১৯ এপ্রিল, ২০১২

Battle of Badr: বদর যুদ্ধের পটভূমি।

মদিনার ইহুদিরা কিন্তু মুহম্মদের শরীয়ত অপেক্ষা আনুষঙ্গিক অনিষ্টসহ পৌত্তলিকতা পছন্দ করেছিল। তারা মুহম্মদকে গালাগালি করত; তাকে দেখে মুখ ভেঙ্গচাত, কোরআনের শব্দাবলীর বিকৃত উচ্চারণ করত, এভাবে সেই সবকে অর্থহীন, অবান্তর বা অপবিত্র বলে প্রতিপন্ন করত। তাদের অনেকে মুসলিম মহিলাদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিদ্রুপাত্মক কবিতা রচনা করে আরবদের মর্যাদাবোধ ও স্বীকৃত বিধানকে পদদলিত করত। এসব করেও তারা ক্ষান্ত হল না। তারা রাষ্ট্রের শত্রুদের কাছে গোপনে দূত প্রেরণ করল, যে রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তারা ওয়াদাবদ্ধ ছিল।

কুরাইশরা মুহম্মদকে হত্যা করার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। তারা মুসলমানদের প্রকৃত জনশক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দল ও ইহুদিদের ধন্যবাদ দিল। তারা এ কথা জানত যে ইহুদিরা মুহম্মদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সাময়িক উপকারের বাসনা থেকে এবং যে মুহুর্তে তারা মদিনার নিকটবর্তী হবে তারা তাদের দলে যোগদান করবে।

ইসলামের তীব্রতম পরীক্ষার সময় উপস্থিত হল। মুহম্মদ নগরের সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে, বিশ্বাসীদের সুগঠিত করতে না করতে ভীষণ আঘাত তার উপরে নেমে এল। 
প্রত্যেক মুহুর্তেই বিরাট কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মুসলমানরা বিচলিত ছিলেন। হিজরতের ন্যূনাধিক এক বৎসর পরে, কুর্জ ইবনে জাবের নামক মক্কার একজন প্রধান, বহু সৈন্য নিয়ে মদিনার প্রান্তরস্থ কৃষিক্ষেতগুলির উপর আক্রমণ করে মুসলমানদের পশুগুলি ধরে নিয়ে গেল। এই সংবাদে মুহম্মদ কতিপয় মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পশ্চাৎধাবন করলেন। কিন্তু আততায়ীর দল ততক্ষণে বহুদূরে চলে গিয়েছিল, সুতরাং এ অভিযান ব্যর্থ হল। কুর্জের এই ঘটনার পর কুরাইশদের আক্রমণ আশঙ্কা শতগুনে বর্ধিত হল এবং মুসলমানরা তাদের গতিবিধির সংবাদ অবগত হবার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল। 

এই ঘটনার পাঁচ মাস পরে, মুহম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে জহসের নেতৃত্বাধীনে একটি গুপ্তচরদল গঠন করে মক্কার পথে পাঠালেন। এই দলে চারটি উট ও আটজন মুসলমান ছিলেন। মুহম্মদ দলপতি আব্দুল্লাহকে একখানা পত্র দিয়ে বলে দিলেন, ‘দু‘দিনের পথ অতিক্রমের পর এই পত্র খুলে দেখবে এবং তার মর্মানুসারে কর্তব্য পালন করবে। তবে, সেই কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে কাউকেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য কোরও না।’

আব্দুল্লাহ পত্র নিয়ে চলে গেলেন এবং দু‘দিন পরে তা খুলে দেখলেন, তাতে লেখা আছে-‘...মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখালায় যাবে এবং গোপনে কুরাইশদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে তাদের সংবাদ জানাতে থাকবে।’

পত্র পাঠের পর আব্দুল্লাহ সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,  ‘..যার ইচ্ছে হয় দেশে ফিরে যাও, আর শহীদের মৃত্যু যার অভিপ্রেত সে আমার সঙ্গে আসুক।’
তখন আব্দুল্লাহর সহচররাও তার সাথে আনন্দ উৎফুল্লতার সাথে নাখালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তারা বাহরাইন নামক স্থানে পৌঁছে বিশ্রামের জন্যে থামলেন। এসময় সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও ওৎবার উট এখানে এসে হারিয়ে গেল। এতে তারা উটের সন্ধান করতে প্রবৃত্ত হলে আব্দুল্লাহ অবশিষ্ট ৬ জনকে নিয়ে অগ্রসর হলেন। 
নাখালায় উপনীত হবার পর কুরাইশদের একটি ক্ষুদ্র বণিকদলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল। আমর ইবনে হাজরামী, হাকাম ইবনে কাইছান, ওসমান ইবনে আব্দুল্লাহ এ কুরাইশদলের সাথে ছিলেন। এসময় ওয়াকেদ ইবনে আব্দুল্লাহ শর নিক্ষেপ করলে হাজরামী নিহত হলেন। মুসলমানরা অবশিষ্ট দু‘জনকে বন্দী করে কাফেলার সমস্ত বাণিজ্য সম্ভারসহ মদিনায় নিয়ে এলেন। 

