ওয়াইশি ইবনে হার্ব (আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধের সন্তান) ছিল জুবায়ের ইবনে মুতিমের ইথিওপিও দাস। সে মূলত: নবীজীর চাচা, হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং ভন্ডনবী মুসাইলিমা ইবনে সুমামা বিন কবির বিন হাবিবের হত্যাকারী হিসেবে সুপরিচিত।
নবীজী যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন সমাজের অবহেলিত ও নির্য়াতিতরাই কেবল তা গ্রহণ করছিল। এভাবে ওমরের বাঁদী রানীন যখন তা গ্রহণ করল, তখন কুরাইশগণ বলতে লাগল, “ইসলাম যদি ভাল কোন ধর্ম হত, তবে রানীনের মত বাঁদী আমাদেরকে ফেলে এগিয়ে যেতে পারত না।"
যা হোক, ইসলামে মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। সুতরাং সকলের সাথে জুবায়েরের দাস ওয়াইশির কাছেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিল। এতে ওয়াইশি জানিয়েছিল: “ও মুহম্মদ! কি করে আপনি আমাকে ইসলামের দিকে আহবান করেন, যখন আপনি বলেন যে, হত্যাকারী, পৌত্তলিক ও ব্যাভিচারী শেষবিচারের দিনে দোযখী সাব্যস্ত হবে, তারা দোযখে যাবে এবং সেখানেই চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে? আমি সবগুলো পাপই করেছি। এতদসত্ত্বেও আমার পরিত্রাণের অন্যকোন উপায় আছে কি?”
উত্তরে নবীজী তাকে জানান: কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-(২৫:৭০)
এতে ওয়াইশি বলেছিল, “ও, মুহম্মদ! “যদি সে তওবা করে, বিশ্বাসী হয় ও সৎকর্ম করে...” এ শর্তগুলো আমার জন্যে খুবই কঠিন।”
নবীজী জানিয়েছিলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।” -(৪: ১১৬)
এরপর ওয়াইশি বলেছিল, “ও, মুহম্মদ! এ তো সম্পূর্ণ আল্লার ইচ্ছেধীন। আমি নিশ্চিত নই আমি ক্ষমা পাব কি পাব না। অন্যকোন পথ আছে কি-না বলেন?”
তখন নবীজী উত্তরে বলেছিলেন: “বল, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” -(৩৯:৫৩)
এ সময় সাহাবীরা বলেছিল, “ওয়া্ইশি যা জানতে চেয়েছে আমাদের মনেও এ প্রশ্ন উদয় হয়েছিল।”
এতে নবীজী বলেন, “এ তো সকল মুসলমানের জন্যেই সুখবর।” -দি ইসলামিক বুলেটিন, খন্ড-২২, নম্বর ২৭, পৃষ্ঠা-২৯।
আর ওয়াইশি এ শুনে বলেছিল, “নিশ্চয় এ কল্যাণের।” কিন্তু সে ঐ সময় ইসলাম গ্রহণ করেনি। সম্ভবত: তার মনিবের ভয়ে, কেননা, কুরাইশগণ মনিবের অনুমতি ছাড়া কোন দাসের ইসলাম গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিল। আবার এমনও হতে পারে, সে ভীত হয়েছিল নব্য মুসলিমদের উপর কুরাইশদের নৈমিত্তিক অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে।
