নব্যুয়তের একাদশ বৎসর। একদিন মুহম্মদ বিষন্ন অথচ আশান্বিত হৃদয়ে মক্কায় আগত আধা ব্যবসায়ী আধা তীর্থযাত্রীদের মধ্যে প্রচার কাজ চালাচ্ছেন। এসময় দূর ইয়াসরিব থেকে আগত ছয়জন লোকের একটি দলের সঙ্গে তার দেখা হল। তিনি তাদেরকে কিছুক্ষণের বিশ্রামের মাঝে তার কথা শ্রবণের অনুরোধ করলেন। তারা বসলেন এবং মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনলেন। তারা শেষ নবীর আবির্ভাবের কথা জেনেছিলেন আর তারা তা জেনেছিলেন তাওরাতের অনুসারী ইহুদিদের কাছ থেকে। তারা প্রায়ই তাদেরকে বলত, ‘শেষ নবীর আবির্ভাবের সময় অত্যাসন্ন, আমরা তার সহযোগিতায় আমাদের হারান মর্যাদা পুনরুদ্ধার করব।’
তারা তাদের কথা স্মরণ করে ও মুহম্মদের আন্তরিকতা ও বক্তব্যের সত্যতায় বিমুগ্ধ হয়ে একে অন্যকে বললেন, ‘দেখ, তারা যেন আমাদের আগে সত্যপথ গ্রহণ করে প্রথম মর্যাদায় অভিষিক্ত না হয়।’
তারা মুহম্মদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন এবং দেশে ফিরে তড়িৎগতিতে প্রচার করলেন যে, আরবদের মধ্যে একজন প্রেরিত পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে যিনি এক আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করছেন এবং তাদের মধ্যে শতাব্দীব্যপী আত্মঘাতী কলহ দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
পরের বৎসর ৬২১ খ্রীঃ এ ইয়াসরিববাসীরা পুনঃরায় এলেন এবং সেই শহরের দু’টি প্রধান গোত্র আওস ও খাজরাজের প্রতিনিধি হিসেবে আরও ছয়জনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। যে স্থানে আগের বৎসর ছয়জন দীক্ষা নিয়েছিলেন সেখানেই নতুন এই ছয়জনও মুহম্মদের কাছে বায়াত হলেন। যে পর্বতের পাদদেশে এই শপথ হয়েছিল তার নামানুসারে এই শপথের নাম হল ‘আকাবার প্রথম শপথ।’ তারা যে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল-
-আমরা আল্লাহর সঙ্গে কোন বস্তুর শরীক করব না;
-চুরি করব না;
-ব্যভিচার করব না;
-আমাদের শিশু সন্তানদের হত্যা করব না;
-সর্বপ্রকার অশোভন ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে থাকব।
-সকল ভাল কাজে আমরা মুহম্মদের নির্দেশ মেনে চলব এবং
-সুখে-দুঃখে তার প্রতি অনুগত থাকব।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় এই লোকগুলো মুহম্মদকে বললেন, ‘কোরআন পাঠদানে সক্ষম এমন কাউকে আমাদের সঙ্গে দিলে ভাল হত।’
মুহম্মদ তখন মেসহাব বিন ওমরকে তাদের সঙ্গে দিলেন। এই মেসহাবের পিতার ছিল অগাধ ধন-সম্পত্তি। অতি মূল্যবান বস্ত্র পারিধান করে মেসহাব যখন মক্কার পথে বের হতেন তখন তার অগ্রে পশ্চাতে আর্দালী চলত। ইসলামে দীক্ষিত হবার পর তিনি এখন কপর্দকহীন কাঙ্গাল। যখন তিনি কোরআনের শিক্ষকরূপে মদিনায় যাচ্ছেন, তখন তার পরিধেয় কেবল এক টুকরো ছেঁড়া কম্বল।
ওহোদ যুদ্ধে এই মেসহাব শহীদ হয়েছিলেন।
মেসহাব ভক্তগণের সঙ্গে মদিনায় গমন করলেন। সেখানে তিনি আসাদ বিন জোরারার বাড়ীতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। ভক্তরা তাদের প্রতিজ্ঞা পূর্ণভাবেই প্রতিপালন করতে লাগলেন। অধিকন্তু কোরআনের পবিত্র শিক্ষার মাহাত্ম্যে তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবনের সূত্রপাত হল।
আনসারদের মধ্যে মহাত্মা সা‘দ বিন মু‘আজের নাম সর্বজন বিদিত। এই সা‘দ ও ওছায়দ নামক আর একব্যক্তি তখন আশহাল গোত্রের প্রধান সমাজপতি। ক্রমান্বয়ে মদিনায় ইসলামের প্রভাব বৃদ্ধি দর্শণ করে তারা বিচলিত হয়ে পড়লেন। তারা ইসলামের মূলোচ্ছেদ করার পরামর্শে লিপ্ত হলেন। সা‘দ ওছায়দকে বললেন, ‘আরে সর্বনাশ! এই লোক এখানে এসে আমাদের নিরীহ লোকগুলিকে একেবারে গোমরাহীর মধ্যে টেনে নিয়ে গেল, আর এখন আমাদের মধ্যে জালপাতার ব্যবস্থা করছে। তুমি গিয়ে তাদেরকে ভীতি প্রদর্শণ করে এস, যাতে আমাদের এদিকে তারা আর কখনও না আসে। না হলে এর পরিণাম তাদের জন্যে কখনই প্রীতকর হবে না। আমি নিজেই এর উচিৎ ব্যবস্থা করে আসতাম, কিন্তু হতভাগা আসাদটা আমার খালাত ভাই, তাই তুমি যাও।’
প্রধান দলপতির কথায় ওয়াছদ সর্বপ্রকার অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন এবং আসাদ ও মেসহাবকে একটা কূপের কাছে খুঁজে পেলেন। ওয়াছদ উগ্রমূর্ত্তি ধারণ পূর্বক কঠোর ভাষায় তাদেরকে বললেন, ‘দুরাত্মা! আমাদের দেশে এসেছ কেন? আমাদের সহজ সরল লোকগুলিকে প্রবঞ্চিত করতে? শীঘ্র এখান থেকে চলে যাও, যদি প্রাণের মায়া থাকে!’
এসময় মেসহাব ধীর, নম্র অথচ অবিচলিত কন্ঠে বললেন, ‘জনাব! একটু স্থির হয়ে বসুন, আমাদের বক্তব্য শ্রবণ করুন। যদি তা আপনার জ্ঞান ও বিবেক অনুসারে সত্য ও যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন, তবে তা গ্রহণ করবেন। আর যদি তা মন্দ প্রতিপন্ন হয়, তাহলে না হয় আপনি আমাদের বিরুদ্ধাচারণ করবেন।’
উগ্র ব্যাবহারের এমন নম্র ও যুক্তিযুক্ত উত্তর পেয়ে ওয়াছদ মনে মনে একটু লজ্জিত হলেন। তিনি প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে সেখানে বসলেন। মেসহাব তখন স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও ধীর গম্ভীর ভাষায় ইসলামের স্বরূপ এবং তার সত্যতা ও শিক্ষা উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিলেন এবং উপসংহারে কোরআনের কতকগুলি আয়াত পাঠ করলেন। কোরআন শ্রবণ করে ওয়াছদ বিমোহিত হলেন, এরপর সেখানেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। চলে আসার সময় তিনি মেসহাবকে বললেন, ‘আমাদের সমাজপতি সা‘দকে কৌশলে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেব, আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে, আশহাল গোত্রের মধ্যে আর কেউই ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করতে অগ্রসর হবে না।’
ওয়াছদ সোজা সা‘দের কাছে ফিরে গেলেন। সা‘দ তখন তার সভাগৃহে লোকজনসহ অবস্থান করছিলেন। ওয়াছদকে দেখেই তিনি গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি করে এলে?’
ওয়াছদ বললেন, ‘আমি তাদের সাথে কথাবার্তা বললাম। বিচলিত হবার কিছু নেই। আমি তাদের নিষেধ করেছিলাম, তারা বলল-আপনি যা বলেন আমরা তাই করব। ফেরার পথে শুনলাম আপনাকে অপদস্ত করার জন্যে হারেছ বংশের লোকেরা আপনার খালাত ভাই আসাদকে হত্যা করতে বের হয়েছে।’
এ কথায় সা‘দ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘তুমি দেখছি কিছুই করে আসতে পারনি।’
তিনি আসাদের বিপদের সংবাদে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে মেসহাবের কাছে গমন করলেন।
সা‘দ উলঙ্গ তরবারী হাতে অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে আসাদকে সম্বোধণ করে বললেন, ‘এসব কি হচ্ছে? কি বলব! তোমার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলে এতক্ষণ তোমার মাথা মাটিতে গড়াগড়ি দিত। ফাঁদ পেতে আমাদের বোকা লোকগুলিকে মজাতে বসেছ তোমরা!’
বিজ্ঞ মেসহাব আগের মত নম্র ও যুক্তিযুক্ত কথায় তার উত্তেজনা প্রশমিত করে ফেললেন। আলোচনা, উপদেশ ও কোরআন শ্রবণের পর সা‘দ আগ্রহ ও ভক্তি সহকারে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
এদিকে সা‘দ কি করে আসেন তা জানার জন্যে লোকেরা আগ্রহ ও উত্তেজনা সহকারে অপেক্ষা করছিল। অতঃপর সা‘দ ফিরে এলেন। লোকেরা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তিনি বললেন, ‘হে আশহাল বংশীয়রা! সত্যি করে বল, তোমরা আমাকে কেমন লোক বলে মনে করে থাক?’
তারা বলল, ‘তুমি আমাদের প্রধান, আমাদের ভক্তিভাজন দলপতি। তোমার জ্ঞানের গভীরতা, তোমার সিদ্ধান্তের সমীচীনতা এবং তোমার ন্যায়নিষ্ঠা সর্বজন বিদিত।’
তিনি বললেন, ‘তবে শোন! তোমাদের এই পৌত্তলিকতার, এই অনাচার ও অবিচারের এবং এই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ধর্মের সাথে-সর্বোপরি তোমাদের সাথে আমার আর কোন সম্বন্ধ নেই। যতক্ষণ না তোমরা এক অনাদি, অনন্ত ও বিশ্বচরাচরের একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন না কর, ততক্ষণ তোমাদের সাথে আমার কোন কথাবার্তাও নেই।’
উভয়পক্ষ হতে ইসলাম সম্বন্ধে তুমুল আলোচনা শুরু হল। অবশেষে সকলে ইসলামের সত্যতা ও মহাত্ম্য স্বীকার করল এবং সেই একদিনে- আশহাল গোত্রের সকল নর-নারী গোত্র প্রধানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইসলাম গ্রহণ করল। পরবর্তীতে মেসহাব ও অন্যান্যদের অতি আগ্রহের সাথে প্রচারের ফলে কয়েক মাসের মধ্যে ইসলাম প্রায় প্রত্যেক গোত্রের মাঝে স্থান করে নিল।
মদিনায় প্রচুর ইহুদি বাস করত কিন্তু সেখানকার পৌত্তলিকরা মূসার শরীয়ত গ্রহণ করেনি। কিন্তু মুহম্মদের শরীয়ত আগমনের পর লোকেরা দলে দলে তা গ্রহণ করতে লাগল। এর কারণ কোরআনে বিধৃত হয়েছে। ‘মরিয়ম তনয় ঈসা যখন বললেন- ‘হে ইস্রাইল বংশীয়রা, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ কর্তৃক তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি-আমার সম্মূখে তাওরাতের যা আছে- আমি তার সত্যতা ঘোষণা করছি এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রসূল আসবেন, আমি তার আগমনের সুসংবাদ দান করছি।’
কিন্তু যখন (সেই আহমদ) স্পষ্ট যুক্তি প্রমাণসহ আগমন করল, তখন তারা বলল-এগুলি তো স্পষ্ট যাদু। দেখ সেই ব্যক্তি অপেক্ষা অত্যাচারী কে? যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যে দোষারোপ করে থাকে অথচ তাকে ইসলামের দিকে আহবান করা হচ্ছে! আর আল্লাহ অত্যাচারী জাতিকে হেদায়েত করেন না। তারা (সেই অত্যাচারীরা) সঙ্কল্প করে যে, আল্লাহর জ্যোতিকে মুখের ফুৎকারে নিবিয়ে দেবে, কিন্তু আল্লাহ নিজের জ্যোতিকে পূর্ণে পরিণত করবেনই- যদিও ঈশ্বরদ্রোহীগণের কাছে এ প্রীতিকর না হয়। তিনি সেই (আল্লাহ), যিনি আপন রসূল (আহমদ)কে হেদায়েত ও সত্যধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেহেতু তাকে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করবেন, যদিও অংশীবাদীগণের কাছে এ অপ্রীতিকর হয়।’-(৩:৪৯-৫১)
পরের বৎসর (৬২২ খ্রীঃ-নব্যুয়তের ত্রয়োদশ বৎসরে) ইয়াসরিববাসীদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা তাদের পৌত্তলিক নাগরিকসহ মোট পাঁচ শতাধিক লোক মক্কায় আগমন করলেন। এদের মধ্যে সত্তুরজন মুসলিম, মুহম্মদকে তাদের কাছে যাবার আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে এসেছিলেন। কিন্তু আগত পৌত্তলিকরা তাদের সাথীদের অভিপ্রায় সম্পর্কে কিছুই জানত না। গভীর রাত্রে যখন সবাই ঘুমে অচেতন তখন এই নবদীক্ষিতরা যেখানে প্রথম শপথ গ্রহণ করেছিলেন সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হলেন। পিতৃব্য আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে মুহম্মদ সেখানে উপস্থিত হলেন। আব্বাস তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি তবে ইসলামের অগ্রগতিতে খুবই আগ্রহ অনুভব করতেন। তিনি আলোচনার উদ্বোধন করে পরিস্কারভাবে ইয়াসরিববাসীদের বুঝিয়ে দিলেন যে, ইসলাম গ্রহণ করে ও রসূলকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা কি ধরনের বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছেন। তারা সকলে একযোগে উত্তর দিলেন যে, বিপদের গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তারা বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী, আপনি বলুন এবং আপনার ও আপনার প্রভুর জন্যে যে কোন শপথ করান।’
মুহম্মদ অভ্যস্ত পথে কোরআনের কতিপয় আয়াত আবৃত্তি করে আলোচনা শুরু করলেন, তারপর তিনি উপস্থিত সকলকে আল্লাহর উপাসনা করার জন্যে আহবান জানালেন এবং ইসলামের আশীর্বাদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। প্রথম শপথটি পুনঃরায় উচ্চারিত হল এবং সেই সঙ্গে এটি যুক্ত হল যে, তারা বিপদের ক্ষণে তাকে ও তার লোকজনদের রক্ষা করবেন।
তারা বললেন, ‘যদি আমরা আল্লাহর কাজে মৃত্যুবরণ করি তবে আমাদের পুরস্কার কি? ‘
তিনি জবাব দিলেন, ‘পরকালে শান্তি।’
তারা বললেন- ‘যখন আপনার সুদিন আসবে তখন কি আপনি আমাদেরকে পরিত্যাগ করে আপনার গোত্র মাঝে ফিরে আসবেন না?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘না, কখনও না। তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, আমি তোমাদের, তোমরা আমার।’
‘তাহলে এবার আপনার হাত দিন।’ -প্রত্যেকে তার হাতে হাত রেখে শপথ (বায়াত) নিলেন।
প্রকৃতপক্ষে এই ‘বায়াত’ বা ক্রয়-বিক্রয় মুহম্মদের সাথে হয়নি। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘যারা তোমার সাথে বায়াত করছে, তারা (তোমার সাথে নয় বরং) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে বায়াত করছে (প্রকৃতপক্ষে) তাদের হাতের উপর আল্লাহরই হাত আছে। অতঃপর যে ব্যক্তি এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে, তার কূ-ফল সেই ভোগ করবে এবং আল্লাহর সাথে তার যে (আদান- প্রদানের) প্রতিজ্ঞা হল- যে ব্যক্তি তা রক্ষা করবে, আল্লাহ শীঘ্রই তার মহান পুরস্কার দান করবেন।’(২৬:৯)
এই বায়াতের উল্লেখিত ‘ক্রয়-বিক্রয়’- উভয়পক্ষ কিসের আদান প্রদান করলেন? কোরআন জানায়- ‘হে মুমিনেরা, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের কথা বলে দেব?- যা তোমাদেরকে ক্লেশজনক আযাব হতে মুক্তি প্রদান করবে? (বলছি, অনুধাবণ কর)- তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং রসূলের প্রতিও এবং তাঁর সন্তোষ লাভের জন্যে নিজেদের ধনপ্রাণ লুটিয়ে দিয়ে জেহাদ করতে থাকবে, এ তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর-যদি তোমরা জ্ঞানী হও, (তবে এই শিক্ষার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারবে)।’
এই অংশটুকু হচ্ছে বিক্রেতা মুসলিম বান্দার বিক্রেয় পণ্য। তিনি নিজের ধন-প্রাণ সমস্তই আল্লাহর হাতে সমর্পন করবেন। বিনিময়ে তার প্রাপ্য কি হবে কোরআনই তার উত্তর দিচ্ছে- ‘আল্লাহ তোমাদের পাপপুঞ্জ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে এমন কাননে প্রবিষ্ট করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে বহু নির্ঝরিণী বয়ে যাচ্ছে এবং আদন কাননে পবিত্র সৌধসমূহ (তোমরা পাবে) এ অতীব সফলতা।’
হ্যাঁ, আর একটা (জিনিষ আছে) যাকে তোমরা অত্যন্ত ভালবেসে থাক- আল্লাহর নিকট হতে সাহায্য প্রাপ্তি ও ত্বরিৎ বিজয়লাভ (এও তোমরা পাবে) সমস্ত বিশ্বাসীকে এ সুসংবাদ পৌঁছে দাও।-(২৮:১০)
এই বায়াত বা ক্রয়-বিক্রয়ের স্বরূপ সম্বন্ধে কোরআনে সূরা তওবায় বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের প্রাণ ও ধন সমস্তই (এই প্রতিদানের বিনিময়ে) ক্রয় করে নিলেন যে- পরিবর্তে তারা বেহেস্ত পাবে। তারা এ (বায়াতের) জন্যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে এবং (তার অবশ্যম্ভবী ফলস্বরূপ) তারা অন্যকে মারবে ও নিজেরা নিহত হবে, এ তাঁর (আল্লাহর) ন্যায়সঙ্গত ওয়াদা। এই ওয়াদা তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআন (সমস্ত গ্রন্থেই) বিদ্যমান রয়েছে। (আর ভেবে দেখ) আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিক স্বীয় প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে পারে? অতএব (হে বায়াতকারী মুসলমানরা!) তোমরা আল্লাহর সাথে যে ক্রয় বিক্রয় করলে, তারজন্যে আনন্দিত হও এবং (জেনে রেখ যে) এই (তোমার মুসলিম জীবনের) চরম সফলতা।’-(৯:১১১)
শপথপর্ব প্রায় শেষ এসময় দূর থেকে এই ঘটনা প্রত্যক্ষণ করা এক আরবের কন্ঠ রাতের বাতাসে ভেসে এল-‘মক্কাবাসীরা! তোমরা নিদ্রা যাচ্ছ, আর এদিকে হতভাগাটা তার নাস্তিক দলটাকে নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করছে।’
সমবেত লোকদের মধ্যে সহসা আতঙ্ক দেখা গেল। কিন্তু মুহম্মদের দৃঢ়চিত্ততা অবিলম্বে তাদের সাহস ফিরিয়ে আনল। এরপর মুহম্মদের নির্দেশমত ইয়াসরিব বাসীরা তাদের মধ্যে থেকে বারজন লোক নির্বাচন করলেন- সকলের অনুমোদনক্রমে নির্বাচিত, মুহম্মদের এই প্রতিনিধিরা হলেন-খাজরাজ বংশের আবু এমামা আসাদ বিন জোরারা, সা‘দ বিন রবি, আব্দুল্লাহ বিন রওয়াহা, রাফে বিন মালেক, বারা বিন মা‘রুর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং আওস বংশের ওয়াছদ বিন হোজায়র, সা‘দ বিন খাইছামা, আব্দুল হাইছাম বিন তাইয়েহান।
আকাবার দ্বিতীয় শপথ সম্পন্ন হল।
মক্কার ঐ গুপ্তচর এই সম্মেলনের খবর সারা শহরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুহম্মদ ও তার অনুসারীদের দুঃসাহস দেখে হতবাক হয়ে কুরাইশরা সদলবলে কাফেলার গমনপথ রূদ্ধ করে শপথ গ্রহণকারী ব্যক্তিদেরকে দাবী করল। কিন্তু ইয়াসরিব (Yathrib) বাসীদের কেউই তাদের প্রশ্নের না কোন উত্তর দিলেন বা তাদেরকে অন্য কোনভাবে সহযোগিতা করতে রাজী হলেন। ফলে কোন কোন ব্যক্তি শপথ নিয়েছেন তা জানতে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা কাফেলাকে উৎপীড়ন না করেই যেতে দিতে বাধ্য হল। কিন্তু, তাদের এই ব্যাবহার মুহম্মদ ও তার অনুসারীদের উপর প্রচন্ড উৎপীড়নেরই পূর্বাভাস হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
মদিনায় প্রচুর ইহুদি বাস করত কিন্তু সেখানকার পৌত্তলিকরা মূসার শরীয়ত গ্রহণ করেনি। কিন্তু মুহম্মদের শরীয়ত আগমনের পর লোকেরা দলে দলে তা গ্রহণ করতে লাগল। এর কারণ কোরআনে বিধৃত হয়েছে। ‘মরিয়ম তনয় ঈসা যখন বললেন- ‘হে ইস্রাইল বংশীয়রা, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ কর্তৃক তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি-আমার সম্মূখে তাওরাতের যা আছে- আমি তার সত্যতা ঘোষণা করছি এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রসূল আসবেন, আমি তার আগমনের সুসংবাদ দান করছি।’
কিন্তু যখন (সেই আহমদ) স্পষ্ট যুক্তি প্রমাণসহ আগমন করল, তখন তারা বলল-এগুলি তো স্পষ্ট যাদু। দেখ সেই ব্যক্তি অপেক্ষা অত্যাচারী কে? যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যে দোষারোপ করে থাকে অথচ তাকে ইসলামের দিকে আহবান করা হচ্ছে! আর আল্লাহ অত্যাচারী জাতিকে হেদায়েত করেন না। তারা (সেই অত্যাচারীরা) সঙ্কল্প করে যে, আল্লাহর জ্যোতিকে মুখের ফুৎকারে নিবিয়ে দেবে, কিন্তু আল্লাহ নিজের জ্যোতিকে পূর্ণে পরিণত করবেনই- যদিও ঈশ্বরদ্রোহীগণের কাছে এ প্রীতিকর না হয়। তিনি সেই (আল্লাহ), যিনি আপন রসূল (আহমদ)কে হেদায়েত ও সত্যধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেহেতু তাকে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করবেন, যদিও অংশীবাদীগণের কাছে এ অপ্রীতিকর হয়।’-(৩:৪৯-৫১)
পরের বৎসর (৬২২ খ্রীঃ-নব্যুয়তের ত্রয়োদশ বৎসরে) ইয়াসরিববাসীদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা তাদের পৌত্তলিক নাগরিকসহ মোট পাঁচ শতাধিক লোক মক্কায় আগমন করলেন। এদের মধ্যে সত্তুরজন মুসলিম, মুহম্মদকে তাদের কাছে যাবার আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে এসেছিলেন। কিন্তু আগত পৌত্তলিকরা তাদের সাথীদের অভিপ্রায় সম্পর্কে কিছুই জানত না। গভীর রাত্রে যখন সবাই ঘুমে অচেতন তখন এই নবদীক্ষিতরা যেখানে প্রথম শপথ গ্রহণ করেছিলেন সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হলেন। পিতৃব্য আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে মুহম্মদ সেখানে উপস্থিত হলেন। আব্বাস তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি তবে ইসলামের অগ্রগতিতে খুবই আগ্রহ অনুভব করতেন। তিনি আলোচনার উদ্বোধন করে পরিস্কারভাবে ইয়াসরিববাসীদের বুঝিয়ে দিলেন যে, ইসলাম গ্রহণ করে ও রসূলকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা কি ধরনের বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছেন। তারা সকলে একযোগে উত্তর দিলেন যে, বিপদের গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তারা বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী, আপনি বলুন এবং আপনার ও আপনার প্রভুর জন্যে যে কোন শপথ করান।’
মুহম্মদ অভ্যস্ত পথে কোরআনের কতিপয় আয়াত আবৃত্তি করে আলোচনা শুরু করলেন, তারপর তিনি উপস্থিত সকলকে আল্লাহর উপাসনা করার জন্যে আহবান জানালেন এবং ইসলামের আশীর্বাদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। প্রথম শপথটি পুনঃরায় উচ্চারিত হল এবং সেই সঙ্গে এটি যুক্ত হল যে, তারা বিপদের ক্ষণে তাকে ও তার লোকজনদের রক্ষা করবেন।
তারা বললেন, ‘যদি আমরা আল্লাহর কাজে মৃত্যুবরণ করি তবে আমাদের পুরস্কার কি? ‘
তিনি জবাব দিলেন, ‘পরকালে শান্তি।’
তারা বললেন- ‘যখন আপনার সুদিন আসবে তখন কি আপনি আমাদেরকে পরিত্যাগ করে আপনার গোত্র মাঝে ফিরে আসবেন না?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘না, কখনও না। তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, আমি তোমাদের, তোমরা আমার।’
‘তাহলে এবার আপনার হাত দিন।’ -প্রত্যেকে তার হাতে হাত রেখে শপথ (বায়াত) নিলেন।
প্রকৃতপক্ষে এই ‘বায়াত’ বা ক্রয়-বিক্রয় মুহম্মদের সাথে হয়নি। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘যারা তোমার সাথে বায়াত করছে, তারা (তোমার সাথে নয় বরং) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে বায়াত করছে (প্রকৃতপক্ষে) তাদের হাতের উপর আল্লাহরই হাত আছে। অতঃপর যে ব্যক্তি এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে, তার কূ-ফল সেই ভোগ করবে এবং আল্লাহর সাথে তার যে (আদান- প্রদানের) প্রতিজ্ঞা হল- যে ব্যক্তি তা রক্ষা করবে, আল্লাহ শীঘ্রই তার মহান পুরস্কার দান করবেন।’(২৬:৯)
এই বায়াতের উল্লেখিত ‘ক্রয়-বিক্রয়’- উভয়পক্ষ কিসের আদান প্রদান করলেন? কোরআন জানায়- ‘হে মুমিনেরা, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের কথা বলে দেব?- যা তোমাদেরকে ক্লেশজনক আযাব হতে মুক্তি প্রদান করবে? (বলছি, অনুধাবণ কর)- তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং রসূলের প্রতিও এবং তাঁর সন্তোষ লাভের জন্যে নিজেদের ধনপ্রাণ লুটিয়ে দিয়ে জেহাদ করতে থাকবে, এ তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর-যদি তোমরা জ্ঞানী হও, (তবে এই শিক্ষার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারবে)।’
এই অংশটুকু হচ্ছে বিক্রেতা মুসলিম বান্দার বিক্রেয় পণ্য। তিনি নিজের ধন-প্রাণ সমস্তই আল্লাহর হাতে সমর্পন করবেন। বিনিময়ে তার প্রাপ্য কি হবে কোরআনই তার উত্তর দিচ্ছে- ‘আল্লাহ তোমাদের পাপপুঞ্জ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে এমন কাননে প্রবিষ্ট করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে বহু নির্ঝরিণী বয়ে যাচ্ছে এবং আদন কাননে পবিত্র সৌধসমূহ (তোমরা পাবে) এ অতীব সফলতা।’
হ্যাঁ, আর একটা (জিনিষ আছে) যাকে তোমরা অত্যন্ত ভালবেসে থাক- আল্লাহর নিকট হতে সাহায্য প্রাপ্তি ও ত্বরিৎ বিজয়লাভ (এও তোমরা পাবে) সমস্ত বিশ্বাসীকে এ সুসংবাদ পৌঁছে দাও।-(২৮:১০)
এই বায়াত বা ক্রয়-বিক্রয়ের স্বরূপ সম্বন্ধে কোরআনে সূরা তওবায় বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের প্রাণ ও ধন সমস্তই (এই প্রতিদানের বিনিময়ে) ক্রয় করে নিলেন যে- পরিবর্তে তারা বেহেস্ত পাবে। তারা এ (বায়াতের) জন্যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে এবং (তার অবশ্যম্ভবী ফলস্বরূপ) তারা অন্যকে মারবে ও নিজেরা নিহত হবে, এ তাঁর (আল্লাহর) ন্যায়সঙ্গত ওয়াদা। এই ওয়াদা তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআন (সমস্ত গ্রন্থেই) বিদ্যমান রয়েছে। (আর ভেবে দেখ) আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিক স্বীয় প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে পারে? অতএব (হে বায়াতকারী মুসলমানরা!) তোমরা আল্লাহর সাথে যে ক্রয় বিক্রয় করলে, তারজন্যে আনন্দিত হও এবং (জেনে রেখ যে) এই (তোমার মুসলিম জীবনের) চরম সফলতা।’-(৯:১১১)
শপথপর্ব প্রায় শেষ এসময় দূর থেকে এই ঘটনা প্রত্যক্ষণ করা এক আরবের কন্ঠ রাতের বাতাসে ভেসে এল-‘মক্কাবাসীরা! তোমরা নিদ্রা যাচ্ছ, আর এদিকে হতভাগাটা তার নাস্তিক দলটাকে নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করছে।’
সমবেত লোকদের মধ্যে সহসা আতঙ্ক দেখা গেল। কিন্তু মুহম্মদের দৃঢ়চিত্ততা অবিলম্বে তাদের সাহস ফিরিয়ে আনল। এরপর মুহম্মদের নির্দেশমত ইয়াসরিব বাসীরা তাদের মধ্যে থেকে বারজন লোক নির্বাচন করলেন- সকলের অনুমোদনক্রমে নির্বাচিত, মুহম্মদের এই প্রতিনিধিরা হলেন-খাজরাজ বংশের আবু এমামা আসাদ বিন জোরারা, সা‘দ বিন রবি, আব্দুল্লাহ বিন রওয়াহা, রাফে বিন মালেক, বারা বিন মা‘রুর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং আওস বংশের ওয়াছদ বিন হোজায়র, সা‘দ বিন খাইছামা, আব্দুল হাইছাম বিন তাইয়েহান।
আকাবার দ্বিতীয় শপথ সম্পন্ন হল।
মক্কার ঐ গুপ্তচর এই সম্মেলনের খবর সারা শহরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুহম্মদ ও তার অনুসারীদের দুঃসাহস দেখে হতবাক হয়ে কুরাইশরা সদলবলে কাফেলার গমনপথ রূদ্ধ করে শপথ গ্রহণকারী ব্যক্তিদেরকে দাবী করল। কিন্তু ইয়াসরিব (Yathrib) বাসীদের কেউই তাদের প্রশ্নের না কোন উত্তর দিলেন বা তাদেরকে অন্য কোনভাবে সহযোগিতা করতে রাজী হলেন। ফলে কোন কোন ব্যক্তি শপথ নিয়েছেন তা জানতে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা কাফেলাকে উৎপীড়ন না করেই যেতে দিতে বাধ্য হল। কিন্তু, তাদের এই ব্যাবহার মুহম্মদ ও তার অনুসারীদের উপর প্রচন্ড উৎপীড়নেরই পূর্বাভাস হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
সমাপ্ত।