আল হারিস বিন সাঈদ (al-Harith bin Said) ভিশন বা স্বপ্ন দর্শণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং দাবী করেন খোদা তাকে তাঁর নবী হতে আহবান জানিয়েছেন। এই বিশ্বাসের উপর কাজ করতে গিয়ে হারিস পরবর্তীতে তার নব্যূয়তের বিষয়টি গোপনে জনসাধারনের নিকট প্রচার করতে থাকেন এবং ধীরে ধীরে দামেস্কের মসজিদে তার একদল অনুসারী তৈরী করে ফেলেন। যখন দামেস্কান কর্তৃপক্ষ আবিস্কার করলেন যে, তিনি দামেস্কের মসজিদে আগত মুসল্লিদের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে বিপথে নিচ্ছেন, তখন তারা বিষয়টি খলিফা আবদ আল মালিককে জ্ঞাত করলে তিনি তাকে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দেন।
এসময় হারিস উমাইয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেস্ক থেকে পালিয়ে জেরুজালেম চলে যান। সেখানে তিনি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তার কার্য্যাবলী চালিয়ে যেতে থাকেন। তার অনুসারীগণ তার চারিদিকে এক অভেদ্য বুহ্য রচনা করল। কিন্তু তার এই নিরাপত্তা বলয় যে নিচ্ছিদ্র ছিল না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, তার এই কার্য্যকলাপ আবারও আবিস্কৃত হল তার একান্ত বিশ্বস্ত এক অনুসারীর প্রতারণার দ্বারা। এই অনুসারী তার গোপন আস্তানার খবর খলিফাকে জ্ঞাত করেছিল। এতে আল হারিস ধৃত ও বন্দী হন এবং পরবর্তীতে খলিফার নির্দেশে তাকে হিজরী ৭৯ সনে ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
উমাইয়া খেলাফতের ঐতিহাসিকগণ আল হারিসকে ভন্ড নবী হিসেবে চিহ্নিত করে এমন দায়সারা ভাবে চিত্রিত করেছেন তার কাহিনী। তারা উপেক্ষা করেছেন তার জীবনাচার ও অলৌকিক কার্য্যাবলী যা অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবী রাখে বলে আমার বিশ্বাস।
আল হারিস দামেস্কের অধিবাসী। ধারণা করা হয় তিনি আবু গুলাসের শিষ্য ছিলেন। তার পিতা বসবাস করতেন আল হুলা (al-Hūla)-তে। ঐ সময় সিরিয়ার দু’টি শহরের নাম আল হুলা ছিল। হারিসের পিতা এই দু’টির কোনটিতে বাস করতেন তা নিশ্চিত নয়। যাইহোক, আল হারিস খোদাভীরু, পরহেজগার ও বিনয়ী ব্যক্তি ছিলেন। এমন কি যদি তাকে মূল্যবান স্বর্ণখঁচিত পোষাকও পরিধান করিয়ে দেয়া হত, তবুও তার বিনয় প্রকাশ পেত। যখন তিনি খোদার প্রশংসা বা কোরআন পাঠ করতেন, আর যারা তা শুনতে পেত তারা স্বীকার করতে বাধ্য হত যে, জীবনে তারা এমন সুমধুর বচন বা কন্ঠ দ্বিতীয় একটা শুনেনি।
এই আল হারিস একদা তার পিতাকে লিখলেন, "হে পিত: আমি এমন সব দর্শণ পাচ্ছি যাতে আমার মনে হচ্ছে শয়তান আমাকে বিভ্রান্ত করছে। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি জানাও এখন আমি কি করব।”
সব শুনে তার পিতা উত্তরে তাকে জানান, "ও আমার পুত্র, তুমি সেই কাজই করে যাও যা তোমাকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বলেছেন- "Shall I declare to you upon whom demons (al-šayātīn) descend? They
descend upon all liars and sinners.”-(২৬:২২১-২২২)। -আর তুমি মিথ্যেবাদী নও, নও পাপিষ্ঠ। সুতরাং যেমন আদেশ পাও তেমনি কার্য্য করাই তোমার কর্তব্য।”
আল হারিস মসজিদে আগতদের নিকট, জনে জনে প্রত্যেকের শপথ ও কসম নিয়ে তাদের সাথে তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেন। এই শপথ ছিল এমন যে, সে যদি দেখে হারিসের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য, তবে সে তা গ্রহণ করবে, আর যদি তার নিকট হারিসের বক্তব্য গ্রহণীয় না হয়, তবে সে বিষয়টি ভুলে যাবে বা গোপন করবে। হারিস মাঝে মাঝে শিষ্যদেরকে বিষ্ময়কর সব কার্য্য করে দেখাতেন। যেমন, তিনি মসজিদের একটা বড় মার্বেল পাথরের স্লাবের নিকট দাঁড়িয়ে সেটাকে হাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে ফেলতেন ও তারপর খোদার মহিমা কীর্তন করতেন বা তিনি তাদেরকে এমনসব ফল খেতে দিতেন যা ঐ মৌসূমে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ শীতকালের ফল গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের ফল শীতে খেতে দিতেন। কখনও কখনও তিনি তাদেরকে বলতেন, "আমার সাথে চল, যাতে আমি তোমাদেরকে ফেরেস্তাদেরকে দেখাতে পারি।”
তিনি তাদেরকে নিয়ে যেতেন দামেস্কের নিকটবর্তী জাবাল কাসিয়ূনের ধর মুরান (Dayr
Murrān)-এ এবং সেখানে ফেরেস্তাগণকে দেখাতেন। আর তারা তাদেরকে দেখতে পেত ঘোড়ার পিঠে সওয়ার মানুষ রূপে।
দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ প্রাঙ্গন। |
আল কাসিম বিন মুহাইমারা ছিল একজন সিরীয় মুহাদ্দিস। সে দামেস্কের মসজিদে মুসল্লিদের ওজু ও গোসলের পানি সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। একদিন আল হারিস তার নিকটে এসে তার কিছু কথা শোনার জন্যে তাকে অনুরোধ করলেন। তবে তিনি তাকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে, যদি সে তার কথা গ্রহণ করে তো করল, আর যদি তা গ্রহণ না করে তবে তার খাতিরে সে বিষয়টি গোপন করে যাবে। তারপর হারিস যখন কাসিমকে তার নব্যূয়তের বিষয়টি নিয়ে শপথবাক্য পাঠ করতে বললেন, তখন কাসিম তাকে বলল, "তুমি একটা মিথ্যেবাদী, তুমি খোদা ও তাঁর ধর্মের শত্রু! তুমি কোন নবী নও এবং তুমি কখনই আমার কোন বচন বা শপথ পাবে না!”
