সাধারণ মানুষ চিরকাল বলে এসেছে, ন্যায় এবং ধর্মের পথ সম্মানের বটে কিন্তু তা কঠিন এবং বিপদসঙ্কূল। কিন্তু অন্যায় এবং পাপের পথে সুখ এবং সম্ভোগ সহজেই লাভ করা যায়। রাষ্ট্রীয় বিধানের কিছু ধমক আর সাধারণ মানুষের কিছু নিন্দাবাদ ব্যতিত অন্যায় এবং পাপের পক্ষে ভয় করার কিছু নেই। মানুষ একথাও জানে এবং তারা বলেও এসেছে যে, সততার পথে লাভের আশা কম, অসততাতেই লাভ। অসৎকে মানুষ সুখী বলেছে। তাকে তারা তাদের সম্পদ ও শক্তির জন্যে প্রকাশ্যে কিম্বা গোপনেও সম্মান করেছে। দুর্বল ও দরিদ্রকে তারা অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু তথাপি এ কথাও সত্য যে, মানুষ অসৎকে কখনও ভাল এবং সৎকে মন্দ বলেনি।
কিন্তু ন্যায় এবং অন্যায়ের বিচারে কিছু মানুষের ধারণা বেশ অদ্ভূত। খোদার সম্বন্ধে তারা বলেঃ খোদার রীতিনীতি বড়ই আশ্চর্যজনক। তিনিই ভাগ্য-নিয়ন্তা-আর তাই যারা সৎ এবং ধর্ম পরায়ণ তাদের ভাগ্যে তিনি বন্টন করেন দু:খ এবং দুর্দশা; কিন্তু যারা অসৎ তাদেরকে তিনি আশীর্বাদ করেন সুখ এবং আনন্দ দিয়ে।
আবার দেবতায় বিশ্বাসী মানুষেরা বলে: -ভিক্ষু বেশে দেবতা হাজির হন ধনীর দরজায়, আর অভয় দিয়ে বলেন, কোন পাপেই তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা দেবতারা ধনীর নিজের কিম্বা তাদের পিতৃ-পিতামহের পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করে দেবেন। কেবল কিছু খরচ করলেই তাদের চলবে। দেবতাদের নামে উৎসর্গ করুক তার সম্পদের কিছু কিম্বা দিয়ে দিক একটা ভোজ, তাহলেই তাদের পাপের মার্জনা হয়ে যাবে। বলুক তারা তাদের শত্রু কে? হোক না সে শত্রু ন্যায়পরায়ণ। ধনীর আব্দারে সেই ন্যায়পরায়ণকে অচিরে ধ্বংস করে দেবে দেবতা তার বরপুত্র ধনীর স্বার্থে। মন্ত্র পড়ে তারা প্রেতযোনীকে আটকে দিতে পারে, পারে তারা যেমন ইচ্ছে তেমনি করে তাদের দ্বারা কার্য সাধন করতে। এ ব্যাপারে কবিদের তারা সাক্ষী মানে-
পাপের প্রাচুর্য লাভে আমাদের শঙ্কার কোন কারণ নেই,
ওর সড়ক যেমন স্বচ্ছন্দ, ওর মঞ্জিল তেমনি সন্নিকট
এসো, সত্যের পথকে আমরা পরিহার করি,
ও পথে দেবতারা সঙ্কটের কাঁটাজাল বিস্তার করে দিয়েছে।
আর সে সড়কের চড়াই বড় খাড়া।----------- হিসিয়ড।
তারা কবি হোমারের উল্লেখ করেও দেখিয়ে দেয়, কিভাবে মানুষ সহজেই দেবতাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং কিভাবে সহজেই দেবতারা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েন-
দেবতাদের বিচ্যুতির পথে টেনে নামানো এমন কোন শক্ত ব্যাপার নয়;
মানুষ যদি কিছু পাপ করে থাকে আর দেবতা হয়ে থাকেন ক্রোধান্বিত,
তাহলে একটু প্রার্থনা, কিছু শূরার উপঢৌকন, আর ভাজা চর্বির লোভনীয় গন্ধ
এটাই হবে যথেষ্ট সেই দেবতার ক্রোধকে প্রশমিত করতে।----------- হোমার: ইলিয়াদ।
এই ভিক্ষুর দল বহু কিতাবের উল্লেখও করেন। তাদের মতে চন্দ্র এবং মিউজের যারা সন্তান, সেই মিউজিয়াস এবং অর্ফিয়ূস লিখিত গ্রন্থেও এ কথার সাক্ষ্য রয়েছে। আর এই সমস্ত কিতাবে বর্ণিত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মহড়া দিয়ে এরা ব্যক্তিমাত্রকে নয়, সমস্ত নগরবাসীকে একথা বিশ্বাস করায় যে, যজ্ঞ, ভোজ আর বিসর্জনের হুল্লোড় দ্বারাই মৃত কিম্বা জীবিত সবারই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারা করে দিতে পারেন। এভাবেই তারা যাগ-যজ্ঞ ও যাদু দ্বারা নরকের যন্ত্রণা থেকে আমাদের রেহাই দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের প্রতিশ্রুতিকে আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, কারণ তাদের অবজ্ঞা করলে আমাদের জন্যে চরম পরিণতি যে অপেক্ষা করছে- এ কথা বলতে তারা ভুলেন না।
ন্যায় ও অন্যায়ের এই চিত্র এবং অন্যায় সম্পর্কে মানুষ, খোদা বা দেবতাদের বিচার প্রণালীর কথা তরুণদের মনে যখন জাগে, তখন তাদের চিন্তা কোন দিকে ধাবিত হবে? তরুণদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ এবং বাতাসে ভেসে চলা মধুকরের ন্যায় পুষ্প থেকে পুষ্পে মধু আহরণ করার মেজাজ, তারা ন্যায় অন্যায়ের এই বোধ থেকে জীবনের কোন আদর্শকে নির্বাচিত করবে? জীবনের সর্বোত্তম ভোগকেই তারা তাদের চরম আদর্শ বলে বিবেচনা করবে, নয় কি?
একথা বলা এ কারণে যে, মানুষ মনে করে, সত্যিকারভাবে সৎ হয়েও সৎ বলে প্রচারিত না হলে সততার কোন লাভ নেই। এমন ক্ষেত্রে সৎ এর ভাগ্যে নিশ্চিতভাবে জুটবে দু;খ, কষ্ট এবং লাঞ্ছনা। অপরদিকে অসৎ হয়েও সৎ বলে পরিচিত হতে পারলে স্বর্গসুখ প্রাপ্তি অনিবার্য। কাজেই সত্যের চেয়ে অসত্যের মাহাত্ম্য যখন অধিক এবং অসত্যই যখন সুখ লাভের উত্তম মাধ্যম, তখন অসত্যের ধ্যানকেই জীবনের লক্ষ্য বলে স্থির করাকে মানুষ শ্রেয় বলে গণ্য করে। কারণ, সে মনে করে সুখ লাভের পথ হচ্ছে নিজের চারিদিকে ন্যায়ের একটি আবরণ তৈরী করা এবং সেই আবরণের আড়ালে ধূর্ত শেয়ালের ন্যায় নিজের স্বার্থ সাধনের জন্যে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করা। অবশ্য ধূর্ততা ঢেকে রাখা বেশ কঠিন।
এভাবে বুদ্ধির কৌশল এবং শক্তির জোরে স্বার্থ সাধন করা এবং দন্ডভোগ থেকে রেহাই পাওয়া খুব অসম্ভব কিছু না। কিন্তু কথা উঠবে, মানুষকে প্রতারিত করা সম্ভব হলেও খোদা বা দেবতাকে প্রতারিত করা সম্ভব নয়। তাদের উপর শক্তি প্রয়োগও অসম্ভব। এর জবাব এই যে, দেবতা থাকলে তো দেবতার ভয়! আর থাকলেও মানুষের জন্যে দেবতাদের ভাবনার গরজই বা কি? আর যদি তাদের শির:পীড়ারও কিছু থাকে তবুও চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা দেবতাদের কথা আমরা পুরাকাহিনী এবং কবিদের কাছ থেকেই পেয়েছি। আর তারা বলেছেনঃ বলিদান, প্রশংসামূলক অর্চণা এবং উপঢৌকন দেবতাদের ঠিক রাখার জন্যে যথেষ্ট।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম অন্যায়ের পথই হচ্ছে উত্তম পথ, লাভের পথ। সততার লাভ কেবল পরকালের দন্ড থেকে রেহাই পাওয়া। কিন্তু অন্যায়ের লাভ থেকে আমরা সততার কারণে বঞ্চিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে অসৎ হলে একদিকে যেমন আমরা জীবনের কোন উপভোগ থেকে বঞ্চিত হব না, তেমনি কবিদের কথা সত্য হলে, প্রার্থনা এবং প্রতারণায় দেবতাকূলকেও খুশী করা আমাদের অসম্ভব হবে না। অবশ্য কাপুরুষ বলতে পারে, নরকের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। সেখানে অন্যায়ের প্রতিফল আমাদের কিম্বা আমাদের বংশধরদের ভোগ করতে হবে। এর উত্তর হচ্ছে, প্রায়শ্চিত্তের দেবতার অভাব নেই সেখানেও। এরূপ দেবতাদের শক্তিও কম নয়।
সুতরাং মানুষ কেন চরম অন্যায়ের বদলে ন্যায়কে জীবনের আদর্শ বলে গ্রহণ করবে? ন্যায়ের কিছু আবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেই অন্যায় পথে দেবতা এবং মানুষ উভয়কেই আমরা জয় করতে পারি-ইহকাল এবং পরকাল উভয়ের সুখ আমরা নিজেদের জন্যে নিশ্চিত করতে পারি।
মানুষ ন্যায়বান কিম্বা সৎ কি নিজের ইচ্ছা সহকারে হয়? অবশ্য প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত কোন ব্যক্তি বা যথার্থ সত্যের জ্ঞানে জ্ঞানীর কথা আলাদা। আসলে কাপুরুষ, বৃদ্ধ এবং দুর্বল- অর্থাৎ অন্যায়ের পথ অবলম্বণে যারা অক্ষম তারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং ন্যায়ের কথা বলে।
এখন কেউ যদি বলে অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় উত্তম, তবে পরিফলের দিক থেকে তাকে একথাও বলতে হবে, কি কারণে সে একটিকে পূণ্য এবং অপরটিকে পাপ বলে বিবেচনা করছে। তবে এখানে খ্যাতির প্রশ্নটি বাদ দিতে হবে এবং ন্যায় অন্যায়ের নিজস্ব সার্থকতার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। কারণ তা না করলে অন্যায়কে অন্ধকারের আড়ালে রাখা হবে। আর তাতে ন্যায় বলতে বোঝাবে অপরের স্বার্থ সাধন আর অন্যায় হবে দুর্বলকে আঘাত করে সবলের নিজের স্বার্থোদ্ধার।
'অন্যায় যদি ন্যায় বলে প্রতিভাত হতে পারে, তাহলে অন্যায়ীর সব অন্যায় হচ্ছে লাভজনক।'- উপরের আলোচনা থেকে আপাত: দৃষ্টিতে এই বাক্যটি সত্য বলে প্রতিভাত হলেও প্রকৃতপক্ষে কি তাই? আমরা মানুষের চরিত্রকে পুরোন উপাখ্যানের জন্তু যেমন- কিমেরা, সিলা, সর্বিয়াসের সঙ্গে তুলনা করে উপরের উক্তির তাৎপর্যটি দেখি।
কিমেরা (Chimaera):ছাগ, সিংহ এবং সর্প-তিন জন্তুর দেহ বিশিষ্ট বিকটাকার দানব। গ্রীক উপাখ্যানে আছে কোরিন্থের রাজপুত্র বেলারোফন এই দানবকে তার পক্ষ যুক্ত অশ্ব দ্বারা হত্যা করে।
সিলা (Seylla):সামুদ্রিক দানব।
সার্বিয়াস (Cerberus):তিনটি কিম্বা পঞ্চাশটি মুন্ডু বিশিষ্ট পাতালপুরীর দেবতা হেডিসের প্রহরী কুকুর।
বেশ জটিল বহু মাথা বিশিষ্ট একটা জন্তু কল্পণা করি। এ জন্তুর যেমন বুনো মাথা আছে, তেমনি পোষা মাথা আছে। জন্তুটার মস্তকদেশ এইগুলি দিয়ে গঠিত। আর তার কি অদ্ভূত ক্ষমতা যে, সে ইচ্ছামত এগুলোকে হিংস্র কিম্বা বাধ্য স্বভাবে পরিণত করে ফেলতে পারে।
এবার একটা সিংহের কল্পণা করি। সিংহের পরে একজন মানুষকে কল্পণা করি। বহুমাথা জন্তুর আকৃতি অবশ্যই প্রকান্ড। তারপরেই সিংহের আকার। এবার তিন জন্তুকে মিলিয়ে একটা জন্তুতে পরিণত করি। এবার এই গোটা জন্তুর উপর তিন জন্তুর এক জন্তুর, ধরি, মানুষের বহিরাকার বসিয়ে দেই- যেন যে দর্শকের পক্ষে বহিরাকার ভেদ করা সম্ভব হবে না, সে যেন একে মানুষ বলেই গণ্য করে।
এবার তাহলে আমরা বলব, অন্যায় সাধনে লাভ এবং ন্যায় সাধনে লোকসান- এমন অভিমতের অর্থ দাঁড়ায় এই বহু মাথা জন্তুকে যেমন ইচ্ছে তেমন করার স্বাধীনতা দেয়া এবং এই জন্তুর এবং সিংহের চরিত্রকে শক্তিশালী করা, আর এর ভিতরের মানুষটিকে বুভূক্ষ ও অসহায় করে রাখা, যাতে পরিণামে এই জন্তুর দল দুর্বল মানুষটাকে নিয়ে যেমন খুশী তেমন করতে পারে। এ কথার অর্থ দাঁড়াবে, এই তিন শক্তির মধ্যে কোন আপোষ বা মিত্রতা স্থাপন না করা; বরং তাদের পরস্পরকে দ্বন্দ্বমান, গর্জনকারী এবং পরস্পরকে ভক্ষণকারী অবস্থায় রেখে দেয়া।
অপরদিকে ন্যায় সাধনেই লাভ- এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে আমাদের সকল কথা এবং কাজ এমন হওয়া উচিৎ যাতে আমাদের অন্তরের মানুষটি শক্তিশালী হতে পারে, যেন সে বহু মাথা জন্তুটার দিকে কৃষকের ন্যায় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারে। কৃষক দেখবে, আমাদের অন্তরের পোষা স্বভাবগুলি উৎসাহিত হতে পারে, যেন বন্য স্বভাবের বৃদ্ধি না ঘটে। সিংহকে বশ করে তার শক্তিকে সে সহায় করবে এবং সকলের স্বার্থ রক্ষার্থে তার নিজের সঙ্গে অপর দুই বন্য শক্তির এবং দুই বন্য শক্তির পরস্পরের মধ্যে আপোষ স্থাপন করবে।
সুতরাং সকলদিক আলোচনার পর আমরা জানলাম-অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় উত্তম। কারণ, ন্যায় এবং উত্তমতা পরিফলে মানুষের জন্যে এই লোকে এবং পরলোকে আশীর্বাদ বা পুরস্কার বয়ে আনে এবং অন্যায় ও অধমতা পরিফলে বয়ে অনে অপমান ও শাস্তি। তাছাড়া খোদার নিকট ন্যায় এবং অন্যায়ের যথার্থ চরিত্র অপরিজ্ঞাত নয়। খোদা ন্যায় এবং অন্যায়ের যথার্থ চরিত্রকে জানে এবং এরা উভয়ে যদি তাঁর পরিচিত হয় তবে এদের একজন তাঁর মিত্র এবং অপরজন তাঁর শত্রু বলে বিবেচিত হবে এবং খোদার নিকট থেকে তাঁর মিত্র যা কিছু উত্তম তাই লাভ করবে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে অতীতে কৃত কোন অপরাধের দন্ডের ক্ষেত্রে।
সুতরাং ন্যায়বান যদি দরিদ্র হয়, যদি সে অসুস্থ্য হয় কিম্বা অনুরূপ অপর কোন দুর্ভাগ্য দ্বারা যদি সে আক্রান্ত হয়, তাহলে এরূপ দুর্ভাগ্য তার এই জীবন কিম্বা পরজীবনের মঙ্গলেরই উৎস। কারণ, যে মানুষ ন্যায়কে বরণ করেছে এবং ন্যায়ের অনুসরণে যে মানুষ মানুষের সাধ্যমত ফেরেস্তায় পরিণত হওয়ার চেষ্টা করেছে, সে মানুষকে খোদা কোনক্রমেই অবজ্ঞা করতে পারেন না। অপরদিকে যে অন্যায়কারী তার ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই সত্য।
তবে অন্যায়কারীর জন্যে পরকালে শাস্তি নিশ্চিত হলেও এইলোকে সব সময়ে যে সে শাস্তির আওতায় আসবে এমন নয়। কেন নয়, তা জানতে আমরা আসমানী কিতাব এবং রসূলগণের বক্তব্যের প্রতি নজর দেব। প্রথমে আমরা নজর দেব ঈসা মসিহের বক্তব্যে-
প্রথমত: ঈসা সমবেত লোকদেরকে বললেন, ‘একজন লোক জমি চাষ করে সেখানে উৎকৃষ্ট গমের বীজ বুনলেন। এরপর সেই লোকের শত্রু এসে ঐ জমিতে শ্যামা ঘাসের বীজ বুনে চলে গেল। ফলে গমের চারা যখন বেড়ে উঠে ফল ধরল, তখন তার মধ্যে শ্যামা ঘাসও দেখা গেল। তা দেখে বাড়ীর গোলামেরা এসে মনিবকে বলল, ‘আপনি কি জমিতে উৎকৃষ্ট বীজ বুনেননি? তবে শ্যামা ঘাস কোথেকে এল?’
তিনি বললেন, ‘কোন শত্রু এ করেছে।’
গোলামেরা বলল, ‘তবে আমরা গিয়ে ঘাসগুলি তুলে ফেলব কি?’
তিনি বললেন, ‘না, ঘাস তুলতে গিয়ে তোমরা হয়তঃ ঘাসের সাথে গমের চারাও তুলে ফেলবে। ফল পাকা পর্যন্ত ওগুলি একসঙ্গে বাড়তে দাও। যারা ফসল কাটে, আমি তখন তাদের বলব, যেন তারা প্রথমে শ্যামা ঘাসগুলি জড় করে আগুনে পোড়াবার জন্যে আঁটি আঁটি করে বাঁধে, আর তারপরে গম আমার গোলায় জমা করে।’
এ থেকে কি জানলাম আমরা? পাপীষ্ঠের সাথে সৎ লোকও শাস্তির মধ্যে পড়ে যেতে পারে এ কারণে খোদা অসৎ মানুষকে শাস্তি দানে ফেরেস্তাদেরকে বিরত রাখেন।
দ্বিতীয়ত: ঈসা বললেন, ‘কোন এক ব্যক্তির আঙ্গুর ক্ষেতে একটা ডুমুর গাছ লাগান হয়েছিল। একবার ঐ মালিক এসে ফলের খোঁজ করলেন; কিন্তু পেলেন না। তখন তিনি মালীকে বললেন, ‘দেখ, তিন বৎসর ধরে এই ডুমুর গাছে আমি ফলের খোঁজ করছি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছিনে। সুতরাং তুমি গাছটি কেটে ফেল। কেন এ শুধু শুধু জমি নষ্ট করবে?’
মালী উত্তর দিল, ‘হুজুর, এই বৎসরও গাছটাকে থাকতে দিন। আমি ওর চারপাশে খুঁড়ে সার দেব। তারপর যদি ফল ধরে তো ভালই, তা না হলে আপনি ওটা কেটে ফেলবেন।’
অর্থাৎ দুনিয়াতে কর্মরত ফেরেস্তাগণ খোদাকে নিরন্তন শান্ত রাখেন পাপাচারী পাপ থেকে ফিরবে এই আশায়। আর এরই প্রতিফলন রয়েছে কোরআনে যে- আল্লাহ কোন জনপদ ধ্বংস করেন না, যে পর্য়ন্ত না তার কেন্দ্রস্থলে তাঁর রসূল প্রেরণ না করেন এবং তিনি কোন জনপদকে ততক্ষণ ধ্বংস করেন না যতক্ষণ না সেখানকার অধিবাসীগণ সীমালঙ্ঘন না করে।-২৮:৫৯
তৃতীয়ত: আবার অদৃশ্যলোকের একদল ফেরেস্তা পাপীষ্ঠদের কৃতকর্মের জন্যে খোদার কানের কাছে নিরন্তর করুণা ভিক্ষা করে যাচ্ছে। ঐ ফেরেস্তাগণও সর্বদা আশা করে মানুষ তাদের পাপের পথ থেকে ফিরবে। নবী আইয়ূবের সহিফায় রয়েছে-
যখন মানুষ পাপের পথে চলে, তখন ফেরেস্তাগণ চিৎকার করে বলেন-
‘হে খোদা! দোযখের শাস্তি থেকে তাকে রেহাই দাও।’
সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে আর তিনি তাকে দয়া করেন,
খোদা মানুষের জন্যে বারবার এসব করেন।-----------আইয়ূবের সহিফা।
সর্বশেষ ঐশী কিতাব কোরআনেরও এর সমর্থণ রয়েছে-‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চতুর্দিক ঘিরে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে- প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং বিশ্বাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! প্রত্যেক বিষয় তোমার দয়া ও জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত আছে, অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বণ করে, তুমি তাদের ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদের স্থায়ী জান্নাতে উপস্থাপিত কর, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দিয়েছ এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরও। নিশ্চয় তুমি মহাপরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময় এবং তুমি তাদের শাস্তি হতে রক্ষা কর, সেদিন যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে তাকে তো অনুগ্রহই করবে, এ সেই মহান সফলতা।’----------(কোরআন, ৪০:৭-৯)
সমাপ্ত।
কিন্তু ন্যায় এবং অন্যায়ের বিচারে কিছু মানুষের ধারণা বেশ অদ্ভূত। খোদার সম্বন্ধে তারা বলেঃ খোদার রীতিনীতি বড়ই আশ্চর্যজনক। তিনিই ভাগ্য-নিয়ন্তা-আর তাই যারা সৎ এবং ধর্ম পরায়ণ তাদের ভাগ্যে তিনি বন্টন করেন দু:খ এবং দুর্দশা; কিন্তু যারা অসৎ তাদেরকে তিনি আশীর্বাদ করেন সুখ এবং আনন্দ দিয়ে।
আবার দেবতায় বিশ্বাসী মানুষেরা বলে: -ভিক্ষু বেশে দেবতা হাজির হন ধনীর দরজায়, আর অভয় দিয়ে বলেন, কোন পাপেই তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা দেবতারা ধনীর নিজের কিম্বা তাদের পিতৃ-পিতামহের পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করে দেবেন। কেবল কিছু খরচ করলেই তাদের চলবে। দেবতাদের নামে উৎসর্গ করুক তার সম্পদের কিছু কিম্বা দিয়ে দিক একটা ভোজ, তাহলেই তাদের পাপের মার্জনা হয়ে যাবে। বলুক তারা তাদের শত্রু কে? হোক না সে শত্রু ন্যায়পরায়ণ। ধনীর আব্দারে সেই ন্যায়পরায়ণকে অচিরে ধ্বংস করে দেবে দেবতা তার বরপুত্র ধনীর স্বার্থে। মন্ত্র পড়ে তারা প্রেতযোনীকে আটকে দিতে পারে, পারে তারা যেমন ইচ্ছে তেমনি করে তাদের দ্বারা কার্য সাধন করতে। এ ব্যাপারে কবিদের তারা সাক্ষী মানে-
পাপের প্রাচুর্য লাভে আমাদের শঙ্কার কোন কারণ নেই,
ওর সড়ক যেমন স্বচ্ছন্দ, ওর মঞ্জিল তেমনি সন্নিকট
এসো, সত্যের পথকে আমরা পরিহার করি,
ও পথে দেবতারা সঙ্কটের কাঁটাজাল বিস্তার করে দিয়েছে।
আর সে সড়কের চড়াই বড় খাড়া।----------- হিসিয়ড।
তারা কবি হোমারের উল্লেখ করেও দেখিয়ে দেয়, কিভাবে মানুষ সহজেই দেবতাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং কিভাবে সহজেই দেবতারা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েন-
দেবতাদের বিচ্যুতির পথে টেনে নামানো এমন কোন শক্ত ব্যাপার নয়;
মানুষ যদি কিছু পাপ করে থাকে আর দেবতা হয়ে থাকেন ক্রোধান্বিত,
তাহলে একটু প্রার্থনা, কিছু শূরার উপঢৌকন, আর ভাজা চর্বির লোভনীয় গন্ধ
এটাই হবে যথেষ্ট সেই দেবতার ক্রোধকে প্রশমিত করতে।----------- হোমার: ইলিয়াদ।
এই ভিক্ষুর দল বহু কিতাবের উল্লেখও করেন। তাদের মতে চন্দ্র এবং মিউজের যারা সন্তান, সেই মিউজিয়াস এবং অর্ফিয়ূস লিখিত গ্রন্থেও এ কথার সাক্ষ্য রয়েছে। আর এই সমস্ত কিতাবে বর্ণিত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মহড়া দিয়ে এরা ব্যক্তিমাত্রকে নয়, সমস্ত নগরবাসীকে একথা বিশ্বাস করায় যে, যজ্ঞ, ভোজ আর বিসর্জনের হুল্লোড় দ্বারাই মৃত কিম্বা জীবিত সবারই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারা করে দিতে পারেন। এভাবেই তারা যাগ-যজ্ঞ ও যাদু দ্বারা নরকের যন্ত্রণা থেকে আমাদের রেহাই দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের প্রতিশ্রুতিকে আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, কারণ তাদের অবজ্ঞা করলে আমাদের জন্যে চরম পরিণতি যে অপেক্ষা করছে- এ কথা বলতে তারা ভুলেন না।
ন্যায় ও অন্যায়ের এই চিত্র এবং অন্যায় সম্পর্কে মানুষ, খোদা বা দেবতাদের বিচার প্রণালীর কথা তরুণদের মনে যখন জাগে, তখন তাদের চিন্তা কোন দিকে ধাবিত হবে? তরুণদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ এবং বাতাসে ভেসে চলা মধুকরের ন্যায় পুষ্প থেকে পুষ্পে মধু আহরণ করার মেজাজ, তারা ন্যায় অন্যায়ের এই বোধ থেকে জীবনের কোন আদর্শকে নির্বাচিত করবে? জীবনের সর্বোত্তম ভোগকেই তারা তাদের চরম আদর্শ বলে বিবেচনা করবে, নয় কি?
একথা বলা এ কারণে যে, মানুষ মনে করে, সত্যিকারভাবে সৎ হয়েও সৎ বলে প্রচারিত না হলে সততার কোন লাভ নেই। এমন ক্ষেত্রে সৎ এর ভাগ্যে নিশ্চিতভাবে জুটবে দু;খ, কষ্ট এবং লাঞ্ছনা। অপরদিকে অসৎ হয়েও সৎ বলে পরিচিত হতে পারলে স্বর্গসুখ প্রাপ্তি অনিবার্য। কাজেই সত্যের চেয়ে অসত্যের মাহাত্ম্য যখন অধিক এবং অসত্যই যখন সুখ লাভের উত্তম মাধ্যম, তখন অসত্যের ধ্যানকেই জীবনের লক্ষ্য বলে স্থির করাকে মানুষ শ্রেয় বলে গণ্য করে। কারণ, সে মনে করে সুখ লাভের পথ হচ্ছে নিজের চারিদিকে ন্যায়ের একটি আবরণ তৈরী করা এবং সেই আবরণের আড়ালে ধূর্ত শেয়ালের ন্যায় নিজের স্বার্থ সাধনের জন্যে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করা। অবশ্য ধূর্ততা ঢেকে রাখা বেশ কঠিন।
এভাবে বুদ্ধির কৌশল এবং শক্তির জোরে স্বার্থ সাধন করা এবং দন্ডভোগ থেকে রেহাই পাওয়া খুব অসম্ভব কিছু না। কিন্তু কথা উঠবে, মানুষকে প্রতারিত করা সম্ভব হলেও খোদা বা দেবতাকে প্রতারিত করা সম্ভব নয়। তাদের উপর শক্তি প্রয়োগও অসম্ভব। এর জবাব এই যে, দেবতা থাকলে তো দেবতার ভয়! আর থাকলেও মানুষের জন্যে দেবতাদের ভাবনার গরজই বা কি? আর যদি তাদের শির:পীড়ারও কিছু থাকে তবুও চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা দেবতাদের কথা আমরা পুরাকাহিনী এবং কবিদের কাছ থেকেই পেয়েছি। আর তারা বলেছেনঃ বলিদান, প্রশংসামূলক অর্চণা এবং উপঢৌকন দেবতাদের ঠিক রাখার জন্যে যথেষ্ট।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম অন্যায়ের পথই হচ্ছে উত্তম পথ, লাভের পথ। সততার লাভ কেবল পরকালের দন্ড থেকে রেহাই পাওয়া। কিন্তু অন্যায়ের লাভ থেকে আমরা সততার কারণে বঞ্চিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে অসৎ হলে একদিকে যেমন আমরা জীবনের কোন উপভোগ থেকে বঞ্চিত হব না, তেমনি কবিদের কথা সত্য হলে, প্রার্থনা এবং প্রতারণায় দেবতাকূলকেও খুশী করা আমাদের অসম্ভব হবে না। অবশ্য কাপুরুষ বলতে পারে, নরকের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। সেখানে অন্যায়ের প্রতিফল আমাদের কিম্বা আমাদের বংশধরদের ভোগ করতে হবে। এর উত্তর হচ্ছে, প্রায়শ্চিত্তের দেবতার অভাব নেই সেখানেও। এরূপ দেবতাদের শক্তিও কম নয়।
সুতরাং মানুষ কেন চরম অন্যায়ের বদলে ন্যায়কে জীবনের আদর্শ বলে গ্রহণ করবে? ন্যায়ের কিছু আবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেই অন্যায় পথে দেবতা এবং মানুষ উভয়কেই আমরা জয় করতে পারি-ইহকাল এবং পরকাল উভয়ের সুখ আমরা নিজেদের জন্যে নিশ্চিত করতে পারি।
মানুষ ন্যায়বান কিম্বা সৎ কি নিজের ইচ্ছা সহকারে হয়? অবশ্য প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত কোন ব্যক্তি বা যথার্থ সত্যের জ্ঞানে জ্ঞানীর কথা আলাদা। আসলে কাপুরুষ, বৃদ্ধ এবং দুর্বল- অর্থাৎ অন্যায়ের পথ অবলম্বণে যারা অক্ষম তারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং ন্যায়ের কথা বলে।
এখন কেউ যদি বলে অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় উত্তম, তবে পরিফলের দিক থেকে তাকে একথাও বলতে হবে, কি কারণে সে একটিকে পূণ্য এবং অপরটিকে পাপ বলে বিবেচনা করছে। তবে এখানে খ্যাতির প্রশ্নটি বাদ দিতে হবে এবং ন্যায় অন্যায়ের নিজস্ব সার্থকতার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। কারণ তা না করলে অন্যায়কে অন্ধকারের আড়ালে রাখা হবে। আর তাতে ন্যায় বলতে বোঝাবে অপরের স্বার্থ সাধন আর অন্যায় হবে দুর্বলকে আঘাত করে সবলের নিজের স্বার্থোদ্ধার।
কিমেরা। |
সিলা (Seylla):সামুদ্রিক দানব।
সার্বিয়াস (Cerberus):তিনটি কিম্বা পঞ্চাশটি মুন্ডু বিশিষ্ট পাতালপুরীর দেবতা হেডিসের প্রহরী কুকুর।
সিলা। |
সার্বিয়াস। |
অপরদিকে ন্যায় সাধনেই লাভ- এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে আমাদের সকল কথা এবং কাজ এমন হওয়া উচিৎ যাতে আমাদের অন্তরের মানুষটি শক্তিশালী হতে পারে, যেন সে বহু মাথা জন্তুটার দিকে কৃষকের ন্যায় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারে। কৃষক দেখবে, আমাদের অন্তরের পোষা স্বভাবগুলি উৎসাহিত হতে পারে, যেন বন্য স্বভাবের বৃদ্ধি না ঘটে। সিংহকে বশ করে তার শক্তিকে সে সহায় করবে এবং সকলের স্বার্থ রক্ষার্থে তার নিজের সঙ্গে অপর দুই বন্য শক্তির এবং দুই বন্য শক্তির পরস্পরের মধ্যে আপোষ স্থাপন করবে।
সুতরাং ন্যায়বান যদি দরিদ্র হয়, যদি সে অসুস্থ্য হয় কিম্বা অনুরূপ অপর কোন দুর্ভাগ্য দ্বারা যদি সে আক্রান্ত হয়, তাহলে এরূপ দুর্ভাগ্য তার এই জীবন কিম্বা পরজীবনের মঙ্গলেরই উৎস। কারণ, যে মানুষ ন্যায়কে বরণ করেছে এবং ন্যায়ের অনুসরণে যে মানুষ মানুষের সাধ্যমত ফেরেস্তায় পরিণত হওয়ার চেষ্টা করেছে, সে মানুষকে খোদা কোনক্রমেই অবজ্ঞা করতে পারেন না। অপরদিকে যে অন্যায়কারী তার ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই সত্য।
তবে অন্যায়কারীর জন্যে পরকালে শাস্তি নিশ্চিত হলেও এইলোকে সব সময়ে যে সে শাস্তির আওতায় আসবে এমন নয়। কেন নয়, তা জানতে আমরা আসমানী কিতাব এবং রসূলগণের বক্তব্যের প্রতি নজর দেব। প্রথমে আমরা নজর দেব ঈসা মসিহের বক্তব্যে-
তিনি বললেন, ‘কোন শত্রু এ করেছে।’
গোলামেরা বলল, ‘তবে আমরা গিয়ে ঘাসগুলি তুলে ফেলব কি?’
তিনি বললেন, ‘না, ঘাস তুলতে গিয়ে তোমরা হয়তঃ ঘাসের সাথে গমের চারাও তুলে ফেলবে। ফল পাকা পর্যন্ত ওগুলি একসঙ্গে বাড়তে দাও। যারা ফসল কাটে, আমি তখন তাদের বলব, যেন তারা প্রথমে শ্যামা ঘাসগুলি জড় করে আগুনে পোড়াবার জন্যে আঁটি আঁটি করে বাঁধে, আর তারপরে গম আমার গোলায় জমা করে।’
এ থেকে কি জানলাম আমরা? পাপীষ্ঠের সাথে সৎ লোকও শাস্তির মধ্যে পড়ে যেতে পারে এ কারণে খোদা অসৎ মানুষকে শাস্তি দানে ফেরেস্তাদেরকে বিরত রাখেন।
দ্বিতীয়ত: ঈসা বললেন, ‘কোন এক ব্যক্তির আঙ্গুর ক্ষেতে একটা ডুমুর গাছ লাগান হয়েছিল। একবার ঐ মালিক এসে ফলের খোঁজ করলেন; কিন্তু পেলেন না। তখন তিনি মালীকে বললেন, ‘দেখ, তিন বৎসর ধরে এই ডুমুর গাছে আমি ফলের খোঁজ করছি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছিনে। সুতরাং তুমি গাছটি কেটে ফেল। কেন এ শুধু শুধু জমি নষ্ট করবে?’
মালী উত্তর দিল, ‘হুজুর, এই বৎসরও গাছটাকে থাকতে দিন। আমি ওর চারপাশে খুঁড়ে সার দেব। তারপর যদি ফল ধরে তো ভালই, তা না হলে আপনি ওটা কেটে ফেলবেন।’
অর্থাৎ দুনিয়াতে কর্মরত ফেরেস্তাগণ খোদাকে নিরন্তন শান্ত রাখেন পাপাচারী পাপ থেকে ফিরবে এই আশায়। আর এরই প্রতিফলন রয়েছে কোরআনে যে- আল্লাহ কোন জনপদ ধ্বংস করেন না, যে পর্য়ন্ত না তার কেন্দ্রস্থলে তাঁর রসূল প্রেরণ না করেন এবং তিনি কোন জনপদকে ততক্ষণ ধ্বংস করেন না যতক্ষণ না সেখানকার অধিবাসীগণ সীমালঙ্ঘন না করে।-২৮:৫৯
তৃতীয়ত: আবার অদৃশ্যলোকের একদল ফেরেস্তা পাপীষ্ঠদের কৃতকর্মের জন্যে খোদার কানের কাছে নিরন্তর করুণা ভিক্ষা করে যাচ্ছে। ঐ ফেরেস্তাগণও সর্বদা আশা করে মানুষ তাদের পাপের পথ থেকে ফিরবে। নবী আইয়ূবের সহিফায় রয়েছে-
যখন মানুষ পাপের পথে চলে, তখন ফেরেস্তাগণ চিৎকার করে বলেন-
‘হে খোদা! দোযখের শাস্তি থেকে তাকে রেহাই দাও।’
সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে আর তিনি তাকে দয়া করেন,
খোদা মানুষের জন্যে বারবার এসব করেন।-----------আইয়ূবের সহিফা।
সর্বশেষ ঐশী কিতাব কোরআনেরও এর সমর্থণ রয়েছে-‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চতুর্দিক ঘিরে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে- প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং বিশ্বাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! প্রত্যেক বিষয় তোমার দয়া ও জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত আছে, অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বণ করে, তুমি তাদের ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদের স্থায়ী জান্নাতে উপস্থাপিত কর, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দিয়েছ এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরও। নিশ্চয় তুমি মহাপরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময় এবং তুমি তাদের শাস্তি হতে রক্ষা কর, সেদিন যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে তাকে তো অনুগ্রহই করবে, এ সেই মহান সফলতা।’----------(কোরআন, ৪০:৭-৯)
সমাপ্ত।
ছবি: thanasis, timelessmyths, bloodbrothersgame.wikia.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন