২৩ ডিসেম্বর, ২০১২

Council of Nicea: নিকাইয়ার সম্মেলন ও সম্রাট কনষ্টানটাইন।

রোমান সম্রাট কনষ্টানটাইন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ক্রিসপাসের (Crispus) প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন। তরুণ রাজকুমার তার সুন্দর ব্যবহার, চমৎকার আচরণ এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাহসিকতার জন্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সম্রাট তার নিজের অবস্থান যাতে বিপন্ন না হয়, সে জন্যে ক্রিসপাসকে গুপ্তহত্যা করেন। ক্রিসপাসের মৃত্যুতে সমগ্র সাম্রাজ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। 

স্টাচু অব সম্রাট কনষ্টানটাইন।
এই হত্যাকান্ডের জন্যে অভিযুক্ত করা হয় ক্রিসপাসের সৎ মাতাকে। সম্রাটের ২য় স্ত্রী, ঐ রানী ফাউস্টা (Fausta) নিজের পুত্রের সিংহাসনে আরোহণের পথ নিষ্কণ্টক করার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। এ কারণে ক্রিসপাসকে সরিয়ে দেবার অভিপ্রায় তার ছিল। যাইহোক, সম্রাট কনষ্টানটাইন ক্রিসপাসের হত্যার অভিযোগে এই রানীকে বন্দী করলেন এবং ফুটন্ত পানি ভর্তি চৌবাচ্চার মধ্যে নিক্ষেপ করে তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। 

কিন্তু এই হত্যাকান্ডের ফল সম্রাটের প্রত্যাশার বিপরীত হল। নিহত নিরাপরাধ রানীর সমর্থকরা, ক্রিসপাসের সমর্থকদের সাথে মিলিত হয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। অন্যদিকে কনষ্টানটাইন নিজেও আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন।আর তাই উপায়ন্তর না দেখে তিনি জুপিটারের মন্দিরের পুরোহিতদের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ঐ পুরোহিতরা তাকে জানাল যে, এমন কোন উৎসর্গ বা প্রার্থনা নেই যা তাকে এ দু’টি হত্যার দায় থেকে মুক্ত করতে পারে। এমতাবস্থায় কনষ্টানটাইন রোমে অবস্থানে স্বস্তি বোধ না করায় বাইজানটিয়াম চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

বাইজানটিয়ামে এসে কনষ্টানটাইন তার নামে শহরটির নামকরণ করেন। তখন থেকেই শহরটি কনষ্টান্টিনোপল (Constantinople) হিসেবে পরিচিত হয়। এখানে তিনি পলীয় চার্চের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত সমর্থন লাভ করেন। ঐ চার্চ তাকে জানায় যে, তিনি যদি তাদের চার্চে প্রায়শ্চিত্ত করেন তবে তার পাপমুক্তি ঘটবে। কনষ্টানটাইন এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। শুধু দু’টি হত্যার রক্তে তার হাত যে রঞ্জিত ছিল তাই নয়, সাম্রাজ্য শাসনের বিভিন্ন সমস্যায়ও তিনি হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। এ ভাবে অপরাধ স্বীকারের মাধ্যমে বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি লাভ এবং দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেয়ে তিনি সাম্রাজ্যের দিকে মনোনিবেশ করলেন। 

কনষ্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) বর্তমানে।
এদিকে পাপমুক্ত হবার পর সম্রাট নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে চার্চকে ব্যবহারের এক অপার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। তিনি চার্চকে জানালেন যে, চার্চ যদি তাকে সমর্থন করে যায়, তবে তিনিও চার্চকে পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যাবেন। সম্রাটের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত এ সমর্থন লাভ করে পলীয় চার্চ রাতারাতি শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠল। অন্যদিকে কনষ্টানটাইনও চার্চকে তার কাজে পূর্ণ ব্যবহার করলেন। ভূ-মধ্যসাগরের চারপাশের দেশগুলোতে অসংখ্য খৃষ্টান চার্চ ছিল যেগুলিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সম্রাট তার পথের কাঁটাগুলিকে তুলে ফেলতে লাগলেন। বহু পুরোহিতই তার গোয়েন্দা বৃত্তির কাজে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে তার অধীনে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় এ সাহায্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অংশত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে এবং অংশত জুপিটারের মন্দিরের যে রোমান পুরোহিতরা তাকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তাদের ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করতে তিনি রোমে একটি পলীয় চার্চ প্রতিষ্ঠার জন্যে খৃষ্টানদেরকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন। 

যাইহোক, কনষ্টানটাইন যখন পলীয় চার্চের সাথে জোটবদ্ধ হলেন, তখন এক ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হল। কেননা তিনি রোমান দেবতাদের পূজারি এবং পৌত্তলিক রাষ্ট্রের ধর্মীয় প্রধান হওয়া সত্ত্বেও সরাসরি পলীয় চার্চকে সমর্থন যুগিয়ে চলছিলেন। সম্রাটের ঐ আনুকূল্য খৃষ্টধর্মকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল এবং কার্যত: তা রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেকের জন্যেই খৃষ্টধর্ম আকস্মিকভাবে যুগপৎ নীতি ও সুবিধা লাভের বিষয় হয়ে উঠল। এতে পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসে যারা দৃঢ় ছিল না, তারা এখন দ্রুত পলীয় চার্চের অনুগত অনুসারীতে পরিণত হল। তবে বহু লোকই অন্তর থেকে নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিল। যেভাবে যাই হোক না কেন, মোটকথা ঐসময় খৃষ্টধর্মে এক গণজোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছিল।

পলীয় চার্চের এই আকষ্মিক উত্থানে আঁরিয়ানবাদী চার্চের সাথে তাদের বিভেদ প্রকট হয়ে দেখা দিল। এসময় সম্রাট কনষ্টানটাইন, একটি ঐক্যবদ্ধ চার্চের রাজনৈতিক সুবিধা উপলব্ধি করেন। সুতরাং তিনি জেরুজালেমকে বাদ দিয়ে খৃষ্টধর্মকে রোম কেন্দ্রিক করতে চাইলেন। কিন্তু আঁরিয়ানবাদী চার্চ তার ইচ্ছা পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে দিল। কারণ তারা এ ঘটনাকে একজন বিদেশি শাসকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে খৃষ্টধর্ম বিরোধী একটি পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করল। 

বিশপ ডোনাটাস।
প্রথম বিদ্রোহের ঘটনাটি ঘটে উত্তর আফ্রিকায় বারবার সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। আর এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ডোনাটাস (Donatus) নামক এক বিশপ, যিনি ৩১৩ খৃষ্টাব্দে বিশপ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে চার্চের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এতে রোমের পলীয় চার্চের বিশপ, ডোনাটাসের স্থলে কার্থেজে কেসিলিয়ান (Cacealian) নামক একজনকে বিশপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যে উভয়পক্ষ সম্রাট কনস্টানটাইনের শরণাপন্ন হলেন। সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতা লাভের এ প্রয়াস খৃষ্টধর্মের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে দিল। 

কনষ্টানটাইন কেসিলিয়ানের পক্ষ সমর্থন করলেন। এতে কার্থেজের অধিবাসীরা রোমান উপ-কন্সালের অফিসের সামনে জড় হল এবং কেসিলিয়ানের নিন্দা করল। কনষ্টানটাইন তাদের এ আচরণে বিরক্ত হলেন। তা সত্ত্বেও তিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার জন্যে রোমের বিশপের নেতৃত্বে একটি ট্রাইবুনাল গঠন করলেন।ডোনাটাস সেখানে হাজির হননি এবং তার পক্ষে যুক্তি-তর্ক পেশ করারও কেউ সেখানে ছিল না। তার অনুপস্থিতিতেই তার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হল। 

আফ্রিকায় আঁরিয়ানবাদী চার্চ রোমান বিশপের প্রদত্ত একতরফা রায় প্রত্যাখ্যান করে। এ ঘটনায় কনষ্টানটাইনের বিরুদ্ধে এ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হল যে, “ঈশ্বরের মন্ত্রীগণ ফালতু মামলাবাজদের মত নিজেদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত ছিলেন” হতাশ হওয়া সত্ত্বেও কনষ্টানটাইন আরলেসে নতুন করে একটি ট্রাইবুনাল স্থাপন করলেন। উভয় পক্ষের শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে তাদেরকে পৃথক পৃথক পথে আরলেসে আসার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ডোনাটাসের সমর্থকরা পুনরায় পরাজিত হল। এ ট্রাইবুনালের রায়ে বলা হয়েছিল: “বিশপগণ নিজেদের বিপজ্জনক লোকদের সাথেই দেখতে পেয়েছেন, যাদের দেশের কর্তৃপক্ষ বা ঐতিহ্যের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই। একমাত্র শাস্তিই তাদের প্রাপ্য।”

পূর্বের রায় পরের রায়ের থেকে কোনভাবেই পৃথক ছিল না। ফলে উত্তর আফ্রিকার খৃষ্টানদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হল না। তারা শুধুমাত্র রোমের পলীয় চার্চের বিশপের রায় বলবৎ করার জন্যে রোমান সাম্রাজ্যের রাজকর্মচারীদের রাতারাতি ঈশ্বরের সেবক বনে যাওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। সুতরাং বিশপ ডোনাটাস তাদের জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হলেন। 

সম্রাট কনষ্টানটাইন দুই চার্চের কাছে লেখা এক পত্রে তাদের মধ্যকার বিরোধ ভুলে যেতে এবং তার সমর্থিত চার্চের অধীনে উভয় পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি তার পত্রে লিখেছিলেন- ’আমার পক্ষে আরো যা করা যেতে পারে তা হল সকল ভ্রান্তি দূর করে এবং হঠকারী মতামত ধ্বংস করে দিয়ে সকল লোককে সত্য ধর্ম ও সরল জীবনের পথ অনুসরণ এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রাপ্য উপাসনা করার আহ্বান জানানো।’
কেউ এ পত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।

৩১৫ খৃষ্টাব্দে ইতালির উত্তরে ফ্রাংকরা হামলা শুরু করলে তা দমনের জন্যে সম্রাট রোমে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আফ্রিকায় প্রেরণের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশন সেখানে পৌছলে তাকে বর্জন করা হয়। ফলে কোন সাফল্য অর্জন ছাড়াই কমিশনের সদস্যরা রোমে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই অপ্রীতিকর সংবাদ কনষ্টানটাইনের কাছে পৌঁছিলে, তিনি স্বয়ং উত্তর আফ্রিকা গমন এবং সঠিক কিভাবে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ফরমান জারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 
কনষ্টানটাইন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও আফ্রিকা সফরে যাননি। কারণ, ডোনাটাসপন্থীরা এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে সম্রাটকে ডোনাটাস ও কেসেলিয়নের মধ্যকার বিরোধে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেয়া হয়। কেননা, যদি তার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হয়, তবে তা হবে তার মর্যাদার প্রতি এক বিরাট আঘাত। সুতরাং সম্রাট এসময় কেবল ডোনাটাসের নিন্দা করে একটি ফরমান জারি করলেন। ঐ ফরমানে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের যথোচিত পন্থায় প্রার্থনার সুযোগ সুবিধার বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। যখন তা উপেক্ষিত হল, তখন অত্যন্ত কঠোর এক আইন জারি করে আফ্রিকায় প্রেরিত হল। এতে ডোনাটাসের অনুসারীদের সকল চার্চ বাজেয়াপ্ত এবং তাদের সকল নেতাকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এসময় কেসেলিয়ান প্রথমে ডোনাটাসপন্থী চার্চদের নেতাদের উৎকোচ দিয়ে হাত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। ডোনাটাসপন্থীরা রাজকীয় ফরমান অগ্রাহ্য ও উৎকোচ উপেক্ষা করে। আর তারা অর্থ উৎকোচের প্রস্তাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে ফাঁস করে দেয়। ফলে কেসেলিয়ান “কসাই এর চাইতেও নির্মম এবং একজন স্বৈরাচারীর চাইতেও নিষ্ঠুর” হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। 

ইতিমধ্যে রোমের পলীয় চার্চ ‘ক্যাথলিক’ বিশেষণ গ্রহণ করেছিল। ঈশ্বরের উপাসনায় তাদের ধর্মমতকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যেই তারা এ নামটি গ্রহণ করে। যাহোক, এখন এই ক্যাথলিক চার্চ ডোনাটাসপন্থীদের কাছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আবেদন জানাল। এ আবেদনের কোন সাড়া মেলেনি এবং ডোনাটাস কেসেলিয়ানের কাছে তার চার্চগুলো হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান। শেষ পর্যন্ত রোমান সেনাবাহিনী মাঠে নামে। পাইকারিভাবে লোকজনকে হত্যা করা হয়। আর বিশপদের হত্যা করা হয় চার্চের অভ্যন্তরে। কিন্তু ঐ হত্যাযজ্ঞ থেকে ডোনাটাস রক্ষা পান এবং অনমনীয় থাকেন। 

কনষ্টানটাইন, যিনি একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, বল প্রয়োগে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্য পুনরুদ্ধারে তার ব্যর্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। বিচক্ষণতা বীরত্বের অঙ্গ এ বিবেচনায় তিনি উত্তর আফ্রিকার জনসাধারণকে তাদের নিজেদের উপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং আফ্রিকা থেকে তার মনোযোগ সরিয়ে এনে সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানের দিকে নিবদ্ধ করেন। ফলে ডোনাটাসপন্থীদের উপর নিপীড়নের মাত্রা হ্রাস পায় এবং তাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তারা এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, সম্রাট যখন ৩৩০ খৃষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় ক্যাথলিকদের জন্যে একটি চার্চ নির্মাণ করেন, তখন ডোনাটাসপন্থীরা তা দখল করে নেয়। আর তারা এ অভিমত ব্যক্ত করে, “ক্যাথলিকদের যাজকগণ অসৎ ব্যক্তি। তারা ইহলোকের রাজন্যবর্গের সাথে কাজ করে। রাজ-অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল হয়ে তারা যীশুর অবমাননা করে যাচ্ছে।”

সম্রাট এ ঘটনায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু আরেকটি চার্চ নির্মাণের জন্যে ক্যাথলিকদের পর্যাপ্ত অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা ছাড়া তার আর কিছু করার ছিল না। ডোনাটাসপন্থীদের আন্দোলন রোম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। রোমে তাদেরও একজন বিশপ ছিলেন, তবে পদমর্যাদার দিক থেকে তাকে কার্থেজ (Carthage) ও নিকোমেডিয়ার (Nicomedia) বিশপের চেয়ে একধাপ নীচে বলে গণ্য করা হত।

এদিকে ডোনাটাসের আন্দোলনের পাশাপাশি একই সময়ে অথচ সম্পূর্ণ স্বাধীন আর এক আন্দোলন দক্ষিণ মিসরে চলছিল। কনষ্টানটাইন যখন ৩২৪ খৃষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার জট খোলার জন্যে আরেকবার উদ্যোগ গ্রহণ করছিলেন, তখনি তার দৃষ্টি মিশরের উপর পতিত হয়। মিশর তখন বিদ্রোহ, গোলযোগ ও অরাজকতায় আকীর্ণ ছিল। ডায়োক্লোশিয়ানের নেতৃত্বে খৃষ্টানদের প্রতি নিপীড়ন যখন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন অনেকেই তা পরিহারের জন্যে তার সাথে সমঝোতা করেছিল। মেলেটিয়াস (Meletius) নামক একজন যাজক এ সময় বলেন যে, যেসব যাজকেরা প্রকাশ্যে খৃষ্টধর্মের নিন্দা করেছে তাদের যাজকবৃত্তির কাজ পুনরায় শুরু করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া উচিত। তিনি আরো বলেন যে, প্রায়শ্চিত্তের পর্যাপ্ত প্রমাণ না প্রদর্শন করা পর্যন্ত সকল বিশুদ্ধ প্রার্থনা সমাবেশে তাদের যোগদান বন্ধ করতে হবে। এ সময় আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান যাজক পিটার আরো নমনীয় পন্থার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে অধিকাংশ লোকই মেলেটিয়াসকে সমর্থন করে। অত:পর আলেকজান্ডার যখন যাজকদের প্রধান হলেন, তিনি মেলেটিয়াসকে মাইনেস-এ (Mines) নির্বাসিত করলেন। 

মেলেটিয়াসকে নির্বাসন থেকে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হল।তিনি ফিরে এলে বহু অনুসারী তার চারপাশে সমবেত হয়। তিনি বিশপ, যাজক ও উচ্চপদের যাজকদের নিয়োগ দান এবং বহু গির্জা নির্মাণ করেছিলেন। তার অনেক অনুসারীরা তাদের নিপীড়নকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে জীবন উৎসর্গ করেছিল। তাই মেলেটিয়াস তার চার্চকে “শহীদদের চার্চ” (Church of the Martyrs) নামে আখ্যায়িত করেছিলেন।বিশপ আলেকজান্ডারের অনুসারীরা এর বিরোধী ছিল। কারণ তারা নিজেদেরকে ক্যাথলিক নামে আখ্যায়িত ও পলের প্রচারিত খৃষ্টধর্মের অনুসরণ করত। 

মেলেটিয়াসের মৃত্যুর পর বিশপ আলেকজান্ডার তার অনুসারীদের প্রার্থনা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন। এ আদেশের বিরোধিতা করে তারা সম্রাট কনষ্টানটাইনের কাছে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। সেখানে নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াসের সাহায্য লাভ করে তারা সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ করে। সম্রাটের দরবারে তাদের উপস্থিতির ঘটনা নিকাইয়ার কাউন্সিল আহ্বানের অন্যতম কারণ ছিল। ইউসেবিয়াস আঁরিয়াসের বন্ধু ছিলেন। এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে আঁরিয়ান ও মেলেটিয়ান আন্দোলনের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। 
 বিশপ আঁরিয়াস।
আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ পিটার আঁরিয়াসকে একজন উচ্চ পদমর্যাদার যাজক হিসেবে নিয়োগ করেন, কিন্তু পরে তাকে তিনি বহিষ্কার করেন। পিটারের উত্তরসূরি আকিলাস (Achillas) পুনরায় তাকে যাজক নিয়োগ করেন। আঁরিয়াস এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে যখন আকিলাসের মৃত্যু ঘটে তখন তিনি তার স্থান দখলের সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্বেও তাতে আগ্রহী হননি। ফলে যাজকদের সর্বোচ্চ পদটিতে আলেকজান্ডার সহজেই অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ৩২১ খৃষ্টাব্দ নাগাদ আঁরিয়াস হয়ে উঠেছিলেন একজন জনপ্রিয় বিদ্রোহী যাজক, বিপুল রকম আত্মবিশ্বাসী এবং নিজের বিশ্বাসের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন। 

এ পর্যায় পর্যন্ত খৃষ্টানদের ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিরাট স্বাধীনতা ছিল। যারা নিজেদের খৃষ্টান বলে আখ্যায়িত করত তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক ত্রিত্ববাদকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কি, সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত ছিল না। কিছু লোক অন্ধভাবে এর সমর্থন করত। অন্যদিকে ডোনাটাস ও মেলেটিয়াসের মত কিছু লোক তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর এ দুয়ের মধ্যে যারা অবস্থান করছিল, তারা নিজেরা যে ভাবে ভাল মনে করত, ত্রিত্ববাদের সেভাবে ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা তাদের ছিল। দু'শতাব্দী ধরে আলোচনার পরও কেউই এ ধর্মমতকে সন্দেহমুক্ত ভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়নি। আঁরিয়াস ত্রিত্ববাদের সংজ্ঞা প্রদানের জন্যে চ্যালেঞ্জ জানালেন। আলেকজান্ডার তখন সম্পূর্ণ পশ্চাদপসরন করলেন। তিনি যতই এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ততই তিনি বিভ্রান্তির শিকার হলেন। আঁরিয়াস যুক্তি দিয়ে এবং পবিত্র গ্রন্থের প্রামাণিকতার উপর নির্ভর করে ত্রিত্ববাদকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করলেন।

এরপর আঁরিয়াস যীশু সম্পর্কে বিশপ আলেকজান্ডারের দেয়া ব্যাখ্যা খণ্ডন করেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, যীশু যদি প্রকৃতই ‘ঈশ্বরের পুত্র’ হয়ে থাকেন তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে পুত্রের পূর্বে পিতার অস্তিত্ব ছিল। অতএব এমন একটি সময় অবশ্যই ছিল যখন সন্তানের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং এর অর্থ এটাই হয় যে পুত্র ছিল কোন সত্তা বা প্রাণ দ্বারা গঠিত সৃষ্টি যা সব সময়ই অস্তিত্বশীল ছিল না। যেহেতু ঈশ্বর অনাদি ও চিরস্থায়ী সত্তা, সে কারণে যীশু ঈশ্বরের মত একই সত্তা হতে পারেন না। 

বিতর্কে এই ব্যক্তিগত বিপর্যয় ঘটার পর আলেকজান্ডার আঁরিয়াসের ধর্মমতের ব্যাপারে রায় ঘোষণার জন্যে এক প্রাদেশিক সভা আহ্বান করেন। প্রায় ১শ’ মিশরীয় ও লিবীয় বিশপ এতে যোগদান করেন। আঁরিয়াস অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তার অবস্থানের কথা ব্যাখ্যা করেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন: এমন এক সময় ছিল যখন যীশু অস্তিত্বশীল ছিলেন না, অথচ ঈশ্বর তখনও বিরাজিত ছিলেন। যেহেতু যীশু ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট সেকারণে তার সত্তা সীমাবদ্ধ, সুতরাং তিনি চিরন্তন হতে পারেন না। একমাত্র ঈশ্বরই চিরন্তন। যেহেতু যীশু সৃষ্ট প্রাণী, সে কারণে তিনিও অন্যান্য সকল যুক্তিবাদী প্রাণীর মতই পরিবর্তনশীল। একমাত্র ঈশ্বরই অপরিবর্তনীয়। এভাবে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, যীশু ঈশ্বর ছিলেন না। অবিরাম যুক্তি সহকারে তার বক্তব্য পেশের পাশাপাশি তিনি বাইবেল থেকে অজস্র শ্লোক উদ্ধৃতি করতেন যেগুলোর কোথাও ত্রিত্ববাদের ব্যাপারে কোন উল্লেখই ছিল না। তিনি বলেন, যদি যীশু বলে থাকেন ‘আমার পিতা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ তাহলে ঈশ্বর ও যীশু সমকক্ষ এ কথায় বিশ্বাস করার অর্থ বাইবেলের সত্যকে অস্বীকার করা। 

আঁরিয়াসের যুক্তিসমূহ অখণ্ডনীয় ছিল। তদুপরি তার বিরুদ্ধে ধর্মমতের বিরোধিতার অভিযোগ আনা হল। আর বিশপ আলেকজান্ডার তার অবস্থানের সুবাদে তাকে যাজক পদ থেকে বহিস্কার ও তাকে নির্বাসনে প্রেরণ করলেন। 

তবে আঁরিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা এত বিপুল ছিল যে পলীয় চার্চ তাকে উপেক্ষা করতে পারেনি। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের অনেক বিশপই আলেকজান্ডারের জারি করা আদেশ মেনে নেয়নি। যে বিতর্ক ৩শ’ বছর ধরে টগবগ করে ফুটছিল তা এবার বিস্ফোরিত হল। পূর্বাঞ্চলের এত বেশি সংখ্যক বিশপ আঁরিয়াসকে সমর্থন করলেন যে আলেকজান্ডার রীতিমত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েন। এ সব বিশপের প্রধান মিত্র ছিলেন নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস। তিনি ও আঁরিয়াস ছিলেন বন্ধু ও লুসিয়ানের ছাত্র যিনি তার পবিত্রতা ও জ্ঞানের জন্য সার্বজনীন মর্যাদার পাত্র ছিলেন। সম্ভবত: ৩১২ খৃষ্টাব্দে লুসিয়ানের হত্যার ঘটনা তাদের বন্ধুত্বকে আরো শক্তিশালী ও অভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসে আরো দৃঢ় প্রত্যয়ী করেছিল। 

আলেকজান্ডার কর্তৃক নির্বাসিত হওয়ার পর আঁরিয়াস কনষ্টান্টিনোপলে ইউসেবিয়াসের কাছে একটি পত্র লেখেন। ইউসেবিয়াসের ব্যাপক প্রভাব ছিল। আর শুধু জনসাধারণের উপরই নয়, খোদ রাজ প্রসাদেও তার প্রভাব বিস্তৃত ছিল। যাইহোক, আঁরিয়াস তার পত্রে ইউসেবিয়াসকে বলেন: “আমরা নির্যাতিত হচ্ছি এ কারণে যেহেতু আমরা বলি যে, যীশু উদ্ভূত হয়েছিলেন; কিন্তু ঈশ্বর উদ্ভূত হননি, তিনি অনাদি।”

অন্যদিকে বিশপ আলেকজান্ডার আঁরিয়াস সম্পর্কে তার এক পত্রে লিখেছেন: তারা শয়তানের দ্বারা চালিত, শয়তান তাদের মধ্যে বাস করে এবং তাদেরকে উত্তেজিত করে; তারা ভেলকি জানে এবং প্রতারক, চতুর, জাদুকরের মত কথায় মোহাবিষ্ট করে, তারা হল দস্যু, নিজেদের আস্তানায় তারা দিনরাত খৃষ্টকে অভিশাপ দেয়... তারা শহরের চরিত্রহীন তরুণী রমণীদের মাধ্যমে লোকজনকে ধর্মান্তরিত করে।”
ইউসেবিয়াস বিশপ আলেকজাণ্ডারের মনোভাবে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় বিশপদের এক সভা আহ্বানপূর্বক তাদের কাছে সম্পূর্ণ বিষয়টি উত্থাপন করেন। এ সমাবেশের ফল ছিল একটি পত্র যা পূর্ব ও পশ্চিমের সকল বিশপের কাছে প্রেরণ করা হয়। পত্রে তাদেরকে আঁরিয়াসকে চার্চে ফিরিয়ে নিতে আলেকজান্ডারকে রাজি করাতে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু আলেকজান্ডার আঁরিয়াসের পূর্ণ আত্মসমর্পণ চাইলেন। এসময় আঁরিয়াস ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন ও তার অনুসারীদের নিয়ে প্রার্থনা সমাবেশ করতে থাকেন। 

এসময় ইউসেবিয়াসের সমালোচনা করে আলেকজান্ডার “তার ক্যাথলিক চার্চের সহযোগী কর্মীদের” কাছে দীর্ঘ এক পত্র লেখেন যাতে তিনি অভিযোগ করেন এই বলে যে, “তিনি মনে করেন যে তার সম্মতির উপরই চার্চের কল্যাণ নির্ভর করে। "তিনি আরো বলেন, "ইউসেবিয়াস আঁরিয়াসকে সমর্থন করেন, আর তা শুধু তিনি যে আঁরিয়াসের মতবাদে বিশ্বাস করেন সে জন্যেই নয়, এর পিছনে রয়েছে তার নিজস্ব উচ্চাকাঙ্খা জনিত স্বার্থ।" এভাবে যাজকদের মধ্যকার বিরোধ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশপদের মধ্যে ব্যক্তিগত বিরোধের রূপ গ্রহণ করে। 

এ বিষয়টি নিয়ে বিশপদের পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভিন্ন প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে। নাইসিয়ার গ্রেগরী (Gregory of Nyssea) লিখেছেন: রাস্তা-ঘাট, বাজার, মুদ্রা ব্যবসায়ীদের দোকান, খাবার দোকানসহ কনষ্টান্টিনোপলের সর্বত্রই তাদের নিয়ে আলোচনা চলছিল। একজন দোকানিকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে অমুক জিনিসের মূল্য কত, সে তার জবাব দেয় উদ্ভূত সত্তা ও উদ্ভূত নয় এমন সত্তা সম্পর্কে জানতে চেয়ে। রুটিওয়ালার কাছে রুটির দাম জানতে চাইলে সে বলে, “পুত্র তার পিতার বান্দা”; চাকরকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে গোসলখানা তৈরি করা হয়েছে কিনা, সে জবাব দেয়: "পুত্র কোন কিছু থেকে উদ্ভূত হয়নি।" ক্যাথলিকরা ঘোষণা করেছে, “জন্মলাভকারীই শ্রেষ্ঠ” এবং আঁরিয়াসরা বলছে: “তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি জন্মদান করেছেন।”

লোকে রমণীদের কাছে জিজ্ঞাসা করত যে কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করার আগে তার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? যাজক মহলের উচ্চ পর্যায়েও এ বিতর্ক ছিল সমানভাবে উত্তপ্ত ও তিক্ত। জানা যায় যে  "প্রতিটি শহরেই বিশপরা বিশপদের সাথে একগুঁয়ে বিরোধে লিপ্ত ছিল। জনসাধারণ ছিল জনসাধারণের বিপক্ষে... এবং তারা পরস্পরের সাথে সহিংস সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।" 

সম্রাট কনষ্টানটাইন বিষয়টি অবহিত ছিলেন। ঘটনাবলী ক্রমশই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তিনি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন এবং আলেকজান্ডার ও আঁরিয়াস উভয়ের উদ্দেশ্যে একটি পত্র প্রেরণ করলেন। এতে তিনি বললেন যে, ধর্মীয় মতামতের ঐক্য তিনি একান্তভাবে কামনা করেন যেহেতু সাম্রাজ্যে শান্তির জন্যে সেটাই হল সর্বোত্তম গ্যারান্টি। উত্তর আফ্রিকার ঘটনাবলীতে গভীরভাবে হতাশ হয়ে তিনি "প্রাচ্যের হৃদয়ের" (Bosom of East) কাছ থেকে উত্তম কিছু আশা করলেন যেখানে "ঐশ্বরিক আলোর প্রভাতের" (Dawn of Divine Light) উদয় ঘটেছিল। 

তিনি লিখেছেন: কিন্তু হায় গৌরবময় ও পবিত্র ঈশ্বর! শুধু আমার কান নয়, আমার হৃদয়ও ক্ষত-বিক্ষত, যখন আমি শুনতে পেলাম যে আপনার মধ্যে যে বিরোধ ও দলাদলি বিদ্যমান তা এমন কি আফ্রিকার চাইতেও মারাত্মক; সুতরাং আপনারা, যাদের আমি অন্যদের বিরোধ নিরসনের দৃষ্টান্ত হিসেবে আশা করি, তাদের চেয়ে আরো খারাপ হওয়ার আগেই এর প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন এবং এখনো, এই আলোচনার মূল কারণ সম্পর্কে সতর্ক অনুসন্ধান করার পর আমি দেখতে পেয়েছি যে, তা একেবারেই তাৎপর্যহীন এবং এ ধরনের বিবাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন।

আমার অনুমান যে, বর্তমান বিতর্কের উৎপত্তি ঘটেছে এভাবে: যখন আপনি, আলেকজান্ডার, প্রতিটি যাজককে জিজ্ঞাসা করলেন যে পবিত্র গ্রন্থের কতিপয় অংশ সম্পর্কে তিনি কি ভাবেন অথবা তিনি একটি অর্থহীন বোকামিপূর্ণ প্রশ্নের একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে কি চিন্তা করেন; এবং আপনি, আরিয়াস, যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই এমন সব কথা বললেন যা কখনো প্রকাশই পায়নি অথবা পেলেও নীরবেই তার বিলুপ্তি ঘটেছে, আপনাদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিল। যোগাযোগ ছিন্ন হল এবং অধিকাংশ লোক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, তারা আর অভিন্ন হিসেবে ঐক্যবদ্ধ রইল না।

এরপর সম্রাট তাদের উভয়কেই অবান্তর প্রশ্ন ও হঠকারী জবাব বিস্মৃত হওয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান: বিষয়টি আদতে কখনোই উত্থিত হওয়ার যোগ্য ছিল না, কিন্তু অলস লোকদের করার মত বহু অপকর্ম থাকে এবং অলস মস্তিষ্কগুলো এ চিন্তাই করে। আপনাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য বা বিরোধ তা পবিত্রগ্রন্থ ভিত্তিক কোন যাজকের ধর্মমত নয়, কিংবা তা নয়া প্রবর্তিত কোন মতবাদের কারণে নয়। আপনারা উভয়েই একই প্রকার এবং অভিন্ন মত পোষণ করেন। সুতরাং আপনাদের মধ্যে পুনর্মিলন সহজেই সম্ভব। 

সম্রাট এ পত্রে পৌত্তলিক দার্শনিকদের উদাহরণ দেন যারা একই প্রকার বিশদ সাধারণ নীতিমালা ধারণের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য পোষণে সম্মত হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে, তিনি প্রশ্ন করেন, নিছক তুচ্ছ ও মৌখিক মতপার্থক্যের কারণে খৃষ্টান ভাইদের একে অপরের সাথে শত্রুর মত আচরণ করা কি ঠিক? তাঁর মতে, এ ধরনের আচরণ: রুচিহীন, শিশুসূলভ ও বদমেজাজি ও দুর্ভাগা ঈশ্বরের যাজকগণ এবং বোধ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ... এটা হল শয়তানের ছলনা ও প্রলোভন। এ ব্যাপারে আসুন আমরা কিছু করি। আমরা সবাই যদি সকল বিষয়ে এক রকম ভাবতে নাও পারি, অন্তত বড় বিষয়গুলোতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। পবিত্র ঐশ্বরিক সত্তা প্রসঙ্গে আসুন সবাই একই বিশ্বাস এক উপলব্ধি পোষণ এবং ঈশ্বর প্রসঙ্গে এক ও অভিন্ন মত অবলম্বন করি। 

পত্রে এ বলে উপসংহার টানা হয়: যদি তা না হয়, তাহলে আমার সেই শান্তিপূর্ণ ও সমস্যামুক্ত রাতগুলো ফিরিয়ে দিন যাতে আমি আমার আনন্দ এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের উৎফুল্লতা লাভ করতে পারি। তা যদি না হয় তাহলে আমি অবশ্যই যন্ত্রণা কাতর ও অশ্রুসিক্ত হব এবং মৃত্যু পর্যন্ত আমি কোন শান্তি পাব না। যেখানে ঈশ্বর প্রেমীগণ, আমার সহকর্মী সেবকগণ এ ধরনের বেআইনি ও ক্ষতিকর বিতর্কে লিপ্ত সেখানে আমি কীভাবে মনে শান্তি পাব?

এ পত্র শুধু খৃষ্টধর্ম সম্পর্কেই নয়, অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও সম্রাটের চরম অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে যেহেতু তিনি মনে করতেন যে, একজন মানুষ যেভাবে খুশি ঈশ্বরের উপাসনা করুক অথবা ঈশ্বর নির্দেশিত পন্থায়ই উপাসনা করুক, তা একই ব্যাপার। কার্যত: তার কাছে আলেকজান্ডার ও আঁরিয়াসের মধ্যকার বিরোধ ছিল নেহায়েতই মৌখিক বিবাদ অথবা এক তাৎপর্যহীন এবং অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ বিষয়। একদিকে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস অন্যদিকে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস এর মধ্যে তার দৃষ্টিতে মৌলিক কোন বিরোধ ছিল না। 

কর্দোবার হোসিয়াস এ পত্র আলেকজান্দ্রিয়ায় বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অল্প কয়েকদিন অবস্থানের পর তিনি তার মিশনের ব্যর্থতা সম্পর্কে সম্রাটকে জ্ঞাত করার জন্যে শূন্য হাতে ফিরে এলেন। 

একদিকে যখন এসব ঘটনা ঘটে চলেছিল, অন্যদিকে কনষ্টানটাইন তার ভগ্নিপতি লিসিনাসের (Licinus) সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করছিলেন। যুদ্ধে লিসিনাস নিহত হন। এসময় কনষ্টানটাইন উপলব্ধি করলেন যে, একটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেও শান্তি হারানো সম্ভব। 

হোসিয়াসের (Hosius) মিশনের ব্যর্থতার পর প্রাচ্যের পরিস্থিতি গোলযোগপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। আঁরিয়াসের বাণী ও যুক্তির পরিণতি হল আলেকজান্দ্রিয়ায় রক্তপাত। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল বা প্রাচ্যের সর্বত্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ইতিপূর্বেই উত্তর আফ্রিকায় বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ ছিল। এ পর্যায়ে সম্রাট উপলব্ধি করেন যে তার পলীয় চার্চের বন্ধুগণ তার কোন সমস্যাই মিটিয়ে দেওয়ার মত শক্তিশালী নয়। উত্তর আফ্রিকার বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন তা হল: প্রকাশ্যে কোন পক্ষ সমর্থন করা তার উচিত নয়। তাই তিনি আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেন। একজন পৌত্তলিক হিসেবে তার অবস্থান তাকে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছিল। যেহেতু তিনি বিবাদমান কোন সম্প্রদায়েরই অনুসারী নন, সে কারণে তিনি একজন নিরপেক্ষ বিচারক হতে পারবেন। তার ধারণা হল, এর ফলে তখন পর্যন্ত বিশপরা যে সমস্যার সম্মুখীন ছিলেন, তা নিরসন হবে। কারণ এ ধরনের একটি বিষয়ের নিষ্পত্তিকারী হিসেবে একজন খৃষ্টানের সভাপতিত্বের বিষয়টি মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কনষ্টানটাইনের নেতৃত্বে বিশপদের এ সভাটি আজ কাউন্সিল অব নিকাইয়া (Council of Nicea) হিসেবে পরিচিত। 

সভার জন্যে আমন্ত্রণ লিপি প্রেরণ করা হল। কনষ্টানটাইন রাজকীয় কোষাগার থেকে এর সকল ব্যয়ভার বহন করা হয়। দু’বিবদমান পক্ষে নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্য যাদের আমন্ত্রণ জানানো হল তারা সার্বিকভাবে তেমন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন না। ডোনাটাসের প্রধান বিরোধী কেসেলিয়ানকে এ সভায় আমন্ত্রণ জানানো হলেও ডোনাটাসের চার্চের কাউকেই আমন্ত্রণ করা হয়নি। সভায় অংশগ্রহণকারী গুরুত্বপূর্ণ বিশপগণ হলেন: কায়সারিয়ার ইউসেবিয়াস, নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস, এথানাসিয়াস, হোসিয়াস। এ ছাড়াও কাউন্সিলে এমন সব ব্যক্তি ছিলেন যারা ধর্মনিষ্ঠার জন্যে খ্যাতিমান হলেও জ্ঞানের জন্যে খ্যাতিমান ছিলেন না। যেমন- স্পিরিডেম (Spyridon), পাটামন, ওসিয়াস, নিকোলাসের মাইজার ইত্যাদি।

এভাবে দেখা যায়, নিকাইয়ার পরিষদ বেশির ভাগ সেসব বিশপদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল যারা একান্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু মূল বিষয়ে পর্যাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান তাদের ছিল না। এ সকল লোককে হঠাৎ করে সেকালের গ্রীক দর্শনের চটপটে ও অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যাখ্যা তাদের মুখোমুখি করা হয়েছিল। তাদের প্রকাশ ভঙ্গি ছিল এমন যে কী বলা হচ্ছে তার তাৎপর্য বুঝে ওঠা এসব বিশপের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারা তাদের জ্ঞানের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অপরাগ হয়ে অথবা তাদের বিরোধীদের সাথে বিতর্কে অক্ষম হয়ে তাদের নিজেদের বিশ্বাসে স্থিত হয়ে চুপ করে থাকা অথবা সম্রাটের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিল না।

সভা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই সকল প্রতিনিধি নিকাইয়া পৌঁছেন। তারা ছোট ছোট দলে জড় হতেন এবং তাদের মধ্যে আসন্ন সভার বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক হত। এসব সমাবেশে, যা সাধারণত জিমনেসিয়াম বা খোলা আকাশের নীচে অনুষ্ঠিত হত, গ্রীক দার্শনিকগণ তাদের যুক্তির বাণ ছুঁড়ে দিতেন এবং ব্যঙ্গ্য-বিদ্রুপ করতেন তবে তা আগত প্রতিনিধিদের বিভ্রান্ত করত না। 

অবশেষে নির্দিষ্ট দিনটি এল। প্রত্যেকেই সভায় উপস্থিত হলেন। সম্রাট সভা উদ্বোধন করবেন। প্রাসাদের একটি বিশাল কক্ষ সভার জন্যে নির্ধারণ করা হয়। কক্ষের মাঝখানে টেবিলে সেকালের সকল জ্ঞাত গসপেলের কপি সমূহ রাখা হয়ে ছিল। সেগুলোর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩শ’। প্রত্যেকের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল চমৎকার সাজে সজ্জিত কাঠের তৈরি রাজসিংহাসনের দিকে। সিংহাসনটি স্থাপন করা হয়েছিল পরস্পরের দিকে মুখ করে সন্নিবিষ্ট দু’সারি আসনের মধ্যে, কক্ষের উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া দিকের শেষ প্রান্তে। কক্ষের মধ্যে গভীর নীরবতা বিরাজ করছিল। এসময় রাজদরবারের কর্মকর্তারা একে একে আসতে শুরু করলেন। শেষ মুহূর্তে কোন ঘোষণা ছাড়াই সম্রাট এসে হাজির হলেন। সভায় আগত সমবেত প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রথমবারের মত তারা সম্রাট কনষ্টানটাইনের প্রতি সবিস্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। 

তিনি ছিলেন সম্রাট কনষ্টানটাইন, বিজয়ী, মহান, শ্রেষ্ঠ। তার দীর্ঘ দেহ, সুগঠিত শরীর, প্রশস্ত কাঁধ এবং সুদর্শন মুখায়বর তার উচ্চ মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। তার অভিব্যক্তি দেখে তাকে অবিকল রোমান সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মত মনে হচ্ছিল। বিশপদের অনেকেই তার ঝলমলে জমকাল রাজ পোশাক দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। তার দীর্ঘ চুলে ঢাকা মাথায় ছিল মনিমুক্তা খচিত রাজমুকুট। তার উজ্জ্বল লাল রঙ্গের আলখেল্লা ছিল মূল্যবান পাথর ও সোনার কারুকাজ খচিত। তার পায়ে ছিল টকটকে লাল রঙের জুতা যা সেকালে শুধুমাত্র সম্রাটরাই পায়ে দিতেন এবং এ কালে শুধুমাত্র পোপই তা পরেন। 

নিকাইয়ার সম্মেলন।
সম্রাটের দু’পাশে আসীন ছিলেন হোসিয়াস ও ইউসেবিয়াস। ইউসেবিয়াস সম্রাটের উদ্দেশ্যে বক্তৃতার মাধ্যমে সভার কার্যক্রম শুরু করলেন। সম্রাট সংক্ষিপ্ত ভাষণের মধ্যে দিয়ে তার জবাব দিলেন। তার ভাষণ ল্যাটিন থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করা হয় যা অল্প লোকেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি সম্রাট নিজেও তা তেমন বুঝতে পারেননি। কারণ গ্রীক ভাষায় তার জ্ঞান ছিল অতি সামান্য। সভার কাজ যতই অগ্রসর হতে থাকল, বিতর্কের তোরণদ্বার তত উন্মুক্ত হতে শুরু করল। কনষ্টানটাইন তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গ্রীক জ্ঞান নিয়ে একটা বিষয়েই তার সকল শক্তি নিয়োজিত করলেন। তাহল, একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছা। তিনি প্রত্যেককে জানিয়ে দিলেন যে বিভিন্ন দলের কাছ থেকে কয়েকদিন আগে তিনি যত অভিযোগ আবেদন পেয়েছিলেন তার সবই তিনি পুড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আশ্বস্ত করলেন যে, যেহেতু তিনি সেগুলোর কোনটিই পড়েননি, সেহেতু তার মন খোলা রয়েছে এবং তিনি পক্ষপাতদুষ্ট নন। 

পলীয় চার্চের প্রতিনিধিগণ ঈশ্বরের ৩টি অংশ প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা বাইবেল থেকে মাত্র দু’জনের পক্ষে যুক্তি পেশ করতে সক্ষম হন। তা সত্ত্বেও ‘পবিত্র আত্মা’ কে ঈশ্বরের তৃতীয় অংশ তথা তৃতীয় ঈশ্বর হিসেবে ঘোষণা করা হয় যদিও এ কল্পিত বিষয়ের সমর্থনে কোন যুক্তি প্রদর্শন করা হয়নি। অন্যদিকে লুসিয়ানের শিষ্যরা তাদের ভিত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন এবং তারা ত্রিত্ববাদীদের একটি অসম্ভব অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যেতে বাধ্য করেন। 

ত্রিত্ববাদীরা একজন খৃষ্টানের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চাইছিল, আঁরিয়াস ও অন্যান্য একত্ববাদী সমর্থকদের বাদ দিয়ে সে সংজ্ঞা নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে ত্রিত্ববাদ যাকে তারা দু’পক্ষের মধ্যে প্রধান বিতর্কিত বিষয় বলে গুরুত্ব আরোপ করেছিল, প্রকৃতপক্ষে কোন গসপেলেই তার উল্লেখ ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল যে তারা যাকে 'পুত্র' হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি ঈশ্বরের পুত্র। আঁরিয়াস পন্থীরা তার জবাবে বলে যে তারা সকলেই ‘ঈশ্বরের পুত্র’, কারণ বাইবেলে লেখা আছে যে, “সকল কিছুই ঈশ্বর থেকে।” এ যুক্তি ব্যবহার করা হলে সকল সৃষ্টিরই ঈশ্বরত্ব প্রমাণিত হয়। পলীয় বিশপগণ তখন যুক্তি উত্থাপন করেন যে যীশু শুধু ‘ঈশ্বর হতে’ নন, ‘ঈশ্বরের সত্তা থেকেও।’ এ যুক্তি সকল সনাতনপন্থী খৃষ্টানের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তারা বলেন, বাইবেলে এ ধরনের কোন কথাই নেই। এভাবে যীশুকে ঈশ্বর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা খৃষ্টানদের ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে তাদের মধ্যে আরো বিভক্তি সৃষ্টি করে। বেপরোয়া হয়ে ত্রিত্ববাদীরা তখন যুক্তি প্রদর্শন করে যে বাইবেলে বলা হয়েছে যে “যীশু হলেন পিতা ও সত্য ঈশ্বরের চিরন্তন ভাবমূর্তি।” আঁরিয়াস পন্থীরা তার জবাবে বলেন, বাইবেলে একথাও বলা হয়েছে যে “আমরা মানবগণ ঈশ্বরের ভাবমূর্তি ও গৌরব।” যাহোক, এ যুক্তি যদি গৃহীত হয় তাহলে প্রমাণিত হয় শুধু যীশুই নয়, সকল মানুষই ঐশ্বরিক বলে দাবি করতে পারে। 

সভাকক্ষেই শুধু নয়, রাজপ্রাসাদের মধ্যেও আলোচনা চলতে থাকে। এভাবে সভায় যার শুরু হয়েছিল তা রাজ প্রাসাদ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। সম্রাটের মাতা হেলেনা পলীয় চার্চকে সমর্থন করে বসেন। অন্যদিকে সম্রাটের বোন কনষ্টানটিনা আঁরিয়াসকে সমর্থন করলেন। কনষ্টানটিনা তার ভ্রাতা সম্রাট কনষ্টানটাইনের সাথে যুদ্ধে তার স্বামী প্রাণ হারালে রাজপরিবারে ফিরে এসেছিলেন। যাহোক, বিতর্ক রাজ দরবারেও ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে রাজপুরুষ এমনকি প্রাসাদের পাচকগণও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদিকে সুকৌশলে সম্রাট দু’পক্ষ থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন এবং সবাইকে আঁচ-অনুমানের মধ্যে রাখেন। একজন পৌত্তলিক হিসেবে তিনি খৃষ্টানদের কোন সম্প্রদায়েরই পক্ষে ছিলেন না। এটি ছিল তার পক্ষে এক জোরালো যুক্তি। 

বিতর্ক চলতে থাকা অবস্থায় উভয় পক্ষের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এ সভায় কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। তা সত্ত্বেও তারা সম্রাটের সমর্থনের প্রত্যাশা করলেন যেহেতু পলীয় চার্চের জন্যে সেটা ছিল শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপার। অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকাবাসীদের জন্যে সম্রাটের সমর্থন লাভের অর্থ ছিল তাদের নিপীড়নের অবসান। 

রাজকুমারী কনষ্টানটিনা ইউসেবিয়াসকে পরামর্শ দিলেন যে সম্রাট একটি ঐক্যবদ্ধ চার্চ চান। কারণ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিভক্তি সাম্রাজ্যকে বিপদগ্রস্ত করবে। কিন্তু যদি কোন ঐকমত্য না হয় তা হলে তিনি ধৈর্য হারাবেন এবং খৃষ্টানদের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। যদি তিনি সেপন্থাই গ্রহণ করেন তা হলে খৃষ্টানদের পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হবে এবং খৃষ্টান ধর্মও অধিকতর বিপন্ন হবে। এদিকে কনষ্টানটাইনের আনুকূল্য লাভের জন্যে উপস্থিত সকল বিশপ ধর্মের কিছু পরিবর্তন সাধনে এমনিতে সম্মত ছিলেন। আর তাই ইউসেবিয়াসের পরামর্শক্রমে আরিয়াস ও তার অনুসারীরা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলেন। যেহেতু সেসময় সাম্রাজ্যের সর্বত্র রোমান সূর্যদেবতার উপাসনা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং সম্রাটকে পৃথিবীতে দেবতার রূপ হিসেবে গণ্য করা হত, এ প্রেক্ষিতে পলীয় চার্চ :
  • রোমান সূর্য-দিবস (Sunday)-কে খৃষ্টানদের সাপ্তাহিক ধর্মীয় দিবস ঘোষণা করল;
  • সূর্য-দেবতার প্রচলিত জন্মদিবস ২৫ডিসেম্বরকে যীশুর জন্মদিবস(Christmas Day)হিসেবে গ্রহণ করল;
  • সূর্য-দেবতার প্রতীক আলোর ক্রুশকে (Cross of Light)খৃষ্টবাদের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করল; এবং
  • সূর্য-দেবতার জন্মদিবসের সকল উৎসব অনুষ্ঠানকে নিজেদের উৎসব অনুষ্ঠান হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিল। 
খৃষ্টধর্ম এবং তার সাম্রাজ্যের ধর্মের মধ্যকার বিপুল ব্যবধান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাওয়ার এ ঘটনা সম্রাট কনষ্টানটাইনের জন্যে নিশ্চয়ই অত্যন্ত সন্তোষজনক মনে হয়েছিল। চার্চ তার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে। ফলে চার্চের প্রতি তার সমর্থন আগে দুর্বল থাকলেও এখন তা অত্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠে।
চূড়ান্ত ভাবে ত্রিত্ববাদ খৃষ্টানধর্মের মৌলিক মতবাদ হিসেবে গৃহীত হয়। এ পর্যায়ে সম্ভবত এই মতবাদের কিছু অনুসারীর তখনও সরাসরি একত্ববাদের অভিজ্ঞতা ও তার প্রতি সমর্থন বিদ্যমান ছিল। তাদের জন্যে ত্রিত্ববাদ সেই পন্থার চেয়ে কম কিছু ছিল না যে পন্থায় তারা যা প্রত্যক্ষ করেছিল তা বর্ণনার চেষ্টা করত। যেহেতু যীশু যে এক ঈশ্বরের শিক্ষা দিয়েছিলেন তা তখন বিলুপ্ত হয়েছিল, তাই তারা শেষ পন্থা হিসেবে প্লাটোনিক দর্শনের পরিভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল যদিও তা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পর্যাপ্ত ছিল না। কার্যত এ-ই ছিল তাদের সব যা তারা জানত। যা হোক, এ বিষয়টি সামান্য কিছু লোকের কাছেই স্পষ্ট ছিল। এপুলিয়াস (Apuleius) লিখেছেন, “আমি নীরবে এই মহিমান্বিত ও প্লাটোনিক মতবাদ উপেক্ষা করেছিলাম। কারণ সামান্য কিছু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিই এটা বুঝেছিলেন, অন্যদিকে প্রতিটি সাধারণ মানুষের কাছেই তা অজ্ঞাত ছিল।” 
প্লাটো বলেন, “স্রষ্টাকে খোঁজা কঠিন, কিন্তু নিম্নশ্রেণির লোকদের কাছে তা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।”  
পিথাগোরাস বলেন, “কু-সংস্কারাচ্ছন্ন মতের মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের কথা বলা নিরাপদ নয়। তাদের কাছে সত্য বা মিথ্যা বলা সমান বিপজ্জনক।”

যারা এক ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন তাদের কারো কারো কাছে যদিও এ পরিভাষার ব্যবহার যৌক্তিক বলেই গণ্য ছিল, কিন্তু কার্যত: এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এমন কোন পন্থা ছিল না যাতে ‘দেবতাগণ’ এর গ্রীক ধারণা যীশুর কাছে প্রত্যাদেশকৃত ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকে সফলভাবে খর্ব করতে পারে। এ ধরনের কোন ঘটনা শুধুমাত্র পল ও তার অনুসারীদের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব ছিল। যারা গ্রীক দর্শনের আদর্শ হৃদয়ংগম করতে পারেনি তাদের মধ্যে শুধু বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি হয়েছিল। আসলে ত্রিত্ববাদের সংস্পর্শে যারা এসেছিল, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অবস্থাই ছিল এ রকম। তারা যে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিল তা নানা জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি করেছিল। সভা নিজে থেকেই তাদের সুস্পষ্টভাবে এ পথে ঠেলে দিয়েছিল। এ মতবাদ কীভাবে উদ্ভূত এবং কেন তা গৃহীত হল, কি করে অনানুষ্ঠানিক ভাবে অনুমোদিত হল, তা বোধগম্য। এটাও পরিষ্কার যে এ মতবাদের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির প্রেক্ষিতে আরিয়াস কেন পথ নির্দেশনার জন্যে গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারার আশ্রয় নেয়ার বদলে খৃষ্টধর্মের উৎসের কাছে ফিরে যাবার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। কারণ গ্রীক দর্শন নবী যীশুর উপর প্রত্যাদেশ থেকে উদ্ভূত ছিল না। 

নিকাইন ধর্মমত।
আজ যা নিকাইন ধর্মমত (Nicene Creed) নামে পরিচিত তা সম্রাট কনষ্টানটাইনের সমর্থনে সভায় উপস্থিতদের দ্বারা প্রণীত ও সত্যায়িত। এতে ত্রিত্ববাদীদের মতই স্থান পেয়েছিল এবং আঁরিয়াসের শিক্ষার সরাসরি প্রত্যাখ্যান হিসেবে নিম্নোক্ত দৈব অভিশাপ সংযুক্ত করা হয়েছিল। 

যারা বলে, "এক সময় তিনি ছিলেন না এবং জন্মের পূর্বে তিনি অস্তিত্বশীল ছিলেন না এবং তিনি কোন কিছু থেকে অস্তিত্বশীল হননি" অথবা যারা বলে যে "ঈশ্বরের পুত্র ভিন্ন সত্তা বা উপাদান অথবা তিনি সৃষ্ট হয়েছেন অথবা পরিবর্তনের উপযোগী" তাদের জন্যে ক্যাথলিক চার্চের অভিশাপ। 

যারা এ ধর্মমতে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ এতে বিশ্বাসী ছিলেন, কেউ কেউ জানতেন না যে কিসে তারা তাদের নাম স্বাক্ষর করেছেন, এবং কিছু ব্যক্তি, যারা সভার প্রতিনিধিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন, তারা ত্রিত্ববাদের সাথে একমত হতে পারেননি, কিন্তু তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্রাটকে খুশি করার জন্যে এতে স্বাক্ষর করেন। তাদের একজন বলেন, “একটু কালির বিনিময়ে প্রাণরক্ষা মোটেই খারাপ নয়।” 

এরাই ছিল সেসব লোক যারা একজন পৌত্তলিক সম্রাটের অধীনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে একজন গোঁড়া খৃষ্টানের পরীক্ষা কি হবে। এর ফল ত্রিত্ববাদীদের জন্য যেমন তেমনি আঁরিয়াসপন্থীদের জন্যও অত্যন্ত বিস্ময়কর হয়েছিল। ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে তা কারোরই জানা ছিল না। সার্বজনীন পরীক্ষা গ্রহণের ধারণাটি ছিল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কেউই তা পছন্দ করেনি। তদুপরি আঁরিয়াসবাদের সরাসরি নিন্দা ছিল এক মারাত্মক পদক্ষেপ। এমনকি যারা ধর্মমতের সত্যায়নে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিল তারাও সন্দেহের সাথেই তা করেছিল। পবিত্র গ্রন্থে ছিল না এবং যীশু বা তার শিষ্যদের দ্বারা ব্যক্ত বা উল্লেখিত নয়, এমন একটি শব্দের সমর্থনে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে তোড়জোড় করে যে সভার আয়োজন করা হয়েছিল বাস্তবে তা কিছু অর্জন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। 

একজন মাত্র ব্যক্তি জানতেন যে তিনি কি করছেন। তিনি হলেন সম্রাট কনষ্টানটাইন। তিনি জানতেন যে দৃঢ় বিশ্বাস নয়, ভোটের উপর ভিত্তি করে দাঁড় করানো একটি ধর্মমতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হবে না। কোন ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু তাকে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত নাও করতে পারে। তিনি জানতেন কীভাবে ও কেন বিশপগণ ধর্মমতের ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন। তিনি বিশপদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছেন এমন ধারণা সৃষ্টি না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে সভার সিদ্ধান্তের প্রতি ঈশ্বরের সমর্থন ও অনুমোদন প্রমাণের জন্যে ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতার আশ্রয় নেয়া হবে। 

সভার শুরুতে এনে জড়ো করা যীশুর শিক্ষার লিখিত বিবরণ গসপেলের বিশাল স্তূপ তখনও সভাকক্ষের মধ্যখানে রাখা ছিল। একটি সূত্রমতে, সেখানে সেসময়ে ২৭০টি গসপেল রাখা ছিল। অন্য একটি সূত্রমতে বিভিন্ন ধরনের গসপেলের সংখ্যা ছিল ৪০০০ এর মত। গসপেলে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন সব ধারণা সম্বলিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গসপেলের সাথে সরাসরি বিরোধমূলক একটি ধর্মীয় মতবাদ প্রণয়ন ও প্রচলন কিছু লোককে যেমন বিভ্রান্ত করেছিল অন্যদিকে গসপেলসমূহের বিদ্যমানতা অন্যদের জন্য খুবই অসুবিধাজনক ছিল। 

এ প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সকল গসপেল সভাকক্ষে একটি টেবিলের নীচে রাখা হবে। তারপর সকলেই কক্ষ ত্যাগ করবে এবং তা তালাবদ্ধ করা হবে। এখন যে গসপেলটি সঠিক সেটা যাতে টেবিলের উপর চলে আসে তার জন্য সারারাত ধরে প্রার্থনা করার জন্যে বিশপদের নির্দেশ দেওয়া হল। 

সকাল বেলা দেখা গেল, আলেকজান্ডারের প্রতিনিধি এথানাসিয়াসের কাছে গ্রহণযোগ্য গসপেলটি টেবিলের উপর স্থাপিত রয়েছে। এ ঘটনায় টেবিলের নীচে থাকা অন্যান্য সকল গসপেল পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সেই রাতে সভাকক্ষের তালার চাবি কার কাছে ছিল, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। 

এরপর অননুমোদিত গসপেল কাছে রাখা গুরুতর অপরাধে পরিণত হয়। এর পরিণতিতে পরবর্তী বছরগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি খৃষ্টান নিহত হয়। এথানাসিয়াস যে কীভাবে খৃষ্টানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, এ থেকেই তা বুঝা যায়।

নিকাইয়ার সভা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বিশপগণ তাদের পুরোনো বিরোধকে জাগিয়ে তুললেন যা তারা সম্রাট কর্তৃক আহূত হয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন। লড়াই শুরু হয়, পুরোনো বিরোধ চলতেই থাকে। তারা যে নিকাইয়ার সভায় ধর্মমতে স্বাক্ষর করেছেন, সে কথা বিস্মিত হলেন। আঁরিয়াসের সমর্থকরা নিকাইয়ার ধর্মমতকে প্রকৃত খৃষ্টান ধর্মের সমর্থক বলে বিবেচনা করেন না, সে কথা গোপন করলেন না। একমাত্র এথানাসিয়াসই (Athanasius) সম্ভবত এ নয়া ধর্মমতের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু তার সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ বিরাজ করছিল। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে তা ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। 

এভাবে নিকাইয়ার সভা খৃষ্টান সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার বিরাট ব্যবধান কমিয়ে আনার পরিবর্তে তা আরো বাড়িয়ে তোলে। তাদের মধ্যে তিক্ততার অবসান তো ঘটলই না, বরং তা বৃদ্ধি পেল। চার্চের ক্রোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সকল যুক্তি ও কারণ বাদ দিয়ে তা শক্তি প্রয়োগের পথ গ্রহণ করে। এর পরিণতিতে বড় ধরনের রক্তপাত শুরু হয়। এ পন্থায় পথ (Goths) ও লমবার্ডরা (Lombards) ‘ধর্মান্তরিত’ হয়। 

৩২৮ খৃষ্টাব্দ বিশপ আলেকজান্ডারের পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ নির্বাচন নিয়ে গোলযোগ দেখা দিল। আঁরিয়াসপন্থী ও মেলেটিয়ানপন্থীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এথানাসিয়াস বিশপ পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত, নির্বাচিত ও অভিষিক্ত হলেন। 

এদিকে সম্রাট কনষ্টানটাইনের দরবারে তার বোন কনষ্টানটিনা খৃষ্টানদের হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি আরিয়াসকেই সত্য খৃষ্টান ধর্মের প্রতিনিধি মনে করতেন। তিনি নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াসের প্রতি সম্রাটের আচরণেরও বিরোধিতা করেন। কনষ্টানটাইন তাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। 

দীর্ঘদিন পর কনষ্টানটিনা সফল হন এবং ইউসেবিয়াসকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। এথানিয়াসের জন্যে এটি ছিল এক মারাত্মক আঘাত। এসময় সম্রাট ধীরে ধীরে আঁরিয়াসের প্রতি ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। যখন তিনি শুনলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ পদে এথানাসিয়াসের নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তখনি তিনি নয়া বিশপকে রাজধানীতে তলব করেন। কিন্তু এথানাসিয়াস ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি রাজধানী কনষ্টান্টিনোপলে গেলেন না। ৩৩৫ খৃষ্টাব্দ কনষ্টানটাইনের রাজত্বের ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে টায়ার (Tyre) নগরীতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এথানাসিয়াস তাতে যোগ দিতে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে রাজকীয় স্বৈরাচারের অভিযোগ আনা হয়। পরিস্থিতি তার এমনই প্রতিকূল ছিল যে তিনি সভার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করেই সভাস্থল ত্যাগ করেন। তার নিন্দা করা হয়। বিশপগণ জেরুজালেমে সমবেত হন এবং তার নিন্দার বিষয়ে নিশ্চিত হন। এসময় আঁরিয়াসকে চার্চে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তিনি ধর্মীয় প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি লাভ করেন। 

আঁরিয়াস ও তার বন্ধু ইউসেবিয়াসকে সম্রাট কনষ্টান্টিনোপলে আমন্ত্রণ জানান। আঁরিয়াস ও সম্রাটের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হল। এরপর বিশপগণ পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে এথানাসিয়াসের নিন্দা করেন। বেপরোয়া এথানাসিয়াস এসময় কনষ্টান্টিনোপলে চলে আসেন। সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্যে তাকে অনুমতি দেওয়া হল। এসময় নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভালভাবেই জানতেন যে নিকাইয়ার সভার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারণে আঁরিয়াসের বিপক্ষে গেছে। তিনি আরও উপলব্ধি করলেন যে ধর্মীয় বিতর্ক সম্রাট কোনভাবেই বুঝতে পারবেন না। সুতরাং সে পথে না গিয়ে তিনি রাজধানীতে শস্য সরবরাহে বাঁধা সৃষ্টির জন্যে এথানাসিয়াসকে অভিযুক্ত করলেন। এই অভিনব অভিযোগে এথানাসিয়াস বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তিনি যে খেলায় দক্ষ, সে খেলা দক্ষতার সাথে খেলতে পারার মত অন্য লোকও আছে। অভিযোগ সহজেই প্রমাণিত হয় এবং এথানাসিয়াসকে গল প্রদেশের ট্রায়ারে প্রেরণ করা হল। আঁরিয়াস কনষ্টান্টিনোপলের বিশপ নিযুক্ত হলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই ৩৩৬ খৃষ্টাব্দ বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি মারা যান। চার্চ একে অলৌকিক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করলেও সম্রাট তা হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করলেন। তিনি এ মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেন। রহস্যজনক পন্থায় তদন্ত কাজ চলে। এথানাসিয়াস এ হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী বলে প্রমাণিত হয়। ফলে আঁরিয়াসকে হত্যার জন্যে এথানাসিয়াসকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। 

আঁরিয়াসের মৃত্যুর ঘটনায় সম্রাট প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। উপরন্তু বোনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি খৃষ্টানধর্ম গ্রহণ করেন। নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস তাকে দীক্ষিত করেন। এর মাত্র এক বছর পর ৩৩৭ খৃষ্টাব্দ সম্রাট পরলোক গমন করেন। এভাবে যিনি তার রাজত্বের অধিকাংশ সময় একত্ববাদের সমর্থকদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছিলেন, তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার হাতে যারা নিহত হয়েছিল তাদেরই ধর্ম গ্রহণ করে পরলোকে গমন করলেন। 

সম্রাট কনষ্টানটাইনের কফিন।
৩৩৭ খৃষ্টাব্দ সম্রাট কনষ্টানটাইনের মৃত্যুর পর পর পরবর্তী সম্রাট কনষ্টানটিয়াসও আঁরিয়াসের ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন এবং একত্ববাদে বিশ্বাসই গোঁড়া খৃষ্টান ধর্ম হিসেবে সরকারীভাবে গৃহীত হওয়া অব্যাহত ছিল। 

৩৪১ খৃষ্টাব্দ এন্টিওকে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে একত্ববাদই খৃষ্টান ধর্মের প্রকৃত ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়। ৩৫১ খৃষ্টাব্দ সিরমিয়ামে অনুষ্ঠিত আরেকটি সম্মেলনে তৎকালীন সম্রাটের উপস্থিতিতে পুনরায় পূর্বের সিদ্ধান্তকেই স্বীকার করে নেয়া হয়। এভাবে আঁরিয়াস যে শিক্ষা ধারণ করেছিলেন তাই খৃষ্টান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গ্রহণ করে। সাধু জেরোম ৩৫৯ খৃষ্টাব্দ লিখেছিলেন যে, "সারা বিশ্বই নিজেকে আঁরিয়াসের ধর্মমতের অনুসারী হিসেবে দেখতে পেয়ে বেদনার্ত ও বিস্মিত হয়েছিল।"

৩৮১ খৃষ্টাব্দ কনষ্টানটিনোপলে সম্রাটের সরকারী ধর্ম হিসেবে আঁরিয়াসের ধর্মমতের কথা ঘোষণা করা হল। 

সমাপ্ত।

উৎস: Jesus- A Prophet of God by Muhammad Ata-Ur-Rahim.

ছবি: Wikipedia, orangemanor.wordpress, saints.sqpn, samuelatgilgal.wordpress, flickr.

১৮ ডিসেম্বর, ২০১২

Sinner: পাপীষ্ঠ ও অবিশ্বাসীরা কেন ঐশী রোষানলে পড়ে না।


সাধারণ মানুষ চিরকাল বলে এসেছে, ন্যায় এবং ধর্মের পথ সম্মানের বটে কিন্তু তা কঠিন এবং বিপদসঙ্কূল। কিন্তু অন্যায় এবং পাপের পথে সুখ এবং সম্ভোগ সহজেই লাভ করা যায়। রাষ্ট্রীয় বিধানের কিছু ধমক আর সাধারণ মানুষের কিছু নিন্দাবাদ ব্যতিত অন্যায় এবং পাপের পক্ষে ভয় করার কিছু নেই। মানুষ একথাও জানে এবং তারা বলেও এসেছে যে, সততার পথে লাভের আশা কম, অসততাতেই লাভ। অসৎকে মানুষ সুখী বলেছে। তাকে তারা তাদের সম্পদ ও শক্তির জন্যে প্রকাশ্যে কিম্বা গোপনেও সম্মান করেছে। দুর্বল ও দরিদ্রকে তারা অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু তথাপি এ কথাও সত্য যে, মানুষ অসৎকে কখনও ভাল এবং সৎকে মন্দ বলেনি।

কিন্তু ন্যায় এবং অন্যায়ের বিচারে কিছু মানুষের ধারণা বেশ অদ্ভূত। খোদার সম্বন্ধে তারা বলেঃ খোদার রীতিনীতি বড়ই আশ্চর্যজনক। তিনিই ভাগ্য-নিয়ন্তা-আর তাই যারা সৎ এবং ধর্ম পরায়ণ তাদের ভাগ্যে তিনি বন্টন করেন দু:খ এবং দুর্দশা; কিন্তু যারা অসৎ তাদেরকে তিনি আশীর্বাদ করেন সুখ এবং আনন্দ দিয়ে।

আবার দেবতায় বিশ্বাসী মানুষেরা বলে: -ভিক্ষু বেশে দেবতা হাজির হন ধনীর দরজায়, আর অভয় দিয়ে বলেন, কোন পাপেই তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা দেবতারা ধনীর নিজের কিম্বা তাদের পিতৃ-পিতামহের পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করে দেবেন। কেবল কিছু খরচ করলেই তাদের চলবে। দেবতাদের নামে উৎসর্গ করুক তার সম্পদের কিছু কিম্বা দিয়ে দিক একটা ভোজ, তাহলেই তাদের পাপের মার্জনা হয়ে যাবে। বলুক তারা তাদের শত্রু কে? হোক না সে শত্রু ন্যায়পরায়ণ। ধনীর আব্দারে সেই ন্যায়পরায়ণকে অচিরে ধ্বংস করে দেবে দেবতা তার বরপুত্র ধনীর স্বার্থে। মন্ত্র পড়ে তারা প্রেতযোনীকে আটকে দিতে পারে, পারে তারা যেমন ইচ্ছে তেমনি করে তাদের দ্বারা কার্য সাধন করতে। এ ব্যাপারে কবিদের তারা সাক্ষী মানে-

পাপের প্রাচুর্য লাভে আমাদের শঙ্কার কোন কারণ নেই,
ওর সড়ক যেমন স্বচ্ছন্দ, ওর মঞ্জিল তেমনি সন্নিকট
এসো, সত্যের পথকে আমরা পরিহার করি,
ও পথে দেবতারা সঙ্কটের কাঁটাজাল বিস্তার করে দিয়েছে।
আর সে সড়কের চড়াই বড় খাড়া।----------- হিসিয়ড।

তারা কবি হোমারের উল্লেখ করেও দেখিয়ে দেয়, কিভাবে মানুষ সহজেই দেবতাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং কিভাবে সহজেই দেবতারা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েন-

দেবতাদের বিচ্যুতির পথে টেনে নামানো এমন কোন শক্ত ব্যাপার নয়;
মানুষ যদি কিছু পাপ করে থাকে আর দেবতা হয়ে থাকেন ক্রোধান্বিত,
তাহলে একটু প্রার্থনা, কিছু শূরার উপঢৌকন, আর ভাজা চর্বির লোভনীয় গন্ধ
এটাই হবে যথেষ্ট সেই দেবতার ক্রোধকে প্রশমিত করতে।----------- হোমার: ইলিয়াদ।

এই ভিক্ষুর দল বহু কিতাবের উল্লেখও করেন। তাদের মতে চন্দ্র এবং মিউজের যারা সন্তান, সেই মিউজিয়াস এবং অর্ফিয়ূস লিখিত গ্রন্থেও এ কথার সাক্ষ্য রয়েছে। আর এই সমস্ত কিতাবে বর্ণিত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মহড়া দিয়ে এরা ব্যক্তিমাত্রকে নয়, সমস্ত নগরবাসীকে একথা বিশ্বাস করায় যে, যজ্ঞ, ভোজ আর বিসর্জনের হুল্লোড় দ্বারাই মৃত কিম্বা জীবিত সবারই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারা করে দিতে পারেন। এভাবেই তারা যাগ-যজ্ঞ ও যাদু দ্বারা নরকের যন্ত্রণা থেকে আমাদের রেহাই দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের প্রতিশ্রুতিকে আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, কারণ তাদের অবজ্ঞা করলে আমাদের জন্যে চরম পরিণতি যে অপেক্ষা করছে- এ কথা বলতে তারা ভুলেন না।

ন্যায় ও অন্যায়ের এই চিত্র এবং অন্যায় সম্পর্কে মানুষ, খোদা বা দেবতাদের বিচার প্রণালীর কথা তরুণদের মনে যখন জাগে, তখন তাদের চিন্তা কোন দিকে ধাবিত হবে? তরুণদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ এবং বাতাসে ভেসে চলা মধুকরের ন্যায় পুষ্প থেকে পুষ্পে মধু আহরণ করার মেজাজ, তারা ন্যায় অন্যায়ের এই বোধ থেকে জীবনের কোন আদর্শকে নির্বাচিত করবে? জীবনের সর্বোত্তম ভোগকেই তারা তাদের চরম আদর্শ বলে বিবেচনা করবে, নয় কি?

একথা বলা এ কারণে যে, মানুষ মনে করে, সত্যিকারভাবে সৎ হয়েও সৎ বলে প্রচারিত না হলে সততার কোন লাভ নেই। এমন ক্ষেত্রে সৎ এর ভাগ্যে নিশ্চিতভাবে জুটবে দু;খ, কষ্ট এবং লাঞ্ছনা। অপরদিকে অসৎ হয়েও সৎ বলে পরিচিত হতে পারলে স্বর্গসুখ প্রাপ্তি অনিবার্য। কাজেই সত্যের চেয়ে অসত্যের মাহাত্ম্য যখন অধিক এবং অসত্যই যখন সুখ লাভের উত্তম মাধ্যম, তখন অসত্যের ধ্যানকেই জীবনের লক্ষ্য বলে স্থির করাকে মানুষ শ্রেয় বলে গণ্য করে। কারণ, সে মনে করে সুখ লাভের পথ হচ্ছে নিজের চারিদিকে ন্যায়ের একটি আবরণ তৈরী করা এবং সেই আবরণের আড়ালে ধূর্ত শেয়ালের ন্যায় নিজের স্বার্থ সাধনের জন্যে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করা। অবশ্য ধূর্ততা ঢেকে রাখা বেশ কঠিন।

এভাবে বুদ্ধির কৌশল এবং শক্তির জোরে স্বার্থ সাধন করা এবং দন্ডভোগ থেকে রেহাই পাওয়া খুব অসম্ভব কিছু না। কিন্তু কথা উঠবে, মানুষকে প্রতারিত করা সম্ভব হলেও খোদা বা দেবতাকে প্রতারিত করা সম্ভব নয়। তাদের উপর শক্তি প্রয়োগও অসম্ভব। এর জবাব এই যে, দেবতা থাকলে তো দেবতার ভয়! আর থাকলেও মানুষের জন্যে দেবতাদের ভাবনার গরজই বা কি? আর যদি তাদের শির:পীড়ারও কিছু থাকে তবুও চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা দেবতাদের কথা আমরা পুরাকাহিনী এবং কবিদের কাছ থেকেই পেয়েছি। আর তারা বলেছেনঃ বলিদান, প্রশংসামূলক অর্চণা এবং উপঢৌকন দেবতাদের ঠিক রাখার জন্যে যথেষ্ট।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম অন্যায়ের পথই হচ্ছে উত্তম পথ, লাভের পথ। সততার লাভ কেবল পরকালের দন্ড থেকে রেহাই পাওয়া। কিন্তু অন্যায়ের লাভ থেকে আমরা সততার কারণে বঞ্চিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে অসৎ হলে একদিকে যেমন আমরা জীবনের কোন উপভোগ থেকে বঞ্চিত হব না, তেমনি কবিদের কথা সত্য হলে, প্রার্থনা এবং প্রতারণায় দেবতাকূলকেও খুশী করা আমাদের অসম্ভব হবে না। অবশ্য কাপুরুষ বলতে পারে, নরকের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। সেখানে অন্যায়ের প্রতিফল আমাদের কিম্বা আমাদের বংশধরদের ভোগ করতে হবে। এর উত্তর হচ্ছে, প্রায়শ্চিত্তের দেবতার অভাব নেই সেখানেও। এরূপ দেবতাদের শক্তিও কম নয়।

সুতরাং মানুষ কেন চরম অন্যায়ের বদলে ন্যায়কে জীবনের আদর্শ বলে গ্রহণ করবে? ন্যায়ের কিছু আবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেই অন্যায় পথে দেবতা এবং মানুষ উভয়কেই আমরা জয় করতে পারি-ইহকাল এবং পরকাল উভয়ের সুখ আমরা নিজেদের জন্যে নিশ্চিত করতে পারি।

মানুষ ন্যায়বান কিম্বা সৎ কি নিজের ইচ্ছা সহকারে হয়? অবশ্য প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত কোন ব্যক্তি বা যথার্থ সত্যের জ্ঞানে জ্ঞানীর কথা আলাদা। আসলে কাপুরুষ, বৃদ্ধ এবং দুর্বল- অর্থাৎ অন্যায়ের পথ অবলম্বণে যারা অক্ষম তারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং ন্যায়ের কথা বলে।

এখন কেউ যদি বলে অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় উত্তম, তবে পরিফলের দিক থেকে তাকে একথাও বলতে হবে, কি কারণে সে একটিকে পূণ্য এবং অপরটিকে পাপ বলে বিবেচনা করছে। তবে এখানে খ্যাতির প্রশ্নটি বাদ দিতে হবে এবং ন্যায় অন্যায়ের নিজস্ব সার্থকতার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। কারণ তা না করলে অন্যায়কে অন্ধকারের আড়ালে রাখা হবে। আর তাতে ন্যায় বলতে বোঝাবে অপরের স্বার্থ সাধন আর অন্যায় হবে দুর্বলকে আঘাত করে সবলের নিজের স্বার্থোদ্ধার।

কিমেরা।
'অন্যায় যদি ন্যায় বলে প্রতিভাত হতে পারে, তাহলে অন্যায়ীর সব অন্যায় হচ্ছে লাভজনক।'- উপরের আলোচনা থেকে আপাত: দৃষ্টিতে এই বাক্যটি সত্য বলে প্রতিভাত হলেও প্রকৃতপক্ষে কি তাই? আমরা মানুষের চরিত্রকে পুরোন উপাখ্যানের জন্তু যেমন- কিমেরা, সিলা, সর্বিয়াসের সঙ্গে তুলনা করে উপরের উক্তির তাৎপর্যটি দেখি।

কিমেরা (Chimaera):ছাগ, সিংহ এবং সর্প-তিন জন্তুর দেহ বিশিষ্ট বিকটাকার দানব। গ্রীক উপাখ্যানে আছে কোরিন্থের রাজপুত্র বেলারোফন এই দানবকে তার পক্ষ যুক্ত অশ্ব দ্বারা হত্যা করে।
সিলা (Seylla):সামুদ্রিক দানব।
সার্বিয়াস (Cerberus):তিনটি কিম্বা পঞ্চাশটি মুন্ডু বিশিষ্ট পাতালপুরীর দেবতা হেডিসের প্রহরী কুকুর।

সিলা।
বেশ জটিল বহু মাথা বিশিষ্ট একটা জন্তু কল্পণা করি। এ জন্তুর যেমন বুনো মাথা আছে, তেমনি পোষা মাথা আছে। জন্তুটার মস্তকদেশ এইগুলি দিয়ে গঠিত। আর তার কি অদ্ভূত ক্ষমতা যে, সে ইচ্ছামত এগুলোকে হিংস্র কিম্বা বাধ্য স্বভাবে পরিণত করে ফেলতে পারে।

এবার একটা সিংহের কল্পণা করি। সিংহের পরে একজন মানুষকে কল্পণা করি। বহুমাথা জন্তুর আকৃতি অবশ্যই প্রকান্ড। তারপরেই সিংহের আকার। এবার তিন জন্তুকে মিলিয়ে একটা জন্তুতে পরিণত করি। এবার এই গোটা জন্তুর উপর তিন জন্তুর এক জন্তুর, ধরি, মানুষের বহিরাকার বসিয়ে দেই- যেন যে দর্শকের পক্ষে বহিরাকার ভেদ করা সম্ভব হবে না, সে যেন একে মানুষ বলেই গণ্য করে।

সার্বিয়াস।
এবার তাহলে আমরা বলব, অন্যায় সাধনে লাভ এবং ন্যায় সাধনে লোকসান- এমন অভিমতের অর্থ দাঁড়ায় এই বহু মাথা জন্তুকে যেমন ইচ্ছে তেমন করার স্বাধীনতা দেয়া এবং এই জন্তুর এবং সিংহের চরিত্রকে শক্তিশালী করা, আর এর ভিতরের মানুষটিকে বুভূক্ষ ও অসহায় করে রাখা, যাতে পরিণামে এই জন্তুর দল দুর্বল মানুষটাকে নিয়ে যেমন খুশী তেমন করতে পারে। এ কথার অর্থ দাঁড়াবে, এই তিন শক্তির মধ্যে কোন আপোষ বা মিত্রতা স্থাপন না করা; বরং তাদের পরস্পরকে দ্বন্দ্বমান, গর্জনকারী এবং পরস্পরকে ভক্ষণকারী অবস্থায় রেখে দেয়া।

অপরদিকে ন্যায় সাধনেই লাভ- এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে আমাদের সকল কথা এবং কাজ এমন হওয়া উচিৎ যাতে আমাদের অন্তরের মানুষটি শক্তিশালী হতে পারে, যেন সে বহু মাথা জন্তুটার দিকে কৃষকের ন্যায় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারে। কৃষক দেখবে, আমাদের অন্তরের পোষা স্বভাবগুলি উৎসাহিত হতে পারে, যেন বন্য স্বভাবের বৃদ্ধি না ঘটে। সিংহকে বশ করে তার শক্তিকে সে সহায় করবে এবং সকলের স্বার্থ রক্ষার্থে তার নিজের সঙ্গে অপর দুই বন্য শক্তির এবং দুই বন্য শক্তির পরস্পরের মধ্যে আপোষ স্থাপন করবে।

সুতরাং সকলদিক আলোচনার পর আমরা জানলাম-অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় উত্তম। কারণ, ন্যায় এবং উত্তমতা পরিফলে মানুষের জন্যে এই লোকে এবং পরলোকে আশীর্বাদ বা পুরস্কার বয়ে আনে এবং অন্যায় ও অধমতা পরিফলে বয়ে অনে অপমান ও শাস্তি। তাছাড়া খোদার নিকট ন্যায় এবং অন্যায়ের যথার্থ চরিত্র অপরিজ্ঞাত নয়। খোদা ন্যায় এবং অন্যায়ের যথার্থ চরিত্রকে জানে এবং এরা উভয়ে যদি তাঁর পরিচিত হয় তবে এদের একজন তাঁর মিত্র এবং অপরজন তাঁর শত্রু বলে বিবেচিত হবে এবং খোদার নিকট থেকে তাঁর মিত্র যা কিছু উত্তম তাই লাভ করবে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে অতীতে কৃত কোন অপরাধের দন্ডের ক্ষেত্রে।

সুতরাং ন্যায়বান যদি দরিদ্র হয়, যদি সে অসুস্থ্য হয় কিম্বা অনুরূপ অপর কোন দুর্ভাগ্য দ্বারা যদি সে আক্রান্ত হয়, তাহলে এরূপ দুর্ভাগ্য তার এই জীবন কিম্বা পরজীবনের মঙ্গলেরই উৎস। কারণ, যে মানুষ ন্যায়কে বরণ করেছে এবং ন্যায়ের অনুসরণে যে মানুষ মানুষের সাধ্যমত ফেরেস্তায় পরিণত হওয়ার চেষ্টা করেছে, সে মানুষকে খোদা কোনক্রমেই অবজ্ঞা করতে পারেন না। অপরদিকে যে অন্যায়কারী তার ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই সত্য।

তবে অন্যায়কারীর জন্যে পরকালে শাস্তি নিশ্চিত হলেও এইলোকে সব সময়ে যে সে শাস্তির আওতায় আসবে এমন নয়। কেন নয়, তা জানতে আমরা আসমানী কিতাব এবং রসূলগণের বক্তব্যের প্রতি নজর দেব। প্রথমে আমরা নজর দেব ঈসা মসিহের বক্তব্যে-

প্রথমত: ঈসা সমবেত লোকদেরকে বললেন, ‘একজন লোক জমি চাষ করে সেখানে উৎকৃষ্ট গমের বীজ বুনলেন। এরপর সেই লোকের শত্রু এসে ঐ জমিতে শ্যামা ঘাসের বীজ বুনে চলে গেল। ফলে গমের চারা যখন বেড়ে উঠে ফল ধরল, তখন তার মধ্যে শ্যামা ঘাসও দেখা গেল। তা দেখে বাড়ীর গোলামেরা এসে মনিবকে বলল, ‘আপনি কি জমিতে উৎকৃষ্ট বীজ বুনেননি? তবে শ্যামা ঘাস কোথেকে এল?’
তিনি বললেন, ‘কোন শত্রু এ করেছে।’
গোলামেরা বলল, ‘তবে আমরা গিয়ে ঘাসগুলি তুলে ফেলব কি?’
তিনি বললেন, ‘না, ঘাস তুলতে গিয়ে তোমরা হয়তঃ ঘাসের সাথে গমের চারাও তুলে ফেলবে। ফল পাকা পর্যন্ত ওগুলি একসঙ্গে বাড়তে দাও। যারা ফসল কাটে, আমি তখন তাদের বলব, যেন তারা প্রথমে শ্যামা ঘাসগুলি জড় করে আগুনে পোড়াবার জন্যে আঁটি আঁটি করে বাঁধে, আর তারপরে গম আমার গোলায় জমা করে।’

এ থেকে কি জানলাম আমরা? পাপীষ্ঠের সাথে সৎ লোকও শাস্তির মধ্যে পড়ে যেতে পারে এ কারণে খোদা অসৎ মানুষকে শাস্তি দানে ফেরেস্তাদেরকে বিরত রাখেন।

দ্বিতীয়ত: ঈসা বললেন, ‘কোন এক ব্যক্তির আঙ্গুর ক্ষেতে একটা ডুমুর গাছ লাগান হয়েছিল। একবার ঐ মালিক এসে ফলের খোঁজ করলেন; কিন্তু পেলেন না। তখন তিনি মালীকে বললেন, ‘দেখ, তিন বৎসর ধরে এই ডুমুর গাছে আমি ফলের খোঁজ করছি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছিনে। সুতরাং তুমি গাছটি কেটে ফেল। কেন এ শুধু শুধু জমি নষ্ট করবে?’
মালী উত্তর দিল, ‘হুজুর, এই বৎসরও গাছটাকে থাকতে দিন। আমি ওর চারপাশে খুঁড়ে সার দেব। তারপর যদি ফল ধরে তো ভালই, তা না হলে আপনি ওটা কেটে ফেলবেন।’

অর্থাৎ দুনিয়াতে কর্মরত ফেরেস্তাগণ খোদাকে নিরন্তন শান্ত রাখেন পাপাচারী পাপ থেকে ফিরবে এই আশায়। আর এরই প্রতিফলন রয়েছে কোরআনে যে- আল্লাহ কোন জনপদ ধ্বংস করেন না, যে পর্য়ন্ত না তার কেন্দ্রস্থলে তাঁর রসূল প্রেরণ না করেন এবং তিনি কোন জনপদকে ততক্ষণ ধ্বংস করেন না যতক্ষণ না সেখানকার অধিবাসীগণ সীমালঙ্ঘন না করে।-২৮:৫৯

তৃতীয়ত: আবার অদৃশ্যলোকের একদল ফেরেস্তা পাপীষ্ঠদের কৃতকর্মের জন্যে খোদার কানের কাছে নিরন্তর করুণা ভিক্ষা করে যাচ্ছে। ঐ ফেরেস্তাগণও সর্বদা আশা করে মানুষ তাদের পাপের পথ থেকে ফিরবে। নবী আইয়ূবের সহিফায় রয়েছে-

যখন মানুষ পাপের পথে চলে, তখন ফেরেস্তাগণ চিৎকার করে বলেন-
‘হে খোদা! দোযখের শাস্তি থেকে তাকে রেহাই দাও।’
সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে আর তিনি তাকে দয়া করেন,
খোদা মানুষের জন্যে বারবার এসব করেন।-----------আইয়ূবের সহিফা।

সর্বশেষ ঐশী কিতাব কোরআনেরও এর সমর্থণ রয়েছে-‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চতুর্দিক ঘিরে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে- প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং বিশ্বাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! প্রত্যেক বিষয় তোমার দয়া ও জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত আছে, অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বণ করে, তুমি তাদের ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদের স্থায়ী জান্নাতে উপস্থাপিত কর, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দিয়েছ এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরও। নিশ্চয় তুমি মহাপরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময় এবং তুমি তাদের শাস্তি হতে রক্ষা কর, সেদিন যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে তাকে তো অনুগ্রহই করবে, এ সেই মহান সফলতা।’----------(কোরআন, ৪০:৭-৯)

সমাপ্ত।

ছবি: thanasis, timelessmyths, bloodbrothersgame.wikia.

১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

Last Prophet: বনি ইস্রায়েলে শেষ রসূলের না আগমনের কারণ।

Everyone that works, works for an end in which he finds satisfaction. Wherefore, God, as He is perfect, hasn't need of satisfaction, because He has satisfaction Himself. And so, willing to work, He created before all things, the soul of His Habib, for whom He determined to create the whole, in order that the creatures should find joy and blessedness in God, whence His Habib should take delight in all His creatures, which He has appointed to be His Messenger, His slave. And wherefore this is, so save as thus He willed.

Every prophet when he came, borne to one nation only, which was the mark of the mercy of God. And so their words were not extended save to that people to which they were sent. But the Messiah, when he shall come, God shall give to him as it were the seal of His hand, insomuch that he shall carry salvation and mercy to all the nations of the world that shall receive his doctrine. 

He, the Messiah, shall come with power upon the ungodly, and shall destroy idolatry, insomuch that he shall make Satan confounded; for so promised God to Abraham, saying: "Behold, in your seed I will bless all the tribes of the earth; and as you have broken in pieces the idols, O Abraham;, even so shall your seed do."" 

Now the Question is, in whom this promise was made; "in Isaac," or in "in Ishmael;" as the Jews says that the Messiah will be among them and in the lineage of David. Is their claim true or baseless? 

To Justify them, we have to inquire first the lineage of David. And we find, he was of Isaac; for Isaac was father of Jacob, and Jacob was father of Judah, of whose lineage is David. 

And the Messiah, when he shall come, of what lineage will he be?.In Jabur (Psalm), we find that David calls him (the Messiah) lord, saying thus:

“God said to my lord,
"Sit on My right hand, 
until I make your enemies your footstool.” -[Psalm, 110:1]

God shall send forth Jews lord which shall have lordship in the midst of their enemies. If that Messenger of God whom they call Messiah shall be the son of David, how should David call him lord?

For this, Jesus said in the Gospel [Barnabas, CH-43], "Believe me, for truly I say to you, that the promise was made in Ishmael, not in Isaac." 

If this, then how it is written in the Book of Moses, that the promise was made in Isaac?.Jesus answered it with a groan: "It is so written, but Moses did not write it, nor Joshua, but rather our rabbins.!" And Jesus Justified himself as-  "if we consider the words of the angel Gabriel, we shall discover the malice of (Jew) scribes and doctors. For the angel said: "Abraham, all the world shall know how God loves you; but how shall the world know the love that you bear to God? Assuredly it is necessary that you do something for love of God."
Abraham answered: 'Behold the servant of God, ready to do all that which God shall will.'
Then spoke God, saying to Abraham: "Take your son, your firstborn (ie. Ishmael);,and come up the mountain Marwah [al-Marwah- a mountain now located in the Masjid al-Haram in Mecca) to sacrifice him."

Now, what is written in the Bible? You will find there Isaac as firstborn. The question is ‘How is Isaac firstborn, if when Isaac was born Ishmael was seven years old?" Therefore, it is clear, that is the deception of their doctors.".

Jesus conclude, saying- "Satan ever seeks to annul the laws of God; and therefore he with his followers, hypocrites and evil-doers, the former with false doctrine, the latter with lewd living, to day have contaminated almost all things, so that scarcely is the truth found. Woe to those hypocrites! for the praises of this world shall turn for them into insults and torments in hell."

Now what about Muhammad, the seal of the Prophets. Was he the promised Messiah? We find him as a splendour one, who gave gladness to nearly all that God has made, for he was adorned with the spirit of understanding and of counsel, the spirit of wisdom and might, the spirit of fear and love, the spirit of prudence and temperance, he was adorned with the spirit of charity and mercy, the spirit of justice and Piety, the spirit of gentleness and patience, which he had received from God three times more than He has given to all His creatures. 

For this, Jesus said in his Gospel [Barnabas, CH-44] that when will he come to the world, the time shall be blessed, He also proclaimed that He had seen him and had done him reverence, even every prophet had seen him, seen that of His spirit, God gives to them prophecy. And when he saw him his soul was filled with consolation, saying-: "O Muhammad;, God be with you, and may He make me worthy to untie, your shoelatchet, for obtaining this I shall be a great prophet and holy one of God." -Jesus rendered his thanks to God.

The appointment of the Prophet Muhammad is indeed a blessing and mercy of Allah to the whole world. This is because he aroused the neglectful world from its heedlessness and gave it the knowledge of the criterion between truth and falsehood, and warned it very clearly of both the ways of salvation and ruin. This makes him as Messiah or the people of the whole world

Thus Qur an says-
Muhammad is .....the Messenger of Allah and the seal of the Prophets.-[al-Ahzab, 33:40] We have sent you forth as a witness, a bearer of good tidings, and a warner, as one who calls people to Allah by His leave, and as a bright, shining lamp.-[al-Ahzab, 33:45-46] We have sent you as a blessing for the people of the whole world.-[al-Anbiya, 21:107]

আদিকাল থেকেই কোন মঙ্গলকর কাজের শুরুতে মানুষ তার উপাস্যের নিকট তার কাজটি নিবেদন করত তার ঐ কাজটি গ্রহণ করার নিবেদন জানিয়ে এবং মোনাজাত করত মঙ্গলকর কিছু চেয়ে। এমনিভাবে কা’বা ঘরের ভিত্তি স্থাপনের সময় ইব্রাহিমও প্রার্থনা নিবেদন করেছিলেন খোদার নিকট। যেমন-

আর যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল (কা’বা) গৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল, তখন তারা বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের এ কাজ গ্রহণ কর। তুমি তো সব শোন আর সব জান। 
-হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের দু‘জনকে তোমার একান্ত অনুগত কর ও আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত এক উম্মত (সমাজ) তৈরী কর। আমাদেরকে উপাসনার নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দাও, আর আমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হও! তুমি তো অত্যন্ত ক্ষমাপরবশ পরম দয়ালু। 

-হে আমার প্রতিপালক! তাদের মধ্যে থেকে তাদের কাছে একজন রসূল প্রেরণ কোরও যে তোমার আয়াত তাদের কাছে আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, তত্ত্বজ্ঞানী।-(২ঃ১২৫-১২৭)

ইব্রাহিম মরুতে নির্বাসন দেয়া পুত্রের বংশধরদের মাঝে কেবলমাত্র একজন রসূল চাইলেন, কেন কেউ কি ভেবে দেখেছেন? অন্যদিকে খোদা তার প্রার্থণা কবুল করলেন এবং তিনি তাদের মাঝে ঐ একজনই  রসূল প্রেরণ করলেন। আর তিনি ঐ রসূলকে ‘Seal of the Prophets’ ঘোষণা করে তার মধ্য দিয়ে নব্যূয়তের ধারারই ইতি টানলেন। কেন?

পৃথিবীতে যত সংখ্যক পয়গম্বর আগমন করেছেন তার অধিকাংশই এসেছেন বনি ইস্রায়েলে। এমন কি ঈসা মসিহ (বনি ইস্রায়েলের ত্রাণকর্তা বা উদ্ধারকারী) যিনি মানুষ জাতিকে পাপ থেকে উদ্ধারের তথা বেহেস্তে প্রবেশের সহজ পথ দেখিয়েছেন, তিনিও কি-না এসেছিলেন একটি মাত্র জাতির জন্যে-কেবলমাত্র বনি ইস্রায়েলকে হেদায়েত করতে। কেননা মসিহ নিজেই বলেছেন- ‘আমাকে কেবল ইস্রায়েল বংশের হারান মেষদের কাছেই পাঠান হয়েছে।’-মথি, ১৫:২৪. ঈসা সীদোন এলাকায় গেলে সেখানকার একজন কনানীয় স্ত্রীলোক তার পিছনে পিছনে চলছিল আর চীৎকার করে বলছিল, ‘হে, ঈসা! আমার প্রতি রহম করুন! জ্বীন-আমার মেয়েটিকে ভীষণ ভাবে ধরেছে।’

কিন্তু যেহেতু ঈসা কেবল ইস্রায়েলী কাছে আগত তাই তার কথা শুনেও কোন উত্তর দিচ্ছিলেন না। কিন্তু শিষ্যরা বলল, ‘ওকে বিদায় করে দিন, কারণ সে আমাদের পিছনে পিছনে চীৎকার করছে।’ তখন ঈসা দাঁড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রীলোকটিকে উপরের কথাটি বলেন।

এতো গেল ঈসা মসিহের নিজের কথা, কিন্তু এত বড় একজন মহান নবী সমগ্র মানবজাতির জন্যে না হয়ে কেবলমাত্র একটি গোষ্ঠির হবার কারণ কি? কারণ হল এই- ইব্রাহিমের নিকট খোদার কৃত অঙ্গীকার।

স্মরণ কর, যখন তাকে তার প্রতিপালক বললেন, ‘অনুগত হও।’
সে বলল, ‘আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম।’(২:১৩১)
আর ইব্রাহিমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করেছি।’   
সে বলল, ‘আমার বংশধরদের মধ্যে হতেও?’ 
আল্লাহ বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি সীমালংঘনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য না।’(২:১২৪) অর্থাৎ ইব্রাহিমকে শুধু মানব জাতির নেতাই করা হয়নি, তার বংশে নব্যূয়ত অব্যাহত রেখে তাকে গৌরাবান্বিতও করেছেন তিনি। তবে স্মরণীয়, সীমালংঘনকারীদের বেলায় অবশ্য ব্যতিক্রম হবে।

আর তাই খোদার কৃত ঐ অঙ্গীকারের কারণে, যখনই বনি ইস্রায়েল সরল ও সত্যপথ থেকে বিচ্যূত হয়েছে, তখনই একজন নবী বা রসূল তাদের মাঝে প্রেরিত হয়েছে, যারা প্রতিমাপূজার কূ-ফল সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করেছেন এবং সত্যপথে ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যেহেতু ইহুদি জাতিটি ছিল, নাফরমান, একগুয়ে ও বক্রস্বভাবী, ফলে তাদের অধিকাংশ ঐসব রসূলদের বাণীতে কর্ণপাত করেনি এবং তাদের উপরও বিশ্বাস স্থাপন করেনি; বরং তারা রসূলগণের অধিকাংশকে নানাপ্রকার ক্লেশ দিয়েছে, নতুবা হত্যা করেছে। ফলে তারা কখনও আল্লাহর স্বরূপ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ বা সম্যক অবহিত হয়নি, হবার চেষ্টা করেনি বা হতে পারেনি। এই কারণে খোদা শেষ চেষ্টাস্বরূপ তাদের মাঝে এমন একজন রসূল প্রেরণ করতে চাইলেন, যিনি হবেন খোদায়ী কিছু গুণ বা কর্মের অধিকারী; যেন ইস্রায়েলীরা তার কাছ থেকে খোদার স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক অবহিত হয় এবং আর যেন একেশ্বরবাদ থেকে কখনই বিচ্যূত না হয়। 

কিন্তু ঐ রসূলের আগমন শেষ প্রচেষ্টা স্বরূপ কেন? আর তার খোদায়ী গূণ থাকারই বা দরকার পড়ল কেন? আর্টিকেলের শিরোনাম এবং যিশুর আগমণের কারণ বুঝতে এটা জানা একান্ত জরুরী। আর তাতে আমরা এটাও জানতে পারব কেন যিশু বলেছিলেন-‘আমাকে কেবল ইস্রায়েল বংশের হারান মেষদের কাছেই পাঠান হয়েছে।’

এই খোদায়ী কিছু গুণ সম্পন্ন রসূল ছিলেন মরিয়ম তনয় হযরত ঈসা মসীহ। অার নবী অরামিয়ার কিতাব থেকে আমরা খোদার ঐ শেষ প্রচেষ্টার ইচ্ছে সম্পর্কে জানতে পাই।

‘এই জন্যে দেখ, আমি তাদেরকে জ্ঞাত করব,
একটিবার তাদেরকে আমি আমার হস্ত ও পরাক্রম জ্ঞাত করব,
তাতে তারা জানবে যে, আমিই খোদা।’---------(অরামিয়া ১৬:২১)

যাইহোক যা বলছিলাম, ঈসা মসিহ এসেছিলেন একটি মাত্র বংশের জন্যে, সমগ্র মানব জাতির জন্যে নয়। তবে এখানে আমাদের আলোচনা এ বিষয় নিয়ে নয়, আমাদের আলোচনা বনি ইস্রায়েলে সর্বশেষ রসূল (Last Prophet)-এর আগমন ও কিতাব না অবতীর্ণের কারণ নিয়ে। প্রথমে লক্ষ্য করি কোরআনের ২:১১৪ আয়াতটির দিকে- আল্লাহ বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি সীমালংঘনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য না।’ এখন আমরা দেখি এ বিষয়ে ঈসা মসিহ ইস্রায়েলীদের কি বলেছিলেন-


টাইডাস কর্তৃক জেরুজালেম ধ্বংস করণ।
ঈসা বললেন, ‘আজ একটা গল্প শুনুন। একজন গৃহস্থ একটা আঙ্গুর ক্ষেত করে তার চারিদিকে বেড়া দিলেন। পরে সেই ক্ষেতের মধ্যে আঙ্গুররস করার জন্যে গর্ত খুঁড়লেন এবং একটা উঁচু পাহারা ঘর তৈরী করলেন।এরপরে তিনি কয়েকজন চাষীর কাছে ক্ষেতটি ইজারা দিয়ে বিদেশে চলে গেলেন। যখন ফল পাকবার সময় হয়ে এল, তখন তিনি সেই ফলের ভাগ নিয়ে আসার জন্যে তার গোলামদের একজনকে সেই চাষীদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।চাষীরা সেই গোলামকে পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিল।ক্ষেতের মালিক তখন তার গোলামদের কয়েকজনকে চাষীদের কাছে পাঠালেন।চাষীরা তাদের একজনকে ধরে বন্দী করে রাখল এবং একজনকে হত্যা করে ফেলল।

আঙ্গুর ক্ষেতের মালিক শেষে নিজের পুত্রকেই তাদের কাছে পাঠালেন। তিনি ভাবলেন, তারা অন্ততঃ তার পুত্রকে সম্মান করবে। কিন্তু সেই চাষীরা মালিকের পুত্রকে দেখে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল- ‘এ-ই পরে সম্পত্তির মালিক হবে। চল, আমরা ওকে হত্যা করি, তাতে আমরাই সম্পত্তির মালিক হয়ে যাব।’

--এরপর সকলে একত্রিত হয়ে মালিকের সেই পুত্রকে ধরে আঙ্গুর ক্ষেত থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। তাহলে বলুন দেখি, আঙ্গুর ক্ষেতের মালিক ঐ চাষীদের নিয়ে কি করবেন?’
তারা বলল, ‘তিনি সেই দুষ্টদের একেবারেই ধ্বংস করবেন এবং যে চাষীরা তাকে সময় মত ফলের ভাগ দেবে, তাদের কাছেই সেই ক্ষেতটা ইজারা দেবেন।’

হয়েছেও তাই, আঙ্গুর ক্ষেতটা বনি ইস্রায়েলদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বনি ইসমাইলের নিকট ইজারা দেয়া হয়েছে। আর ৭০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট টাইডাস (Titus) ইস্রায়েলীদের প্রতি কি করেছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি জাতিরূপে ইস্রায়েলীদের অস্তিত্বই তিনি বিনাশ করে দিয়েছিলেন। যাইহোক, আমরা আবার ঈসার বলা গল্পে ফিরি- তখন ঈসা বললেন, ‘আপনারা কি পাক কিতাবের মধ্যে পড়েননি-

‘রাজমিস্ত্রীরা যে প্রস্তরখানা অগ্রাহ্য করেছে,
তা কোনের প্রধান প্রস্তর হয়ে উঠল।
খোদাই এ করলেন, আর তা আমাদের দৃষ্টিতে অদ্ভুত।’---------- (যবুর ১১৮:২২-২৩)


কোণের প্রস্তর
কোন প্রস্তরের কথা ঈসা এখানে উল্লেখ করছেন যা দাউদের উপর নাযিলকৃত যবুরে উল্লেখ করা হয়েছে? সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে- যে সময় ঈসা একথা বলছেন তখন আসলে ঐ প্রস্তর খন্ডটি গৃহকোনে লাগানোই হয়নি। অবহেলিত অবস্থায় তা তখনও গৃহ প্রাঙ্গনে পরিত্যাক্তই ছিল। হ্যাঁ এটা ঐ কৃষ্ণ প্রস্তর (Black Stone), যা হজরে আসওয়াদ (al-Hajar al-Aswad) নামেও সম্যক পরিচিত এবং বর্তমানে Eastern Corner Stone of Ka'ba। মুহম্মদ ৬০৫ খৃষ্টাব্দে ঐ প্রস্তর খন্ডটিকে কাবার পূর্বকোণে স্থাপন করেছিলেন। ঘটনা এই-

৬০৫ খ্রীষ্টাব্দে কুরাইশগণ কা’বা (Ka'ba) গৃহের সংস্কার কাজে হাত দিয়েছিল। কা’বাগৃহটি নিম্নভূমিতে অবস্থিত থাকায় বর্ষার জলস্রোত প্রবল বেগে তার মধ্যে প্রবেশ করত। এতে গৃহটি প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ত। এই সমস্যা দূরীকরণে এর চারিদিকে একটি প্রাচীর নির্মাণ করা হয়, কিন্তু জলস্রোতের প্রবল বেগ তাও বিধস্ত করে ফেলেছিল। এজন্যে কা’বাগৃহকে নূতন করে সংস্কার করার সঙ্কল্প কুরাইশ প্রধানদের মনে স্থানলাভ করেছিল।

এই কাজ চলাকালে সংস্কারে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে হজরে আসওয়াদ যা কা’বাগৃহের প্রাঙ্গনে ছিল, সেটি কা’বাগৃহের মধ্যে স্থাপন করা নিয়ে এমন একটি বিবাদের সূত্রপাত হল, যার ফলে ভয়ানক রক্তপাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। প্রত্যেক পরিবারই এই সম্মানীয় কাজটি সম্পাদন করার কৃতিত্বের দাবীদার হতে চাইল। অবশেষে মুহম্মদের ক্ষিপ্র হস্তক্ষেপের ফলে এই বিবাদের সন্তোষজনক সমাধান ঘটেছিল। তিনি একখানি চাদর বিছিয়ে তার ওপর হজরে আসওয়াদটি রাখলেন এবং প্রত্যেক গোত্রের নির্বাচিত জন চাদরটির প্রান্ত ধরে কা’বা গৃহের এক কোনে নিয়ে গেলেন। অতঃপর মুহম্মদ প্রস্তর খন্ডটিকে গৃহকোণে যথাস্থানে রাখলেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে- আদমের সময় যখন কাবা নির্মিত হয়, তখনও এই প্রস্তর খন্ডটি গাঁথুনির কাজে লাগায়নি ফেরেস্তাগণ। আবার ইব্রাহিম ও ইসমাইল যখন ধ্বংস প্রাপ্ত কাবার পূন: ভিত্তি স্থাপন করেন, তখনও প্রস্তর খন্ডটিকে তারা গাঁথুনির কাজে লাগাননি। রাজমিস্ত্রিদের অবহেলিত ঐ প্রস্তর খন্ডটি আজ কোণের প্রধান প্রস্তর, আশ্চর্য -সত্যিই বড় অদ্ভূত।


কাবার কোণে কৃষ্ণ প্রস্তরের স্থাপন
এই প্রস্তর খন্ডটির এত গুরুত্ব হল কেন? কি এর ইতিহাস? আসলে ইব্রাহিম ও তার বংশধরদের মধ্যে চিরাচরিত পদ্ধতি ছিল যে, প্রান্তরে বা অন্য কোথাও উপাসনা বা উৎসর্গের স্থান মনোনীত হলে সেখানে তারা চিহ্নস্বরূপ একখানা প্রস্তর স্থাপন করত। কা’বা গৃহের ভিত্তি স্থাপনের পর ইব্রাহিম ও ইসমাইল যথানিয়মে সেখানেও একখানা  প্রস্তর রেখেছিলেন। প্রস্তরখানা ঘোর কৃষ্ণবর্ণের হওয়ায় শেষে তা 'হজরে আসওয়াদ' নামে খ্যাত হয়। বংশের আদি পুরুষের স্মৃতিফলক মনেকরে আরবগণ স্বভাবতঃই ঐ কৃষ্ণ প্রস্তরের সমাদর করত। কিন্তু ঘোর পৌত্তলিকতার যুগেও কখনই তার কোন প্রকার পূজা হয়নি। আর তাই বিগ্রহদের আসনের ত্রিসীমানায় তার স্থানও হয়নি। এ কারণে মক্কা বিজয়ের পর যখন দেব-বিগ্রহ গুলিকে কা’বা হতে অপসারণ করা হয় তখন এই প্রস্তর খন্ডকে অপসারণ করা আবশ্যক বলে কেউই মনে করেনি।

অনেকে অবশ্য একথাও বিশ্বাস করে যে, এই প্রস্তর খন্ডটি বেহেস্ত থেকে পতিত হয়েছিল আদম ও হাওয়াকে এ নির্দেশণা দিতে যে, কোথায় কা'বা নির্মাণ করতে হবে। অনেকে আবার একথাও বিশ্বাস করে যে, আদিতে প্রস্তর খন্ডটি ঝকঝকে সাদা ছিল এবং মানুষের ক্রমাগত পাপ গ্রহণের ফলে তা কাল বর্ণ ধারণ করেছে। এখানে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হজ্জের সময় মুসলিমগণ কাবাকে বেষ্টন করে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে সাতবার প্রদক্ষিণ করে এবং এই প্রস্তরে প্রতিবার প্রদক্ষিণ শেষে একবার চুমু দেয়। 

বর্তমানে প্রস্তর খন্ডটির উন্মুক্ত তলটি ২০ সেন্টিমিটার (৭.৯ ইঞ্চি) বাই ১৬ সেন্টিমিটার (৬.৩ ইঞ্চি)। অবশ্য প্রতিনিয়ত এটি এর আকার হারাচ্ছে ভক্তদের ক্রমাগত চুম্বনের ফলে। যাইহোক, এখন আমরা আবার ঈসার গল্পে ফিরে যাই-


কৃষ্ণ প্রস্তর
ইহুদি ও সমবেত আলেমদেরকে ঈসা বললেন, 'এ জন্যে আপনাদের বলছি, বেহেস্তী রাজ্যের সু-সংবাদ আপনাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং এমন লোকদের দেয়া হবে, যাদের জীবনে সেই রাজ্যের উপযুক্ত ফল দেখা যাবে। যে সেই প্রস্তরের উপর পড়বে, সে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং সেই প্রস্তর যার উপর পড়বে সে চুরমার হয়ে যাবে।’- ম্যাথূ ২১:৪৩-৪৪

কি হয়েছিল পরবর্তীতে? মুহম্মদ ও মুসলমানদের উপর যারাই অস্ত্রধারণ করেছিল তারাই টুকরো টুকরো হয়েছে, আবার যাদের উপর মুহম্মদ ও মুসলিমগণ অস্ত্র তুলেছিলেন তারাও ধ্বংস হয়েছে।

সব শেষে আমরা দেখি হাদিসে কি রয়েছে- Muhammad said, "My similitude in comparison with the prophets before me is that of a man who has built a house nicely and beautifully, except for a place of one brick in a corner. The people go about it and wonder at its beauty, but say: 'Would that this brick be put in its place!' So I am that brick, and I am the seal of the prophets" (fa’anā ’l-labinah, wa anā khātamu ’n-nabīyīn).-Narrated by Abu Hurayrah in Sahih al-Bukhari. Kitab al-Manaqib. Hadith 44;al-Bukhari #3293 Sahih Muslim, Kitab al-Fada'il, Hadith 24; Muslim, #4246; Musnad Ahmad ibn Hanbal, #8959; an-Nasa'i, Sunan al-Kubra, #10907; Sahih Ibn Hibban, #654

সমাপ্ত।

ছবি: Wikipedia.

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...