ঈমাম বুখারী ৬ লক্ষের মত হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন। তার মধ্যে তিনি ৯৯ শতাংশ হাদিস বর্জন করেন। তার নিজস্ব “ব্যক্তি গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি”তে হাদিস সাব বর্ণনাকারীগণ বাদ পড়াতে তাদের বর্ণিত হাদিসগুলোও বর্জিত হয়। তবে মূল বর্ণনাকারী অথাৎ সাহাবীদের কাউকেও তিনি বর্জন করেননি, যদিও অনেক সাহাবী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য রসূলুল্লাহর সময়ও ছিল। এমনই একজন সাহাবা আবু হুরায়রা। তার বর্ণিত ৪৪৬টি হাদিস বুখারী শরীফে স্থান পেয়েছে।
আবু হুরায়রার বংশ-পরিচয় পরিস্কার নয়। তার জন্ম, জন্মস্থান ও বংশধারা সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা এই যে, তার জন্ম ইয়েমেনের লোহিত সাগরের উপকূলস্থ তিহামা অঞ্চলের বাহাতে, দাউস বংশের আযদ গোত্রের বনি সুলায়েম উপগোত্রে, ৬০৩ সনের দিকে। তার প্রকৃত নাম আবদ আল-রহমান ইবনে সখর আল-আযদি বলে ফিকহ ও হাদিসবেত্তা আল-নওয়াবী উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, হুরায়রার পিতা ছিলেন ওমায়ের বিন আমের এবং মাতা ওমায়মা বিনতে সুফেহ।
আরবীতে, হির্রা অর্থ বিড়াল এবং হুরায়রা অর্থ বিড়াল ছানা। ইবনে কুতায়বা, তার নাম কিভাবে আবু হুরায়রা হল, সে সম্পর্কে হুরায়রার নিজের এই উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “আমার এমন নামকরণের কারণ, ছোট একটা বিল্লির সঙ্গে আমি সবসময় খেলা করতাম।”
অবশ্য ইবনে সা’দ, হুরায়রার ভিন্ন এক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমন- “আমি ভেড়া চরানোর কাজ করতাম, আর আমার ছিল একটা ছোট বিল্লি। রাতের বেলা আমি তাকে গাছে তুলে দিতাম, আর সকালে তাকে নামিয়ে নিয়ে তার সাথে খেলা করতাম। আর তাই লোকেরা আমাকে আবু হুরায়রা বলে ডাকত।”
আবার কোথাও কোথাও আবু হুরায়রা নামের শানে নযুল এমনও দেয়া হয়েছে- “ইসলাম গ্রহণের পর আবু হুরায়রা মসজিদে নব্বীতে এবং নবীজীর কাছে কাছে থাকতেন। আর খাওয়া-দাওয়া শেষে বিড়ালের জন্যে নিয়মিত থালায় কিছু অবশিষ্ট রাখা তার অভ্যাস ছিল। এভাবে মসজিদের আশেপাশে বিড়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর হুরায়রাও তাদের সাথে খেলা করতে পছন্দ করতেন। এতে তিনি আবু হুরায়রা উপাধি পান।”
ফিরোজ আবাদি তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন- “হুরায়রার তার বিড়াল প্রীতি এবং তার সাথে খেলা করার অভ্যাস, ইসলাম গ্রহণের পরও বজায় রেখেছিল, যে পর্যন্ত না নবীজী তার বিড়ালকে তার জামার অস্তিনে লুকিয়ে রাখতে দেখতে পান।”
হুরায়রার বাল্যকাল কিভাবে কেটেছে সে সম্পর্কে শেখ আহমেদ তার কিতাবে হুরায়রার এমন উদ্ধৃতি দিয়েছেন- “আমি এতিম হয়ে বড় হয়েছি। তারপর সম্বলহীন অবস্থায় আমি ভাগ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। অত:পর বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় আহার ও পরিধেয় বস্ত্রের বিনিময়ে আমি বুশরা বিনতে গাজওয়ানের নোকর হিসেবে নিয়োগ পাই....আমার কাজ ছিল যখন তারা অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে আসতেন বা কোথাও যেতেন, তখন বাদ্য ও সঙ্গীতের সাথে তাদেরকে অভ্যর্থনা করা বা বিদায় জানানো।”
আজদ গোত্র। |
ইবনে সা’দ এর তাবাকাত থেকে জানা যায়, হিজরী ৭ম সনে, ৩০ বৎসর বয়সের সময় হুরায়রা কপর্দকহীন অবস্থায় একবস্ত্রে নগ্নপদে দাউস গোত্রের কিছুলোকের সাথে মদিনায় আগমন করেন। এসময় রসূলুল্লাহ খায়বর যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। মদিনায় ফিরে নবীজী তার সঙ্গীদেরকে লব্ধ "গনিমতের মাল" থেকে একটা অংশ হুরায়রাকে দিতে বলেন এবং তারা সেইমতই করেন।
ইবনে হজর আসকালানী তার ফতেহ আল-বারীতে উল্লেখ করেছেন- আর হুরায়রা "মসজিদে নব্বী"তে থাকতে লাগলেন যেভাবে "আসহাবে সুফ্ফা"গণ থাকতেন। কেননা, তিনি ছিলেন সহায় সম্বলহীন, উপরন্তু তার পরিবার বা নিকট আত্মীয়ের অপর কেউ মদিনাতে ছিল না। তাছাড়া তিনি জানতে পেরেছিলেন আসহাবে সুফ্ফাদেরকে নবীজী আপ্যায়ন করতেন এবং অন্যান্য সাহাবীদের দ্বারাও আপ্যায়ন করাতেন।
সুফ্ফাদের প্রতি আরও একজন অতি সদয় ছিলেন, তিনি হলেন আলীর ভ্রাতা জাফর ইবনে আবু তালিব। এ কারণে তাকে “দরিদ্রের পিতা” বলেও সম্বোধন করা হত। আর তাই হুরায়রার নিকট জাফর এর পরিচয় ছিল নবীজীর পরে সর্বাধিক দয়ালু ব্যক্তি হিসেবে।
