মধ্যযুগে ক্যাথলিক গির্জা বিভিন্ন ধরণের কর আদায় করত। টাইথ (Tithe- উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ গির্জাকে দিতে বাধ্য থাকা।) ও এ্যানেট এ ধরণের দু’টি কর ছিল। অবশ্য তাওরাতেও এক দশমাংশ যাকাতের সুস্পষ্ট বিধান ছিল। আর ইঞ্জিল বা বাইবেলে এই বিধানের কোন পরিবর্তন খোদা আনেননি। সুতরাং ঈসা ও তার সকল উম্মতদের প্রতি পূর্বোক্ত বিধান কার্যকরী ছিল।
ক্যাথলিক গির্জা। |
আদায়কৃত এইসব অর্থ বিধান অনুযায়ী ব্যয় না করে যাজকশ্রেণী নিজেরা ভোগবাদীতায় মত্ত হয়ে বিলাসী জীবন-যাপন করতে শুরু করলেন। এই যাজকশ্রেণী অতঃপর ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অর্থ আদায়ের আরও নুতন নুতন ফন্দি ফিকিরে লিপ্ত হলেন।
অসৎ ও লোভী প্রকৃতির এই যাজক শ্রেণীর একদল অতঃপর সাধারণ ধর্মবিশ্বাসীদের কান্ডজ্ঞানের অভাবের সুযোগ নিয়ে এক প্রকার ছাড়পত্র (indulgence) বিক্রিতে লিপ্ত হলেন। Indulgence-কে তারা মুক্তিপত্র হিসেবে অভিহিত করে এর ক্রয়কারীকে পৃথিবীর যাবতীয় পাপকর্ম থেকে মুক্ত করে দেবার ঘোষণা দিলেন।
যাজক টেটজেল। |
ধর্মের নামে মানবতা বিরোধী এই ঘোষণা সাধারণ ধর্মবিশ্বাসীদের জীবন বিপন্ন করে তুলল। বিত্তহীন, নিপীড়িত সাধারণ ধর্ম বিশ্বাসীদেরকে গির্জা সর্বদাই এই ধারণা দিয়ে এসেছে যে, তাদের যাবতীয় দু:খ-কষ্ট ইহজগতে খোদার অভিপ্রায়। মানুষ গির্জার যে কোন আদেশ নির্দেশকে খোদার অমোঘ বাণী বলে বিশ্বাস করত এবং কোন প্রশ্ন করাকেও পাপ জ্ঞান করত।
সুতরাং জ্ঞানহীন, নির্বোধ ঐ অত্যাচারীত জনগোষ্ঠী পরজগতে শান্তি পাবার আশায় ইহজগতের দু:খ-কষ্টকে তাদের ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিত। আর তারা খোদার কাছে অত্যাচারকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করত; আর জানত, ন্যায়বিচারক খোদা পরকালে ঐ অত্যাচারীকে কঠিন শাস্তি দেবেন। কিন্তু indulgence বিক্রির কারণে এখন তারা দেখল পরকালেও তাদের জন্যে কিছু নেই। সুতরাং তাদের ভিতর ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে শুরু করল।
Indulgence. |
সুতরাং এখন ধর্ম যাজকদের indulgence সম্পর্কিত ফতোয়া যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা বুঝতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠির কারও এতটুকু অসুবিধা হল না। অন্যদিকে যুগের পরিবর্তনে, শিক্ষার বিস্তারে মানুষের চিন্তা চেতনার এই যে প্রসার ঘটেছে ঐ লোভী যাজকগোষ্ঠী কিন্তু তা আদৌ উপলব্ধি করতে পারেননি।
Indulgence বিক্রি। |
নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা বিকাশের দরুণ পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে একটি অভিজাত (বুর্জোয়া) শ্রেণী গড়ে উঠে। এরা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানার প্রসার ঘটিয়ে প্রচলিত সামন্তবাদী অর্থনীতির বিপরীতে নুতন কর্মমুখর, সৃজনশীল একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু গির্জা ও সামন্ত প্রভূদের একচ্ছত্র অধিপত্যের কারণে তারা কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছিল না। সুতরাং তারা ক্যাথলিক গির্জার শক্তি হ্রাস কল্পে ধর্মের সংস্কার কামনা করছিল। আর এই কারণেই প্রতিবাদী জনগোষ্ঠীর প্রতি এই শ্রেণীর জোরালো সমর্থন ছিল।
Papal Bull. |
জার্মানীর সাক্সনি অঞ্চলের ইসব্লেন শহরে লুথারের জন্ম। ১৮ বৎসর বয়সে স্কুল পেরিয়ে তিনি ইরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অত:পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি অগাস্টিন ধর্মাশ্রমে ভর্তি হন। এইসময় তিনি ব্রাদার অগাস্টাস হিসেবে পরিচিত হন।
১৫০৫ সালে লুথার উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১৫১৭ সালের ৩১শে অক্টোবর, যাজক টেটজেলের indulgence বিক্রির বিরুদ্ধে উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্চে লুথার তার ৯৫ দফার প্রতিবাদ লিপি পাঠান। রোমে তার বিরুদ্ধে কমিশন বসে; তাকে ক্যাথলিক ধর্ম থেকে বহি:স্কারের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ১৫২০ খ্রীষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর পোপের ঘোষণাবলে (Papal Bull) লুথারকে ক্যাথলিক গির্জা থেকে বহি:স্কার করা হয়।
ড: মার্টিন লুথার। |
রোম সম্রাট ৫ম চার্লস পোপ লিওর পরামর্শক্রমে Worms-এ ১৫২১ খ্রীষ্টাব্দে হুসিয়ারী উচ্চারণ করেন যে, তিনি (লুথার) তার মতামত ত্যাগ না করলে তাকে জাঁ হাঁস (Jan Hus) এর পরিণতি বরণ করতে হবে। উল্লেখ্য ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলায় জাঁ হাঁসকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল ধর্মেদ্রোহী হিসেবে।
Jan Hus. |
যাহোক, লুথার সম্রাটের ঐ হুসিয়ারীতে কর্ণপাত করলেন না। ফলে সম্রাটের প্রত্যক্ষ মদদে তার রচিত পুস্তকাদি পুড়িয়ে ফেলার উৎসব চলতে লাগল। এতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অত:পর লুথারের নেতৃত্বে ধর্ম সংস্কারের আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচণা হল।
জ্যাঁ ক্যালভিন। |
প্রোটেস্ট্যান্টগণ বিজয়ী হলেও তারা ছিল সংখ্যালঘু। সুতরাং নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা উপলব্ধি করে ১৫৩১ খ্রীষ্টাব্দে তারা একটি আত্মরক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে যা "স্মলক্যান্ডিক লীগ" (Schmalkaldic League) নামে পরিচিত ছিল।
জেসুইট সংঘ। |
Ignatius of Loyola. |
ইতিপূর্বে গির্জা সমাজে মানুষকে প্রকৃতির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল হিসেবে প্রচার করেছে। কিন্তু ক্যালভিন ধারণা দিলেন- মানুষ কেবলমাত্র কর্মের মধ্যে দিয়েই শক্তির ফলাফল পেয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ক্যালভিন মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ ও আত্মনিয়োগ করার ধারণা দেন। মধ্যযুগের শেষপর্বে এই ভাবাদর্শ সম্পদ উৎপাদনে এক নূতন প্রেরণা দেয়।
ইউরোপের ধর্ম পীড়িত ও নিগৃহীত মানুষের বৃহৎ অংশেরই ধর্ম সংস্কারের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ সেখানে উদার ও গণতান্ত্রিক আবওহাওয়ার ক্ষেত্র তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন অত:পর নিষ্কণ্টক রইল না। কারণ সামন্তশক্তি তো তখনও নি:শেষিত হয়নি। তাছাড়া ক্যাথলিক গোষ্ঠি এই আন্দোলনকে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে প্রথম থেকেই বিবেচনা করে এর বিরোধিতা করে আসছিল। এখন তারা এই আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করল।
সাধু বার্থোলমেউ দিবসের গণহত্যা, ফ্রান্স। |
গণহত্যা, ফ্রান্স। |
পোপ কর্তৃক গণহত্যাকারীদেরকে প্রদত্ত মেডেল। |
এক নির্দয় গণহত্যা সংঘটিত হতে লাগল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ-ই রেহাই পেল না। এই অভিযান দু-সপ্তাহ ব্যাপী চলেছিল এবং কয়েক লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল। শুধুমাত্র ফ্রান্সের শহরগুলোতেই ৩০ (ত্রিশ) হাজারের বেশী মানুষ এই হামলায় নিহত হয়েছিল। ইতিহাসে এই গণহত্যা "সাধু বার্থোলমেউ দিবসের গণহত্যা" নামে অবিহিত। পোপ এই হত্যাকান্ড অনুমোদন করেছিলেন এবং পিশাচ ঐসব হত্যাকারীদেরকে পুরস্কৃত করার আদেশও দিয়েছিলেন।
এতকিছুর পরও কোন দেশেই ধর্ম সংস্কার আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করা যায়নি। কারণ এই আন্দোলন শিক্ষিত সমাজের চাহিদাকে ধারণ করেছিল যার পরিণতি অতঃপর ইউরোপে উদারবাদী শাসন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
সমাপ্ত।
ছবি: Wikipedia,
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন