অারব উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত হেজাজ অঞ্চলের মক্কা নগরীতে নবী মুহম্মদ জন্মগ্রহণ করেন। তার সঠিক জন্ম তারিখটি জানা যায় না। এর কারণ এই যে, ঐ সময় আরবদের মাঝে কোন সুনির্দিষ্ট বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল না। ফলে ঐতিহসিক ও জ্যোতির্বিদদের যারা এ বিষয়ের উপর কাজ করেছেন, তারা মতামত হিসেবে নবীজীর জন্মের অনেকগুলো সম্ভাব্য তারিখ দিয়েছেন। আর এই মতের ভিন্নতার কারণেই, বিশ্বকোষ ব্রিটেনিকা একটা সন্দেহজনক তারিখ দিয়ে, জন্মসনের স্থানে একটি প্রশ্নবোধক টিহ্ন এঁকে রেখে দিয়েছে। এতে এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বজগৎ নিশ্চিত নয়, কোন তারিখে নবী মুহম্মদ, যিনি সর্বশেষ নবী হিসেবে পরিচিত, ধরায় আগমন করেছিলেন।
সাধারণভাবে ধরা হয় নবীজীর জন্মদিন বা মওলিদ হস্তী বৎসরের (অর্থাৎ যে বৎসর আবিসিনীয় সম্রাট আবরাহা কা’বা আক্রমণ করেছিলেন তার হস্তী বাহিনী নিয়ে।) ১২ই রবিউল আওয়াল, যদিও বৎসর এবং তারিখ দু’টোর ক্ষেত্রেই মতের ভিন্নতা রয়েছে। তবে অধিকাংশ মুসলিম এটা জানে না যে, সঠিক তারিখটির ব্যাপারে বিতর্ক সবসময়ই ছিল এবং ১২ই রবিউল আওয়াল কোন সর্বজন স্বীকৃত তারিখ নয়। আর সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া ফলাফল হস্তী বৎসরের ব্যাপারে যে তথ্য দিয়েছে তা সাধারণভাবে আমাদের জানা তথ্যকে বিতর্কিত করেছে এবং ঐ ভিন্ন মতটিকেই প্রকারন্তে আরও ওজনদার করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, হস্তী বৎসরটি নবীজীর জন্মের প্রায় ১৭-১৮ বৎসর পূর্বের। আর হেকলও এ বিষয়ে এমনিতর ভিন্ন মতামত উল্লেখ করেছেন সিরা পা্ঠ্যতে যে, ঐ ঘটনা ছিল নবীজীর জন্মের ১৫ বৎসর পূর্বের বা এমনকি তার জন্মের ৩০-৭০ বৎসর পূর্বেরও হতে পারে।
‘সহীহ সিত্তা’ বলে খ্যাত হাদিসের ৬টি গ্রন্থের কোনটিতে এমন কোন হাদিস নেই যেটি সুনির্দিষ্ট করবে নবীজীর জন্ম তারিখটি। বরং তাতে এ সংক্রান্ত একমাত্র যে হাদিসটি রয়েছে তা কেবল নির্দিষ্ট করেছে দিনটি, তারিখটি নয়-
আবু কাতাদা বর্ণনা করেন যে, এক বেদুইন নবীজীর কাছে সোমবার দিন বোজা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তাতে নবীজী উত্তর করেছিলেন- “ঐটি সেইদিন যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম এবং সেইদিন যেদিন কোরআনের অবতরণ শুরু হয়েছিল।” -সহীহ মুসলিম।
আর দিনের যে সময়টাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন তা আমরা জানতে পারি-সিদি আল-গাউস আবদ আল-আজিজ আল-ধাব্বাগ, আল-ইবরিজ এর বর্ণনা থেকে। তিনি উল্লেখ করেছেন-“তিনি (নবীজী) জন্মগ্রহণ করেন, রাতের শেষ তৃতীয়াংশে, আর সর্বশক্তিমান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।”
