যাদের ইসলাম সম্পর্কে ভাল ধারণা নেই তারা কোরআনের কোন আয়াত নাযিল এবং পরবর্তীতে তা বাতিলের কারণ বুঝতে পারেন না। তাই তারা প্রশ্ন করেন- 'আয়াতটি নাযিলেরইবা কারণ কি ছিল, যদি তা বাতিল করতে হবে? তবে কি তিনি ভুল করে নাযিল করে ফেলেছিলেন, আর পরে তা সংশোধন করেছেন?' অনেকে তো কৌতুক ও কটাক্ষ করেন, প্রমান হিসেবে দেন নবীজীকে বলা বিবি আয়েশার সেই ঐতিহাসিক রসাত্মক সংলাপ-"Your God indeed rushes in coming to your aid!"- এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখ্যা আমরা পরবর্তীতে কোন আর্টিকেলে দেব।
জীবন পুস্তক! |
কোন এক শবে-কদরের রাত্রিতে পূর্ণ কোরআন আল্লাহর নির্দেশে ফেরেস্তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা লওহে মাহফুজের ঐ খোদায়ী কিতাব থেকে তুলে নিয়ে মহাবিশ্বের আকাশে ছড়িয়ে দেয়া হয় নবীজীর নব্যূয়তের পূর্বেই। এভাবে পূর্ণ কোরআন অদৃশ্যলোক থেকে দৃশ্যলোকে আগমন করে এবং তা সংরক্ষণ ও পাহারার কাজে ফেরেস্তাদের নিযুক্ত করা হয়। কারণ জিব্রাইল বা অন্যান্য ফেরেস্তা যারা দুনিয়ার কাজে নিয়োজিত তাদের অদৃশ্যলোকে যাবার ক্ষমতা নেই। ৪ঠা আসমানের সিদরাতুল মুনতাহাই এইসকল ফেরেস্তাদের যাতায়াতের শেষ সীমানা।সিদরা অর্থ বরই, মুনতাহা অর্থ শেষসীমানা। সেখানে একটি বরই কূলগাছ আছে যার পাতাতে ফেরেস্তারা স্বর্ণ বর্ণের ফড়িং-এর মত করে থাকে। দৃশ্যলোকের এই শেষ সীমানাই অদৃশ্যলোকের শুরু, যার প্রথমেই রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া।
Ein Sof and angelic hierarchies. |
উপরের তথ্য সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- নিশ্চয় আমি এই কোরআন অবতীর্ণ করেছি লায়লাতুল কদরে। লায়লাতুল কদর সম্পর্কে তুমি কি জান? লায়লাতুল কদর হল হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেস্তারা স্বীয় পালনকর্তার নির্দেশে অবতীর্ণ হয়। শান্তিই শান্তি, যা ফজরোদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (৯৭:১-৫)
নিশ্চয় এটা সম্মানিত কোরআন, যা আছে এক গোপন কিতাবে।(৫৬:৭৭-৭৮) এটা লিখিত আছে সম্মানিত, উচ্চ পবিত্র পত্রসমূহে, লিপিকারের হস্তে, যারা মহৎ পূত চরিত্র।(৮০:১৩-১৬) নিশ্চয় এ কোরআন আমার কাছে সমুন্নত অটল রয়েছে লওহে মাহফুজে।(৪৩:৪) আমি সত্যসহ এ কোরআন নাযিল করেছি এবং সত্যসহ এটা নাযিল হয়েছে।-(১৭:১০৫)
কোরআনের একটি পাতা। |
শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্তমিত হয়, তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয় এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। কোরআন তো ওহি, যা তার (মুহম্মদ) প্রতি প্রত্যাদেশ হয় তা শিক্ষা দান করে শক্তিশালী (জিব্রাইল)।
সহজাত জিব্রাইল, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল উর্দ্ধ দিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হল, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দু’ধনুকের ব্যবধান রইল। অথবা তা অপেক্ষাও নিকটতর হল। তখন আল্লাহ তার দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন, যা সে দেখেছে, তার অন্তকরণ তা অস্বীকার করেনি। সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে?
নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী সিদরা বৃক্ষের কাছে, যার নিকটবর্তীতে জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত। যখন বৃক্ষটি, যার দ্বারা শোভিত হবার, তার দ্বারা মন্ডিত ছিল। তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যূতও হয়নি সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শণাবলী দেখেছিল।’-(৫৩:১-১৮)
সহজাত জিব্রাইল, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল উর্দ্ধ দিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হল, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দু’ধনুকের ব্যবধান রইল। অথবা তা অপেক্ষাও নিকটতর হল। তখন আল্লাহ তার দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন, যা সে দেখেছে, তার অন্তকরণ তা অস্বীকার করেনি। সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে?
নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী সিদরা বৃক্ষের কাছে, যার নিকটবর্তীতে জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত। যখন বৃক্ষটি, যার দ্বারা শোভিত হবার, তার দ্বারা মন্ডিত ছিল। তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যূতও হয়নি সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শণাবলী দেখেছিল।’-(৫৩:১-১৮)
আর সংরক্ষণ ও পাহারার কারণ হল- নবীজীর নব্যুয়ত লাভের পূর্বে জ্বিণ জাতি উর্দ্ধাকাশে ফেরেস্তাদের আলোচনা শুনে সেগুলি তাদের মত করে অতীন্দ্রবাদীদের কাছে পৌঁছিয়ে দিত। তাই কোরআন নাযিল হবার পর, ওহীর হেফাজতের জন্যে জ্বিণ জাতিকে আকাশের সংবাদ সংগ্রহ থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়। কোন জ্বিণ সংবাদ শ্রবণের মানসে উর্দ্ধাকাশে গেলে, তাকে উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করা হতে লাগল। যাইহোক নবীজীর নব্যূয়তের পর যখন যেমন প্রয়োজন তা জিব্রাইল তার কাছে নিয়ে আসত। এখানে আয়াত পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের কাজে নবী মুহম্মদ, জিব্রাইল বা আল্লাহর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আয়াতটি এসেছে ঘটনার মাধ্যমে, বাতিল হয়েছে মানুষের অসুবিধা দূর করতে-সবই পূর্ব নির্ধারিত।
কোরআন জানায়- নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজীর দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং তাকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান থেকে। ওরা উর্দ্ধ জগতের কোন কিছু শ্রবণ করতে পারে না এবং চারদিক থেকে তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয়, ওদেরকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে। ওদের জন্যে রয়েছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ ছোঁ মেরে কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তার পশ্চাৎধাবন করে।-(৩৬:৬-১০)
আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছি, অতঃপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডকে ওঁৎ পেতে থাকতে দেখে।-(৭২:৮-৯)
এই কোরআন শয়তানরা অবতীর্ণ করেনি। তারা এ কাজের উপযুক্ত নয় এবং তারা এর সামর্থ্যও রাখে না। তাদেরকে তো শ্রবণের জায়গা থেকেও দূরে রাখা হয়েছে।- -(২৬:২১০-২১২)
এখন আমরা কোন আয়াত নাযিল ও পরপরই তা বাতিল করার উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করব একটি সাধারণ ঘটনার মাধ্যমে।
সাধারণ মজলিসসমূহে উপস্থিত লোকজন নবীজীর বাণী শুনে উপকৃত হত। এ সুবাদে কিছু লোকজন তার সাথে আলাদাভাবে গোপন কথাবার্তা বলতে চাইলে তিনি সময় দিতেন। এই সুযোগ নিয়ে কিছু মুনাফেক নবীজীর কাছে একান্তে অহেতুক কথাবার্তায় দীর্ঘসময় অতিবাহিত করত। তার এই বোঝা হালকা করতে এই আয়াত নাযিল হল- মুমিনরা, তোমরা রসূলের কাছে কান কথা বলতে চাইলে তৎপূর্বে সদকা প্রদান করবে। এটা তোমাদের জন্যে শ্রেয়ঃ ও পবিত্র হওয়ার ভাল উপায়। যদি তাতে সক্ষম না হও, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।-(৫৮:১২)
এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর কেবল আলীই আদেশটি বাস্তবায়িত করেন। তিনি এক দিনার সদকা প্রদান করে নবীজীর কাছ থেকে একান্তে কথা বলার সময় নেন।
উপরের ঐ আয়াতের দরুণ সাহাবীদের অনেকেই অসুবিধার সম্মুখীণ হন, কারণ তাদের অধিকাংশই ছিলেন হত-দরিদ্র। ফলে আলীর পর আর কেউই আদেশটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এই আয়াত দ্বারা পূর্বেকার আদেশটি রহিত করে দেয়া হয়- তোমরা কি কান কথা বলার পূর্বে সদকা প্রদান করতে ভীত হয়ে গেলে? অতঃপর তোমরা যখন সদকা দিতে পারলে না এবং আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিলেন, তখন তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর। আল্লাহ খবর রাখেন যা তোমরা কর।-(৫৮:১৩)
আদেশটি রহিত হল বটে কিন্তু তার উদ্দেশ্য ঠিকই অর্জিত হল। মুসলমানরা আন্তরিক মহব্বতের তাগিদেই মজলিস দীর্ঘায়িত করা থেকে বিরত হলেন এবং মুনাফেকরা যখন দেখল যে, সাধারণ মুসলমানদের কর্মপন্থার বিপরীতে এরূপ করলে তারা চিহ্নিত হয়ে যাবে এবং মুনাফেকী ধরা পড়ার সম্ভাবণা, তখন তারাও এ থেকে বিরত হয়ে গেল।
কোরআনের কোন আয়াত নাযিল ও পরবর্তীতে তা বাতিলের কারণে অনেকে কোরআনকে ঐশী গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করত না। আর তারা নবীজীকে প্রতারক বলেই ভাবত। এ বিষয়ে কোরআন জানায়-
And when We exchange a verse in the place of another verse - and God knows very well what he is sending down - they say (to Muhammad), "Thou art a mere forger!" -(16:101)
কোরআনের কোন আয়াত বাতিল হয়ে তার পরিবর্তে অন্য আয়াত নাযিল হলেও বাতিল হওয়া আয়াতের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ কোরআন যেমন ধর্মগ্রন্থ তেমনি ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণীও বটে। আর তাই রসূলুল্লাহ সূরা সমূহ থেকে বাতিল হওয়া আয়াতগুলো কখনও বাদ দেননি। আর এটা সত্য হলে বুখারীর এই হাদিসগুলির আর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না-
Narrated al-Bara: There was revealed: 'Not equal are those believers who sit (at home) and those who strive and fight in the Cause of Allah.' (4.95)
The Prophet said, "Call Zaid for me and let him bring the board, the inkpot and the scapula bone (or the scapula bone and the ink pot)."
Then he said, "Write: 'Not equal are those Believers who sit..", and at that time 'Amr bin Um Maktum, the blind man was sitting behind the Prophet . He said, "O Allah's Apostle! What is your order For me (as regards the above Verse) as I am a blind man?"
So, instead of the above Verse, the following Verse was revealed:'Not equal are those believers who sit (at home) except those who are disabled (by injury or are blind or lame etc.) and those who strive and fight in the cause of Allah.' (4.95) -Bukhari, V6, 61:512.
Narrated Sahl bin Saud: When the following verses were revealed: "Eat and drink until the white thread appears to you, distinct from the black thread" (2:187) and "of dawn" was not revealed, some people who intended to fast, tied black and white threads to their legs and went on eating till they differentiated between the two. Allah then revealed the words, "of dawn", and it became clear that meant night and day.-Bukhari, V3, 31:141. ...ইত্যাদি।
বুখারীর এই হাদিসগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যারা কোরআন নবী মুহম্মদের রচিত বলে বিশ্বাস করেন, তারা প্রমান হিসেবে এই হাদিসগুলির উদাহরণ টানেন।
সমাপ্ত।
ছবি: Freethoughtblogs.