৫ নভেম্বর, ২০১২

Spartans: গ্রীক-পারস্যিক যুদ্ধ ও ৩০০ স্পার্তান।


খ্রী:পূ: পঞ্চম শতাব্দীর প্রারম্ভে পরাক্রমশালী পারস্য সম্রাট প্রথম দরিয়াবস ইজিয়ান সাগরের অধিকাংশ দ্বীপ ও সাগরের উপকূল দখল করে নিল। অত:পর তিনি গ্রীসের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলেন।

ম্যারাথন বর্তমানে।
খ্রী:পূ: ৪৯০ অব্দে পারস্যিক বাহিনী সমুদ্র পথে ইজিয়ান সাগর অতিক্রম করে আত্তিকায় ম্যারাথন ময়দানে অবতরণ করল, জায়গাটি এথেন্স থেকে মাত্র ৪২কিমি দূরে।

ম্যারাথন ময়দানে পারস্যিক বাহিনীর অবতরণের দূ:সংবাদ এথেন্সে পৌঁছিল। তখন এথেনীয় অভিজাতবর্গের এক অংশ পারস্যিকদের পক্ষে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হল; তাদের আশা ছিল, পারস্য সম্রাটের সহায়তায় তারা পুনর্বার দেমোসের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।

Battle of Marathon.
অন্যদিকে দেমোস এবং সাধারণ এথেন্সবাসীদের যারা পরাধীনতাকে ঘৃণা করে, তাদের তখন ঘুম হারাম। কোন সময় নষ্ট না করে তারা তাদের সৈন্যদল দ্রুত সমবেত করল। যে সেনাবাহিনী গঠিত হল তার মধ্যে ছিল ভারী অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জ্বিত ১০ হাজার পদাতিক; অন্যদিকে পারস্যিক বাহিনী ছিল আকারে বহুগুনে বড়। ম্যারাথন ময়দানের চারিদিকের উঁচু টিলা থেকে দেখা যাচ্ছিল পারস্যিক বাহিনীর ছাউনি এবং সমূদ্র তীরে টেনে আনা তাদের সাঁরি সাঁরি রণতরী।

পারস্যিকরা যাতে এথেন্সের দিকে অগ্রসর হতে না পারে সে পথ বন্ধ করে দিয়ে গ্রীকরা পারস্যিকদের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের অগম্য সব পাহাড়ী টিলায় অবস্থান নিল। সেনাপতি মিলতিয়াদেস গ্রীক বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

লেওনিদাসের মনুমেন্ট, থার্মোপল।
প্রায় এক সপ্তাহ ব্যাপী উভয় বাহিনী সামনা সামনি অবস্থান করে রইল। অবশেষে গ্রীক বাহিনী ফালাঙ্গোসে সাঁরিবদ্ধ হয়ে রণাভিযান করল। মিলতিয়াদেস জানতেন যে, পারস্যিক বাহিনীর সেরা সৈন্যদল থাকে বাহিনীর মধ্যভাগে। সুতরাং ফালাঙ্গোসের উভয় পাশে তিনি নিজস্ব বাহিনীর সেরা যোদ্ধাদের রাখলেন।

পারস্যিকদের ঝাঁক ঝাঁক উড়ন্ত তীরের নীচে গ্রীক বাহিনী পারস্যিকদের আক্রমণ করল। গ্রীকদের এই সাহস ও শক্তির পিছনে কাজ করছিল একটি মাত্র বোধ যে, তারা লড়ছে মাতৃভূমির জন্যে- জননী, জায়া ও সন্তান-সন্তুতির জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে।  

গ্রীক বাহিনীর দুর্বল মধ্যভাগ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে পারস্যিকরা বিজয়োল্লাস করতে লাগল। এসময় গ্রীক ফালাঙ্গোসের পার্শ্বদেশের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দলগুলো দু‘দিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ করে বসল। পারস্যিকরা ঐ আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে নিজেদের জাহাজের দিকে পালাতে লাগল। পারস্যিকদের বেশকিছু জাহাজ দখল করে নিল গ্রীকরা, অন্যগুলো পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। 

থার্মোপলিস যুদ্ধক্ষেত্র বর্তমানে।
এক গ্রীক সৈনিক এথেন্সবাসীর কাছে এই বিজয়ের সুসংবাদ দ্রুত বহন করার আনন্দে ৪২ কি.মি. দীর্ঘপথ-ম্যারাথন থেকে এথেন্স- দৌঁড়ে নগর দ্বারে পৌঁছিল। অত:পর সে চিৎকার করে বলেছিল- ‘এথেনীয় ভাইসব, তোমরা আনন্দ কর, আমরা জিতেছি।’ আর এতটুকু কেবল বলতে পেরেই সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। তার এই স্মৃতি সংরক্ষণার্থে পরবর্তীতে ৪২কিমি দীর্ঘ দৌঁড় প্রতিযোগীতা ‘ম্যারাথন দৌঁড়’ প্রচলিত হয়।

৪৮৬ খ্রীঃপূঃ দরিয়াবসের মৃত্যুর পর প্রথম অ্যাটোশা তার উত্তররাধিকারী হলেন। তিনি জেরেক্সেস বা অহশ্বেরশ নাম ধারণ করলেন। দরিয়াবস গ্রীকদের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন, তাই অহশ্বেরশ সিংহাসনে আরোহণ করেই ঐ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। সম্রাটের বক্তব্য ছিল- ‘যারা আমাদের দৃষ্টিতে দোষী এবং যারা নির্দোষ উভয়ের উপরই আমরা সমভাবে দাসত্ব শৃঙ্খলের জোয়াল তুলে দেব।’

গ্রীক-পারস্যিক যুদ্ধ।
খ্রী:পূ: ৪৮০ অব্দে পারস্যিক সেনা ও নৌবাহিনী পুন:রায় গ্রীস অভিমুখে যাত্রা করল। পারস্যিক এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল অ্যাসিরিয়, মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, এশিয়া মাইনরের গ্রীক জাতি ও অন্যান্যদের দ্বারা।

আর ফিনিশীয়রা সম্রাটের নির্দেশে নৌবহরের যুদ্ধ জাহাজসমূহ তৈরী করেছিল। কেননা তারা ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দক্ষ নাবিক ও জাহাজ নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। আর তারা নিজেদের প্রয়োজনের খাতিরেই তাদের এই উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। কেননা ভূ-মধ্য সাগরীয় উপকূলবর্তী প্রায় সমস্ত স্থানেই তারা সমুদ্র পথে তাদের সওদা নিয়ে বাণিজ্যে বেরুত। শুধু সাগরেই নয়, তারা এমনকি আটলান্টিক মহাসাগরও পাড়ি দিত। 

পারস্য সেনাবাহিনী বিনা যুদ্ধে উত্তর গ্রীস দখল করে নিল। তখন মধ্য ও দক্ষিণ গ্রীসের বেশ কয়েকটি নগর রাষ্ট্র তাদেরকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হল। স্পার্তার সম্রাট লেওনিদাসের অধিনায়কত্বে গ্রীক বাহিনী সংকীর্ণ থার্মোপিলে গিরিপথ পাহারা দিয়ে মধ্য গ্রীসে পারস্যিকদের প্রবেশ পথ অবরুদ্ধ করল।

৩০০ স্পার্তান।
পারস্যিক সম্রাট লেওনিদাসের নিকট দূত পাঠালেন অস্ত্রত্যাগ ও পারস্যিক বাহিনীর হাতে অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ জানিয়ে। লেওনিদাস উত্তর দিলেন-‘এসে নিয়ে যাও।’
এই উত্তর শুনে পারস্যিক এক দূত বলেছিল-‘আমাদের তীর আর বল্লম এত যে, তা ছুঁড়লে সূর্য্য ঢেকে যাবে।’
এক গ্রীক যোদ্ধা তার উত্তরে বলেছিল-‘ঠিক আছে কি আর করা যাবে, অন্ধকারের মধ্যেই তাহলে আমরা যুদ্ধ করব।’

দু‘দিন ধরে পারস্যিক বাহিনী গ্রীকদের উপর আক্রমণ চালাল। কিন্তু সব আক্রমণই গ্রীকরা প্রতিহত করল। কিন্তু রাত্রে কোন এক গ্রীক বিশ্বাসঘাতকতা করে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে রাস্তা দেখিয়ে পারস্যিকদের নিয়ে আসে। লেওনিদাস যখন দেখলেন যে তার সেনাবাহিনী প্রায় শত্রু বেষ্টিত হয়ে পড়েছে, তখন তিনি স্পার্তান ব্যতিত সমস্ত গ্রীকদের পিছু হটতে আদেশ দিলেন।

লেওনিদাসের সাথে ৩০০ (তিন'শ) জন স্পার্তান (300 Spartans) যোদ্ধা এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হল। অসীম বীরত্বের সাথে তারা পারস্যিকদের সাথে যুদ্ধ করে এবং সকলেই নিহত হয়। বহুপরে ঐ স্থানে লেওনিদাস ও তার যোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তাতে লেখা ছিল- ‘হে পথিক, আমাদের অন্তিম সম্বন্ধে স্পার্তানদের বোলও: স্বধর্মে স্থিত থেকে আমরা আমাদের অস্থি এখানে রেখে গেলাম।’

ত্রিয়েরেস বা তিন পংক্তিক।
পারস্যিক বাহিনী মধ্য গ্রীস দখল করে নিল। এথেন্সের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও দাসদের দক্ষিণ গ্রীসে নিয়ে যাওয়া হল এবং তাদেরকে সালামিস দ্বীপে নৌবাহিনীর প্রহরাধীনে রাখা হল। জাহাজ ও দ্বীপ থেকে অতি দু:খের সাথে তারা দেখতে লাগল কিভাবে তাদের জন্মভূমি দাউ দাউ করে জ্বলছে।

আত্তিকা ও সালামিসের মধ্যে যে প্রণালী রয়েছে সেখানে গ্রীকদের সম্মিলিত নৌবাহিনী দাঁড়িয়ে ছিল। গ্রীকদের প্রত্যেকটি জাহাজে ১৮০ জন করে দাঁড়ি ও ২০-৩০ জন করে সৈনিক থাকত। এই জাহাজগুলোর উভয় পার্শ্বে তিন সাঁরিতে দাঁড়ি ছিল বলে তাদেরকে বলা হত ত্রিয়েরেস বা তিন পংক্তিক। এই ত্রিয়েরেস খোলামেলা বাহির সমুদ্রে অধিকতর দক্ষতার সাথে কর্মক্ষম বিশালাকার ও ভারি পারস্যিক নৌযান অপেক্ষা অধিক দ্রুততর গতিবেগ সম্পন্ন ছিল।

সালামিসের যুদ্ধ।
নিজের সুবিশাল নৌবাহিনীর বিজয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে পারস্য সম্রাট তাদের প্রণালীর মধ্যে প্রবেশ করে গ্রীকদের সাথে যুদ্ধের আদেশ দিলেন। আত্তিকার উঁচু সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে আমত্যবর্গ পরিবৃত পারস্যিয়ান সম্রাট দেখতে লাগলেন, তার রণতরী গ্রীকদের মুখোমুখী হচ্ছে। আর সালামিস দ্বীপ থেকে বৃদ্ধ ও নারীর দল তাকিয়ে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগল। যুদ্ধ জয় অথবা মৃত্যু-গ্রীস বাহিনীর সামনে অন্য কোন পথ খোলা নেই; পশ্চাদপসরণ করলে তাদের পরিবারসমূহ দাস হয়ে যাবে।

পারস্যিক নৌবাহিনী প্রণালীর মধ্যে প্রবেশ করা মাত্রই গ্রীক রণতরীসমূহ তাদের দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে এল। গ্রীক ত্রিয়েরেসের ধাক্কায় হয় দাঁড় ভেঙ্গে গেল, নতুবা পার্শ্বদেশে ছিদ্র হয়ে গেল, নতুবা চড়ার ঠেকে, বা ডুবো গিরিশৃঙ্গে আঘাত লেগে, বা নিজেদের মধ্যে ধাক্কা লেগে পারস্যিকদের ২০০ টিরও বেশী রণতরী ডুবে গেল। বাকি নৌযানসমূহ পশ্চাদপসরণে বাধ্য হল।

নৌবাহিনীর ব্যর্থতায় সম্রাট তার সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে গ্রীস ত্যাগ করলেন। অন্যদিকে গ্রীসে রেখে যাওয়া পারস্যিকদের সঙ্গে সম্মিলিত গ্রীক বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হল প্লাতেয়া শহরের কাছে খ্রী:পূ: ৪৭৯ অব্দে। এই যুদ্ধ দীর্ঘকাল চলেছিল। 

গ্রীস থেকে ফেরার পর সূদীর্ঘকাল পারস্যের শাসকেরা গ্রীস থেকে দূরে থেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন।

সমাপ্ত।

ছবি: Wikipedia, fanpop, findingdulcinea.
বি:দ্র: যারা ২০০৬ সনে মুক্তি পাওয়া '300' মুভিটি দেখেননি তাদের জন্যে আফসোস রইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...