হুরায়রা সর্বদা নবীজীর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন যতটা না তার প্রতি ভালবাসায়, তার চেয়েও অধিক ছিল তার ক্ষুধা নিবৃত্তির কারণে। আর তিনি নিজেই এর সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন -“আমি তার সঙ্গ ছাড়তাম না ক্ষুধা নিবারণের জন্যেI” আর এ সম্পর্কে বুখারী, মুসলিম ও আহমদে অনেকগুলো হাদিসও রয়েছে।
আল-তিজানি সামায়ি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “হুরায়রা প্রায় তিন বৎসরকাল নবীজীর সঙ্গ লাভ করেছিলেন। অনেকের মতে এ সময়কাল এক বৎসর দশ মাস। কেননা, নবীজী তাকে আল-হাদরামীর সঙ্গী করে বাহরাইনে প্রেরণ করেছিলেন। আর তিনি নবীজীর মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।”
এই আবু হুরায়রা, ৬৮১ সন, ৫৯ হিজরীতে, ৭৮ বৎসর বয়সে মারা যান এবং তাকে “আল-বাকী”তে সমাহিত করা হয়।
নবীজীর জীবিতকালে হুরায়রার পরিচিতি তেমন একটা ছিল না। তিনি কখনও উল্লেখযোগ্য সাহাবী হিসেবেও গণ্য হননি। বর্তমানে সুন্নী মুসলিম সমাজে তার অধিক পরিচিতির একমাত্র কারণ, তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদিস বর্ণনা। কেননা, বক্তৃতা ও লেকচারে, শুক্রবারের খুৎবায় ও সেমিনারে, হাদিসের কিতাব ও সিরাতে, ফিকাহ ও ইবদাহতে, আবু হুরায়রা নামটি এসেছে এভাবে: “আবু হুরায়রার কর্তৃত্ববলে, আল্লাহ তার উপর খুশী থাকুন, যিনি বলেছেন: রসূলুল্লাহ, আল্লাহ তার উপর শান্তি ও করুণা বর্ষণ করুন, বলেন.....”।
হাদিস সংগ্রহকারীগণের সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, হাদিস বর্ণনাকারীগণের মধ্যে আবু হুরায়রাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণিত হাদিস সংখ্যা সর্বমোট ৫,৩৭৪টি বলে আল-কাস্টালানী এবং ইবনে হাযম তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আর এ সংখ্যা বিবি আয়েশা বর্ণিত হাদিসের দ্বিগুনেরও অধিক এবং চার খলিফা বর্ণিত হাদিসের সংখ্যার কয়েকগুন বেশী। জুবায়ের সিদ্দিকী বলেন, বিবি আয়েশার বর্ণিত হাদিস সর্বমোট ২২১০টি, আবু বকরের ১৪২টি, ওমরের ৫৩৭টি, ওসমানের ১৪৬টি এবং আলীর ৫৮৬টি।
মুসলিমদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষত: শিয়াগণ হুরায়রা বর্ণিত সকল হাদিস বর্জন করে থাকেন। তারা নবীজীর পরিবারের সদস্যদের হত্যায়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের সাথে তার সখ্যতা, তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে হাদিস বর্ণনা, ত্রুটিপূর্ণ ও জাল হাদিস বর্ণনাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা দৃঢ়তার সাথে বলেন, “আমরা ঐ “পেট পুজারী” আবু হুরায়রাকে বাতিল করে দিয়েছি, যে আলীর উচ্চমর্যাদা ও কর্তৃত্বভার জানা সত্ত্বেও তাকে উপেক্ষা করে কূ-চক্রী মূয়াবিয়াকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বেঁছে নেয়। আর তার খাবার টেবিলে সুস্বাদু ডিসগুলো উপভোগে রত থেকে মিথ্যে হাদিস রচনা করে চলে আলীর বিপক্ষে।”
শিয়াদের এমন দাবীর যথার্থতা কি, তা খতিয়ে দেখা একজন মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেননা কোন কিছুতে [ঈমান বাদে] অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে বরং সত্যতা যাঞ্চাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন খোদা আমাদেরকে। এমনকি তাঁর সৃষ্টি, প্রেরিত বাণীও যাঞ্চাই করা যাবে, যদিও সেগুলো ত্রুটিহীন, যেমন-
তারা (মানুষ) কি উপরের আসমানের দিকে লক্ষ্য করে না, কিভাবে আমি তাকে বানিয়েছি এবং তাকে সাঁজিয়েছি এবং তাতে কোন ফাঁক বা ফাঁটল নেই।-(৫০:৬) দৃষ্টিকে পুনরায় নিক্ষেপ কর। কোন ফাঁক দেখতে পাও কি?”-(৬৭:৩)
তারা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরীত্য দেখতে পেত।-(৪:৮২)
এখন প্রশ্ন হল- খোদা কেন তাঁর সৃষ্টি বা তাঁর প্রেরিত বাণীতে ফাঁক খুঁজে দেখতে মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন? এ এ কারণে যে, যেন ফাঁটল বা ত্রুটি খুঁজে পাওয়া বা না পাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়, আর, অবিশ্বাসীদের অবিশ্বাস আরও বৃদ্ধি পায়। [যেমন- “আর যখন ইব্রাহিম বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দেখাও কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর।’
তিনি বললেন, ‘তুমি কি এ বিশ্বাস কর না?’
সে বলল, ‘নিশ্চয় করি, তবে কেবল এ আমার মনকে বুঝ দেবার জন্যে।’-(২:২৬০)]
উদাহরণ স্বরূপ- কোন বিশ্বাসী যখন এই আয়াতগুলো দেখবে- "আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিন্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিন্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত্ত করেছি, অবশেষে তাকে এক নূতন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কতই না কল্যাণময়!"-(২৩:১২-১৬) -তখন শিহরিত হবে খোদার সৃষ্টির নৈপূণ্যতায়। অন্যদিকে অবিশ্বাসীগণ আয়াতগুলি দেখে বলবে, “এই সৃষ্টিতে তো বিকলাঙ্গ ও হিজড়াও জন্মে।” বা, “খৎনার চামড়াটি যদি কেটে ফেলতেই হবে, তবে তা দেবার দরকারই-বা কি ছিল?” ইত্যাদি।
যাইহোক, আমরা আমাদের মূল উপস্থাপনায় ফিরে আসি এবং ডিটেইল বর্ণনায় দেখার চেষ্টা করি, ঠিক কোন কোন কারণে শিয়াগণ আবু হুরায়রার সব হাদিস বর্জন করেছেন -
কারণ-১:
বিবি আয়েশার বিবাহের দশ বৎসর পর অর্থাৎ হিজরতের ৭ম বৎসরে আবু হুরায়রা মুসলমান হন। মাত্র দু’তিন বৎসর বসুলুল্লাহর সঙ্গ পেয়ে অক্ষর জ্ঞানহীন এই ব্যক্তি এত অধিক হাদিস বর্ণনা করেন কিভাবে? এখানে এই প্রশ্ন নয় তার স্মরণে রাখার মানসিক সক্ষমতা নিয়ে বরং প্রশ্ন এই যে, রসূলুল্লাহর নিকটতম এবং তার অধিক সাহচর্য পাওয়া ব্যাক্তিবর্গ (আলী, আবু বকর প্রমুখ) যেখানে বর্ণনা করেছেন সীমিত কিছু হাদিস, তবে কেন এবং কি উদ্দেশ্যে তিনি বর্ণনা করেছেন এত অধিক সংখ্যক হাদিস? কোন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে এই ব্যক্তির এতগুলো হাদিস কি গ্রহণ করা সম্ভব, যা কিনা চার খলিফা, নবীজীর স্ত্রীগণের এবং সকল হাশেমীয় পুরুষ ও স্ত্রীলোকের বর্ণিত হাদিসেরও অধিক?
অবশ্য হুরায়রার এই অধিক হাদিস বর্ণনা করার কারণ বুখারীর কিতাবেই হরায়রার হাদিস হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন- আব্দুল আজিজ ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “লোকে বলে, আবু হুরায়রা বড় বেশী হাদিস বর্ণনা করে। জেনে রাখ, কিতাবে দু’টি আয়াত যদি না থাকত, তবে আমি একটি হাদিসও বর্ণনা করতাম না।” তিনি আয়াত দু'টি বর্ণনা করলেন-
“আমি সেসব স্পষ্ট নিদর্শণ ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্যে কিতাবে তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ তাদেরকে লানত দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয় কিন্তু যারা তওবা করে এবং নিজদিগকে সংশোধন আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে, ওরাই তারা যাদের প্রতি আমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালূ।” -(২:১৫৯-১৬০)
অত:পর বললেন, “আসলে, আমার মুজাহির ভাইরা বাজারে কেনা-বেচায় এবং আমার আনসার ভাইরা জমিজমার কাজে মশগুল থাকত। আর আবু হুরায়রা খেয়ে না খেয়ে তুষ্ট থেকে রসূলুল্লাহর সাথে লেগে থাকত। তাই তারা যখন উপস্থিত থাকত না, তখন সে উপস্থিত থাকত এবং তারা যা মুখস্ত করত না, সে তা মুখস্ত রাখত।”- বুখারী, ১১৯।
--কিসের কি যুক্তি! কোরআনের ২:১৫৯-১৬০ আয়াতদ্বয়ে খোদার বাণী গোপনকারীকে সতর্ক করা হয়েছে, হাদিস গোপনকারীকে নয়, হুরায়রার কি এই জ্ঞানটুকুও নেই। তাছাড়া বসূলুল্লাহর কথা, কাজ বা অনুমোদনকে হাদিস হিসেবে ধরলে, হুরায়রার নিজের এই উক্তি কি করে হাদিস হিসেবে বুখারী তার কিতাবে স্থান দিয়েছেন? মুহাদ্দিস ও বিজ্ঞ আলেমগণ সাহাবীদের এ ধরণের বর্ণনাকে আসার বা “মওকূফ হাদিস” হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। পাঠক ভাবেন একবার! কাউলী বা ফে'লীর খোঁজ নেই, বুখারীর অাসার নিয়ে টানাটানি। আর এ কারণেই আজ মানুষ তাদের সংগৃহীত হাদিস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সাহস পাচ্ছে।
কারণ-২:
আবু হুরায়রার ব্যক্তি সততা ও বর্ণিত হাদিসের সত্যতা প্রশ্নের সম্মুখীণ। কেননা, নবীজীর নামে ভূয়া হাদিস বর্ণনা করায় এবং ব্যক্তি সততা না থাকার অভিযোগে হযরত ওমর তাকে দু’দুবার চাবুক পেটা করেছিলেন।