মদিনায় উপস্থিতির পর, কাফেলার এই কার্যকলাপের বিষয় অবগত হয়ে মুহম্মদ যারপর নাই অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি আব্দুল্লাহকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে যুদ্ধ বা লুন্ঠন করতে প্রেরণ করিনি, তবে তোমরা এই অন্যায় আচরণ কেন করলে?’
মুহম্মদের ভর্ৎসনায় আব্দুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের অনুতাপের অবধি রইল না। তাদের মনে হতে লাগল যে, এই পাপের জন্যে তারা নিশ্চয় ধ্বংস হয়ে যাবেন। 

এই ঘটনার পর মক্কাবাসীরা দূত পাঠিয়ে বন্দীদের মুক্তি প্রার্থনা করল। কিন্তু দলের যে দু‘জন উটের সন্ধানে ছিলেন তারা তখনও ফেরেননি, কাজেই আশঙ্কা হল কুরাইশরা সম্ভবতঃ তাদেরকে বন্দী বা হত্যা করে থাকবে। সুতরাং মুহম্মদ কুরাইশ দূতকে তার এ আশঙ্কার কথা জ্ঞাপন করে ঐ লোকদের ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। অতঃপর তারা ফিরে এলে বন্দীরা মুক্তি পেলেন। কিন্তু ওসমান মুক্তিলাভ করে ফিরে গেলেও হাকাম ইসলাম গ্রহণ করে মদিনাতেই রয়ে গেলেন।কিছুদিন পর বিরমাউনায় এই হাকাম নিহত হয়েছিলেন।
কুরাইশদের প্রধান দলপতি আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল ও তাদের সহচরবর্গ উত্তমরূপে বুঝতে পেরেছিলেন যে, মদিনায় গমনের পর মুসলমানরা অধিক শক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। আর কিছুকাল অপেক্ষা করলে তারা অজেয় হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে মুসলমানদের সাথে সত্ত্বর যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্যে তারা উন্মূখ হয়েই ছিলেন। 

এসময় কাফেলাকে আক্রমণ ও বন্দীদের মদিনায় নীত হবার সংবাদে তারা মদিনা আক্রমণের জন্যে দৃঢ়সংকল্প হলেন। এই আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান এক সহস্র উটের বাণিজ্য সম্ভারের এক কাফেলা নিয়ে শ্যাম দেশে গমণ করলেন। অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদাদি- রণসম্ভার খরিদ করার ও বেতনভোগী সৈন্যদল সংগ্রহের জন্যে মক্কাবাসীরা ৫০ হাজার দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা (দিনার হল স্বর্ণমুদ্রা যার ওজন সাড়ে চার মাশা) আবু সুফিয়ানের সাথে প্রেরণ করেছিল। এমনকি কুরাইশ নরনারীদের মধ্যে এক রতি- মাশা সোনা-চাঁদিও যার কাছে ছিল, সেও তা এই কাফেলার সাথে প্রেরণ করেছিল নিজের অংশ হিসেবে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হল-‘অবিশ্বাসীরা মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথ হতে প্রতিনিবৃত করার জন্যে নিজেদের ধন-সম্পদসমূহ ব্যয় করতে যাচ্ছে, দেখ শীঘ্রই তারা তা (ইসলাম ধর্মে বিঘ্নদানের জন্যে) ব্যয় করে ফেলবে- তখন এ তাদের পক্ষে অনুতাপেরই কারণ হবে, তদন্তর তারা পরাজিত হয়ে যাবে।’(৮:৩৬)
এই আয়াত নাযিল হবার পর আবু সুফিয়ানের কাফেলা আক্রমণের জন্যে মুহম্মদ সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। মক্কায় মুসলমানদের উপর কুরাইশদের নির্যাতন যখন চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল, যখন এমন কোন দিন যেত না, যেদিন কোন না কোন মুসলমান তাদের নিষ্ঠুর হাতে প্রহৃত ও আহত হয়ে না আসতেন, তখন মুসলমানরা তাদের উপর জুলুম ও অত্যাচার দেখে মুহম্মদের কাছে তাদের মেকাবেলায় যুদ্ধ করার অনুমতি চাইতেন। কিন্তু যদিও মক্কায় অবস্থানের শেষ দিনগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবুও মুহম্মদ তাদেরকে নিবৃত্ত করতেন এই বলে- ‘সবর কর। কেননা আমাকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়নি।’

আর এখন- যখন যুদ্ধের অনুমতি পাওয়া গেল, তখন রমজান মাস, যুদ্ধের কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেই দেখে কেউ কেউ সাহস প্রদর্শণ করলেও অধিকাংশ দোদুল্যমানতা প্রকাশ করলেন। অথচ জেহাদ ও যুদ্ধের এই আদেশ নতুন নয়। পূর্ববর্তী উম্মত ও পয়গম্বরদেরকেও অবিশ্বাসীদের মোকাবেলায় যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এরূপ করা না হলে কোন মাযহাব ও ধর্মের অস্তিত্ব থাকত না এবং উপাসনালয়সমূহ বিধস্ত হয়ে যেত।

এসময় মুসলমানদের উৎসাহিত করতে জেহাদের অনুমতি বাচক এই আয়াত নাযিল হল-‘যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের অনুমতি প্রদান করা হল- কারণ তারা অত্যাচারিত। সেই সমস্ত লোক যারা স্বদেশ হতে অন্যায়রূপে বহিস্কৃত হয়েছে- তবে তারা এ মাত্র বলেছিল যে, আল্লাহই আমাদের প্রভু। আল্লাহ যদি মানব সমাজের কতিপয় লোকের দ্বারা অন্য লোকদেরকে অপসৃত না করতেন, তা হলে মন্দির, গির্জা, উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ- যাতে বহুলরূপে আল্লাহর নাম করা হয়ে থাকে-বিধ্বস্ত করে ফেলা হত।’(২২:৩৯-৪০)

আর তারা যদি চুক্তির পর তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ও তোমাদের ধর্ম সম্পর্কে বিদ্রুপ করে, তবে অবিশ্বাসী প্রধানদের সাথে যুদ্ধ করবে। এরা এমন লোক যাদের প্রতিশ্রশ্রুতি প্রতিশ্রুতিই নয়। তোমরা কি সে সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না, যারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং রসূলকে তাড়িয়ে দেবার সংকল্প করেছে? ওরাই প্রথম তোমাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে। তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? বিশ্বাসী হলে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর- এ-ই আল্লাহর কাছে শোভনীয়। তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর। তোমাদের হাতে আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দেবেন, ওদেরকে অপদস্ত করবেন, ওদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে জয়ী করবেন ও বিশ্বাসীদের চিত্ত প্রশান্ত করবেন।(৯:১২-১৪)

উপরের আয়াতসমূহ নাযিল হবার পরেও মুহম্মদ জেহাদে অংশগ্রহণ করাকে অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক করলেন না। তিনি শুধু ঘোষণা করলেন, ‘যাদের কাছে এই মূহুর্তে সওয়ারীর ব্যবস্থা আছে শুধুমাত্র তারাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।’
ফলে যুদ্ধে যাবার জন্যে অল্পসংখ্যকই তৈরী হয়েছিলেন। অধিকাংশই বিরত রইলেন এ কারণে যে, মুহম্মদ তো যুদ্ধে যাত্রা অপরিহার্য করেননি। আর তাদের মনে হয়েছিল যে, বাণিজ্যিক কাফেলার জন্যে খুব বেশী যোদ্ধার প্রয়োজন পড়বে না। 

এই যুদ্ধ যাত্রায় কোন স্ত্রীলোক অংশ নেয়নি। যাত্রার সময় নওফেলের কন্যা উম্মে ওয়ার্কা মুহম্মদের কাছে উপস্থিত হয়ে শুশ্রুষাকারিনীরূপে সেনাদলের সাথে যাবার অনুমতি চেয়েছিল। তিনি তাকে ক্ষান্ত করে বললেন, ‘নিজ বাটিতে অবস্থান কর।’

মুহম্মদ এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন। দলে উট ছিল ৭০টি অর্থাৎ প্রতি তিন জনের জন্যে একটি। ফলে তার বাহন উটেরও অপর দু‘জন অংশীদার ছিলেন। তারা হলেন আলী ও আবু লুবাবাহ। যখন মুহম্মদের হেঁটে চলার পালা এল, তখন তারা বললেন, ‘হে রসুলুল্লাহ! আপনি উপরেই থাকুন, আপনার পরিবর্তে আমরা হেঁটে চলব।’
তিনি বললেন, ‘না, আমরা পালাক্রমেই আরোহণ করব।’

বি‘রে সুকইয়া নামক স্থানে পৌঁছে মুহম্মদ কায়েস ইবনে সা‘দকে সৈন্য গণনার নির্দেশ দিলেন। কায়েস জানালেন, ‘মোট তিন‘শ তেরজন সৈন্য রয়েছে।’
তিনি খুশী হয়ে বললেন, ‘তালুতের সৈন্য সংখ্যাও ছিল এই। সুতরাং লক্ষণ শুভ।’
এদিকে সিরিয়ার আইনে যোরকা নামক স্থানে একব্যক্তি আবু সুফিয়ানকে সংবাদ দিল- ‘মুসলমানরা আপনার এই কাফেলাকে আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করছে।’

আবু সুফিয়ান এই সংবাদে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তিনি হিজাজের নিকটবর্তী হলে জনৈক দমদম ইবনে ওমেরকে কুড়ি মেশকাল সোনা দিয়ে এ ব্যাপারে রাজী করালেন যে, সে দ্রুত মক্কায় পৌঁছে কুরাইশদের সংবাদ দেবে যে, তার কাফেলা মুসলমানদের আক্রমণ আশঙ্কার সম্মুখীণ হয়েছে।

দমদম দ্রুতগামী একটি উটে রওনা হয়ে গেল। অতঃপর মক্কার নিকটবর্তী হয়ে ঘোর বিপদের চিহ্নস্বরূপ সে তার উটের নাক কান কেটে এবং নিজের পরিধেয় ছিঁড়ে হাওদাটি উটের পিঠে উল্টোভাবে বসিয়ে নগরীতে প্রবেশ করল। গোটা মক্কায় হৈঁ চৈঁ পড়ে গেল। এমনিতেই মুহম্মদ হিযরত করে মদিনায় চলে এলেও মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে তাদের মনে শত্রুতার এক দাবাদাহ জ্বলেই যাচ্ছিল। এখন তারা মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার জন্যে উৎগ্রীব হয়ে উঠল। 

আবু জেহেল, ওৎবা, শায়বা প্রমুখ মক্কার বারজন সর্দার যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়ভার নিজেদের কাঁধে নিলেন। সাঁজ সাঁজ রবে সকলে প্রতিরোধের জন্যে তৈরী হয়ে গেল। যারা যুদ্ধে যেতে অপারগ হল তারা অন্য একজনকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করে দিল। আর নেতারা বিশেষভাবে তাদেরকে যুদ্ধে যাত্রা বাধ্যতামূলক করলেন, যারা মুসলমানদের সমর্থক বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন মুহম্মদের পিতৃব্য আব্বাস, আবু তালিবের পুত্র আকীল, আবু বকরের পুত্র আব্দুর রহমান, মুহম্মদের জামাতা আ’স ইত্যাদি অনেকে।

মদিনার ইহুদিরা বিশেষ করে বনি নাজির ও বনি কুরাইজা গোত্র যারা মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল, কুরাইশদের গোপনে যুদ্ধের সাঁজ-সরঞ্জাম, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল। তাদের সাহায্য পেয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কুরাইশরা সকল প্রস্তুতি সেরে ফেলল। অতঃপর আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য, যাদের মধ্যে দু‘শ ঘোড়সওয়ার, ও সাত‘শ উষ্ট্রারোহী বর্মধারী এবং সারা গায়িকার বাঁদ্যদল মদিনার দিকে যাত্রা করল। যাত্রার প্রাক্কালে বাহিনী প্রধান আবু জেহেল কা‘বার পর্দা ধরে এই প্রার্থণা করলেন- ‘হে আল্লাহ! উভয় বাহিনীর মধ্যে যেটি উত্তম ও উচ্চতর এবং অধিক হেদায়েতের উপর রয়েছে তাকে বিজয় দান কোরও।’

এই নির্বোধেরা ভেবেছিলেন তারাই উত্তম এবং অধিক হেদায়েতের উপর রয়েছেন। তাই তাদের প্রার্থণার জবাবে এই আয়াত নাযিল হয়েছিল-তোমরা যদি মিমাংসা কামনা কর, তাহলে তোমাদের কাছে মিমাংসা পৌঁছে গেছে। আর যদি তোমরা প্রত্যাবর্তণ কর, তবে তা তোমাদের জন্যে উত্তম এবং তোমরা যদি তাই কর, তবে আমিও তেমনি করব। বস্তুতঃ তোমাদের কোনই কাজে আসবে না তোমাদের দল-বল, তা যত বেশীই হোক। জেনে রেখ আল্লাহ রয়েছেন ঈমানদারদের সাথে।(৮:১৯)

কুরাইশ বাহিনী যখন মুসলমানদের মোকাবেলার জন্যে যখন গর্বিতভাবে রওনা হচ্ছিল, তখন তাদের মনে হঠাৎ এক আশঙ্কা চেপে বসল। তাদের প্রতিবেশী বনি বকর ছিল তাদের শত্রু। তারা যুদ্ধ করতে চলে গেলে, সেই সুযোগে এই শত্রুরা না আবার তাদের বাড়ী-ঘর এবং নারী-শিশুদের উপর হামলা করে বসে। তারা রওনা হল বটে, কিন্তু এ আশঙ্কা তাদের পায়ে বেড়ী হয়ে রইল।

কুরাইশ বাহিনীর সাথে পথে বনি বকর গোত্রের একজন অন্যতম প্রধান সর্দার সোরাকা ইবনে মালেকের সঙ্গে দেখা হল। সোরাকার হাতে ছিল গোত্রের পতাকা এবং সঙ্গে ছিল সৈনিকদের একটি খন্ড দল। সে এগিয়ে এসে কুরাইশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দিয়ে বসল। সে বলল, ‘তোমাদের শক্তি-সামর্থ ও সংখ্যাধিখ্য তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং আজকের দিনে এমন কেউ নেই যারা তোমাদের উপর জয়লাভ করতে পারবে। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা নিঃশ্চিন্তে এগিয়ে চল।’
বীরদর্পে কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে সোরাকার বাহিনীও এগিয়ে চলল মদিনার পথে। 

এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- যারা বেরিয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে। আর আল্লাহর পথে তারা বাঁধা দান করত। বস্তুতঃ আল্লাহর আয়ত্ত্বে রয়েছে সেসমস্ত বিষয় যা তারা করে।(৮:৪৭)
আর যখন সুদৃশ করে দিল শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপকে এবং বলল যে, আজকের দিনে কোন মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না, আর আমি হলাম তোমাদের সমর্থক।(৮:৪৮)

এদিকে মুহম্মদ বদরের কাছে পৌঁছে জানতে পারলেন একহাজার সুসজ্জিত সেনাদল আবু জেহেলের নেতৃত্বে মুসলমানদেরকে মোকাবেলার জন্যে মদিনার দিকে এগিয়ে এসেছে। মুসলমানরা মদিনা হতে বহির্গমনের পর এখন উভয় অর্থাৎ আবু সুফিয়ানের ও কুরাইশদের অভিযানের খবর যুগপৎভাবে অবগত হলেন। মুসলমানরা জানতেন এই দু‘দলের মধ্যে একটির উপর তারা জয়লাভ করবেন। তাই এ সময়ে একদল মুসলমান আবু জেহেলের বাহিনী মোকাবেলার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, কিন্তু আর একদল এই দু‘দলের মধ্যে আবু সুফিয়ানের কাফেলাটি নিস্কন্টক ছিল বলে, সেটিকে আক্রমণ করার জন্যে উৎসুক হলেন। কেননা তারা বিশেষরূপে ভীত ও কুন্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করছিলেন যে, আবু জেহেলের বাহিনী মোকাবেলা অত্যন্ত দূরূহ বরং অসাধ্য ব্যাপার। আর এইদল মদিনা থেকে নির্গমনের সময়ও যুদ্ধ করার বিষয়ে মুহম্মদের সাথে যথেষ্ট বাক-বিতন্ডা করেছিলেন। 

আবু সুফিয়ানের কাফেলা ও আবু জেহেলের এই অভিযান এবং মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোরআন জানায়- হে মুহম্মদ! তোমার প্রভু তোমাকে ন্যায্যরূপে স্বগৃহ হতে বহির্গত করলেন, অথচ এ বহির্গমণের সময় একদল মুসলমান (যেতে) বিশেষ কুন্ঠিত হচ্ছিল। সত্য স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হবার পরেও তারা তোমার সাথে বিতন্ডা করছিল। যেন তাদেরকে মৃত্যুর পানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আর সেই মৃত্যুকে যেন তারা প্রত্যক্ষ করছিল এবং যখন দু‘দলের মধ্যে একটি সম্বন্ধে আল্লাহ তোমাদেরকে এ ওয়াদা দিচ্ছিলেন যে, তোমরা সেইটির উপর জয়যুক্ত হতে পারবে: কিন্তু তোমাদের বাসনা ছিল যে (দল দু‘টির মধ্যে) যেটি নিস্কন্টক, সেইটির উপর তোমরা অধিকার লাভ কর- অথচ আল্লাহ স্বীয় বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার এবং ধর্মদ্রোহীদের মূলোচ্ছেদ করার সঙ্কল্প করেছিলেন।’(৮:৫-৭)

বদর অভিযান, রুট ম্যাপ।
মুসলিম মুজাহিদরা মদিনা থেকে ষাট মাইল পূর্ব-দক্ষিণে বদর সন্নিকটে এসে জানতে পারলেন আবু সুফিয়ানের কাফেলা পূর্বেই চলে গিয়েছে এবং কুরাইশ বাহিনী বদরের প্রান্তরে এসে পৌঁছেছে। তখন মুহম্মদ সকলের সাথে পরামর্শে বসলেন। 

এ সময় আনসার দলপতি সা‘দ ইবনে ওবায়দা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হযরত! কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলা করা সম্পর্কে আপনি আমাদের (আনসারদের) মতামত জানতে চাচ্ছেন? যার হস্তে আমার প্রাণ-তাঁর শপথ, আপনি আদেশ করলে আমরা সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করতে পারি, জগতের দুর্গমতম স্থানকে পদদলিত করতে পারি।’

আর মেকদাদ বললেন, "হে রসূলুল্লাহ! We now stand by you, whatever you ask us to do. We will not behave like the followers of Moses as who said, ‘Go you and your God and fight the enemy, we remain here behind.' If we must fight, we will and we will fight to the right of you, to the left of you, in front of you and behind you. True, the enemy wants to get at you. But we assure you that he will not do so, without stepping over our dead bodies. Prophets of God, you invite us to fight. We are prepared to do more. Not far from here is the sea. If you command us to jump into it, we will hesitate not."

কুরাইশ সৈন্যদল যুদ্ধের ময়দানে মোতায়েন হয়েছিল। ফলে যিনি জীবনে কোনদিন অস্ত্র ধরেননি, যার কাছে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তীব্র বেদনা বয়ে আনত, যিনি আরবদের পৌরুষ বিষয়ক বিধিসমূহের বিরুদ্ধে তার সন্তান বা শিষ্যদের ক্ষতিতে নিদারুণ অশ্রুবির্জন করতেন, যার চরিত্র এতই কোমল ও দয়ালু ছিল যে তার শত্রুরা তাকে স্ত্রীজনোচিত বলে ভাবত। এই মানুষটি এখন প্রয়োজনের তাগিদে যুদ্ধের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। 

অতঃপর মুহম্মদ যাত্রার আহবান করলেন এবং মুসলমানরা যাত্রা শুরু করলেন এবং তারা যে বদরের উপত্যকা দিয়ে আবু জেহেল অগ্রসর হচ্ছিল সেখানে পৌঁছে গেলেন রাতের বেলায়। সকলে একস্থানে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। কেবলমাত্র মুহম্মদ একা জেগে তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করতে লাগলেন। 

যোদ্ধাদের এই ঘুম ছিল আল্লাহর রহমতস্বরূপ। এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত- যখন তিনি আরোপ করেন তোমাদের উপর তন্দ্রাচ্ছন্নতা নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রশান্তির জন্যে।(৮:১১) 
বদর যুদ্ধ।
দ্বিতীয় হিজরী, ১৭ই রমজান, শুক্রবারের ভোরবেলা। বদর প্রান্তরে ফজরের আজান ধ্বনিত হল। একটু আগে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। মুসলমানরা অযু শেষে নামাজ আদায় করলেন। রাতে ঘুম হওয়াতে তারা এখন ক্লান্তি মুক্ত। আরবদের যুদ্ধ-বিগ্রহ নিশিকালে বা ভোররাত্রে পরিচালিত হত এবং তা আকস্মিক ও হত্যামূলক লুন্ঠন পর্যায়ে সীমিত ছিল, ছিল বিচ্ছিন্ন লড়াই বা সাধারন দাঙ্গার পর্যায়ভুক্ত। মুহম্মদ তার দেশবাসীর অভ্যস্ত কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এ কারণে ফজরের নামাজ শেষেই মুজাহিদরা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। 

কুরাইশরা প্রথমে বদরের প্রান্তরে পৌঁছে সুবিধাজনক উঁচুস্থানে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাদের নিকটবর্তী ছিল পানি। আর মুসলমানদের অবস্থান করতে হয়েছিল নিম্নাঞ্চলে যেখানে কোন পানি ছিল না, ছিল চলাচলে অসুবিধাজনক বালুকাময় প্রান্তর। 

এই যুদ্ধের নকশা এই আয়াত বিবৃত করেছে এভাবে-আর যখন তোমরা ছিলে সমরাঙ্গনের এ প্রান্তে আর তারা ছিল সে প্রান্তে অথচ কাফেলা তোমাদের থেকে নীচে নেমে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় যদি তোমরা পারস্পরিক অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে, তবে তোমরা একসঙ্গে সে ওয়াদা পালন করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ এমন এক কাজ করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।-(৮:৪২)

বদর যুদ্ধ।
যুদ্ধের এদিনটি ছিল শীতের ঝড়ো দিন। এক প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব পূর্বেই সারা উপত্যকা দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির দরুণ পানির সমস্যার সমাধান হল এবং বালুপূর্ণ ক্ষেত্র সমতল হয়ে পড়ায় কৌশলগত দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থান এখন মুসলমানদের অনুকূলে চলে এল। অন্যদিকে বৃষ্টির ফলে কুরাইশদের উঁচু ঢালু অবস্থান কর্দমাক্ত হয়ে পড়ায় চলাচলে তারা সমস্যায় পড়ে গেল। এসবের মধ্যেই প্রভাতে সহস্রাধিক কুরাইশ সৈন্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে সাঁরিবদ্ধভাবে আগুয়ান হল।

এদিকে তুলনামূলক একটি নিরাপদ অবস্থানে মুহম্মদের জন্যে একটি ছোট সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি ও আবু বকর তার নীচে উপবিষ্ঠ হলেন। আর তাদের হেফাজতকল্পে খোলা তরবারি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মু‘আজ। অতঃপর যখন মুহম্মদ ধর্মদ্রোহীদের উষ্ট্রারোহী ও অশ্ববাহিনীকে ঔদ্ধত্য সহকারে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে দেখলেন, তখন তিনি মূসার মত উর্ধ্বে হস্ত উত্তোলিত করে প্রার্থনা করলেন- ‘হে প্রভু, তোমার সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যেও না। প্রভু, যদি এই ক্ষুদ্র দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তবে তোমার নির্ভেজাল প্রার্থনা করার মত কেউ থাকবে না।’

এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- এবং তোমাদের উপর আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেন, যাতে তোমাদেরকে পবিত্র করে দেন এবং যাতে তোমাদের থেকে অপসারিত করে দেন শয়তানের অপবিত্রতা। আর যাতে সুরক্ষিত করে দিতে পারেন তোমাদের অন্তরসমূহকে এবং তাতে যেন সুদৃঢ় করে দিতে পারেন তোমাদের পা‘গুলো।-(৮:১১)

তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করেছিলে স্বীয় পরওয়ারদেগারের কাছে, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদের মঞ্জুরি দান করলেন যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব ধারাবাহিক ভাবে আগত হাজার ফেরেস্তার মাধ্যমে। আর আল্লাহ তো শুধু সুসংবাদ দান করলেন যাতে তোমাদের মন আশ্বস্ত হতে পারে।-(৮:৯-১০)

যখন নির্দেশ দান করেন ফেরেস্তাদেরকে তোমাদের পরওয়ারদেগার যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। আমি অবিশ্বাসীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায়। যেহেতু তারা অবাধ্য হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের, সেজন্যে এই নির্দেশ। বস্তুতঃ যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হয়, নিঃসন্দেহে আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। আপাততঃ বর্তমান এ শাস্তি তোমরা আস্বাদন করে নাও এবং জেনে রেখ যে, অবিশ্বাসীদের জন্যে রয়েছে দোযখের আযাব।-(৮:১২-১৪)

এরপর সমরনীতি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হল- হে ঈমানদারেরা, তোমরা যখন অবিশ্বাসীদের সাথে মুখোমুখি হবে, তখন পশ্চাৎপসারণ কোরও না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাৎপসারণ করবে, অবশ্য লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিম্বা যে নিজ সৈন্যদের কাছে আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত- অন্যরা আল্লাহর গজব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম।-(৮:১৫-১৬)

মুহম্মদ প্রার্থনায় নিমগ্ন এসময় কুরাইশদের পক্ষ হতে তীর বর্ষণ শুরু হল। একটি তীর মেহজা নামের একজন মুসলিম সৈন্যের বক্ষ ভেদ করে গেল। এই মেহজাই বদর যুদ্ধের প্রথম শহীদ। সকল মুসলমানই তার মৃত্যু দৃশ্য দেখলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোন চাঞ্চল্য বা ক্রোধ প্রকাশিত হল না। কারণ মুহম্মদের হুকুম ছিল- ‘আমি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ বিপক্ষকে আক্রমণ কোরও না।’--কাজেই তারা নিরব, নিস্পন্দভাবে দঁড়িয়ে রইলেন। এসময় আরেকটি তীর পানি পানরত অবস্থায় হারেছা নামীয় একজনের কন্ঠ ভেদ করে গেল। সৈন্যরা নীরবে তাও দর্শণ করলেন। এরপর মুহম্মদ সকলকে প্রস্তুত হতে আদেশ করলেন। সকলে সমঃস্বরে উত্তর করলেন, ‘প্রভু হে, আমরা সকলেই প্রস্তুত।’

মুহম্মদ যোদ্ধাদেরকে বললেন, ‘তোমাদের জন্যে কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের পালনকর্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ তিন হাজার ফেরেস্তা পাঠাবেন। অবশ্য তোমরা যদি সবর কর এবং বিরত থাক আর তারা যদি তখনই তোমাদের উপর চড়াও হয়, তাহলে তোমাদের পালনকর্তা চিহ্নিত ঘোড়ার উপর পাঁচ হাজার ফেরেস্তা তোমাদের সাহায্যে পাঠাতে পারেন।’
তিনি একমুষ্ঠি মাটি তুলে নিয়ে শত্রুদের ডানে, বামে, সম্মুখে ও পশ্চাতে নিক্ষেপ করলেন। 

মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা দেখে কুরাইশ বাহিনীর অনেকের মনে পরিণতি ভেবে আফসোস হতে লাগল। তারা ভাবছিল-এহেন শক্তিশালী বাহিনীর বিপক্ষে মুষ্টিমেয় এই মুসলিম বাহিনী! হায়, বেচারাদেরকে তাদের দ্বীনই প্রতারণায় ফেলে মৃত্যুর মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।’

এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত-যখন মুনাফেকরা বলতে লাগল এবং যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্থ, এরা নিজেদের ধর্মের উপর গর্বিত।-(৮:৪৯)
কুরাইশদের তিনজন (ওৎবা, শায়বা ও অলিদ) উন্মুক্ত প্রান্তরে এগিয়ে এলেন এবং প্রথা অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে থেকে তিনজনকে একক যুদ্ধে আহবান করলেন। তারা চিৎকার করে বললেন, ‘কে আছ আস, আমাদের তরবারীর খেলা দেখে যাও!’

এই আহবান শুনে কয়েকজন আনসার মুহম্মদের অনুমতি ব্যতিরেকেই তরবারী হাতে সেই দিকে ধাবিত হলেন। মুহম্মদের নিষেধ করার পূর্বেই ওৎবা চিৎকার করে বললেন, ‘মুহম্মদ! মদিনার এই চাষাগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করা আমাদের পক্ষে অসম্মানজনক। আমাদের যোগ্য যোদ্ধা পাঠাও।’

ওৎবাকে অগ্রসর হতে দেখে তার একপুত্র হোজায়ফা মুসলমানদের পক্ষ থেকে মোকাবেলার জন্যে ব্যাকুলতা প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু মুহম্মদ তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে থেকে আমীর হামজা, আলী ও ওবায়দাকে মোকাবেলার জন্যে অগ্রসর হতে বললেন। তিনি এটা করলেন একারণে যাতে কেউ এ প্রশ্ন না তুলতে পারে যে, মুহম্মদ মোহাজিরদেরকে বাদ দিয়ে আনসারদেরকে প্রথমে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। 

হামজার সাথে শায়বার, আলীর সাথে অলিদের ও ওবায়দার সাথে ওৎবার যুদ্ধ হল এবং মূহুর্তের মধ্যে শায়বা ও অলিদের মস্তক ভূলুন্ঠিত হল। আর বৃদ্ধ ওবায়দা ওৎবাকে নিহত করলেন বটে, কিন্তু নিজেও মারাত্মক আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। ওৎবার স্ব-বংশে নিধন প্রাপ্তির পর যুদ্ধ সাধারণ রূপ পরিগ্রহ করল। 

কুরাইশদের সহায়তার জন্যে যে শয়তানী বাহিনী যুদ্ধে এসেছিল, তাদের কারণে একসময় যুদ্ধের ভাগ্যবিপর্যয় দেখা দিচ্ছিল। এসময় আল্লাহ জিব্রাইলের নেতৃত্বে এক ফেরেস্তার বাহিনী প্রেরণ করলেন। সোরাকা ইবনে মালেকরূপী ইবলিস এবং তার সাথীরা ফেরেস্তা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে তখনি তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হল। কাছেই ছিল কুরাইশ যুবক হারেছ ইবনে হাশেম। সে সোরাকাকে পালিয়ে যেতে দেখে বলল, ‘যুদ্ধের ময়দানে এসে এ-কি করছেন! আপনি তো বলেছিলেন, আমি তোমাদের সমর্থনে রয়েছি।’
সোরাকা বলল, ‘আমি তোমাদের সাথে কৃত চুক্তি থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছি। কারণ, আমি এমন জিনিষ দেখছি যা তোমাদের চোখ দেখতে পায় না।’

সোরাকা তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের গতি ফিরে এল। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত-অতঃপর যখন সামনা সামনি হল উভয় বাহিনী, তখন সে অতি দ্রুত পায়ে পিছন দিকে পালিয়ে গেল এবং বলল, ‘আমি তোমাদের সাথে নেই- আমি দেখছি যা তোমরা দেখছ না।-(৮:৪৮)
মুসলমানদের তরবারির আঘাতে যেসব কুরাইশরা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়ছিল, ফেরেস্তারা তাদের জান কবজ করতে লাগলেন। এসময় মৃত্যুপথযাত্রীদের মনে হতে লাগল কেউ যেন আগুনের চাবুক দিয়ে তাদের মুখে ও পিঠে আঘাত করে চলেছে। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তারা মৃত্যুর কলে ঢলে পড়তে লাগল। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত- আর যদি তুমি দেখ, যখন ফেরেস্তারা অবিশ্বাসীদের জান কবজ করে; প্রহার করে তাদের মুখে ও পশ্চাৎদেশে আর বলে, জলন্ত আযাবের স্বাদ গ্রহণ কর।-(৮:৫০) 

মক্কাবাসীরা অনেক ক্ষতি সহ্যকরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল। তাদের অনেক নেতা নিহত হলেন। আবু জেহেল তার দুর্নিবার অহংকারের শিকার হয়েছিলেন। মা‘আজ ও তার ভাই আবু জেহেলকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়েছিলেন। আবু জেহেল পুত্র ইকরামা তাদেরকে বাঁধা দিয়েছিলেন। তিনি মা‘আজের বাম বাহুতে আঘাত করে তা ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু অদম্য মা‘আজ তা উপেক্ষা করে আবু জেহেলকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। 

বদর যুদ্ধে (Battle of Badr) অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের পক্ষে ৬ জন মোহাজির ও ৮ জন আনসার নিহত হয়। আর কুরাইশদের পক্ষে ওৎবা, শায়বা, আবু জেহেল ও তার ভ্রাতা আছী, আবু সুফিয়ানের পুত্র হানজালাসহ প্রায় শতাধিক নিহত হয়েছিলেন।
বদর যুদ্ধে নিহতদের সমাধি।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুরাইশদের পলায়নের সংবাদ শুনে মুহম্মদ মুসলমানদের অস্ত্র ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন। তিনি যুদ্ধের পূর্বেও মুসলমানদের এই বলে সতর্ক করেছিলেন-‘কুরাইশদের মধ্যে কতকগুলি লোক অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছে। সাবধান, তাদেরকে কেউ আঘাত কোরও না।’

মুসলমানরা মুহম্মদের আদেশ মেনে নিয়ে অস্ত্র ব্যাবহার বন্ধ করে পলায়নপর শত্রুদেরকে বন্দী করতে আরম্ভ করলেন। বহু সংখ্যক কুরাইশ (৭০জন) মুসলমানদের হাতে বন্দী হল। অতঃপর এসব বন্দী ও আবু জেহেলের ছিন্ন শির মুহম্মদের কাছে আনীত হল।

যুদ্ধ শেষে মুসলমানদের অনেকে নিজেদের বীরত্বসূচক কিছু কথাবার্তা বলে ফেললেন। এ সময় এই আয়াত নাযিল হল-সুতরাং তোমরা তাদের হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর তুমি মাটির মুষ্ঠি নিক্ষেপ করনি, যখন তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং যেন ঈমানদারদের প্রতি এহসান করতে পারেন যথার্থভাবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী, পরিজ্ঞাত।-(৮:১৭) 

সমাপ্ত।

NB: This is all about the battle of Badr. Now in the following link, you will find how the liars depicted this battle to impose falsehood on Islam just hiding that the caravan was not a simple caravan, it was full with arms and ammunition's to use them against Muslim (8:36)- http://www.thereligionofpeace.com/muhammad/myths-mu-badr.htm



ছবি: Wikipedia, go-makkah, bjsallahwalay, commons.wikimedia.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...