সুতরাং নবীজী সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু কোন মাসের কোন সোমবার? আর বৎসরই বা কোনটি? এটা জানতে আমাদেরকে অন্য উৎসের দিকে নজর দিতে হবে। তথাপি মান সম্পন্ন উৎস হিসেবে হাদিসের যে কিতাবগুলো রয়েছে তাতে কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ নেই। হ্যাঁ, একটা বর্ণনা পাওয়া যায় যার সত্যতা অবশ্য বিতর্কিত, তা হল- সূয়াদ বিন ঘাপলা বর্ণনা করেন- “নবীজী এবং আমি একই বৎসরে, হস্তী বৎসরে জন্মগ্রহণ করি।” সুনান আল-বায়হাকি, ভলিয়্যূম-১, পৃষ্টা-৭৯। আরও কিছু সূত্রও অবশ্য নির্দেশণা দেয় যে, তিনি ঐ বৎসর জন্মগ্রহণ করেন। সুতরাং, হাদিসের মূল ও বর্ধিত কিতাব থেকে আমরা এ পর্যন্ত দু’টো তথ্য কুড়িয়ে পেলাম-
এক. তিনি সোমবার জন্মগ্রহণ করেন,
দুই. তিনি হস্তী বৎসরে জন্মগ্রহণ করেন।
আবার, ইতিহাসের কিতাবগুলোতে দৃষ্টি দিলে আমরা নবীজীর অনেকগুলো জন্ম তারিখ দেখতে পাই। ইবনে ইসহাক (মৃত্যু-১৫০ হিজরী)- গোড়ারদিককার নবীজীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনীকারদের অন্যতম। তিনি হাদিস বা অপর গ্রহণযোগ্য কোন সূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেছেন যে, নবীজী হস্তী বৎসরের ১২ই রবিউল আওয়াল, সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে ইসহাক ও নবীজীর জন্মকালের মধ্যে প্রায় ২০০ বৎসরের ব্যবধান রয়েছে, সুতরাং এই দিনটি স্বীকার করে নিতে হলে আমাদের আরও কিছু প্রমাণ অবশ্যই দরকার।
প্রথমদিককার গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ (মৃত্যু-২৩০ হিজরী) তার তাবাকাতে নবীজীর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কয়েকজন প্রাথমিক বর্ণনাকারীর অভিমত তুলে ধরেছেন। ক্রম অনুসারে সেগুলি হল-
১. হস্তী বৎসরের ২রা রবিউল আওয়াল, সোমবার।
২. হস্তী বৎসরের ১০ই রবিউল আওয়াল, সোমবার।
৩. সোমবার, কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ নেই।
৪. হস্তী বৎসরে, কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ নেই।
এখানে মজার ব্যাপার লক্ষ্যণীয় এই যে, ইসলামের গোড়ার দিকের এই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ১২ই রবিউল আওয়ালকে তার তালিকায় স্থানই দেননি। অবশ্য শেষ দু’টি অপশনও সঠিক এবং কোন সুনির্দিষ্ট তারিখের সাথে তা বিরোধপূর্ণও নয়। কিন্তু প্রথমদিককার তথ্য দাতারা যারা এতটুকু তথ্য দিয়েছেন, তাদের এসব উদ্ধৃতি উল্লেখ থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, তাদের কারো নবীজীর সঠিক জন্মতারিখ জানা ছিল না, আর তাই তারা কেবল ততটুকু তথ্যই দিয়েছেন যতটুকু তারা জানেন।
মধ্যযুগের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে কাছিরও (মৃত্যু-৭৭৪ হিজরী) নবীজীর জন্মতারিখ সম্পর্কে তার স্মারকগ্রন্থ আল-বিদায়া ওয়াল নিহায়াতে অনেকগুলো অভিমত নথিবদ্ধ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন যে, বেশিরভাগ পন্ডিতই বিশ্বাস করেন নবীজী রবিউল আওয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট তারিখের ব্যাপারে তারা ভিন্ন মত পোষণ করেন। ঐসব অভিমতগুলোর কিছু হল-
ক). ২রা রবিউল আওয়াল: এ অভিমত হল গোড়ার দিকের সিরা পন্ডিতগণের অন্যতম আবু মা’সার আল-সিন্ধীর (মৃত্যু-১৭১ হিজরী) এবং বিখ্যাত মালিকি জুরিষ্ট ও পন্ডিত, ইবনে আবদ আল-বারের (মৃত্যু-৪৬৩হিজরী)। সম্ভাব্য অপশন হিসেবে এ্ই তারিখ আরও লিপিবদ্ধ হয়েছে আল-ওয়াকিদি (মৃত্যু-২০৭ হিজরী) কর্তৃক, হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে তার দূর্বলতা স্বত্ত্বেও তিনি ইসলামের প্রথমদিককার স্বনামধণ্য ঐতিহাসিকদের একজন হিসেবে স্বীকৃত।
খ). ৮ই রবিউল আওয়াল: এই অভিমতটি আন্দালুসিয়ান পন্ডিত ইবনে হাজম (মৃত্যু-১২৮ হিজরী) এবং গোড়ার দিককার আরো কিছু পন্ডিতদের। ঈমাম মালিক (মৃত্যু-১৭৯ হিজরী) এই মতটির কথা উল্লেখ করেছেন আল-জুহুরী (মৃত্যু-১২৮ হিজরী) ও মুহম্মদ বিন জুবায়েরের মতামত হিসেবে। অন্যদের মধ্যে ইবনে আবদ আল-বার ১ম মতটির পক্ষে রায় দিলেও স্বীকার করেছেন যে, এই মতটি অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের অভিমত। নবীজীর জীবনীর উপর প্রথম প্রবন্ধ লেখকদের একজন ইবনে ধাইয়াও (মৃত্যু-৬১০ হিজরী) এই তারিখটিকে সবচেয়ে জোরালো মত হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
গ). ১০ই রবিউল আওয়াল: নবীজীর বংশধর এবং শিয়া ঈমামগণের একজন, আবু জাফর আল-বাকিরের (মৃত্যু-১১৪ হিজরী) অভিমত হিসেবে ইবনে আসাকির (মৃত্যু-৫৭১ হিজরী) এটি বর্ণনা করেছেন। আর এটা বিখ্যাত স্কলার এবং সাহাবীগণের ছাত্র, আল-শাবি (মৃত্যু-১০০ হিজরী)-এরও অভিমত এবং আল ওয়াকিদির (মৃত্যু-২০৭ হিজরী) নিজেরও।
ঘ). ১২ই রবিউল আওয়াল: এই অভিমতটি ইবনে ইসহাকের (মৃত্যু-১৫০ হিজরী), যিনি কোন সূত্র ছাড়াই এটি উল্লেখ করেছেন। অন্য উৎসে এটি উল্লেখ করা হয়েছে জাবির ও ইবনে আব্বাসের অভিমত হিসেবে, কিন্তু এ্ই বিষয়ের উপর তাদেরকে নিয়ে কোন ইসনাদ প্রাইমারী সোর্স বুকে পাওয়া যায়নি।
ঙ). ১৭ই রবিউল আওয়াল: এই তারিখটি কিছু শিয়া পন্ডিতদের অভিমত এবং অধিকাংশ সুন্নী পন্ডিত এটি বাতিল করে দিয়েছেন কোনরূপ যুক্তিগ্রাহ্য যুক্তি প্রদান ব্যতিরেকেই।
চ). ২২শে রবিউল আওয়াল: এই অভিমতটি ইবনে হাজমের (মৃত্যু-১২৮ হিজরী) নামে আরোপিত।
ছ). হস্তী বৎসরের ১২ই রমযান: প্রথমদিককার পন্ডিতগণের এমনই অভিমত ছিল বলে ইবনে আসাকির এটি বর্ণনা করেছেন।
জ). হস্তী বৎসরের রমযান মাসে: এই অভিমতটি প্রথমদিককার সুপরিচিত ঐতিহাসিক আল জুবায়ের বিন আল-বক্করের (মৃত্যু-২৫৬ হিজরী) অভিমত, যিনি সর্বপ্রথম এবং বহুল স্বীকৃত মক্কার ইতিহাস রচনা করেন। আর প্রাথমিক কিছু পন্ডিতও তার সাথে এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন।
এই হচ্ছে নবীজীর জন্ম তারিখের ব্যাপারে সবচেয়ে জোরালো মতামতগুলির অন্যতম। তথাপি কোনভাবেই এ্ই তালিকাকেও সুসম্পন্ন বলে অভিমত দেয়া যাচ্ছে না একারণে যে, আধুনিক কালের একজন গবেষণাকারী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সঠিক তারিখটির ব্যাপারে সাঁরির প্রথমে থাকবে ৯ই রবিউল আওয়াল। আর আমাদের মত অল্প বিদ্যার লোক এটি খুব সহজভাবেই গণনা করবে এভাবে-
আমরা জানি, একটি চান্দ্র মাস প্রায় ২৯.৫দিন, সুতরাং চান্দ্র বৎসর =২৯.৫x১২=৩৫৪ দিনে যা প্রচলিত গ্রেগোরিয়ান বৎসরের চেয়ে (৩৬৫-৩৫৪)=১১দিন কম।
অাবার, ২০১৫ গ্রেগোরিয়ান বৎসর=১,৪৩৬ হিজরী সন।
আর, আমরা জানি, নবীজী ৫৩-৫৪ বৎসর বয়সের সময় হিজরত করেন।
সুতরাং নবীজীর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত মোট চান্দ্র বৎসর= হিজরী বৎসর+৫৪ (সনের নীচের সীমা পেতে ৫৪ বৎসর ধরা হল)= ১,৪৩৬+৫৪ = ১,৪৯০ বৎসর।
এই ১৪৯০ চান্দ্র বৎসর, সমান গ্রেগোরিয়ান বৎসরের থেকে মোট ১,৪৯০x১১ বা, ১৬,৩৯০ দিন বা, ১৬,৩৯০/৩৫৪ = ৪৬.৩ অর্থাৎ প্রায় ৪৬ বৎসর কম।
সুতরাং ১,৪৯০ চান্দ্র বৎসরের সমতুল্য গ্রেগোরিয়ান বৎসর = ১,৪৯০-৪৬ = ১,৪৪৪ বৎসর।
অতএব, নবীজীর জন্ম বৎসর = ২,০১৫-১,৪৪৪ = ৫৭১ সিই। আর যদি আমরা ধরি যে, নবীজী ৫৩ বৎসর বয়সে হিজরত করেছিলেন, তবে এটি হবে ৫৭২ সিই।
অন্যদিকে নবীজীর জন্মদিন সোমবার হস্তী বৎসরের রবিউল আওয়াল মাসে এবং যেহেতু ৮ ও ১০ তারিখ সর্বাধিক সমর্থিত বলে আমরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি, তাই ক্যালেন্ডার থেকে সহজেই আমরা পিছনের দিকে গণনা করে দেখতে পাই সোমবারটি পড়ে ঐ মাসের ৯ তারিখে।
অর্থাৎ ৫৭১ সিই্= হিজরী পূর্ব ৫৪ সোমবার ৯ই রবিউল আওয়াল এবং সংশ্লিষ্ট গ্রেগোরিয়ান তারিখ ২০শে এপ্রিল ৫৭১ সিই। আর এই তারিখ প্রথম সুপারিশ করেন মিশরীয় এ্যাস্ট্রোনোমার মুহম্মদ পাশা আল-ফালাকি (১৩০২/১৮৮৫)।তবে গণনার এসব রীতিতে যে সমস্যা রয়েছে তা এই যে, গ্রেগোরিয়ান ও হিজরীর মধ্যে রূপান্তরের সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি নেই, ফলে যে কনভার্সান এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তা পুরোপুরি নির্ভুল নয়।
আরেকটি ভিন্ন গণনা দেখিয়েছে যে, নবীজীর জন্মদিন, সোমবার, ১৭ই জুন, (১২ই রবিউল আওয়াল) ৫৬৯ সিই এবং এটি অামাদের সময়ের বিখ্যাত মুসলিম স্কলার মুহম্মদ হামিদুল্লাহ (২০০২) কর্তৃক সুপারিশকৃত।.
যাহোক, আরও যেসব ভিন্ন মতামত রয়েছে তার উল্লেখ আমরা পাই মুহম্মদ হুসেন হেকলের বর্ণনায়। তার রচিত নবীজীর জীবনীতে নবীজীর জন্ম মাস রবিউল আওয়াল ও রমযান ছাড়াও মুহররম, সফর বা রজবও হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া তিনি ফরাশী ওরিয়েন্টালিষ্ট এর উদ্ধৃতি দিয়ে আরও উল্লেখ করেছেন যে, সবচেয়ে সম্ভাব্য সময় আগস্ট ৫৭০ সিই, যা রজবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর আর্টিকেলের শুরুতেই আমরা বলেছি যে, হেকল তার সিরাতে হস্তী বৎসরটি নবীজীর জন্মের ১৫ বৎসর পূর্বের বা এমনকি তার জন্মের ৩০-৭০ বৎসর পূর্বেরও হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন, যা সম্প্রতিক ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যাহোক, উপরে উপস্থাপিত সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নবীজীর সুনির্দিষ্ট জন্ম তারিখের ব্যাপারে অনেকগুলো অভিমত রয়েছে যার কিছু মাসের ব্যাপারে ভিন্ন এবং অবশিষ্টগুলো এমনকি বৎসরের ব্যাপারেও। তবে ঐতিহাসিক এবং স্কলারগণের এক বড় অংশ এ বিষয়ে একমত যে, নবীজী হস্তী বৎসরের যা ৫৭০ (বা ৫৭১) সিই’র সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রবিউল আওয়াল মাসের কোন এক সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর এই তথ্যকে আমলে নিলে আমরা আরো দেখতে পাই যে, রবিউল আওয়াল মাসে রয়েছে অর্ধ ডজনের কাছাকাছি অভিমত। সত্যি বলতে কি, এসব তারিখগুলোর মধ্যে দু’টি তারিখ-৮ই এবং ১০ই ছিল ইসলামের প্রথম পাঁচ শতাব্দী পর্যন্ত জনপ্রিয় অভিমত। আর এ দু’য়ের মধ্যে বিশেষত: পরের মতামতটিই মূল্যায়িত হত বেশী।
তাহলে এখন এই প্রশ্ন দাঁড়ায়, ১২ই রবিউল আওয়ালকে অধিকাংশ লোক নবীজীর জন্মদিন হিসেবে উৎযাপন করে যাচ্ছে কেন? তবে কি অধিকাংশ লোক মতের এত ভিন্নতা সম্পর্কে অবগত নয়?
এর উত্তরে বলা যায়, প্রকৃত তারিখটি কোন সাহাবা বা নবীজীর স্ত্রীদের কারও জানা ছিল না এবং “১২ই রবিউল আওয়াল” অন্য দিনগুলোর মতই একটি, তবে ইবনে কাছির কিন্তু একথাটি উল্লেখ করেছেন- “…আর এটাই এ বিষয়ে সবচেয়ে কমন মতামত, তবে আল্লাই এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন।” যদিও এই অভিমত ইসলামের প্রথম কয়েক প্রজন্মের স্কলারদের কারও নামে আরোপিত হয়নি। এদিকে ইবনে রজব আল-হাম্বলিও তার লাতি’ফ আল-মা’রিফ (পৃষ্ঠা ১৮৫) গ্রন্থে লিখেছেন- “অধিকাংশ লোকের অভিমত যে, তিনি (নবীজী) সপ্তাহের ২য়দিন (সোমবার) ১২ই রবিউল আওয়াল জন্মগ্রহণ করেন.... হস্তী বৎসরে।” আর ইতিমধ্যেই আমরা বলেছি, ইবনে ইসহাকও এই তারিখটির কথা উল্লেখ করেছেন (কোন সূত্র ছাড়াই)। তবে নিম্নে বর্ণিত ফ্যাক্টর দু’টোও এসবের সাথে কাজ করে থাকতে পারে বলে আমাদের ধারণা-
প্রথমত: ইবনে ইসহাকের নিজস্ব জনপ্রিয়তা। তার সিরা গ্রন্থ নবীজীর জীবনালেখ্য সম্পর্কিত তথ্যের প্রাথমিক উৎস। আর তাই তার গ্রন্থটি অন্য অভিমতগুলোকে উপেক্ষা করে একটি স্টান্ডার্ড রেফারেন্স হিসেবে পরবর্তীতে অনেক স্কলারই তাদের লেখায় ব্যাবহার করেছেন সিম্পলি কপি-পেস্ট করে যা তারিখ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
দ্বিতীয়ত: প্রথমবারের মত একদল লোক যখন নবীজীর জন্মদিন হিসাবে দিনটি উৎযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখন সম্ভবত: তারা অতটা বিচার বিশ্লেষণ না করেই ১২ তারিখটি বেঁছে নিয়েছিল। তারপর যখন মিলাদ-উন-নবী উৎযাপন বিস্তার লাভ করল, এই দিনটিও একই সাথে অধিকাংশের স্বীকৃতি লাভ করেছিল। আর এ ধারণা এটাও ব্যাখ্যা করে যে, কেন অাবদ আল-বার হিজরী ৫ম শতাব্দীতে মওলিদ (মিলাদ-উন-নবী) উৎযাপনের ধারণা গড়ে ওঠার পূর্বে উল্লেখ করেন যে, ঐতিহাসিকদের মধ্যে অধিকাংশের অভিমত ৮ই রবিউল আওয়াল এবং কেন ইবনে কাছির আরও তিন’শ বৎসর পর যখন মিলাদ-উন-নবী সর্বসাধারণের উৎসব হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল, উল্লেখ করেন যে, ১২ই রবিউল আওয়াল অধিকাংশের অভিমত।
এ পর্যন্ত উপস্থাপিত তথ্যের সার সংক্ষেপ হল- নবীজীর জন্মের সঠিক তারিখটি ক্লাসিক্যাল স্কলারদের মধ্যে সর্বদাই বিতর্কের বিষয় ছিল। সহিহ হাদিসের কিতাবগুলোতে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি,আর এ থেকে প্রমানিত হয় তারা একে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেননি যেমনটা পরবর্তীরা করেছেন।
অধিকাংশ শিয়া স্কলার ১৭ই রবিউল আওয়াল এবং অধিকাংশ সুন্নী স্কলার ১২ই রবিউল আওয়াল নবীজীর জন্মতারিখ বলে বিশ্বাস করেন। আর এ কারণেই উভয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান জানাতে ১২-১৭ রবিউল আওয়ালকে ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে নির্ধারণ করেছে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান।
সমাপ্ত।
সংশোধিত নয়।
উৎস:
সহিহ বুখারী,
সহিহ মুসলিম,
সুনান বায়হাকি,
মালিক বিন আনাস, আল-মুয়াত্তা,
ইবনে ইসহাক, সিরাত রসূল আল্লাহ,
ইবনে সা’দ আল-তাবাকাত আল-কবির,
ইবনে কাছির, আল-বিদায়া ওয়াল নিহায়া,
ইবনে আসাকির, তারিখ মদিনাত দামাস্ক,
মওলিদ না মওলুদ- ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া,
আল ওয়াকিদি, কিতাব আল তারিখ ওয়াল মাঘাজি,
ইবনে রজব আল হাম্বলি, আল-লাতিফ আল-মারিফ,
ইবনে হাজম, আল-ইহকাম ফি উসূল আল-আহকাম,
ইবনে হজর আল-অাসকালানি, ফতেহ আল-বারী ফি সারহ সহিহ আল-বুখারী,
আল-জুরায়ের আল-বক্কর, আল-মুনতাখব মিন কিতাব আযওয়াজ আল-নবী,
Dr. Yasir Qadhi, The Birth-date of the Prophet and the history of the Mawlid, muslimmatters.org/2009/03/13/
Vaiz Zade Khorasani, Muhammad (1996). "Muhammad brithday, Unity Week and 9th International Islamic Unity Conferance" . Mishkat (51): 4–43.