১ম ঘটনা: মাহমুদ আবু রওয়া বলেন- “রসূলূল্লাহর জীবিতকালে হুরায়রা এমন একটি হাদিস বর্ণনা করেন- আমি বললাম, “ও রসুলূল্লাহ! আমি আপনার এমন অনেক হাদিস শুনেছি যেগুলো আমি ভুলতে বসেছি।”
তিনি বললেন, “আত্মাকে প্রসারিত কর, তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান, জমিন এবং যাবতীয় সৃষ্টি সাত দিনে।”
যখন ওমর এ সম্পর্কে জানতে পারলেন, তখন তিনি তাকে ডেকে নিয়ে ঐ হাদিসটি পুনরায় বর্ণনা করতে বললেন। সেটি শোনার পর ওমর তাকে চাবুক মারতে মারতে কঠোর স্বরে বললেন, “এটা কিভাবে হতে পারে যখন আল্লা নিজেই বলেছেন এসব করা হয়েছিল ছয় দিনে, আর তুই তাঁর রসূলের নামে বলে বেড়াচ্ছিস তা হয়েছিল কি-না সাত দিনে?”
হুরায়রা নরম সূরে বললেন, “হয়ত: আমি এটা শুনেছি কা’ব আল-আহবারের কাছ থেকে..”
ওমর বললেন, “যেহেতু তুই নবীজীর হাদিস এবং যা কা’ব আল-আহবার বলে, তার মধ্যে পার্থক্য করতে পারিস না, সুতরাং অবশ্যই তোর কোনকিছু একেবারেই বর্ণনা করা উচিৎ না।”
আর এ ঘটনা ইবনে আসাকির ও মুত্তাকি বর্ণনা করেছেন এভাবে- খলিফা ওমর তাকে চাবুক পেটা করেন, তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং নবীজীর পবিত্র নাম নিয়ে হাদিস বর্ণনা করা নিষিদ্ধ করেন। কথিত আছে, ওমর যখন তাকে চাবুক মারতে শুরু করেন, তখন হুরায়রা বুঝতে পারেননি কেন তাকে চাবকান হচ্ছে। তাই তিনি ওমরের নিকট কারণ জানতে চান। ওমর চাবকাতে চাবকাতে উত্তর দেন- "কারণ তুই নবীজীর নামে অধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করিস, তুই কেবল তার উপর মিথ্যে আরোপ করাতেই পারদর্শী। সুতরাং নবীজীর কোন হাদিস বর্ণনা অবশ্যই তোকে বন্ধ করতে হবে; নতুবা আমি তোকে দাউসের এলাকাতেই ফেরৎ পাঠাব।”
২য় ঘটনা: ইবনে আবদ রাব্বি বলেন- “৬৪২ সনে (২১ হিজরী) খলিফা ওমর হুরায়রাকে বাহরাইনের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। দু’বৎসর তিনি ঐ দায়িত্ব পালন করেন এবং তারপর পদচ্যূত হন তার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ানোর কারণে।
পদচ্যূতের পর হুরায়রাকে খলিফা ওমরের নিকট নিয়ে এলে ওমর তাকে বললেন, “আমি জানতে পেরেছি যখন আমি তোকে বাহরাইনের গভর্ণর নিযুক্ত করি, তখন তোর পায়ে দেবার মত এক জোড়া জুতাও ছিল না, কিন্তু আমাকে এখন বলা হয়েছে তুই এক হাজার ছয়’শ দিনারের অশ্ব ক্রয় করেছিস।”
হুরায়রা নরম স্বরে বললেন, “আমি উপহার হিসেবে কিছু অশ্ব লাভ করেছিলাম, আর সেগুলি বৃদ্ধি পেয়েছে।”
ওমর তার ওজরে কান না দিয়ে বললেন, “আমি তোকে কেবল বেতন দিতাম। আর এই মূল্য তোর দু’বছরের বেতনেরও বেশী। সুতরাং বাকী অর্থ বায়তুল মালে জমা কর।”
হুরায়রা বলেন, “এই অর্থ আপনার নয়।”
ওমরের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল, তিনি বললেন, “আল্লা স্বাক্ষী, আমি চাবকে তোর পিঠের চামড়া তুলে নেব।” এ কথা বলে তিনি তাকে চাবকাতে শুরু করেন যতক্ষণ না হুরায়রা রক্তাক্ত হন। তারপর হুংকার দিয়ে বলেন, “এবার অর্থ ফেরৎ নিয়ে আয়।”
এসময় হুরায়রা বলেন, “আমি এর হিসেব আল্লার কাছে দেব।”
এতে ওমর বলেন, “এটা হত তখনই, যদি তুই ঐ অর্থ সঠিকভাবে গ্রহণ করতিস এবং তা ফিরিয়ে দিতিস বাধ্যগত হয়ে। সুতরাং এখন আমি তোকে তোর মায়ের কাছে ফেরৎ পাঠাব গোবর দলার মত করে, যেন তিনি তোকে গাধা চরানীর কাজে লাগাতে পারেন।”
আর এ ঘটনা ইবনে আসাকির ও আবিল হাদিদ বর্ণনা করেছেন এভাবে- “খলিফা ওমর আবু হুরায়রাকে ২১ হিজরীতে বাহরাইনের গভর্ণর নিয়োগ করার পর লোকেরা খলিফাকে অবহিত করে যে, আবু হুরায়রা বড় ধরণের সম্পদের মালিক বনে গেছেন এবং বেশকিছু অশ্ব ক্রয় করেছেন। সুতরাং ২৩ হিজরীতে ওমর তাকে পদচ্যূত করেন। এরপর আবু হুরায়রা দরবারে প্রবেশ করতেই খলিফা তাকে বললেন: “ও আল্লার শত্রু, শত্রু তাঁর কিতাবের! তবে কি তুই আল্লার সম্পদ চুরি করেছিস?”
তিনি বললেন, “আমি কখনও চৌর্যবৃত্তি করিনি, লোকেরা আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে।”
ইবনে সা’দের বর্ণনা- “খলিফা বললেন: “যখন আমি তোকে বাহরাইনের গভর্ণর নিযুক্ত করি, তখন তোর পায়ে দেবার মত এক জোড়া জুতোও ছিল না, কিন্তু আমি এখন জানতে পারলাম, তুই ১৬০০ দিনার দিয়ে অশ্ব ক্রয় করেছিস। এ সম্পদ তুই কিভাবে অর্জন করলি?”
তিনি উত্তর দিলেন, “ওগুলো ছিল লোকদের উপহার যা বেশ কয়েকগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
খলিফার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল এবং তিনি তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে চাবকালেন যে তার পিঠ রক্তাক্ত হয়ে গেল। তারপর তিনি দশ হাজার দিনার যা আবু হুরায়রা বাহরাইন থেকে সংগ্রহ করেছিল, তা তার কাছ থেকে নিয়ে বায়তুল মালের খাতে জমা করার আদেশ দিলেন।”
কারণ-৩:
আবু হুরায়রা হাদিস বিকৃতকারী ও মিথ্যেবাদী। নবীজীর অনেক গণ্যমান্য সাহাবী তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেমন-
ক. হুরায়রা বর্ণিত: আমি ওসমানের স্ত্রী, নবী কন্যা রোকাইয়ার গৃহে প্রবেশ করলাম। তার হাতে একটা চিরুনি ছিল। তিনি বললেন, “নবীজী এইতো এখান থেকে গেলেন। আমি তার চুল আঁচড়ে দিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আবু আব্দুলাহ (ওসমান)-কে কেমন দেখছ?” আমি বললাম, “ভালই।” তিনি বললেন, “আকিদায় সে আমারই কাছাকাছি, তাকে সম্মান কোরও।” -[মুস্তাদরক আল-হাকিম, খন্ড ৪, পৃ. ৪৮]
-রোকাইয়া মারা যান আবু হুরায়রার ইসলাম গ্রহণের পূর্বে। অথচ তিনি রোকাইয়ার গৃহে সংঘটিত তার মৃত্যুর পূর্ববর্তী কোন ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যখন তার মদিনায় আগমনই ঘটেনি। এটা কিভাবে সম্ভব?
খ. আবু হুরায়রা বর্ণিত- রসূলুল্লাহ তার পিতৃব্য [আবু তালিব]কে তার মৃত্যুর সময় বলেন: “আল্লা ছাড়া কোন মা’বুদ নেই- কেবল এই স্বীকারোক্তিটুকু দেন তাতে আমি বিচার দিনে আপনার [মুসলমান হবার] পক্ষে সাক্ষ্যদাতা হব।” কিন্তু তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। তখন আল্লা এই আয়াত নাযিল করেন:
“যাকে পছন্দ কর, তাকে তুমি সৎপথে আনতে পারবে না, কেবল আল্লাহ তা’আলাই তা পারেন যাকে তাঁর ইচ্ছা। কে সৎপথে পরিচালিত তা কেবল তাঁরই জানা আছে।-২৮:৫৬-[মুসলিম, পুস্তক-০০১, নস্বর ০০৩৭]
সকলেই এ বিষয়ে একমত যে আবু তালিবের মৃত্যুর সময় আবু হুরায়রার মক্কা তো দূরের কথা, হিজাজেই আগমন ঘটেনি। তাহলে কিভাবে তিনি চাক্ষুষ স্বাক্ষীর মত ঘটনার বর্ণনা দেন?
গ. আবু হুরায়রা বর্ণিত: “যখন এই আয়াতটি নাযিল হয়: আর সতর্ক কর তোমার নিকট আত্মীয়-স্বজনকে-[২৬:১৪], রসূলুল্লাহ কুরাইশদেরকে ডাকলেন, সুতরাং তারা সমবেত হলেন এবং তিনি তাদেরকে সাধারণ সতর্কবাণী দিলেন। তারপর তিনি একটি নির্দিষ্ট গোত্রের উদাহরণ দিলেন এবং বললেন: ও কাব বিন লুওয়াইয়ের সন্তানগণ, নিজেদেরকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও; ও মুর্রা বিন কা’বের সন্তানগণ, নিজেদেরকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও; ও আবদ শামসের সন্তানগণ, নিজেদেরকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও; ও আবদ মানাফের সন্তানগণ, নিজেদেরকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও; ও হাশিমের সন্তানগণ, নিজেদেরকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও; ও আবদ আল-মুত্তালিবের সন্তানগণ, নিজেদেরকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও; ও ফাতিমা, নিজেকে আগুণের শাস্তি থেকে বাঁচাও, কেননা, আল্লা আমাকে কোন বিষয়ে কোন ক্ষমতা দেননি [তোমাদেরকে রক্ষা করার] তোমাদের সাথে আমার সম্বন্ধ যুক্ত হয়ে থাকা ছাড়া।” -[মুসলিম, পুস্তক, ০০১, নম্বর ০৩৯৯]
--রসূলুল্লাহকে দেখার একযুগ আগের ঘটনা কিভাবে আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন?
ঘ. ইবনে শিরিণ বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “একবার রসূলুল্লাহ আমাদের সান্ধ্যকালীন এক নামাজের ঈমামতি করলেন।-----তিনি আমাদের নিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে সালাম ফিরালেন। তারপর তিনি মসজিদে আড়াআড়ি রাখা এক খন্ড কাঠের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন এমনভাবে যেন তিনি রাগান্বিত। তিনি তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের মধ্যে প্রবেশ করালেন। আর তার তার ডান চোয়াল বাম হাতের পিঠের উপর রাখলেন। যাদের তাড়া ছিল তারা মসজিদের দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। সাহাবীগণ বললেন, "নামাজ কি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে?"
উপস্থিত লোকজনের মধ্যে আবু বকর ও ওমরও ছিলেন। কিন্তু তারা নবীজীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত: করছিলেন। জুল ইয়াজদিন নামে লম্বা হাত বিশিষ্ট এক ব্যক্তি বললেন, "ইয়া রসূলুল্লাহ! আপনি কি ভুলে গেছেন, নাকি নামাজ সংক্ষেপ করা হয়েছে?"
তিনি বললেন, "আমি ভুলিনি এবং নামাজ সংক্ষেপও করা হয়নি।" এরপর তিনি (অন্যদের) জিজ্ঞেস করলেন, "জুল ইয়াজদিনের কথা কি ঠিক?"
তারা বললেন, "হ্যাঁ।"
তারপর তিনি এগিয়ে এলেন এবং নামাজের বাদ পড়া অংশটুকু আদায় করলেন। তারপর সালাম ফেরালেন ও আল্লাহু আকবর বললেন এবং স্বাভাবিক সিজদার মত বা একটু দীর্ঘ সিজদা করলেন। তারপর আল্লাহু আকবর বলে মাথা ওঠালেন। পরে আল্লাহু আকবর বললেন এবং স্বাভাবিক সিজদার মত বা একটু দীর্ঘ সিজদা করলেন। তারপর আল্লাহু আকবর বলে মাথা ওঠালেন।” -[বুখারী, খন্ড ১, বই ৮, নম্বর ৪৬৯]
-বর্ণিত এই হাদিসে আবু হুরায়রা পরিস্কার ভাবে বলছেন যে, তিনি রসূলের পিছনে ঐ নামাজে অংশগ্রহণকারীদের একজন এবং ঐ নামাজে জুল ইয়াজদিনও উপস্থিত ছিলেন। এই জুল ইয়াজদিনের ছিলেন জুহরা গোত্রের এবং তার প্রকৃত নাম থুশ-শামালায়েন ইবনে আবদ আমর।আমরা জানি যে, জুল ইয়াজদিন বদর যুদ্ধে শহীদদের অন্যতম। তার হত্যাকারী ছিলেন- ওসামা আজ-জসমি ইবনে আব্দুল বির। সুতরাং ঘটনাটি অবশ্যই বদর যুদ্ধের পূর্ববর্তী, যখন হুরায়রার নবীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎই ঘটেনি। তাহলে কিভাবে তিনি নবীজীর সঙ্গে নামাজ আদায় করেন, যখন নবীজীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎই ঘটেনি?
ঙ. আবু হুরায়রা বর্ণিত- নবীজী বলেন: “একটা বিড়ালের কারণে এক স্ত্রীলোক দোযখবাসী হবে। সে তাকে বেঁধে রেখেছিল। তাকে খেতে দেয়নি এমনকি জমিনে চরেফিরে পোঁকা-মাকড় খাবার সুযোগ ও দেয়নি।” -[বুখারী. খন্ড ২, পৃ. ১৪৯; মুসনাদ, খন্ড ২, পৃ. ২৬১] এবং
আবু হুরায়রা বর্ণিত- “কোন নামাজরত ব্যক্তির সম্মুখ দিয়ে যদি কোন বানর, কোন কাল কুকুর বা কোন মহিলা গমন করে, তবে ঐ ব্যক্তির নামাজ হবে না।” -[বুখারী, ১০২; হাম্বলী, ৪/৮৬]
-বিবি আয়েশা এসব হাদিস শুধু অস্বীকারই করেননি, তিনি অনেকবারই হুরায়রাকে বিতর্কিত করেছেন এবং বলেছেন, “আবু হুরায়রা এক মহামিথ্যুক, যে হাদিস জাল করে এবং তা নবীজীর নামে চালিয়ে দেয়।” -[ইবনে কুতায়বা, হাকিম, জাহাবি, মুসলিম]
ইবনে কুতায়বা তার কিতাবে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন- “বিবি আয়েশা হুরায়রাকে বললেন, “তুমি এমন সব হাদিস বলে বেড়াও যা আমরা তার নিকট থেকে কখনও শুনিনি।”
এতে হুরায়রা বললেন, “আপনি তো সব সময় আয়নার সামনে সাজুগুজু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।”
তখন বিবি আয়েশা বলেন, “তুমি তো সেই, যে কিনা সব সময় তার পেট আর খিধে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তোমার খিধে তোমাকে ব্যস্ত রাখে, আর তুমি খাবারের খোঁজে লোকদের পিছে যত্রতত্র দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু কর। ওদিকে তারা সাধারনত: তোমাকে এড়িয়ে চলে বা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সবশেষে তুমি ফিরে আস এবং আমার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে থাক। লোকেরা ভাবে তুমি উন্মত্ত আর তারা তোমার দিকে ধেয়ে যায়।”
ঈমাম আবু জাফর আসকালানি বলেন, আমাদের মহামানবগণের মতানুসারে, আবু হুরায়রা একজন দুষ্টলোক। তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। ওমর তাকে চাবুক দিয়ে পেটান এবং তাকে বলেন যে, সে হাদিস পরিবর্তন করেছে এবং নবীজীর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে। তিনি হুরায়রা সম্পর্কে হযরত আলীর উদ্ধৃতিরও উল্লেখ করেন। আলী বলেছিলেন, “মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিথ্যুক আবু হুরায়রা দাউসি থেকে সাবধান।” -[ইবনে আবি আল-হাদিদ, নাহজুল বালাগার উপর ধারাবিবরণী, খন্ড ১, পৃ. ৩৬০]
কারণ-৪:
হুরায়রা বর্ণিত অসংখ্য হাদিসে বা, অথবা, কিম্বা যুক্ত করা হয়েছে, যা হাদিস বর্ণনার পরিপন্থি। কেননা হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে এ সতর্কতা সকলেরই জানা ছিল--“Do not narrate a tradition unless you are so certain as if you are certain of the sun's light"! অথচ আমরা বুখারীর কিতাবে হুরায়রা বর্ণিত এমন সব হাদিসও দেখছি-
ক. আহম্মদ ইবনে মুহম্মদ আল মক্কী বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “নবীজী প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হলে আমি তার অনুসরণ করলাম। তিনি এদিক ওদিক তাকালেন না। যখন আমি তার নিকটবর্তী হলাম, তখন তিনি আমাকে বললেন, “আমাকে কিছু পাথর কুড়িয়ে দাও, আমি তা দিয়ে ইসতিনজা করব।” বা এ ধরণের কোন কথা বললেন, “আর আমার জন্যে হাঁড় বা গোবর আনবে না।”
তখন আমি আমার কাপড়ের কোঁচায় করে কয়েকটি পাথর এনে তার পাশে রাখলাম এবং সরে গেলাম। তিনি কাজ শেষে সেগুলো ব্যবহার করলেন।”- [বুখারী, ১৫৭]
খ. ইসহাক ইবনে নাসর বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “নবীজী বলেন, “বনি ইস্রায়েলীরা নগ্ন হয়ে একে অপরের সম্মুখে গোসল করত। কিন্তু মূসা গোসল করতেন একাকী। এতে লোকেরা বলাবলি করত, “আল্লার কসম, মূসা একশিরা রোগের কারণেই আমাদের সাথে গোসল করেন না।”
একবার মূসা একটা পাথরের উপর তার কাপড় রেখে গোসল করছিলেন। পাথরটা তার কাপড় নিয়ে চলতে শুরু করল। তখন মূসা “আমার কাপড়,আমার কাপড়” বলে তার পিছনে পিছনে ছুটলেন। এদিকে বনি ইস্রায়েলীরা মূসার দিকে তাকাল। তখন তারা বলল, “আল্লার কসম, মূসার কোন রোগ নেই।”
মূসা পাথর থেকে তার কাপড় নিয়ে পরলেন এবং পাথরটাকে পেটাতে শুরু করলেন।”
আবু হুরায়রা বলেন, “আল্লার কসম, পাথরটাতে “ছয় কিংবা সাতটি” পিটুনীর দাগ পড়ে গেল।”- [বুখারী, ২৭৫]
গ. সুলায়মান ইবনে হার্ব বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহর কাছে দাঁড়িয়ে এক কাপড়ে সালাত আদায়ের হুকুম জিজ্ঞাসা করল। তিনি বললেন, “তোমাদের প্রত্যেকের কাছে কি দু’খানা করে কাপড় আছে?”
এরপর এক ব্যক্তি ওমরকে একই প্রশ্ন করল। তিনি বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাদের সামর্থ্য দিয়েছেন তখন তোমরাও নিজেদের সামর্থ্য প্রকাশ কর। লোকেরা যেন পুরো পোশাক একত্রে পরিধান করে অর্থাৎ মানুষ তহবন্দ ও চাদর, তহবন্দ ও জামা, তহবন্দ ও কাবা, পায়জামা ও চাদর, পায়জামা ও জামা, পায়জামা ও কাবা, জাঙ্গিয়া ও কাবা, জাঙ্গিয়া ও জামা পরে সালাত আদায় করে।” হুরায়রা আরও বলেন যে, “আমার “মনে হয়” ওমর জাঙ্গিয়া ও চাদরের কথাও বলেছিলেন।- [বুখারী, ৩৫৮]
ঘ. সুলায়মান ইবনে হার্ব বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “একজন কাল বর্ণের “পুরুষ অথবা মহিলা” মসজিদ ঝাড়ু দিত। সে ইন্তেকাল করল। নবীজী তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। সাহাবীগণ বললেন, “সে ইন্তেকাল করেছে।”
তিনি বললেন, “তোমরা আমাকে খবর দিলে না কেন? আমাকে তার কবরটা দেখিয়ে দাও।” তারপর তিনি তার কবরের কাছে গেলেন এবং তার জানাজার নামাজ আদায় করলেন।”- [বুখারী, ৪৪৪]
অথচ বুখারীর কিতাবে হুরায়রা এমন হাদিস রয়েছে- আবু মুসাব আহম্মদ ইবনে আবু বকর বর্ণিত: আবু হুরায়রা বলেন, “ইয়া বসূলুল্লাহ, আমি আপনার কাছ থেকে বহু হাদিস শুনি, কিন্তু ভুলে যাই।"
তিনি বললেন, "তোমার চাদর খুলে ধর।" আমি তা খুলে ধরলাম।
তিনি দু’হাত অঞ্জলী করে তাতে কিছু ঢেলে দেবার মত করে বললেন, "এটা তোমার বুকের সাথে লাগিয়ে ধর।"
আমি তা বুকের সাথে লাগালাম। এরপর আমি আর কিছুই ভুলিনি।"-[বুখারী, ১২০]
--আর উপরের সব ক'টি (ক,খ,গ,ঘ) হাদিসই কি তার না ভোলার নমুনা?
এভাবে হুরায়রা বর্ণিত প্রায় সকল হাদিসই কোন না কোন ত্রুটি সম্পন্ন বলেই শিয়াগণ প্রমান করেন। সেগুলির সব এখানে বর্ণনার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।
উপরের তথ্যপ্রমাণ শেষে কিভাবে আমরা উপসংহার টানব? আমরা আমাদের অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষার আলোকে বলতে পারি যে, শিয়াগণের হুরায়রা বর্ণিত হাদিস বর্জন করার কারণ যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। তথাপি আমরা কাউকে হুরায়রার হাদিস গ্রহণ বা বর্জনের উপদেশ দিচ্ছিনে। কেননা, আমরা বিশ্বাস করি- বিশ্বাসীদের নেতা হযরত ওমর, আলী এবং বিশ্বাসীদের মাতা বিবি আয়েশাকে উপেক্ষা করে হুরায়রা বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব এখতিয়ার।
আমরা নির্দ্বিধায় কেবল একথাই বলব- হাদিস সম্পর্কে বিতর্ক থাকলে মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিৎ সেটিকে কোরআনের সাথে যাঞ্চাই করা- যদি সেটা কোরআনের সাথে সংঘর্ষিক হয়, তবে তা বর্জন করা। তবে একথা সত্য যে, যার যেমন জ্ঞান, সে ঐ অনুসারেই অনুধাবণ করে, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
উৎস:
• অাল-কোরঅান,
• সহিহ মুসলিম,
• সহিহ আল-বুখারী,
• মুস্তাদার্ক উল হাকিম, ধাহাবি,
• মুসনাদ, আহমেদ ইবনে হাম্বল,
• কানযুল-উম্মাল, আলী অাল-মুতাক্কি,
• আল-মা’রিজ, ইবনে কুতাইবা আল-দিনোরী,
• আল-কামুস আল-মুহেত, অাল-ফায়রুজ আবাদী,
• তাওইল-ই-মুকতালিফুল হাদিস, ইবনে কুতাইবা আল-দিনোরী,
• ফতেহ আল-বারী ফি শারহ সহিহ আল-বুখারী, ইবনে হজর আসকালানী,
• আবু হুরায়রা, সৈয়দ অাবুল হুসাইন শরাফুদ্দিন অাল -মুসাওয়ি,
• নিহায়াত আল-আকদাম ফি ইলম আল-কালাম, ইবনে হজম,
• শিয়া’জ আর দা অাহল আল-সুন্নাহ, অাল তাজানি সামায়ি,
• আল-মুস্তাদার্ক আলা অাল-সহিহান, আল-হাকিম,
• অাল মিলাল ওয়া আন নিহান, আল-শাহরাস্তানী,
• অাল-ইকদ অাল-ফরিদ, ইবনে আবদ রব্বিহ
• অাল-তাবাকাত আল-কুবরা, ইবনে সা’দ,
• শারহি নাহজুল বালাগা, ইবনে আছির,
• ইরশাদ অাস সারী, আল-কাস্টালানী,
• শামস আল-মা’রিফ, শেখ আহমেদ,
• আবু হুরায়রা, মাহমুদ আবু রওয়াহ,
• তারিখ কবির, ইবনে আসাকির,
• উইকিপিডিয়া।