২৩ ডিসেম্বর, ২০১২

Council of Nicea: নিকাইয়ার সম্মেলন ও সম্রাট কনষ্টানটাইন।

রোমান সম্রাট কনষ্টানটাইন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ক্রিসপাসের (Crispus) প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন। তরুণ রাজকুমার তার সুন্দর ব্যবহার, চমৎকার আচরণ এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাহসিকতার জন্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সম্রাট তার নিজের অবস্থান যাতে বিপন্ন না হয়, সে জন্যে ক্রিসপাসকে গুপ্তহত্যা করেন। ক্রিসপাসের মৃত্যুতে সমগ্র সাম্রাজ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। 

স্টাচু অব সম্রাট কনষ্টানটাইন।
এই হত্যাকান্ডের জন্যে অভিযুক্ত করা হয় ক্রিসপাসের সৎ মাতাকে। সম্রাটের ২য় স্ত্রী, ঐ রানী ফাউস্টা (Fausta) নিজের পুত্রের সিংহাসনে আরোহণের পথ নিষ্কণ্টক করার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। এ কারণে ক্রিসপাসকে সরিয়ে দেবার অভিপ্রায় তার ছিল। যাইহোক, সম্রাট কনষ্টানটাইন ক্রিসপাসের হত্যার অভিযোগে এই রানীকে বন্দী করলেন এবং ফুটন্ত পানি ভর্তি চৌবাচ্চার মধ্যে নিক্ষেপ করে তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। 

কিন্তু এই হত্যাকান্ডের ফল সম্রাটের প্রত্যাশার বিপরীত হল। নিহত নিরাপরাধ রানীর সমর্থকরা, ক্রিসপাসের সমর্থকদের সাথে মিলিত হয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। অন্যদিকে কনষ্টানটাইন নিজেও আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন।আর তাই উপায়ন্তর না দেখে তিনি জুপিটারের মন্দিরের পুরোহিতদের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ঐ পুরোহিতরা তাকে জানাল যে, এমন কোন উৎসর্গ বা প্রার্থনা নেই যা তাকে এ দু’টি হত্যার দায় থেকে মুক্ত করতে পারে। এমতাবস্থায় কনষ্টানটাইন রোমে অবস্থানে স্বস্তি বোধ না করায় বাইজানটিয়াম চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

বাইজানটিয়ামে এসে কনষ্টানটাইন তার নামে শহরটির নামকরণ করেন। তখন থেকেই শহরটি কনষ্টান্টিনোপল (Constantinople) হিসেবে পরিচিত হয়। এখানে তিনি পলীয় চার্চের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত সমর্থন লাভ করেন। ঐ চার্চ তাকে জানায় যে, তিনি যদি তাদের চার্চে প্রায়শ্চিত্ত করেন তবে তার পাপমুক্তি ঘটবে। কনষ্টানটাইন এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। শুধু দু’টি হত্যার রক্তে তার হাত যে রঞ্জিত ছিল তাই নয়, সাম্রাজ্য শাসনের বিভিন্ন সমস্যায়ও তিনি হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। এ ভাবে অপরাধ স্বীকারের মাধ্যমে বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি লাভ এবং দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেয়ে তিনি সাম্রাজ্যের দিকে মনোনিবেশ করলেন। 

কনষ্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) বর্তমানে।
এদিকে পাপমুক্ত হবার পর সম্রাট নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে চার্চকে ব্যবহারের এক অপার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। তিনি চার্চকে জানালেন যে, চার্চ যদি তাকে সমর্থন করে যায়, তবে তিনিও চার্চকে পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যাবেন। সম্রাটের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত এ সমর্থন লাভ করে পলীয় চার্চ রাতারাতি শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠল। অন্যদিকে কনষ্টানটাইনও চার্চকে তার কাজে পূর্ণ ব্যবহার করলেন। ভূ-মধ্যসাগরের চারপাশের দেশগুলোতে অসংখ্য খৃষ্টান চার্চ ছিল যেগুলিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সম্রাট তার পথের কাঁটাগুলিকে তুলে ফেলতে লাগলেন। বহু পুরোহিতই তার গোয়েন্দা বৃত্তির কাজে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে তার অধীনে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় এ সাহায্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অংশত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে এবং অংশত জুপিটারের মন্দিরের যে রোমান পুরোহিতরা তাকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তাদের ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করতে তিনি রোমে একটি পলীয় চার্চ প্রতিষ্ঠার জন্যে খৃষ্টানদেরকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন। 

যাইহোক, কনষ্টানটাইন যখন পলীয় চার্চের সাথে জোটবদ্ধ হলেন, তখন এক ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হল। কেননা তিনি রোমান দেবতাদের পূজারি এবং পৌত্তলিক রাষ্ট্রের ধর্মীয় প্রধান হওয়া সত্ত্বেও সরাসরি পলীয় চার্চকে সমর্থন যুগিয়ে চলছিলেন। সম্রাটের ঐ আনুকূল্য খৃষ্টধর্মকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল এবং কার্যত: তা রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেকের জন্যেই খৃষ্টধর্ম আকস্মিকভাবে যুগপৎ নীতি ও সুবিধা লাভের বিষয় হয়ে উঠল। এতে পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসে যারা দৃঢ় ছিল না, তারা এখন দ্রুত পলীয় চার্চের অনুগত অনুসারীতে পরিণত হল। তবে বহু লোকই অন্তর থেকে নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিল। যেভাবে যাই হোক না কেন, মোটকথা ঐসময় খৃষ্টধর্মে এক গণজোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছিল।

পলীয় চার্চের এই আকষ্মিক উত্থানে আঁরিয়ানবাদী চার্চের সাথে তাদের বিভেদ প্রকট হয়ে দেখা দিল। এসময় সম্রাট কনষ্টানটাইন, একটি ঐক্যবদ্ধ চার্চের রাজনৈতিক সুবিধা উপলব্ধি করেন। সুতরাং তিনি জেরুজালেমকে বাদ দিয়ে খৃষ্টধর্মকে রোম কেন্দ্রিক করতে চাইলেন। কিন্তু আঁরিয়ানবাদী চার্চ তার ইচ্ছা পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে দিল। কারণ তারা এ ঘটনাকে একজন বিদেশি শাসকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে খৃষ্টধর্ম বিরোধী একটি পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করল। 

বিশপ ডোনাটাস।
প্রথম বিদ্রোহের ঘটনাটি ঘটে উত্তর আফ্রিকায় বারবার সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। আর এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ডোনাটাস (Donatus) নামক এক বিশপ, যিনি ৩১৩ খৃষ্টাব্দে বিশপ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে চার্চের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এতে রোমের পলীয় চার্চের বিশপ, ডোনাটাসের স্থলে কার্থেজে কেসিলিয়ান (Cacealian) নামক একজনকে বিশপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যে উভয়পক্ষ সম্রাট কনস্টানটাইনের শরণাপন্ন হলেন। সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতা লাভের এ প্রয়াস খৃষ্টধর্মের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে দিল। 

কনষ্টানটাইন কেসিলিয়ানের পক্ষ সমর্থন করলেন। এতে কার্থেজের অধিবাসীরা রোমান উপ-কন্সালের অফিসের সামনে জড় হল এবং কেসিলিয়ানের নিন্দা করল। কনষ্টানটাইন তাদের এ আচরণে বিরক্ত হলেন। তা সত্ত্বেও তিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার জন্যে রোমের বিশপের নেতৃত্বে একটি ট্রাইবুনাল গঠন করলেন।ডোনাটাস সেখানে হাজির হননি এবং তার পক্ষে যুক্তি-তর্ক পেশ করারও কেউ সেখানে ছিল না। তার অনুপস্থিতিতেই তার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হল। 

আফ্রিকায় আঁরিয়ানবাদী চার্চ রোমান বিশপের প্রদত্ত একতরফা রায় প্রত্যাখ্যান করে। এ ঘটনায় কনষ্টানটাইনের বিরুদ্ধে এ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হল যে, “ঈশ্বরের মন্ত্রীগণ ফালতু মামলাবাজদের মত নিজেদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত ছিলেন” হতাশ হওয়া সত্ত্বেও কনষ্টানটাইন আরলেসে নতুন করে একটি ট্রাইবুনাল স্থাপন করলেন। উভয় পক্ষের শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে তাদেরকে পৃথক পৃথক পথে আরলেসে আসার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ডোনাটাসের সমর্থকরা পুনরায় পরাজিত হল। এ ট্রাইবুনালের রায়ে বলা হয়েছিল: “বিশপগণ নিজেদের বিপজ্জনক লোকদের সাথেই দেখতে পেয়েছেন, যাদের দেশের কর্তৃপক্ষ বা ঐতিহ্যের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই। একমাত্র শাস্তিই তাদের প্রাপ্য।”

পূর্বের রায় পরের রায়ের থেকে কোনভাবেই পৃথক ছিল না। ফলে উত্তর আফ্রিকার খৃষ্টানদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হল না। তারা শুধুমাত্র রোমের পলীয় চার্চের বিশপের রায় বলবৎ করার জন্যে রোমান সাম্রাজ্যের রাজকর্মচারীদের রাতারাতি ঈশ্বরের সেবক বনে যাওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। সুতরাং বিশপ ডোনাটাস তাদের জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হলেন। 

সম্রাট কনষ্টানটাইন দুই চার্চের কাছে লেখা এক পত্রে তাদের মধ্যকার বিরোধ ভুলে যেতে এবং তার সমর্থিত চার্চের অধীনে উভয় পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি তার পত্রে লিখেছিলেন- ’আমার পক্ষে আরো যা করা যেতে পারে তা হল সকল ভ্রান্তি দূর করে এবং হঠকারী মতামত ধ্বংস করে দিয়ে সকল লোককে সত্য ধর্ম ও সরল জীবনের পথ অনুসরণ এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রাপ্য উপাসনা করার আহ্বান জানানো।’
কেউ এ পত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।

৩১৫ খৃষ্টাব্দে ইতালির উত্তরে ফ্রাংকরা হামলা শুরু করলে তা দমনের জন্যে সম্রাট রোমে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আফ্রিকায় প্রেরণের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশন সেখানে পৌছলে তাকে বর্জন করা হয়। ফলে কোন সাফল্য অর্জন ছাড়াই কমিশনের সদস্যরা রোমে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই অপ্রীতিকর সংবাদ কনষ্টানটাইনের কাছে পৌঁছিলে, তিনি স্বয়ং উত্তর আফ্রিকা গমন এবং সঠিক কিভাবে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ফরমান জারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 
কনষ্টানটাইন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও আফ্রিকা সফরে যাননি। কারণ, ডোনাটাসপন্থীরা এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে সম্রাটকে ডোনাটাস ও কেসেলিয়নের মধ্যকার বিরোধে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেয়া হয়। কেননা, যদি তার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হয়, তবে তা হবে তার মর্যাদার প্রতি এক বিরাট আঘাত। সুতরাং সম্রাট এসময় কেবল ডোনাটাসের নিন্দা করে একটি ফরমান জারি করলেন। ঐ ফরমানে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের যথোচিত পন্থায় প্রার্থনার সুযোগ সুবিধার বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। যখন তা উপেক্ষিত হল, তখন অত্যন্ত কঠোর এক আইন জারি করে আফ্রিকায় প্রেরিত হল। এতে ডোনাটাসের অনুসারীদের সকল চার্চ বাজেয়াপ্ত এবং তাদের সকল নেতাকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এসময় কেসেলিয়ান প্রথমে ডোনাটাসপন্থী চার্চদের নেতাদের উৎকোচ দিয়ে হাত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। ডোনাটাসপন্থীরা রাজকীয় ফরমান অগ্রাহ্য ও উৎকোচ উপেক্ষা করে। আর তারা অর্থ উৎকোচের প্রস্তাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে ফাঁস করে দেয়। ফলে কেসেলিয়ান “কসাই এর চাইতেও নির্মম এবং একজন স্বৈরাচারীর চাইতেও নিষ্ঠুর” হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। 

ইতিমধ্যে রোমের পলীয় চার্চ ‘ক্যাথলিক’ বিশেষণ গ্রহণ করেছিল। ঈশ্বরের উপাসনায় তাদের ধর্মমতকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যেই তারা এ নামটি গ্রহণ করে। যাহোক, এখন এই ক্যাথলিক চার্চ ডোনাটাসপন্থীদের কাছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আবেদন জানাল। এ আবেদনের কোন সাড়া মেলেনি এবং ডোনাটাস কেসেলিয়ানের কাছে তার চার্চগুলো হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান। শেষ পর্যন্ত রোমান সেনাবাহিনী মাঠে নামে। পাইকারিভাবে লোকজনকে হত্যা করা হয়। আর বিশপদের হত্যা করা হয় চার্চের অভ্যন্তরে। কিন্তু ঐ হত্যাযজ্ঞ থেকে ডোনাটাস রক্ষা পান এবং অনমনীয় থাকেন। 

কনষ্টানটাইন, যিনি একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, বল প্রয়োগে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্য পুনরুদ্ধারে তার ব্যর্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। বিচক্ষণতা বীরত্বের অঙ্গ এ বিবেচনায় তিনি উত্তর আফ্রিকার জনসাধারণকে তাদের নিজেদের উপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং আফ্রিকা থেকে তার মনোযোগ সরিয়ে এনে সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানের দিকে নিবদ্ধ করেন। ফলে ডোনাটাসপন্থীদের উপর নিপীড়নের মাত্রা হ্রাস পায় এবং তাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তারা এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, সম্রাট যখন ৩৩০ খৃষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় ক্যাথলিকদের জন্যে একটি চার্চ নির্মাণ করেন, তখন ডোনাটাসপন্থীরা তা দখল করে নেয়। আর তারা এ অভিমত ব্যক্ত করে, “ক্যাথলিকদের যাজকগণ অসৎ ব্যক্তি। তারা ইহলোকের রাজন্যবর্গের সাথে কাজ করে। রাজ-অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল হয়ে তারা যীশুর অবমাননা করে যাচ্ছে।”

সম্রাট এ ঘটনায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু আরেকটি চার্চ নির্মাণের জন্যে ক্যাথলিকদের পর্যাপ্ত অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা ছাড়া তার আর কিছু করার ছিল না। ডোনাটাসপন্থীদের আন্দোলন রোম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। রোমে তাদেরও একজন বিশপ ছিলেন, তবে পদমর্যাদার দিক থেকে তাকে কার্থেজ (Carthage) ও নিকোমেডিয়ার (Nicomedia) বিশপের চেয়ে একধাপ নীচে বলে গণ্য করা হত।

এদিকে ডোনাটাসের আন্দোলনের পাশাপাশি একই সময়ে অথচ সম্পূর্ণ স্বাধীন আর এক আন্দোলন দক্ষিণ মিসরে চলছিল। কনষ্টানটাইন যখন ৩২৪ খৃষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার জট খোলার জন্যে আরেকবার উদ্যোগ গ্রহণ করছিলেন, তখনি তার দৃষ্টি মিশরের উপর পতিত হয়। মিশর তখন বিদ্রোহ, গোলযোগ ও অরাজকতায় আকীর্ণ ছিল। ডায়োক্লোশিয়ানের নেতৃত্বে খৃষ্টানদের প্রতি নিপীড়ন যখন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন অনেকেই তা পরিহারের জন্যে তার সাথে সমঝোতা করেছিল। মেলেটিয়াস (Meletius) নামক একজন যাজক এ সময় বলেন যে, যেসব যাজকেরা প্রকাশ্যে খৃষ্টধর্মের নিন্দা করেছে তাদের যাজকবৃত্তির কাজ পুনরায় শুরু করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া উচিত। তিনি আরো বলেন যে, প্রায়শ্চিত্তের পর্যাপ্ত প্রমাণ না প্রদর্শন করা পর্যন্ত সকল বিশুদ্ধ প্রার্থনা সমাবেশে তাদের যোগদান বন্ধ করতে হবে। এ সময় আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান যাজক পিটার আরো নমনীয় পন্থার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে অধিকাংশ লোকই মেলেটিয়াসকে সমর্থন করে। অত:পর আলেকজান্ডার যখন যাজকদের প্রধান হলেন, তিনি মেলেটিয়াসকে মাইনেস-এ (Mines) নির্বাসিত করলেন। 

মেলেটিয়াসকে নির্বাসন থেকে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হল।তিনি ফিরে এলে বহু অনুসারী তার চারপাশে সমবেত হয়। তিনি বিশপ, যাজক ও উচ্চপদের যাজকদের নিয়োগ দান এবং বহু গির্জা নির্মাণ করেছিলেন। তার অনেক অনুসারীরা তাদের নিপীড়নকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে জীবন উৎসর্গ করেছিল। তাই মেলেটিয়াস তার চার্চকে “শহীদদের চার্চ” (Church of the Martyrs) নামে আখ্যায়িত করেছিলেন।বিশপ আলেকজান্ডারের অনুসারীরা এর বিরোধী ছিল। কারণ তারা নিজেদেরকে ক্যাথলিক নামে আখ্যায়িত ও পলের প্রচারিত খৃষ্টধর্মের অনুসরণ করত। 

মেলেটিয়াসের মৃত্যুর পর বিশপ আলেকজান্ডার তার অনুসারীদের প্রার্থনা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন। এ আদেশের বিরোধিতা করে তারা সম্রাট কনষ্টানটাইনের কাছে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। সেখানে নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াসের সাহায্য লাভ করে তারা সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ করে। সম্রাটের দরবারে তাদের উপস্থিতির ঘটনা নিকাইয়ার কাউন্সিল আহ্বানের অন্যতম কারণ ছিল। ইউসেবিয়াস আঁরিয়াসের বন্ধু ছিলেন। এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে আঁরিয়ান ও মেলেটিয়ান আন্দোলনের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। 
 বিশপ আঁরিয়াস।
আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ পিটার আঁরিয়াসকে একজন উচ্চ পদমর্যাদার যাজক হিসেবে নিয়োগ করেন, কিন্তু পরে তাকে তিনি বহিষ্কার করেন। পিটারের উত্তরসূরি আকিলাস (Achillas) পুনরায় তাকে যাজক নিয়োগ করেন। আঁরিয়াস এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে যখন আকিলাসের মৃত্যু ঘটে তখন তিনি তার স্থান দখলের সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্বেও তাতে আগ্রহী হননি। ফলে যাজকদের সর্বোচ্চ পদটিতে আলেকজান্ডার সহজেই অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ৩২১ খৃষ্টাব্দ নাগাদ আঁরিয়াস হয়ে উঠেছিলেন একজন জনপ্রিয় বিদ্রোহী যাজক, বিপুল রকম আত্মবিশ্বাসী এবং নিজের বিশ্বাসের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন। 

এ পর্যায় পর্যন্ত খৃষ্টানদের ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিরাট স্বাধীনতা ছিল। যারা নিজেদের খৃষ্টান বলে আখ্যায়িত করত তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক ত্রিত্ববাদকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কি, সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত ছিল না। কিছু লোক অন্ধভাবে এর সমর্থন করত। অন্যদিকে ডোনাটাস ও মেলেটিয়াসের মত কিছু লোক তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর এ দুয়ের মধ্যে যারা অবস্থান করছিল, তারা নিজেরা যে ভাবে ভাল মনে করত, ত্রিত্ববাদের সেভাবে ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা তাদের ছিল। দু'শতাব্দী ধরে আলোচনার পরও কেউই এ ধর্মমতকে সন্দেহমুক্ত ভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়নি। আঁরিয়াস ত্রিত্ববাদের সংজ্ঞা প্রদানের জন্যে চ্যালেঞ্জ জানালেন। আলেকজান্ডার তখন সম্পূর্ণ পশ্চাদপসরন করলেন। তিনি যতই এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ততই তিনি বিভ্রান্তির শিকার হলেন। আঁরিয়াস যুক্তি দিয়ে এবং পবিত্র গ্রন্থের প্রামাণিকতার উপর নির্ভর করে ত্রিত্ববাদকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করলেন।

এরপর আঁরিয়াস যীশু সম্পর্কে বিশপ আলেকজান্ডারের দেয়া ব্যাখ্যা খণ্ডন করেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, যীশু যদি প্রকৃতই ‘ঈশ্বরের পুত্র’ হয়ে থাকেন তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে পুত্রের পূর্বে পিতার অস্তিত্ব ছিল। অতএব এমন একটি সময় অবশ্যই ছিল যখন সন্তানের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং এর অর্থ এটাই হয় যে পুত্র ছিল কোন সত্তা বা প্রাণ দ্বারা গঠিত সৃষ্টি যা সব সময়ই অস্তিত্বশীল ছিল না। যেহেতু ঈশ্বর অনাদি ও চিরস্থায়ী সত্তা, সে কারণে যীশু ঈশ্বরের মত একই সত্তা হতে পারেন না। 

বিতর্কে এই ব্যক্তিগত বিপর্যয় ঘটার পর আলেকজান্ডার আঁরিয়াসের ধর্মমতের ব্যাপারে রায় ঘোষণার জন্যে এক প্রাদেশিক সভা আহ্বান করেন। প্রায় ১শ’ মিশরীয় ও লিবীয় বিশপ এতে যোগদান করেন। আঁরিয়াস অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তার অবস্থানের কথা ব্যাখ্যা করেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন: এমন এক সময় ছিল যখন যীশু অস্তিত্বশীল ছিলেন না, অথচ ঈশ্বর তখনও বিরাজিত ছিলেন। যেহেতু যীশু ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট সেকারণে তার সত্তা সীমাবদ্ধ, সুতরাং তিনি চিরন্তন হতে পারেন না। একমাত্র ঈশ্বরই চিরন্তন। যেহেতু যীশু সৃষ্ট প্রাণী, সে কারণে তিনিও অন্যান্য সকল যুক্তিবাদী প্রাণীর মতই পরিবর্তনশীল। একমাত্র ঈশ্বরই অপরিবর্তনীয়। এভাবে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, যীশু ঈশ্বর ছিলেন না। অবিরাম যুক্তি সহকারে তার বক্তব্য পেশের পাশাপাশি তিনি বাইবেল থেকে অজস্র শ্লোক উদ্ধৃতি করতেন যেগুলোর কোথাও ত্রিত্ববাদের ব্যাপারে কোন উল্লেখই ছিল না। তিনি বলেন, যদি যীশু বলে থাকেন ‘আমার পিতা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ তাহলে ঈশ্বর ও যীশু সমকক্ষ এ কথায় বিশ্বাস করার অর্থ বাইবেলের সত্যকে অস্বীকার করা। 

আঁরিয়াসের যুক্তিসমূহ অখণ্ডনীয় ছিল। তদুপরি তার বিরুদ্ধে ধর্মমতের বিরোধিতার অভিযোগ আনা হল। আর বিশপ আলেকজান্ডার তার অবস্থানের সুবাদে তাকে যাজক পদ থেকে বহিস্কার ও তাকে নির্বাসনে প্রেরণ করলেন। 

তবে আঁরিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা এত বিপুল ছিল যে পলীয় চার্চ তাকে উপেক্ষা করতে পারেনি। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের অনেক বিশপই আলেকজান্ডারের জারি করা আদেশ মেনে নেয়নি। যে বিতর্ক ৩শ’ বছর ধরে টগবগ করে ফুটছিল তা এবার বিস্ফোরিত হল। পূর্বাঞ্চলের এত বেশি সংখ্যক বিশপ আঁরিয়াসকে সমর্থন করলেন যে আলেকজান্ডার রীতিমত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েন। এ সব বিশপের প্রধান মিত্র ছিলেন নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস। তিনি ও আঁরিয়াস ছিলেন বন্ধু ও লুসিয়ানের ছাত্র যিনি তার পবিত্রতা ও জ্ঞানের জন্য সার্বজনীন মর্যাদার পাত্র ছিলেন। সম্ভবত: ৩১২ খৃষ্টাব্দে লুসিয়ানের হত্যার ঘটনা তাদের বন্ধুত্বকে আরো শক্তিশালী ও অভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসে আরো দৃঢ় প্রত্যয়ী করেছিল। 

আলেকজান্ডার কর্তৃক নির্বাসিত হওয়ার পর আঁরিয়াস কনষ্টান্টিনোপলে ইউসেবিয়াসের কাছে একটি পত্র লেখেন। ইউসেবিয়াসের ব্যাপক প্রভাব ছিল। আর শুধু জনসাধারণের উপরই নয়, খোদ রাজ প্রসাদেও তার প্রভাব বিস্তৃত ছিল। যাইহোক, আঁরিয়াস তার পত্রে ইউসেবিয়াসকে বলেন: “আমরা নির্যাতিত হচ্ছি এ কারণে যেহেতু আমরা বলি যে, যীশু উদ্ভূত হয়েছিলেন; কিন্তু ঈশ্বর উদ্ভূত হননি, তিনি অনাদি।”

অন্যদিকে বিশপ আলেকজান্ডার আঁরিয়াস সম্পর্কে তার এক পত্রে লিখেছেন: তারা শয়তানের দ্বারা চালিত, শয়তান তাদের মধ্যে বাস করে এবং তাদেরকে উত্তেজিত করে; তারা ভেলকি জানে এবং প্রতারক, চতুর, জাদুকরের মত কথায় মোহাবিষ্ট করে, তারা হল দস্যু, নিজেদের আস্তানায় তারা দিনরাত খৃষ্টকে অভিশাপ দেয়... তারা শহরের চরিত্রহীন তরুণী রমণীদের মাধ্যমে লোকজনকে ধর্মান্তরিত করে।”
ইউসেবিয়াস বিশপ আলেকজাণ্ডারের মনোভাবে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় বিশপদের এক সভা আহ্বানপূর্বক তাদের কাছে সম্পূর্ণ বিষয়টি উত্থাপন করেন। এ সমাবেশের ফল ছিল একটি পত্র যা পূর্ব ও পশ্চিমের সকল বিশপের কাছে প্রেরণ করা হয়। পত্রে তাদেরকে আঁরিয়াসকে চার্চে ফিরিয়ে নিতে আলেকজান্ডারকে রাজি করাতে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু আলেকজান্ডার আঁরিয়াসের পূর্ণ আত্মসমর্পণ চাইলেন। এসময় আঁরিয়াস ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন ও তার অনুসারীদের নিয়ে প্রার্থনা সমাবেশ করতে থাকেন। 

এসময় ইউসেবিয়াসের সমালোচনা করে আলেকজান্ডার “তার ক্যাথলিক চার্চের সহযোগী কর্মীদের” কাছে দীর্ঘ এক পত্র লেখেন যাতে তিনি অভিযোগ করেন এই বলে যে, “তিনি মনে করেন যে তার সম্মতির উপরই চার্চের কল্যাণ নির্ভর করে। "তিনি আরো বলেন, "ইউসেবিয়াস আঁরিয়াসকে সমর্থন করেন, আর তা শুধু তিনি যে আঁরিয়াসের মতবাদে বিশ্বাস করেন সে জন্যেই নয়, এর পিছনে রয়েছে তার নিজস্ব উচ্চাকাঙ্খা জনিত স্বার্থ।" এভাবে যাজকদের মধ্যকার বিরোধ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশপদের মধ্যে ব্যক্তিগত বিরোধের রূপ গ্রহণ করে। 

এ বিষয়টি নিয়ে বিশপদের পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভিন্ন প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে। নাইসিয়ার গ্রেগরী (Gregory of Nyssea) লিখেছেন: রাস্তা-ঘাট, বাজার, মুদ্রা ব্যবসায়ীদের দোকান, খাবার দোকানসহ কনষ্টান্টিনোপলের সর্বত্রই তাদের নিয়ে আলোচনা চলছিল। একজন দোকানিকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে অমুক জিনিসের মূল্য কত, সে তার জবাব দেয় উদ্ভূত সত্তা ও উদ্ভূত নয় এমন সত্তা সম্পর্কে জানতে চেয়ে। রুটিওয়ালার কাছে রুটির দাম জানতে চাইলে সে বলে, “পুত্র তার পিতার বান্দা”; চাকরকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে গোসলখানা তৈরি করা হয়েছে কিনা, সে জবাব দেয়: "পুত্র কোন কিছু থেকে উদ্ভূত হয়নি।" ক্যাথলিকরা ঘোষণা করেছে, “জন্মলাভকারীই শ্রেষ্ঠ” এবং আঁরিয়াসরা বলছে: “তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি জন্মদান করেছেন।”

লোকে রমণীদের কাছে জিজ্ঞাসা করত যে কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করার আগে তার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? যাজক মহলের উচ্চ পর্যায়েও এ বিতর্ক ছিল সমানভাবে উত্তপ্ত ও তিক্ত। জানা যায় যে  "প্রতিটি শহরেই বিশপরা বিশপদের সাথে একগুঁয়ে বিরোধে লিপ্ত ছিল। জনসাধারণ ছিল জনসাধারণের বিপক্ষে... এবং তারা পরস্পরের সাথে সহিংস সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।" 

সম্রাট কনষ্টানটাইন বিষয়টি অবহিত ছিলেন। ঘটনাবলী ক্রমশই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তিনি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন এবং আলেকজান্ডার ও আঁরিয়াস উভয়ের উদ্দেশ্যে একটি পত্র প্রেরণ করলেন। এতে তিনি বললেন যে, ধর্মীয় মতামতের ঐক্য তিনি একান্তভাবে কামনা করেন যেহেতু সাম্রাজ্যে শান্তির জন্যে সেটাই হল সর্বোত্তম গ্যারান্টি। উত্তর আফ্রিকার ঘটনাবলীতে গভীরভাবে হতাশ হয়ে তিনি "প্রাচ্যের হৃদয়ের" (Bosom of East) কাছ থেকে উত্তম কিছু আশা করলেন যেখানে "ঐশ্বরিক আলোর প্রভাতের" (Dawn of Divine Light) উদয় ঘটেছিল। 

তিনি লিখেছেন: কিন্তু হায় গৌরবময় ও পবিত্র ঈশ্বর! শুধু আমার কান নয়, আমার হৃদয়ও ক্ষত-বিক্ষত, যখন আমি শুনতে পেলাম যে আপনার মধ্যে যে বিরোধ ও দলাদলি বিদ্যমান তা এমন কি আফ্রিকার চাইতেও মারাত্মক; সুতরাং আপনারা, যাদের আমি অন্যদের বিরোধ নিরসনের দৃষ্টান্ত হিসেবে আশা করি, তাদের চেয়ে আরো খারাপ হওয়ার আগেই এর প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন এবং এখনো, এই আলোচনার মূল কারণ সম্পর্কে সতর্ক অনুসন্ধান করার পর আমি দেখতে পেয়েছি যে, তা একেবারেই তাৎপর্যহীন এবং এ ধরনের বিবাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন।

আমার অনুমান যে, বর্তমান বিতর্কের উৎপত্তি ঘটেছে এভাবে: যখন আপনি, আলেকজান্ডার, প্রতিটি যাজককে জিজ্ঞাসা করলেন যে পবিত্র গ্রন্থের কতিপয় অংশ সম্পর্কে তিনি কি ভাবেন অথবা তিনি একটি অর্থহীন বোকামিপূর্ণ প্রশ্নের একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে কি চিন্তা করেন; এবং আপনি, আরিয়াস, যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই এমন সব কথা বললেন যা কখনো প্রকাশই পায়নি অথবা পেলেও নীরবেই তার বিলুপ্তি ঘটেছে, আপনাদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিল। যোগাযোগ ছিন্ন হল এবং অধিকাংশ লোক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, তারা আর অভিন্ন হিসেবে ঐক্যবদ্ধ রইল না।

এরপর সম্রাট তাদের উভয়কেই অবান্তর প্রশ্ন ও হঠকারী জবাব বিস্মৃত হওয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান: বিষয়টি আদতে কখনোই উত্থিত হওয়ার যোগ্য ছিল না, কিন্তু অলস লোকদের করার মত বহু অপকর্ম থাকে এবং অলস মস্তিষ্কগুলো এ চিন্তাই করে। আপনাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য বা বিরোধ তা পবিত্রগ্রন্থ ভিত্তিক কোন যাজকের ধর্মমত নয়, কিংবা তা নয়া প্রবর্তিত কোন মতবাদের কারণে নয়। আপনারা উভয়েই একই প্রকার এবং অভিন্ন মত পোষণ করেন। সুতরাং আপনাদের মধ্যে পুনর্মিলন সহজেই সম্ভব। 

সম্রাট এ পত্রে পৌত্তলিক দার্শনিকদের উদাহরণ দেন যারা একই প্রকার বিশদ সাধারণ নীতিমালা ধারণের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য পোষণে সম্মত হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে, তিনি প্রশ্ন করেন, নিছক তুচ্ছ ও মৌখিক মতপার্থক্যের কারণে খৃষ্টান ভাইদের একে অপরের সাথে শত্রুর মত আচরণ করা কি ঠিক? তাঁর মতে, এ ধরনের আচরণ: রুচিহীন, শিশুসূলভ ও বদমেজাজি ও দুর্ভাগা ঈশ্বরের যাজকগণ এবং বোধ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ... এটা হল শয়তানের ছলনা ও প্রলোভন। এ ব্যাপারে আসুন আমরা কিছু করি। আমরা সবাই যদি সকল বিষয়ে এক রকম ভাবতে নাও পারি, অন্তত বড় বিষয়গুলোতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। পবিত্র ঐশ্বরিক সত্তা প্রসঙ্গে আসুন সবাই একই বিশ্বাস এক উপলব্ধি পোষণ এবং ঈশ্বর প্রসঙ্গে এক ও অভিন্ন মত অবলম্বন করি। 

পত্রে এ বলে উপসংহার টানা হয়: যদি তা না হয়, তাহলে আমার সেই শান্তিপূর্ণ ও সমস্যামুক্ত রাতগুলো ফিরিয়ে দিন যাতে আমি আমার আনন্দ এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের উৎফুল্লতা লাভ করতে পারি। তা যদি না হয় তাহলে আমি অবশ্যই যন্ত্রণা কাতর ও অশ্রুসিক্ত হব এবং মৃত্যু পর্যন্ত আমি কোন শান্তি পাব না। যেখানে ঈশ্বর প্রেমীগণ, আমার সহকর্মী সেবকগণ এ ধরনের বেআইনি ও ক্ষতিকর বিতর্কে লিপ্ত সেখানে আমি কীভাবে মনে শান্তি পাব?

এ পত্র শুধু খৃষ্টধর্ম সম্পর্কেই নয়, অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও সম্রাটের চরম অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে যেহেতু তিনি মনে করতেন যে, একজন মানুষ যেভাবে খুশি ঈশ্বরের উপাসনা করুক অথবা ঈশ্বর নির্দেশিত পন্থায়ই উপাসনা করুক, তা একই ব্যাপার। কার্যত: তার কাছে আলেকজান্ডার ও আঁরিয়াসের মধ্যকার বিরোধ ছিল নেহায়েতই মৌখিক বিবাদ অথবা এক তাৎপর্যহীন এবং অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ বিষয়। একদিকে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস অন্যদিকে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস এর মধ্যে তার দৃষ্টিতে মৌলিক কোন বিরোধ ছিল না। 

কর্দোবার হোসিয়াস এ পত্র আলেকজান্দ্রিয়ায় বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অল্প কয়েকদিন অবস্থানের পর তিনি তার মিশনের ব্যর্থতা সম্পর্কে সম্রাটকে জ্ঞাত করার জন্যে শূন্য হাতে ফিরে এলেন। 

একদিকে যখন এসব ঘটনা ঘটে চলেছিল, অন্যদিকে কনষ্টানটাইন তার ভগ্নিপতি লিসিনাসের (Licinus) সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করছিলেন। যুদ্ধে লিসিনাস নিহত হন। এসময় কনষ্টানটাইন উপলব্ধি করলেন যে, একটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেও শান্তি হারানো সম্ভব। 

হোসিয়াসের (Hosius) মিশনের ব্যর্থতার পর প্রাচ্যের পরিস্থিতি গোলযোগপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। আঁরিয়াসের বাণী ও যুক্তির পরিণতি হল আলেকজান্দ্রিয়ায় রক্তপাত। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল বা প্রাচ্যের সর্বত্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ইতিপূর্বেই উত্তর আফ্রিকায় বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ ছিল। এ পর্যায়ে সম্রাট উপলব্ধি করেন যে তার পলীয় চার্চের বন্ধুগণ তার কোন সমস্যাই মিটিয়ে দেওয়ার মত শক্তিশালী নয়। উত্তর আফ্রিকার বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন তা হল: প্রকাশ্যে কোন পক্ষ সমর্থন করা তার উচিত নয়। তাই তিনি আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেন। একজন পৌত্তলিক হিসেবে তার অবস্থান তাকে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছিল। যেহেতু তিনি বিবাদমান কোন সম্প্রদায়েরই অনুসারী নন, সে কারণে তিনি একজন নিরপেক্ষ বিচারক হতে পারবেন। তার ধারণা হল, এর ফলে তখন পর্যন্ত বিশপরা যে সমস্যার সম্মুখীন ছিলেন, তা নিরসন হবে। কারণ এ ধরনের একটি বিষয়ের নিষ্পত্তিকারী হিসেবে একজন খৃষ্টানের সভাপতিত্বের বিষয়টি মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কনষ্টানটাইনের নেতৃত্বে বিশপদের এ সভাটি আজ কাউন্সিল অব নিকাইয়া (Council of Nicea) হিসেবে পরিচিত। 

সভার জন্যে আমন্ত্রণ লিপি প্রেরণ করা হল। কনষ্টানটাইন রাজকীয় কোষাগার থেকে এর সকল ব্যয়ভার বহন করা হয়। দু’বিবদমান পক্ষে নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্য যাদের আমন্ত্রণ জানানো হল তারা সার্বিকভাবে তেমন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন না। ডোনাটাসের প্রধান বিরোধী কেসেলিয়ানকে এ সভায় আমন্ত্রণ জানানো হলেও ডোনাটাসের চার্চের কাউকেই আমন্ত্রণ করা হয়নি। সভায় অংশগ্রহণকারী গুরুত্বপূর্ণ বিশপগণ হলেন: কায়সারিয়ার ইউসেবিয়াস, নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস, এথানাসিয়াস, হোসিয়াস। এ ছাড়াও কাউন্সিলে এমন সব ব্যক্তি ছিলেন যারা ধর্মনিষ্ঠার জন্যে খ্যাতিমান হলেও জ্ঞানের জন্যে খ্যাতিমান ছিলেন না। যেমন- স্পিরিডেম (Spyridon), পাটামন, ওসিয়াস, নিকোলাসের মাইজার ইত্যাদি।

এভাবে দেখা যায়, নিকাইয়ার পরিষদ বেশির ভাগ সেসব বিশপদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল যারা একান্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু মূল বিষয়ে পর্যাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান তাদের ছিল না। এ সকল লোককে হঠাৎ করে সেকালের গ্রীক দর্শনের চটপটে ও অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যাখ্যা তাদের মুখোমুখি করা হয়েছিল। তাদের প্রকাশ ভঙ্গি ছিল এমন যে কী বলা হচ্ছে তার তাৎপর্য বুঝে ওঠা এসব বিশপের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারা তাদের জ্ঞানের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অপরাগ হয়ে অথবা তাদের বিরোধীদের সাথে বিতর্কে অক্ষম হয়ে তাদের নিজেদের বিশ্বাসে স্থিত হয়ে চুপ করে থাকা অথবা সম্রাটের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিল না।

সভা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই সকল প্রতিনিধি নিকাইয়া পৌঁছেন। তারা ছোট ছোট দলে জড় হতেন এবং তাদের মধ্যে আসন্ন সভার বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক হত। এসব সমাবেশে, যা সাধারণত জিমনেসিয়াম বা খোলা আকাশের নীচে অনুষ্ঠিত হত, গ্রীক দার্শনিকগণ তাদের যুক্তির বাণ ছুঁড়ে দিতেন এবং ব্যঙ্গ্য-বিদ্রুপ করতেন তবে তা আগত প্রতিনিধিদের বিভ্রান্ত করত না। 

অবশেষে নির্দিষ্ট দিনটি এল। প্রত্যেকেই সভায় উপস্থিত হলেন। সম্রাট সভা উদ্বোধন করবেন। প্রাসাদের একটি বিশাল কক্ষ সভার জন্যে নির্ধারণ করা হয়। কক্ষের মাঝখানে টেবিলে সেকালের সকল জ্ঞাত গসপেলের কপি সমূহ রাখা হয়ে ছিল। সেগুলোর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩শ’। প্রত্যেকের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল চমৎকার সাজে সজ্জিত কাঠের তৈরি রাজসিংহাসনের দিকে। সিংহাসনটি স্থাপন করা হয়েছিল পরস্পরের দিকে মুখ করে সন্নিবিষ্ট দু’সারি আসনের মধ্যে, কক্ষের উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া দিকের শেষ প্রান্তে। কক্ষের মধ্যে গভীর নীরবতা বিরাজ করছিল। এসময় রাজদরবারের কর্মকর্তারা একে একে আসতে শুরু করলেন। শেষ মুহূর্তে কোন ঘোষণা ছাড়াই সম্রাট এসে হাজির হলেন। সভায় আগত সমবেত প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রথমবারের মত তারা সম্রাট কনষ্টানটাইনের প্রতি সবিস্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। 

তিনি ছিলেন সম্রাট কনষ্টানটাইন, বিজয়ী, মহান, শ্রেষ্ঠ। তার দীর্ঘ দেহ, সুগঠিত শরীর, প্রশস্ত কাঁধ এবং সুদর্শন মুখায়বর তার উচ্চ মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। তার অভিব্যক্তি দেখে তাকে অবিকল রোমান সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মত মনে হচ্ছিল। বিশপদের অনেকেই তার ঝলমলে জমকাল রাজ পোশাক দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। তার দীর্ঘ চুলে ঢাকা মাথায় ছিল মনিমুক্তা খচিত রাজমুকুট। তার উজ্জ্বল লাল রঙ্গের আলখেল্লা ছিল মূল্যবান পাথর ও সোনার কারুকাজ খচিত। তার পায়ে ছিল টকটকে লাল রঙের জুতা যা সেকালে শুধুমাত্র সম্রাটরাই পায়ে দিতেন এবং এ কালে শুধুমাত্র পোপই তা পরেন। 

নিকাইয়ার সম্মেলন।
সম্রাটের দু’পাশে আসীন ছিলেন হোসিয়াস ও ইউসেবিয়াস। ইউসেবিয়াস সম্রাটের উদ্দেশ্যে বক্তৃতার মাধ্যমে সভার কার্যক্রম শুরু করলেন। সম্রাট সংক্ষিপ্ত ভাষণের মধ্যে দিয়ে তার জবাব দিলেন। তার ভাষণ ল্যাটিন থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করা হয় যা অল্প লোকেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি সম্রাট নিজেও তা তেমন বুঝতে পারেননি। কারণ গ্রীক ভাষায় তার জ্ঞান ছিল অতি সামান্য। সভার কাজ যতই অগ্রসর হতে থাকল, বিতর্কের তোরণদ্বার তত উন্মুক্ত হতে শুরু করল। কনষ্টানটাইন তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গ্রীক জ্ঞান নিয়ে একটা বিষয়েই তার সকল শক্তি নিয়োজিত করলেন। তাহল, একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছা। তিনি প্রত্যেককে জানিয়ে দিলেন যে বিভিন্ন দলের কাছ থেকে কয়েকদিন আগে তিনি যত অভিযোগ আবেদন পেয়েছিলেন তার সবই তিনি পুড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আশ্বস্ত করলেন যে, যেহেতু তিনি সেগুলোর কোনটিই পড়েননি, সেহেতু তার মন খোলা রয়েছে এবং তিনি পক্ষপাতদুষ্ট নন। 

পলীয় চার্চের প্রতিনিধিগণ ঈশ্বরের ৩টি অংশ প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা বাইবেল থেকে মাত্র দু’জনের পক্ষে যুক্তি পেশ করতে সক্ষম হন। তা সত্ত্বেও ‘পবিত্র আত্মা’ কে ঈশ্বরের তৃতীয় অংশ তথা তৃতীয় ঈশ্বর হিসেবে ঘোষণা করা হয় যদিও এ কল্পিত বিষয়ের সমর্থনে কোন যুক্তি প্রদর্শন করা হয়নি। অন্যদিকে লুসিয়ানের শিষ্যরা তাদের ভিত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন এবং তারা ত্রিত্ববাদীদের একটি অসম্ভব অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যেতে বাধ্য করেন। 

ত্রিত্ববাদীরা একজন খৃষ্টানের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চাইছিল, আঁরিয়াস ও অন্যান্য একত্ববাদী সমর্থকদের বাদ দিয়ে সে সংজ্ঞা নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে ত্রিত্ববাদ যাকে তারা দু’পক্ষের মধ্যে প্রধান বিতর্কিত বিষয় বলে গুরুত্ব আরোপ করেছিল, প্রকৃতপক্ষে কোন গসপেলেই তার উল্লেখ ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল যে তারা যাকে 'পুত্র' হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি ঈশ্বরের পুত্র। আঁরিয়াস পন্থীরা তার জবাবে বলে যে তারা সকলেই ‘ঈশ্বরের পুত্র’, কারণ বাইবেলে লেখা আছে যে, “সকল কিছুই ঈশ্বর থেকে।” এ যুক্তি ব্যবহার করা হলে সকল সৃষ্টিরই ঈশ্বরত্ব প্রমাণিত হয়। পলীয় বিশপগণ তখন যুক্তি উত্থাপন করেন যে যীশু শুধু ‘ঈশ্বর হতে’ নন, ‘ঈশ্বরের সত্তা থেকেও।’ এ যুক্তি সকল সনাতনপন্থী খৃষ্টানের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তারা বলেন, বাইবেলে এ ধরনের কোন কথাই নেই। এভাবে যীশুকে ঈশ্বর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা খৃষ্টানদের ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে তাদের মধ্যে আরো বিভক্তি সৃষ্টি করে। বেপরোয়া হয়ে ত্রিত্ববাদীরা তখন যুক্তি প্রদর্শন করে যে বাইবেলে বলা হয়েছে যে “যীশু হলেন পিতা ও সত্য ঈশ্বরের চিরন্তন ভাবমূর্তি।” আঁরিয়াস পন্থীরা তার জবাবে বলেন, বাইবেলে একথাও বলা হয়েছে যে “আমরা মানবগণ ঈশ্বরের ভাবমূর্তি ও গৌরব।” যাহোক, এ যুক্তি যদি গৃহীত হয় তাহলে প্রমাণিত হয় শুধু যীশুই নয়, সকল মানুষই ঐশ্বরিক বলে দাবি করতে পারে। 

সভাকক্ষেই শুধু নয়, রাজপ্রাসাদের মধ্যেও আলোচনা চলতে থাকে। এভাবে সভায় যার শুরু হয়েছিল তা রাজ প্রাসাদ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। সম্রাটের মাতা হেলেনা পলীয় চার্চকে সমর্থন করে বসেন। অন্যদিকে সম্রাটের বোন কনষ্টানটিনা আঁরিয়াসকে সমর্থন করলেন। কনষ্টানটিনা তার ভ্রাতা সম্রাট কনষ্টানটাইনের সাথে যুদ্ধে তার স্বামী প্রাণ হারালে রাজপরিবারে ফিরে এসেছিলেন। যাহোক, বিতর্ক রাজ দরবারেও ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে রাজপুরুষ এমনকি প্রাসাদের পাচকগণও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদিকে সুকৌশলে সম্রাট দু’পক্ষ থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন এবং সবাইকে আঁচ-অনুমানের মধ্যে রাখেন। একজন পৌত্তলিক হিসেবে তিনি খৃষ্টানদের কোন সম্প্রদায়েরই পক্ষে ছিলেন না। এটি ছিল তার পক্ষে এক জোরালো যুক্তি। 

বিতর্ক চলতে থাকা অবস্থায় উভয় পক্ষের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এ সভায় কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। তা সত্ত্বেও তারা সম্রাটের সমর্থনের প্রত্যাশা করলেন যেহেতু পলীয় চার্চের জন্যে সেটা ছিল শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপার। অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকাবাসীদের জন্যে সম্রাটের সমর্থন লাভের অর্থ ছিল তাদের নিপীড়নের অবসান। 

রাজকুমারী কনষ্টানটিনা ইউসেবিয়াসকে পরামর্শ দিলেন যে সম্রাট একটি ঐক্যবদ্ধ চার্চ চান। কারণ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিভক্তি সাম্রাজ্যকে বিপদগ্রস্ত করবে। কিন্তু যদি কোন ঐকমত্য না হয় তা হলে তিনি ধৈর্য হারাবেন এবং খৃষ্টানদের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। যদি তিনি সেপন্থাই গ্রহণ করেন তা হলে খৃষ্টানদের পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হবে এবং খৃষ্টান ধর্মও অধিকতর বিপন্ন হবে। এদিকে কনষ্টানটাইনের আনুকূল্য লাভের জন্যে উপস্থিত সকল বিশপ ধর্মের কিছু পরিবর্তন সাধনে এমনিতে সম্মত ছিলেন। আর তাই ইউসেবিয়াসের পরামর্শক্রমে আরিয়াস ও তার অনুসারীরা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলেন। যেহেতু সেসময় সাম্রাজ্যের সর্বত্র রোমান সূর্যদেবতার উপাসনা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং সম্রাটকে পৃথিবীতে দেবতার রূপ হিসেবে গণ্য করা হত, এ প্রেক্ষিতে পলীয় চার্চ :
  • রোমান সূর্য-দিবস (Sunday)-কে খৃষ্টানদের সাপ্তাহিক ধর্মীয় দিবস ঘোষণা করল;
  • সূর্য-দেবতার প্রচলিত জন্মদিবস ২৫ডিসেম্বরকে যীশুর জন্মদিবস(Christmas Day)হিসেবে গ্রহণ করল;
  • সূর্য-দেবতার প্রতীক আলোর ক্রুশকে (Cross of Light)খৃষ্টবাদের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করল; এবং
  • সূর্য-দেবতার জন্মদিবসের সকল উৎসব অনুষ্ঠানকে নিজেদের উৎসব অনুষ্ঠান হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিল। 
খৃষ্টধর্ম এবং তার সাম্রাজ্যের ধর্মের মধ্যকার বিপুল ব্যবধান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাওয়ার এ ঘটনা সম্রাট কনষ্টানটাইনের জন্যে নিশ্চয়ই অত্যন্ত সন্তোষজনক মনে হয়েছিল। চার্চ তার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে। ফলে চার্চের প্রতি তার সমর্থন আগে দুর্বল থাকলেও এখন তা অত্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠে।
চূড়ান্ত ভাবে ত্রিত্ববাদ খৃষ্টানধর্মের মৌলিক মতবাদ হিসেবে গৃহীত হয়। এ পর্যায়ে সম্ভবত এই মতবাদের কিছু অনুসারীর তখনও সরাসরি একত্ববাদের অভিজ্ঞতা ও তার প্রতি সমর্থন বিদ্যমান ছিল। তাদের জন্যে ত্রিত্ববাদ সেই পন্থার চেয়ে কম কিছু ছিল না যে পন্থায় তারা যা প্রত্যক্ষ করেছিল তা বর্ণনার চেষ্টা করত। যেহেতু যীশু যে এক ঈশ্বরের শিক্ষা দিয়েছিলেন তা তখন বিলুপ্ত হয়েছিল, তাই তারা শেষ পন্থা হিসেবে প্লাটোনিক দর্শনের পরিভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল যদিও তা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পর্যাপ্ত ছিল না। কার্যত এ-ই ছিল তাদের সব যা তারা জানত। যা হোক, এ বিষয়টি সামান্য কিছু লোকের কাছেই স্পষ্ট ছিল। এপুলিয়াস (Apuleius) লিখেছেন, “আমি নীরবে এই মহিমান্বিত ও প্লাটোনিক মতবাদ উপেক্ষা করেছিলাম। কারণ সামান্য কিছু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিই এটা বুঝেছিলেন, অন্যদিকে প্রতিটি সাধারণ মানুষের কাছেই তা অজ্ঞাত ছিল।” 
প্লাটো বলেন, “স্রষ্টাকে খোঁজা কঠিন, কিন্তু নিম্নশ্রেণির লোকদের কাছে তা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।”  
পিথাগোরাস বলেন, “কু-সংস্কারাচ্ছন্ন মতের মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের কথা বলা নিরাপদ নয়। তাদের কাছে সত্য বা মিথ্যা বলা সমান বিপজ্জনক।”

যারা এক ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন তাদের কারো কারো কাছে যদিও এ পরিভাষার ব্যবহার যৌক্তিক বলেই গণ্য ছিল, কিন্তু কার্যত: এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এমন কোন পন্থা ছিল না যাতে ‘দেবতাগণ’ এর গ্রীক ধারণা যীশুর কাছে প্রত্যাদেশকৃত ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকে সফলভাবে খর্ব করতে পারে। এ ধরনের কোন ঘটনা শুধুমাত্র পল ও তার অনুসারীদের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব ছিল। যারা গ্রীক দর্শনের আদর্শ হৃদয়ংগম করতে পারেনি তাদের মধ্যে শুধু বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি হয়েছিল। আসলে ত্রিত্ববাদের সংস্পর্শে যারা এসেছিল, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অবস্থাই ছিল এ রকম। তারা যে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিল তা নানা জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি করেছিল। সভা নিজে থেকেই তাদের সুস্পষ্টভাবে এ পথে ঠেলে দিয়েছিল। এ মতবাদ কীভাবে উদ্ভূত এবং কেন তা গৃহীত হল, কি করে অনানুষ্ঠানিক ভাবে অনুমোদিত হল, তা বোধগম্য। এটাও পরিষ্কার যে এ মতবাদের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির প্রেক্ষিতে আরিয়াস কেন পথ নির্দেশনার জন্যে গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারার আশ্রয় নেয়ার বদলে খৃষ্টধর্মের উৎসের কাছে ফিরে যাবার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। কারণ গ্রীক দর্শন নবী যীশুর উপর প্রত্যাদেশ থেকে উদ্ভূত ছিল না। 

নিকাইন ধর্মমত।
আজ যা নিকাইন ধর্মমত (Nicene Creed) নামে পরিচিত তা সম্রাট কনষ্টানটাইনের সমর্থনে সভায় উপস্থিতদের দ্বারা প্রণীত ও সত্যায়িত। এতে ত্রিত্ববাদীদের মতই স্থান পেয়েছিল এবং আঁরিয়াসের শিক্ষার সরাসরি প্রত্যাখ্যান হিসেবে নিম্নোক্ত দৈব অভিশাপ সংযুক্ত করা হয়েছিল। 

যারা বলে, "এক সময় তিনি ছিলেন না এবং জন্মের পূর্বে তিনি অস্তিত্বশীল ছিলেন না এবং তিনি কোন কিছু থেকে অস্তিত্বশীল হননি" অথবা যারা বলে যে "ঈশ্বরের পুত্র ভিন্ন সত্তা বা উপাদান অথবা তিনি সৃষ্ট হয়েছেন অথবা পরিবর্তনের উপযোগী" তাদের জন্যে ক্যাথলিক চার্চের অভিশাপ। 

যারা এ ধর্মমতে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ এতে বিশ্বাসী ছিলেন, কেউ কেউ জানতেন না যে কিসে তারা তাদের নাম স্বাক্ষর করেছেন, এবং কিছু ব্যক্তি, যারা সভার প্রতিনিধিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন, তারা ত্রিত্ববাদের সাথে একমত হতে পারেননি, কিন্তু তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্রাটকে খুশি করার জন্যে এতে স্বাক্ষর করেন। তাদের একজন বলেন, “একটু কালির বিনিময়ে প্রাণরক্ষা মোটেই খারাপ নয়।” 

এরাই ছিল সেসব লোক যারা একজন পৌত্তলিক সম্রাটের অধীনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে একজন গোঁড়া খৃষ্টানের পরীক্ষা কি হবে। এর ফল ত্রিত্ববাদীদের জন্য যেমন তেমনি আঁরিয়াসপন্থীদের জন্যও অত্যন্ত বিস্ময়কর হয়েছিল। ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে তা কারোরই জানা ছিল না। সার্বজনীন পরীক্ষা গ্রহণের ধারণাটি ছিল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কেউই তা পছন্দ করেনি। তদুপরি আঁরিয়াসবাদের সরাসরি নিন্দা ছিল এক মারাত্মক পদক্ষেপ। এমনকি যারা ধর্মমতের সত্যায়নে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিল তারাও সন্দেহের সাথেই তা করেছিল। পবিত্র গ্রন্থে ছিল না এবং যীশু বা তার শিষ্যদের দ্বারা ব্যক্ত বা উল্লেখিত নয়, এমন একটি শব্দের সমর্থনে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে তোড়জোড় করে যে সভার আয়োজন করা হয়েছিল বাস্তবে তা কিছু অর্জন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। 

একজন মাত্র ব্যক্তি জানতেন যে তিনি কি করছেন। তিনি হলেন সম্রাট কনষ্টানটাইন। তিনি জানতেন যে দৃঢ় বিশ্বাস নয়, ভোটের উপর ভিত্তি করে দাঁড় করানো একটি ধর্মমতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হবে না। কোন ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু তাকে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত নাও করতে পারে। তিনি জানতেন কীভাবে ও কেন বিশপগণ ধর্মমতের ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন। তিনি বিশপদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছেন এমন ধারণা সৃষ্টি না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে সভার সিদ্ধান্তের প্রতি ঈশ্বরের সমর্থন ও অনুমোদন প্রমাণের জন্যে ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতার আশ্রয় নেয়া হবে। 

সভার শুরুতে এনে জড়ো করা যীশুর শিক্ষার লিখিত বিবরণ গসপেলের বিশাল স্তূপ তখনও সভাকক্ষের মধ্যখানে রাখা ছিল। একটি সূত্রমতে, সেখানে সেসময়ে ২৭০টি গসপেল রাখা ছিল। অন্য একটি সূত্রমতে বিভিন্ন ধরনের গসপেলের সংখ্যা ছিল ৪০০০ এর মত। গসপেলে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন সব ধারণা সম্বলিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গসপেলের সাথে সরাসরি বিরোধমূলক একটি ধর্মীয় মতবাদ প্রণয়ন ও প্রচলন কিছু লোককে যেমন বিভ্রান্ত করেছিল অন্যদিকে গসপেলসমূহের বিদ্যমানতা অন্যদের জন্য খুবই অসুবিধাজনক ছিল। 

এ প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সকল গসপেল সভাকক্ষে একটি টেবিলের নীচে রাখা হবে। তারপর সকলেই কক্ষ ত্যাগ করবে এবং তা তালাবদ্ধ করা হবে। এখন যে গসপেলটি সঠিক সেটা যাতে টেবিলের উপর চলে আসে তার জন্য সারারাত ধরে প্রার্থনা করার জন্যে বিশপদের নির্দেশ দেওয়া হল। 

সকাল বেলা দেখা গেল, আলেকজান্ডারের প্রতিনিধি এথানাসিয়াসের কাছে গ্রহণযোগ্য গসপেলটি টেবিলের উপর স্থাপিত রয়েছে। এ ঘটনায় টেবিলের নীচে থাকা অন্যান্য সকল গসপেল পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সেই রাতে সভাকক্ষের তালার চাবি কার কাছে ছিল, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। 

এরপর অননুমোদিত গসপেল কাছে রাখা গুরুতর অপরাধে পরিণত হয়। এর পরিণতিতে পরবর্তী বছরগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি খৃষ্টান নিহত হয়। এথানাসিয়াস যে কীভাবে খৃষ্টানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, এ থেকেই তা বুঝা যায়।

নিকাইয়ার সভা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বিশপগণ তাদের পুরোনো বিরোধকে জাগিয়ে তুললেন যা তারা সম্রাট কর্তৃক আহূত হয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন। লড়াই শুরু হয়, পুরোনো বিরোধ চলতেই থাকে। তারা যে নিকাইয়ার সভায় ধর্মমতে স্বাক্ষর করেছেন, সে কথা বিস্মিত হলেন। আঁরিয়াসের সমর্থকরা নিকাইয়ার ধর্মমতকে প্রকৃত খৃষ্টান ধর্মের সমর্থক বলে বিবেচনা করেন না, সে কথা গোপন করলেন না। একমাত্র এথানাসিয়াসই (Athanasius) সম্ভবত এ নয়া ধর্মমতের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু তার সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ বিরাজ করছিল। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে তা ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। 

এভাবে নিকাইয়ার সভা খৃষ্টান সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার বিরাট ব্যবধান কমিয়ে আনার পরিবর্তে তা আরো বাড়িয়ে তোলে। তাদের মধ্যে তিক্ততার অবসান তো ঘটলই না, বরং তা বৃদ্ধি পেল। চার্চের ক্রোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সকল যুক্তি ও কারণ বাদ দিয়ে তা শক্তি প্রয়োগের পথ গ্রহণ করে। এর পরিণতিতে বড় ধরনের রক্তপাত শুরু হয়। এ পন্থায় পথ (Goths) ও লমবার্ডরা (Lombards) ‘ধর্মান্তরিত’ হয়। 

৩২৮ খৃষ্টাব্দ বিশপ আলেকজান্ডারের পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ নির্বাচন নিয়ে গোলযোগ দেখা দিল। আঁরিয়াসপন্থী ও মেলেটিয়ানপন্থীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এথানাসিয়াস বিশপ পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত, নির্বাচিত ও অভিষিক্ত হলেন। 

এদিকে সম্রাট কনষ্টানটাইনের দরবারে তার বোন কনষ্টানটিনা খৃষ্টানদের হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি আরিয়াসকেই সত্য খৃষ্টান ধর্মের প্রতিনিধি মনে করতেন। তিনি নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াসের প্রতি সম্রাটের আচরণেরও বিরোধিতা করেন। কনষ্টানটাইন তাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। 

দীর্ঘদিন পর কনষ্টানটিনা সফল হন এবং ইউসেবিয়াসকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। এথানিয়াসের জন্যে এটি ছিল এক মারাত্মক আঘাত। এসময় সম্রাট ধীরে ধীরে আঁরিয়াসের প্রতি ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। যখন তিনি শুনলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ পদে এথানাসিয়াসের নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তখনি তিনি নয়া বিশপকে রাজধানীতে তলব করেন। কিন্তু এথানাসিয়াস ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি রাজধানী কনষ্টান্টিনোপলে গেলেন না। ৩৩৫ খৃষ্টাব্দ কনষ্টানটাইনের রাজত্বের ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে টায়ার (Tyre) নগরীতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এথানাসিয়াস তাতে যোগ দিতে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে রাজকীয় স্বৈরাচারের অভিযোগ আনা হয়। পরিস্থিতি তার এমনই প্রতিকূল ছিল যে তিনি সভার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করেই সভাস্থল ত্যাগ করেন। তার নিন্দা করা হয়। বিশপগণ জেরুজালেমে সমবেত হন এবং তার নিন্দার বিষয়ে নিশ্চিত হন। এসময় আঁরিয়াসকে চার্চে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তিনি ধর্মীয় প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি লাভ করেন। 

আঁরিয়াস ও তার বন্ধু ইউসেবিয়াসকে সম্রাট কনষ্টান্টিনোপলে আমন্ত্রণ জানান। আঁরিয়াস ও সম্রাটের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হল। এরপর বিশপগণ পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে এথানাসিয়াসের নিন্দা করেন। বেপরোয়া এথানাসিয়াস এসময় কনষ্টান্টিনোপলে চলে আসেন। সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্যে তাকে অনুমতি দেওয়া হল। এসময় নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভালভাবেই জানতেন যে নিকাইয়ার সভার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারণে আঁরিয়াসের বিপক্ষে গেছে। তিনি আরও উপলব্ধি করলেন যে ধর্মীয় বিতর্ক সম্রাট কোনভাবেই বুঝতে পারবেন না। সুতরাং সে পথে না গিয়ে তিনি রাজধানীতে শস্য সরবরাহে বাঁধা সৃষ্টির জন্যে এথানাসিয়াসকে অভিযুক্ত করলেন। এই অভিনব অভিযোগে এথানাসিয়াস বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তিনি যে খেলায় দক্ষ, সে খেলা দক্ষতার সাথে খেলতে পারার মত অন্য লোকও আছে। অভিযোগ সহজেই প্রমাণিত হয় এবং এথানাসিয়াসকে গল প্রদেশের ট্রায়ারে প্রেরণ করা হল। আঁরিয়াস কনষ্টান্টিনোপলের বিশপ নিযুক্ত হলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই ৩৩৬ খৃষ্টাব্দ বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি মারা যান। চার্চ একে অলৌকিক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করলেও সম্রাট তা হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করলেন। তিনি এ মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেন। রহস্যজনক পন্থায় তদন্ত কাজ চলে। এথানাসিয়াস এ হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী বলে প্রমাণিত হয়। ফলে আঁরিয়াসকে হত্যার জন্যে এথানাসিয়াসকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। 

আঁরিয়াসের মৃত্যুর ঘটনায় সম্রাট প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। উপরন্তু বোনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি খৃষ্টানধর্ম গ্রহণ করেন। নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস তাকে দীক্ষিত করেন। এর মাত্র এক বছর পর ৩৩৭ খৃষ্টাব্দ সম্রাট পরলোক গমন করেন। এভাবে যিনি তার রাজত্বের অধিকাংশ সময় একত্ববাদের সমর্থকদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছিলেন, তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার হাতে যারা নিহত হয়েছিল তাদেরই ধর্ম গ্রহণ করে পরলোকে গমন করলেন। 

সম্রাট কনষ্টানটাইনের কফিন।
৩৩৭ খৃষ্টাব্দ সম্রাট কনষ্টানটাইনের মৃত্যুর পর পর পরবর্তী সম্রাট কনষ্টানটিয়াসও আঁরিয়াসের ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন এবং একত্ববাদে বিশ্বাসই গোঁড়া খৃষ্টান ধর্ম হিসেবে সরকারীভাবে গৃহীত হওয়া অব্যাহত ছিল। 

৩৪১ খৃষ্টাব্দ এন্টিওকে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে একত্ববাদই খৃষ্টান ধর্মের প্রকৃত ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়। ৩৫১ খৃষ্টাব্দ সিরমিয়ামে অনুষ্ঠিত আরেকটি সম্মেলনে তৎকালীন সম্রাটের উপস্থিতিতে পুনরায় পূর্বের সিদ্ধান্তকেই স্বীকার করে নেয়া হয়। এভাবে আঁরিয়াস যে শিক্ষা ধারণ করেছিলেন তাই খৃষ্টান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গ্রহণ করে। সাধু জেরোম ৩৫৯ খৃষ্টাব্দ লিখেছিলেন যে, "সারা বিশ্বই নিজেকে আঁরিয়াসের ধর্মমতের অনুসারী হিসেবে দেখতে পেয়ে বেদনার্ত ও বিস্মিত হয়েছিল।"

৩৮১ খৃষ্টাব্দ কনষ্টানটিনোপলে সম্রাটের সরকারী ধর্ম হিসেবে আঁরিয়াসের ধর্মমতের কথা ঘোষণা করা হল। 

সমাপ্ত।

উৎস: Jesus- A Prophet of God by Muhammad Ata-Ur-Rahim.

ছবি: Wikipedia, orangemanor.wordpress, saints.sqpn, samuelatgilgal.wordpress, flickr.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...