২ নভেম্বর, ২০১২

Pharaoh: থেবসের নেক্রোপলিশ কবরখানায় ফেরাউন।


ফেরাউন (Pharaoh) ইস্রায়েলীদের চলে যাবার অনুমতি দিলেও পরপরই তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন, যখন পরদিন সকালে তার কর্মচারীরা এসে জানাল, ‘হে  ফেরাউন, সকল বনি ইস্রায়েলীরা মূসার নেতৃত্বে রাতে মিসর ত্যাগ করেছে।’
একথা শুনে ফেরাউন মনে মনে ভাবলেন, ‘এ আমি কি করলাম? আমি যে আমার সব দাস হারালাম!’ 

কর্ণাক মন্দিরে প্রবেশ পথ, প্রাচীন থেবস।
তিনি তৎক্ষণাৎ বনি ইস্রায়েলীদের পশ্চাৎধাবণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং অতঃপর প্রতিটি এলাকা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করতে শহরময় ঘোষণাকারী পাঠিয়ে দিলেন। 

ঐ সকালেই শহরে শহরে ফেরাউনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেয়া হল-‘বনি ইস্রায়েলীদেরকে অবশ্যই ধরে আনতে হবে। এভাবে তাদেরকে দেশ ত্যাগের সুযোগ দেয়া হবে না। তারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করেছে, কষ্ট দিয়েছে, আর আমাদেরকে রাগান্বিত করেছে। তাছাড়া তাদেরকে ধরা খুব একটা কঠিনও না, তারা তো একটা ক্ষুদে দল, আর আমরা তো সংখ্যায় অনেক বেশী, আর যথেষ্ট হুসিয়ার!’

ইস্রায়েলীরা দেশ ত্যাগ করেছে জানতে পেরে মিসরীয়রাও ক্ষুব্ধ হল। কেননা তারা তাদের অলঙ্কার চেয়ে নিয়েছিল ফিরিয়ে দেবার নামে। আর তাই তারা অতি অল্পসময়ে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। 

এভাবে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনী ও রথ ইস্রায়েলীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করলেন। তারপর তিনি সত্তুর হাজার অশ্বারোহীসহ প্রায় সাত লক্ষ সেনা নিয়ে পরবর্তী দিন সূর্যোদয়ের সময় ভীতসন্ত্রস্ত পলায়নপর ইস্রায়েলীদের পশ্চাৎধাবন করলেন।এভাবে আল্লাহ ফেরাউনের দলকে তাদের বাগ-বাগিচা ও ঝরণাসমূহ থেকে বহিঃস্কার করলেন এবং বহিঃস্কার করলেন তাদের ধন-ভান্ডার ও মনোরম স্থানসমূহ থেকে। তারা যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে, কিন্তু তারা তা জানে না। আর পিছনে ফেলে যাচ্ছে কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্যস্থান, কত সুখের উপকরণ, যাতে তারা খোশগল্প করত। এমনিই হয়েছিল।

প্রাচীন থেবস।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-তারপর ফেরাউন শহরে শহরে লোক যোগাড় করতে পাঠাল এ বলে যে, ‘বনি ইস্রায়েলী তো একটা ক্ষুদে দল অথচ এরা আমাদের উত্যক্ত করে আসছে। আমরা তো সংখ্যায় অনেক বেশী, আর যথেষ্ট হুসিয়ার!’(২৬:৫৩-৫৬)
অতঃপর আমি ফেরাউনের দলকে তাদের বাগ-বাগিচা ও ঝরণাসমূহ থেকে বহিঃস্কার করলাম এবং ধন-ভান্ডার ও মনোরম স্থানসমূহ থেকে।(২৬:৫৭-৫৮)

আর সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাৎধাবন করল।(২৬:৬০) তারা ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্যস্থান, কত সুখের উপকরণ, যাতে তারা খোশগল্প করত। এমনিই হয়েছিল। (৪৪:২৫-২৮)

ইস্রায়েলীরা যখন সাগরের তীরে এসে পৌঁছিল তখন প্রায় সন্ধ্যা। তারা দেখল তাদের দু’দিকে পর্বত, সামনে সমুদ্র এবং পিছনে ফেরাউনের সেনাবাহিনী। এই অবস্থায় নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে তারা ভীষণ ভাষায় মূসাকে আক্রমণ করল। তাদের একদল মূসাকে বলল, ‘হে মূসা! আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম! এখন আমাদের কি হবে?’
অন্যেরা অভিযোগের সূরে বলল, ‘ওহে মূসা, মিসরে কবর দেবার জায়গা নেই বলেই কি তুমি এই মরুএলাকায় আমাদের মরবার জন্যে এনেছ?’

কেউ কেউ বলল, ‘হে মূসা! মিসরে থাকতেই কি আমরা তোমাকে বলিনি যে, আমাদের এখানেই থাকতে দাও, আমরা মিসরীয়দের গোলামীই করব? এই মরুভূমিতে মরার চেয়ে মিসরীয়দের গোলামী করা কি আমাদের পক্ষে ভাল ছিল না?’
মূসা বললেন, ‘ভয় কোরও না, তোমরা কেবল শান্ত থাক। ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনিই আমাদেরকে পথ দেখাবেন।’ 
সাগরের পানি দু’ভাগ হয়ে তাদের জন্যে একটি পথ তৈরী হল। 
ইস্রায়েলীরা কিন্তু মূসার কথায় শান্ত হল না। তাদের কিছু তাকে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করতে চাইল, আর কিছু আবার মিসরে ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হল। এই পরিস্থিতিতে মূসা অসীম ধৈর্য্য সহকারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে মূসা আদেশ পেলেন- ‘তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর।’

নির্দেশমত মূসা তার লাঠি দিয়ে সমুদ্রকে আঘাত করলেন- অবাক বিষ্ময়ে ইস্রায়েলীরা দেখল সাগরের পানি দু’ভাগ হয়ে দু‘দিকে পর্বত সদৃশ হয়ে গেল। আর মাঝ দিয়ে তাদের জন্যে একটি পথ তৈরী হল। তারা সেই পথে হেঁটে সমুদ্র পার হতে লাগল। 

এদিকে ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী এসময়ই সমুদ্রতীরে এসে হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তারা ভেবে পাচ্ছিলেন না-কিভাবে সমুদ্রের বুকে এই পথ তৈরী হল। নিজের মত সৈন্যবাহিনীকে এভাবে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফেরাউন সম্বিত ফিরে পেলেন। তিনি সগর্বে সেনাদেরকে বললেন, ‘এসব আমার প্রতাপেরই লীলা।’

এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- ‘ওরা সূর্যোদয়ের সময় তাদের পিছু নিল। তারপর যখন দু’দল পরষ্পরকে দেখতে পেল তখন তাদের সঙ্গীরা বলে উঠল, ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।’ 
মূসা বলল, ‘কিছুতেই না, আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক, তিনিই আমাদেরকে পথ দেখাবেন।’(২৬:৬০-৬২)

অতঃপর আমি মূসাকে আদেশ করলাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর।’ ফলে, তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ হয়ে গেল। আমি সেথায় অপরদলকে পৌঁছিয়ে দিলাম। (২৬:৬৩-৬৪)

ইস্রায়েলীদের যাত্রাপথ ও লোহিত সাগর ক্রসিং পয়েন্ট।
ফেরাউন তৎক্ষণাৎ নিজের রথ সমুদ্রের পথে চালিয়ে দিলেন এবং সেনাবাহিনীকেও আদেশ করলেন তাকে অনুসরণের জন্যে। ইস্রায়েলীদের ধরার জন্যে সেনারা যতই তাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, ততই তাদের রথের চাকা মাটিতে ডেবে যেতে লাগল, ফলে তারা ইস্রায়েলীদের নাগাল পেল না, এতে তাদের মনে হতাশা জাগল। ইতিমধ্যে সাগরের পানি দু’দিক থেকে এসে তাদের রথ ও অশ্বরূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করল, তাতে ফেরাউন ও তার যে সকল সৈন্য ইস্রায়েলীদের পশ্চাতে সমুদ্রে প্রবিষ্ট হয়েছিল তাদের একজনও অবশিষ্ট রইল না। 

এদিকে ফেরাউন যখন ডুবে যেতে লাগলেন তখন তিনি ভীত হয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে বললেন, ‘আমি ঈমান আনলাম, আর কোন মাবুদ নেই সেই আল্লাহ ছাড়া- যার উপরে বনি ইস্রায়েলী বিশ্বাসী -আমিও তাদের শামিল- যারা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’

আল্লাহ বান্দার তওবা ততক্ষণ পর্যন্তই কবুল করে থাকেন যতক্ষণ না মৃত্যুর উর্দ্ধশ্বাস আরম্ভ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রাণ হরণের নিমিত্তে ফেরেস্তা সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়। এসময়টি ঐ বান্দার জন্যে আখেরাতের হুকুম-আহকাম শুরু হবার মূহূর্ত। কাজেই সে সময়কার কোন আমল (ঈমান বা কূফর) গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং আল্লাহ তাকে অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘এখন এ কথা বলছ! অথচ তুমি ইতিপূর্বে নাফরমানী করছিলে এবং পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভূক্ত ছিলে। অতএব এখন আমি তোমাকে টিকিয়ে রাখব তোমার লাশের মাধ্যমে, যেন তুমি নিদর্শণ হতে পার তাদের জন্যে-যারা তোমার পরে আসবে। তবে নিশ্চয়ই মানবজাতির অনেকেই আমার নিদর্শণাবলী সম্পর্কে গাফেল।’

ফেরাউন রামেসিস ২য়, মমী।
এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ-‘ফেরাউন তাদের ধাওয়া করছিল নিজের লোক লস্করসহ এবং সমুদ্র্র তাদের ঢেকে ফেলল।’(২০:৭৮) তাদের জন্যে ক্রন্দন করেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।(৪০:২৯)

‘আমি পার করে নিলাম বনি-ইস্রায়েলীকে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে। ফেরাউন ও তার লোকলস্কর তাদেরকে ধাওয়া করছিল- বিদ্রোহ ও আক্রোশ বশতঃ শেষপর্যন্ত যখন সে ডুবে যেতে বসল, বলল; আমি ঈমান আনলাম আর কোন মাবুদ নেই সেই আল্লাহ ছাড়া- যাঁর উপরে বনি ইস্রায়েলী বিশ্বাসী -আমিও তাদের শামিল-যারা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’

আল্লাহ বললেন, ‘কি? তুমি বিদ্রোহ করেছ, নীতিভ্রষ্টতার কারণ হয়েছ। এখন আমি তোমাকে টিকিয়ে রাখব তোমার লাশের মাধ্যমে। যেন তুমি নিদর্শণ হতে পার তাদের জন্যে-যারা তোমার পরে আসবে। তবে নিশ্চয়ই মানবজাতির অনেকেই আমার নিদর্শণাবলী সম্পর্কে গাফেল।’ (১০:৯০-৯২)

সমাধিক্ষেত্রে নেয়া হচ্ছে ফেরাউনের মমী।
কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফেরাউন ও তার সঙ্গীদের চরম পরিণতি-জাহান্নাম। আয়াতটি এই- ‘কেয়ামতের দিন (ফেরাউন) তার লোকজনের পুরোভাগে থেকে অগ্রসর হবে এবং দোজখে যাবার কালে তাদের নেতৃত্ব দেবে।’(১১:৯৮)

এভাবে ইস্রায়েলীরা নিরাপদে সমুদ্র পার হল। আর তারা দাসত্ব ও মৃত্যুর থেকে মুক্তি পেল। তাদের অধিকাংশ সমস্ত ঘটনার জন্যে আল্লাহর কাছে অন্তর ঢেলে কৃতজ্ঞতা জানাল।

ইস্রায়েলীদের এই মহা উদ্ধার সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- আমি অনুগ্রহ করেছিলাম মূসা ও হারুণের প্রতি। তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়কে উদ্ধার করেছি মহাসঙ্কট থেকে। আমি তাদেরকে সাহায্য করেছিলাম, ফলে তারাই ছিল বিজয়ী।(৩৭:১১৪-১১৬)

পানিতে ডুবে মরার পর ফেরাউনের লাশ পানির উপর ভেসে উঠল এবং ঢেউ তাকে বয়ে এনে কূলে তুলে দিল। অত:পর তার লাশ রাজকর্মচারীরা উদ্ধার করল এবং সেই লাশকে তারা মমী করে রাখল মিসরের লাকসর এলাকা থেকে নীলনদের সরাসরি ওপারে, থেবসের নেক্রোপলিশ কবরখানায়- লোকচক্ষুর অন্তরালে। বর্তমানে মমীটি সংরক্ষিত রয়েছে মিসরের যাদুঘরে, রাজকীয় মমীর কামরায়। এভাবে আল্লাহ হাজার হাজার বৎসর পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে ফেরাউনর লাশ প্রদর্শনীর জন্যে রাখলেন যেন তারা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

সমাপ্ত।

ছবি: Wikipedia, whc.unesco, unionoffaiths, biblebelievers, bible.ca.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Moses: কোরাণিক ক্যানভাসে নবী মূসা।

Abu Hena Mostafa Kamal  01 May, 2017 মি সরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ফেরাউন। হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তরাধিকারী ন...