বাহাউল্লাহ বর্তমান ইরানের তেহরানের মাজান্দারান নগরে ১২ই নভেম্বর, ১৮১৭ সনে এক উচ্চ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মির্জা হুসেইন আলী নূরী। নিজেকে নবী হিসেবে ঘোষণা করার পর তিনি 'বাহাউল্লাহ' এই আরবী উপাধিটি ধারণ করেন, যার অর্থ 'গ্লোরী অফ গড' বা খোদার মহিমা। তার অনুসারীরা দাবী করেন তিনি ইব্রাহিমের শেষ বয়সে বিবাহ করা স্ত্রী কাটুরার বংশজাত। তার পিতা ছিলেন মির্জা বুজুর্গ (Mírzá Buzurg) এবং মাতা খাদিজা খানম (Khadíjih Khánum)। মির্জা বুজুর্গ প্রথমে ফতেহ আলী শাহ কাজর এর দ্বাদশ সন্তান ঈমাম-ভার্দি মির্জার প্রধানমন্ত্রী (Vizier) ছিলেন। অত:পর তিনি বুরুজার্ড (Burujird)ও লরেস্তান (Lorestan)এর গভর্নর নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ১৮৩৪ সনে শাহ-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহম্মদ শাহ ক্ষমতায় এলে তিনি পদচ্যূত হন।
|
শিরিন অব বাহা, আক্কা। |
বাল্যকাল থেকেই বাহাউল্লাহ খুবই সেন্সিটিভ ও আধ্যাত্মিক ধরণের ছিলেন। শিক্ষা জীবনের শুরুতে তিনি তৎকালীন তেহরানে প্রচলিত বিভিন্ন জ্ঞান আহরণ করেন। বড় ভাইয়ের বিবাহের সময় তার 'Puppet Show' বা 'পুতুল নাচ' দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি লক্ষ্য করলেন শো শেষে পাপেটারগণ সকল পাপেট বা পুতুলগুলোকে বাক্সবন্দী করল। এই দৃশ্য যুবক বাহাউল্লাহকে জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত করল। তিনি সুফীবাদে দীক্ষিত হলেন এবং অচিরেই সুফীদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করলেন।
পিতা মির্জা বুজুর্গ এর মৃত্যুর পর তৎকালীন মন্ত্রী হাজী মির্জা আকাসী বাহাউল্লাহকে একটি সরকারী পদ গ্রহণের জন্যে অনুরোধ করেন, বাহাউল্লাহর অস্বীকৃতিতে তা পরিত্যক্ত হয়। এসময় মন্ত্রী বাহাউল্লাহর নিজস্ব সম্পত্তি মাজান্দারান নগরের নূরী গ্রামের একটা অংশ হুকুম দখল করতে চাইলেন। কিন্তু বাহাউল্লাহ তা রাষ্ট্রের কাছে বিক্রী করতে অস্বীকৃত হলে মন্ত্রী মির্জা আকাসী ও তার মধ্যে এক বড় ধরণের তিক্ততার সূত্রপাত হল।
|
শিরিন অব বাব, হাইফা। |
১৮৩৫ সনে, ১৮ বৎসর বয়সে বাহাউল্লাহ তেহরানের এক মহৎ ব্যক্তির কন্যা আছিয়া খানমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৮৪৯ সনে, ৩২ বৎসর বয়সের সময় তিনি আবারও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তার বিধবা চাচাত বোন ফাতিমা খানম এর সাথে। অবশ্য ১৮৬৩ সনের কিছু পূর্বে তিনি বাগদাদে অবস্থান কালীন সময়ে আরও একটা বিবাহ করেছিলেন। এইসব স্ত্রীর গর্ভে তার সর্বমোট ১৪টি সন্তান জন্মলাভ করে, এদের ১০টি ছিল পুত্রসন্তান। অন্যদিকে বাহাউল্লাহর পুরো পরিবারের মধ্যে কেবলমাত্র ১ম স্ত্রী আছিয়া খানম ও তার সন্তানগণ যথাক্রমে মির্জা মেহেদী, বাহাইয়া খানম ও আব্দুল বাহাই পবিত্র পরিবারভূক্ত বলে গণ্য।
এদিকে ১৮৪৪ সনে সিরাজ নগরের ২৫ বৎসর বয়স্ক সৈয়দ মির্জা আলী মুহম্মদ নামক এক ব্যক্তি বাব (Bab) বা গেট (Gate) উপাধি ধারণ করে নিজেকে প্রতিজ্ঞাত মেহেদী বলে দাবী করলেন। বাব ঘোষণা করলেন তিনিই শেষ নন, তারপরে আসবেন 'প্রতিজ্ঞাত জন' যার কথা পাক কিতাবসমূহে আছে, যিনি পৃথিবীতে খোদায়ী রাজ্য স্থাপন করবেন। বাব তার লেখাসমূহে জানিয়েছিলেন যে, প্রতিজ্ঞাত জনের আগমন শীঘ্রই হবে। এ কারণে তার কোন উত্তরাধিকারী থাকবে না, যতক্ষণ না তিনি আসেন। তবে তিনি তার পরে তার আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে সাধারণ নেতা হিসেবে মির্জা ইয়াহিয়া (Mírzá Yahyá) নামক এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বাব তার অনুসারীদের এ নির্দেশও দিয়েছিলেন যে, যখন সেই প্রতিজ্ঞাত জন আসবেন তখন যেন তারা তাকে অনুসরণ করে।
|
বাহাই টেম্পল সিডনি। |
বাহাউল্লাহ সর্বপ্রথম বাবের কথা শুনেছিলেন ১৮৪৪ সনে, যখন তার বয়স ২৭ বৎসর। এসময় তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে বাবের নিকট থেকে মোল্লা হুসেইন নামক এক ব্যক্তি এসেছিলেন। এই ব্যক্তি তাকে বাবের কথা এবং তার দাবীর বিষয়টি জানিয়েছিলেন। বাহাউল্লাহ বাবের দাবীর বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন এবং একজন বাবী হিসেবে তেহরান থেকে নিজ প্রদেশ নূরে ফিরে বাবী আন্দোলনকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। লোকালয়ে তার পরিচিতি তাকে খুব সহজে মানুষের কাছে পৌঁছুতে সাহায্য করেছিল।তিনি শুধু প্রচারেই নয়, অনুসারীদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
১৮৪৮ সনে বাহাউল্লাহ খোরাসানে বাবীদের এক সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে ৮১জন বাবী নেতা ২২ দিনের জন্যে একত্রিত হয়েছিলেন। ঐ সম্মেলনে বাবীদের মধ্যে যারা ইসলামিক আইন মেনে চলতে চায় ও যারা মনে করে বাবের বাণী একটি নূতন খোদায়ী দিকনির্দেশনার নির্দেশ, এ দু’য়ের মাঝে বিষয়টির উপর দীর্ঘ আলোচনা চলেছিল। বাহাউল্লাহ বাবের দিকটি সমর্থন করেন এবং ভোটাভুটিতে জয়লাভ করেন। এই সম্মেলনেই তিনি 'বাহা' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
১৮৪৮ সনের শেষদিকে বাবী সম্প্রদায় ও কাজার সরকারের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে বাহাউল্লাহ নির্যাতিত বাবীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে তেহরান থেকে মাজান্দারানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু তিনি সেখানে যাবার আগেই আটক ও কারাবন্দী হলেন।১৮৫০ সনে বাবী আন্দোলন পারস্যের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়লে বাবী ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গার সূত্রপাত হল। এরই ফলশ্রুতিতে ঐ সনেই বাবকে বন্দী করে তিবরিজের উন্মুক্ত ময়দানে জনসম্মুখে গুলি করে হত্যা করা হল। তার লাশ তার অনুসারীরা প্রথমে তেহরানে ও পরে ইজ্রায়েলের হাইফাতে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করে। এটি বর্তমানে শিরিন অব বাব নামে পরিচিত।
|
লোটাস টেম্পল দিল্লী। |
এদিকে বাবের এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে তেহরানের একদল বাবী, আজিমের নেতৃত্বে তৎকালীন ইরানের বাদশাহ, শাহ নাসের আল দীন শাহকে হত্যার এক ষড়যন্ত্র করে এবং ১৫ই অগাস্ট তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করলেও তারা সফল হতে পারেনি। এ সময় শাহকে হত্যার পরিকল্পনার দায়ে অনেক বাবীকে হত্যা ও আটক করা হয়। বাহাউল্লাহ সহ বেশ কিছু বাবী নেতাকে তেহরানে শিয়াচল (Síyáh-Chál) নামক এক ভূ-গর্ভস্থ অন্ধকুপে (Bláck Pit) আটক রাখা হয়। এই অন্ধকূপে বাহাউল্লাহ অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করেছিলেন। এই কারাগারে বন্দীরা বেশীদিন বাঁচত না, আর যারা বেঁচে থাকত, তারা আসলে তাদের মৃত্যুকেই কামনা করত সর্বদা। মৃত্যুর আদেশ পাওয়া বা এমনিতেই সেখানে মারা যাওয়াটা তাদের কাছে ছিল সৌভাগ্যের বিষয়। এই অন্ধকূপের কারাকক্ষে বন্দীকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে কোমর, দু’হাত ও দু’পা অতি ভারী লৌহ শিকলে আবদ্ধ করে স্যাঁতসেতে মেঝেতে নিজ মল-মূত্রের মাঝে শয়নে বাধ্য করা হত। ফলে অচিরেই বন্দীর কোমরে ও দু’হাত-পায়ে ঘাঁয়ের সৃষ্টি হত। চির অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় এক বন্দীর দু’গজ সামনেই যে অপর বন্দী রয়েছে তার কাতরানীর শব্দ শোনা ছাড়া তাকে দেখার সৌভাগ্য কখনও একে অপরের হত না। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত, প্রভাবশালী ও ধনী পরিবারের সদস্য হওয়ায় বাহাউল্লাহর পরিবার কারারক্ষীদেরকে উচ্চ অঙ্কের পারিতোষিকের দ্বারা তার জন্যে খাদ্য ও অন্যান্য বস্তু সরবরাহে সক্ষম হয়েছিল।
|
বাহাই মন্দির ইলিয়ন, USA |
শিয়াচলের অন্ধকূপে চার মাস আটক থাকার পর বাহাউল্লাহকে রুশ দূতাবাসের চাপে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হল। কেননা ইতিমধ্যে আজিম, শাহকে হত্যার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে সকল দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। এদিকে সরকার তাকে মুক্তি দিলেও তার মাতৃভূমি পারস্যে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করল। ফলে শুরু হল বাহাউল্লাহর ৪০ বৎসরের নির্বাসন জীবন।
বাহাউল্লাহ বলেন তেহরানের শিয়াচল বা অন্ধকূপের ঐ বন্দী জীবনে তার বেশকিছু অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা হয়। দিব্য-দর্শনে তার নিকট এক স্বর্গীয় হুরীর আগমন হয়, যে তাকে অবহিত করে যে তিনিই সেই প্রতিজ্ঞাত জন যার সত্ত্বর আগমন সম্পর্কে বাব ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
বাহাউল্লাহকে রুশ দূতাবাস তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে ৮ই এপ্রিল, ক্ষত-বিক্ষত, অসুস্থ্য শরীর নিয়ে ১৮৫৩ সনে চলে এলেন বর্তমান ইরাকের বাগদাদ নগরে। এই প্রাচীন নগরীটি তখন ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন। এদিকে বাহাউল্লাহকে বাগদাদে নির্বাসিত করা হয়েছে জানতে পেরে মির্জা ইয়াহিয়া সেখানে যাবার মনস্থ করলেন। শাহকে হত্যার পরিকল্পণা ব্যর্থ হবার পর ব্যাপকভাবে বাবীদেরকে ধরপাকড়ের সময় তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। যাহোক, এসময় অন্যান্য বাবীরাও যারা পারস্যে বিশেষভাবে নির্যাতিত হচ্ছিল, তারাও এখন একে একে বাগদাদে বাহাউল্লাহর চারিপাশে এসে ভীড় করল।
মির্জা ইয়াহিয়া বাগদাদে এসে বাবী সম্প্রদায়ের মাঝে বাহাউল্লাহর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালেন এবং সম্প্রদায়কে দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেললেন। নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে নিজেকে বিরোধের উৎস হিসেবে দেখতে পেয়ে বাহাউল্লাহ একাকীত্বের জীবন বেঁছে নিলেন এবং পরিবারের ভার তার ভ্রাতা মির্জা মূসার হাতে অর্পণ করে, একজন মাত্র সাথীসহ কুর্দিস্থানে চলে গেলেন। বাহাউল্লাহ বাগদাদের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত সুলাইমানিয়া শহরের নিকট কুর্দিস্থানের পাহাড়ের দিকে গমন করেছিলেন।
|
বাহাই টেম্পল, ডয়েসল্যান্ড। |
দু’বৎসর বাহাউল্লাহ কুর্দিস্থানের পাহাড়ে বসবাস করেছিলেন। তিনি আসলে সেখানে একজন সাধকের জীবন-যাপন করেছিলেন, তার পোষাক ছিল দরবেশ সুলভ; আর তিনি নাম ধারণ করেছিলেন দরবেশ মুহম্মদ-ই-ইরানী। কোন একসময় কেউ একজন তার একাকীত্বের জীবন-যাপন লক্ষ্য করে, যা স্থানীয় সূফী সমাজের মধ্যে ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি করেছিল। তারপর যখন তিনি আগতদের দর্শণ দিতে শুরু করলেন, তখন তিনি তার শিক্ষা ও জ্ঞানের জন্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেন। নকসীবান্ধা, কাদেরিয়া ও খালিদিয়ার নেতাগণ যথাক্রমে শায়খ উসমান, শায়খ আব্দুর রহমান ও শায়খ ইসমাইল প্রমুখ তার উপদেশ চাইতেন। এই সময়ে নির্জনে বাহাউল্লাহ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এদিকে বাগদাদে মির্জা ইয়াহিয়ার দূর্বল নেতৃত্বের কারণে বাবী সম্প্রদায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে লাগল। এসময় বাহাউল্লাহর পরিবারসহ কিছু বাবী দিকনির্দেশনার জন্যে বাহাউল্লাহকে খুঁজে ফিরতে থাকে। তারপর যখন দরবেশ মুহম্মদ নামধারী একজন লোকের পাহাড়ে বসবাসের সংবাদ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল, তখন বাহাউল্লাহর পরিবার তাকে বাগদাদে ফিরে আসার জন্যে বিনীত অনুরোধ করল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯শে মার্চ, ১৮৫৬ সনে দু’বৎসর কুর্দিস্থানে কাটানোর পর তিনি বাগদাদে ফিরে এলেন।
বাগদাদে ফিরে বাহাউল্লাহ বাবী সম্প্রদায়কে ভগ্নহৃদয় ও বিভক্ত দেখতে পেলেন। তার অনুপস্থিতে মির্জা ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারী পলিসি ও কার্যকরী যোগ্য নেতৃত্ব দানের অক্ষমতাই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মির্জা ইয়াহিয়া বাবের পরিস্কার নির্দেশের বিরুদ্ধে তার দু’জন বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করেছিলেন; শাহকে দ্বিতীয়বার হত্যা প্রচেষ্টার পর নূর প্রদেশের বাবীদেরকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন; এমনকি তার নেতৃত্বের বিরোধিতাকারীদের প্রতি তিনি ত্রাস সৃষ্টিও করেছিলেন যা সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করেছিল।
এ কারণে বাগদাদে ফিরে বাহাউল্লাহ বাবী সম্প্রদায়কে সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করলেন। ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং লেখনীর দ্বারা বাবী ধর্ম সম্পর্কে তাদের মাঝে নূতন উপলব্ধি ও প্রেরণার সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্য ও তিনি যে বাবের সেই প্রতিজ্ঞাত জন, এ বিষয়টি সম্পূর্ণ উহ্য রাখলেন। তথাপি শীঘ্রই তিনি বাবীদের মাঝে এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের নিকট চিহ্নিত হয়ে গেলেন আগামীদিনের বাবী নেতা হিসেবে। এসময় তিনি সরকারী কর্মকর্তা ও সুন্নী আলেমদের নিকট থেকে সহানুভূতি লাভ করেছিলেন।
|
বাহাই-রিদভ্যানের উদ্যান, বাগদাদ। |
নগরীতে বাহাউল্লাহর উঠতি প্রভাব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পারস্যিয়ান বাবী সম্প্রদায় শীঘ্রই মনোযোগ আকর্ষণ করল ইসলামিক আলেমগণ ও পারস্যিয়ান সরকারের, যারা বাহাউল্লাহ ও বাবীদের প্রতি চরম শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। পারস্যিয়ান সরকার বাহাউল্লাহকে বহিস্কার করার জন্যে অটোম্যান সরকারকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু অটোম্যান সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে বাহাউল্লাহকে স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকা থেকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনষ্টানটিনোপলে সরে আসাটা সমস্যার আশু সমাধান বলে বিবেচনা করলেন।
সরকারী নির্দেশের পর, ১৮৬৩ সনের ২১শে এপ্রিল বাহাউল্লাহ বাগদাদ ত্যাগ করলেন এবং বাগদাদের নিকটবর্তী নাজিবিয়া উদ্যানে প্রবেশ করলেন। বর্তমানে এটির নাম 'বাহাই-রিদভ্যানের উদ্যান'।
বাহাউল্লাহ ও তার সঙ্গীরা কনস্টানটিনোপলে যাত্রার পূর্বে সেখানে ১২ দিন অবস্থান করেছিলেন। ঐ সময়ই বাহাউল্লাহ তার সঙ্গী, ক্ষুদ্র এক দলের নিকট একজন 'খোদার দূত' (Messenger of God) হিসেবে তার উদ্দেশ্য ও অবস্থান ঘোষণা করেন। এ কারণে বাহাই সম্প্রদায়ের নিকট এই সময়কালটা বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ এবং তারা এর স্মরণে ১২ দিন ধরে ঐ উদ্যানে 'রিদভ্যানের উৎসব' (Festival of Ridván)পালন করে থাকে।
বাহাউল্লাহ যখন দাবী করেছিলেন যে তিনি শিয়াচলে স্বর্গীয় অপ্সরীর দেখা পেয়েছিলেন এবং রিদভ্যানের উদ্যানে তার ঘোষনা Ayyam-i Butun বা "Days of Concealment" এর মধ্যবর্তী সময়কালকে দূতীয় গোপনীয়তার সময়কাল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন যে, এই সময়কালটা ছিল একটা "Set Time of Concealment"। রিদভ্যানের উদ্যানের ঘোষণা ছিল বাবী সম্প্রদায়ে একট নূতন ধাপের শুরু যা বাবীবাদ (Bábísm) থেকে পৃথক করেছে বাহাই ধর্মমত বা বিশ্বাসের (Bahá'í Faith) উত্থানকে একটি স্বতন্ত্র আন্দোলন হিসেবে।
৩রা মে, ১৮৬৩ সনে বাহাউল্লাহ পরিবার এবং অনুসারীদের এক বিরাট দল নিয়ে রিদভ্যানের উদ্যান থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৭ই অগাস্ট, ১৮৬৩ সনে কনস্টানটিনোপলে পৌঁছেন। এই যাত্রায় তিনি যে শহরেই পা রেখেছেন, সেখানেই সমাদর ও সম্মানের সাথে আপ্যায়িত হয়েছেন। এমনকি কনস্টানটিনোপলে পৌঁছিলে তিনি রাজকীয় অতিথীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। তবে অটোম্যান কর্তৃপক্ষ কেন তাকে পারস্যে ফেরৎ না পাঠিয়ে কনস্টানটিনোপলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তা পরিস্কার নয়। কারণটা হয়ত: রাজনৈতিক ছিল, কেননা বাহাউল্লাহ ইতিমধ্যে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সম্পন্ন একজন মানুষ রূপে।
|
বাহাউল্লাহর নির্বাসন পথের ম্যাপ। |
যাহোক, বাহাউল্লাহ অটোম্যান কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন। সুতরাং সাড়ে তিন মাস কনস্টানটিনোপলে অবস্থানের পর তাকে আদ্রিয়ানোপলে যেতে আদেশ দেয়া হল। কেন সেখানে যেতে বলা হয়েছিল তাও পরিস্কার নয়। হয়ত: হতে পারে এটা পারস্য দূতাবাসের চাপ এবং বাহাউল্লাহর অটোম্যান কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করতে অস্বীকৃতির সমন্বিত ফলাফল।
যাইহোক, কর্তৃপক্ষের আদেশমত বাহাউল্লাহ তার পরিবার ও অনুসারীসহ ১লা ডিসেম্বর, ১৮৬৩ সনে আদ্রিয়ানোপলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং ১২ই ডিসেম্বর সেখানে পৌঁছেন। এই যাত্রা ভ্রমনের ছিল না, ছিল নির্বাসনের। বাহাউল্লাহ এখানে সাড়ে চার বৎসর অবস্থান করেন। এখানে অবস্থান কালে মির্জা ইয়াহিয়া তাকে হত্যার কয়েকটি পরিকল্পনা করেন। কেননা বাবী সম্প্রদায়ে বাহাউল্লাহর উত্থান ক্রমাগত তার নেতৃত্বের অবস্থান নিম্নগামী করছিল। এই কাজে প্রথমে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন স্থানীয় একজন নাপিতকে। এই নাপিত মুহম্মদ আলী ছিল ইস্পাহানের অধিবাসী। কিন্তু নাপিত মির্জা ইয়াহিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেয়। পরবর্তীতে মির্জা ইয়াহিয়া ওস্তাদ মুহম্মদ আলী-ই সালমানীর সহযোগীতায় তাকে স্নানের সময় হত্যার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এটাও ব্যর্থ হলে তিনি বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যার প্রচেষ্টা চালান এবং আংশিক সফল হন। বিষের ক্রিয়ায় বাহাউল্লাহর স্নায়ূ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় পরবর্তী জীবন তাকে হস্ত কস্পন (Shaking Hand) নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
|
বাহাউল্লাহর আক্কার কারাগার। |
এই ঘটনার পর ১৮৬৬ সনে বাহাউল্লাহ প্রকাশ্য নিজেকে বাবের ভাববাণীকৃত 'খোদার মনোনীত সেই ব্যক্তি' (Him Whom God Shall Make
Manifest) হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং একটি ঘোষণাপত্র লিখে মির্জা ইয়াহিয়ার নিকট পাঠালেন যাতে তার অনুসারীদেরকে প্রথমবারের মত 'বাহার সম্প্রদায়' (People of Bahá) বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই ঘোষণা একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে মির্জা ইয়াহিয়ার পদকে একেবারে নীচে নামিয়ে দিয়েছিল। স্বভাবতই মির্জা ইয়াহিয়া এর বিরোধিতায় নামলেন এবং বাবী মতাদর্শ রক্ষায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেন। ফলে তার অনুসারীরা অচিরেই মাইনরিটিতে পরিণত হল।
বাহাউল্লাহ তার কয়েকজন অনুসারীকে ইরাক ও ইরানের বাবীদের মাঝে তার দাবী সম্বলিত বাণী পৌঁছানোর জন্যে নির্দেশ দিলেন যারা তার বক্তব্য শুনতে পারেনি। তিনি তাদেরকে আরও বলে দিলেন তারা যেন সকল বাহাইকে একত্রিত ও পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে তার আদেশ জানিয়ে দেন। এই সময়কালে বাহাউল্লাহ স্বতন্ত্র্যভাবে বাহাই বিশ্বাস ও অনুশীলনী সম্পর্কে লেখার কাজে হাত দেন।
এরপর বাহাউল্লাহ তার দাবীকৃত বাহাই বিশ্বাস গ্রহণ করতে, দৃশ্যমান বিরোধগুলো নিস্পত্তিতে একত্রে কাজ কাজ করার আশ্বাস দিয়ে এবং মানুষের জন্যে এ পৃথিবীকে বেহেস্তী রাজ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় তার সাথে শামিল হতে বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও রাজ-রাজড়াদের প্রতি আহবান জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন। তার প্রথম পত্র (Tablet of the Kings) প্রেরিত হয়েছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান আব্দুল আজিজ ও তার সভাষদদের প্রতি।পরবর্তীতে আক্কাতে পৌঁছে তিনি যাদের নিকট পত্র প্রেরণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-
|
বাহাজি ম্যনসন। |
১. পোপ পায়াস ৯বম।
২. ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান ৩য়।
৩. রূশ সম্রাট আলেকজান্ডার ২য়।
৪. প্রুশিয়ার রাজা উইলহেম ১ম।
৫. আয়ারল্যান্ড ও বৃটেনের রানী ভিক্টোরিয়া।
৬. অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর সম্রাট ফ্রান্সিস জোসেফ।
৭. পার্স্যিয়ান সম্রাট নাসির উদ্দিন শাহ।
৮. আমেরিকার শাসক ও সেখানকার প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট।
বাবী সম্প্রদায়ে এখন বাহাউল্লাহ ও মির্জ ইয়াহিয়ার মধ্যে বিভেদ প্রকট হয়ে দেখা দিল। কোনভাবেই এই বিভক্তি দূর করার আর কোন পথ খোলা ছিল না। মির্জা ইয়াহিয়া ও তার অনুসারীরা বাহাউল্লাহকে হেয় করতে তার বিরুদ্ধে এক গুরুতর অভিযোগ এনে অটোম্যান কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করলেন। বাহাউল্লাহর বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র ও স্থানীয়দের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এসময় সরকার তাদের প্রতি মনোযোগ দিলেন এবং দেখতে পেলেন যে বাহাউল্লাহ এবং মির্জা ইয়াহিয়া উভয়ে এক নূতন ধর্মীয় দাবী ছড়িয়ে দিচ্ছেন যা মুসলিমদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।এতে সরকার আশঙ্কা করলেন আগামীতে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হতে পারে। সুতরাং কর্তৃপক্ষ তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে পুনরায় তাদের উভয়কে অটোম্যান সাম্রাজ্যের দুই প্রান্তে কারাদন্ডসহ নির্বাসনে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৮৬৮ সনের জুলাই মাসে এ সম্পর্কিত রাজকীয় ফরমান জারী হল। মির্জা ইয়াহিয়া ও তার অনুসারীদেরকে সাইপ্রাসের ফামাগুস্তা (Famagusta) এবং বাহাউল্লাহ ও তার অনুসারীদেরকে প্যালেস্টাইনের আক্কাতে (Akka) নির্বাসনের আদেশ হয়েছিল।
|
বাহাই গার্ডেন আক্কা। |
বাহাউল্লাহ তার পরিবার ও অনুসারীসহ আদ্রিয়ানোপল ত্যাগ করলেন ১২ই অগাস্ট ১৮৬৮ সনে সমুদ্র ও স্থলপথের এক দীর্ঘ যাত্রা শেষে ঐ বৎসরের ৩১শে অগাস্ট আক্কা এসে পৌঁছিলেন। তাদেরকে শহরের একটি দূর্গের মধ্যে একটি ব্যারাকে বন্দী রাখা হল। আর শহরের অধিবাসীদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হল যে, এইসব বন্দীরা সাম্রাজ্যের শত্রু, খোদা ও তার ধর্মের শত্রু, সুতরাং তাদের সাথে কারও দেখা সাক্ষাৎ ও মেলামেশা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১ম বৎসরের বন্দী জীবন বাহাইদের খুবই কষ্টে কাটল। কয়েকজন মারাও গেল, যাদের মধ্যে ছিল বাহাউল্লার ২২ বৎসরের পুত্র মির্জা মেহেদী। সে প্রার্থনা ও ধ্যানের সময় স্কাইলাইট দিয়ে নীচে পড়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে কারাকর্মকর্তারা বাহাউল্লাহকে সম্মান ও বিশ্বাস করতে শুরু করলে অবস্থার উন্নতি হল। তারপর সুলতানের মৃত্যুর পর তিনি শহর ত্যাগ ও আশেপাশের এলাকায় যাবার অনুমতিও পেলেন।
১৮৭৭ থেকে ১৮৭৯ সন পর্যন্ত বাহাউল্লাহ মাজরাহির একটি বাড়ীতে ছিলেন। তারপর তার শেষ বৎসরগুলো (১৮৮৯ সন থেকে বাকী জীবন) কাটে বাহজি ম্যানসনে-আক্কার সীমান্তলগ্ন স্থানে।যদিও তিনি তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে আটোম্যান শাসকের অধীনে কারাবন্দীই ছিলেন।
৯ই মে, ১৮৯২ সনে বাহাউল্লাহ সামান্য জ্বরে পড়েন।পরবর্তীতে তার শারিরীক অবস্থার আরও অবনতি হয় এবং ২৯শে মে, ১৮৯২ সনে তিনি পরলোকগমন করেন। তাকে বাহাজি ম্যানসনের পাশেই অন্তিম শয়নে শায়িত করা হয়।
বাহাউল্লাহ নিজেকে সকল ধর্মের বিশ্বাসীদের নিকট 'প্রতিজ্ঞাত জন' হিসেবে তুলে ধরেছেন (এখানে উল্লেখ্য যদিও তিনি কখনও বলেননি যে, তিনি হিন্দুদের 'কলি অবতার' বা বৌদ্ধদের 'মৈত্রীয়', কিন্তু তার লেখনীর মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে)। তার শিক্ষা ছিল মূলত: খোদা একজনই; সকল ধর্মই তাঁর নিকট থেকে এসেছে; এখন সময় এসেছে মানবতার স্বার্থে সকলে এক হবার, যেন খোদার অভীষ্ট পূরণে সকলে মিলে এক বেহেস্তী রাজ্য গঠন করা যায়।
সমাপ্ত।
ছবি: Wikipedia.