মুহম্মদ আছরের পর নিয়মিত সকল বিবিদের কাছে কুশল জিজ্ঞাসার জন্যে গমন করতেন। নিয়মিত এই সাক্ষাতে তিনি নববিবাহিত বিবি জয়নবের গৃহে একটু বেশীসময় অতিবাহিত করতে লাগলেন। বাল্যকাল থেকেই জয়নব মুহম্মদকে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন এবং জানতেন তিনি মধু খেতে বিশেষ পছন্দ করেন। তাই তিনি বিবাহের পূর্বপর্যন্ত সবসময়ই তার জন্যে মধু সরবরাহ করে এসেছেন। এখন বিবাহের পর যখনই মুহম্মদ তার হুজরাতে (মুহম্মদের প্রত্যেক বিবির জন্যে একটি করে হুজরা নির্মিত হয়েছিল। কক্ষ ছাড়াও এতে কিছু বারান্দা ও ছাদ থাকত। মসজিদে নব্বীর সংলগ্ন এসব হুজরা খর্জুর শাখা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এর দ্বারে একটা মোটা কাল পশমী পর্দা ঝুলান থাকত। হুজরার দরজা থেকে ছাদ বিশিষ্ট কক্ষ পর্যন্ত ছয়-সাত হাতের ব্যবধান ছিল। কক্ষ দশ হাত এবং ছাদের উচ্চতা সাত- আট হাত ছিল। মুহম্মদের তিরোধানের পর ওলীদ ইবনে আব্দুল মালেকের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে এসব হুজরা মসজিদে নব্বীর অন্তর্ভূক্ত করে দেয়া হয়েছিল।) আগমন করতেন, তখন তিনি নিজ হাতে তাকে মধু পান করাতেন। এ কারণেই একটু বেশী সময় মুহম্মদ তার হুজরাতে অবস্থান করতেন। এ দেখে বিবি আয়েশার- যিনি ছিলেন তার বিবিদের মধ্যে একমাত্র কুমারী, মনে ঈর্ষা মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠল। তিনি অপর এক বিবি হাফসার সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করে স্থির করলেন যে, তিনি জয়নবের হুজরা হতে ফিরে তাদের দু‘জনের মধ্যে যার কাছে আগে আসবেন, তিনিই তাকে বলবেন, ‘মাগফীরের গন্ধ পাচ্ছি! আপনি কি মাগফীর পান করেছেন?’ -মাগফীর এক বিশেষ দুর্গন্ধযুক্ত আঠা।
জয়নবের হুজরা হতে বেরিয়ে মুহম্মদ আয়েশার হুজরাতে এলেন, তখন তাকে তিনি সেভাবেই কথা বললেন। মুহম্মদ বললেন, ‘না, আমি তো মধু পান করেছি!’
আয়েশা (Aisha) বললেন, ‘সম্ভবতঃ মৌমাছি কোন মাগফীর বৃক্ষে বসে তার রস চুষেছিল। এ কারণেই মধু দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছে।’
মুহম্মদ সবসময় দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু সযত্নে এড়িয়ে চলতেন। কেননা জিব্রাইল প্রায়ই তার কাছে ওহী নিয়ে আগমন করতেন, আর তিনি দুর্গন্ধের কাছে আসতে পারতেন না। তাই তিনি এখন তার এই বিবিকে খুশী করতে তার কাছে অতঃপর মধু খাবেন না বলে কসম খেলেন। কিন্তু একথা জয়নব শুনলে মনঃক্ষুন্ন হবেন ভেবে সাথে সাথে তিনি আয়েশাকে বিষয়টি গোপন রাখতে বললেন। কিন্তু মেয়েরা পেটে কথা লুকিয়ে রাখতে পারে না। বিবি আয়েশা বিষয়টি বিবি হাফসার গোচরীভূত করে দিলেন।
অতঃপর গোপন এই বিষয়টি যে ফাঁস হয়েছে জিব্রাইল মারফত মুহম্মদ তা জানতে পারলেন। তখন তিনি আয়েশার বিরুদ্ধে তার কাছে অভিযোগ আনলেও কি ভেবে পূর্ণ কথা বললেন না। সবশুনে আয়েশা বললেন, ‘কে আপনাকে একথা বলল?’
তিনি বললেন, ‘যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন।’
মুহম্মদ চুপ হয়ে গেলেন। আর এদিকে সেসময় আয়েশাও মনে মনে ভাবছিলেন এই অপরাধে মুহম্মদ যদি তাকে তালাক দেন তবে অতঃপর তিনি তার মত স্ত্রী সম্ভবতঃ আর পাবেন না।
মুহম্মদ আয়েশাকে তালাক দেবার কথাই ভেবেছিলেন। কিন্তু জিব্রাইল এসে তাকে এ কাজে বিরত রাখেন এই বলে-‘তার পূণ্য অনেক, আর তার নাম জান্নাতে তোমার বিবিগণের তালিকায় লিখিত আছে।’
আর এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতসমূহ নাযিল হল, যাতে পূর্ণ ঘটনা এবং বিবি আয়েশার মনোভাবের জবাব দেয়া হয়েছে।- হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্যে যা হালাল করেছেন, তুমি তোমার স্ত্রীদের খুশী করতে তা নিজের জন্যে হারাম করছ কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক। তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
যখন নবী তার স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বলল, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বলল এবং কিছু বলল না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বলল, তখন স্ত্রী বলল, ‘কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল?’
যখন নবী তার স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বলল, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বলল এবং কিছু বলল না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বলল, তখন স্ত্রী বলল, ‘কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল?’
নবী বলল, ‘যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন।’
তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে (আয়েশা ও হাফসা) তওবা কর, তবে ভাল কথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ, জিব্রাইল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনরা তার সহায়। উপরন্তু ফেরেস্তারাও তার সাহায্যকারী। যদি নবী তোমাদের সকলকে পরিত্যাগ করে, তবে সম্ভবতঃ তার পালনকর্তা তাকে পরিবর্তে দেবেন তোমাদের চাইতে উত্তম স্ত্রী, যারা হবে আজ্ঞাবহ, ঈমানদার, নামাযী, তওবাকারিণী, এবাদত কারিণী, রোজাদার, অকুমারী ও কুমারী।(৬৬:১-৫)
আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার পর মুহম্মদ কসম ভঙ্গ করেন এবং কাফফারা আদায় করেন। কাফফারা হিসেবে তিনি একটি ক্রীতদাস মুক্ত করে দেন।
সমাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন