিজেদের মধ্যে নবীর প্রত্যাশা করল। তারা ধারণা করল, আল্লাহ যেমন আরবদের মাঝে নবী প্রেরণ করেছেন তেমনি তাদের মাঝেও তিনি প্রেরণ করবেন। আর তারা তাদের ঐ ভাবাদর্শ ও চিন্তাধারাকে তাদের অনুসারীদের মধ্যেও বপন করতে সক্ষম হয়। এতে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে নব্যূয়তের দাবীদার উত্থিত হয়। উমাইয়া ও আব্বাসী যুগের নব্যূয়তের দাবীদারদের অধিকাংশই ছিল অনারব।
পরবর্তীতে যারা নব্যূয়তের দাবী করেছেন, তাদের অধিকংশই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায় ভূক্ত। তারা প্রথমে ঈমাম হওয়ার দাবী করেছিলেন, যা শেষপর্যন্ত নব্যূয়তের দাবী পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। যেমন,- মুগীরা ইবনে সাঈদ আল-ইজলী, আবু মনসূর আল-ইজলী, আবুল খাতাব আল-আসাদী এবং বয়ান ইবনে সামুআন। আর আলী ইবনে ফাদল আল হিমাইরী আল ইয়েমেনী, যিনি ছিলেন শিয়াদের বার ঈমামী বাইশনা আশারী উপদলের এক ব্যক্তি। তিনি ইসমাঈলী শিয়াদের প্ররোচনায় পড়ে নিজেকে ঈমাম মেহেদী বলে দাবী করে বসেন, তারপর দাবী করেছিলেন তার নব্যূয়ত প্রাপ্তির।
নব্যূয়তের দাবীদারদের মধ্যে সূফী প্রভাবও বেশ লক্ষ্যণীয়। যেমন,- আল হারিস বিন সাঈদ। সবাই তাকে সবচেয়ে বড় পরহেজগার বলে মনে করত, কিন্তু শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তিনি পদস্খলিত হন এবং নিজের নব্যূয়ত দাবী করে বসেন।
মূলত: নব্যূয়তের দাবীদারদের যে কাজটি সবচেয়ে বেশী সহযোগীতা করেছিল তা হল তাদের সম্প্রদায়ের মাঝে ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব। ফলে এইসব দাবীদাররা সহজে তাদের মতামত ঐ সম্প্রদায়ের উপর খাটাতে সক্ষম হয়েছিল। আবার একথাও উড়িয়ে দেয়া যাবে না যে, নব্যূয়তের এইসব দাবীদাররা মুসলিম উম্মাহর খারাপ অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল সবচেয়ে বেশী।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
উ’স:
al-Nadīm, The Fihrist.
Sahih Bukhari,
The History of al-Tabari
Maulana Wahiduddin Khan, Muhammad: A Prophet for All Humanity.
Taha Jabir Alalwani, Apostasy in Islam: A Historical and Scriptural Analysis.
M. Mukarram Ahmed, Muzaffar Husain Syed, Encyclopaedia of Islam, ,
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন