১২ মার্চ, ২০১২

Hijrat: মুহম্মদের মদিনায় হিজরত।

শিষ্যদের প্রায় সকলে ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করলেও, মুহম্মদ একাই অনুগত আলী ও আবু বকরসহ সাহসিকতার সঙ্গে নিজ অবস্থান আগলে ছিলেন। অবশ্য যে সকল মুসলমান নরনারী কুরাইশদের দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত ও বন্দী হয়ে মক্কায় অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিল তাদের কথা আলাদা। 

ইতিমধ্যে বিপদের মেঘ দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল। মুহম্মদ যে কোন সময়ে পলায়ন করতে পারেন এই আশঙ্কায় দার-উন-নাদওয়ায় (কোসাই ইবনে কেলাবের বাড়ী- বর্তমান বাবুজ জিয়াদাতই সেইস্থান যেখানে এই বাড়ীটি ছিল।) কুরাইশদের একটি জরুরী অধিবেশন বসল-অন্যত্র থেকে কিছুসংখ্যক প্রধানকে এই অধিবেশনে ডাকা হল।
মুহম্মদের বংশকে এই সভায় আহবান করা হয়নি। 

উপস্থিত সমস্যা ও তার সমাধানকল্পে আহবায়িত এই সভা খুবই বাক-বিতন্ডাপূর্ণ হল। কারণ, কুরাইশদের মনে ভয় প্রবেশ করেছিল। এই ভয় ছিল এই যে, এতদিন মুহম্মদের ইসলাম প্রচার ও লোকদের নূতন ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার বিষয়টি মক্কাতেই সীমাবদ্ধ ছিল অর্থাৎ কুরাইশদের আয়ত্ত্বের মধ্যেই ছিল, কিন্তু এখন তা মদিনাতেও বিস্তার লাভ করেছে এবং তার অনুসারীদেরও অধিকাংশ মদিনাতে হিযরত করেছে। এখন মুহম্মদ সেখানে পালিয়ে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন। তাতে কুরাইশদের সমূহ বিপদের সম্ভাবণা। এ কারণে সভায় তাকে যাবৎজীবন কারাদন্ড প্রদান বা নগর থেকে বহিস্কার করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হল। 

একজন বলল, ‘আমার মতে হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ী দিয়ে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তাকে জেলখানায় রাখা হোক। তারপর কারাকক্ষের দরজা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হোক। সেখানে সে নিজের পাপের দন্ডভোগ করতে করতে মরে যাবে।’
আর একজন এ কথার প্রতিবাদ করে বলল, ‘এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করলে মুহম্মদের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের এ সংবাদ জানতে বাকী থাকবে না। তারা যে কোন প্রকারে, তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। এতে একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধ-বিগ্রহ বেঁধে একটা হিতে বিপরীত কান্ড ঘটতে পারে-এই প্রস্তাব একেবারেই অসমীচীন।’
আর একজন বলল, ‘তাকে দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হোক। দেশান্তরিত হয়ে যাবার পর, সে যেখানে যাক বা যা করুক, তা আমাদের দেখার কোন আবশ্যকতা নেই। আমরা নিরাপদে নিজেদের কাজ-কর্মে মনোযোগ দিতে পারব।’

এই প্রস্তাবেরও প্রতিবাদ হল। প্রতিবাদকারীরা বলল, ‘তার কথা যেরূপ মিষ্টি এবং সে মানুষের মনকে যেমন সুন্দর করে বশীভূত করে নিতে পারে-তাতে সে যে দেশে গমন করবে, সেখানেই তার বহু ভক্ত জুটে যাবে। তাহলে আমাদের কন্টক যেমনকার তেমনি রয়ে গেল। পক্ষান্তরে অন্যত্র যেতে পারলেই সে লোকবলে পুষ্ট হবে। তখন আমাদের উপর আপতিত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে পড়বে।’  

অতঃপর তাকে হত্যা করার প্রস্তাব উঠল; কিন্তু কেউ একজন তাকে হত্যা করলে তিনি ও তার পরিবার রক্তের প্রতিশোধ-প্রতিহিংসায় কবলিত হয়ে পড়বেন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? 

অবশেষে আবু জেহেল (তার প্রকৃত নাম আমর এবং বিচক্ষণতার জন্যে সে আবুল হিশাম (জ্ঞানের পিতা) উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মান্ধতার জন্যে নতুন ধর্মের মধ্যে তিনি কোন কল্যাণ দেখতে পাননি, এ কারণে মুহম্মদ তাকে আবু জেহেল (অজ্ঞানতার পিতা) উপাধি দেন) পরামর্শ দিলেন- ‘সকল গোত্রের বাঁছাইকৃত লোকেরা তাকে হত্যা করবে।’
প্রস্তাবটি সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হল। 

কুরাইশদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোরআন জানায়-‘এবং (হে মুহম্মদ! সেই ঘোর বিপদের কথা স্মরণ কর) যখন অবিশ্বাসীরা তোমার সম্বন্ধে- তোমাকে বন্দী করে রাখবে কি তোমাকে হত্যা করে ফেলবে, কিম্বা তোমাকে দেশ হতে বহিস্কার করে দেবে- এ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল।(৮:৩০)
এদিকে ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয় মুহম্মদকে বিপদ সম্পর্কে সাবধান করল। অতঃপর জিব্রাইল মারফত তিনি কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হলেন ও হিযরতের আদেশ পেলেন। ইতিপূর্বেই মুহম্মদ মানসিকভাবে হিযরতের প্রস্তুতিতে ছিলেন, সুতরাং তিনি দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিলেন। আর  আবু বকর তার সঙ্গী হবেন এটাও তিনি নিশ্চিত ছিলেন। 
দ্বিপ্রহরের প্রখর রৌদ্রে মুহম্মদ আবু বকরের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। আবু বকর পূর্ব থেকেই হিজরতের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। তিনি চার মাস পূর্বে দু’টি দ্রুতগামী উট মুহম্মদের পূর্ব ইঙ্গিতে ক্রয় করে রেখেছিলেন। তাকে এমন অসময়ে আগমন করতে দেখে আবু বকর বললেন, ‘ব্যাপার কি? আমার জনক-জননী আপনার প্রতি উৎসর্গীত হোক।’ 
মুহম্মদ বললেন, ‘ব্যাপার কিছুই না। আমি হিযরত (Hijrat) করার অনুমতি পেয়েছি।’
তিনি বললেন, ‘আমি সঙ্গে যেতে পারব কি?’
সম্মতি সূচক উত্তর পেয়ে আবু বকর বললেন, ‘তাহলে আপনি আমার একটি উট গ্রহণ করুন।’
তিনি বললেন, ‘বেশ। তবে বিনামূল্যে নয়।’
মুহম্মদ আবু বকরের সঙ্গে যাত্রার বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে গৃহে ফিরে এলেন।
এদিকে আসমা ও আয়েশা দু‘বোন মিলে তাড়াতাড়ি করে তাদের পথের জন্যে কিছু খাদ্য তৈরী করতে লাগলেন। আর আবু বকর আপণ কর্তব্যের খাতিরে নিজ পরিবারকে এবং সহায় সম্পত্তি কুরাইশদের মধ্যে রেখে, আনন্দ ও আগ্রহ সহকারে, ইসলামের জন্যে, সত্যের জন্যে, আল্লাহর রসূলের জন্যে- নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে, নিজেকে আসন্ন মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে নিক্ষেপ করে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।  

মক্কার জনসাধারণ কুরাইশ দলপতিদের প্ররোচনায় ও নিজেদের অজ্ঞতাবশতঃ মুহম্মদের বিরুদ্ধাচারণ করতে কুন্ঠিত হয়নি। কিন্তু সেই পরম শত্রুকে তারা তখনও এতদূর বিশ্বাস্য ও মহাত্মা বলে মনে করত যে মক্কার যার যে কোন মূল্যবান অলঙ্কার ও নগত অর্থ আমানত বা গচ্ছিত রাখার আবশ্যক হত, সে তা নিঃসংশয়ে তার কাছে রেখে যেত। এমনকি তিনি যখন আবু বকরকে নিয়ে মদিনায় যাত্রা করার জন্যে প্রস্তুত হলেন, তখনও তার কাছে কুরাইশদের বহু মূল্যবান জিনিষপত্র গচ্ছিত ছিল, তখনও তিনি আমিন ও সাদেক নামে খ্যাত। তাকে সেইরাত্রে চলে যেতে হবে অথচ আমানতের জিনিষপত্রগুলি ফিরিয়ে দিতে গেলে লোকের মনে সন্দেহের উদ্রেক হবে। এই কারণে তিনি, আলীকে মক্কায় রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। 

সন্ধ্যা রাত। গৃহীত প্রস্তাব মত লোকেরা মুহম্মদের গৃহ পাহারা দিতে এল। মুহম্মদ তাদের অভিসন্ধি পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। সুতরাং তিনি হত্যাকারীদের দৃষ্টি তার শয্যার উপর নিবদ্ধ করার জন্যে তার সবুজ পোশাক অনুগত আলীকে পরিধান করালেন ও তার শয্যায় শয়ন করতে আদেশ করলেন এবং তিনি হযরত দাউদের মত জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। 
লোকেরা রাত্রি জেগে মুহম্মদের গৃহ পাহারা দিতে লাগল এবং প্রত্যুষে যখন তিনি ঘর থেকে বের হবেন তখন তাকে হত্যা করার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। তারা মাঝে মাঝে দরজার একটি ছিদ্র দিয়ে দেখতে লাগল যে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন কিনা। 

সওর গুহা।
এদিকে মুহম্মদ নির্দিষ্ট স্থানে আবু বকরের সাথে মিলিত হলেন। অতঃপর তারা সকলের অলক্ষ্যে তাদের নির্দয় জন্মভূমি থেকে পলায়ণ করলেন। 

তারা মক্কার দক্ষিণ দিকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত সত্তর গিরি গুহায় কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন। মক্কা হতে হোছায়নি গ্রামে যে পথ গিয়েছে, ঐ পথের বামদিকে-আন্দাজ দেড় ঘন্টার পথ অতিক্রম করলে এই পর্বত দেখা যায়। পর্বতের চূঁড়া দেশে এই গুহাটি অবস্থিত। গুহাটির একটি মাত্র প্রবেশ মুখ ছিল-যার মধ্যে দিয়ে একজন মোটাসোটা লোক কষ্টে প্রবেশ করতে পারত। পরবর্তীতে যাত্রীদের সুবিধার জন্যে অন্যদিক হতে একটা প্রশস্তপথ তৈরী করা হয়েছিল। 

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আলী গাত্রত্থান করলেন। অতঃপর আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দ্বার খুলে বেরিয়ে এলেন তিনি। তৎক্ষণাৎ অবরোধকারীরা খোলা তরবারী হাতে ঘিরে ধরল তাকে। ভোরের আলো ততটা না ফুটলেও তারা মুহম্মদের সবুজ পোষাক পরিহিত আলীকে চিনতে পারল। কাজেই তাকে হত্যা করতে উদ্যোগী হল না তারা। বরং সারারাত নিজেদের বোকামীর কথা চিন্তা করে তারা বিশেষ লজ্জিত হয়ে পড়ল। 

মুহম্মদ পলায়ন করেছেন- এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এতে কুরাইশদের উম্মত্ততা সীমাহীন আক্রোশে ফেঁটে পড়ল। হত্যাকারীরা ব্যর্থ হয়েছে- আর এই ব্যর্থতা তাদের সমগ্র শক্তিকে জাগিয়ে তুলল। 
উন্মত্ত কুরাইশদল আলীকে বন্দী করে নিয়ে এল। অতঃপর আক্রোশ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বল, মুহম্মদ কোথায়?’
আলী দুঃসাহসিক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর করলেন, ‘তোমরা কি তার গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্যে আমাকে নিয়োজিত করেছিলে?’

সুষ্ঠ জবাব না পেয়ে তারা আলীকে উৎপীড়নের চরম করল। তারপর সদলবলে মুহম্মদের খোঁজে আবু বকরের গৃহদ্বারে এসে উপস্থিত হল। কেননা মুহম্মদ যে মদিনায় গমন করবেন এবং আবু বকর ছাড়া যে তিনি কিছুই করবেন না এ কথা তাদের অবিদিত ছিল না। 

দলপতি ক্রোধান্বিত হয়ে আবু বকরের গৃহদ্বারে ভীষণভাবে করাঘাত করতে শুরু করলেন। বাড়ীতে তখন যুবতী আসমা ও বালিকা আয়েশা ছিলেন। ব্যাপার কি তা তাদের বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হল না। পিতা তাদেরকে বিপদের মধ্যে রেখে গেছেন এবং নিজেও মৃত্যুর মুখে ঝাপিয়ে পড়েছেন কিন্তু তাতে তারা এতটুকু বিচলিত ছিলেন না। আসমা দরজা খুলে দিলেন এবং সম্মুখে মূর্ত্তিমান শয়তান আবু জেহেলকে দেখতে পেলেন। আবু জেহেল তীব্রস্বরে হুংকার দিলেন, ‘বল, তোর পিতা কোথায়?’ 
নিরুদ্বিগ্ন ঠান্ডা স্বরে আসমা উত্তর করলেন, ‘আমি বলতে পারিনে।’ 
সাথে সাথে আবু জেহেল তাকে প্রচন্ড এক চড় লাগালেন। এই চড়ে আসমার কর্ণবালি ছিন্ন হয়ে গেল এবং তিনি ছিঁটকে পড়লেন। ক্রোধান্বিত দলপতি ভূ-লুন্ঠিত আসমার প্রতি ক্ষণকাল তীব্র দৃষ্টি হেনে দলবলসহ প্রস্থান করলেন। 

অশ্বারোহীরা দেশময় তন্নতন্ন করে মুহম্মদকে খুঁজতে লাগল। তার মস্তিস্কের উপর কুরাইশ প্রধানরা মূল্য নির্ধারণ করলেন। 
এক’শ উট মুহম্মদের শিরের মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল। 

পলাতকদ্বয় তিন দিন সওর গুহায় অবস্থান করলেন। দু’একবার বিপদ এত কাছে এসে পড়েছিল যে, আবু বকর সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। 
খুঁজে ফেরা কুরাইশদের একদল মুহম্মদের অনুসন্ধানে গুহার মুখ পর্যন্ত এসে গেল। এ সময় আবু বকর ভীতকন্ঠে বললেন, ‘আমরা যে মাত্র দু’জন।’
মুহম্মদ বললেন-‘না, আমরা তিনজন, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ 
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত- ‘যখন অবিশ্বাসীরা তাকে দেশান্তরিত করে দিয়েছিল, দু-‘জন মাত্র, দু‘জনের একজন সে (মুহম্মদ)। যখন তারা গুহায় অবস্থান করছিল (এবং অবিশ্বাসীদের উলঙ্গ তরবারীর নীচে তাদের নিঃসহায় অবস্থা ও আসন্ন মৃত্যুর বিভিষিকা প্রত্যক্ষ করে সত্যের ধ্বংসের আশঙ্কায়-যখন তার সঙ্গী বিচলিত হয়ে পড়েছিল) সে আপন সহচর (আবু বকর)কে বলল, -চিন্তিত হবে না, বিষন্ন হবে না (আমরা দু‘জন মাত্র নই) আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’(৯:৪০)

এদিক ওদিক অনুসন্ধান করার পর গুহার মুখে দৃষ্টি ফেলে অনুসন্ধানীরা বলল, ‘এর ভিতর নিশ্চয়ই কেউ প্রবেশ করেনি, নতুবা মাকড়সার জাল কিছুতেই অক্ষত থাকত না।’ 

মাকড়সারা ক্ষতিগ্রস্থ স্থানে পুনঃরায় জাল বুনে নিয়েছিল। 
প্রকৃতপক্ষে পরিত্যক্ত গুহামুখে পূর্ব থেকেই প্রচুর মাকড়সা জাল বিস্তার করেছিল সহজ শিকারের আশায়। মুহম্মদ ও আবু বকরের প্রবেশের কারণে এই জাল কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বটে কিন্তু তারা দীর্ঘসময় গুহাতে অবস্থান করায় মাকড়সারা ক্ষতিগ্রস্থ স্থানে পুনঃরায় জাল বুনে নিয়েছিল। 

গুহায় তল্লাশি না করেই অনুসন্ধানী কুরাইশ দল ফিরে গেল। তিনদিন পর তারা তাদের তল্লাশি প্রচেষ্টা কিছুটা শিথিল করল। এ কয়দিন আবু বকরের দুঃসাহসী কন্যা আসমা রাত্রিতে একাকী সবার অলক্ষ্যে অতি সতর্পণে কয়েক মাইল পথ হেঁটে তাদের জন্যে আহার্য সরবরাহ করেছিলেন। গৃহত্যাগের পূর্বে আবু বকর তাদের অবস্থান পরিকল্পণা তার এই জৈষ্ঠ্য কন্যাকে জানিয়ে এসেছিলেন। 
তৃতীয় রজনীর প্রভাতে পলাতকরা গুহা ত্যাগ করলেন। 
আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ার্কা নামক এক ব্যক্তিকে আবু বকর পূর্ব হতে নিযুক্ত করেছিলেন। তার সঙ্গে কথা ছিল তৃতীয় রজনীর প্রভাতে তিনি আবু বকরের নির্দিষ্ট উট দু‘টি নিয়ে সওর পর্বতের কাছে উপস্থিত হবেন। আব্দুল্লাহ যদিও তখন পর্যন্ত পৌত্তলিক ছিলেন। কিন্তু তিনি তার কথা ও দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেছিলেন। উট দু‘টি ও আমেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

মুহম্মদ ও আবু বকর মদিনার পথে।
সাধারণভাবে মক্কা ও মদিনার কাফেলা যে সকল পথ দিয়ে যাতায়াত করে থাকে, সেই সকল পথ দিয়ে গমন করা কোনমতেই নিরাপদ নয়, এজন্যে অপরিচিত পথ দিয়ে তাদেরকে যেতে হবে। আব্দুল্লাহ এসম্পর্কে খুবই দক্ষ ব্যক্তি তাই তাকে ও তার সঙ্গে আগত আমেরকে সঙ্গে নেয়া হল। এরপর স্বল্প ব্যবহৃত পথে তারা লোহিত সাগরের উপকূল ধরে ইয়াসরিবের পথে যাত্রা করলেন। 

মুহম্মদ ও তার সঙ্গীরা দ্রুত বেগে পথ পর্যটন করছেন। দেখতে দেখতে সূর্যের কিরণ প্রখর হতে প্রখরতর হতে লাগল। একসময় তারা পরিশ্রান্ত হয়ে ছায়ার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন এবং সম্মুখে একটি পাহাড়ের চাতানের নীচে আশ্রয় নিতে থামলেন। আবু বকর উট থেকে নেমে প্রথমে স্থানটি যথাসম্ভব পরিস্কার করে সেখানে নিজের চাদর বিছিয়ে মুহম্মদকে তথায় বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করলেন। 
মুহম্মদ উট থেকে অবতরণ করলেন।

মুহম্মদ বিশ্রাম নিচ্ছেন, এসময় আবু বকর তথা হতে একটু দূরে গিয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। কুরাইশ কর্তৃক নিয়োজিত ঘাতকদল এখনও তাদেরকে অনুসরণ করছে কিনা, দূরদর্শী আবু বকর বিশেষ সতর্কতার সাথে তার সন্ধান নিচ্ছিলেন। অতঃপর তার নজরে এল-অদূরে একজন রাখাল কতকগুলি ছাগল চরাচ্ছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে ঐ রাখালকে প্রশ্ন করে জানতে পারলেন যে, সে একজন কুরাইশ ভৃত্য। তার অনুরোধ মতে রাখাল একটি দুগ্ধবতী ছাগ দোহন করে একটি পাত্র ভর্তি করে নিয়ে এল। আরবের নিয়মমত তাতে কিছুটা পানি মিশ্রিত করে তিনি তা মুহম্মদের কাছে নিয়ে এলেন। মুহম্মদ সেই দুধ পান করলেন। একসময় আবু বকর বললেন, ‘যাত্রার সময় হয়েছে।’
তারা সেখান থেকে যাত্রা করলেন।
Migration Route (in Red).
মুহম্মদের শিরের জন্যে ধার্য্য উচ্চমূল্য মক্কা থেকে অনেক অশ্বারোহীকে পথে টেনে এনেছিল এবং তখনও তারা সযতেনে অসহায় গৃহত্যাগীকে খুঁজে ফিরছিল। মুহম্মদের কাফেলাটি এদেরই একজনের নজরে এল। সে ত্বরিত নিজ পল্লীতে ফিরে গেল। পল্লীর প্রধানরা তখন এক মজলিশে বসে গল্পগুজব করছিলেন। আগন্তুক ব্যাগ্র ও ত্রস্তভাবে সংবাদ দিল, ‘একটি ক্ষুদ্র যাত্রীদল সমূদ্র উপকূলের দিক দিয়ে যাত্রা করছে।’ 

সূরাকা ইবনে মালেক একজন দূর্বার, দুধর্ষ যোদ্ধা। সে সেখানে উপস্থিত ছিল, সে উত্তমরূপে বুঝতে পারল যে সংবাদদাতা যথার্থ সংবাদই এনেছে। কিন্তু শত উটের মূল্যবান পুরস্কার আর মুহম্মদকে হত্যার অক্ষয় যশ একাই লাভ করবে সঙ্কল্প করল সে। কাজেই এসময় সে চাতুরীর আশ্রয় নিল, বলল, ‘না, না, ঐ দলটি মুহম্মদ বা তার সহচরবৃন্দের নহে। আমি বিশেষরূপে অবগত রয়েছি যে, ঐ দলটি তাদের পলায়িত পশুর সন্ধানে বের হয়েছে।’
তার কথার সত্যতায় আর কারও সন্দেহ রইল না এবং কেউই যাত্রীদলের অনুসরণে প্রবৃত্ত হল না। 

Migration Route (in Red).
অল্পক্ষণ পরে সূরাকা ধীর পদক্ষেপে তথা হতে নিজ বাড়ীতে এল এবং অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্রুতগামী অশ্বে আরোহণ পূর্বক উপকূলের দিকে তীরবেগে ধাবিত হল। 
একসময় দলটি সুরাকার দৃষ্টি সীমানায় চলে এল। 
দূর হতে ধাবমান এক অশ্বারোহীকে দেখতে পেয়ে আবু বকর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমাদের সর্বনাশ।’
মুহম্মদ বললেন, ‘ভীত হবেন না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন।’ 

পলাতকদের দেখতে পেয়ে সুরাকা এক ধরণের উত্তেজনা অনুভব করল। সে ত্রস্ততার মধ্যে  দ্রুতবেগে তার অশ্বকে সম্মুখে ধাবিত করল। হঠাৎ তার অশ্ব একখন্ড প্রস্তরে আঘাতপ্রাপ্ত হল। এতে সে ছিঁটকে ভুপাতিত হল। তার মন অনেকটা ভেঙ্গে পড়ল। সে নিরুৎসাহ হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং আর অগ্রসর হবে কিনা, এ সম্পর্কে ইতস্ততঃ করতে লাগল। এরপর সে যলমের চোঙ্গা হতে শর শলাকা বের করে ভাগ্য পরীক্ষা করল। ফল না সূচক হল। এতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে জর্জরিত এই পৌত্তলিকটির মন একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল।

অতঃপর সেইসময় শয়তানের প্ররোচনা তাকে এক’শ উটের পুরস্কার ও সম্মানিত হবার গৌরব লাভের লোভ দুঃসাহস এনে দিল। সে গণনার ফলকে অগ্রাহ্য করল। ভাবল- সম্ভবতঃ গণনারই ভুল হয়েছে। সে পুনঃরায় অশ্বারোহণ করল এবং দ্রুতবেগে সম্মুখে ধাবিত হল। কিছুদূর যেতে না যেতেই তার অশ্বের সম্মুখের পদদ্বয় মাটিতে প্রোথিত হল এবং সে পুনঃরায় ভু-তলশায়ী হল। এসময় আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে তার অশ্বটিকে উদ্ধার করতে পারল না। সে ভীত হল ও পূর্বেকার ভাগ্যপরীক্ষার ফলের কথা তার মনে পড়ল। দ্রুত হস্তে পুনঃরায় যলমের চোঙ্গা হতে শর শলাকা বের করে আবারও ভাগ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হল সে। 
ফল এবারও না সূচক। 

এদিকে অদূরে উষ্ট্রপৃষ্ঠে উপবিষ্ট অবিচঞ্চল আত্মবিশ্বাসী মুহম্মদের সহাস্য মুখ। সেদিকে তাকিয়ে সুরাকা ভয়ে ও বিস্ময়ে একেবারে বিহবল হয়ে পড়ল। মুহম্মদ এসময় একমনে কোরআনের আয়াত আবৃত্তি করতে লাগলেন। আর আবু বকর উত্তেজনা নিয়ে সতর্কতার সাথে চতুর্দিকে ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন। 

দেহে বল নেই, অন্তরে সাহস নেই, সর্বাঙ্গ অবসন্ন সুরাকা যাকে অনুসরণ করছিল তারই কাছে কাতরস্বরে অতঃপর ক্ষমাপ্রার্থী হল এবং ক্ষমা প্রদর্শণের সাফাইয়ের জন্যে অনুরোধ করল। আবু বকর প্রদত্ত একখানি অস্থির উপর এই সাফাই প্রদত্ত হল। মুহম্মদের নির্দেশে আমের এটা লিখলেন।  
এরপর মুহম্মদ সুরাকার অশ্বটিকে উদ্ধার করে দিলে সে ফিরে গেল। আর যাত্রীদল মদিনার দিকে প্রস্থান করলেন।
মুহম্মদ যে মদিনায় হিযরত করবেন এটা কুরাইশদের বিশেষরূপে জানা ছিল। তাই তারা মদিনা গমনের গন্তব্য পথের চারিপার্শ্বের আরব গোত্রগুলির মধ্যে নিজেদের সঙ্কল্প ও মূল্যবান পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। এই পুরস্কারের লোভে আসলাম বংশের বারিদা নামক জনৈক প্রধান, ৭০ জন দুর্ধর্ষ সঙ্গী নিয়ে মুহম্মদের আগমন প্রতীক্ষা করছিল। মদিনার উপরিভাগ আর অধিক দূরে নয়, এসময় এই ক্ষুদ্র যাত্রীদলের সাথে তাদের দেখা হল। ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব লুন্ঠনকারী, পশু প্রকৃতির এই দুর্ধর্ষ দস্যুদল একই সাথে বিদ্বেষে ও প্রলোভনে উত্তেজিত, উৎসাহিত। কা’বার অবমাননাকারী, দেবদেবীগণের শত্রু মুহম্মদের হত্যার ন্যায় পূণ্যকর্ম আর কি হতে পারে! তার উপর শত উটের মহামূল্য পুরস্কার।
মার মার কাট কাট রূপে ৭০টি নাঙ্গা তরবারী হাতে ছুটে এল তারা আগন্তুক দলটির দিকে।

মুহম্মদ নিবিষ্ট মনে কোরআন পাঠ শুরু করলেন। সেই পবিত্র সূর লহরী ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হয়ে দ্রুত আগুয়ান দস্যুদলের কর্ণ-কূহরে প্রবেশ করতে লাগল এবং তা শ্রোতাদের মর্মে স্থান করে নিল। দস্যু দলপতি বারিদার চরণদ্বয় যেন ভারাক্রান্ত হয়ে এল, তার বাহুদ্বয় শিথিল হয়ে পড়ল। এসময় মুহম্মদ তার সেই স্বাভাবিক মধুর-গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আগন্তুক! তুমি কে?’
‘আমি বারিদা, আসলাম গোত্রপতি।’
-‘আসলাম-শান্তি, শুভকথা।’
‘আর আপনি?’ -কম্পিত স্বরে বারিদার প্রশ্ন।
‘আমি মক্কার অধিবাসী, মুহম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। সত্যের সেবক, আল্লাহর রসূল।’  
বারিদার শিথিল মুষ্ঠি হতে বর্শাদন্ড খসে পড়ল। অবিলম্বে সে বসে পড়ল। সহচররাও তাকে অনুসরণ করল।

মুহম্মদের মুখ নিঃসৃত বাণী শুনে বারিদা অভিভূত হয়ে পড়ল। এরপর যখন মুহম্মদ চলে যেতে উদ্যত হয়েছেন তখন বারিদা ভক্তি গদগদ কন্ঠে নিবেদন করল, ‘প্রভু হে! নিজ গুণে একবার যে চরণে ঠাঁই দিয়েছেন, তা থেকে আর বঞ্চিত করবেন না।’

মহা উৎসাহে সঙ্গীদের নিয়ে বারিদা তার অগ্রবর্তী হল। ৭০ খানা উলঙ্গ কৃপাণ-৭০ খানা দীর্ঘ বর্শাফলক, সূর্য্য কিরণে উদ্ভাসিত হয়ে তাদের পিছনে পিছনে হেলে দুলে চলতে লাগল। দলপতি নিজের শ্বেত পতাকাকে বার বার আন্দোলিত করে ঘোষণা করতে করতে চলল:
‘...স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আসছেন-
জগদ্বাসীর কাছে এই আনন্দ সংবাদ।’

বারিদা পথ হতে ফিরে গিয়েছিল। এরপরে সে বদর যুদ্ধের সমসাময়িককালে মদিনায় উপস্থিত হয়েছিল। মধ্যবর্তী সময়ে সে নিজ গোত্রে ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত ছিল।

যাত্রীদল আর কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই অগ্রসর হতে থাকলেন। পথে জুবায়ের ইবনে আওয়াম ও কতিপয় লোকের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল। ঐদল বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সিরিয়ায় গিয়েছিল। জুবায়ের খুশী হয়ে আবু বকর ও মুহম্মদের ব্যবহারের জন্যে কয়েকখন্ড শ্বেতবস্ত্র উপহার দিলে তারা তা পরিধান করলেন। যাত্রীদল তাদের কাছ থেকে অবগত হলেন যে, মদিনাবাসী অধীর আগ্রহে তাদের আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছে।

মুহম্মদ যখন রাগেবের নিকটবর্তী জোহফা নামক স্থানে পৌঁছিলেন, তখন মক্কার পথ তার দৃষ্টিগোচর হল। এতে বায়তুল্লাহ ও স্বদেশের স্মৃতি তার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করল। তখন জিব্রাইল তাকে আশ্বস্ত করতে এই আয়াত নিয়ে আগমন করেছিলেন-যিনি তোমার প্রতি কোরআনের বিধান পাঠিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তোমাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনবেন।(২৮:৮৫)

তিনদিন পথ চলার পর তারা ইয়াসরিবের সীমান্তে প্রবেশ করলেন। ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের এক গরমের দিনে মুহম্মদ তার উট "আল কাসোয়া" থেকে অবতরণ করলেন ইয়াসরিবের মাটিতে-যা পরে তার স্বদেশ ও আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল। 

সমাপ্ত।
ছবি: xtimeline.com, panoramio, kashif-ali, ezsoftech, oocities.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...