আল কাসিম বিষয়টি আবু ইদ্রিস আল হাওলানিকে জ্ঞাত করল। এই আবু ইদ্রিস ছিলেন উমাইয়া দরবারের একজন কাজী বা বিচারক। সবশুনে তিনি কাসিমকে বললেন, "তুমি তো বোকামী করেছ, তুমি কি তাকে বন্দী করতে পারতে না? সে তো এখন পালিয়ে যাবে!”
দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। |
আল হারিস পালিয়ে জেরুজালেম চলে আসেন এবং সেখানে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। তার বিশ্বস্ত শিষ্যরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বেঁছে বেঁছে লোকদেরকে ধরে আনত এবং তিনি তাদেরকে তার মতাদর্শে দীক্ষিত করতেন। এমনিই চলছিল।
একদিন ইরাকের বসরা নগরী থেকে এক ব্যক্তি জেরুজালেমে এল। হারিসের এক শিষ্যের সাথে এই বসরীয়র দেখা হল। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে শিষ্য বসরীয়কে বলল, 'এখানে একজন ধর্মতাত্ত্বিক লোক অছেন, তুমি কি তার ধর্মতত্ত্বের আলোচনা শুনতে আগ্রহী?’
বসরীয়রা ধর্মতত্ত্ব তথা থিয়োলজিতে ব্যাপক আগ্রহী ছিল। সুতরাং সে বলল, 'অবশ্যই’।
তারপর সে ঐ শিষ্যের সাথে চলতে লাগল যতক্ষণ না তারা আল হারিসের আস্তানায় পৌঁছিল। অত:পর সে হারিসের মজলিসে বসল ও তার আলোচনা শুনল। সত্যি বলতে কি ঐ বসরীয় সুন্দর একটি আলোচনা শুনল। আর তারপর হারিস তাকে তার বিষয়টি বললেন। তিনি বললেন যে, তিনি খোদা কর্তৃক আহুত ও প্রেরিত নবী। এতে ঐ বসরীয় বলল, 'আপনার বাণী সুন্দর বটে, তদুপরি আরও কিছু বিষয় অনুসন্ধানের রয়েছে।’
তিনি বললেন, 'তবে অনুসন্ধান কর।’
বসরীয় চলে গেল।
পরে বসরীয় পুনরায় হারিসের নিকট এল এবং বলল, 'আপনার বাণী সুন্দর এবং তা আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। আমি আপনার উপর ঈমান আনলাম। এটাই সত্য ধর্ম।’
বসরীয় হারিসকে নিয়মিত দর্শণ দিতে লাগল, যতক্ষণ না সে তার অন্যতম বিশ্বস্ত শিষ্যদের একজন না হল। এভাবে সে জেনে গেল কোথায় হারিস যান, কোথায় থাকেন, কিভাবে লুকান, তার বিশ্বস্ত শিষ্যগণ কারা ও তার নিরাপত্তা বেষ্টনীর স্তরসমূহ কিভাবে কাজ করে ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য।
তারপর একসময় ঐ বসরীয় হারিসকে বলল, 'এবার আমাকে যাবার অনুমতি দিন।’
'কোথায়?’- হারিস জিজ্ঞেস করলেন।
'বসরায়’- সে বলল, 'আমি আপনার ধর্মপ্রচারকারীর প্রথমজন হতে যাচ্ছি।’
তখন তিনি অনুমতি দিলেন।
খলিফার আল সিনাইবারার প্রাসাদ। |
প্রহরী তাকে জিজ্ঞেস করল, 'কি সেই সংবাদ?’
সে বলল, 'সংবাদটি বিশ্বাসীদের নেতার জন্যে।’
খলিফা তার প্রহরীদেরকে তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিতে নির্দেশ দিলেন। বসরীয় খলিফার তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করে দেখতে পেল খলিফা তার সভাষদবর্গ পরিবেষ্টিত রয়েছেন। বসরীয় খলিফাকে বলল, 'আপনার জন্যে একটা সংবাদ আছে।’
খলিফা বললেন, 'কি তোমার সংবাদ।’
বসরীয় জানত ইতিপূর্বে খলিফা তার সেনাদলের এক বৃহৎ অংশের বিরুদ্ধে হারিসের উপর সমব্যাথী হবার অভিযোগ এনেছিলেন। সুতরাং সে বলল, 'আমাকে অনুমতি দিন যেন আমি একান্তে আপনার সাথে কথা বলতে পারি।’
খলিফা আবদ আল মালিক তার সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি বসরীয়কে কাছে ডাকলেন। সে তার নিকটবর্তী হলে তিনি বললেন, 'এখন বল, কি সংবাদ এনেছ?’
'আল হারিস’- সে নীচু স্বরে বলল।
খলিফা তার সিংহাসনে নড়ে-চড়ে বসলেন, বললেন, 'কোথায় সে?’
'হে বিশ্বাসীদের নেতা’-সে বলল, 'সে এখন জেরুজালেমে। আমি জানি কোথায় সে থাকে আর কোথায় সে যায়।’
বসরীয় তার আদ্যোপান্ত কাহিনী খলিফাকে খুলে বলল। সবশুনে খলিফা বললেন, 'তুমি তার সঙ্গী ছিলে। সুতরাং বল কিভাবে তাকে ধরা যাবে।’
বসরীয় বলল, 'আমার সঙ্গে কিছু লোক দেন যারা খোদার কালাম জানে না।’
সুতরাং খলিফা বসরীয়কে ৪০ জন ফারঘানা (Fargāna)-র লোক দিলেন এবং তাদেরকে তার আদেশ মত কাজ করতে নির্দেশ দিলেন। এই ফারঘানারা ছিল খলিফার 'আল বারিদ’ দলের সদস্য। উমাইয়া খলিফা আল বারিদকে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান বা কোন সম্মানিয় ব্যক্তি বা ভয়ানক কয়েদীকে প্রহরা দিয়ে আনায়নের কাজে ব্যবহার করতেন। যাইহোক, খলিফা জেরুজালেমের কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেও বসরীয়র হাতে দিলেন। এই চিঠিতে তিনি বসরীয় জেরুজালেম ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার সকল চাহিদা পূরণ করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বসরীয় জেরুজালেমে এসে নগর কর্মকর্তার সাথে দেখা করে খলিফার পত্রটি হস্তান্তর করল। তখন ঐ কর্মকর্তা বললেন, 'তুমি কি চাও?’
বসরীয় নগরের সকল শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তিকে জেরুজালেমের আনাচে কানাচে,প্রতিটি কোনায় কোনায়, রাস্তায় সর্বত্র মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং সংকেত পাবার পর যে-ই তাদের পাশ দিয়ে যাক না কেন তাকে আটক করার নির্দেশ দিলেন। তারপর যখন সবকিছু ছক অনুযায়ী করা হল, তখন সে একাকী হারিসের আস্তানায় গেল। সে দ্বারদেশে পৌঁছে দারোয়ানকে বলল, 'আমাকে ভিতরে যেতে অনুমতি দাও, যাতে আমি আল্লার নবীর সাথে দেখা করতে পারি।’
দ্বাররক্ষী তাকে নিস্পৃহ গলায় বলল, 'সকাল না হওয়া পর্যন্ত রাতের এই প্রহরে প্রবেশের কোন অনুমতি নেই।’
'তাকে জানাও’-বসরীয় বলল, 'যে আমি সবে পৌঁছেছি এবং পৌঁছানোর আগে থেকেই তার সাথে দেখা করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি।’
দ্বাররক্ষী ভিতরে গেল এবং একটু পরে এসে তার জন্যে দ্বার খুলে দিল।
বসরীয় গৃহমধ্যে প্রবেশ করার সংকেত পাওয়া মাত্র সকল মোমবাতি জ্বালান হল। এতে পুরো জেরুজালেম আলোকে আলোকিত হয়ে গেল। বসরীয় আল হারিসের মূল আস্তানায় প্রবেশ করল। কিন্তু তাকে সেখানে দেখল না। সে তখন তাকে খুঁজতে শুরু করল, তথাপি কক্ষের কোথাও তাকে পেল না। এসময় তার অনুসারীগণ যারা সেখানে ছিল তাকে বলল, 'হায়! তুমি আল্লার নবীকে হত্যা করতে চাও, কিন্তু তাকে স্বর্গে তুলে নেয়া হয়েছে!’
বসরীয় তাদের কথায় কান না দিয়ে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরল এবং একসময় দেয়াল গাত্রে তার লুকিয়ে থাকার নিরাপদ স্বর্গ আবিস্কার করে ফেলল। সে সেখানে হাত ঢুকিয়ে তাকে ধরে টেনে বের করে নিয়ে এল। তারপর তাকে জোরপূর্বক গৃহের বাইরে বের করে দিয়ে ফারগিন্সদের বলল, 'একে ধরে এমনভাবে বাঁধ, যেন পালাতে না পারে।'
আল হারিসকে যখন শৃংঙ্খলিত করা হচ্ছিল, তখন তিনি কোরআনের (৪০:২৮) আয়াতটি পাঠ করলেন। রক্ষী ঐ ফারগিন্সরা আরবী ভাল জানত না। তারা তখন তাকে বলল, “This is our Koran. Give us your own Koran.”
খলিফার 'আল বারিদ’ রক্ষীদল আল হারিসকে তার গলার সাথে হস্তদ্বয় একত্রে শৃংঙ্খলিত করল। তারপর তারা তাকে নিয়ে দামেস্কের পথে রওনা দিল। এই দল যখন একটি পার্বত্য পথের নিকট পৌঁছিল তখন জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে হারিস কোরআনের (৩৪:৫০) আয়াতটি পাঠ করলেন-“If I go astray, that is my loss, and if I am rightly guided it is through what my Lord has revealed to me.”
আয়াতটি পাঠ শেষ হওয়া মাত্র আল হারিসের গলা ও হাত থেকে শৃংঙ্খল খুলে মাটিতে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ রক্ষীরা তাকে আবার শৃংঙ্খলিত করল। কিন্তু হারিস এই একই ঘটনা পুনরায় ঘটাল যখন তারা অন্য একটি পার্বত্যময় পথের উপর পৌঁছিল।
অবশেষে আল বারিদ রক্ষীদল হারিসকে নিয়ে দামেস্কের আল সিনাবারাতে পৌঁছিল। আর তারপর খলিফা আবদ আল মালিককে হারিসের আগমন সংবাদ জ্ঞাত করলে তিনি তাকে কারাবন্দী করতে আদেশ দিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য খলিফা একজন অজ্ঞাত ফিকহবিদকে হারিসের কাছে পাঠিয়েছিলেন যেন তার মারফতে তিনি সত্য জানতে ও বুঝতে পারেন যে তিনি শয়তান দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং অত:পর তিনি অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে পারেন। কিন্তু হারিস ঐ ফিকহবিদ দ্বারা পরিশুদ্ধ হতে অস্বীকার করেন। তখন খলিফা তাকে জীবন্ত ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যার আদেশ দিলেন। এই আদেশ শুনে আল হারিস বলে উঠলেন- “Will you (pl.) kill a man who says, ‘My Lord is God?'”-(৪০:২৮)।
তখন শীতকাল। আল হারিসের জন্যে একটা ক্রুস তৈরী করা হল। তারপর কোন এক সকালে তাকে ঐ ক্রুসে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে দেযা হল। তবে বিষ্ময়ের ব্যাপার এই যে, হারিস ক্রুসবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুহুর্তেও একটি অলৌকিক কার্য্য দেখিয়ে যান। তিনি যখন ক্রুসে ঝুলছিলেন তখন একজন রক্ষী বর্শা দিয়ে তার বুকের বামদিকে বিদ্ধ করতে চাইল। কিন্তু তার সেই বর্শার আঘাত তাকে বিদ্ধ করতে পারেনি। বর্শার লৌহ ফলক পশ্চাৎদিকে বেঁকে গেল এবং বর্শাধারীকে দ্বিগুণ বেগে দূরে ঠেলে দিল। এতে সাধারণ দর্শণার্থীরা ঘোষণা করল- 'তিনি অভেদ্য।’
কেউ কেউ বলল, 'অস্ত্র কোন নবীর উপর কাজ করবে না (Weapons do not avail against prophets!).’
