ওয়াইশি ইবনে হার্ব লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ওয়াইশি ইবনে হার্ব লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২৬ মার্চ, ২০১৬

Wahshi ibn Harb: অবিস্মৃত এক ঘাতকের নাম।


য়াইশি ইবনে হার্ব (আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধের সন্তান) ছিল জুবায়ের ইবনে মুতিমের ইথিওপিও দাস। সে মূলত: নবীজীর চাচা, হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং ভন্ডনবী মুসাইলিমা ইবনে সুমামা বিন কবির বিন হাবিবের হত্যাকারী হিসেবে সুপরিচিত।

নবীজী যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন সমাজের অবহেলিত ও নির্য়াতিতরাই কেবল তা গ্রহণ করছিল। এভাবে ওমরের বাঁদী রানীন যখন তা গ্রহণ করল, তখন কুরাইশগণ বলতে লাগল, “ইসলাম যদি ভাল কোন ধর্ম হত, তবে রানীনের মত বাঁদী আমাদেরকে ফেলে এগিয়ে যেতে পারত না।"

যা হোক, ইসলামে মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। সুতরাং সকলের সাথে জুবায়েরের দাস ওয়াইশির কাছেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিল। এতে ওয়াইশি জানিয়েছিল: “ও মুহম্মদ! কি করে আপনি আমাকে ইসলামের দিকে আহবান করেন, যখন আপনি বলেন যে, হত্যাকারী, পৌত্তলিক ও ব্যাভিচারী শেষবিচারের দিনে দোযখী সাব্যস্ত হবে, তারা দোযখে যাবে এবং সেখানে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে? আমি সবগুলো পাপই করেছি। এতদসত্ত্বেও আমার পরিত্রাণের অন্যকোন উপায় আছে কি?”

উত্তরে নবীজী তাকে জানান: কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-(২৫:৭০)

এতে ওয়াইশি বলেছিল, “ও, মুহম্মদ! “যদি সে তওবা করে, বিশ্বাসী হয় ও সৎকর্ম করে...” এ শর্তগুলো আমার জন্যে খুবই কঠিন।”

নবীজী জানিয়েছিলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।” -(৪: ১১৬)

এরপর  ওয়াইশি বলেছিল, “ও, মুহম্মদ! এ তো সম্পূর্ণ আল্লার ইচ্ছেধীন। আমি নিশ্চিত নই আমি ক্ষমা পাব কি পাব না। অন্যকোন পথ আছে কি-না বলেন?”

তখন নবীজী উত্তরে বলেছিলেন: “বল, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” -(৩৯:৫৩)

এ সময় সাহাবীরা বলেছিল, “ওয়া্ইশি যা জানতে চেয়েছে আমাদের মনেও এ প্রশ্ন উদয় হয়েছিল।”
এতে নবীজী বলেন, “এ তো সকল মুসলমানের জন্যেই সুখবর।” -দি ইসলামিক বুলেটিন, খন্ড-২২, নম্বর ২৭, পৃষ্ঠা-২৯।

আর ওয়াইশি এ শুনে বলেছিল, “নিশ্চয় এ কল্যাণের।” কিন্তু সে ঐ সময় ইসলাম গ্রহণ করেনি। সম্ভবত: তার মনিবের ভয়ে, কেননা, কুরাইশগণ মনিবের অনুমতি ছাড়া কোন দাসের ইসলাম গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিল। আবার এমনও হতে পারে, সে ভীত হয়েছিল নব্য মুসলিমদের উপর কুরাইশদের নৈমিত্তিক অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে।

বদর যুদ্ধে অনেক কুরাইশ নেতা নিহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে ছিল তুয়াইমা ইবনে আদি আল-খায়ের এবং ওৎবা ইবনে আবি রাবিয়া। তারপর ওহুদ যুদ্ধের সময়, আবু সূফিয়ানের স্ত্রী, ওৎবার কন্যা হিন্দ ওয়াইশিকে এমন এক প্রস্তাব দিল যে, যদি সে মুহম্মদ ইবনে আবদ আল্লা, আলি ইবনে আবু তালিব বা হামজা ইবনে আবদ আল-মুত্তালিব- এই তিনজনের কাউকে হত্যা করতে পারে, যাতে সে বদর যুদ্ধে নিহত তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সমর্থ হয়, তবে তার ঐ কাজে সফলতার পুরস্কার স্বরূপ সে তার মুক্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে তার কাছে প্রতিজ্ঞাত হয়।

বদর যুদ্ধে হামজা, জুবায়ের ইবনে মুতিমের পিতৃব্য তাইমিয়া ইবনে আদি বিন আল খায়েরকে হত্যা করেছিলেন। সুতরাং কুরাইশগণ যখন মুসলমানদের উপর পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং তাদেরকে পরাভূত করতে আবারো যুদ্ধের জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করছিল, সেময় তার মুনিব জুবায়ের তাকে বললেন, ‘আমার চাচার হত্যার প্রতিশোধে যদি তুমি মুহম্মদের পিতৃব্য হামজাকে হত্যা করতে পার, তবে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে।’ সুতরাং দাসত্বের বন্ধন যা তার গলদেশে দীর্ঘকাল আগে ফাঁসের মত আঁটকে গিয়েছিল, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, এ ছিল ওয়াইশির জন্যে এক দ্বি-মুখী সুযোগ।

তারপর আইনাইন [আইনাইন ওহুদ পর্বতের নিকটবর্তী একটি পর্বত এবং এ দুটি পর্বতের মধ্যবর্তী উপত্যকা যেখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল] বৎসরে কুরাইশগণ যখন যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে পড়ল তখন ওয়াইশি যুদ্ধে অংশ নিতে তাদের সঙ্গে গেল।

ওহুদ যুদ্ধের দিনে [সিই ৬২৫] যখন কুরাইশ যোদ্ধারা যুদ্ধের জন্যে সাঁরিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল, তখন ওয়াইশি তার শিকার খুঁজে ফিরছিল। নবী মুহম্মদের দিকে অগ্রসর হওয়া তার জন্যে সম্ভব ছিল না, কারণ একদল সাহাবী সর্বদাই তাকে ঘিরে থাকত, পাহারায়। সে ভেবে দেখল আলী যুদ্ধের ময়দানে খুবই সতর্ক অন্যদিকে হামজা যুদ্ধে এাস সৃষ্টিকারী, সে অন্যদিকে নজর দেয় না, সুতরাং তাকে ফাঁদে ফেলে বা তার অসতর্কতার কোন সুযোগ নিয়ে তাকে ঘায়েল করা যেতে পারে।

সে যখন এসব ভাবছিল ঠিক তখন কুরাইশদের মধ্য থেকে শায়বা বেরিয়ে এল এবং হেঁকে বলল, ‘মুসলমানদের মধ্যে এমন কেউ কি আছ যে আমার সঙ্গে দ্বৈত লড়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে?’
আর হামজা তার হাঁক শুনে এগিয়ে এলেন এবং তাচ্ছিল্যের সূরে বললেন, “কে শায়বা নাকি! যার মা লেডিসদের ধরে ধরে খৎনা করে! তা তু কি আল্লা ও তাঁর রসূলকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিস? তবে আয়! ও ভগাংকুর কাটনেওয়ালীর পুত! সামনে আয়!”

শায়বা ইবনে আল-উজ্জা তার দিকে এগিয়ে গেলেন আর হামজাও তার তরবারী চালালেন। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল যে, দেখতে মনে হল হামজা মিস করেছেন, কিন্তু না, ঐ আঘাত তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিল।

ওয়াইশি হামজার উপর চোখ রেখে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়েছিল। তারপর তিনি যখন তার কাছাকাছি হলেন, তখন সে বেরিয়ে এল এবং নির্দিষ্ট এক দূরত্ব থেকে তার বর্শাটাকে ভারসাম্যে নিয়ে সেটিকে ছুঁড়ে দিল। অন্যান্য আফ্রিকানদের মত ওয়াইশিও ছিল বর্শা নিক্ষেপে দক্ষ, তা কখনও লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয় না।

ওয়াইশি তার বর্শার দিকে তাকাল, সেটি তখনও লক্ষ্যবস্তুর দিকে উড়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ হামজাকে আঘাত করল তার নাভিতে এবং বেরিয়ে গেল তার পায়ূদেশ দিয়ে। তিনি ওয়াইশিকে আক্রমণ করতে তার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন কিন্তু প্রচন্ড যন্ত্রণা তা তাকে করতে দিল না। তিনি ঐ অবস্থায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না তার আত্মা তার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে না গেল।অত:পর ওয়াইশি তার কাছে গিয়ে বর্শাটা টেনে বের করে নিয়ে ফিরে গেল সেখানে যেখানে কুরাইশরা ছাউনি ফেলেছিল আর তার মুক্তির অপেক্ষায় থাকল। কোথাও না গিয়ে সে সেখানেই রইল কেননা তার দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত হতে সে কেবল হামজাকেই বেঁছে নিয়েছিল হত্যার জন্যে, নিজেকে যুদ্ধের সঙ্গে জড়ায়নি।

যখন যুদ্ধের ময়দান কুরাইশদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল, তখন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, হিন্দ বিনতে ওৎবা হামজার লাশটি খুঁজে পায়। বদর যুদ্ধে হামজা তার পিতা ওৎবা ইবনে রাবিয়াকে হত্যা করেছিলেন। সে এইসময় পিতৃহত্যার প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল। ছুরি দিয়ে সে লাশের বুক চিরে ফেলল এবং কলিজা বের করে নিয়ে, তার বুকের উপর বসেই তা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।

কোন এক শিষ্যের মাধ্যমে নবীজী তার পিতৃব্যের মৃত্যুর কথা জানতে পারেন। কিন্তু তার উপর এমন কিছু ঘটতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। এই পিতৃব্যর প্রতি তার ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। তিনি জানতে চান, কেউ তাকে ঐ স্থানটি দেখিয়ে দিতে পারবে কি-না যেখানে তার পিতৃব্য নিহত হয়েছেন। তখন এক শিষ্য উঠে দাঁড়ালে, তিনি তার সঙ্গে সেখানে গেলেন।

লাশের অবস্থা দেখে নবীজী ব্যাথিত হন। বুক-পেট চিরে ফেলে ভিতরের সবকিছু টেনে বের করে ফেলা হয়েছে। যে শিষ্য তাকে সেখানে নিয়ে যায়, সে জানায় যে, মৃতদেহের অবস্থা অমনটা ছিল না যখন সে তাকে নিহত হতে দেখেছে, এসব ঘটেছে পরবর্তীতে।

যুদ্ধ শেষে কুরাইশগণ যখন মক্কাতে ফিরে গিয়েছিল, তখন ওয়াইশিও তাদের সাথে ছিল। তারপর সে সেখানে একজন মুক্তমানুষ হয়ে, উদ্দীপনার সাথে নতুনভাবে জীবন-যাপন শুরু করে। অত:পর মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হামজাকে হত্যার অপরাধে ওয়াইশিকে “যুদ্ধঅপরাধী” ঘোষণা করা হয়। এতে সে মক্কা থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ওয়াইশি এ বিষয়ে বলেছিল, “ওহুদ যুদ্ধের পর আমি মক্কাতেই বসবাস করতে থাকি যতক্ষণ না তা মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হয়। তারপর আমি পালিয়ে যাই তায়েফে।”

ওয়াইশি তায়েফে সাকিফদের সান্নিধ্যে বেশ কয়েক বৎসর বাস করে। তারপর নবম হিজরীতে, যখন তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের অভিপ্রায়ে নবীজীর কাছে এক প্রতিনিধিদল প্রেরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঐ ক্রান্তি লগ্নে সে বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিৎ। যদি তায়েফ ইসলাম গ্রহণ করে, তবে সে কোথায় যাবে? অবশেষে সে সিরিয়া, ইয়েমেন বা অন্য কোন দেশে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ঐ সময়টা ছিল তার জন্য উদ্বেগ ও সিদ্ধান্তহীনতার কাল। আর সে সময় কেউ একজন তাকে বলেছিল, “কসম আল্লা, তিনি এমন কাউকে হত্যা করেন না, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং তুমি আমাদের সঙ্গে চল।” সে এমনটা বলেছিল কারণ নবীজীর সংযম ও সহনশীলতার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় তা তায়েফবাসীর কাছেও পৌঁছেছিল, আর তার ক্ষমাশীলতা ও দয়ার কথা তো সর্বজন বিদিত ছিল।

ওয়াইশি আরও জানতে পারে নবীজী দূতদের কোন ক্ষতি করেন না; আর তাই সে মদিনাতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিনিধিদলের একজন হয়ে। তারপর যখন সাকিফ গোত্র নবীজীর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করল, ওয়াইশিও তাদের সাথে ছিল এবং ব্যক্তিগতভাবে নবীজীর কাছে গিয়ে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল।

ওয়াইশি তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে পরবর্তীতে বলেছিল, “অামি শুনেছি, যত বড় অপরাধই হোক না কেন, ক্ষমা চাইলে খোদা ক্ষমা করেন [কারণ তিনি অসীম ক্ষমাশীল]। আর তাই আমি নবীজীর কাছে গেলাম মুখে কলেমা শাহাদৎ নিয়ে।”

নবীজী তাকে দেখলেন। বহু বৎসরের অদর্শণে, এ সেই ওয়াইশি কি-না তা তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। "তুমি কি সেই ইথিওপিয় ওয়াইশি?" -নবীজী জিজ্ঞেস করেন।
এতে ওয়াইশি হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। তখন তিনি তাকে বসতে বলেন, তারপর তাকে জিজ্ঞেস করেন, “হামজা ইবনে অাবদ আল-মুত্তালিবকে কিভাবে তুমি হত্যা করেছিলে?”

ওয়াইশি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো কাহিনী স্মরণ করল। কিন্তু সে কেবল উত্তরে বলল, “তাই ঘটেছিল, যা আপনাকে জানানো হয়েছিল,” সে আরও বলেছিল, “ও রসূলুল্লাহ! আর যা আপনাকে জানানো হয়নি তা হল, আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি, কেবল তাকে হত্যা করি নিজের দাসত্ব মুক্তির জন্যে।”

পিন পতন নিস্তবতা। বিষাদের ছায়া নেমে এল নবীজীর সারামুখে, তিনি বললেন, “আমার পিতৃব্যের উপর তোমার হাত দিয়ে যে কহিনীর শুরু, তার সমাপ্তি হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে।” তিনি নিরব হয়ে বসে রইলেন কিছুসময়, তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললেন, “ও ওয়াইশি! পুনরুত্থিত হবার আগে তুমি আর আমার সামনে এস না।” -তিনি চলে গেলেন।

নবীজী ওয়াইশিকে ভবিষ্যতে তার সামনে আসতে নিষেধ করেছিলেন কেন?
বস্তুত: এ কেবল তার মঙ্গল কামনায়, কেননা তাকে দেখলে তার চাচার কথা স্মরণে আসবে, আর তাতে তার মন ব্যাথায় ভরে উঠবে, এতে তার অজান্তে যাতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ওয়াইশির উপর নেমে না আসে।

পরবর্তী দু’বছর ওয়াইশি, দর্শণার্থী এড়িয়ে একটু নিরিবিলি থাকতে, তায়েফের বিভিন্ন স্থানে বাস করল। সে বিবেকের দংশনে ভুগছিল এবং জীবন সংশয়ে ছিল। এ ছিল এক দূর্বিসহ জীবন। তবে সে তার নবদীক্ষিত ধর্মে বিশ্বস্ত রইল। এরপর সে সত্য প্রতিষ্ঠায় অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক পেল। তখন সে রিদ্দার যুদ্ধে অংশ নিল।

নবীজীর জীবনাবসান কালে মুসাইলিমা নবূয়্যত দাবী করে বসে। কিন্তু নবীজীর মধ্য দিয়ে নবূয়্যতের সমাপ্তির সুস্পষ্ট ঘোষণা ইতিপূর্বেই কোরআন জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং মুসাইলিমা মুসলমানদের নিকট সন্দেহাতীতভাবে একজন ভন্ড হিসেবে স্বীকৃত হয়। ইসলাম গ্রহণের পর মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা, আল্লা ও তাঁর রসূলের উপর মিথ্যারোপের কারণে খলিফা আবুবকর তাকে দমনের সিদ্ধান্ত নেন। অার যখন তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হল, তখন ওয়াইশিও তাতে অংশগ্রহণ করে মুসাইলিমাকে নিজ হাতে হত্যার অভিলাশ নিয়ে, যাতে করে তার উপর চেপে বসা গ্লানির ভার কিছুটা হলেও কমে।

রিদ্দার যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ। তার আগমণের খবরে মুসাইলিমা আকরাবাতে তার অনুগত বাহিনীকে বিন্যস্ত করে। মুসলিমদের ১ম ও ২য় আক্রমণের ধাক্কা সে প্রতিহত করে। কিন্তু প্রচুর হতাহতের পরও মুসলিমদের দৃঢ়তা দেখে সে তার সুরক্ষিত বাগিচা অঙ্গনে প্রবেশ করে।

তারপর মুসলিম সেনারা যখন ৩য় ধাপের আক্রমণের মধ্যদিয়ে ঐ সুরক্ষিত বাগানে প্রবেশ করে, তখন ওয়াইশি চারিদিকে মুসাইলিমাকে খুঁজে ফেরে। একসময় তার শিকারী বাজের দৃষ্টি তাকে খুঁজে পায় দূরে একজায়গায় তার অনুসারী বেষ্টিত অবস্থায়। দূরত্বটা তার জন্যে খুব একটা বেশী নয়। দ্রুত সে প্রস্তুত হয়ে পজিশন নেয় তারপর লক্ষ্যস্থির করে সে তার বর্শা ছুড়ে দেয়। এ সেই বর্শা যা দিয়ে ইতিপূর্বে সে হামজাকে বিদ্ধ করেছিল।

মুসাইলিমা তরবারী হাতে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়েছিল। উসকো খুশকো চুলে তাকে দেখাচ্ছিল ছাই রংয়ের এক উটের মত। ওয়াইশি যখন তার বর্শা ছুঁড়েছিল, ঐ সময় বিপরীত দিক থেকে আবু দোজনা নামের এক আনসারীও মুসাইলিমার কাছে পৌঁছুতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে তার কাছে যাবার আগেই ওয়াইশির ছুঁড়ে দেয়া বর্শা মুসাইলিমাকে অসহায়ভাবে গেঁথে ফেলল মাটির সাথে। আর ঠিক সেই মূহূর্তে দোজনার তরবারীও তাকে আঘাত হানে এবং তার শির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু দূর্ভাগ্য দোজনার, উল্লাস প্রকাশ করার আগেই পেছন থেকে হানা এক আঘাত তার শিরও ফেলে দিয়েছিল ভূমিতে। এক গৃহের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে মুসাইলিমার পরিণতি দেখে এক দাসী আফসোস নিয়ে বলেছিল: “হায়! বিশ্বাসীদের নেতা নিহত হলেন এক কাফ্রি দাসের হাতে।”

ওয়াইশি পরবর্তীতে খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অত:পর যখন সেটি বিজিত হয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়, তখন সে এমেসার হিমসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। আর সেখানে বসবাস কালে সে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে শরিয়তী আইনের শাস্তি তাকে পেতে হয়। খলিফা ওমর তাকে ৮০টি দোররা মারার নির্দেশ দেন। সে ছিল প্রথম মুসলিম যে সিরিয়ায় এ ধরণের অপরাধের জন্য শাস্তির আওতায় আসে। তবে শাস্তি পাবার পরেও ওয়াইশি মদ্যপান পরিত্যাগ করতে পারেনি। এতে ওমর হতাশ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “হয়ত: হামজার রক্তের কারণে আল্লার অভিশাপ ঐ বুনোটার উপর ভর করেছে।”

ওয়াইশির শেষ জীবনটা ঐ এমেসাতেই কাটে। তবে শেষের দিকে সে বেশ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। অনেকে তাকে এক নজর দেখার জন্যে তার বাড়ীতে ভীড় করত। তবে পাঁড় মাতাল হলেও সে আগতদের অনুরোধে তাদেরকে হামজা ও মুসাইলিমাকে হত্যার বিস্তারিত ঘটনা শোনাত। আর তার আসনের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা সেই ঐতিহাসিক বর্শাটা দেখিয়ে উপসংহার টানত- “যখন আমি অবিশ্বাসী ছিলাম, এই বর্শা দিয়ে আমি হামজাকে হত্যা করেছি- যে ছিল মানুষের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট; আর যখন বিশ্বাসী হলাম, এটা দিয়েই আমি হত্যা করলাম মুসাইলিমাকে- যে ছিল মানুষের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট!” আর সে বর্শাটা হাতে তুলে নিয়ে কোলের উপর রাখত, তারপর সেটির গায়ে গভীর মমতায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনা হয়ে যেত।

একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি.......

জাফর বিন আমর বিন ওবায়দুল্লা ও আমর বিন উমাইয়া একসাথে ঘুরতে বের হয়েছিল। তারপর যখন তারা হিমে [সিরিয়ার এক শহর] পৌঁছিল, ওবায়দুল্লা আমরকে বলল, “ওয়াইশিকে দেখতে যাবা, যাতে করে আমরা তার কাছ থেকে হামজা হত্যার কাহিনীটা শুনতে পারি?”
সে বলল, “তা বেশ, চল।”

ওয়াইশি অধিকাংশ সময় হিমেই বসবাস করত। সুতরাং তারা তার সম্পর্কে খোঁজ নিল, এতে কেউ একজন তাদেরকে বলে, “He is that in the shade of his palace, as if he were a full water skin.” সুতরাং তারা এগিয়ে গেল এবং যখন কাছাকাছি পৌঁছিল, তারা তাকে দেখতে পেল। তারা হাত নেড়ে তাকে অভিবাদন জানাল এতে ওয়াইশিও তার প্রতিউত্তর দিল। ওবায়দুল্লা নিজেকে পাগড়ীর আড়ালে লুকিয়ে ছিল, যাতেকরে ওয়াইশি তার দু’চোখ ও পা ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পারে। এরপর সে বলল, ‘ও ওয়াইশি! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

ওয়াইশি তার দিকে তাকাল এবং তারপর বলল, “না, খোদা স্বাক্ষী! কিন্তু আমার এটা জানা আছে যে, আদি বিন আল খায়ের, আবু আল-আসের কন্যা উম্মে কিতালকে বিবাহ করেন এবং সে তার জন্যে মক্কাতে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। আর আমি ঐ শিশুর জন্যে একটা ধাত্রীর খোঁজ করেছিলাম। আমি মাতাসহ ঐ শিশুকে সঙ্গে নিয়ে ঐ ধাত্রীর কাছে যাই এবং তার হাতে ঐ শিশুকে সমর্পণ করি। আর তোমার পা ঠিক ঐ শিশুর পায়ের মত।”

তখন ওবায়দুল্লা তার মুখ অনাবৃত্ত করে বলল, “তুমি কি তোমার ঐ হামজা হত্যা কাহিনীটা আমাদেরকে একটু শোনাবে?”
ওয়াইশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর ক্ষণকাল নীরবতার পর সে বলল, “কেন শোনাব না।” সে কাহিনী বর্ণনা করে চলে।.....
এমনিভাবেই দিন গুজরান করে চলে ওয়াইশি। আর অপেক্ষায় থাকে ডাক আসার..............।

সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।

উৎস:
কোরআন,
সহিহ বুখারী,
মোবারকপুরী, দি সিল্ড নেকটার, পৃষ্ঠা ২৬১।

২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

Musaylimah: এক ভন্ডনবীর উপাখ্যান।

মুসাইলিমার পুরো নাম মুহম্মদ হাসান মুসাইলিমা বিন সুমামা বিন কবির বিন হাবিব। তার জন্ম বনু হানিফা গোত্রে। এই গোত্র বনু বকরের (পরবর্তীতে রাবিয়া) একটি খৃষ্টান শাখা এবং নজদে বসবাসকারী আরব গোত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় গোত্র। এরা মূলত: উত্তর আরব থেকে গিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করে। ৫০৩ সিইতে তারা মধ্য আরবের কিন্দা সাম্রাজ্যে নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে অবির্ভূত হয়। বনু বকরেরা বাস করত অাল-ইয়ামামায় এবং তারা আল হিজরকে (বর্তমান আর-রিয়াদ) তাদের রাজধানী করেছিল।-[যোসেফ চিলোদ, পৃ.১৪]

৬২৮ সিইর জুনে, কুরাইশদের সাথে হুদা্ইবিয়ার সন্ধির কিছু পূর্বে, নবী মুহম্মদ ইয়ামামার শাসক ও বনু হানিফা গোত্রের প্রাক্তন প্রধান হাওদা বিন আলীকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়ে এক পত্র দিয়েছিলেন। তখন হাওদা তার ইসলাম গ্রহণের শর্ত হিসেবে নবীজীর কাছে তার নব্যূয়তের অংশীদারিত্ব অথবা উত্তরাধিকারীত্বের স্বীকৃতির প্রস্তাব রাখে, যা নবীজী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।৬৩০ সিইতে হাওদার মৃত্যুর পর মুসাইলিমা সাফল্যজনকভাবে নিজেকে তার জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত করে এবং ইয়ামামার পূর্বাঞ্চলের এক বৃহৎ এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে যা ছিল মূলত: আবাদি জমি এবং সেখানে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হত।


নবীজীর মৃত্যুর পূর্ববর্তী বৎসরে সে ইয়ামামায় আগত ও সেখানে বসতি স্থাপনকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রগুলো ও ইয়ামামাবাসীর মধ্যে অানুগত্যের ভিত্তিতে সামাজিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।পরে সে সেখানে একটি নিরাপদ এলাকা (হারাম) গড়ে তোলে, যার কিছু জায়গায় তার সাথে আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ কিছু পরিবারকে বসবাস করতে দেয়। সূত্রমতে, হারাম পরিচালনায় দূর্ণীতি ছিল এবং বনু উসায়েদ, যারা এটির পরিচালনা করত, তারা অন্যদের সাথে দূর্ব্যবহার করত।


যে বছর প্রচুর ফসল ফলত, যাযাবর বনু আসাদ ইয়ামামার গ্রামগুলোতে হানা দিত এবং লুটপাট করে এনে তা রাখত মুসাইলিমার প্রতিষ্ঠিত পবিত্র হারামের অভ্যান্তরে। সতর্ক করা সত্ত্বেও একের পর এক তা হতে থাকলে ইয়ামামাবাসী বনু আসাদকে হারাম এলাকা থেকে বের করে দেবার প্রস্তুতি নিল। কিন্তু মুসাইলিমা তাদেরকে নিবৃত্ত করে জিব্রা
ইলের দোহাই দিয়ে একথা বলে: “স্বর্গ থেকে আমার কাছে যিনি আগমন করেন তার জন্যে অপেক্ষা করা,” তারপর প্রকাশ করে: “শপথ রাতের অন্ধকারের এবং কাল নেকড়ের, আসাদগণ হারামের পবিত্রতা বিনষ্ট করেনি।”
তখন ইয়ামামীরা বলেছিল- “হারামের অর্থ কি তাহলে নিষিদ্ধকে অনুমোদিত আর আমাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা?”

পরবর্তীতে, বনু আসাদ আবারো ইয়ামামায় হানা দিয়ে শস্য় লুটে আনে এবং আবারো মুসাইলিমা তার অনুসারীদেরকে পবিত্র এলাকায় প্রবেশে বাঁধা দেয়, তার দোহা
ই দিয়ে, “যিনি তার কাছে আগমন করেন” এবং এই বাণী প্রকাশের মাধ্যমে- “শপথ অন্ধকার রাতের এবং নি:শব্দ পায়ে চলা সিংহের, আসাদ কোন কাঁচা বা পাঁকা ক্ষেতের ফসল কেটে আনেনি।”-[তাবারী,পৃ. ১৯৩২; তাবারী, ক্রনিক, পৃ. ২৯৪]


সাবার রানী বিলকিস
ইয়ামামার দক্ষিণে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক নগরী সাবা, যার রানী বিলকিস জেরুজালেমে নবী শলোমনের কাছে গিয়েছিলেন। এ নগরী নবী মূসার আমল থেকেই যাদু ও মায়া বিদ্যা চর্চার কেন্দ্রভূমি ছিল। সেখানে বসবাসকারীগণ ছিল ম্যাজিবাদী- অগ্নি উপাসক, যারা অালোক এবং অন্ধকারকে তাদের ধর্মনীতির অন্তর্ভূক্ত করেছিল। এতে কালক্রমে অন্ধকারের শক্তি তথা জ্বিণ তাদের ধর্মে উপাসনার অংশ হয়ে যায়। ফলে আরাধনাকারীরা আবির্ভূত হয় ভাববাদী তথা গণক ও সূতসায়ার রূপে। অজ্ঞ মানুষ তাদের নানান ইচ্ছে পূরণে এদের স্মরণাপন্ন হত। যেমন-

‘আর শলোমনের রাজত্বে শয়তানেরা যা আওড়াত তারা (সাবাবাসীরা) তা মেনে চলত। শলোমন কূফর করেনি, বরং শয়তানই কূফর করেছিল। তারা মানুষকে শিক্ষা দিত (সেই) জাদু যা বাবিল শহরের দুই ফেরেস্তা হারুত ও মারুতের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল।- [২:১০১]


অর্থাৎ সাবাতে জাদুকর ও সূতসায়ারদেরকে জাদু শিক্ষা দিত শয়তান জ্বিণেরা। আর তারা তাদেরকে ‍সেই জাদু শিক্ষা দিত, যা অবতীর্ণ হয়েছিল বাবিলে বসবাসকারী ফেরেস্তা হারুত ও মারুতের উপর। অর্থাৎ ঐ ফেরেস্তাদ্বয়ের কারণে সাবা নগরীতে যাদু, মায়া ও ডাকিনী বিদ্যার প্রচলন ও ব্যবহার বহূলরূপে বৃদ্ধি পায়।


আর সূতসায়ারদের ভাববানীও ছিল তেমনি এক বাণী যা তারা পেত জ্বিণদের কাছ থেকে। ঐসব বাণী রচিত হত বিশেষ ধাঁচে, বিশেষ ছন্দে, যার কিছু ফলত, কিছু কখনও ফলত না। আর বাণী না ফললে তারা প্রার্থীর রীতিপালনের ত্রুটির উপর দোষ চাপাত। তথাপি, সমাজে তাদের সম্মান ও কদরে কখনও কোন ঘাটতি ছিল না।


জনসংখ্যার চাপ, যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্মীয় বিরোধ, পশুপালন প্রভৃতি কারনে মানুষ এক স্থান থেকে অন্যত্র বসতি স্থাপন করত। এভাবে হিজাজে আগতরা যখন অভিবাসীরূপে সেখানে বসবাস গড়ে তোলে, তখন তারা সাবার ঐসব গণক, জাদুকর, ওঝা ও সূতসায়ারদের সংস্পর্শে আসে। অত:পর তারা তাদের সামাজিক অবস্থান ও প্রতিপত্তিতে আকৃষ্ট হয়ে ঐসব বিদ্যার চর্চা ও আরাধনা শুরু করে। হিজাজে এ ধারাই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বনি কুরাইশ গোত্রে নবী আবির্ভূত হলে তারা সেদিকে দৃষ্টি দিল। আর নবীর প্রতি অনুসারীদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা অবলোকন করে নিজেরাও নবী হয়ে গৌরাবান্বিত হতে চাইল। তাছাড়া এমনিতেই হিজাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী, তাদের গোত্রগত কৌলিণ্য ও সম্মানকে বিশেষ মর্যাদায় দেখত। আর সূচতুর ঐসব জাদুকর ও সূতসায়ারগণ একেই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগায় এবং নবী মুহম্মদের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়কালটাকে উপযুক্ত বিবেচনা করে তারা নব্যূয়ত প্রাপ্তির দাবী করে বসে। ফলে প্রায় প্রতিটি গোত্র থেকেই একের পর এক তথাকথিত নবীর আগমন ঘটতে থাকে।


৯বম হিজরীর শেষ দিকে নবীজী শাসনকর্তাগণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে চারিদিকে দূত প্রেরণ করেছিলেন। এমনিভাবে মুসাইলিমার কাছেও দূত পৌঁছেছিল। এতে বনু হানাফি গোত্রের একপ্রতিনিধি দলের সাথে সে মদিনায় আগমন করে এবং অবস্থান করে কাইস্যা কাননে, যা ছিল আল-হারিছের অবকাশকালীন গৃহ। এই আল-হারিছ ছিল মদিনার সম্ভান্ত ইহুদি গোত্র বনু নাজ্জারের বংশোদ্ভূত একজন আনসার। তার কন্যা কাইস্যা বিনতে আল-হারিছের সাথে মুসাইলিমার বিবাহ হয়েছিল। আর সে ছিল কাইস্যার ২য় স্বামী।


পরদিন সকালে প্রতিনিধিদল নবীজীর সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার করে ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করে,নবীজী তার রীতি অনুসারে তাদের প্রত্যেকে উপহার প্রদান করেন। ঐসময় তাদের একজন জানায় যে, তাদের এক সাথী ক্যাম্পে রয়ে গেছে তাদের বাহন উটগুলো দেখাশোনার কাজে। তখন নবীজী বলেছিলেন, “সে তার সঙ্গীদের মাল-সামানা দেখাশোনার কাজে পেছনে থেকে যাওয়া কর্তব্য জ্ঞান করেছে বলে তার মর্যাদা তোমাদের কারো থেকে কোন অংশে কম নয়।” তিনি তার জন্যেও উপহার দিলেন।


ক্যাম্পে ফিরে তারা মুসাইলিমাকে তার উপাহার দিয়ে বলে যে, সে তাদের সাথে থেকে ইসলাম গ্রহণ করতে না পারলেও তাদেরই একজন হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়েছে। এ কথা শুনে সে তখনই নিজেকে মুসলমান হিসেবে ঘোষণা দেয়। তারপর তারা ইয়ামামায় ফিরে গিয়ে নিজেদের গোত্রকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসে এবং সেখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করে প্রত্যাহিক নামাজ কায়েম করে।


মদিনাতে গিয়ে মুসাইলিমা নবীজীর প্রতি তার শিষ্যদের সমীহ এবং তার উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান লক্ষ্য করে নিজেও নবী হবার জন্যে অনুপ্রাণিত হয়। আল-জাহেয বলেন, নব্যূয়ত দাবী করার পূর্বে, জ্যেতিষশাস্ত্র, মায়াবিদ্যা ও জাদু শেখার জন্যে সে আরব ভূমি [ধর আল-আরব] ও পারস্যের [অাল-অাযিম] মধ্যবর্তী সকল বাণিজ্যিক শহরগুলো ভ্রমন করে এবং তারপর নিজ গোত্রে ফিরে এসে নব্যূয়ত দাবী করে বসে। 


ইবনে কাছিরও তার সিরাত গ্রন্থে মুসাইলিমার জাদু প্রদর্শনীতে পারদর্শীতার কথা উল্লেখ করেছেন। তার কথায়- মুসাইলিমা তার জাদু দিয়ে সমবেত জনতাকে বিষ্ময়াভূত করতে পারত। অার সে তার এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই মানুষকে নিজ বলয়ে ধরে রাখত। তাছাড়া তার পোষাক পরিচ্ছদও ছিল পূণ্যবাণ ব্যক্তি ও নবীগণের অনুরূপ। ফলে মানুষ সহজেই তার ক্ষমতাকে ঐশ্বরিক দান বলে বিশ্বাস করতে প্ররোচিত হত।


মুসাইলিমার বেশকিছু জাদুকার্য সিরা লেখকরা লিপিবদ্ধ করেছে, যেমন,- সে খুর সহজেই একটা আস্ত ডিম বোতলে ভরে ফেলতে পারত; একটা পাখির সব পালক ছাড়িয়ে ফেলে তা আবার লাগিয়ে দিতে পারত যাতে সে আবার উড়তে পারে,ইত্যাদি। ফলে তার জাদুকে অলৌকিক ভেবে কিছু অজ্ঞলোক তার চারপাশে জড় হয়। আর সে তার তাদেরকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে, দয়াময় খোদার কাছ থেকে, ফেরেস্তা জিব্রাইলের মাধ্যমে তার কাছে ওহী নাযিল হয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে নবী মুহম্মদের নব্যূয়ত অস্বীকার করেনি, বরং দাবী করে যে, তাকে তার সাথে নব্যূয়ত শেয়ার [ভাগাভাগি] করে, তার সহযোগী হিসেবে পাঠানো হয়েছে।


ইবনে কাছির বলেন, মুসাইলিমা তার কাছে আগত কথিত ওহীগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করত যেন তা ঐশীবাণী। আর লোকদেরকে বলত যে, মুহম্মদ তার সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছেন। এমনকি সে নিজেকে রহমান হিসেবে পরিচয় দিত অর্থাৎ ঐশ্বরিক কিছু গুণের সঙ্গে সে নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছিল। এতে তার গোত্রের অনেকে যারা ইতিপূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, নবী মুহম্মদের পাশাপাশি তাকেও তারা নবী হিসেবে স্বীকার করে নিল।


ধীরে ধীরে মুসাইলিমার প্রভাব এবং ক্ষমতা তার গোত্র মাঝে বৃদ্ধি পেল। লোকেরা তাকে “রহমান আল-ইয়ামামা” বলতে শুরু করল। আরো কিছুকাল পরে, পুরো গোত্র তার সাথে একাত্ম হল। তারপর সে তার গোত্রের একদল বীর যোদ্ধার সাথে মদিনায় এল এবং কাইস্যা কাননে অবস্থান করল।


আগত হানাফিগণ অত:পর নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে প্রস্তাব রাখেন মুসাইলিমাকে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেবার ও আরবের উপর তার সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবার। এমন অযৌক্তিক দাবীর কথা শুনে নবীজী তার হতে ধরা শুকনো একটা খেজুর শাখার প্রতি ইঙ্গিত করে এমন কি তার একটি আঁশ পর্য়ন্ত তাকে দিতে অস্বীকার করেন। 


পরদিন সকালে প্রতিনিধিগণ আবারো নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ করার প্রস্তুতি নিল। ঐ সময় মুসাইলিমা ও তার স্ত্রী তাদের উটের পরিচর্যা করছিল। সে তাদেরকে বলল, “তাকে বোলও, যদি সে আমাকে তারপরে নব্যূয়তের উত্তরাধিকারীত্বে সম্মত হয়, তবে আমি তাকে অনুসরণ করব।”


তারপর ঐ প্রতিনিধিদল যখন মসজিদ উন নব্বীতে পৌঁছিল, তখন নবীজী সাবেত বিন কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে এলেন। তার হাতে গতদিনের সেই মরা খেজুর ডালটাও ছিল। প্রতিনিধিরা তখন তার কাছে সংশোধিত প্রস্তাবটি রাখে। তখন নবীজী তাদেরকে বিগত রাতে দেখা একটা স্বপ্নের কথা বলেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, তিনি দু’টি স্বর্ণের ব্রেসলেট পরে অাছেন যা তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল। তখন তাকে বলা হল সেগুলোকে গুড়িয়ে দূর করে দিতে এবং তিনি যখন তা করলেন, তখন তা অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি ঐ ব্রেসলেট দু’টোর অর্থ করেন দু’জন মিথ্যেবাদী-মুসাইলিমা ও আসওয়াদের প্রতিরূপ হিসেবে। 


“সুতরাং,” তিনি বললেন, “সে ফিরে যাবার পর ধ্বংস হবে। আমি তোমাদেরকে কেবল তাই বলেছি যা আমাকে তার সম্পর্কে দেখান হয়েছে। এ ছাড়া এখানে সাবেত বিন কায়েস রয়েছে, সে তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে।” তিনি চলে গেলেন।


১১ হিজরীর মুহররম মাসে ইয়ামামা থেকে আগত দু’জন লোককে মদিনায় দেখা গেল, যারা নবীজীর জন্য একটি পত্র নিয়ে এসেছে মুসাইলিমার কাছ থেকে। নবীজীর সেক্রেটারীদের একজন পত্রটি খুলে নবীজীর সামনে তা পাঠ করলেন। তাতে লেখা ছিল-


“আল্লাহর রসূল মুসাইলিমা হতে আল্লাহর রসূল মুহম্মদের প্রতি-

আসসালামু আলায়কুম!
আমি আপনার অংশীদার; ক্ষমতা আমাদের মধ্যে অবশ্যই ভাগ করতে হবে। পৃথিবীর অর্ধেক আমার, বাকী অর্ধেক আপনার কুরাইশদের। কিন্তু কুরাইশরা লোভী জাতি-তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার নেই।’

নবীজী এই চিঠির বিষয়বস্তু জানতে পেরে দূতদ্বয়ের দিকে ফিরে মুসাইলিমার সম্পর্কে তাদের কি বক্তব্য তা জানতে চাইলে, তারা উত্তরে বলল যে, তাদেরও ঐ একই বক্তব্য যা মুসাইলিমার। তখন নবীজী বলেন, “যদি তোমরা দূত ও বার্তাবাহক না হতে তবে আমি তোমাদেরকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিতাম।” তিনি আরও বলেছিলেন, “যখন তোমরা ইসলাম গ্রহণ করেছ এবং আমার নব্যূয়ত সম্পর্কেও অবহিত, তখন কেন তোমরা এমন একজন মাথামোটাকে অনুসরণ করতে গেলে পবিত্র ধর্ম ইসলাম পরিত্যাগ করে?”


নবীজী মূলত: মুসাইলিমার নব্যূয়তে অংশীদারিত্ব অথবা তারপরে উত্তরাধিকারিত্বের দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিনি তার সেক্রেটারীকে ডেকে পত্রের একটি সযত্ন প্রতিউত্তরের নির্দেশনা দেন। 


“পরমদাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে-

আল্লাহর রসূল মুহম্মদ থেকে মিথ্যবাদী মুসাইলিমার প্রতি-
‘যারা সত্যপথের অনুসারী তাদের প্রতি সালাম। পৃথিবী আল্লাহর, তিনি যার প্রতি সদয় হন তাকেই দুনিয়ার কর্তৃত্ব দান করেন। কেবল পরহিজগারদের জন্যেই পরকাল (শুধু তারাই সুফল লাভ করবে, যারা আল্লাহকে ভয় করবে)।’

(মোহর):

রসূল আল্লাহ।” -(অাল-তাবারী)

এই চিঠিতে নবীজী মুসাইলিমাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে সম্বোধন করেছেন। আর তখন থেকে মুসলমানগণ তাকে মুসাইলিমা আল-কাজ্জাব বা মিথ্যবাদী মুসাইলিমা বলে সম্বোধন করে আসছে।


এদিকে পত্র নিয়ে নবীজীর দূতদ্বয় ইয়ামামায় পৌঁছিলে মুসাইলিমার লোকেরা তাদেরকে বন্দী করে তার সামনে হাজির করে। ‍অার সে প্রচলিত রীতির বিপরীতে তাদের সাথে কুকুরের মত ব্যবহার করে এবং তাদেরকে তরবারীর নীচে রাখে। তারপর সে তাদের কাছে- সেও মুহম্মদের মত একজন নবী, তার স্বীকারোক্তি দাবী করে। তখন তাদের একজন ঐ স্বীকারোক্তি দিয়ে দিল যখন তার গর্দানে চেপে থাকা তরবারী চামড়া ভেদ করে মাংসের গভীরে প্রবেশ করছিল। আর তাতে সে তার জীবন রক্ষা করতে পারে বটে, তবে অপরজন স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করে বসে। এতে মুসাইলিমা তার হাত ও পা প্রতিটি গিঁট থেকে কেটে একে একে বিছিন্ন করে। প্রতিবার অঙ্গ কাটার সে তার কাছে স্বীকারোক্তি দাবী করে, আর সেও তা অস্বীকার করে যায়, যতক্ষণ না তার মৃত্যু হয়। তবে দূত হত্যার অপরাধেও নবীজী মুসাইলিমার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি সম্ভবত: ঐ সপ্নের কারণে যা আমরা ইতিমধ্যে উপরে উল্লেখ করেছি।


মুসাইলিমার শিক্ষার প্রায় সবই হারিয়ে গেছে। ইবনে কাছির বলেন: সে ঐশীবাণী প্রাপ্তির দাবী করেছিল আলৌকক কাজ ও রোগ নিরাময় করার কাজে। সে নামাজ বিলুপ্ত করেছিল এবং অবাধ যৌণাচার ও মদ্যপানের অনুমোদন দিয়েছিল। অন্যদিকে তাবারী উল্লেখ করেছেন: খৎনা করা,পুত্র সন্তান জীবিত অবস্থায় কোন নারীর সঙ্গে সহবাস করা সে নিষিদ্ধ করেছিল। আর অনুমোদন দিয়েছিল যে কোন দিক ফিরে দিনে তিনবার নামাজ আদায়ের এবং রাতের বেলা উপোসে রমজানের রোজা করার। তবে শুকরের মাংস ও মদ সে নিষিদ্ধ করেছিল।


এ বেশ মজার ছিল যে, মুসা
ইলিমা আল্লার রসূলের মত সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিত যেমন দিতেন নবী মুহম্মদ। কোরাণিক বাণী প্রকাশের মত আয়াত রচনা করে তাদেরকে দিত। মুসাইলিমা কোরআনের আয়াত ও তার ধরণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে আর-রাজ্জাল বিন উনফুওয়ার মাধ্যমে। এই ব্যক্তি বনু হানিফার একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা এবং নবী মুহম্মদের নিকট আগত প্রতিনিধিদলেরও একজন সদস্য ছিলেন। -(বালাজুরি, পৃ. ১৩২) আর নবীজী তাকে হানাফিদের নিকট কোরাণিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।-(তাবারী, পৃ. ১৯৩২; বালাজুরি, পৃ. ১৩৩) যাহোক, তার অধিকাংশ আয়াত কুরাইশদের উপর হানাফিদের শেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে।

নবী মুহম্মদের মৃত্যু 
মুসাইলিমার অনুসারীদের মধ্যে আশা জাগিয়ে তোলে। ঐ সময় তার অনুসারীদের মাঝে দেয়া এক ভাষণে তিনি কুরাইশ ও মক্কার সাথে তার গোত্র ও তাদের ভূমির তুলনা করে বলেন:

'What made Quraish more deserving of prophethood than yourselves? They are not greater in number than you; your land is wider than their land. Gabriel descends from heaven like he used to descend to Muhammad.'

মুসাইলিমা দাবী করেন যে, মুহম্মদের নিকট যে বাণীর আগমন হত তা তার মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে গেছে, আর তা
ই তা কেবল তার কাছেই আগমন করবে। এখন কেবলমাত্র সেই একমাত্র নবী এমন অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে মুসাইলিমার নামে আরোপিত এই আয়াতে:

O you, woman, take the tambourine and play, and disseminate the virtues of this prophet! Passed away the prophet of Bani Hashim, and rose up the prophet of Bani Ya'rub. -(
ইবনে কাছির, আল-বিদায়া ওয়া আল-নিহায়া, খন্ড- ৬, পৃ. ৩৪১)

মুসাইলিমার সম্মান ও মর্যাদা এবং তার অনুসারীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেল। আর এতে ইয়ামামাবাসীরাও অনুপ্রাণিত হল, তারা মানষিকভাবে নিরাপত্তা ও শান্তি অনুভব করল। কিন্তু এই অনুভূতিতে আঘাত এল পূর্ববর্তী একজন সূতসায়ারের আগমনে, যে দাবী করল তাকেও নব্যূয়ত দান করা হয়েছে। তার নাম সাজাহ বিনতে আল-হারিছ। সে ছিল তামিম গোত্রের একজন খৃষ্টান, কিন্তু বাস করত বনু তাগলিবের খৃষ্টান আরবদের মধ্যে।


ইসলাম গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু একবার স্বইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে কেউ তা পরিবর্তণ করতে পারে না। কারণ, এ ধর্ম সত্যের। সুতরাং ইসলাম পরিত্যাগ অর্থ সত্যের উপর অপবাদ আরোপ এবং সত্যকে অস্বীকার করার শামিল, যা মানবতার বিরূদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য। কারণ তা একদিকে যেমন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর মিথ্যে আরোপ করে, তেমনি অন্যদিকে নব্য মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিবর্গের সম্মুখে খোদায়ী ধর্মের মর্যাদা ও মাহত্ম্যকে ভূ-লুন্ঠিত করে, এতে সত্য ধর্মের প্রতি আগ্রহী একদল মানুষ নিরুৎসাহিত হয়, যা তাদের পরকালীন জীবনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে।


মুসাইলিমা ও তার গোত্রীয় লোকেরা ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ অবগতির পর স্ব-ইচ্ছায় তারা মুসলমান হয়েছিল, অত:পর তারা তার মিথ্যে নব্যূয়তের দাবী (যেহেতু কোরআন নব্যূয়তের ধারা সমাপ্তি ঘোষণা করেছিল।) দ্বারা প্রতারিত হয়ে পরকালীন জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে গেল। প্রকৃত মুসলমান কাউকে সত্য গ্রহণ করার পর তাকে সত্যের খেলাপ ও সত্যের অপলাপ করতে দিতে পারে না। এদেরকে দমন ও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা অপরিহার্য্য ছিল।


খেলাফত লাভের পর আবু বকর যখন সাহাবাদের সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করলেন, তখন কেউই প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মতি দেয়নি। তখন আবু বকর তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘যারা মুসলমান হবার পর, রসূল প্রদত্ত নির্দেশ ও ইসলামকে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা আমার কর্তব্য। যদি আমার বিপক্ষে সব জ্বিণ, মানব ও বিশ্বের যাবতীয় বৃক্ষ-প্রস্তর একত্রিত করে আনা হয় এবং আমার সাথে কেউই না থাকে, তবুও আমি একাই ধর্মের জন্যে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’- এই বক্তব্যের পর সাহাবারা এগিয়ে আসে এবং তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে বিভিন্ন রণাঙ্গনে সেনাবাহিনী প্রেরণের জন্যে মানচিত্র তৈরী করে ফেলে।


ইবনে কাছির বলেন, মুসাইলিমা ও তুলাইহা নব্যূয়ত প্রাপ্তির দাবী করেছে জানতে পেরে সাজাহ বিনতে আল-হারিছ নাম্নী এক খৃষ্টান নারীও নব্যূয়ত প্রাপ্তির দাবী করে বসে। এ ছিল সেই সময়, যখন খলিফা আবু বকর ধর্মত্যাগীদের দমনে হিজাজের উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে প্রেরণ করেছেন। সাজাহ এই সংবাদ অবহিত হয়ে মদিনার বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ঐ উদ্দেশ্যে সে তার গোত্রের চার হাজার যোদ্ধাকে একত্রিত করে। তবে মদিনার বিরুদ্ধে অারো অনেকেই তার সাথে যাবার জন্যে ইচ্ছুক ছিল। কিন্তু সে তার ঐ পরিকল্পণা বাতিল করে, যখন জানতে পারে, খালিদ তুলাইহা আল-আসাদীকে পরাজিত করেছে। তখন সে খালিদের থ্রেট মোকাবেলায় মুসাইলিমার সহযোগিতা লাভে ইয়ামামার দিকে অগ্রসর হয়।


তাবারী বলেন, সাজাহর আগমনে মুসাইলিমা একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্যে তাকে আমন্ত্রণ জানায়। সে তাকে তার নব্যূয়তের অংশীদার হিসেবে চিনতে পারে এবং ঘোষণা দেয় যে খোদা কর্তৃক কুরাইশকদেরকে বন্দোবস্ত দেয়া ভূমি সাজাহ ও তার লোকদের জন্যে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং অপর অর্ধাংশ মুসাইলিমার। এছাড়াও সে সাজাহকে ঐ বছর ইয়ামামায় উৎপন্ন শস্য নেবার অনুমতি এবং পরের বছর উৎপাদিত ফসল দেবারও প্রতিশ্রুতি দেয়।


প্রাথমিকভাবে মুসাইলিমার সাথে একটা সমঝোতায় উপনীত হয় সাজাহ। তারপর এক আনন্দঘন মুহুর্তে সে তার সম্পর্কে জানতে চায় এবং তার নিকট অবতীর্ণ আয়াতের কিছুটা শোনাতে অনুরোধ করে। তখন সে নরম সূরে ও হৃদয়স্পর্শী কন্ঠে আবৃত্তি করে এ শ্লোক-


"God has been gracious to the pregnant woman; 

He has brought forth from her a living being
that can move from her very midst." -(Ibn Ishaq: P 636-37; Tabari: pp. 1737-38).

মুসাইলিমার এ আয়াত শোনার পর সাজাহ বলে, "All speech-act that had its origin in the unseen powers, all speech-act- that was not a daily mundane use of words, but had something to do with the unseen powers, such as cursing, blessing, divination, incantation, inspiration, and revelation, had to be couched in this form".


মুসাইলিমা তাকে বলে, খোদা তার কাছে প্রকাশ করেছেন যে, জীবনে একজন স্ত্রীলোকের স্থান কেবল শয্যায়। সে আবৃত্তি করে-


"God created women with a wide-open cleft,

And made men as partners for her;
Then we penetrate the clitoris,
And she bears children for us." -(Tabari, pp. 1917-1918).

সাজাহ মুসাইলিমাকে নবী হিসেবে স্বীকার করে, তখন সে বলে: “আমাকে বিবাহ করবে? তাহলে তোমার ও আমার লোকদের নিয়ে আমি সারা আরব জয় করে নেব।” 
পরে তারা দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।


অাল-ইয়ামামা
কয়েকদিনপর সাজাহ জাজিরাতে ফিরে যায় [কারো কারো মতে তিনদিন]। কেননা সে তার গোত্রের লোকদের ছেড়ে থাকতে ইচ্ছুক ছিল না।

মুসাইলিমার উত্থানশক্তি সম্পর্কে আবুবকর ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি মনোনীত করেন খালিদ বিন ওয়ালিদকে। তুলাইহাকে পরাজিত করার পর খালিদ খলিফার ঐ আদেশ পান। তখন তিনি তার বাহিনী নিয়ে ইয়ামাম্রার দিকে অগ্রসর হন। যাত্রাপথে তিনি খলিফার অপর এক পত্র মারফত বনু হানাফির যুদ্ধশক্তি, তাদের দক্ষতা ও দু:সাহসের বিষয়ে সম্যক অবহিত হন।

মুসাইলিমার চরেরা খালিদের অগ্রযাত্রার কথা তাকে অবহিত করে। বোথা থেকে ইয়ামামার যাত্রাপথ ওয়াদি হানিফার মধ্যদিয়ে এসেছে এবং জুবাইলার পিছনে এই ওয়াদির উত্তর তীর, আকরাবার বিস্তীর্ণ সমতলভূমি যা আকরাবা থেকে ইয়ামামা এবং আরো দক্ষিণ-পূর্বের বিস্তৃত উর্বর এলাকার বহি:স্থ সীমানা চিহ্নিত করেছে। মুসাইলিমার ইচ্ছে ছিল না তার লোকদের গ্রাম ও শহরগুলো মুসলিম বাহিনী তছনছ করে দিক। এ কারণে সে তার বাহিনী নিয়ে ইয়মামার ২৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে জুবাইলার দিকে অগ্রসর হল এবং জুবাইলার নিকটবর্তীতে, যেখান থেকে আকরাবার সমতলভূমির শুরু সেই স্থানে ছাউনি ফেলল। এই স্থানে ছা্‌উনি ফেলে সে কেবল তার উর্বর আবাদি ফসলী ক্ষেতই রক্ষা করল না বরং অগ্রগামী খালিদের যাত্রাপথও বিপদসংকূল করে দেয়, যাতে খালিদ বাধ্য হন ওয়াদির মধ্যদিয়ে আগমনে, আর তাতে তার বাম উইং থাকবে বনু হানাফির আক্রমণভাগে।

ইয়ামামা থেকে যথেষ্ট দূরে থাকতেই খালিদের চরেরা সংবাদ নিয়ে এল যে, মুসাইলিমা আকরাবার সমতলভূমিতে, ওয়াদি হানিফার উত্তর তীরে ছাউনি ফেলেছে, যার মধ্যদিয়ে ইয়ামামার দিকে যাত্রাপথটি চলে গেছে। খালিদ তখন তার বাহিনী নিয়ে উপত্যাকার মধ্যদিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে অগ্রসর হলেন না। আকরাবার কয়েক মাইল পশ্চিমে তিনি রাস্তা পরিত্যাগ করলেন এবং দক্ষিণ দিক থেকে ঘুরে ওয়াদির মাইল খানেক দক্ষিণে এবং জুবাইলার শহরের বিপরীতে, এক উচ্চভূমিতে উপস্থিত হলেন। ঐ উচ্চভুমি থেকে আকরাবার পুরো সমতলভূমি এবং সামনের সীমানা যা বনু হানিফার বসতি বিস্তৃত করেছে, তার সবকিছুই খালিদের দৃষ্টিতে চলে এল। খালিদ ঐ উচ্চভূমিতে ছাউনি ফেললেন।



ওয়াদি হানিফার উপত্যাকা সীমানা নির্ধারণ করেছিল সম্মুখ যুদ্ধের ক্ষেত্র। উত্তর দিকের তীরটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু হয়েছে, কোথাও ঢালু, কোথাও খাড়ির মত। দক্ষিণ দিকটি প্রায় ২০০ ফুট উচু থেকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমেছে। মুসলিম যোদ্ধারা ছাউনি ফেলেছে উপত্যাকার প্রায় মাইল খানেক দূরে। দক্ষিণ তীরে বূহ্য রচনা করে দাঁড়িয়েছে মুসাইলিমা তার বাহিনী নিয়ে, তাদের পিছনে রয়েছে আকরাবার বিস্তৃত সমতলভূমি। আর ঐ সমতলভুমিতে, ওয়াদি থেকে মাইল দুয়েক দূরে রয়েছে সুউচ্চ প্রচীর ঘেরা বাগান, যা আবাজ নামে পরিচিত মুসাইলিমার পবিত্র হারাম। আকরাবার যুদ্ধের পর এটা পরিচিত হয় মউত উদ্যান নামে।


বনু হানিফার অবস্থান

শীতকালে, ৬৩২ সনের ডিসেম্বরের ৩য় সপ্তাহ, ১১ হিজরী শাওয়ালের শুরুর দিকের এক প্রভাতে ইয়ামামার যুদ্ধ শুরু হয়। ফজরের নামাজ শেষে যুদ্ধের জন্য দু’দল মুখোমুখি হল। মুসাইলিমার যোদ্ধা ছিল ৪০ হাজার। সে তার বাহিনীকে বিন্যাস করল- মধ্যভাগ এবং বাম ও ডানে দু’টো উইং। বাম উইং এর কমান্ডে ছিল রাজ্জাল, ডান উইংএ মুহাকিম বিন তোফায়েল এবং মধ্যভাগ সে তার নিজের কমান্ডে রেখেছিল। অন্যদিকে খালিদের নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদ ছিল ১৩ হাজার। খালিদ তাদেরকে ওয়াদি হানিফার দক্ষিণ তীরে মুসাইলিমার অনুরূপ- একটা মধ্যভাগ ও দু’টো উইং-এ বিন্যাস্ত করেন। বাম উইং এর নেতৃত্বে ছিলেন আবু হুদাফা এবং ডান উইং এ জায়েদ, ওমরের জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা। আর মধ্যবর্তী অংশ ছিল সরাসরি খালিদের অধীন।



মুসাইলিমার সেনাবাহিনী তিনগুণ বেশী হলেও খালিদ যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে পুরো আশাবাদী ছিলেন, কারণ তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের, যারা ছিল “সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় জীবন দানকারীর স্বর্গপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত” -খোদায়ী এই প্রতিজ্ঞায় পূর্ণ বিশ্বাসী। তবে বনু হানিফাদের দক্ষতা ও দু:সাহস এ যুদ্ধকে রক্তক্ষয়ী ও কষ্টার্জিত করবে তাতেও তিনি সন্দিহান ছিলেন না। কারণ ইতিমধ্যে আবু বকর তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন পত্র মারফত। যাহোক, খালিদের নির্দেশ পেয়ে মুসলিম মুজাহিদগণ ওয়াদির উত্তর তীরের দিকে ছুটে গেল, যেখানে মুসাইলিমা তার যোদ্ধাদের নিয়ে বূহ্য রচনা করে অপেক্ষায় ছিল খালিদের আক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।



পাথুরে দেয়ালের মত করে মুসাইলিমার যোদ্ধারা দাঁড়িয়েছিল। তাদের অনেকে মুসলিমদের আক্রমনে নিহত হল বটে, তবে তাদের সম্মুখভাগ তারা ভেদ করতে দিল না। ধর্মত্যাগীরা যুদ্ধ করল উন্মত্ত হয়ে, এক ইঞ্চি ভূমি না ছাড়ার শপথে তারা মৃত্যূকে বেঁছে নিল। আর মুসলিমগণ বিষ্ময়ের সাথে অনুধাবন করল তারা একটুও অগ্রগতি লাভ করেনি। মুসলিমদের তার দুই উইং ভেদ করার কঠোর প্রচেষ্টার পর মুসালিমা বুঝতে পারল যদি সে এমন আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে আরও দীর্ঘসময় থাকে, তবে তাতে মুসলিমদের অগ্রগতি বাড়তে থাকবে। তখন সে তার একজন সেনাপতিকে তার সম্মুখ দলকে প্রতি আক্রমণের নির্দেশ দিল। তখন ধর্মত্যাগীরা সামনে বাড়ল বিশাল এক ঢেউয়ের মত করে, আর তখন মুসলিমগণ নিজেদেরকে এক বিভিষিকার মধ্যে দেখতে পেল, তারা অনুধাবণ করল, তারা পিছু হটে যাচ্ছে। 


মুসলিমগণ ক্রমান্বয়ে পিছু হটতে থাকল, তারপর তা আরও দ্রুতগতির হল, এতে ধর্মত্যাগীরা আক্রমণে আরও দু:সাহসী হয়ে উঠল। আর বিভ্রান্তির মধ্যে মসলিমগণ পশ্চাদুনুসরণ করতে থাকল। তাদের কিছু ক্ষুদ্রদল যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে শুরু করল এবং অন্যরাও তাদেরকে অনুসরণ করল। সেনাধাক্ষ্যগণ তাদের পলায়ন প্রতিহতে ব্যর্থ হয়ে দ্রুত পিছিয়ে এলেন তাদের সাথে। মুসলিম যোদ্ধাগণ এখন তাদের ছাউনি অতিক্রম করে বেশকিছু দূরে এসে থামল।

রিদ্দা-আকরাবার যুদ্ধ।
মুসলিম যোদ্ধারা আকরাবার সমতলভূমি পরিত্যাগ করতে শুরু করলে ধর্মত্যাগীরা তাদেরকে ধাওয়া করল উন্মত্তের মত। এ তাদের কোন পরিকল্পণার মধ্যে ছিল না, বরং তা ছিল সহজাত প্রতিক্রিয়া। তারা মুসলিমদের ক্যাম্পে থামল এবং তা তছনছ করে ফেলল। যদ্ধ জয়-পরাজয়ের মাঝে স্থির হয়েছিল এবং বিজয়ের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। বরং দৃশ্যত: মুসলিমদের পশ্চাৎপসারণ পরাজয়ের নামান্তর ছিল।

খালিদ এখন পরিস্কার বুঝতে পারলেন ধর্মত্যাগীরা তাদের ভন্ড নবীর উপর বিশ্বাস একটুও হারায়নি।সুতরাং হতাহতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার একমাত্র উপায় হল মুসাইলিমার মৃত্যু, যা তাদের মনোবলকে দমিয়ে দেবে। কিন্তু সে তার বিশ্বস্ত অনুসারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় নিরাপদে রয়েছে। তাকে হত্যা করতে হলে তাকে তার নিরাপদ অবস্থান থেকে বের করে আনা দরকার।

তখন খালিদ মুসাইলিমাকে আলোচনার প্রস্তাব দিলেন এবং তাতে সে রাজী হল। তারপর খালিদ যখন তার কাছাকাছি চলে এলেন, সে সতর্কতার সাথে সম্মুখে পা বাড়াল এবং খালিদের থেকে দ্বৈত লড়ার দূরত্বের ঠিক বাইরে গিয়ে থামল। তখন খালিদ তার কাছে জানতে চাইল- “যদি আমরা শর্তে আসতে চাই, কি শর্ত তুমি গ্রহণ করবে?”

মুসাইলিমা তার মাথা একদিকে হেলিয়ে দিল যেন সে তার পাশে দন্ডায়মান অদৃশ্য কারো কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছে। আর যেন এভাবেই কি সে প্রত্যাদেশ পেয়ে থাকে! আর তাকে এমনটা করতে দেখে খালিদের নবীজীর কথা মনে পড়ল, তিনি বলেছিলেন যে, মুসাইলিমা কখনও একা থাকে না, তারপাশে সবসময় শয়তান থাকে। সে শয়তানের অবাধ্য হয় না বরং শয়তান তার মুখ দিয়ে কথা বলে। এখন শয়তান মুসাইলিমাকে শর্তে আসতে নিষেধ করে দিল, ফলে সে খালিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল।

খালিদ ইতিমধ্যে মুসাইলিমাকে হত্যার পুরো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার সাথে কথা বলা কেবল তাকে তার নিরাপদ বেষ্টনী থেকে বের করে কাছে নিয়ে আসা। তাকে এখন ব্যস্ত রাখতে খালিদ তাকে আরও একটা প্রশ্ন করলেন, আর সে আগের মতই মাথা একপাশে হেলিয়ে দিল। আর ঠিক ঐ মূহুর্তে খালিদ তার দিকে লাফ দিলেন। খালিদ দ্রুতই করেছিলেন, কিন্তু মুসাইলিমা ছিল দ্রুততর। মূহূর্তে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং অদৃশ্য হল বেষ্টনীর মধ্যে। 

Musaylima was safe once again in the arms of his guards. But in that moment of flight something meaningful happened to the spirit of the two armies, depressing one and exalting the other. The flight of their 'prophet' and commander from Khalid was a disgraceful sight in the eyes of the apostates,To exploit the psychological opportunity which now presented itself, Khalid ordered an immediate renewal of the offensive. The spirits of the Muslims rose as they redoubled their efforts. Then the infidel front broke into pieces the commander of his right wing, Muhakim, who came to the rescue of the apostates."Banu Hanifa!" he shouted. "The garden! The garden! Enter the garden and I shall protect your rear."

মুসাইলিমার যোদ্ধাদের এক বড় অংশ ভেঙ্গে পড়ল এবং তারা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে চারিদিক দিয়ে পালিয়ে গেল। কেবল তার এক চতুর্থাংশ যোদ্ধা রয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে এবং তারা নিজেদেরকে নিরাপদ করতে দেয়াল ঘেরা বাগানের দিকে সরে যেতে লাগল। আর ঐ সময় ছোট একটা দল নিয়ে মুহাকিম পেছন থেকে তাদেরকে নিরাপত্তা দিচ্ছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার, খলিফা পুত্র আব্দুর রহমানের নিক্ষিপ্ত তীর তাকে মৃত্যুর দূয়ারে পৌঁছে দিল।

সাত হাজারের কিছু বেশী অনুসারীসহ মুসাইলিমা তার পবিত্র হারামের অভ্যান্তরে আশ্রয় নিল। আর তারা প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিয়ে সুউচ্চ প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে নিজেদেরকে বিপদমুক্ত ও নিরাপদ ভাবল।

পড়ন্ত বিকাল। মুসলিম যোদ্ধাদের বড় অংশ এখন দেয়াল ঘেরা ঐ বাগানের কাছাকাছি সমবেত। তারা উদ্বিগ্ন দিনের অবশিষ্ট সময়টুকুর মধ্যে সুরক্ষিত ঐ বাগানের অভ্যান্তরে প্রবেশ করে বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি টানা নিয়ে। কেননা বাগানের মধ্যে প্রবেশের কোন পথ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেয়াল অপ্রবেশ্য বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আর তার প্রবেশ দ্বার ভেতর থেকে বন্ধ। অবরোধ ভাঙ্গার কোন সরঞ্জাম নেই, আবার সময়ও নেই তা তৈরী করে নেবার।

While Khalid searched his brain for ideas, an old warrior by the name of Baraa bin Malik, who stood in the group that confronted the gate, said to his comrades "Throw me over the wall into the garden." His comrades refused, for Baraa was a distinguished and much-respected Companion, and they hesitated to do something which would certainly result in his death. But Baraa insisted. At last his comrades agreed to his request and lifted him on their shoulders near the gate. He got his hands onto the edge of the wall, swung himself up and jumped into the garden. In a minute or so he had killed two or three infidels who stood between him and the gate, and before others could intercept him, he had loosened the heavy bolt. The gate was flung open and a flood of Muslims roared through it like water thundering through a breach in a dam. The last and most gory place of the Battle of Yamama had begun.

In the clashes with the Banu Hanifa, a division of the army that came from those Medinans who had assisted Muhammad in his emigration from Mecca (the Ansar) attacked Yamama and fought bravely together with the Meccans who had fled with Muhammad (the Muh'jirin). They were summoned to help out in dangerous situations in the bloody battle of 'Aqrab'.

At the outset, the Banu Hanifa succeeded in repulsing the Bedouin attacks. The solution of Khalid was to put the Bedouin fighters of the army behind the lines of the well motivated and steadfast warriors of the Emigrants (Muhajirin) and Helpers (Ansar).

When Khalid's siege was tightened and the eventual defeat of this pretender became evident some of Musaylimah's simple-minded follower asked him: "What has happened to the occult help and support which you had promised us?"

Musaylimah replied: "There is no news about occult law and help. It was a false promise which I gave you. However, it is incumbent upon you to defend your honour and greatness".However, defense of honour and greatness was of little avail!

This above sayings of Musaylimah shows that he was an eloquent speaker and it also shows that he is not at all the speaker of those insipid sentences, which history has attributed to him, as specimens of his contention with the Holy Qur'an.

মুসাইলিমা নিহত হয় দূর থেকে উড়ে আসা জ্যাভলিনে, যা তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে মাটিতে তাকে গেঁথে ফেলেছিল। আর যখন সে প্রচন্ড যন্ত্রণায় দু’হাতে সেটি তুলে ফেলতে চেষ্টা করছিল, তখন আবু দো’জনা তার তরবারীর আঘাতে তার শির বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু সে মুসাইলিমার নিহত হবার খবর প্রচার করতে পারেনি। শির উঁচু করতেই তার গর্দান থেকে তা লাফিয়ে পড়ে মুসাইলিমার পাশে গিয়ে স্থান নেয়। কারো কারো মতে, ১১ হিজরী বা ৬৩২ সনে মুসাইলিমা যখন নিহত হন, ঐসময় তার বয়স ছিল ১৪০ বা ১৫০ বৎসর।

মুসাইলিমা নিহত হবার খবর ছড়িয়ে পড়লে যুদ্ধ আর প্রলম্বিত হয়নি। ঐসময় অনেকে হতাশা নিয়ে আত্মহত্যার মত সহিংসতায় লিপ্ত হয়। কিন্তু তারা কেবল তাদের যন্ত্রণা ও কষ্টই দীর্ঘায়িত করতে পারল, জীবন রক্ষা করতে পারল না। একসময় তাদের অধিকাংশ আক্রমণ বা আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা থামিয়ে দিল এবং হতাশা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কোন মুসলিম যোদ্ধার তরবারীর আঘাত যা তাদেরকে হতাশার ঐ কষ্ট থেকে নিস্কৃতি দেবে। আর ঐ সময় সূৃর্য্য অস্ত গেল, শান্ত ও নিস্তব্ধতা নেমে এল ঐ মউত উদ্যানে।

মুসাইলিমার অনুসারীদের প্রগাঢ় বিশ্বস্ততার নানান গল্প কালের প্রবাহেও টিকে আছে। এক মহিলা তার মৃত্যুর কথা শুনে আর্তচিৎকার দিয়ে বলেছিল, “হায়, বিশ্বাসীদের নেতা!” এক আহত বনু হানাফি যোদ্ধা পাশে থাকা এক মুসলিম যোদ্ধাকে অনুরোধ করে তাকে হত্যা করতে যাতে সে তার কষ্ট থেকে মুক্তি পায়। তারপর যখন সে মুসাইলিমার নিহতের খবর জানতে পারল, তখন সে মন্তব্য করল- “হায়! একজন নবীকে ধ্বংস করে দিল তার নিজের লোকেরা।” একথা শুনে ঐ মুসলিম যোদ্ধা তাকে এক “মরণ ঘা” দিয়ে পরপারে পাঠিয়ে দিল।

মুসাইলিমার অনুসারীর এক বহৎ অংশ নিহত হয় দেয়াল ঘেরা তার স্যাক্রেড হারামের অভ্যান্তরে ও তার বহি:স্থ প্রাঙ্গনে। স্থানটি পরবর্তিতে মউত উদ্যান “গার্ডেন অব ডেথ” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার অনেক নমুনা বিভিন্ন উৎসে দেখতে পাওয়া যায়। তবে মুসাইলিমার অনুসারীগণও যুদ্ধ করেছিল নির্ভিকচিত্তে। ফলে বিজয়ী হলেও মুসলমানদেরকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছিল। যুদ্ধে আবু দো’জনা (যিনি ওহুদ যুদ্ধে মানববর্ম হয়ে নবীজীকে তীরের আঘাত থেকে রক্ষা করেছিলেন), আবু হুদাইফা (বাম উইং কমান্ডার), ওমরের ভ্রাতা জায়েদ (ডান উইং কমান্ডার) এবং চার’শ কোরআনে হাফেজসহ প্রায় ১,২০০ মুসলিম নিহত হয়। অন্যদিকে মুসাইলিমাসহ তার অনুসারীরা নিহত হয় ২১ হাজারের মত, যার ৭ হাজার নিহত হয়েছিল ওয়াদির উন্মুক্ত ময়দানে খালিদের ১ম ও ২য় আক্রমণে, ৭ হাজার মুসাইলিমার স্যাক্রেড হারামের অভ্যান্তরে এবং অবশিষ্টরা ছিল তারাই যারা মুসাইলিমা নিহত হবার পরও তার নবূয়্যত অস্বীকার করতে সম্মত হয়নি।

মুসাইলিমা নিহত হবার পর খালিদ নজদের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী বনু হানিফাদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে মুসলিম যোদ্ধাদের ছোট ছোট দল প্রেরণ করেন তাদের বশ্যতা আদায়ে, ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসার আহ্ববান জানিয়ে। আর প্রেরিত ঐ যোদ্ধা দল তাদের কাছে গিয়ে তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চায়। মূলত: তারা গোত্রের প্রতিটি সদস্যকে প্রশ্ন করেছিল- সে কার উপর বিশ্বাস করে? মুহম্মদের না মুসাইলিমার?

মুসাইলিমা নিহত এবং বনু হানাফিও তাদের গণ্যমান্য সকল নেতৃবর্গকে যুদ্ধে হারিয়েছিল, তথাপি তারা ছিল দূর্বিনীত কোন ব্যাতিক্রম ছাড়াই। তাদের কেউ অনুশোচনা করেনি, করতে রাজীও হয়নি।[কেবল কয়েকজন এমন অভিমত দিয়েছিল- “তোমাদের মধ্যেও একজন নবী থাকুক এবং আমাদের মধ্যেও একজনকে থাকতে দাও!”] ফলে তরবারীর নীচে দ্বি-খন্ডিত হল অবশিষ্ট প্রায় সাত হাজার হানাফি। তাদের কারো প্রতি কোন রকম দয়া প্রদর্শণ করা হয়নি। কেননা, অনুশোচনায় অস্বীকারকারী প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন খলিফা আবু বকর। -(বার্থহোল্ড, ৫০২-৫১১)

মুসাইলিমার নব্যূয়তে বিশ্বাস, তার বেঁচে থাকা শিষ্যদের মধ্যে ইসলামের প্রথম দশক পর্যন্ত টিকে ছিল। তারপর মুয়াবিয়া সাজাহকে জোরপূর্বক আরবভূমি থেকে উৎখাত করলে সে বসরার কূফাতে চলে গেল, ঐসময় মুসাইলিমার বেশকিছু অনুসারীও তাকে অনুসরণ করে এবং তাকে ঘিরে সেখানে বসতি করে। পরে তারা সেখানে একটা মসজিদও নির্মাণ করে নেয়। কূফায় বসবাস গড়ে তোলা মুসাইলিমার সকল অনুসারীরা বনু হানাফির ঐ মসজিদে সমবেত হত এবং প্রায়শ: ঐ মসজিদের মিনার থেকে- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া মুসাইলিমা রসূলুল্লাহ”- ধ্বনি শোনা যেত।

ইবনে মা’সুদ কূফার আমির থাকাকালে জানতে পারলেন যে, নবীজীর নিকট মুসাইলিমার পত্র নিয়ে দূত হিসেবে গমনকারী দু’জনের একজনকে কূফা নগরীতে পুন:রায় দেখা গেছে যে কি-না তখনও মুসাইলিমার নব্যূয়তের উপর বিশ্বাস রাখে। তখন আমির তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। তারপর যখন তাকে তার সম্মুখে হাজির করা হল, তিনি তাকে শিরোচ্ছেদ করেন একথা বলে যে, মুসাইলিমার দূতের পরিচয় এখন আর তার নেই। তারপর তিনি মুসাইলিমার সকল অনুসারীকে হাজতে ভরার নির্দেশ দেন। কিছু পালিয়ে যায়, অার কিছু ধরা পড়ে জেলে যায়। পরবর্তীতে, যারা অনুশোচনা করে, তারা জেল থেকে মুক্তি পায়, আর যারা তাদের বিশ্বাস আঁকড়ে থাকে, তাদেরকে শিরোচ্ছেদ করা হয়। ঐ সময় সাজাহ ইসলাম গ্রহণ করে এবং আমৃত্যু তাতে বিশ্বাসী ছিল। 

সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।

# একজন জিজ্ঞেস করেছিল, “মুসাইলিমাকে “আল-কাজ্জাব” উপাধি দেয়া হয় কোন যুক্তিতে? আর সেই যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

@ আমি বললাম- নবী ইব্রাহিম ইসমাইলের বংশে কেবল একজন নবীর জন্যে প্রার্থনা করেন। সুতরাং মুহম্মদের আগমনের পর অন্তত: ইসমাইলের বংশে আর কোন নবী আগমনের সম্ভাবণা ছিল না। অন্যদিকে কোরআনে নবী মুহম্মদকে “নবীগণের মোহর” হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে সারা জাহানে ভবিষ্যতে আর কোন নবী আগমণের সম্ভাবণা ছিল না।

“আর যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল (কা’বা) গৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল, তখন তারা বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের এ কাজ গ্রহণ কর। তুমি তো সব শোন আর সব জান। 
--হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের দু‘জনকে তোমার একান্ত অনুগত কর ও আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত এক উম্মত (সমাজ) তৈরী কর। আমাদেরকে উপাসনার নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দাও, আর আমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হও! তুমি তো অত্যন্ত ক্ষমাপরবশ পরম দয়ালু। 

--হে আমার প্রতিপালক! তাদের মধ্যে থেকে তাদের কাছে ”একজন” রসূল প্রেরণ কোরও যে তোমার আয়াত তাদের কাছে আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, তত্ত্বজ্ঞানী।-(২:১২৭-২৯)

“মুহম্মদ তোমাদের কারো পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং “নবীগণের মোহর”। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ের জ্ঞান রাখেন।”-(৩৩-৪০)

সুতরাং নবীজী এবং মুসলমানগণ মুসাইলিমাকে কোনরকম সন্দেহ ছাড়া আল-কাজ্জাব তথা মিথ্যেবাদী উপাধি দিতে সক্ষম হন। 
আবার, মুসাইলিমার অনুসারীরা কিন্তু কোরআনে বিশ্বাস করে, সুতরাং তারা কিভাবে এটি [ইব্রাহিম একজন নবীর জন্যে প্রার্থনা এবং কোরআনের নবীগণের মোহর বিষয়টি] ব্যাখ্যা করবে?
আর যারা কোরআনে বিশ্বাস করে না বা ইব্রাহিম প্রার্থনা সম্পর্কেও নিশ্চিত নয়, তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে তারা নিজ চোখে ইব্রাহিমকে প্রার্থনা করতে এবং তিনি কি প্রার্থনা করেছিলেন তা নিজ কানে শুনতে পাবেন- কেয়ামতের ময়দানে।

তদুপরি আমরা এখন  মুসাইলিমার ভন্ডত্বের অন্যান্য উৎসগুলির দিকেও নজর দেব।

তথ্য-১:
নবী হিসেবে মুসাইলিমা নাম যখন পুরো ইয়ামামায় ছড়িয়ে গেল, তখন একপ্রান্ত থেকে তার গোত্রের এক লোক তাকে পরীক্ষা করতে এল। লোকটি বলল, "আমরা জানতে পারলাম তুমি নাকি মুহম্মদের মত নব্যূয়ত দাবী করছ?"
সে বলল, "আমি তাতে তার সঙ্গে একজন অংশীদার।" তারপর তিনি তার অধীনস্তের দিকে ফিরে, যে তার সাথে মদিনায় গমনকারী প্রতিনিধিদলের একজন ছিল, বললেন, “ওই! কস না ক্যান, তিনি কি তোরে বলেননি যখন তুই তাঁর কাছে আমার কথা উল্লেখ করলি- তার স্থান তোমার থেকে কোন অংশে কম নয়? -এর অর্থ এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, তিনি জানেন যে, আমি তাতে তাঁর সাথে একজন পার্টনার?"