বদর যুদ্ধে অনেক কুরাইশ নেতা নিহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে ছিল তুয়াইমা ইবনে আদি আল-খায়ের এবং ওৎবা ইবনে আবি রাবিয়া। তারপর ওহুদ যুদ্ধের সময়, আবু সূফিয়ানের স্ত্রী, ওৎবার কন্যা হিন্দ ওয়াইশিকে এমন এক প্রস্তাব দিল যে, যদি সে মুহম্মদ ইবনে আবদ আল্লা, আলি ইবনে আবু তালিব বা হামজা ইবনে আবদ আল-মুত্তালিব- এই তিনজনের কাউকে হত্যা করতে পারে, যাতে সে বদর যুদ্ধে নিহত তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সমর্থ হয়, তবে তার ঐ কাজে সফলতার পুরস্কার স্বরূপ সে তার মুক্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে তার কাছে প্রতিজ্ঞাত হয়।
বদর যুদ্ধে হামজা, জুবায়ের ইবনে মুতিমের পিতৃব্য তাইমিয়া ইবনে আদি বিন আল খায়েরকে হত্যা করেছিলেন। সুতরাং কুরাইশগণ যখন মুসলমানদের উপর পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং তাদেরকে পরাভূত করতে আবারো যুদ্ধের জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করছিল, সেময় তার মুনিব জুবায়ের তাকে বললেন, ‘আমার চাচার হত্যার প্রতিশোধে যদি তুমি মুহম্মদের পিতৃব্য হামজাকে হত্যা করতে পার, তবে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে।’ সুতরাং দাসত্বের বন্ধন যা তার গলদেশে দীর্ঘকাল আগে ফাঁসের মত আঁটকে গিয়েছিল, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, এ ছিল ওয়াইশির জন্যে এক দ্বি-মুখী সুযোগ।
তারপর আইনাইন [আইনাইন ওহুদ পর্বতের নিকটবর্তী একটি পর্বত এবং এ দুটি পর্বতের মধ্যবর্তী উপত্যকা যেখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল] বৎসরে কুরাইশগণ যখন যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে পড়ল তখন ওয়াইশি যুদ্ধে অংশ নিতে তাদের সঙ্গে গেল।
ওহুদ যুদ্ধের দিনে [সিই ৬২৫] যখন কুরাইশ যোদ্ধারা যুদ্ধের জন্যে সাঁরিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল, তখন ওয়াইশি তার শিকার খুঁজে ফিরছিল। নবী মুহম্মদের দিকে অগ্রসর হওয়া তার জন্যে সম্ভব ছিল না, কারণ একদল সাহাবী সর্বদাই তাকে ঘিরে থাকত, পাহারায়। সে ভেবে দেখল আলী যুদ্ধের ময়দানে খুবই সতর্ক অন্যদিকে হামজা যুদ্ধে এাস সৃষ্টিকারী, সে অন্যদিকে নজর দেয় না, সুতরাং তাকে ফাঁদে ফেলে বা তার অসতর্কতার কোন সুযোগ নিয়ে তাকে ঘায়েল করা যেতে পারে।
সে যখন এসব ভাবছিল ঠিক তখন কুরাইশদের মধ্য থেকে শায়বা বেরিয়ে এল এবং হেঁকে বলল, ‘মুসলমানদের মধ্যে এমন কেউ কি আছ যে আমার সঙ্গে দ্বৈত লড়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে?’
আর হামজা তার হাঁক শুনে এগিয়ে এলেন এবং তাচ্ছিল্যের সূরে বললেন, “কে শায়বা নাকি! যার মা লেডিসদের ধরে ধরে খৎনা করে! তা তুই কি আল্লা ও তাঁর রসূলকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিস? তবে আয়! ও ভগাংকুর কাটনেওয়ালীর পুত! সামনে আয়!”
শায়বা ইবনে আল-উজ্জা তার দিকে এগিয়ে গেলেন আর হামজাও তার তরবারী চালালেন। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল যে, দেখতে মনে হল হামজা মিস করেছেন, কিন্তু না, ঐ আঘাত তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিল।
ওয়াইশি হামজার উপর চোখ রেখে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়েছিল। তারপর তিনি যখন তার কাছাকাছি হলেন, তখন সে বেরিয়ে এল এবং নির্দিষ্ট এক দূরত্ব থেকে তার বর্শাটাকে ভারসাম্যে নিয়ে সেটিকে ছুঁড়ে দিল। অন্যান্য আফ্রিকানদের মত ওয়াইশিও ছিল বর্শা নিক্ষেপে দক্ষ, তা কখনও লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয় না।
ওয়াইশি তার বর্শার দিকে তাকাল, সেটি তখনও লক্ষ্যবস্তুর দিকে উড়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ হামজাকে আঘাত করল তার নাভিতে এবং বেরিয়ে গেল তার পায়ূদেশ দিয়ে। তিনি ওয়াইশিকে আক্রমণ করতে তার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন কিন্তু প্রচন্ড যন্ত্রণা তা তাকে করতে দিল না। তিনি ঐ অবস্থায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না তার আত্মা তার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে না গেল।অত:পর ওয়াইশি তার কাছে গিয়ে বর্শাটা টেনে বের করে নিয়ে ফিরে গেল সেখানে যেখানে কুরাইশরা ছাউনি ফেলেছিল আর তার মুক্তির অপেক্ষায় থাকল। কোথাও না গিয়ে সে সেখানেই রইল কেননা তার দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত হতে সে কেবল হামজাকেই বেঁছে নিয়েছিল হত্যার জন্যে, নিজেকে যুদ্ধের সঙ্গে জড়ায়নি।
যখন যুদ্ধের ময়দান কুরাইশদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল, তখন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, হিন্দ বিনতে ওৎবা হামজার লাশটি খুঁজে পায়। বদর যুদ্ধে হামজা তার পিতা ওৎবা ইবনে রাবিয়াকে হত্যা করেছিলেন। সে এইসময় পিতৃহত্যার প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল। ছুরি দিয়ে সে লাশের বুক চিরে ফেলল এবং কলিজা বের করে নিয়ে, তার বুকের উপর বসেই তা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।
কোন এক শিষ্যের মাধ্যমে নবীজী তার পিতৃব্যের মৃত্যুর কথা জানতে পারেন। কিন্তু তার উপর এমন কিছু ঘটতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। এই পিতৃব্যর প্রতি তার ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। তিনি জানতে চান, কেউ তাকে ঐ স্থানটি দেখিয়ে দিতে পারবে কি-না যেখানে তার পিতৃব্য নিহত হয়েছেন। তখন এক শিষ্য উঠে দাঁড়ালে, তিনি তার সঙ্গে সেখানে গেলেন।
লাশের অবস্থা দেখে নবীজী ব্যাথিত হন। বুক-পেট চিরে ফেলে ভিতরের সবকিছু টেনে বের করে ফেলা হয়েছে। যে শিষ্য তাকে সেখানে নিয়ে যায়, সে জানায় যে, মৃতদেহের অবস্থা অমনটা ছিল না যখন সে তাকে নিহত হতে দেখেছে, এসব ঘটেছে পরবর্তীতে।
যুদ্ধ শেষে কুরাইশগণ যখন মক্কাতে ফিরে গিয়েছিল, তখন ওয়াইশিও তাদের সাথে ছিল। তারপর সে সেখানে একজন মুক্তমানুষ হয়ে, উদ্দীপনার সাথে নতুনভাবে জীবন-যাপন শুরু করে। অত:পর মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হামজাকে হত্যার অপরাধে ওয়াইশিকে “যুদ্ধঅপরাধী” ঘোষণা করা হয়। এতে সে মক্কা থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ওয়াইশি এ বিষয়ে বলেছিল, “ওহুদ যুদ্ধের পর আমি মক্কাতেই বসবাস করতে থাকি যতক্ষণ না তা মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হয়। তারপর আমি পালিয়ে যাই তায়েফে।”
ওয়াইশি তায়েফে সাকিফদের সান্নিধ্যে বেশ কয়েক বৎসর বাস করে। তারপর নবম হিজরীতে, যখন তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের অভিপ্রায়ে নবীজীর কাছে এক প্রতিনিধিদল প্রেরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঐ ক্রান্তি লগ্নে সে বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিৎ। যদি তায়েফ ইসলাম গ্রহণ করে, তবে সে কোথায় যাবে? অবশেষে সে সিরিয়া, ইয়েমেন বা অন্য কোন দেশে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ঐ সময়টা ছিল তার জন্য উদ্বেগ ও সিদ্ধান্তহীনতার কাল। আর সে সময় কেউ একজন তাকে বলেছিল, “কসম আল্লা, তিনি এমন কাউকে হত্যা করেন না, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং তুমি আমাদের সঙ্গে চল।” সে এমনটা বলেছিল কারণ নবীজীর সংযম ও সহনশীলতার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় তা তায়েফবাসীর কাছেও পৌঁছেছিল, আর তার ক্ষমাশীলতা ও দয়ার কথা তো সর্বজন বিদিত ছিল।
ওয়াইশি আরও জানতে পারে নবীজী দূতদের কোন ক্ষতি করেন না; আর তাই সে মদিনাতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিনিধিদলের একজন হয়ে। তারপর যখন সাকিফ গোত্র নবীজীর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করল, ওয়াইশিও তাদের সাথে ছিল এবং ব্যক্তিগতভাবে নবীজীর কাছে গিয়ে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল।
ওয়াইশি তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে পরবর্তীতে বলেছিল, “অামি শুনেছি, যত বড় অপরাধই হোক না কেন, ক্ষমা চাইলে খোদা ক্ষমা করেন [কারণ তিনি অসীম ক্ষমাশীল]। আর তাই আমি নবীজীর কাছে গেলাম মুখে কলেমা শাহাদৎ নিয়ে।”
নবীজী তাকে দেখলেন। বহু বৎসরের অদর্শণে, এ সেই ওয়াইশি কি-না তা তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। "তুমি কি সেই ইথিওপিয় ওয়াইশি?" -নবীজী জিজ্ঞেস করেন।
এতে ওয়াইশি হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। তখন তিনি তাকে বসতে বলেন, তারপর তাকে জিজ্ঞেস করেন, “হামজা ইবনে অাবদ আল-মুত্তালিবকে কিভাবে তুমি হত্যা করেছিলে?”
ওয়াইশি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো কাহিনী স্মরণ করল। কিন্তু সে কেবল উত্তরে বলল, “তাই ঘটেছিল, যা আপনাকে জানানো হয়েছিল,” সে আরও বলেছিল, “ও রসূলুল্লাহ! আর যা আপনাকে জানানো হয়নি তা হল, আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি, কেবল তাকে হত্যা করি নিজের দাসত্ব মুক্তির জন্যে।”
পিন পতন নিস্তবতা। বিষাদের ছায়া নেমে এল নবীজীর সারামুখে, তিনি বললেন, “আমার পিতৃব্যের উপর তোমার হাত দিয়ে যে কহিনীর শুরু, তার সমাপ্তি হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে।” তিনি নিরব হয়ে বসে রইলেন কিছুসময়, তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললেন, “ও ওয়াইশি! পুনরুত্থিত হবার আগে তুমি আর আমার সামনে এস না।” -তিনি চলে গেলেন।
নবীজী ওয়াইশিকে ভবিষ্যতে তার সামনে আসতে নিষেধ করেছিলেন কেন?
বস্তুত: এ কেবল তার মঙ্গল কামনায়, কেননা তাকে দেখলে তার চাচার কথা স্মরণে আসবে, আর তাতে তার মন ব্যাথায় ভরে উঠবে, এতে তার অজান্তে যাতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ওয়াইশির উপর নেমে না আসে।
পরবর্তী দু’বছর ওয়াইশি, দর্শণার্থী এড়িয়ে একটু নিরিবিলি থাকতে, তায়েফের বিভিন্ন স্থানে বাস করল। সে বিবেকের দংশনে ভুগছিল এবং জীবন সংশয়ে ছিল। এ ছিল এক দূর্বিসহ জীবন। তবে সে তার নবদীক্ষিত ধর্মে বিশ্বস্ত রইল। এরপর সে সত্য প্রতিষ্ঠায় অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক পেল। তখন সে রিদ্দার যুদ্ধে অংশ নিল।
নবীজীর জীবনাবসান কালে মুসাইলিমা নবূয়্যত দাবী করে বসে। কিন্তু নবীজীর মধ্য দিয়ে নবূয়্যতের সমাপ্তির সুস্পষ্ট ঘোষণা ইতিপূর্বেই কোরআন জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং মুসাইলিমা মুসলমানদের নিকট সন্দেহাতীতভাবে একজন ভন্ড হিসেবে স্বীকৃত হয়। ইসলাম গ্রহণের পর মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা, আল্লা ও তাঁর রসূলের উপর মিথ্যারোপের কারণে খলিফা আবুবকর তাকে দমনের সিদ্ধান্ত নেন। অার যখন তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হল, তখন ওয়াইশিও তাতে অংশগ্রহণ করে মুসাইলিমাকে নিজ হাতে হত্যার অভিলাশ নিয়ে, যাতে করে তার উপর চেপে বসা গ্লানির ভার কিছুটা হলেও কমে।
রিদ্দার যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ। তার আগমণের খবরে মুসাইলিমা আকরাবাতে তার অনুগত বাহিনীকে বিন্যস্ত করে। মুসলিমদের ১ম ও ২য় আক্রমণের ধাক্কা সে প্রতিহত করে। কিন্তু প্রচুর হতাহতের পরও মুসলিমদের দৃঢ়তা দেখে সে তার সুরক্ষিত বাগিচা অঙ্গনে প্রবেশ করে।
তারপর মুসলিম সেনারা যখন ৩য় ধাপের আক্রমণের মধ্যদিয়ে ঐ সুরক্ষিত বাগানে প্রবেশ করে, তখন ওয়াইশি চারিদিকে মুসাইলিমাকে খুঁজে ফেরে। একসময় তার শিকারী বাজের দৃষ্টি তাকে খুঁজে পায় দূরে একজায়গায় তার অনুসারী বেষ্টিত অবস্থায়। দূরত্বটা তার জন্যে খুব একটা বেশী নয়। দ্রুত সে প্রস্তুত হয়ে পজিশন নেয় তারপর লক্ষ্যস্থির করে সে তার বর্শা ছুড়ে দেয়। এ সেই বর্শা যা দিয়ে ইতিপূর্বে সে হামজাকে বিদ্ধ করেছিল।
মুসাইলিমা তরবারী হাতে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়েছিল। উসকো খুশকো চুলে তাকে দেখাচ্ছিল ছাই রংয়ের এক উটের মত। ওয়াইশি যখন তার বর্শা ছুঁড়েছিল, ঐ সময় বিপরীত দিক থেকে আবু দোজনা নামের এক আনসারীও মুসাইলিমার কাছে পৌঁছুতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে তার কাছে যাবার আগেই ওয়াইশির ছুঁড়ে দেয়া বর্শা মুসাইলিমাকে অসহায়ভাবে গেঁথে ফেলল মাটির সাথে। আর ঠিক সেই মূহূর্তে দোজনার তরবারীও তাকে আঘাত হানে এবং তার শির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু দূর্ভাগ্য দোজনার, উল্লাস প্রকাশ করার আগেই পেছন থেকে হানা এক আঘাত তার শিরও ফেলে দিয়েছিল ভূমিতে। এক গৃহের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে মুসাইলিমার পরিণতি দেখে এক দাসী আফসোস নিয়ে বলেছিল: “হায়! বিশ্বাসীদের নেতা নিহত হলেন এক কাফ্রি দাসের হাতে।”
ওয়াইশি পরবর্তীতে খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অত:পর যখন সেটি বিজিত হয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়, তখন সে এমেসার হিমসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। আর সেখানে বসবাস কালে সে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে শরিয়তী আইনের শাস্তি তাকে পেতে হয়। খলিফা ওমর তাকে ৮০টি দোররা মারার নির্দেশ দেন। সে ছিল প্রথম মুসলিম যে সিরিয়ায় এ ধরণের অপরাধের জন্য শাস্তির আওতায় আসে। তবে শাস্তি পাবার পরেও ওয়াইশি মদ্যপান পরিত্যাগ করতে পারেনি। এতে ওমর হতাশ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “হয়ত: হামজার রক্তের কারণে আল্লার অভিশাপ ঐ বুনোটার উপর ভর করেছে।”
ওয়াইশির শেষ জীবনটা ঐ এমেসাতেই কাটে। তবে শেষের দিকে সে বেশ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। অনেকে তাকে এক নজর দেখার জন্যে তার বাড়ীতে ভীড় করত। তবে পাঁড় মাতাল হলেও সে আগতদের অনুরোধে তাদেরকে হামজা ও মুসাইলিমাকে হত্যার বিস্তারিত ঘটনা শোনাত। আর তার আসনের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা সেই ঐতিহাসিক বর্শাটা দেখিয়ে উপসংহার টানত- “যখন আমি অবিশ্বাসী ছিলাম, এই বর্শা দিয়ে আমি হামজাকে হত্যা করেছি- যে ছিল মানুষের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট; আর যখন বিশ্বাসী হলাম, এটা দিয়েই আমি হত্যা করলাম মুসাইলিমাকে- যে ছিল মানুষের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট!” আর সে বর্শাটা হাতে তুলে নিয়ে কোলের উপর রাখত, তারপর সেটির গায়ে গভীর মমতায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনা হয়ে যেত।
একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি.......
জাফর বিন আমর বিন ওবায়দুল্লা ও আমর বিন উমাইয়া একসাথে ঘুরতে বের হয়েছিল। তারপর যখন তারা হিমে [সিরিয়ার এক শহর] পৌঁছিল, ওবায়দুল্লা আমরকে বলল, “ওয়াইশিকে দেখতে যাবা, যাতে করে আমরা তার কাছ থেকে হামজা হত্যার কাহিনীটা শুনতে পারি?”
সে বলল, “তা বেশ, চল।”
ওয়াইশি অধিকাংশ সময় হিমেই বসবাস করত। সুতরাং তারা তার সম্পর্কে খোঁজ নিল, এতে কেউ একজন তাদেরকে বলে, “He is that in the shade of his palace, as if he were a full water skin.” সুতরাং তারা এগিয়ে গেল এবং যখন কাছাকাছি পৌঁছিল, তারা তাকে দেখতে পেল। তারা হাত নেড়ে তাকে অভিবাদন জানাল এতে ওয়াইশিও তার প্রতিউত্তর দিল। ওবায়দুল্লা নিজেকে পাগড়ীর আড়ালে লুকিয়ে ছিল, যাতেকরে ওয়াইশি তার দু’চোখ ও পা ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পারে। এরপর সে বলল, ‘ও ওয়াইশি! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
ওয়াইশি তার দিকে তাকাল এবং তারপর বলল, “না, খোদা স্বাক্ষী! কিন্তু আমার এটা জানা আছে যে, আদি বিন আল খায়ের, আবু আল-আসের কন্যা উম্মে কিতালকে বিবাহ করেন এবং সে তার জন্যে মক্কাতে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। আর আমি ঐ শিশুর জন্যে একটা ধাত্রীর খোঁজ করেছিলাম। আমি মাতাসহ ঐ শিশুকে সঙ্গে নিয়ে ঐ ধাত্রীর কাছে যাই এবং তার হাতে ঐ শিশুকে সমর্পণ করি। আর তোমার পা ঠিক ঐ শিশুর পায়ের মত।”
তখন ওবায়দুল্লা তার মুখ অনাবৃত্ত করে বলল, “তুমি কি তোমার ঐ হামজা হত্যা কাহিনীটা আমাদেরকে একটু শোনাবে?”
ওয়াইশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর ক্ষণকাল নীরবতার পর সে বলল, “কেন শোনাব না।” সে কাহিনী বর্ণনা করে চলে।.....
এমনিভাবেই দিন গুজরান করে চলে ওয়াইশি। আর অপেক্ষায় থাকে ডাক আসার..............।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
উৎস:
কোরআন,
সহিহ বুখারী,
মোবারকপুরী, দি সিল্ড নেকটার, পৃষ্ঠা ২৬১।