৬ জুলাই, ২০১৫

Inferno: দান্তের ক্যানভাসে নরক ও নারকীয়তা।

ধ্য যুগীয় কবি দূরান্তে দেগলি আলিঘিরি, দান্তের জন্ম ১২৬৫ সনের মে-জুন মাসে ইটালির ফ্লোরেন্সে। তার পিতা আলিঘিরি, আলিঘিরি ডি বেলিন্সিওন ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ গুয়েল্ফ।তার সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। কেননা ১৩০০ সনের মধ্যভাগে মন্টাপার্টির যুদ্ধে ঘিবিলিনিরা জয়লাভ করলেও আলিঘিরিকে কোন যাতনা ভোগ করতে হয়নি। অবশ্য অনেকে এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তারা বলেন রাজনীতিতে নিস্ক্রিয়তার কারণে তার সামাজিক অবস্থান এমন মূল্যবান ছিল না যে, কর্তৃপক্ষ তাকে নির্বাসনে দেবার কথা ভাবতে পারতেন। 

যাহোক, গুয়েল্ফদের প্রতি দান্তের পরিবারের অকুন্ঠ সমর্থন ও আনুগত্য ছিল। এই গুয়েল্ফ ছিল ঘিবিলিনিদের বিপক্ষ একটি রাজনৈতিক সংগঠন যারা প্যাপাসিকে সমর্থন দিয়েছিল। অন্যদিকে ঘিবিলিনিরা ছিল রোমান সম্রাটের ছত্রছায়ায়। দান্তের মাতা বেলা সম্ভবত: আবাতি পরিবারের সদস্য ছিলেন। তিনি মারা যান দান্তের বয়স যখন দশ বৎসরেরও কম। স্ত্রীর মৃত্যুর পর আলিঘিরি পুনরায় বিবাহ করেন।

বিয়েট্রেস পোর্টিনারি বা বিকির সাথে প্রথম দেখা।
১২ বৎসর বয়সের সময় দান্তে বাগদান সম্পন্ন করেন ক্ষমতাশালী ডোনাটি পরিবারের গেমা ডি মানেটো ডোনাটির সাথে। নোটারীর মাধ্যমে ছোট এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এ ধরণের বাল্য বিবাহ ঐ সময় খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার ছিল। একই সময় দান্তে প্রেমে পড়েন ফল্কো পোর্টিনারির কন্যা বিয়েট্রেস পোর্টিনারি বা বিকির সাথে। ৯ বৎসর বয়সে প্রথম দেখাতেই তার বিকিকে ভাল লেগেছিল। গেমার সাথে দান্তের বিবাহের সঠিক সময় জানা যায় না। তবে বিয়ের বৎসর খানেক পর বিকির সাথে পুনরায় তার যোগাযোগ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। তিনি বিকিকে নিয়ে বেশ কয়েকটি সনেট রচনা করেন, কিন্তু স্ত্রী গেমা তার কোন কবিতায় স্থান পায়নি। দান্তে তার কবিতাসমূহে বিকিকে উপস্থাপন করেছেন দেবীকন্যা হিসেবে যে তাকে সব সময় আধ্যাত্মিক উপদেশ ও প্রেরণা যুগিয়েছে। ১২৯০ সনে বিকির অকাল মৃত্যুতে দান্তে দর্শণ শাস্ত্রের উপর আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ধর্মীয় স্কুল ডোমেনিকান চার্চের অধীনস্ত সান্তা মারিয়া নভেলায় ভর্ত্তি হন। 

দান্তের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। সম্ভবত: তিনি চার্চ এর সঙ্গে যুক্ত ফ্লোরেন্সের কোন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার তুসকান কবিতার উপর আগ্রহ ছিল এবং এ বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন এটা নিশ্চিত। পরবর্তীতে তিনি ল্যাটিন ক্লাসিক্যাল লেখক কিরো, ওভিদ ও ভার্জিলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। 

১১ই জুন ১২৮৯ সনে সংঘটিত কম্পালডিনোর যুদ্ধে গুয়েল্ফ অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দিয়ে দান্তে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এই যুদ্ধ ছিল ফ্লোরেন্টাইন গুয়েল্ফ ও আরিজ্জো ঘিবিলিনের মধ্যে। যুদ্ধে ঘিবিলিনিরা পরাজিত হয় গুয়েল্ফদের কাছে। গুয়েল্ফদের এই বিজয় ফ্লোরেন্সের সংবিধানে সংস্কার আনে। নগর কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জন্যে কোন বাণিজ্যিক, শিল্পকলা বা জনসেবা মূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা আবশ্যিক করে দেয়া হয়। আর তাই দান্তে একজন ফার্মাসিস্ট হতে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর পড়াশুনো শুরু করেন, যদিও তার চিকিৎসা বিদ্যা প্রাকটিস করার কোন ইচ্ছে ছিল না। এটার প্রয়োজন ছিল কেবলমাত্র তার রাজনৈতিক কেরিয়ার গঠনের জন্যে। যাইহোক পরবর্তীতে তিনি কয়েক বৎসর নগরের বেশ কয়েকটি অফিসে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এদিকে ঘিবিলিনিদের উপর বিজয়ের পর গুয়েল্ফ, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ এই দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শ্বেতাঙ্গ গুয়েল্ফদের নেতৃত্বে ছিলেন ভিয়েরী ডেই সার্কি। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গ গুয়েল্ফদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কর্সো ডোনাটি। প্রথমদিকে এই বিভক্তি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ফ্লোরেন্টাইনের আভ্যান্তরীণ কার্যাবলীতে পোপের ভূমিকা নিয়ে তা মতাদর্শগত বিরোধে পরিণত হয়। কৃষ্ণাঙ্গরা পোপকে সমর্থন করে যাচ্ছিল, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গরা আরো বেশী স্বাধীনতা দাবী করেছিল। আর তাই শ্বেতাঙ্গরা ক্ষমতায় আরোহণ করেই কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বিতাড়িত করল। এরই প্রতিক্রিয়ায় পোপ ৮ম বেনিফেস ফ্লোরেন্সে একটি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

অবশ্য পোপ প্রথমে ফ্রান্সের রাজা ৪র্থ ফিলিপের ভ্রাতা চালর্স অব ভেলোইসকে তুসকানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং আশা করা হচ্ছিল ১৩০১ সনে তিনি ফ্লোরেন্সে এসে পৌঁছুবেন। কিন্তু ফ্লোরেন্সের নগর শাসক পোপের আধিপত্য কিছুটা খর্ব করার দাবীতে কয়েক সপ্তাহ আগে এই দূতের সঙ্গে দূর্ব্যাবহার করেছিলেন। এ কারণে এ ধারণা জন্মেছিল যে, দূত চার্লস সম্ভবত: পোপের কিছু বাড়তি নির্দেশ নিয়ে আসবেন। আর তাই পোপের প্রকৃত মনোভাব জানতে ফ্লোরেন্সের নগর কাউন্সিল এক প্রতিনিধিদল রোমে প্রেরণ করলেন। দান্তে এই প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য ছিলেন।

এদিকে প্রতিনিধিদল রোমে পৌঁছিলে পোপ তাদেরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং দান্তেকে রোমে থেকে যেতে আদেশ দিলেন। এই সময় ১লা নভেম্বর, ১৩০১ সনে চালর্স অব ভেলোইস ব্লাক গুয়েল্ফদের নিয়ে ফ্লোরেন্সে অভিযান পরিচালনা করেন এবং ছয়দিনের মধ্যে শেতাঙ্গদের হটিয়ে দিয়ে ব্লাক গুয়েল্ফদের সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এতে কান্টে ডি গ্যব্রিয়েলি ডা গুবিও নগর শাসক মনোনীত হন। এসময় দান্তেকে বিপুল পরিমাণ অর্থদন্ডসহ দু’বৎসরের জন্যে নির্বাসন দন্ড দেয়া হল। আর তাকে হুশিয়ার করে বলা হয়েছিল যে, অর্থ পরিশোধ ব্যতিরেকে তিনি যদি ফ্লোরেন্সে আসেন, তবে তার প্রাণসংশয় ঘটতে পারে। দান্তে এই অর্থদন্ড দিতে সম্মত হননি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাছাড়া তার ফ্লোরেন্সের সমস্ত সম্পত্তি ব্লাক গুয়েল্ফ দ্বারা দখলীকৃত হওয়ায় তিনি অর্থদন্ড দেবার কোন যৌক্তিকতাও খুঁজে পাননি।

এসময় দান্তে রোমে থেকে শ্বেতাঙ্গ গুয়েল্ফদের ক্ষমতা পুনুরুদ্ধারের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সেগুলোর সবকয়টি ব্যর্থ হয়। এসব কারণে ফ্লোরেন্স নগর কমিটি দান্তের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডাদেশ ঘোষণা করে। এসময় দান্তে বার্থেলমেউ ১ম ডেলা স্কেলার আমন্ত্রণে রোম থেকে ভেরোনাতে গমন করেন এবং সেখান থেকে তিনি লিগুরিয়ার সার্জানাতে চলে যান। ধারণা করা হয়, এরপর তিনি জেন্টুকা নামক এক সম্ভ্রান্ত মহিলার আমন্ত্রণে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে লুকাতে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন।

১৩১০ সনে লুক্সেমবার্গের রোমান সম্রাট ৭ম হেনরী তার ৫,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে ইটালীতে আগমন করেন। দান্তে এটাকে এক সুযোগ মনে করে সম্রাটকে এক আবেগ তাড়িত পত্র দেন। এই সময় হেনরী ৭ম, দান্তে ও তার রচিত কিতাব, ইমেন্সা ডেই ডাইলেকশানে টেস্টান্টের সাথে পরিচিত হন। ইতিমধ্যে ফ্লোরেন্সের নগর শাসক অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ গুয়েল্ফকে ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দান্তে এর আওতায় আসেননি সম্রাটকে প্রদত্ত তার পত্রের দরুন। এসময় মার্চ, ১৩১১ সনে, সম্রাট দান্তেকে তুসকানের নিকটবর্তী অর্ণোর ঝর্ণার নীচের একটি এলাকা বসবাসের জন্যে দেন।

১৩১২ সনে সম্রাট ৭ম হেনরী ব্লাক গুয়েল্ফদের উৎখাত করেন। এতে দান্তে আশান্বিত হন। কিন্তু ১৩১৩ সনে সম্রাটের মৃত্যুর পর তার সকল আশা-ভরসার মৃত্যু ঘটে। এসময় সম্রাট হেনরীর সামরিক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তিনি কখনও নগরে প্রবেশ করবেন না এই মুচলেকাতে তার শাস্তি কমিয়ে গৃহবন্দীতে আনা হয়। দান্তে এটা মেনে নেননি, ফলে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ তার সন্তানদের উপরও কার্যকরী বলে ঘোষিত হয়।

১৩১৫ সনে উগুসিওনে ডেলা ফাগিওলা নামক যে সামরিক অফিসার নগর নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, তিনি দান্তে সহ সকল নির্বাসিতদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। অবশ্য এর জন্যে প্রত্যেককে নির্ধারিত অর্থদন্ড দিতে হবে বলে ঐ ঘোষণায় জানান হয়েছিল। কিন্তু দান্তে এই অর্থদন্ড না দিয়ে নির্বাসনে থাকাই শ্রেয় বলে বিবেচনা করেন। যদিও তিনি আশা প্রকাশ করতেন একসময় ব্লাক গুয়েল্ফগণ তাকে সম্মানের সাথে ফ্লোরেন্সে আমন্ত্রণ জানাবে, যদিও তা আপাত: দৃষ্টিতে অসম্ভবই ছিল, দান্তে সেটাও বুঝতেন-

Se mai continga che 'l poema sacro
al quale ha posto mano e cielo e terra,
sì che m'ha fatto per molti anni macro,
vinca la crudeltà che fuor mi serra
del bello ovile ov'io dormi' agnello,
nimico ai lupi che li danno guerra;
con altra voce omai, con altro vello
itornerò poeta, e in sul fonte
del mio battesmo prenderò 'l cappello
                                                       —( Paradiso, XXV, 1–9)

১৩১৮ সনে প্রিন্স গুইডো নভেলো ডা পোলেন্টা দান্তেকে রাভেনাতে আমন্ত্রণ জানান। দান্তে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। অত:পর ১৩২১ সনে ভেনিসে এক ডিপ্লোম্যাটিক মিশন শেষে রাভেনাতে ফেরার পথে পথিমধ্যে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বৎসর। সম্ভবত: ভেনিসে দান্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হয়েছিলেন। যাহোক, তাকে রাভেনাতে নিয়ে এসে সান পিয়ের ম্যাগোরের চার্চে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে এই চার্চ সানফ্রান্সিসকো নামে পরিচিত।

দান্তের এক বন্ধু বার্ণার্ডো ক্যানাসিও ফ্লোরেন্সকে উৎসর্গ করে তার সমাধি ফলকে এই পংক্তিটি লেখেন-

Parvi Florentia mater amoris
"Florence, mother of little love"

-এই হল দান্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী। এই মহান ব্যক্তিটি স্মরণীয় ও বরণীয় তার ডিভাইন কমেডির জন্যে, যা বিশ্ব সাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি। মূলত: ডিভাইন কমেডি তিন খন্ডে বিভক্ত-ইনফার্নো, পুর্গাটোরিও ও প্যারাডিসো। 

ইটালিয়ান ইনফার্নো শব্দের অর্থ নরক বা পাতালপুরী, যার কথা আমরা কমবেশী সবাই জানি। এটা হচ্ছে মৃত্যুর পর শান্তি বা যন্ত্রণা ভোগের জায়গা, যেখানে মানুৃষ তাদের খারাপ কৃতকর্মের দরুণ শাস্তিভোগ করবে অনন্তকাল ধরে। মুসলিমগণ সর্বশেষ ঐশী কিতাব কোরআন মারফত নরকের নারকীয়তার কিছুটা জানে। কিন্তু আমাদের এ আলোচনা তা নিয়ে নয়, বরং এ আলোচনা দান্তে তার ইনফার্নোতে এই নরক ও তার নারকীয়তার যে ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তাই নিয়ে। 

কোন এক রাতে দান্তে নরক ভ্রমণে গিয়েছিলেন রোমান কবি ভার্জিলকে সাথে নিয়ে। ঐ ভ্রমণে ভার্জিল মূলত: দান্তের গাইড হিসেবে কাজ করেন। যাহোক, দান্তে তার নরক ভ্রমনে সেখানে যে নারকীয়তা দেখেছেন তারই রূপক বর্ণনা দিয়েছেন ইনফার্নোতে। দান্তের মতে নরকের অবস্থান পৃথিবীরই একটা অংশে। 

দান্তে প্রথমত: সমগ্র নরককে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছেন। ক. নরকের উর্দ্ধভাগ খ. নরকের নিম্নভাগ ও গ. নরকের কেন্দ্রভাগ।

ক. নরকের উর্দ্ধভাগ: এখানে মূলত: অসংযমী পাপের শাস্তি ভোগের স্থান। এই পাপগুলো মূলত: দেহগত অর্থাৎ অসংযত দৈহিক কামনা, বাসনা ও আবেগ থেকে এগুলোর উৎপত্তি। বলা যায় এ সেই ধরণের পাপ যেগুলো অন্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি, ক্ষতিগ্রস্থ করেছে কেবল ব্যক্তির নিজের। এখানে বেশ কিছু দৈত্যকার প্রহরী রয়েছে, যাদের দায়িত্ব হল- যখনই কোন আত্মা এখনে এসে পৌঁছে, তখন তাকে নির্ধারিত শাস্তির স্থানে পৌঁছে দিয়ে শাস্তিভোগ করানো। এই অংশটি বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যেমন-

দান্তে চিত্রিত নরক।
১. ভেস্টিবুলা: এটি আসলে অপেক্ষার স্থান-ওয়েটিং এরিয়া। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: নিরপেক্ষ। তারা দুনিয়াতে না খোদার পক্ষে না শয়তানের পক্ষে ছিল। অর্থাৎ পাপ বা পূণ্যের কোনটিই তারা অর্জন করেনি বা অর্জন করলেও তা সমান সমান। তাই বলে তারা একেবারে শাস্তিমুক্ত নয়। আত্মাগুলো এখানে পোঁকা-মাকড় দ্বারা দংশিত অথবা নিয়ত তাড়িত হয়। এই অপেক্ষার স্থানের পরেই রয়েছে দান্তের বিভক্তি অনুসারে নরকের বৃত্তাকার নয় স্তরের শাস্তির প্রথম পাঁচটি স্তর।

১ম সার্কেল-: এই এলাকার নাম লিম্ব বা নরকের প্রান্তবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদেরই যারা ছিল ধর্মচারী পূজারী, কবি, দার্শণিক, বিজ্ঞানী বা সেইসব শিশু যাদেরকে বাপ্তিষ্ম করা হয়নি। এখানকার শাস্তি হল এক ধরণের বিষন্নতা ও হতাশা কারণ তারা খোদাকে জানতে বা চিনতে পারেনি। এখানে রয়েছে সবুজ প্রান্তর এবং একটি দূর্গ, যার সাতটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে যা প্রতিনিধিত্ব করছে সাতটি গুণের। এই দূর্গ প্রকৃতপক্ষে অনাদিকাল থেকে আগত জ্ঞানী-গুণিদের বসবাসের জন্যে। এখানে দান্তের সঙ্গে দেখা হয়েছে- কবি হোমার, হোরাস, অভিড ও লুকান; আমাজান রানী পেন্থেসিলা, গণিতজ্ঞ ই্উক্লিড, বিজ্ঞানী পেডেনিয়াস ডায়োসকরিডস, রাজ্য মুখপাত্র সিসেরো, প্রথম ডাক্তার হিপোক্রেটস; দার্শণিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটল, ও অ্যাভেরোস; ঐতিহাসিক চরিত্র লুক্রেশিয়া, লুসিয়াস, জুনিয়াস, ব্রুটাস ও জুলিয়াস সিজার; পুরাণ চরিত্র হেক্টর, ইলেক্ট্রা, ক্যামিলা, ল্যাটিনাস ও অর্ফিয়ূস; এবং আরো অনেকের সাথে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি এখানে ক্রুসেডার গাজী সালাউদ্দিনকেও দেখেছেন।  

২য় সার্কেল: এই এলাকার নাম লাস্ট বা কামনা-বাসনা। এটা লিম্বর পরবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদেরই যারা ছিল দুনিয়াতে প্রচন্ড কামনা-বাসনা তাড়িত। এখানকার শাস্তি হল চিরন্তন প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া দ্বারা ক্রমাগত আগে-পিছে উদ্দেশ্যহীন তাড়িত হওয়া। দান্তের সঙ্গে এখানে দেখা হয়েছে সেমিরামিস, ডিডো, ক্লিওপেট্রা, ট্রয়ের হেলেন, আকিলিস, প্যারিস, ত্রিস্টান ও অন্যান্যদের, যারা দুনিয়াতে কামনা-বাসনার দ্বারা তাড়িত ছিল বা বলা যায় যৌনতার মধ্যে তারা তাদের জীবনকাল অতিবাহিত করেছে। অন এ ড্রিম-কবিতায় জন কিটস সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এখানকার শাস্তি-

“... But to that second circle of sad hell,
Where ‘mid the gust, the whirlwind, and the flaw
Of rain and hail-stones, lovers need not tell
Their sorrows. Pale were the sweet lips I saw,
Pale were the lips I kiss’d, and fair the form/span
I floated with, about that melancholy storm.”

৩য় সার্কেল: এই এলাকার নাম গ্লুটোন বা ভোজনবিলাস। এটা লাস্টের পরবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদের যারা দুনিয়াতে প্রচন্ড স্বার্থপর, মাত্রাতিরিক্ত ভোজনবিলাসী এবং অন্যান্য আসক্তির মধ্যে এমনভাবে জীবন-যাপন করেছে যে, তারা জীবনবোধ সম্পর্কে সারাটা জীবন ছিল অনূভূতিহীন। এখানকার শাস্তি হল, লাঞ্ছিত অবস্থায় অনুভূতিহীন হয়ে থাকা অর্থাৎ অস্বস্তিকর ঘৃণ্য পরিবেশে দৃষ্টিহীন অবস্থায়, পাশের জনের প্রতি অমনোযোগী হয়ে নোংরা মল-মূত্রের মধ্যে শুকরের মত বসবাস। এখানকার এই পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে অবিরত মল-মূত্রের তুষারপাত দ্বারা বা বলা যায় বৃষ্টির মত ঝরিয়ে। এই এলাকার প্রহরী হল বৃহৎ কীট সদৃশ ভয়ংকর সার্বেরুস। 

৪র্থ সার্কেল: এই এলাকার নাম গ্রীড বা লোভ-লালসা। এটা গ্লুটোনের পরবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো তাদেরই যারা দুনিয়াতে সম্পদের প্রতি ভয়ানক আকৃষ্ট ছিল অর্থাৎ তারা ছিল হয় প্রচন্ড অর্থলোভী নতুবা প্রচন্ড বেহিসেবী। আর তাই এ্ই আত্মাগুলো দু’দলে বিভক্ত- অর্থলোভী ও অমিতাচারী। ১ম দল হল পাদ্রীবর্গ, পোপগণ, কার্ডিনালগণ ও অন্যান্যরা যাদের আয়ত্বে সম্পদ ছিল এবং ২য় দল তারাই যারা অর্থ-সম্পদের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে। এখানকার শাস্তি হল মূলত: অহেতুক শ্রম যেমন, বিশাল পাথরখন্ড লক্ষ্যহীন ঠেলতে থাকা যা তাদের নিকটবর্তীদেরকে হতাশায় নিমজ্জিত করবে, কেননা এর কোন শেষ নেই। বা বলা যায় দু’দল একে অন্যের সঙ্গে এমনভাবে মল্লযুদ্ধে রত যাতে তারা হাতিয়ার হিসেব ব্যবহার করছে অতিভারী পাথরখন্ড যা তারা বুক দিয়ে ক্রমাগত ধাক্কাচ্ছে। এই দু’দলের পাহারায় যাকে নিয়োজিত করা হয়েছে তাকে দান্তে চিত্রিত করেছেন প্লুটাস রূপে যিনি গ্রীক সম্পদের দেবতা এবং অন্ধকার জগৎ তথা যমপুরীর শাসক। এখানকার এই শাস্তি দান্তে এভাবে চিত্রিত করেছেন-

"… I saw multitudes
to every side of me; their howls were loud
while, wheeling weights, they used their chests to push.
They struck against each other; at that point,
each turned around and, wheeling back those weights,
cried out: Why do you hoard? Why do you squander?' "
                                   —Inferno, Canto VII (25-30)

৫ম সার্কেল: এই এলাকার নাম এ্যাংগার বা ক্রোধ। এটা গ্রীডের পরবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদেরই যারা দুনিয়াতে গোমড়া মুখো ছিল অর্থাৎ যারা খোদা, মানুষ ও মহাবিশ্বের মধ্যে কোথাও কোন আনন্দ খুঁজে পায়নি। এই আত্মাগুলোকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে পঙ্কিল জলাভূমিতে যার পানি স্টাইক্স নদীর মত কর্দমাক্ত। তারা সেখানে একে অপরের সাথে নিরন্তন লড়ে যাচ্ছে এমনভাবে, যেন তারা অতীতের রাগ ও ক্ষোভের প্রশমন করছে- প্রচন্ড হতাশার মধ্য দিয়ে। আর কর্দমাক্ত পানির নীচ থেকে উঠে আসছে বাতাসের বুদ্বুদ যা তাদের ঐসমস্ত কর্ম প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে। দান্তে ও ভার্জিলকে ফলিগিয়াস তার ডিঙ্গি নৌকাতে করে এই জলাভূমি পার হতে সাহায্য করেন। এই ফলিগিয়াস ছিলেন গ্রীক পুরাণ অনুসারে ল্যাপ্থিসের রাজা। অন্যদিকে জলাভূমির অপর পারে নৌকা ঘাটে বাঁধতে সাহায্য করেন ফিলিপ্পো আর্জেন্টি, ফ্লোরেন্সের ঐ কৃষ্ণাঙ্গ গুয়েল্ফ, যে দান্তের নির্বসনের সময় তার সকল সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল।

২. নরকের নিম্নভাগ: এই এলাকাকে ডিস নগরের সাথে তুলনা করা চলে। এটির চারিদিকের প্রহরায় রয়েছে পতিত ফেরেস্তাগণ, যারা আদমকে সিজদায় অস্বীকার করার সময় ইবলিসের পক্ষ নিয়েছিল। যাহোক, এই এলাকাটি দুনিয়াতে যারা নিছক আসক্তিতে নিমজ্জিত ছিল তাদের জন্যে নয়, বরং বলা চলে, এটি তাদের জন্যে নির্ধারিত যারা জ্ঞানপাপী। ভার্জিল তাদেরকে এলাকাটিতে প্রবেশ করতে দিতে প্রহরীদের সম্মত করাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এতে ঐ সময় নরকে শাস্তিদাত্রী দেবীগণ, ধরিত্রী মাতা গেয়ার তিন কন্যা, আলেক্টো, মেজেরা ও টিসিফোন প্রবেশ করতে দিতে অসম্মত হয় এবং মেডুসা তো হুমকিই দিয়েছিল। নরকে গেয়ার কন্যাত্রয়ের কাজ মূলত: মানুষের নৈতিক পাপের (আলেক্টো ক্রোধের, মেজেরা প্রতিহিংসার ও টিসিফোন ঈর্ষার) শাস্তি দেয়া। যাহোক, ঐ সময় স্বর্গ থেকে এক ফেরেস্তা নেমে এসে প্রবেশে বাঁধাদানকারীদেরকে তিরস্কার করে তাদেরকে নিরাপদে সেখানে প্রবেশে সাহায্য করে। দান্তের বর্ণনায় এই এলাকাটিতে দৈত্যকার প্রহরীদের ভীড় বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। যা হোক, এই অংশটিতে রয়েছে দান্তের বিভক্তি অনুসারে নরকের শাস্তির-৬ ও ৭ স্তর।

৬ষ্ঠ সার্কেল: এই এলাকার নাম হেরেসি যা ক্রোধীয় শাস্তির পরবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদেরই যারা ছিল বৈধর্মী বা ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী। এখানকার শাস্তি হল, প্রজ্জলিত কবরের মধ্যে ফাঁদে আঁটকে রাখা। দান্তে এখানে ইপিকুরিয়ান্সের দেখা পান যিনি দাবী করেছিলেন যে, শরীরের সাথে সাথে আত্মারও মৃত্যু ঘটে; দেখা হয় ফারিনাটা দেগলি উবার্টি -একজন ঘিবিলাইনের সাথে, যিনি তার মৃত্যুর পরে ১২৮৩ সনে বৈধর্মীর জন্যে নিন্দিত হয়েছিলেন। আরও দেখা হয়েছিল এপিকুরাস, সম্রাট ২য় ফ্রেডারিক ও পোপ ২য় আনাস্টাসিয়াস, প্রভৃতির সঙ্গে।

৭ম সার্কেল: এই এলাকার নাম ভায়োলেন্স যা বৈধর্মীয় শাস্তির পরবর্তী এলাকা। পুরো এলাকাটি উৎকট গন্ধে ভরপুর। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদেরই যারা দুনিয়াতে সহিংসতায় লিপ্ত ছিল। এলাকাটি তিনটি বৃত্তীয় রিং এ বিভক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি বৃত্তীয় রিং এর শাস্তি একেক রকম সহিংসতার ভিন্নতায়। যেমন-

১ম বৃত্তীয় রিং: এখানকার আত্মাগুলো পরিচিত ও অপরিচিত জনের বিরুদ্ধে সহিংসতার অপরাধে অপরাধী। এদের শাস্তি হল ফুটন্ত রক্তের নদীর মধ্যে ডুবিয়ে রাখা। হত্যার সংখ্যার উপর নির্ভর করে আত্মাগুলো এই রক্ত নদীর বিভিন্ন গভীরতায় থাকবে। গ্রীক পুরাণের সেন্টাউরস, যার অর্ধ শরীর মানবের ও বাকী অর্ধ অশ্বের, রয়েছে এদের পাহারায়। কেউ স্থান পরিবর্তন করতে চাইলে সে তার চারিদিকে অগ্নিবলয় সৃষ্টি করে বা তাকে তীর নিক্ষেপে বিরত রাখে। মহাবীর আলেকজান্ডারকে ভ্রু পর্যন্ত রক্তের মধ্যে সেখানে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। দান্তে এখানে আরও দেখেছেন সিরাকুজের ১ম ডায়োনিসিয়াস, আজ্জোলিনো ডা রোমানো, গাই ডা মনফোর্ট, ওবিজ্জো ডস্টে, ইজ্জেলিনো ৩য় ডা রোমানো, রিনিয়ের দ্যা কর্নেটো, ও রিনিয়ের পাজ্জোকে।

২য় বৃত্তীয় রিং: এখানকার আত্মাগুলো নিজেদের উপর সহিংসতা করেছিল অর্থাৎ এরা আত্মহত্যাকারী বা এরা লম্পট ছিল। আত্মহত্যাকারীদের শাস্তি হল, তাদের আত্মাগুলো চলৎশক্তিহীন বস্তু তথা কাঁটাওয়ালা ঝোপ বা গাছের মধ্যে ফাঁদে আঁটকে থাকবে। আর কাছেই, তাদের দৃষ্টির সম্মুখে থাকবে তাদের পরিত্যক্ত নির্জীব শরীর। আর সেইসব লম্পট যারা তাদের অর্থ ও সম্পদ অনাচারে অপব্যবহার করেছিল; তাদের আত্মাগুলোকে সেখানে তাড়িত করতে থাকবে ভয়ংকর একদল কুকুর। দান্তে এখানে দেখা পান পিয়েত্রো ডেলা ভিগনে, লানো ডা সিয়েনা ও জ্যাকোপো ডা সান্ট আন্দ্রেয়ার।

৩য় বৃত্তীয় রিং: এখানকার আত্মাগুলো দুনিয়াতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত ছিল। খোদা ও তাঁর ধর্মের বিরুদ্ধে কুৎসাকারী, পুরুষ-পুরুষে যৌনমিলনকারী, সুদখোররাও এদের অন্তর্ভূক্ত। এদের শাস্তি হল এদের আত্মাগুলো একটা মরুর উত্তপ্ত রালুর উপর থাকবে। আর তাদের উপর বর্ষিত হতে থাকবে অগ্নি, এক ধরণের অপ্রাকৃতিক মেঘ থেকে। অর্থাৎ বলা যায় এদের উপর অবিচ্ছিন্নভাবে ঘটতে থাকবে তেমনই, যেমনটা ঘটেছিল সদোম ও ঘমোরাবাসীদের উপর। দান্তে এখানে দেখা পান ক্যাপানিয়াস, ব্রুনেটো ল্যাটিনি, ল্যাকোপো রুস্টিকুসি, ক্যাটেল্লো ডি রসো গিয়ানফিকলিয়াজ্জি, গুইডো গুয়েরা, সিয়াপ্পো উর্বিয়াসি, গিয়োভান্নি ডি বুইয়ামন্টে, রিজিনাল্ডো ডেগলি স্ক্রোভেগনি ও ভিটালিয়ানো ডি ল্যকোপো ভিটালিয়ানি।  আর সুদখোরদের এই পরিণতির ব্যাপারে দান্তে বলেন- 
"From these two, art and nature, it is fitting,
if you recall how Genesis begins,
for men to make their way, to gain their living;
and since the usurer prefers another
pathway, he scorns both nature in herself
and art her follower; his hope is elsewhere." 
                               —Inferno, Canto XI, (106-111)

৮ম সার্কেল: এই এলাকার নাম ফ্রড যা ভায়োলেন্স বা সহিংসতার শাস্তির পরবর্তী এলাকা। এখানকার আত্মাগুলো মূলত: তাদেরই যারা দুনিয়াতে প্রতারণা, জালিয়াতি বা বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত ছিল। এই এলাকাটি দান্তে ও ভার্জিল ভ্রমন করেছিলেন তিন মাথাওয়ালা পাখাবিশিষ্ট দানব জেরিয়নের পিঠে চড়ে। এই দানবটি গঠিত মানব, পশু ও সরীসৃপের সমন্বয়ে। পুরো এলাকাটি দশটি বৃত্তাকার পাথুরে খাদের পরিখায় বিভক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি পরিখার শাস্তি একেক রকম, প্রতারণার ভিন্নতায়। যেমন-

পরিখা-১: এখানে রয়েছে কূটনাকারী ও প্রলোভনকারীগণ এবং তারা ভিন্ন্ সাঁরিতে বিপরীত দিকে তাড়িত হচ্ছে ডেভিল বা দানব দ্বারা নিরন্তন বেত্রাঘাতের সাথে। কূটনাকারীদের মধ্যে দান্তে দেখতে পান ভেনেডিকো কাকসিয়ানমিকো যে তার নিজ ভগ্নিকে মার্কিজ ডস্টের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আর প্রলোভনকারীদের সাঁরিতে ছিল গ্রীক পুরাণের জেসন, যে প্রলোভিত করেছিল মিদিয়া এবং হাইপসিপাইলকে। আর হাইপসিপাইলকে তো সে গর্ভবতী অবস্থায় একাকী পরিত্যাগও করেছিল। 

পরিখা-২: এখানে রয়েছে ফ্লাটারার্স তথা তোষামোদকারীগণ। এরা মুখের কথা দিয়ে মানুষকে শোষণ করত। এদেরকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে মানুষের মল-মূত্রের মধ্যে। দান্তে এখানে দেখতে পান লুক্কার আলেসিও ইন্টারমিনেই ও থাইসকে। এই থাইস ছিল আলেকজান্ডারের সেনাপতি টলেমি ১ম সোটারের প্রেমিকা, যে পর্সিপোলিস পুড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করেছিল। 

পরিখা-৩: এখানে রয়েছে সিমোনিস্টসগণ। এরা চার্চের সেইসব কর্মকর্তা যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে অর্থাৎ যাজকপদ পেতে ঘুষের আদান-প্রদান করত অথবা চার্চ অফিস ক্রয়-বিক্রয় করত। সিমোন মগুসের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে। এই সিমোন সেইন্ট পিটারকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়েছিল ঐশী ক্ষমতা পাবার লোভে। এদেরকে পাথুরে গর্তে মাথা ঢুকিয়ে উর্দ্ধপদে রেখে তাদের পায়ের তালুকে প্রজ্জলিত করা হয়েছে। সিমোন ছাড়াও দান্তে এখানে দেখতে পান পোপ ৩য় নিকোলাস, পোপ ৮ম বেনিফেস ও পোপ ৫ম ক্লিমেন্টকে।

পরিখা-৪: এখানে রয়েছে সুথসায়ারগণ অর্থাৎ জাদুকর, গণক ও ভন্ড নবীগণ। এদের মাথা মুচড়িয়ে মুখ পশ্চাৎদিকে করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা কেবল তাদের পশ্চাৎ দিকটাই দেখতে পায় সম্মুখের কোনকিছু নয়। দান্তে এখানে অন্যান্যদের মধ্যে দেখতে পান অ্যাম্ফিয়ারুস, টায়ারেসিয়াস, মান্টো, অরুণস, মাইকেল স্কট, আলবার্তো ডে ক্যাসালোডি,ও গুইডো বোনাটিকে।

পরিখা-৫: এখানে রয়েছে ব্যারেটার্স বা দূর্ণীতিগ্রস্থ রাজনীতিকগণ। এরা সরকারী কর্মকর্তা, উকিল ও বিচারক যারা ঘুষ গ্রহন করত। এদেরকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে ফুটন্ত পীচ বা আলকাতরার হ্রদে। আর তাদের পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে মেলব্রাঙ্ক নামের এমন সব ডেভিল যাদের রয়েছে অশুভ নখর। কেউ হ্রদের তীরে উঠতে চাইলে এরা তাকে তাদের নখরে বিদ্ধ করে ছুড়ে ফেলে হ্রদের মধ্যে। দান্তে ও ভার্জিলকে এই হ্রদ পার করে দেয় মেলব্রাঙ্কদের নেতা মেলাকোডা তার এক ছোটখাট বাহিনী নিয়ে।

পরিখা-৬: এখানে রয়েছে হিপোক্রেটস অর্থাৎ ভন্ড, মুনাফেকগণ। এরা ভারী সীসার বর্ম পরিধান করে ইতস্তত: ঘুরে বেড়াচ্ছে। দান্তে এখানে দেখা পান কাটালানো, লোডেরিংগো, পোপ ৫ম সিক্সটাস ও কাইফাকে। এই কাইফা জেসাসকে ক্রুসবিদ্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন। এখানে তাকে মাটিতে ক্রুসবিদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং অন্যরা তাকে পদদলিত করছে।

পরিখা-৭: এখানে রয়েছে থিভস ও রবার্স অর্থাৎ চোর-ডাকাতগণ। আর এদের পাহারায় রয়েছে ককাস। রোমান পুরাণ থেকে আমরা জানি এই ককাসের কাঁধে রয়েছে এমন এক ড্রাগন যার নিশ্বাসে আগুন ঝরে, আর তার অশ্ব সদৃশ পিঠে রয়েছে সাপের দঙ্গল। এখানকার অধিবাসী আত্মাদেরকে রাখা হয়েছে এমন একটা গর্তে, যেখানে রয়েছে ভয়ংকর সব সাপ ও গিরগিটি। যখনই কোন সাপ বা গিরগিটি এদেরকে ছোবল মারে তখনই তাদের শরীর বিভিন্ন আকারে পরিবর্তিত হয়। ফলে এদেরকে দেখা যাচ্ছে কেউ অর্ধ মানব ও অর্ধ সর্প বা অন্য কোন রূপ। ড্রাগনের ছোবলে কেউ ছাই হয়ে গেলে আবার সে পুনরুত্থিত হচ্ছে। আবার ঐ অর্ধ মানব ও অর্ধ সর্প সদৃশ দেহকে কোন সাপ ছোবল মারলে তাদের ঐ অংশ সর্প সদৃশ হলে তা মানবের রূপ নিচ্ছে আর মানব সদৃশ হলে তা সাপের রূপ ধারণ করে। 

W. Blake's illustration of
Dante's depiction of Prophet Muhammad.
পরিখা-৮: এখানে রয়েছে ইভিল কাউন্সিলর্স অর্থাৎ কূ-পরামর্শ দাতাগণ। এরা দুনিয়াতে কেবল অসৎ উপদেশই দেয়নি, বরং এরা তাদের পদাধিকার বলে অন্যকে জালিয়াতে প্ররোচিত করেছিল। এদেরকে আগুণের লেলিহান শিখার মধ্যে প্রজ্জলিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। দান্তে এখানে অন্যান্যদের মধ্যে দেখতে পান উলিসিস ও ডায়োমেডিসকে। এরা ট্রয় নগরী ধ্বংসের জন্যে ট্রোজান অশ্ব তৈরীর পরামর্শ দিয়েছিল।

পরিখা-৯: এখানে রয়েছে সোয়ার্স অফ ডিসকর্ড অর্থাৎ বিরোধ ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীগণ। এরা নিজেদের বুক চিরে অতীত কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করছে। দান্তে নবী মুহম্মদকে খৃষ্টধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করে এখানে স্থান দিয়েছেন (মধ্যযুগে খৃষ্টানদের এমনই মানসিকতা ছিল। তারা ঐ সময় সত্যের শক্তিতে দিশেহারা হয়ে এভাবেই স্বজাতি ও স্বধর্মাবলম্বীদের কাছে নবী মুহম্মদকে উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে মুহম্মদের স্থলে যিশুখৃষ্টকেই দোযখের এই স্থানে দেখানোর কথা দান্তের। এ কারণে যে, যিশু ছিলেন ইহুদি এবং তিনি ইহুদি ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী। আর যিশু নিজেও তাই বলেছেন- ”Do you think I came to bring peace on earth? No, I tell you, but division”.-Luke, 12:52. এছাড়াও যিশুর সকল শিষ্য ছিলেন ইহুদি এবং তার উর্দ্ধারোহণের পূর্ব পর্যন্ত ইহুদি ছাড়া একজনও তার ধর্ম গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে মুহম্মদের জন্ম পৌত্তলিকদের মাঝে, আর তার প্রচার ছিল পৌত্তলিক, খৃষ্টান, ইহুদি, পার্শী ইত্যাদি সকল মানুষের মাঝে। আরও মজার ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে, দান্তে এমন সময় এভাবে মুহম্মদকে চিত্রিত করেছেন যখন মুহম্মদের অনুসারীগণ কেবলমাত্র সত্যের শক্তিতে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের ক্রুস ছিনিয়ে নিয়ে প্যাকেট করে পুনরায় ইউরোপে ফেরৎ পাঠিয়েছে।)। কেননা দান্তের দৃষ্টিতে ইসলাম হচ্ছে খৃষ্টধর্মের বিকৃতরূপ। এভাবে দান্তে আলীকেও এখানে দেখিয়েছেন, কেননা তার বিশ্বাস আলী মুসলিমদের মধ্যে শিয়া ও সুন্নীর বিভেদ এনেছেন। দান্তের বর্ণনা-

"A cask by losing centre-piece or cant 
Was never shattered so, as I saw one 
Rent from the chin to where one breaketh wind. 

Between his legs were hanging down his entrails; 
His heart was visible, and the dismal sack 
That maketh excrement of what is eaten. 

While I was all absorbed in seeing him, 
He looked at me, and opened with his hands 
His bosom, saying: "See now how I rend me; 

How mutilated, see, is Mahomet; 
In front of me doth Ali weeping go, 
Cleft in the face from forelock unto chin; 

And all the others whom thou here beholdest, 
Disseminators of scandal and of schism 
While living were, and therefore are cleft thus. 

A devil is behind here, who doth cleave us 
Thus cruelly, unto the falchion's edge 
Putting again each one of all this ream, 

When we have gone around the doleful road; 
By reason that our wounds are closed again 
Ere any one in front of him repass."  - Canto 28. 

এখানে আরো দেখান হয়েছে বার্ট্রান ডে বর্নকে। এই বার্ট্রান হেনরী দি ইয়ং কিংকে প্ররোচিত করেছিলেন তার পিতা ২য় হেনরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে।

পরিখা-১০: এখানে রয়েছে ফলসিফায়ার্স অর্থাৎ অপরসায়নবিদ, নকল বা ভেজালকারী, মিথ্যেবাদী বা মিথ্যে শপথকারী ও হাতুড়ে ডাক্তারগণ। যেমন কর্ম তারা করেছে তেমনি ফল তারা পাচ্ছে এখানে। এরা ছিল রোগ, যা নগরবাসীদের ধ্বংস এনেছিল। আর তাই এদের কেউ পাগল অবস্থায়, কেউ কুষ্ঠরোগ নিয়ে, কেউ ভয়ংকর কোন জ্বর নিয়ে সেখানে রয়েছে। নবী ইউসূফের বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দেয়ায় এখানে রয়েছে জুলেখা। রয়েছে সিনোন, সে ট্রোজান অশ্বকে তাদের শহরে নিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিল। তার এই উপদেশ ছিল মিথ্যে ও অশুভ। এ কারণে সে শাস্তি পাচ্ছে ভয়ানক এক জ্বরে। এখানে আরও রয়েছে গ্রীক পুরাণের মীরা, যে তার পিতার সাথে সহবাস করার পর গাছে পরিণত হয় এবং জন্ম দেয় আদোনিসকে। সে এখানে রয়েছে বিকারগ্রস্থ, উন্মাদ অবস্থায়।

৩. নরকের কেন্দ্রভাগ: এখানে রয়েছে নরকের শাস্তিও কেবল একটি স্তর সার্কেল-৯। চরম শৈত্যের স্থান এটি। পুরো এলাকার চারিদিক বেষ্টন করে অনেকগুলি ভীষণাকার দৈত্য রয়েছে প্রহরীরূপে। এদের কেবল কোমর থেকে উর্দ্ধাংশ দৃশ্যমান।

৯বম সার্কেল: পুরো এলাকাটিকে চারটি সমকেন্দ্রিক এলাকাতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-

১ম রাউন্ড: এটির নাম কায়না, আদমের পুত্র কেইন বা কাবিলের নামানুসারে, যে তার ভ্রাতা হাবিলকে হত্যা করে দুনিয়ার প্রথম খুনটি সংঘটিত করেছিল। কাবিল ছাড়াও এখানে অন্যান্য দ্রোহীদের মধ্যে আরও রয়েছে মর্ড্রডে। মর্ড্রডে তার পিতা কিং আর্থারকে আক্রমণ করেছিল। এদের শাস্তি হল মুখাবয়র পর্যন্ত বরফের মধ্যে ডুবে থাকা।

২য় রাউন্ড: এটির নাম এ্যান্টেনোরা, ট্রয়ের এ্যন্টেনোরের নামানুসারে, যে তার নিজ নগরবাসীদের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এ্যন্টেনোর ছাড়াও এখানে আরও রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকগণ, দলের, শহরের বা দেশের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতাকারীগণ। ১ম রাউন্ডের মতই এদের শাস্তি, আর তা হল মুখাবয়র পর্যন্ত বরফের মধ্যে ডুবে থাকা।

৩য় রাউন্ড: এটির নাম টলেমিয়া, আবুবুসের পুত্র টলেমির নামানুসারে, যে সিমোন ম্যাকাবিয়াস ও তার সন্তানদের একটা ভোজে নিমন্ত্রণ করে এনে সকলকে হত্যা করেছিল। এদের শাস্তি পূর্ববর্তীদের থেকেও বেশী, কারণ এরা দূত ও অতিথিদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মুখাবয়ব ছাড়া শরীরের বাকী অংশ তাদের চরম শীতল বরফের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। টলেমি ছাড়াও এখানে অন্যান্যদের মধ্যে আরও রয়েছে ফ্রাঁ আলবেরিগো, যে তার রক্ষীদের দিয়ে নিজ ভ্রাতাকে ভোজেরত অবস্থায় হত্যা করেছিল।

নরকের কেন্দ্রে বরফের ফাঁদে শয়তান
৪র্থ রাউন্ড: এটির নাম জুদেকা, জুদাস ইস্কেরিয়ত। এই জুদাস যিশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এদের শাস্তি হল সম্পূর্ণ বরফের মধ্যে আপদমস্তক ডুবে থাকা।

নরকের একদম কেন্দ্রে রয়েছে শয়তান ইবলিস। সে খোদার বিরুদ্ধাচারণ করেছিল। তাকে এখানে রাখা হয়েছে বীভৎস দানব হিসেবে। তার তিনটি মুখ, একটি লাল, একটি কাল ও অপরটি ধূসর হলুদ। তিন মুখ দিয়ে সে চাবাচ্ছে জুদাস, ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসকে। তার কোমর পর্যন্ত বরফে ডোবানো, ছয়চক্ষু দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে, আর সে তার বাঁদুরের ন্যায় ছ’টি ডানা দিয়ে নিরন্তন ব্যর্থ চেষ্টা করছে মুক্ত হতে। কিন্তু প্রবল শৈত্য প্রবাহ যেন তাকে আরও জেঁকে ধরছে। দান্তে শয়তানের এই রূপকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-

He had three faces: one in front bloodred;
and then another two that, just above
the midpoint of each shoulder, joined the first;
and at the crown, all three were reattached;
the right looked somewhat yellow, somewhat white;
the left in its appearance was like those
who come from where the Nile, descending, flows. 
                                      —Inferno, Canto XXXIV, (39-45)
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
পাঠকদের কেউ প্রশ্ন করেন না। তাই আমিই তাদের কাছে প্রশ্ন রাখলাম- 
  • কেন দান্তে সুদখোরকে “প্রকৃতির বিরুদ্ধে সহিংসতা”-র মধ্যে ফেলেছেন? 
  • কেন তিনি সডোমিকে লাস্ট থেকে ভিন্ন জাতীয় পাপ হিসেবে পৃথক করেছেন? 
  • কেন সার্কেল-৯ বরফীয় যখন অন্যান্য সকল সার্কেলগুলি গরমের? 
  • কেন দান্তে শয়তানের তিন মাথা কল্পনা করেছেন? 
ধন্যবাদ।

ছবি: উ
ইকিপিডিয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...