লোকটি জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে কি কোন ফেরেস্তা আসে?"
সে বলল, “হ্যাঁ আসে, তার নাম রহমান".
এতে ঐ লোক জিজ্ঞেস করল, “ঐ ফেরেস্তা কি আলোর না আঁধারের?"
মুসাইলিমা উত্তর দিল, "আঁধারের।"

তখন ঐ লোক বলল, "আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি একজন মিথ্যেবাদী। কিন্তু আমার কাছে ইয়ামামার রাবিয়া গোত্রের একজন মিথ্যেবাদী, কুরাইশ গোত্রের একজন সত্যবাদীর চেয়ে অনেক বেশী প্রিয়।"

তথ্য-২:
মুসাইলিমা নবী নন বরং একজন সূতসায়ার ও জাদুকর ছিল। আর এ কারণে তার দোয়া ফলত না বরং তা আরো বিপর্যয় ডেকে আনত। যেমন-

বনু হানিফার এক নারী মুসাইলিমার কাছে এসে বলল: “আমাদের খেজুর বাগানগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, কূয়োতেও পানি নেই, সুতরাং আমাদের পানের পানি, ফসল ও বাগিচার জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করেন যেমন মুহম্মদ করেছিলেন হাজমান গোত্রের জন্যে।”

মুসাইলিমা ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দেশের কল্যাণের জন্যে খোদার কাছে কিভাবে দোয়া করতে হয় তা জানত না, তাই সে তার সাগরেদকে জিজ্ঞেস করল, “ও নাহার, সে কি বলল?”
তখন সে বলল, “হাজমানের লোকেরা মুহম্মদের কাছে গিয়ে পানির অভাবের কথা বলে এবং তাদের শুকিয়ে যাওয়া কূয়ো ও খেজুর বাগানের..... ।”  সুতরাং সে তাদের জন্য দোয়া করে।- (তাবারী, পৃষ্ঠা ১৯৩৪) 

অত:পর তার দোয়ার ফলাফল বিপর্যয় ডেকে আনে: কূয়োগুলো আরো শুস্ক হয়, আর তার হাতের ছোঁয়ায় খেজুর গাছগুলোও মরে যেতে লাগে এবং মাঠের ফসলাদিও শুকিয়ে যায়।

তথ্য-৩:
অনেকে মনে করেন মুসালিমা নবী ছিলেন, আর তাই তার নব্যুয়তে বিশ্বাসী তার ২১ হাজার অনুসারীরা তার জন্য জীবন দিতে পিছপা হয়নি? বিষয়টি ঠিক মোটেও এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে, নবী সম্পর্কে বনু হানাফিদের অধিকাংশের কোন ধারণা ছিল না, ছিল না ঐশী কিতাব সম্পর্কে, কিন্তু তারা সম্যক পরিচিত ছিল গণক ও সূতসায়াদের সাথে, কিভাবে পরিচিত ছিল তা আর্টিকেলের শুরুতে আমরা আলোচনা করেছি। আর তাই তারা জীবন দিল তাদের প্রাচীন বিশ্বাসে-

Their [Kahins] mantic knowledge is based on ecstatic inspiration . . . [which] is of satan origin: a Djinnï. The kahins often express themselves in very obscure and ambiguous language. They give. greater emphasis to their utterance by striking oaths, swearing by the earth and sky, sun, moon and stars, light and darkness,evening and morning, plants and animaIs of all kinds....

Kahins play an extremely important part in public as well as private life. They are interrogated on aIl important tribal and state occasions . . In private life, the kahins especially act as judges in disputes and points of law of aIl kinds. ...Their decision is considered of divine judgement against which there is no appeal. -[SEI, p. 207; G. Ryckmans, pp. 11-12; Blachère, Histoire, pp. 188-195]. 

অন্যান্য প্রমাণ দেয়া যায় মুসাইলিমার আয়াতগুলো বিশ্লেষণে, কিন্তু তার আর প্রযোজন আছে কি? 
সবশেষে যারা কোরআন বিশ্বাস করেন না তাদেরকে বলছি, যদি মুসাইলিমা নবী হয়, তবে নিশ্চয়ই একজন বাধ্যতামূলক শেষনবী থাকতে হবে সমগ্র জগৎবাসীর জন্যে, [যেহেতু মুসাইলিমা নিজেকে শেষনবী হিসেবে ঘোষণা দেয়নি]। আর অবধারিতভাবে পূর্ববর্তী সকল কিতাবে সেই নবীর পরিচয় থাকতে হবে। কিন্তু মুহম্মদ ছাড়া অন্য কারো নাম কি পূর্ববর্তী সকল কিতাবে আছে? 
নেই।
সুতরাং মুহম্মদই শেষ নবী এবং অবধারিতভাবে মুসাইলিমা পরবর্তী সকলেই ভন্ড ঈসা ব্যতিত-যার এখনও মরণ হয়নি। আর এর প্রমাণ আগামীর মানুষ পাবে।

# আরেকজন জিজ্ঞেস করেছিল, “ভাই, রিদ্দা যুদ্ধের যৌক্তিকতা কি, বা আপনি কিভাবে এ যুদ্ধকে মূল্যায়ণ করেন?”

@ আমি বললাম- ইসলামে কারো ধর্ম পালনে বাঁধা দেয়া যেমন নিষিদ্ধ তেমনি ইসলাম গ্রহণে জোরজবরদস্তিও নিষিদ্ধ। ইসলাম গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তির সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। কেননা, মানুষ স্বাধীন ভাবে সৃষ্ট, তাদেরকে দেয়া হয়েছে ভাল-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান, দেয়া হয়েছে বিবেক। সুতরাং মানুষ তার জ্ঞান ও বিবেক ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এ তো খোদা প্রদত্ত অধিকার। যা খোদা দিযেছেন তা ছিনিয়ে নেবার অধিকার কারো নেই। তবে মানুষকে আল্লাহ ও  তাঁর রসূলের উপর মিথ্যে অপবাদ আরোপের অধিকার মানুষকে দেয়া হয়নি। সুতরাং যারা এ অপরাধ সংঘটিত করবে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশ রয়েছে।

কিন্তু, ইসলাম খোদায়ী ধর্ম- “সত্য ধর্ম” [পৃধিবীর প্রথম মানব আদম এ ধর্মের ভিত রচনা করেন, অত:পর এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর এ ধর্ম প্রচার করেন, যাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, দাউদ, ঈসা। আর নবী মুহম্মদের মাধ্যমে এ ধর্মের পূর্ণতা পায়] সুতরাং কেউ ইসলাম তথা সত্য গ্রহণ করে অত:পর তা বর্জন করতে পারে না। সত্য অস্বীকার বা খেলাপকারী, সত্যের অপব্যাখ্যা বা অপলাপকারী এবং সত্যের অপবাদকারী মানুষের এবং খোদার শত্রু। ইসলামে একাজ চরম ঘৃণ্য বিবেচিত, কারণ তা মানবতা বিরোধী, আর তা এ কারণে যে, তা সত্যের আলো বঞ্চিত এবং শিক্ষা ও জ্ঞানে পিছিয়ে থাকা একদল মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে, যা তাদেরকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীণ করবে পরকালে। আর মুসলমান হবার পর কারো দ্বারা মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন, ইসলামে মানুষ হত্যার চেয়ে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। এদেরকে দমনে যুদ্ধের নির্দেশ রয়েছে, যেমন-

আর যদি ভঙ্গ করে তারা তাদের শপথ প্রতিশ্রুতির পর এবং বিদ্রুপ করে তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে, তবে কুফর প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ, এদের কেন শপথ নেই যাতে তারা ফিরে আসে। -[৯:১২]

আব্দুল্লাহ বর্ণিত: রসুলুল্লাহ বলেন, “একজন মুসলিমের রক্তপাত নিষিদ্ধ যে স্বীকার করে যে, আল্লাহ ব্যতিত অন্যকোন উপাস্য নেই এবং আমি তাঁর রসূল, তিনটি ক্ষেত্র ব্যতিত: হত্যার প্রতিশোধে, বিবাহিত কেউ যে ব্যভিচার করেছে এবং ইসলাম অস্বীকার করে মুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করেছে।”-[বুখারী,, খন্ড ৯, কিতাব ৮৩, নম্বর ১৭]

আর এটাই মূলত: আবু বকরকে যুদ্ধে ঠেলে দেয়। তবে খলিফা নব্যূয়তের ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সাজাহর বিরুদ্ধে সেনা অভিযান করেননি, কারণ সে মুসলিম নয়- ছিল খৃষ্টান।

উৎস:
এম জে, কিস্টার, মুসাইলিমা,
দালে এফ আইকেলমান, মুসাইলিমা,
ভি, বার্থহোল্ড, মুসাইলিমা,
এম, ওয়াট, মুসাইলিমা,
ভাক্কা, সাজদাহ,
সহিহ অাল বুখারী,
ইবনে কাছির, সিরাত রসূল আল্লাহ,
ইবনে ইসহাক, সিরাত রসূল আল্লাহ,
ইবনে কাছির, অাল-মিসবাহ আল-মুনির তাহজিব ওয়া তাহকিক তফসির,
ইবনে আবদ আল-বার আল-নামারী, আল-দুরার ফি ইখতিয়ূর আল মাঘজি ওয়াল সিয়ার,
আল-কালাই, অাল-ইকতিফা ফি মাঘাজি রসূল আল্লাহ ওয়াল সালাছা আল-খুলাফা,
আদ-দিয়ারবকরী, তারিখ আল-খামিস ফি আওয়াল আনফুস আন-নাফিস,
আল-নুয়াইরি, নিহোয়াত আল-আরব ফি ফুনিন আল-অাদাব,
ইয়াকুত বিন আব্দুল্লাহ অাল-হামায়ি, মুজাম অাল-বুলদান,
আল-তাবারী, তারিখ অাল-রসূল ওয়া অাল-মুলুক,
ইবনে সা’দ, কিতাব আল-তাবাকাত অাল কুবরা,
অাল-বায়হাকী, অাল-মাহাসিন ওয়াল মাসায়ি,
অাল-বায়হাকী, দালাইল অাল-নবু’ওয়া,
আল-বালাজুরি, কিতাব ফুতুহ অাল-বুলদান,
আল-কালবি, জামোরাত আল-নাসাব,
আল-মাকিরিজি, ইমতা আল-আসমা,
আল-সুহাইলি, রাউদ আল-উনুফ,
অাল-ওয়াকিদি, কিতাব আল-রিদ্দা,
ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া,
আল-ইসলাম ডট ওআরজি
উইকিপিডিয়া,
কোরআন।

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...