হারিসের অনুসারীগণ এসময় মাটিতে উঁপুড় হয়ে ভয়ে ও বিষ্ময়ে তাকে সম্মান করল। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল- “it’s not possible for someone like him to be killed!”
ঐ রক্ষী দ্রুত গিয়ে খলিফাকে বিষয়টি জ্ঞাত করলে তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন, “Muhammad was not the father of any of your men, but was God’s Messenger and the Seal of the Prophets.”-(৩৩:৪০)। তিনি ঐ রক্ষীকে খোদার নাম নিয়ে হারিসকে বিদ্ধ করার চেষ্টার জন্যে তিরস্কার করেন।
তারপর খলিফা তার প্রধান কারারক্ষী আবু জুরা রওয়াহ বিন জিন্বা (Abū Zura Rawh b. Zinbā)-কে ডেকে এ নির্দেশ দেন- “Pierce his right side, then the šaytān will be forced out his left.” এতে সে পাতলা সূচালো এক বল্লম নিয়ে এসে হারিসের পাঁজড়ের বিভিন্ন স্থানে খোঁচাতে থাকল যতক্ষণ না তা বিদ্ধ হয়। অবশেষে দুই পাঁজড়ের মধ্যস্থানে বল্লম বিদ্ধ হলে সে তা এমনভাবে বিদ্ধ করতে থাকল যতক্ষণ না বল্লমের অগ্রভাগ তার পৃষ্ঠদেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এভাবেই হারিসের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।
আল হারিস তার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ, সুমিষ্ট কন্ঠ ও বাণী দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তিনি স্বল্প সময়ে এক বিরাট অনুগত অনুসারী তৈরী করেন। তার মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রমান পাওয়া যায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খলিফার অভিযোগ থেকে। সম্ভবত: খলিফার উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মধ্যেও তার অনুসারী ছিল। কিছু কিছু সূত্র জানায় জিলান, যিনি রাজদরবারের খতিব ছিলেন ও উম্মে আল দার্দার বিরুদ্ধে কানাঘুষা হয়েছিল যে তারা হারিসের সমর্থক ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল।
জিলান আল দামেস্কী, রাজদরবারের সেক্রেটারী বা খতিবই শুধু ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথেও জড়িত ছিলেন। হিশাম বিন আবদ আল মালিক তাকে ক্রুসবিদ্ধ করে দামেস্কের নগর দ্বারে ঝুলিয়ে দেন। কিন্তু এই শাস্তি দেশদ্রোহীর বেলায় প্রযোজ্য ছিল ধর্মদ্রোহীর বেলায় নয়। সম্ভবত: হিশাম হারিসের প্রতি জিলানের সহানুভূতির কথা জানতে পেরেই এই কঠোর শাস্তি দেন। প্রথমে আমরা জিলানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুত্রগুলোতে নজর বুলিয়ে যাই-
সূত্র-১: আল ওয়ালিদ বিন মুসলিম বর্ণনা করেন- আল মুন্দির বিন নাফি বলেন তিনি জিলানকে তিরস্কার করে হালিদ বিন লাগলাগকে বলতে শুনেছেন, ’ড্যাম য়্যূ জিলান, তুমি কি নাচনেওয়ালা ছিলে না? ড্যাম য়্যূ, তুমি কি কিবতী ছিলে না যে পরে মুসলমান হয়েছে? আমি কি তোমাকে রমজান মাসে মহিলাদের দিকে আপেল ছুঁড়ে দেবার সময় হাতেনাতে ধরিনি? একসময় তুমি হারিস আল কাদ্দাবের স্ত্রীর প্রহরার দায়িত্ব নিয়েছিলে আর দাবী করেছিলে তিনি বিশ্বাসীদের মাতা। আর তারপর তুমি তোমার মতাদর্শের পরিবর্তন ঘটালে, বনে গেলে কাদেরী- একজন জিন্দিক (zindīq-a Persian word resembling the heretic notion of hulul al-Ruh, incarnation of the spirit, often related to Manichaeism. The term zindīq here likely does not connote dualist beliefs, despite the frequent associa-tions of qadar with Magians, but rather Gaylān’s practice of kalām;)! -(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, XLVIII, p. ১৯২)
সূত্র-২: ইয়াহিয়া বিন মুসলিম নাম্নী এক সিরীয় জেরুজালেমে গিয়েছিল খোদার পবিত্র নগরীতে আল আকসা মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্যে। এই সময় সে যখন শহরে প্রবেশ করল, তখন এক লোকের সাথে তার দেখা হল। লোকটি তার কাছে জানতে চাইল যে এই শহুরে ভ্রাতার জন্যে কিছুটা সময় ব্যয় করার মত অবকাশ তার আছে কিনা। যখন সে সম্মতি দিল, তখন সে তার এই কাহিনী বর্ণনা করল-
'শহরে রাতটা কাটাও’ লোকটি বলল, 'সকালে তুমি ঘুম থেকে উঠলে আমি তোমার সাথে দেখা করব।’
পরদিন সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম, সে আমার সাথে দেখা করল এবং বলল, ’তুমি রাতে স্বপ্নের মধ্যে কি কিছু দেখেছ?’
আমি বললাম, 'না, ভাল স্বপ্নই তো দেখলাম।’
সে এই বিষয়ে আমাকে তিনবার প্রশ্ন করল তারপর সে বলল, 'চল।’
আমি তার সাথে গেলাম এবং আমরা একটা ডেরায় প্রবেশ করলাম। সেখানে আমি দেখলাম জিলান, আল হারিস আল কাদ্দাব ও তার অনেকগুলো সঙ্গী রয়েছেন। এ সময় এক ব্যক্তি জিলানকে বলল, 'আবু মারওয়ান! আপনি ঐ সহিফাটি কি করলেন যেটা আমরা গতকাল পাঠ করছিলাম?’
জিলান বললেন, 'সেটার সঠিকত্ব নিরীক্ষণে স্বর্গে ফেরৎ নেয়া হয়েছে আর তারপর সেটা আমাদের কাছে পুনরায় অবতরণিত হবে।’
তখন আমি বললাম, 'আমি কখনও ভাবিনি যে, জীবিত অবস্থায় কখনও মুহম্মদের কমিউনিটির মধ্যে আমি এমনকিছু শুনতে পাব।’-(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, XLVIII, p. ১৯১).
অন্যদিকে উম্মে আল দার্দা রাজ দরবাবের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি এই পদ অর্জন করেছিলেন একজন ফিকহবিদ হিসেবে। বাল্যকালে তাকে এতিম অবস্থায় লালন-পালন করেন রসুলুল্লাহর সাহাবী আবু দার্দা। উম্মে দার্দা প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই কোরআন এবং অন্যান্য ধর্মতত্ত্বের উপর তার দখল আসে আবু দার্দার প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানে। পরে তিনি যৌবণ প্রাপ্ত হলে আবু দার্দা তাকে বিবাহ করে নেন। আবু দার্দার মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এই বলে যে, তিনি মৃত্যুর পরবর্তী জীবনেও আবু দার্দার স্ত্রী হয়ে থাকতে চান।
উম্মে দার্দা জেরুজালেমে এক স্কুলে ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষা দিতেন। তার সুনামের কারণে খলিফা আবদ আল মালিক তার প্রতি আগ্রহী হন এবং তাকে জেরুজালেম ছেড়ে দামেস্কে এসে বসবাসের জন্যে অনুরোধ করেন। আর খলিফার সেই অনুরোধ উম্মে দার্দা রক্ষা করেন।
-এমন একজন মহিলা হারিসের অনুসারী হিসেবে অসামঞ্জস্য। তবু তার বিরুদ্ধে এমন অপবাদ রটেছিল। অপবাদ বললাম এ কারণে যে, দামেস্কানরা দেখেছিল তিনি বহিরাগত আবার আল হারিসও ছিল রিফুজি। আর সম্ভবত: তারা এটাকেই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেঁছে নিয়েছিল। যাইহোক, আমরা এখন উম্মে দার্দার বিরুদ্ধে এই অপবাদের সূত্রটি দেখব।
"ইসমাইল বিন ওবায়েদ আল্লা- উম্মে দার্দার একজন প্রথিত যশা ছাত্র বর্ণনা করেন- "উম্মে আল দার্দা আমাকে বললেন, 'লোকেরা আল হারিস আল কাদ্দাব সম্পর্কে কি বলছে?’
আমি বললাম, 'ও মা, তারা দাবী করছে আপনি তাকে আপনার আনুগত্যের শপথ দিয়েছেন!’ কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসা করেননি কে সেই ব্যক্তি যে এমন দাবী করছে, এটা হয়ত: একারণে যে, পাছে সেখানে কথা ওঠা ব্যক্তির প্রতি তার ঘৃণা জন্মে।” -(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, LXX, p. 126)
-এমন হাই প্রোফাইলের ব্যক্তিদের সাথে হারিসের সম্পর্কের সূত্রটিই বা কি? এ এই যে, একসময় আল হারিস খলিফা আবদ আল মালিক এর পিতা ও খলিফার পূর্বসূরী মারওয়ান বিন আল হাকাম এর শিক্ষক ছিলেন-(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, XI, p. 427.)।
সমাপ্ত।
ছবি: Wikipedia, amonamon2.wordpress.
উৎস:
খলিফা আবদ আল মালিক তার সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি বসরীয়কে কাছে ডাকলেন। সে তার নিকটবর্তী হলে তিনি বললেন, 'এখন বল, কি সংবাদ এনেছ?’
'আল হারিস’- সে নীচু স্বরে বলল।
খলিফা তার সিংহাসনে নড়ে-চড়ে বসলেন, বললেন, 'কোথায় সে?’
'হে বিশ্বাসীদের নেতা’-সে বলল, 'সে এখন জেরুজালেমে। আমি জানি কোথায় সে থাকে আর কোথায় সে যায়।’
বসরীয় তার আদ্যোপান্ত কাহিনী খলিফাকে খুলে বলল। সবশুনে খলিফা বললেন, 'তুমি তার সঙ্গী ছিলে। সুতরাং বল কিভাবে তাকে ধরা যাবে।’
বসরীয় বলল, 'আমার সঙ্গে কিছু লোক দেন যারা খোদার কালাম জানে না।’
সুতরাং খলিফা বসরীয়কে ৪০ জন ফারঘানা (Fargāna)-র লোক দিলেন এবং তাদেরকে তার আদেশ মত কাজ করতে নির্দেশ দিলেন। এই ফারঘানারা ছিল খলিফার 'আল বারিদ’ দলের সদস্য। উমাইয়া খলিফা আল বারিদকে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান বা কোন সম্মানিয় ব্যক্তি বা ভয়ানক কয়েদীকে প্রহরা দিয়ে আনায়নের কাজে ব্যবহার করতেন। যাইহোক, খলিফা জেরুজালেমের কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেও বসরীয়র হাতে দিলেন। এই চিঠিতে তিনি বসরীয় জেরুজালেম ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার সকল চাহিদা পূরণ করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বসরীয় জেরুজালেমে এসে নগর কর্মকর্তার সাথে দেখা করে খলিফার পত্রটি হস্তান্তর করল। তখন ঐ কর্মকর্তা বললেন, 'তুমি কি চাও?’
বসরীয় নগরের সকল শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তিকে জেরুজালেমের আনাচে কানাচে,প্রতিটি কোনায় কোনায়, রাস্তায় সর্বত্র মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং সংকেত পাবার পর যে-ই তাদের পাশ দিয়ে যাক না কেন তাকে আটক করার নির্দেশ দিলেন। তারপর যখন সবকিছু ছক অনুযায়ী করা হল, তখন সে একাকী হারিসের আস্তানায় গেল। সে দ্বারদেশে পৌঁছে দারোয়ানকে বলল, 'আমাকে ভিতরে যেতে অনুমতি দাও, যাতে আমি আল্লার নবীর সাথে দেখা করতে পারি।’
দ্বাররক্ষী তাকে নিস্পৃহ গলায় বলল, 'সকাল না হওয়া পর্যন্ত রাতের এই প্রহরে প্রবেশের কোন অনুমতি নেই।’
'তাকে জানাও’-বসরীয় বলল, 'যে আমি সবে পৌঁছেছি এবং পৌঁছানোর আগে থেকেই তার সাথে দেখা করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি।’
দ্বাররক্ষী ভিতরে গেল এবং একটু পরে এসে তার জন্যে দ্বার খুলে দিল।
বসরীয় গৃহমধ্যে প্রবেশ করার সংকেত পাওয়া মাত্র সকল মোমবাতি জ্বালান হল। এতে পুরো জেরুজালেম আলোকে আলোকিত হয়ে গেল। বসরীয় আল হারিসের মূল আস্তানায় প্রবেশ করল। কিন্তু তাকে সেখানে দেখল না। সে তখন তাকে খুঁজতে শুরু করল, তথাপি কক্ষের কোথাও তাকে পেল না। এসময় তার অনুসারীগণ যারা সেখানে ছিল তাকে বলল, 'হায়! তুমি আল্লার নবীকে হত্যা করতে চাও, কিন্তু তাকে স্বর্গে তুলে নেয়া হয়েছে!’
বসরীয় তাদের কথায় কান না দিয়ে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরল এবং একসময় দেয়াল গাত্রে তার লুকিয়ে থাকার নিরাপদ স্বর্গ আবিস্কার করে ফেলল। সে সেখানে হাত ঢুকিয়ে তাকে ধরে টেনে বের করে নিয়ে এল। তারপর তাকে জোরপূর্বক গৃহের বাইরে বের করে দিয়ে ফারগিন্সদের বলল, 'একে ধরে এমনভাবে বাঁধ, যেন পালাতে না পারে।'
আল হারিসকে যখন শৃংঙ্খলিত করা হচ্ছিল, তখন তিনি কোরআনের (৪০:২৮) আয়াতটি পাঠ করলেন। রক্ষী ঐ ফারগিন্সরা আরবী ভাল জানত না। তারা তখন তাকে বলল, “This is our Koran. Give us your own Koran.”
খলিফার 'আল বারিদ’ রক্ষীদল আল হারিসকে তার গলার সাথে হস্তদ্বয় একত্রে শৃংঙ্খলিত করল। তারপর তারা তাকে নিয়ে দামেস্কের পথে রওনা দিল। এই দল যখন একটি পার্বত্য পথের নিকট পৌঁছিল তখন জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে হারিস কোরআনের (৩৪:৫০) আয়াতটি পাঠ করলেন-“If I go astray, that is my loss, and if I am rightly guided it is through what my Lord has revealed to me.”
আয়াতটি পাঠ শেষ হওয়া মাত্র আল হারিসের গলা ও হাত থেকে শৃংঙ্খল খুলে মাটিতে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ রক্ষীরা তাকে আবার শৃংঙ্খলিত করল। কিন্তু হারিস এই একই ঘটনা পুনরায় ঘটাল যখন তারা অন্য একটি পার্বত্যময় পথের উপর পৌঁছিল।
অবশেষে আল বারিদ রক্ষীদল হারিসকে নিয়ে দামেস্কের আল সিনাবারাতে পৌঁছিল। আর তারপর খলিফা আবদ আল মালিককে হারিসের আগমন সংবাদ জ্ঞাত করলে তিনি তাকে কারাবন্দী করতে আদেশ দিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য খলিফা একজন অজ্ঞাত ফিকহবিদকে হারিসের কাছে পাঠিয়েছিলেন যেন তার মারফতে তিনি সত্য জানতে ও বুঝতে পারেন যে তিনি শয়তান দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং অত:পর তিনি অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে পারেন। কিন্তু হারিস ঐ ফিকহবিদ দ্বারা পরিশুদ্ধ হতে অস্বীকার করেন। তখন খলিফা তাকে জীবন্ত ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যার আদেশ দিলেন। এই আদেশ শুনে আল হারিস বলে উঠলেন- “Will you (pl.) kill a man who says, ‘My Lord is God?'”-(৪০:২৮)।
তখন শীতকাল। আল হারিসের জন্যে একটা ক্রুস তৈরী করা হল। তারপর কোন এক সকালে তাকে ঐ ক্রুসে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে দেযা হল। তবে বিষ্ময়ের ব্যাপার এই যে, হারিস ক্রুসবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুহুর্তেও একটি অলৌকিক কার্য্য দেখিয়ে যান। তিনি যখন ক্রুসে ঝুলছিলেন তখন একজন রক্ষী বর্শা দিয়ে তার বুকের বামদিকে বিদ্ধ করতে চাইল। কিন্তু তার সেই বর্শার আঘাত তাকে বিদ্ধ করতে পারেনি। বর্শার লৌহ ফলক পশ্চাৎদিকে বেঁকে গেল এবং বর্শাধারীকে দ্বিগুণ বেগে দূরে ঠেলে দিল। এতে সাধারণ দর্শণার্থীরা ঘোষণা করল- 'তিনি অভেদ্য।’
কেউ কেউ বলল, 'অস্ত্র কোন নবীর উপর কাজ করবে না (Weapons do not avail against prophets!).’
হারিসের অনুসারীগণ এসময় মাটিতে উঁপুড় হয়ে ভয়ে ও বিষ্ময়ে তাকে সম্মান করল। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল- “it’s not possible for someone like him to be killed!”
ঐ রক্ষী দ্রুত গিয়ে খলিফাকে বিষয়টি জ্ঞাত করলে তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন, “Muhammad was not the father of any of your men, but was God’s Messenger and the Seal of the Prophets.”-(৩৩:৪০)। তিনি ঐ রক্ষীকে খোদার নাম নিয়ে হারিসকে বিদ্ধ করার চেষ্টার জন্যে তিরস্কার করেন।
তারপর খলিফা তার প্রধান কারারক্ষী আবু জুরা রওয়াহ বিন জিন্বা (Abū Zura Rawh b. Zinbā)-কে ডেকে এ নির্দেশ দেন- “Pierce his right side, then the šaytān will be forced out his left.” এতে সে পাতলা সূচালো এক বল্লম নিয়ে এসে হারিসের পাঁজড়ের বিভিন্ন স্থানে খোঁচাতে থাকল যতক্ষণ না তা বিদ্ধ হয়। অবশেষে দুই পাঁজড়ের মধ্যস্থানে বল্লম বিদ্ধ হলে সে তা এমনভাবে বিদ্ধ করতে থাকল যতক্ষণ না বল্লমের অগ্রভাগ তার পৃষ্ঠদেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এভাবেই হারিসের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।
আল হারিস তার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ, সুমিষ্ট কন্ঠ ও বাণী দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তিনি স্বল্প সময়ে এক বিরাট অনুগত অনুসারী তৈরী করেন। তার মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রমান পাওয়া যায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খলিফার অভিযোগ থেকে। সম্ভবত: খলিফার উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মধ্যেও তার অনুসারী ছিল। কিছু কিছু সূত্র জানায় জিলান, যিনি রাজদরবারের খতিব ছিলেন ও উম্মে আল দার্দার বিরুদ্ধে কানাঘুষা হয়েছিল যে তারা হারিসের সমর্থক ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল।
জিলান আল দামেস্কী, রাজদরবারের সেক্রেটারী বা খতিবই শুধু ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথেও জড়িত ছিলেন। হিশাম বিন আবদ আল মালিক তাকে ক্রুসবিদ্ধ করে দামেস্কের নগর দ্বারে ঝুলিয়ে দেন। কিন্তু এই শাস্তি দেশদ্রোহীর বেলায় প্রযোজ্য ছিল ধর্মদ্রোহীর বেলায় নয়। সম্ভবত: হিশাম হারিসের প্রতি জিলানের সহানুভূতির কথা জানতে পেরেই এই কঠোর শাস্তি দেন। প্রথমে আমরা জিলানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুত্রগুলোতে নজর বুলিয়ে যাই-
সূত্র-১: আল ওয়ালিদ বিন মুসলিম বর্ণনা করেন- আল মুন্দির বিন নাফি বলেন তিনি জিলানকে তিরস্কার করে হালিদ বিন লাগলাগকে বলতে শুনেছেন, ’ড্যাম য়্যূ জিলান, তুমি কি নাচনেওয়ালা ছিলে না? ড্যাম য়্যূ, তুমি কি কিবতী ছিলে না যে পরে মুসলমান হয়েছে? আমি কি তোমাকে রমজান মাসে মহিলাদের দিকে আপেল ছুঁড়ে দেবার সময় হাতেনাতে ধরিনি? একসময় তুমি হারিস আল কাদ্দাবের স্ত্রীর প্রহরার দায়িত্ব নিয়েছিলে আর দাবী করেছিলে তিনি বিশ্বাসীদের মাতা। আর তারপর তুমি তোমার মতাদর্শের পরিবর্তন ঘটালে, বনে গেলে কাদেরী- একজন জিন্দিক (zindīq-a Persian word resembling the heretic notion of hulul al-Ruh, incarnation of the spirit, often related to Manichaeism. The term zindīq here likely does not connote dualist beliefs, despite the frequent associa-tions of qadar with Magians, but rather Gaylān’s practice of kalām;)! -(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, XLVIII, p. ১৯২)
সূত্র-২: ইয়াহিয়া বিন মুসলিম নাম্নী এক সিরীয় জেরুজালেমে গিয়েছিল খোদার পবিত্র নগরীতে আল আকসা মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্যে। এই সময় সে যখন শহরে প্রবেশ করল, তখন এক লোকের সাথে তার দেখা হল। লোকটি তার কাছে জানতে চাইল যে এই শহুরে ভ্রাতার জন্যে কিছুটা সময় ব্যয় করার মত অবকাশ তার আছে কিনা। যখন সে সম্মতি দিল, তখন সে তার এই কাহিনী বর্ণনা করল-
'শহরে রাতটা কাটাও’ লোকটি বলল, 'সকালে তুমি ঘুম থেকে উঠলে আমি তোমার সাথে দেখা করব।’
পরদিন সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম, সে আমার সাথে দেখা করল এবং বলল, ’তুমি রাতে স্বপ্নের মধ্যে কি কিছু দেখেছ?’
আমি বললাম, 'না, ভাল স্বপ্নই তো দেখলাম।’
সে এই বিষয়ে আমাকে তিনবার প্রশ্ন করল তারপর সে বলল, 'চল।’
আমি তার সাথে গেলাম এবং আমরা একটা ডেরায় প্রবেশ করলাম। সেখানে আমি দেখলাম জিলান, আল হারিস আল কাদ্দাব ও তার অনেকগুলো সঙ্গী রয়েছেন। এ সময় এক ব্যক্তি জিলানকে বলল, 'আবু মারওয়ান! আপনি ঐ সহিফাটি কি করলেন যেটা আমরা গতকাল পাঠ করছিলাম?’
জিলান বললেন, 'সেটার সঠিকত্ব নিরীক্ষণে স্বর্গে ফেরৎ নেয়া হয়েছে আর তারপর সেটা আমাদের কাছে পুনরায় অবতরণিত হবে।’
তখন আমি বললাম, 'আমি কখনও ভাবিনি যে, জীবিত অবস্থায় কখনও মুহম্মদের কমিউনিটির মধ্যে আমি এমনকিছু শুনতে পাব।’-(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, XLVIII, p. ১৯১).
অন্যদিকে উম্মে আল দার্দা রাজ দরবাবের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি এই পদ অর্জন করেছিলেন একজন ফিকহবিদ হিসেবে। বাল্যকালে তাকে এতিম অবস্থায় লালন-পালন করেন রসুলুল্লাহর সাহাবী আবু দার্দা। উম্মে দার্দা প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই কোরআন এবং অন্যান্য ধর্মতত্ত্বের উপর তার দখল আসে আবু দার্দার প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানে। পরে তিনি যৌবণ প্রাপ্ত হলে আবু দার্দা তাকে বিবাহ করে নেন। আবু দার্দার মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এই বলে যে, তিনি মৃত্যুর পরবর্তী জীবনেও আবু দার্দার স্ত্রী হয়ে থাকতে চান।
উম্মে দার্দা জেরুজালেমে এক স্কুলে ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষা দিতেন। তার সুনামের কারণে খলিফা আবদ আল মালিক তার প্রতি আগ্রহী হন এবং তাকে জেরুজালেম ছেড়ে দামেস্কে এসে বসবাসের জন্যে অনুরোধ করেন। আর খলিফার সেই অনুরোধ উম্মে দার্দা রক্ষা করেন।
-এমন একজন মহিলা হারিসের অনুসারী হিসেবে অসামঞ্জস্য। তবু তার বিরুদ্ধে এমন অপবাদ রটেছিল। অপবাদ বললাম এ কারণে যে, দামেস্কানরা দেখেছিল তিনি বহিরাগত আবার আল হারিসও ছিল রিফুজি। আর সম্ভবত: তারা এটাকেই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেঁছে নিয়েছিল। যাইহোক, আমরা এখন উম্মে দার্দার বিরুদ্ধে এই অপবাদের সূত্রটি দেখব।
"ইসমাইল বিন ওবায়েদ আল্লা- উম্মে দার্দার একজন প্রথিত যশা ছাত্র বর্ণনা করেন- "উম্মে আল দার্দা আমাকে বললেন, 'লোকেরা আল হারিস আল কাদ্দাব সম্পর্কে কি বলছে?’
আমি বললাম, 'ও মা, তারা দাবী করছে আপনি তাকে আপনার আনুগত্যের শপথ দিয়েছেন!’ কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসা করেননি কে সেই ব্যক্তি যে এমন দাবী করছে, এটা হয়ত: একারণে যে, পাছে সেখানে কথা ওঠা ব্যক্তির প্রতি তার ঘৃণা জন্মে।” -(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, LXX, p. 126)
-এমন হাই প্রোফাইলের ব্যক্তিদের সাথে হারিসের সম্পর্কের সূত্রটিই বা কি? এ এই যে, একসময় আল হারিস খলিফা আবদ আল মালিক এর পিতা ও খলিফার পূর্বসূরী মারওয়ান বিন আল হাকাম এর শিক্ষক ছিলেন-(Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq, XI, p. 427.)।
সমাপ্ত।
ছবি: Wikipedia, amonamon2.wordpress.
উৎস:
- Sean W. Anthony,The Prophecy and Passion of al-Harith ibn Sa'id al-Kadhdhab,
- Ibn Asākir, Ta'rih madinat Damasq,
- D.M. Dunlop, al-Hārith b. Saīd al-Kadhdhāb,
- F. Donner, Narratives of Islamic Origins.
- A. Elad, The Rise and Development of Early Muslim Historiography,
- Yāqūt al-Hamawī (d. 626/1229), Muğam al-buldān,
- Šams al-Dīn al-Dahabī (d. 748/1348), Tarīh ̮al-Islām wa-wafayāt al-mašāhīr wa-l-alām
- Ibn Katīr (d. 774/1373),al-Bidāya wa-l-nihāya,
- Ibn al-Ğawzī (d. 597/1200), al-Muntaz am fī Tarīh ̮al-mulūk wa-l-umam,
- Ibn Hağar al- Asqalānī (d. 852/1449),Lisān al-mīzān,
- Šihāb al-Dīn Mahmūd b. Tamīm al-Maqdisī (d.765/1363), Mutīr al-garām ilā ziyārat al-Quds wa-l-Šām,
- Ahmad b. Yahyā l-Balādurī (d. 279/982), Ansāb al-ašrāf,
- Abū Bakr Ahmad b. Abī Haytama, al-Tarīh ̮al-kabīr,
- Ğamāl al-Dīn al-Mizzī, Tahdīb al-Kamāl fī asmā al-riğāl,
- Mohammad Akram Nadwi, al-Muhaddithāt: The Women Scholars in Islam,
- Steven C. Judd, Ghaylān al-Dimashqī,
- Josef van Ess, Anfänge muslimischer Teologie,
- J.L. Kraemer, “Apostates, Rebels and Brigands”,
- Šams al-Dīn al-Dahabī, Siyar alām al-nubalā,
- Wikipedia.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন